মাপা হাসি চাপা কান্না
সব কেমন যেন শুকনো হয়ে যাচ্ছে। ভাব, ভালোবাসা, হাসি-কান্না।
জীবন যেন শুকনো পাঁউরুটি। টিভির পরদায় গানের অনুষ্ঠান। যিনি গাইছেন তাঁর না হয় দমের কাজ। গলনালি ঠেলে উঠছে। উঠতেই পারে। সুর সমেত বাণী ওগরাচ্ছেন। বেশ কষ্টের ব্যাপার। চোখ উলটে যেতে পারে। মুখ বিকৃত হতে পারে; কিন্তু যাঁরা সঙ্গত করছেন, তাঁদের অবস্থা দেখলে কষ্ট হয়। গোবদা মুখ যেন মাস্টারমশাই ধমকে হাতের লেখা করতে বসিয়েছেন। আজকাল আবার খুরখুরে তবলা হয়েছে। তবলচি যেন নাতির মাথায় চাঁটি মারছেন। বল ব্যাটা, অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, আ-এ আমটি আমি খাব পেড়ে।
সেকালে গানের সঙ্গে বাজনা হত। একালে বাজনার সঙ্গে গান হয়। গাইয়ে একজন বাজিয়ে ষোলো জন। নোটেশানের যুগ। গিটার একচরণ বাজিয়ে ছেড়ে দিলে, বেহালা গজখানেক কান্না নামিয়ে এলিয়ে পড়ল। সেতারে তিন টুসকি বাঁশিতে তিন ফুঁ। ষোলোজনের ঝাড়ফুঁক। আজকাল আবার ঘুরে ফিরে গান গাইবার রীতি। হাতে মাইক্রোফেন। বিশাল ন্যাজের মতো মোটা তার গাইয়ের পেছন-পেছন লটরপটর করছে। তিনি শরীর দুলিয়ে-দুলিয়ে এক আধ চরণ কৃপা করছেন। আজকাল বাণীও মারাত্মক :
রেখো না, আমার হাতে হাত
খামচে দোব।
চোখে চোখ রেখো না চোখ দেখাব।
তোমাতে আমাতে জুতোতে জামাতে
কাছাতে কোঁচাতে
জড়িয়ে যাব (ইকো : যাব-যাব যাব-)
হা:।
সবক’টা যন্তর মাঝরাতের চতুষ্পদ প্রহরীর মতো আর্তনাদ ছাড়বে। না, প্রাণের কোনও প্রকাশ নেই। শুকনো শব্দ।
‘তুমি কোথায়?’ গেয়ে গাইয়ে সরে পড়লেন। যন্ত্রীরা পাঁচ মিনিট খ্যাঁচোর ম্যাঁচোর করলেন। গাইয়ে তার মধ্যে পান কিনলেন, সিগারেট ধরালেন। ধীরে সুস্থে আসরে এলেন। গিটারের গিটকিরি তখনও চলছে। আরও দুবার পান চিবিয়ে গায়ক ছাড়লেন। ‘আমি হেথায়।’ তারপর খুব দ্রুত, ‘এসো না, এসো না, এসো না, কাছে এসো, এসো কাছে, দূরে কেন না’ ব্যাস আবার পাঁচ মিনিটের ছুটি। যন্ত্রের লাঠালাঠি চলুক। দু-মাত্রায় তাল কাটার ভয় নেই। প্যারেডের ছন্দ, ডান বাঁ, ডান বাঁ, গান এখন গণিত। ভাবের ব্যাপার নেই। সোয়েটার বোনা উলটে সোজা সোজা উলটো। মীড়, গমক, মূর্ছনা, বিস্তার, বিলম্ব, প্রলম্ব, সেকালের বস্তু।
মাটান রোল, ফিশফ্রাই
ইডলি ধোসা
চিকেন ড্রাই।
‘কী চাই! বাবু বাড়ি নেই। দরজা খুলেই দু-রাউন্ড। দরজা বন্ধ। প্রস্থান। সোনারপুর থেকে তেতেপুড়ে সোনা গিয়েছিল সোদপুরে বন্ধু বিমলের সঙ্গে দেখা করতে। পত্রপাঠ বিদায়। আচ্ছা, দূর থেকে এসেছেন, খানিক বসুন। এক গেলাস জল খান। বাঙালির সেই সব আতিথেয়তা আর নেই।
‘আরে বসুন, বসুন, এক কাপ চা খেয়ে যান।’ সাহস করে কেউ হয় তো বা বললেন। বলেই, অন্দরমহলের দিকে এমন মুখে তাকাবেন, যেন কেউ শিশুটিকে বলেছেন, ‘ওই লে জুজু আসছে।’
বাইরের ঘরে বসে বসেই শোনা যাবে, ‘হ্যাঁ গা, এক কাপ চা হবে?’
‘চা আ। এই সময় চা আ আ।’
ভেতর থেকে একটা বেড়াল ছুটে বাইরে চলে এল। ভয়ে ন্যাজ গুটিয়ে গেছে। তিনটে চড়াই উড়ে গেল ভেন্টিলেটার থেকে। অতিথি গৃহস্বামীর লজ্জা ঢাকতে পায়ের জুতো হাতে করে চোরের মতো গুটি-গুটি রাস্তায় বেরিয়ে এসে, মার ছুট।
দুজনে দেখা দীর্ঘদিন পরে। কথা হচ্ছে।
অমরনাথ ঘুরে এলুম।’
‘হে হে, খুব ভালো।’
‘মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিলুম।’
‘হে হে, খুব ভালো।’
‘ছেলেটা বিলেত গেল।’
‘হে হে, খুব ভালো।’
‘মা হঠাৎ মারা গেলেন।’
‘হে হে খুব ভালো।’
সবই ভালো। আজকাল কেউ কারুর কথা মন দিয়ে শোনে না। ভদ্রতার খাতিরে হে হে করে যায়। যান্ত্রিক হাসি। যান্ত্রিক বিস্ময়।
মেয়েরা যদি বা প্রাণখুলে হাসেন, ছেলেদের হাসি যেন শুকনো ছাতু। আবার মেয়েদের বিস্ময় ও সহানুভূতি প্রকাশের ঘনঘটায় প্রাণ আছে কিনা বোঝা দায়।
‘শ্যামা ডিভোর্স করেছে।’
‘ওমা, তাই না কি, বলিস কি?’
‘রমাদির ছেলে এবারেও পাশ করতে পারেনি।’
‘ওমা, তাই না কি, বলিস কি?’
‘শ্যামলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
ওমা, তাই না কি, বলিস কি?’
মাঝরাতে স্বামী বললে, ‘গোপা, বুকে অসহ্য ব্যথা। আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি।’
‘ওমা, তাই না কি, বলো কি?’
ভোরবেলা ‘মেকানিক্যাল টি’। ‘ওঠো চা।’
কে উঠবে! ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল আর এল না। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী শুনে বলবেন, ‘ওমা, তাই না কি! মারা গেছে। দাঁড়াও, ডালে জল ঢেলে এসে শুনছি।’
EKDOM THIK