1 of 2

মামূর্তের দানব-দেবতা

মামূর্তের দানব-দেবতা

সাহারা মরুভূমির ওপর তখন পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল।

পৃথিবীর সমস্ত বিশাল সৌন্দর্যই মানুষের মনকে আকর্ষণ করে। পর্বতের মধ্যে যেমন হিমালয়, সমুদ্রের মধ্যে যেমন প্রশান্ত মহাসাগর, মরুভূমির মধ্যেও তেমনি এই সাহারা। ছেলেবেলা থেকেই সাহারাকে দেখবার জন্যে মনের ভেতর থেকে একটা প্রবল ইচ্ছার সাড়া পেতুম। তাই ইউরোপ থেকে ফেরবার সময় সাহারার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আমরা দুই বন্ধুতে।

বালুকার এই মহাসাগরে সারাদিন কাটিয়ে বেশ বুঝতে পেরেছি, গরম কড়ায় ফেলে ভাজবার সময় কই মাছের অবস্থা হয় কীরকম! সারাক্ষণ তাঁবুর ভেতরে আধমরার মতন পড়ে ছিলুম। এখন সন্ধ্যার পরে তাঁবুর বাইরে এসে দেখি, পরিপূর্ণ পূর্ণিমার হাসি সমস্ত মরুভূমিকে একটা অনন্ত মায়া-রাজ্য করে তুলেছে!

চাঁদের আলো আর মরুভূমি আজ যেন একাকার হয়ে মিশে গেছে। এখন এই মরুভূমিকে দেখলে কে বলতে পারবে যে খানিক আগে এইখানেই ছিল নরকের এক বিরাট অগ্নিকুণ্ড!

আমরা আছি একটা ‘ওয়েসিসে’-র ভেতরে। সকলেই জানেন বোধ হয়, ‘ওয়েসিস’ হচ্ছে অসীম, শুষ্ক ধূধূ বালুকাপ্রান্তরের ভেতরে ছোট্ট একটি তরুশ্যামল জায়গা। হয়তো পঞ্চাশ, ষাট, এক-শো কী আরও বেশি মাইল পথ পার হওয়ার পরে মরুভূমির মধ্যে এইরকম এক-একটা ‘ওয়েসিস’ পাওয়া যায়। এখানে থাকে তালজাতীয় গাছের কুঞ্জছায়া এবং মরুভূমির মধ্যে সবচেয়ে যা দুর্লভ, সেই শীতল জলের মিষ্ট ধারা। তবে সব ‘ওয়েসিস’ যে জল পাওয়া যায় তাও নয়। আমাদের এই ‘ওয়েসিসে’ পাতাল থেকে একটি জলের উৎস উঠে মনোরম এক সরোবরের সৃষ্টি করেছে। কাজেই মরুপথের সমস্ত যাত্রী এখানে বিশ্রাম না-করে বিদায় নেয় না।

সুন্দর মরু উদ্যানের ধারে আমরা দুজনে চুপ করে বসে আছি এবং সরোবরের জলে জ্যোৎস্নার রূপালি সারি ঝিলমিল করে উঠছে। আর-এক দিকে যতদূর চোখ চলে দেখা যায় আকাশের মতন অসীম অবাধ বালুকার রাজ্য।

আচম্বিতে মনে হল, সেই জনহীন মরুভূমির রহস্য ভেদ করে যেন একটা মানুষের চলন্ত ছায়া ফুটে উঠল! ছায়াটা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে এবং এগিয়ে আসতে আসতে মাঝে মাঝে যেন মাটির ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে!

আমরাও অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলুম। হ্যাঁ, মানুষই বটে! কিন্তু কী তার চেহারা! মানুষের এমন শ্রান্ত, শুষ্ক ও শীর্ণ আকার আমরা কখনো দেখিনি! হয়তো এই ভয়াবহ মরুভূমিতে পথ হারিয়ে পানাহারের অভাবেই এর এমন দশা হয়েছে!

আগন্তুক আমাদের কাছে এসে আর দাঁড়াতে পারলে না। টলতে টলতে মাটির ওপরে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। তারপর অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বললে, ‘জল!’

দুজনে ধরাধরি করে তাকে তুলে তাঁবুর ভেতরে নিয়ে এলুম এবং তার ঠোঁটের কাছে ধরলুম ঠান্ডা জলের গেলাস। আগন্তুকের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফালা-ফালা হয়ে গেছে এবং তার হাঁটুর ওপরে ও করতলে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন— বোধ হয় চলতে না-পেরে বালির ওপরে হামাগুড়ি দিয়ে আসার দরুনই তার হাত ও হাঁটু ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। আগন্তুকের অবস্থা দেখে বেশ বোঝা গেল, পৃথিবীতে তার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে।

আরও এক গেলাস জলপান করে আমাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে সে দুর্বল স্বরে বললে, ‘হ্যাঁ, আমি একলাই এসেছি। আমি? আমি হচ্ছি একজন প্রত্নতাত্ত্বিক, অর্থাৎ মাটি খুঁড়ে অতীত গৌরবের সমাধি আবিষ্কার করাই হচ্ছে আমার ব্যাবসায়।… কিন্তু আজ বেশ বুঝতে পারছি, এ কাজে হাত না দিলেই আমি ভালো করতুম। অতীতের গুপ্তকথা আবিষ্কারের চেষ্টা সবসময়ে নিরাপদ নয়। অতীতকে বর্তমানে টেনে আনতে গিয়েই আজ আমি এই বিপদে পড়েছি।’

আমাদের দুজনের চোখে-মুখে বিস্ময়ের আভাস দেখে আগন্তুক আবার বললে, ‘আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। আমি এখনও পাগল হইনি। আচ্ছা, আমার ইতিহাস আপনারা শুনুন, সব কথাই আমি খুলে বলব। কিন্তু তার আগেই আমার আর একটা কথা আপনাদের স্মরণ রাখতে বলছি। ভুলেও কোনোদিন ইগিডি মরুভূমিতে যাবেন না! আমাকেও আগে একজন এমনি সাবধান করে দিয়েছিল, কিন্তু তবু আমি সাবধান হইনি। অবাধ্য হয়ে আমি গিয়েছিলুম নরকে— হ্যাঁ মশাই, নরকে!… এখন গোড়া থেকেই সমস্ত শুনুন :

আমার নাম— থাক, আমার নামে কোনো দরকার নেই। এক বছর আগে অ্যাটলাস পাহাড়ের তলা দিয়ে আমি মরুভূমির ভেতরে এসে পড়েছিলুম। আমার ইচ্ছা ছিল, উত্তর-আফ্রিকার মরুভূমির ভেতরে প্রাচীন কার্থেজ শহরের কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করব।

সেই চেষ্টায় আমি মাসের-পর-মাস কাটিয়ে দিয়েছি। কখনো অজানা আরবপল্লিতে, কখনো কোনো ‘ওয়েসিস’-র ছায়ায় এবং কখনো জনশূন্য, অপরিচিত মরুভূমির ভেতরে আমার দিনের-পর-দিন কেটে গিয়েছে। এখানে-সেখানে প্রাচীন দুর্গ ও মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ভেতরে প্রাচীন কার্থেজের পূর্ব গৌরবের অনেক নিদর্শনই আমি খুঁজে পেয়েছি। তারপর একদিন এমন একটি জিনিস আমার চোখে পড়ল যার ফলে আর ইগডি মরুভূমিতে না-গিয়ে থাকতে পারলুম না।

একটি হাজার হাজার বছর আগেকার ভাঙা মন্দিরের গায়ে পাথরের ওপরে এই কথাগুলি খোদা ছিল :

বণিকগণ, তোমরা কেউ মামূর্ত শহরে যেও না। পর্বতের গিরিসঙ্কট পার হয়ে ওই শহরে যাওয়া যায়। আমি কার্থেজের এক ব্যাবসায়ী, চারজন সঙ্গীর সঙ্গে না জেনে আমিও ওই শহরে গিয়ে পড়েছিলুম। তারপর ওই শহরের দুষ্ট পুরোহিতরা আমাদের বন্দি করে। ওখানে এক রাক্ষস-দেবতা বা দানব আছে, পুরোহিতরা তার জন্যে এমন এক বিরাট ও বিস্ময়কর মন্দির তৈরি করে দিয়েছে, যার তুলনা ত্রিভুবনে নেই। মামূর্ত শহরের দানব-দেবতার সামনে নিয়ে গিয়ে পুরোহিতরা আমার সঙ্গীদের বলি দেয় এবং আমি কোনোরকমে তাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছি। পাছে আবার কোনো হতভাগ্য ওই শহরে গিয়ে বিপদে পড়ে, সেইজন্যে সকলকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি। মন্দিরের দুষ্ট দেবতা, সৃষ্টি-প্রভাত থেকে যে সেখানে বিরাজ করছে, সাবধান— তাকে সাবধান!

বুঝতেই পারছেন, হাজার হাজার বছরের পুরোনো এই সাবধান-বাণী আমার মনের ওপরে কী অপূর্ব কাজই করলে! এত বড়ো একটা অতুলনীয় মন্দিরের কথা আমি কোনো কেতাবেই পড়িনি এবং কোনো লোকের মুখেই শুনিনি। ইগিডি মরুভূমির ভেতরে মামূর্ত নামে যে একটি প্রাচীন শহর ছিল বা আছে— একথাও আজ কেউ আর জানে না। রোমের দুর্দ্ধর্ষ সৈন্যদের কবলে পড়ে বিপুল সভ্যতার লীলাক্ষেত্র কার্থেজ আজ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার স্মৃতির শেষ ধ্বংসাবশেষে এসে আজ যা আবিষ্কার করলুম, তার সত্যতা পরীক্ষা করবার জন্যে আমার সারা প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠল।

কাছেই একটা ছোটো আরব-পল্লি ছিল। সেখানে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েও বিশেষ কিছু নতুন কথা জানতে পারলুম না। কেবল বুড়ো আরবদের মুখ থেকে অনেক কষ্টে সংগ্রহ করা গেল, কোন পথ দিয়ে ইগিডি মরুভূমিতে যাওয়া যায়।

কিন্তু আরবরা যে এর চেয়েও বেশি কিছু জানে— এ সন্দেহ আমার এখনও যায়নি। কারণ আমার সঙ্গী হওয়ার জন্যে তাদের অনেককেই অনুরোধ করেছিলুম। কিন্তু অনেক টাকার লোভ দেখিয়েও তাদের কারুকে রাজি করাতে পারিনি। প্রথমটা তারা রাজি হয়েছিল। কিন্তু যেই শুনলে গিরিসঙ্কট পার হয়ে আমি ইগিডি মরুভূমিতে যাব, অমনি তারা সবাই একেবারে বেঁকে বসল। বললে, গিরিসঙ্কটের ওপারে তারা কেউ কখনো যায়নি, মরুভূমির পথঘাটের খোঁজ তারা রাখে না ইত্যাদি। কোনো কোনো বুড়ো আরবের মুখে শুনলুম, ইগিডি মরুভূমিতে নাকি মানুষের যাওয়া উচিত নয়, কারণ সেখানে ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব বাস করে!

তাদের কুসংস্কার টলানো অসম্ভব দেখে আমি একলাই ইগিডি মরুভূমিতে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলুম। তারপর দুটো উটের পিঠে আমার মোটমাট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে তিনদিন পথ হেঁটে গিরিসঙ্কটের কাছে গিয়ে হাজির হলুম।

গিরিসঙ্কটের পথ অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। সেই সরু শুঁড়িপথটা বড়ো বড়ো পাথরে এমন আচ্ছন্ন হয়ে আছে যে তার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হওয়া একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার! পথের দু-ধারে উঁচু পাহাড়ের দেওয়াল আকাশের দিকে উঠে গিয়ে আলো আসবার উপায় প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সেই ছায়াময়, রহস্যময়, নির্জন ও নিস্তব্ধ গিরিসঙ্কট ভেদ করে আমি যখন ওধারে গিয়ে দাঁড়ালুম, তখন বিপুল বিস্ময়ে আমার মন অভিভূত হয়ে গেল। সীমাহীন এক মরুভূমি চারিধার থেকে বিপুল এক পুকুরের পাড়ের মতন পাতালের দিকে নেমে গিয়েছে। এবং আমার কাছ থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে যেখানে চারিদিকের ঢালু জায়গা এসে মিশেছে, সেইখানে প্রাচীন মামূর্ত শহরের শ্বেতবর্ণ ধ্বংসাবশেষ সূর্যালোকে তুষার-পর্বতের সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে!

খানিকক্ষণ পরে আবার অগ্রসর হলুম সেই ধ্বংসাবশেষের দিকে। এ যেন মূর্তিমান বিরাট অতীতের দিকে বর্তমানের ক্ষুদ্র মানবশিশুর অভাবিত তীর্থযাত্রা! যতই এগিয়ে যাচ্ছি ধ্বংসাবশেষ ততই মস্ত হয়ে উঠছে। কোথাও একটা ভাঙা দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও কতকগুলো থামের সারি এবং কোথাও-বা ইট-পাথরের প্রকাণ্ড স্তূপ! অনেক জায়গায় বালির রাশির ভেতরে ধ্বংসাবশিষ্ট বাড়ি-ঘর একেবারে চাপা পড়ে গিয়েছে।

তারপর আমি আর একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলুম। কোথাও দেওয়ালের পাথরের ওপরে, কোথাও থামের ওপরে এবং কোথাও-বা সিঁড়ির ধাপের ওপরে কিম্ভূতকিমাকার এক জানোয়ারের মূর্তি খোদা আছে। জানোয়ারটাকে দেখতে অনেকটা অক্টোপাসের মতন; যদিও তা অক্টোপাসের মূর্তি নয়। তার দেহ গোল ও বেঢপ এবং দেহের তলা দিয়ে মাকড়সার পায়ের মতন কতকগুলো অদ্ভুত পা বা লকলকে শুঁড় বেরিয়ে আছে। চারদিকেই এই বেয়াড়া মূর্তির ছড়াছড়ি কেন? এ কি কোনো পবিত্র চিহ্ন, না আর কিছু? কিছুই বুঝতে না-পেরে শেষটা বোঝবার চেষ্টা ছেড়ে দিলুম।

এবং এই শহরের হেঁয়ালিটাই বা বুঝব কেমন করে? আমি একলা। এত বড়ো একটা ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করবার মতন যন্ত্রপাতিও সঙ্গে করে আনিনি এবং বেশিদিন এখানে থাকতেও পারব না। খাবার ও জল ফুরোলেই আমাকে এখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ধ্বংসাবশেষের মাঝখানে একটা খোলা জায়গায় আমার উট দুটোকে নিয়ে গিয়ে সেদিনের মতন তাঁবু খাটিয়ে ফেললুম।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে। সেই বিজনতার রাজ্যে মানুষের হাসির স্বর বা পাখির ডাক কিংবা কোনো কীটপতঙ্গেরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অন্ধকার ও স্তব্ধতা যেন নীরব নির্ঝরের মতো চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে ঝরে পড়তে লাগল! তারই মাঝখানে মিটমিট করে জ্বলছে কেবল আমার লন্ঠনের আলো— যেন কোনো ভীরু, কম্পমান ও অসহায় জীবের মতো!

কাল সকালে উঠে কী করব তাই ভাবছি, হঠাৎ একটা অস্ফুট অস্পষ্ট শব্দ শুনে চমকে উঠলুম! কারণ, জানবার জন্যে ফিরে তাকিয়েই আমি যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলুম। বলেছি, আমি তাঁবু গেড়েছি, একটা খোলা জায়গার মাঝখানে, সমতল বালুকাপ্রান্তরের ওপরে। লন্ঠনের আলোতে স্পষ্ট দেখলুম, বালুকার ওপরে হঠাৎ একটা গর্ত জেগে উঠল! যদিও অসম্ভব, তবু আমার মনে হল, শূন্যলোক থেকে যেন একটা আশ্চর্য গর্ত বালির ওপরে খসে পড়ল!

এখানে কোনোদিকে কোথাও জীবনের চিহ্নও দেখা যায় না— একটা ছায়া পর্যন্ত নয়! তবু আমার চোখের সামনে কোন অদৃশ্য হস্ত এই গর্তটা খুঁড়লে? খালি তাই নয়, কেমন একটা খড়মড় শব্দও আমার কানে এল। তারপরেই আমার আরও কাছে আবার তেমনি একটা গর্ত জেগে উঠল! বালুকা-সমুদ্র যেন বুদবুদ কাটছে! ভয়ে বুকটা ছমছম করতে লাগল।

আমার উনুনে আগুন জ্বলছিল। তার ভেতর থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে আমি দ্বিতীয় গর্তটার দিকে সজোরে নিক্ষেপ করলুম। আবার কীরকম একটা শব্দ শুনলুম এবং সঙ্গে-সঙ্গে এও বুঝলুম যে শব্দটা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে! শরীরী বা অশরীরী যে-কেউ এই দুটো গর্ত খুঁড়ে থাকুক, এখন আর সে আমার কাছে নেই— এই ভেবে একটা আশস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলুম।

কিন্তু এই অদ্ভুত রহস্য আমাকে আর শান্তিতে থাকতে দিলে না। ঘুমিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারলুম না, চতুর্দিক থেকে এই মৃত শহরের যত প্রাচীন, জীর্ণ দুঃস্বপ্ন এসে আমাকে বারংবার আক্রমণ করতে লাগল। বহু যুগ আগে এখানে যেসব মহাপাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে তাদেরই আকারহীন আত্মা যেন ভীষণ সব আকারহীন আকার ধারণ করে আমার সুমুখে দেখা দিয়েই আবার হাওয়ার মতো মিলিয়ে যেতে লাগল! দৃষ্টিহীন ক্রুদ্ধ চক্ষু, পদহীন চলন্ত দেহ, মুণ্ডহীন জীবন্ত মূর্তি!… প্রায় সারা রাতটাই অনিদ্রায় কেটে গেল।

পূর্ব আকাশে উষার তুলি যখন সিঁদুর ছবি আঁকতে শুরু করলে, আমার মনের ভয়ের ভাবটা তখন আর রইল না।

তারপর সূর্যের জ্বলন্ত মুখ দেখে কালকের সব দুশ্চিন্তাই আমি একেবারে ভুলে গেলুম। আঁধার রাতের শেষে সূর্যের সোনার আলো নিয়ে আসে নতুন আশার ডালা। এইজন্যেই বোধ হয় পৃথিবীর সব দেশেরই আদিম অধিবাসীরা সূর্যের উপাসনা করত।

আমার দেহে আবার নতুন সাহস ও শক্তি ফিরে এল। সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়ে গেল প্রাচীন কার্থেজের সেই মৃত ব্যবসায়ীর কথা। এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বিরাট ও বিস্ময়কর মন্দিরের চিহ্ন হয়তো এখনও বিদ্যমান আছে। সে মন্দিরে ছিল কোনো এক বিরাট দানব-দেবতার পূজার বেদি, যার সামনে হত নরবলি। কিন্তু কোথায় সে মন্দির বা তার ধ্বংসাবশেষ?

কাছেই একটা ছোট্ট পাহাড় ছিল। তারই চূড়ায় উঠে চারদিকে তাকিয়ে দেখলুম। কার্থেজের ব্যাবসায়ী বলেছেন, সে মন্দির নাকি আকারে বিরাট। এতদিনে অত বড়ো একটা মন্দির যদি ভেঙে পড়েই থাকে, তাহলে তার ধ্বংসস্তূপ তো কম প্রকাণ্ড হবে না! কিন্তু চতুর্দিকে তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও তেমন কোনো ধ্বংসস্তূপ আমার নজরে পড়ল না।

তবে আর একটা চিন্তাকর্ষক দৃশ্য আমার চোখে পড়ল বটে। অনেক দূরে পূর্বদিকে প্রদীপ্ত সূর্যের সমুজ্জ্বল আলোকপটের ওপরে সুদীর্ঘ ও প্রকাণ্ড দুটি প্রস্তর-মূর্তি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এত বড়ো ও উঁচু পাথরের মূর্তি বড়ো একটা দেখা যায় না। পিছন দিক থেকে প্রভাতের সূর্য তাদের আরও মহিমময় ও গম্ভীর ভাবপূর্ণ করে তুলেছে। এই নতুন আবিষ্কার আমার মনে উত্তেজনার স্রোত বইয়ে দিলে। তখনি তাঁবু তুলে সেই দিকে অগ্রসর হলুম। ধ্বংসাবশেষ পার হয়ে সেই মূর্তি দুটোর কাছে গিয়ে পৌঁছোতে আমার অনেকটা সময় গেল। ধ্বংসাবশেষের দিকে আড়ষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম মূর্তি দুটোর গলা থেকে পা পর্যন্ত মানুষের মতন দেখতে এবং তাদের সমস্ত দেহ মাছের আঁশের মতন একরকম বর্ম দিয়ে ঢাকা। কিন্তু তাদের মুখ! তাদের মুখ একেবারে অমানুষিক! মানুষের মুখের সঙ্গে একটুও মেলে না! জীবন্ত দেহ দেখেই কি এই মূর্তি দুটো গড়া হয়েছিল! তা যদি হয়ে থাকে, তবে এমন অদ্ভুত জীবন্ত দেহ আধুনিক পৃথিবীর কোনো মানুষই কখনো দেখেনি।

চারদিকে তাকিয়ে দেখলুম, মূর্তি দুটোর দু-পাশে সুদীর্ঘ দুই সারি ভগ্নস্তূপ অনেক দূরে চলে গিয়েছে। এই ভগ্নস্তূপ নিশ্চয়ই কোনো উচ্চ প্রাচীরের। কিন্তু মূর্তি দুটোর পরস্পরের মাঝখানে ওরকম কোনো ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ল না। খুব সম্ভব এই মূর্তি দুটোর মাঝখানে এক সময়ে কোনো তোরণ বা দ্বারপথ ছিল। কিন্তু একটা বিষয় ভেবে বিস্মিত হলুম। সারা শহর ভেঙে পড়েছে, এমন কঠিন পাথরের প্রাচীরও ভেঙে পড়েছে, কিন্তু এই ভয়াবহ ও অপার্থিব মূর্তি দুটো আজও সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে বর্তমান আছে কেন? মনের ভেতর থেকে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়ার আগেই আর একটা ব্যাপার লক্ষ করলুম। মূর্তি দুটোর পিছন থেকে ছোটো ছোটো পাথরের মূর্তির দুটো সারি প্রায় এক মাইল দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সেই মূর্তি-বীথিকার মধ্যে প্রবেশ করবার সময়ে দেখলুম, বড়ো মূর্তি দুটোর বেদির পাশেও সেইরকম বিরাট অক্টোপাস বা মাকড়সার চেহারা খোদা রয়েছে। পথের দু-পাশে সারি সারি এই যে ছোটো ছোটো মূর্তি রয়েছে, এগুলোও যে কোন জীবজন্তুর মূর্তি তা বোঝবার ক্ষমতা আমার নেই। এমন সব জন্তু পৃথিবীতে কোনোদিন ছিল বা আছে বলে আমি জানি না। ভয়াল তাদের চেহারা এবং প্রত্যেকেরই মুখে হিংসা ও অমঙ্গলের ভাব ফুটে উঠেছে। তাদের দেখলেই বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে।

দুই সারির সর্বশেষ মূর্তি দুটোর কাছে গিয়ে যখন দাঁড়ালুম, তখন সামনের দিকে তাকিয়ে মরুভূমির ধূধূ বালুকারাশির পাণ্ডুর প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। মনে কেমন বাঁধা লাগল। এই সুদর্ঘ মূর্তি-বীতির সার্থকতা কী? মরুভূমির শূন্যতার ভেতরে এসে অকারণেই এই মূর্তির সারি শেষ হয়েছে কেন?

কিন্তু ঠিক আমার সুমুখেই মরুভূমির যে অংশটুকু রয়েছে, তার মধ্যে একটি অদ্ভুত বিশেষত্ব লক্ষ করলুম। প্রায় বিঘা কয়েক জমি বিলিতি মাটিতে বাঁধানো উঠানের মতন একেবারে মসৃণ ও সমতল। অথচ এই অংশটুকুর বাইরে মরুভূমির সমস্তটাই এবড়ো-খেবড়ো বালির রাশিতে ভরা এবং সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে উঁচু-নীচু বালিয়াড়ির স্তূপ। সেখানে সর্বদাই প্রবল বাতাসে হুহু করে বালি উড়ছে, অথচ এই সমতল অংশটার মধ্যে বাতাসের কোনো প্রভাবই নেই!

বিস্মিতভাবে সেই সমতল অংশটার দিকে অগ্রসর হলুম। কিন্তু কয়েক পা এগুতে-না-এগুতেই কোনো অদৃশ্য হস্ত আমার মুখে ও বুকে আচমকা এত জোরে আঘাত করলে যে, যাতনায় ককিয়ে উঠে তখনি আমি ভূমিতলে ছিটকে পড়ে গেলুম! খানিকক্ষণ আচ্ছন্নের মতন বালির ওপরে শুয়ে রইলুম। তারপর আমার সমস্ত কৌতূহল পরিপূর্ণ মাত্রায় জেগে উঠল। এ কী ব্যাপার? কেউ কোথাও নেই, তবু কে আমাকে এমনভাবে ধাক্কা মারলে? উঠে বসে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে, ডান হাতে রিভলভার তুলে অতি সাবধানে আবার আমি ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলুম।

যখন সেই সমতল অংশের ধারে গিয়ে উপস্থিত হলুম, তখন আমার হাতের রিভলভারটা হঠাৎ কীসের ওপরে পড়ে ঠক করে বেজে উঠল! রিভলভারটা ঠিক যেন কোনো পাঁচিলের ওপরে গিয়ে পড়েছে, অথচ সেখানে পাঁচিল-টাচিল কিছুই নেই! বাঁ-হাত বাড়িয়েও আবার সেই নিরেট ও অদৃশ্য বাধাটাকে অনুভব করলুম এবং সঙ্গে-সঙ্গে সচমকে তীরের মতো দাঁড়িয়ে উঠলুম।

দুই হাত দুই দিকে বিস্তৃত ও সমস্ত দেহ দিয়ে অনুভব করে বেশ বুঝলুম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক আশ্চর্য অদৃশ্য দেওয়াল!… খানিকক্ষণ অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম। অতীতে এই মৃত শহরে হয়তো এমন কোনো বৈজ্ঞানিক জন্মেছিলেন, যিনি নিরেট পদার্থকে অদৃশ্য করে তোলবার কোনো অজানা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। অবশ্য, এটা একেবারে অসম্ভবও বলা যায় না। কারণ আমাদের আধুনিক বৈজ্ঞানিকরাও ‘এক্স-রে’-র সাহায্যে দৃশ্যমান পদার্থকে অনেকটা অদৃশ্য করতে পারেন। অতীতের বৈজ্ঞানিকরা এই পদ্ধতিতে হয়তো আরও বেশি দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। সবিস্ময়ে ভাবতে লাগলুম, কিন্তু কেমন করে তারা এটা করলে? শহরের বড়ো বড়ো পাথরের বাড়িগুলো কাল প্রভাবে ধুলোর সঙ্গে ধুলো হয়ে মিশিয়ে গেছে, অথচ এই অদৃশ্য দেওয়াল এখনও ঠিক আগেকার মতোই অটুট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি ঢিলের-পর-ঢিল ছুড়তে লাগলুম। কিন্তু যত জোরে যত উঁচুতেই ছুড়ি, সব ঢিলই কীসে ঠেকে আবার ঠিকরে ফিরে আসে! বোঝা গেল পাঁচিলটা অনেক ওপরে— আমার ঢিলের সীমানার বাইরে উঠে গিয়েছে। পাঁচিলের ওপাশে যাওয়ার জন্যে প্রাণটা আনচান করতে লাগল। কিন্তু কেমন করে যাব? ওধারে যাওয়ার নিশ্চয়ই কোনো পথ আছে, কিন্তু সে কোথায়? তখন মনে পড়ল, সেই দুই প্রকাণ্ড ও বীভৎস প্রস্তর মূর্তি এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত দীর্ঘ মূর্তি-বথির কথা। আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি মূর্তি-বীথির পাশের দিকে, কিন্তু যেখানে সেই মূর্তি-বীথি শেষ হয়েছে ঠিক সেইখান দিয়ে এগুবার চেষ্টা করলে হয়তো আমার চেষ্টা বিফল হবে না।

সমস্ত ব্যাপারটা একবার তলিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম। মরুভূমির সেই মণ্ডলাকার সমতল অংশ ও সেই বিপুল ও অদৃশ্য প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার মনে পড়ল, বিলুপ্ত কার্থেজের অজ্ঞাত ব্যাবসায়ীর সাবধান বাণী— ‘বণিকগণ, তোমরা কেউ মামূর্ত শহরে যেও না!’ হয়তো এইটেই হচ্ছে ব্যাবসায়ীর কথিত সেই বিরাট বিস্ময়কর মন্দির! হয়তো এই মন্দিরের ভেতরেই কোনো দানব দেবতার সামনে অতীতের কোনো এক ভুলে-যাওয়া দিনে ব্যাবসায়ীর চারজন অভাগা সঙ্গীকে বলি দেওয়া হয়েছিল! মৃত শহরের ওপার থেকে কোনো এক দৈববাণী যেন মৌন ভাষায় আমাকে ডাকতে লাগল— ‘ফিরে এসো, ফিরে এসো, ওই ভীষণ নরক থেকে এখনই পালিয়ে এসো!’

কিন্তু আমি ফিরে এলুম না, ফিরে আসতে পারলুম না! কোনো কঠিন নিয়তি যেন আমাকে টেনে সেই মূর্তি-বীথির শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে ফেললে এবং সেইখানেই আমি সেই অদৃশ্য প্রাচীরের অদৃশ্য দ্বার-পথের সন্ধান পেলুম।

সেই দ্বারপথ কতটা উঁচু বুঝতে পারলুম না বটে, কিন্তু চওড়ায় সেটা প্রায় বিশ ফুটের কম হবে না। একদিকের অদৃশ্য দেওয়ালের গায়ে হাত দিয়ে আমি অগ্রসর হতে লাগলুম।

খানিক পরেই গিয়ে পৌঁছোলুম একটা মস্তবড়ো অদৃশ্য উঠানের ওপরে। সে এক পরম বিস্ময়! আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার চতুর্দিকে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দেওয়াল, স্তম্ভের শ্রেণি ও ঘর-দ্বার রয়েছে; কিন্তু সমস্তই অদৃশ্য! সেই কাচের চেয়ে স্বচ্ছ, অদৃশ্য বাড়ির দেওয়ালের-পর-দেওয়াল ভেদ করে আমার দৃষ্টি বাইরের অপার মরুভূমির ভেতরে গিয়ে পড়েছে এবং বাইরে থেকে সূর্যের সুবর্ণ কিরণ এই বিপুল প্রাসাদের ভেতরে এসে সর্বত্র বিচরণ করছে। খুব সন্তর্পণে ধীরে ধীরে আরও খানিকটা এগিয়েই বুঝতে পারলুম, আমি এক বিস্তৃত সোপান শ্রেণির সামনে এসে পড়েছি! আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে ওপরে উঠতে লাগলুম। যতই ওপরে উঠি মনটা ততই অদ্ভুতভাবে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কারণ আমি যেন শূন্যে পদক্ষেপ করে বাতসের ভেতর দিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছি! ধাপের-পর-ধাপ যেন আর শেষ হতে চায় না। কেবলই মনে হয় ওপর থেকে কখন হঠাৎ হুড়মুড় করে পৃথিবীর ওপরে গিয়ে পড়ব! শেষটা, সিঁড়ি যখন শেষ হল, আমি তখন মাটি থেকে প্রায় এক-শো ফুট ওপরে একটা বারান্দার মতন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।

সেখানে গিয়ে আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলতে ভরসা হল না। হামাগুড়ি দিয়ে প্রত্যেক ইঞ্চি পরীক্ষা করতে করতে এগিয়ে চললুম এবং একটু পরেই আবার পাঁচিল ও তার গায়ে একটা দরজা আবিষ্কার করলুম। দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। কিন্তু তার ভেতরে ঢুকতে গিয়েই কেমন একটা অজানা আতঙ্ক এসে আমার মনের ওপরে ধাক্কা মারলে। যেন এখানে দুষ্ট ও হিংস্র আত্মা বাস করে অনন্ত কাল ধরে! আমি কিছুই দেখলুম না, কিছুই শুনলুম না, তবু মনে হল যেন কোনো প্রাচীন অভিশাপ যুগ-যুগান্তর ধরে এখানে বাস করে আসছে! যেন কত নির্যাতিত দেহের যন্ত্রণা এখানে ক্রন্দন করছে নিশিদিন, নীরবে! ঘরের ভেতরে সাহস করে ঢুকতে পারলুম না, মনটাকে হালকা করবার জন্যে আবার সেই অদৃশ্য বারান্দার ধারে গিয়ে দাঁড়ালুম।

সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে গিয়ে পড়েছে। তাকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন একটা অগ্নিতপ্ত লোহার রক্ত গোলকের মতো। সেই সুবৃহৎ ও সুদীর্ঘ প্রস্তর-মূর্তি দুটো মরু বালুর ওপরে লম্বা দুটো ছায়া ফেলে স্থিরভাবে বসে বসে যেন মহাকালকে ব্যঙ্গ করছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনের পটে অতীতের এক স্মৃতির ছবি আঁকতে লাগলুম

এই মেঘচুম্বী, অদৃশ্য ও বিরাট দেবালয়ের সামনে ওই বিপুল ধ্বংসাবশেষ যেন আবার তাদের গত জীবনকে ফিরে পেলে! চারদিকে প্রাসাদের-পর-প্রাসাদের ভিড়, প্রশস্ত রাজপথের-পর-রাজপথ জনাকীর্ণ হয়ে কত দূরে চলে গিয়েছে। তুরী, ভেরী ও দামামার তালে তালে পূজারীর দল দুই প্রস্তর-মূর্তির তোরণের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসছে কয়েক জন হতভাগ্য বন্দিকে সঙ্গে করে— তাদের দানব-দেবতার অতৃপ্ত উদর পূরণের জন্যে!

আচম্বিতে অনেক নীচে বালুকারাশির দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। বালির ভেতরে ঠিক তেমনি— যেন শূন্য থেকে খসে পড়া একটা গর্ত। তারপরে আমার সচকিত দৃষ্টির সামনে বালির ওপরে ক্রমাগত গর্তের-পর-গর্ত জেগে উঠতে লাগল। গর্তের রেখা মন্দির পর্যন্ত এসে পড়ল, তারপর আর কিছু দেখা গেল না।

ধাঁ করে আমার মনে পড়ে গেল, ধ্বংসাবশেষের পাথরে পাথরে খোদা সেই খানিক অক্টোপাস ও খানিক মাকড়সার মতন জীবের মূর্তির কথা! সেই মূর্তির সঙ্গে এই অদৃশ্য বিপদের কোনো সম্পর্ক আছে কি? এই অদৃশ্য বিপদের আকারও কি তেমনি বীভৎস? কার্থেজের ব্যবসায়ী বলেছে— ‘মন্দিরের দুষ্ট দেবতা, সৃষ্টি-প্রভাত থেকে যে যেখানে বিরাজ করছে, সাবধান— তাকে সাবধান!’ সৃষ্টির আদিম প্রভাতে পৃথিবীতে অনেক অতিকায় দানব বাস করত, পণ্ডিতেরা মাটির ভেতর থেকে আজও যাদের কঙ্কাল আবিষ্কার করেছেন। ওই মৃত শহরের বিলুপ্ত বাসিন্দারা কি সেইরকম কোনো দানবকেই তাদের দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল? এবং বিজ্ঞানের কৌশলে এই মন্দিরের মতন তাদের দানব-দেবতাকেও কি অদৃশ্য, অমর ও অজর করে রেখেছে? বালির ওপরে ওই গর্তগুলো কি সেই অদৃশ্য দানবেরই বিপুল পদচিহ্ন? আর এরই ভয়ে কি আরবরা আমার সঙ্গী হতে রাজি হয়নি?

মনের ভেতরে যখন ঝড়ের মতো এমনি প্রশ্নের-পর-প্রশ্ন আসতে লাগল, তখন হঠাৎ আমার স্মরণ হল, সেই অদৃশ্য দানব মন্দিরের দিকে এসেছে এবং এতক্ষণে হয়তো এই অদৃশ্য মন্দিরেই প্রবেশ করেছে! এই সন্দেহ মনে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আমার দেহের সমস্ত আড়ষ্টতা ঘুচে গেল, আমি যথাসম্ভব দ্রুতপদে সিঁড়ির ওপর দিয়ে নীচে নেমে গেলুম। আমি জানি, যে-পথ দিয়ে আমি এখানে ঢুকেছি সেই পথ দিয়েই সে আমাকে ধরতে আসছে! কিন্তু কোথায় আমি লুকোব? কাচের চেয়েও স্বচ্ছ, অদৃশ্য এই মন্দির, এর মধ্যে লুকোবার ঠাঁই খুঁজে পাব কেমন করে?

এমন সময়ে একটা শব্দ কানে এল— থপ, থপ, থপ, থপ! মৃত্যুর অদৃশ্য দূত যে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করেছে— সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই! জানি না এ কোন জাতীয় দানব জীব এবং এর মস্তিষ্কে বুদ্ধি আছে কত কম বা কত বেশি! জানি না সে আমাকে দেখতে পেয়েছে কি না। সিঁড়ির পাশে এক কোণে হুমড়ি খেয়ে জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে আমি বসে রইলুম এবং সেই অবস্থায় থেকে শুনতে পেলুম থপথপ-থপথপ করে সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে কে ওপরে উঠে যাচ্ছে!

সেই ভয়ঙ্কর পায়ের শব্দ যখন থেমে গেল, তখন আন্দাজ করে নিলুম, যে-ঘরে ঢুকতে আমি ভয়ে পেয়েছিলুম জীবটা সেই ঘরের ভেতরেই গিয়ে ঢুকেছে! আমিও আর দেরি করলুম না, উঠানের ওপর দিয়ে দ্রুতপদে ছুটতে লাগলুম। কিন্তু হঠাৎ ভুল দিকে গিয়ে একটা অদৃশ্য দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার আগেকার মতো ছিটকে মাটির ওপরে পড়ে গেলুম। এবারে গুরুতর আঘাত লেগেছিল, কিন্তু তবু প্রাণপণে আমার যন্ত্রণার চিৎকারকে দমন করলুম।

ওপর থেকে আবার শব্দ এল— থপ, থপ, থপ, থপ! বিভীষিকা দানব-দেবতা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে!

পাগলের মতন উঠে আবার একদিকে ছুটে গেলুম অন্ধের মতো এবং আবার এক দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়লুম!

আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে রইলুম। পায়ের শব্দ আর শোনা গেল না। আরও খানিকক্ষণ সেই অবস্থায় অপেক্ষা করলুম এবং তখনও কোনোরকম শব্দ না-পেয়ে আশান্বিত হয়ে আমি উঠে দাঁড়ালুম ও দুই পা অগ্রসর হতেই একেবারে সেই দানবের কবলে গিয়ে পড়লুম সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারেই! সেই অদৃশ্য দানবটা কখন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে একেবারে আমার কাছে এসেই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল— রোমশ, ঠান্ডা ও পিচ্ছল শুঁড়ের মতন কী-একটা জিনিসের ওপরে আমার হাত গিয়ে পড়ল। তারপরেই সেটা আমার হাতের কাছ থেকে সরে গেল এবং সঙ্গে-সঙ্গেই সেইরকম আরও তিন-চারটে শুঁড়ের মতন জিনিস আমাকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করলে! কিন্তু ঘৃণায় ও আতঙ্কে শিউরে উঠে তাদের কবল থেকে সজোরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আমি আবার ছুটতে ছুটতে মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলুম। ওপরে উঠে আমি স্থির করলুম, বারান্দা থেকে এক-শো ফুট নীচে যদি লাফিয়ে পড়ি, তাহলেও এই ঘৃণ্য দানবের কবলে পড়ে মরার চেয়ে সে মৃত্যু হবে ঢের বেশি সুখের মরণ!

সিঁড়ির ওপরে আবার পায়ের শব্দ হতে লাগল— থপ, থপ, থপ, থপ! দানব ওপরে আসছে!

সিঁড়ির ঠিক মুখেই দু-হাতে বারান্দার প্রাচীর চেপে ধরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলুম। আচম্বিতে সেই প্রাচীরটা দুলে আমার দিকে হেলে পড়ল! নিশ্চয় এর ভিত আলগা হয়ে গিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি প্রবল একটা ধাক্কা মেরে সেটাকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে দিলুম। প্রাচীরটা হুড়মুড় করে সিঁড়ির ওপর ভেঙে পড়ল! একমুহূর্ত সমস্ত স্তব্ধ। তারপরেই শুনলুম, যেন লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝি পোকা, কালো ব্যাং ও গোখরো সাপ একসঙ্গে গর্জন শুরু করে দিলে! সঙ্গে-সঙ্গে দেখলুম একটা হলদে রঙের তরল পদার্থ সিঁড়ির ওপর দিয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে! প্রাচীরের ভাঙা অংশটা তাহলে ওই দানবেরই ঘাড়ের ওপরে গিয়ে পড়েছে এবং ওই হলদে তরল পদার্থটা খুব সম্ভব তারই দেহের রক্ত! তার দেহ অদৃশ্য, কিন্তু রক্ত দৃশ্যমান!

তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে সেই রক্ত দেখে আন্দাজে লক্ষ্য স্থির করে আমি উপরিউপরি কয়েক বার গুলি-বৃষ্টি করলুম। দানবটার চিৎকারে কান যেন ফেটে যাওয়ার মতো হল এবং সঙ্গে-সঙ্গে বেশ দেখতে পেলুম রক্তের ধারার ওপরে তার অদৃশ্য দেহের ছটফটানি!

আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলুম, কিন্তু সেই অদৃশ্য জীবটার চিৎকার ও ছটফটানি তখনও একটুও কমল না। পাথরের স্তূপের তলায় সে বন্দি হয়েছে ও রিভলভারের গুলিতে আহত হয়েছে বটে, তবু তার মৃত্যু হল না!

এদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার এমন ঘনিয়ে উঠল যে আর এখানে অপেক্ষা করাও চলে না। এই সৃষ্টিছাড়া, অভিশপ্ত অদৃশ্য মন্দিরের ভেতরে অন্ধকারে রাত্রিবাসের কথা মনে করতেই আমার বুক কেঁপে উঠল। কে জানে এখানে এরকম আরও কত বিভীষিকাই হয়তো আছে! কে বলতে পারে ওইরকম দানব-দেবতাও এখানে আরও অনেক নেই?

রাত্রের অন্ধকারের কথা ভেবে মন আমার মরিয়া হয়ে উঠল। যেমন করেই হোক ওই সিঁড়ি দিয়েই এখনি আমাকে নেমে যেতে হবে!

আগেই বলেছি, এই অদৃশ্য সোপান-শ্রেণি খুব বিস্তৃত। একসঙ্গে অনেক লোক এর ওপর দিয়ে পাশাপাশি ওঠা-নামা করতে পারে। সিঁড়ির যেখান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল আমি তার বিপরীত দিকে গিয়ে দ্রুতপদে নীচের দিকে নামতে লাগলুম। সেই বন্দি ও আহত দানব মহা আক্রোশে আরও জোরে গর্জন করে উঠল, কিন্তু আমাকে সে ধরতে পারলে না!

প্রায় অন্ধকারে পথ খুঁজে বার করে কোনোরকমে তাঁবুর কাছে এসে হাজির হলুম। তারপর আলো জ্বেলে যে দৃশ্য দেখলুম তাতে আমার প্রাণটা স্তম্ভিত হয়ে গেল!

তাঁবুর ঠিক পাশেই বালুর ওপরে আমার উট দুটোর মৃতদেহ চর্মমাত্রসার হয়ে পড়ে রয়েছে! তাদের দেহে হাড় ও চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। চামড়ার ওপরে কতকগুলো ক্ষতচিহ্ন দেখে বুঝলুম, অনেকগুলো শুঁড় দিয়ে কোনো ভয়ানক জীব যেন চামড়ার তলা থেকে তাদের সমস্ত রক্তমাংস শুষে খেয়ে ফেলেছে! কী নিষ্ঠুর মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার পেয়েছি, সে-কথা মনে করে আমার সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল!

তারপর কী অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে যে এই সুদীর্ঘ পথ পার হয়ে এসেছি, তা কেবল আমিই জানি আর জানেন আমার ভগবান! আমার খাবার ফুরিয়ে গেল, জল ফুরিয়ে গেল, দেহের শক্তিও ফুরিয়ে গেল; তবু আমি সেই মৃত্যুপুরী থেকে দূরে— আরও দূরে পালিয়ে এসেছি, কখনো মাতালের মতন টলতে টলতে, কখনো অসহায় শিশুর মতন হামাগুড়ি দিতে দিতে!

আমি যা স্বচক্ষে দেখেছি, পৃথিবীর আর কোনো মানুষ কোনোদিন যেন তা দেখতে না-চায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *