মান বাঙলা ভাষা : সাধু ও চলতি
পৃথিবীতে বহু ভাষা আছে। তবে সব ভাষা সমান উন্নত নয়; সব ভাষার শক্তি সমান নয়। ভাষার মূল কাজ সমাজের মানুষের যোগাযোগে সাহায্য করা। সব ভাষাই এ-কাজটি চমৎকারভাবে করে। ধরা যাক একটি আঞ্চলিক ভাষার কথা। ভাষাটি ব্যবহৃত হয় দেশের একটি ছোটো এলাকায়। ওই এলাকার মানুষেরা ভাষাটি ব্যবহার ক’রে স্বচ্ছন্দে জীবন চালায়। কিন্তু ভাষাটি তার চেয়ে বেশি কিছু পারে না। তাতে কোনো কবিতা লেখা হয় না, রচিত হয় না উপন্যাস। তাতে জ্ঞানের কোনো কথাই লিখিত হয় না। ওই ভাষার শব্দের সংখ্যা খুব কম। তাতে আধুনিক জীবনের জন্যে দরকারি সব কাজ সম্পন্ন করা যায় না। তাই ওই ভাষাটি অনুন্নত, অবিকশিত। ভাষাটির বিকাশ ঘটানো যেতো, সাধন করা যেতো উন্নতি; কিন্তু নানা কারণে তা হয় নি।
কিন্তু পৃথিবীর বেশ কিছু ভাষার ঘটেছে বিপুল উন্নতি। সেগুলোর সাহায্যে সামাজিক যোগাযোগ খুব চমৎকার সম্পন্ন তো হয়ই; তার ওপরও সম্পন্ন হয় আরো বহু কাজ। এমন ভাষাকে বলা হয় ‘উন্নত’ বা ‘বিকশিত’ বা ‘মানসম্পন্ন’ ভাষা। আদিযুগে বা মধ্যযুগে বাঙলা ভাষা ছিলো একটি অবিকশিত বা অনুন্নত ভাষা। একটি ভাষা বলাও ঠিক নয়। বাঙলা ভাষা বলতে ছিলো একগুচ্ছ আঞ্চলিক ভাষা—দেশের একএক অঞ্চলে ছিলো তার একএক রূপ। সে-রূপগুলোর মধ্যে অবশ্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। ওই আঞ্চলিক ভাষাগুচ্ছে বা বাঙলা ভাষায় আদি ও মধ্য যুগে লেখা হয়েছে কিছু কবিতা ও কাব্য। তার বেশি কিছু হয় নি। তাই ওই সময়ে বাঙলা ভাষার বিকাশ ঘটেছে বেশ কম। জ্ঞানের কোনো শাখার প্রকাশ-মাধ্যমরূপেই ব্যবহৃত হয় নি বাঙলা ভাষা। তার ছিলো না এমন কোনো রূপ, যা ব্যবহৃত হতো সারা বাঙলা ভাষাঞ্চলে।
কোনো একটি ভাষার বিকাশ ঘটার জন্যে দরকার পড়ে ওই ভাষা যারা বলে, তাদের জাতীয় চেতনা। একটি জাতি যখন বোধ করে যে এ-ভাষাটি তাদের, তখন তারা বিকাশ ঘটাতে থাকে তাদের ভাষার। আর ওই জাতির যদি থাকে একটি নিজস্ব রাষ্ট্র, তাহলে তো ভাষার বিকাশ ঘটে খুব দ্রুত। কেননা রাষ্ট্রের জন্যে দরকার হয় এমন একটি ভাষা, যা দিয়ে পালন করা যায় রাষ্ট্রের দরকারি সব কাজ। মধ্য যুগে বাঙালির জাতীয় চেতনা আজকের মতো ছিলো না। কিন্তু তা দেখা দেয় ক্রমশ, এবং উনিশশতকে ওই চেতনা ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। বাঙলা ভাষারও বিকাশ ঘটতে থাকে। কোনো জাতি যখন একটি ভাষাকে আপন ভাষা ব’লে গ্রহণ করে, সম্পন্ন করতে চায় ওই ভাষার সাহায্যে সব ভাষিক কাজ, তখন দরকার পড়ে ভাষাটির একটি ‘মানরূপ’। মানরূপ, অর্থাৎ ভাষাটির এমন রূপ, যা সারা দেশে অভিন্ন। তা আঞ্চলিক নয়। তা সমগ্র দেশিক। আদিযুগে ও মধ্যযুগে বাঙলা ভাষার কোনো মানরূপ ছিলো না। তার এমন কোনো রূপ ছিলো না, যা ব্যবহৃত হতো বাঙলা ভাষাঞ্চলের সমগ্র এলাকায়। মানরূপ ছিলো না, কেননা আদি ও মধ্য যুগের বাঙালির দরকার হয় নি মানরূপের।
কোনো ভাষার মানরূপ সৃষ্টি করতে হ’লে দুটি দিকে মনোযোগ দিতে হয়। প্রথমে ভালোভাবে স্থির করতে হয় ভাষাটির অবয়ব বা শরীর। অর্থাৎ ভাষাটিতে কতোগুলো ধ্বনি আছে, তার প্রতিটি শব্দের রূপ আর বানান কী, প্রতিটি শব্দের অর্থ কী ইত্যাদি বিষয় স্থির ক’রে ফেলতে হয়। কেউ বলবে বা লিখবে ‘খাইছি’, কেউ ‘খেয়েছি’, তা চলবে না। সবকিছু হবে সুস্থিত। সুস্থির। অবশ্য চরমভাবে কোনো কোনো ভাষাই সুস্থির নয়া ভাষার রূপ স্থির হয়ে গেলে দেখতে হয় ভাষাটি কতোটা দায়িত্ব পালন করতে পারে। কোনো ভাষায় যদি শুধু আলাপই করা যায়, আর কিছু করা না যায়, তবে সেটা বিশেষ কাজের ভাষা নয়। ভাষা দিয়ে কবিতা লিখতে হবে, রচনা করতে হবে উপন্যাস। জ্ঞানের সমস্ত কিছু প্রকাশের উপযোগী হ’তে হবে ভাষাটিকে। তাকে দিয়ে ব্যবসা চালাতে হবে, রাজনীতি করতে হবে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের প্রয়োজন মেটাতে হবে ভাষাটিকে। যদি তা পারে, তখন বলবো যে ভাষাটি পালন করতে পারে বিভিন্ন ভূমিকা। কোনো ভাষার রূপ স্থির আর ভূমিকা বিশদ হ’লেই ভাষাটিকে ধরা হয় ‘উন্নত’, বা ‘বিকশিত’, বা ‘মানবদ্ধ’, বা ‘মানসম্পন্ন’, বা ‘মানভাষা’ ব’লে।
“চর্যাপদ”-এর কালে বাঙলা ভাষা ছিলো খুবই অবিকশিত। তার শব্দের রূপ স্থির হয় নি, ধ্বনিও অস্থির। জ্ঞানের কথা তখনো শোনে নি বাঙলা ভাষা। মধ্যযুগে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় বাঙলা ভাষা। সাহিত্য সৃষ্টি হয় বাঙলা ভাষায় বিপুল পরিমাণে। ধনাঢ্য হয়ে ওঠে বাঙলা শব্দভাণ্ডার। কিন্তু বাঙলা ভাষার রূপ তখনো অস্থিত। আঞ্চলিকতার ছোঁয়া তাতে বড়ো বেশি। তখনো সারা দেশের আঞ্চলিক ভাষারাশি ছেঁকে সৃষ্টি করা হয় নি কোনো সর্ববঙ্গীয় বাঙলা ভাষা। মানভাষা। কিন্তু মানভাষা সৃষ্টির অসচেতন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে তখন। সাধুভাষায় যে ‘করিল’, ‘করিতেছিল’, ‘হইল’, ‘হইবে’ প্রভৃতি ক্রিয়ার রূপ বসে, মধ্যযুগেই সে-রূপগুলো তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। ব্যবহৃত হ’তে শুরু করেছিলো ব্যাপকভাবে। দেখা দিয়েছিলো ‘তাহার’, ‘উহার’, ‘ইহার’ ইত্যাদি পরিপূর্ণ সর্বনামরূপ। কিন্তু আঠারো- শতকের শেষভাগ থেকে শুরু ক’রে উনিশশতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরে সৃষ্টি করা হয় বাঙলা ভাষার একটা মানরূপ। তার নাম সাধুভাষা বা সাধু বাঙলা ভাষা বা সাধুরীতি।
বাঙলা ভাষার একটি মানরূপের সন্ধান চলছিলো অনেক বছর। উনিশশতকে সেটি দেখা দেয় সাধুভাষার রূপ ধ’রে। কোনো ভাষার মানরূপের ভিত্তি হয়ে থাকে এমন একটি উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, যা প্রভাবশালী। হয়তো ওই উপভাষাটিতে অনেক দিন ধ’রে সাহিত্য রচিত হয়েছে, তাই তার বিকাশ ঘটেছে অন্যান্য উপভাষার চেয়ে ভালোভাবে। এমনও হ’তে পারে যে ভাষার মানরূপ সৃষ্টির সময় ওই উপভাষী ব্যক্তিরা পালন করেন বিশেষ ভূমিকা। অনেকের মতে বাঙলা সাধুভাষার ভিত্তিরূপে ব্যবহৃত হয়েছে নদিয়া-শান্তিপুর ও ভাগীরথীর উভয় কূলে প্রচলিত উপভাষাটি। কিন্তু সাধুভাষার সৃষ্টিকারীরা ওই উপভাষাটিকে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছিলেন এমন একটি মার্জিত বাঙলা ভাষারূপ, যা বিশেষ কোনো অঞ্চলের নয়। তাঁরা সংস্কৃত থেকে শব্দ ঋণ করেছেন অবিরলভাবে, তৈরি করেছেন নতুন শব্দ, বিকাশ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন রকম বাঙলা বাক্যের। ফলে জন্ম নিয়েছে বাঙলা ভাষার একটি মানরূপ। কেরি, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত এবং আরো অনেকের শ্রমে ক্রমবিকশিত হয় সাধুভাষা। তবে তাঁদের ভাষায় ছিলো কোনো-না-কোনো রকম অস্থিতি। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনায়, সীতার বনবাস-এ, সাধুরীতি লাভ করে স্থির মানরূপ। এর পর বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও আরো অনেকে সাধুরীতির বাঙলায় নিয়ে আসেন নানা বৈচিত্র্য। কিন্তু তার মূলকাঠামো বদলায় নি।
তাই উনিশশতকের মাঝামাঝি বাঙলা ভাষার মানরূপ সাধুভাষাই হয়ে ওঠে বাঙলা ভাষা। ওই ভাষা ছিলো সর্ববঙ্গীয়; বাঙলার সব অঞ্চলেই সাধুভাষার রূপ ছিলো অবিভিন্ন। কিন্তু সাধুভাষা ছিলো একটি বড়ো সীমাবদ্ধতা বা সমস্যা। সাধুভাষা লেখার ভাষা। বহু বই লেখা হয়েছে সাধুভাষায় বা সাধুরীতিতে; কিন্তু ওই ভাষায় কেউ কখনো, শুধু পাগল আর যাত্রাভিনেতারা ছাড়া, কথা বলে নি। তাই বাঙলার একটি মানভাষা জন্ম নেয়, লেখার কাজে খুব দক্ষতার পরিচয় দেয়, কিন্তু ব্যর্থ হয় একটি এলাকায়। সেটি হচ্ছে কথা বলার এলাকা। মানভাষা এমন হওয়া উচিত যাতে সম্পন্ন করা সম্ভব সব কিছু। তা হবে মুখের ভাষা, তা হবে লেখার ভাষা। যদি তা না হয়, তাহলেই সমস্যা দেখা দেয়। এক রীতির ভাষায় বই লিখবো, আর অন্য রীতির ভাষায় কথা বলবো, এটা এক ঝামেলা। বাঙলা সাধুভাষা আমাদের প্রতিদিনের জীবন ও তাপ থেকে চ’লে গিয়েছিলো অনেক দূরে। আবার যে-ভাষা ছিলো জীবনের, যাতে কথা বলা হতো, তাতে কিছু লেখা চলতো না। তাই একটি সমস্যা দেখা দেয়। এ-সমস্যার সমাধানরূপে জন্ম নেয় আরেকটি মান বাঙলা ভাষা। তার নাম চলতি ভাষা বা চলতি রীতি বা চলতি বাঙলা।
চলতি বাঙলার জন্মস্থানের নাম কলকাতা। উনিশশতকের বাঙলাদেশ ও ভাষার কেন্দ্র কলকাতা। মধ্যযুগে এক অঞ্চলের বাঙালি খুব কাছাকাছি আসে নি আরেক অঞ্চলের বাঙালির। তাই তাদের দরকার হয় নি এমন একটি কথ্য বাঙলা, যাতে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে সব এলাকার বাঙালি। উনিশশতকে বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালি শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসায় ও আরো সহস্র কারণে উপস্থিত হয় কল্লোলিনী কলকাতায়। তাদের দরকার হয় একটি কথ্য ভাষারীতি, যা সকলের। সাধুভাষা দিয়ে ওই কাজ সম্ভব ছিলো না। কেননা তা বোবা। তাদের দরকার হয় একটি মুখর ভাষা, যার নাম চলতি ভাষা। এক সময় বলা হতো চলিত ভাষা। রবীন্দ্রনাথ একে বলতেন প্রাকৃত বাঙলা।
চলতি বাঙলার জন্ম কলকাতায় হ’লেও তা কলকাতা শহরের উপভাষাভিত্তিক ছিলো না। যে-অঞ্চলের উপভাষা ভিত্তি ক’রে জন্ম হয়েছিলো সাধুভাষার, সে-অঞ্চলের উপভাষা ভিত্তি ক’রেই জন্ম নেয় চলতি ভাষা। নদিয়া, শান্তিপুর, ভাগীরথীর দু-কূলের ভাষা কলকাতা শহরে এসে আধুনিক বাঙালির প্রয়োজন মেটাতে হয়ে ওঠে চলতি ভাষা। চলতি ভাষা কথ্য ভাষা, মুখের ভাষা। তাতে শুধু কথা বলা হতো এক সময়। উনিশশতকের মাঝামাঝি বাঙলা ভাষার দেখা দেয় দুটি মানরূপ। একটি সাধুভাষা : লেখার ভাষা। অন্যটি চলতি ভাষা : কথার ভাষা। সাধু ও চলতি ভাষা দুই তপস্বী ছিলো না যে এক ছায়ার নিচে শান্তিতে ধ্যান করবে। তারা হয়ে ওঠে এক বাঙলা-রাজ্যে দুই রাজা। রাজাদের কাজ যুদ্ধ করা। উনিশতকের মাঝামাঝি বাঙলা ভাষার দুই রাজার, সাধু ও চলতির, যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের উত্তেজনা টিকে থাকে শতাব্দীব্যাপী। আজো তা পুরোপুরি থেমে যায় নি।
উনিশশতকের মাঝামাঝি সাধুরীতিটি তার রাজত্ব পেতে বসে মহাসমারোহে। তখন তার রূপ বেশ দৃঢ়ভাবে স্থির হয়ে গেছে। ভারিভারি শব্দে আর লম্বা লম্বা ক্রিয়ারূপে, উৎকলিকাকুল, অবয়বসংস্থানাদিকৃত, গমন, করিলেন, হরণ করিয়াছে, প্রযুক্ত, পুরঃসর প্রভৃতিতে, চমৎকারভাবে সেজেগুজে, বলা যাক সজ্জিত হয়ে, লাভ করেছে অনমনীয় রাজকীয় মহিমা। অর্থাৎ উনিশশতকের মধ্যভাগের সম্রাট সাধুরীতি। কিন্তু মুখেমুখে তখন জন্ম নিচ্ছিলো বিদ্রোহী চলতি রীতি। ওই সময়ে চলতি রীতিটি খুব স্থির রূপ পায় নি, কিন্তু রূপ পেয়েছে অনেকখানি। কিছুটা শক্তি আয় ক’রেই বিদ্রোহী চলতি রীতি বিদ্রোহ ঘোষণা ক’রে বসে সাধুরীতির বিরুদ্ধে, উনিশশতকের মাঝামাঝি। ওই বিদ্রোহের ইশতেহার প্রথম ঘোষিত হয়, দ্রোহের পতাকা প্রথম ওড়ানো হয় প্যারীচাঁদ মিত্রের এক অভূতপূর্ব গদ্যসৃষ্টি “আলালের ঘরে দুলাল”-এ। ১৮৫৮-তে। তখন চলতি রীতির জয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। কেননা তখনো তা শক্তি অর্জন করে নি, তার রূপ স্থির হয় নি। তবে তা নাড়া দেয় সাধুরীতির শেকড়সুদ্ধ। সাধুরীতি ক্রমেক্রমে আসতে থাকে চলতির কাছাকাছি, বড়োবড়ো শব্দ বিদায় নিতে থাকে সাধুরীতি থেকে। কিন্তু শরীরে বা রূপে সাধুরীতিই থেকে যায়। তার ক্রিয়ামাত্রই ‘করিয়াছিলেন’, ‘হইতেছিল’, সর্বনামমাত্রই ‘তাহার’, ‘তাহাকে’, ‘তাহাদিগকে’, ‘আমাদিগের’।
উনিশশতক ধ’রে মুখেমুখে, ও কিছুটা লেখায়, শক্তি, সৌষ্ঠব, মান আয়ত্ত করতে থাকে চলতি রীতিটি। এ-রীতিটির ছিলো একটি স্বাভাবিক সুবিধা। চলতি ভাষা মুখের ভাষা, চলতি ভাষা লেখার ভাষা। এটা নির্বাক নয়, এটা নিরক্ষর নয়। কথাও বলতে জানে, লিখতেও জানে। তাই তো তার মধ্যে লুকিয়ে ছিলো জয়ের বীজ। বিদ্রোহীরা কখনো পরাজিত হয় না। বিদ্রোহী চলতি রীতির জন্যেও অপেক্ষা ক’রে ছিলো অবধারিত জয়। বিশশতকের দ্বিতীয় দশকে, ১৯১৪ অব্দে, প্রমথ চৌধুরী দেখা দেন চলতি রীতির প্রবক্তারূপে। তিনি দাবি করেন যে বিদায় জানাতে হবে সাধুরীতিকে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে চলতি রীতিকে, কথা ও লেখায়, সব এলাকায়। তাঁর বিদ্রোহ আলোড়ন আনে বাঙলা ভাষারাজ্যে। এগিয়ে আসেন বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সন্তান ও পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি চলতি রীতিতে লিখেছিলেন এর আগেও। কিন্তু বেশি লেখেন নি। উনিশশো চোদ্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ চলতি রীতিকেই মেনে নেন বাঙলা ভাষারূপে। চলতি রীতি হয়ে ওঠে মানভাষা, বাঙলা ভাষা। এগিয়ে আসেন অন্যরা। ধীরেধীরে বিদায় নিতে থাকে সাধুরীতি।
এখন তো সাধুরীতি যাপন করছে মরণোত্তর জীবন। রবীন্দ্রনাথ সাধু- চলতির কলহকে ব্যাখ্যা করেছিলেন রূপকথার রূপকে। বাঙলা রূপকথায় এক রাজার দুই রানী, সুয়ো ও দুয়োরানীর ঝগড়া, খুব বিখ্যাত। রূপকথার শুরুতে সুয়োরানী রাজার প্রিয়তমা, তখন পীড়নে দুঃখে দিন কাটে দুয়োরানীর। রূপকথার শেষে দুয়োরানী হয়ে ওঠে প্রিয়তমা, বিদায় নেয় সুয়োরানী। রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে একদিন সুয়োরানী বিদায় নেবে, সিংহাসনে বসবে দুয়োরানী। তাঁর বাণী ফলে গেছে। বাঙলা ভাষার দুয়োরানী, চলতি রীতি, এখন সিংহাসনে। সাধুরীতি ঘুমিয়ে আছে রবীন্দ্রকথিত ‘ঐতিহাসিক কবরস্থানে’। তবে তার কবরস্থান অবহেলায় মলিন নয়। তা এখন তীর্থের মতো। এখন চলতি বাঙলাই মান বাঙলা ভাষা। বাঙলা ভাষা।
কোথায় বিরোধ সাধু আর চলতির? এক সময় মনে করা হতো যে তাদের বিরোধটা খুব বড়ো। সাধুরীতি হবে গুরুগম্ভীর শব্দে পরিপূর্ণ, তাতে শোনা যাবে সংস্কৃত গর্জন, লম্বালম্বা ক্রিয়ারূপের নিনাদ। তা হবে মুখের ভাষা থেকে খুবই দূরের। আর চলতি রীতি হবে সরল সোজা মুখের ভাষা, যাতে থাকবে না জটিল কোনো ভাব। অর্থাৎ এদের মধ্যে থাকবে দুস্তর দূ রত্ব। একটি জীবন থেকে দূরে থাকবে; প্রকাশ করা হবে তাতে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। অন্যটি হবে জীবনের ভাষা; কিন্তু তাতে সহজ সরল সাধারণ কথা ছাড়া কিছু বলা যাবে না। এমন দেয়াল টেকার কথা নয়। যতোই দিন যেতে থাকে, চলতি বাঙলায় প্রকাশ পেতে থাকে জীবনের সমস্ত কিছু। তাতে যেমন বলা যায় ‘কাছে এসো’, তেমনি বলা যায় ‘অসলংগ্ন ভাবচ্ছবির অনিকাম সংঘট্ট’। এখন সাধু-চলতির মধ্যে পার্থক্য সামান্য। আছে উচ্চারণে কিছুটা ভিন্নতা, আছে শব্দগত কিছুটা পার্থক্য, আছে বাক্যগঠনে প্রায়-ধরা-যায়-না এমন ভিন্নতা। সাধু-চলতির প্রধান পার্থক্য ক্রিয়ারূপে আর সর্বনামে। যাইব, খাইব, করিব, চলিব সাধু। যাবো, খাবো, করবো, চলবো চলতি। তাহাকে, তাহাদিগের, যাহা সাধু। তাকে, তাদের, যা চলতি। এখন সাধু-চলতির বড়ো ব্যবধান এখানেই। তবে সাধু আর নেই। চলতি রীতি শোষণ ক’রে নিয়েছে তার সব শক্তি। ক্রিয়ারূপ আর সর্বনামের রূপ ঠিক রেখে যাই বলা আর লেখা হোক, তাই চলতি ভাষা। সাধুরীতি আজ মৃত।