মান্না দে—একটি সংগীত প্রতিষ্ঠানের নাম
ছবি আঁকতে গেলে একটা ক্যানভাসের ওপর আঁকতে হয়৷ মান্নাদার ছবি যদি আঁকতে চাই সেই ক্যানভাসটা জানা দরকার৷ যা যুগোত্তীর্ণ, তাই classical৷ চিরদিন যা বেঁচে থাকে৷ যে-শিল্পী, সে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখে এসে সেই শাস্ত্রীয় প্রভাবটাকে নতুন নতুন রূপে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর নব শিল্পকলায়৷ এদিক থেকে দেখতে গেলে, আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথই আধুনিক সংগীতের জনক৷ Classical Music-কে নানান আঙ্গিকে ব্যবহার করে, তিনি তৈরি করেছেন কত অবিস্মরণীয় গান৷ আজ খুব দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা৷ এই যে globalis culture-এর প্রভাব আমাদের দেশে, তার উদ্দেশ্য বোধহয় আমাদের ঐতিহ্যকে শেষ করে দেওয়া৷ ইউরোপিয়ান বা ওয়েস্টার্ন যে Classical Music এবং ভারতীয় যে শাস্ত্রীয় সংগীত তার মেলবন্ধন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ পরবর্তীকালে আধুনিক গানে তার প্রভাব আমরা পেয়েছি৷ যে গান জীবনের সঙ্গে একদিন মিশেছিল, মানুষের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ককে সুষমা মণ্ডিত করেছিল, Classical music তারই ধারা ও ঐতিহ্যকে বহন করতে পারত৷ Globilised music সেখানেই করেছে আঘাত৷ একে ঠিক ইউরোপিয়ান মিউজিক বলা যায় না৷ এ অন্যরকম কিছু, যা জীবনকে বিপন্ন করে, সমৃদ্ধ করে না৷ এমন দুঃসময়ে এমন কেউ কেউ আছেন, যারা মূল্যবোধহীন জীবন থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছেন৷ তেমন এক মহান শিল্পী মান্না দে, তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে সেই ক্যানভাসের প্রসঙ্গ আসবেই৷ সেই ক্যানভাসটাকে না জানলে মান্না দে-র মানকেও বোধহয় সঠিকভাবে বোঝা যায় না৷ মান্না দে-র গানকে বুঝতে গেলে বোধহয় এই পটভূমিকাটা জানারও প্রয়োজন আছে৷ নইলে তাঁর গানের যে ঐতিহ্য, যে প্রকাশ, তা অনুভব করা যায় না৷ তিনি devalued culture থেকে সংগীতকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন৷ শাস্ত্রীয় সংগীত তো সমস্ত যুগকে পুষ্টি জোগায়৷ এই Heritage music-কে মান্না দে সঠিকভাবে শিখেছেন ও প্রয়োগ করেছেন যুগোপযোগী আধুনিক জীবনে৷ প্রকৃত সংগীতকে কীভাবে আধুনিকতার মোড়কে পরিবেশন করে সমৃদ্ধ করা যায়, গানে গানে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন৷ সংগীত গুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে ধ্রুপদ শিখেছেন তিনি৷ অতি যত্ন করে শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা করেছেন কত গুণী গুরুদের কাছে, তবু তিনি অনায়াসে গাইতে পারেন — ‘জীবনে কি পাবো না’ অথবা ‘পৃথিবী তাকিয়ে দ্যাখো’৷ কত সংগীত শিক্ষিত আধুনিক মনের মানুষ দেখুন মান্না দে৷ আমার সুরে ‘কে তুমি শুধুই ডাকো’ গানের যে চলন, শুরুতে যে সরগম আছে গানের রাগের সঙ্গে তার মিল নেই৷ একটা অনিয়মের সৌন্দর্য প্রয়োগ করতে চেয়েছিলাম৷ মান্না দে প্রকৃত যোদ্ধা, প্রখর তাঁর রসবোধ, কোনও Prejudice না রেখে এই গানটি তিনি যে কী অসাধারণ গেয়েছিলেন, সবাই জানেন৷ কিন্তু একবারও তার Puritan মন নিয়ে বলেননি, ও মশাই৷ এটা কি করলেন৷ গানটির রূপে অন্যরাগের প্রভাব আর এই শুরুর সরগম একেবারে অন্যরাগ৷ এটা কী করে হয়? আসলে তিনি তো জীবন পথিক তাই তার চিন্তায় রবীন্দ্রভাষার প্রতিফলন৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘হিন্দুস্তানি সংগীত ভাল ক’রে শিখলে তা থেকে আমরা লাভ না করে পারব না৷ তবে এ লাভটা হবে তখনই যখন আমরা তাদের দানটা যথার্থ আত্মসাৎ করে তাকে আপন রূপ দিতে পারব৷ তর্জমা করে বা ধার করে সত্যিকার সৃষ্টি হয় না; সাহিত্যেও নয়, সংগীতেও নয়৷… মানুষের মধ্যেই মিশেল আছে, বন মানুষের মধ্যে মিশেল নেই৷’ এ সত্য মান্না দে মেনেছেন তাঁর কর্মকাণ্ডে৷
এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে আসছে যেটার বিষয়টা প্রত্যক্ষভাবে মান্না দে না হলেও পরোক্ষ ভাবে মান্না দে-র প্রয়োগ প্রণালী, চিন্তা ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ আজকের যুগটার সব থেকে অসুস্থ মানসিকতা পূর্বসূরি ও উত্তরসূরি দুই প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্কের ও বোধের মিশেলটা ছানার জলেরভাব, তাকে ক্ষীর করতে না পারা৷ সম্পর্কের দুধ যেন টকে যাচ্ছে — সে ক্ষেত্রে মান্না দে-র শিল্পী ও সুরস্রষ্টা প্রকাশই সার্থক দাওয়াই৷ একটু পরিষ্কার করে বলি — রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা’৷ আর প্রখ্যাত সংগীত চিন্তাবিদ শ্রদ্ধেয় রাজেশ্বর মিত্র লিখছেন, কবি জয়দেব ‘গীত গোবিন্দ’ রচনার সময়েই শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিকাঠামো ভাঙবার চেষ্টা করেছেন কেবল ভাবের প্রয়োজনে৷ অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সংগীত হচ্ছে ঐতিহ্য, কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীত তো classical, আর classical তো যুগবদ্ধ বা সময়বদ্ধ হতে পারে না — তার থাকবে অনাদি চলমানতা৷ রবীন্দ্রনাথও বলছেন, ‘সংগীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে৷ সমাজের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করিতে পারে ও তাহার উপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়৷’ অর্থাৎ classical গানের চলমানতা ও সমাজের যুগের পটপরিবর্তনের একটা সামঞ্জস্য আছে৷ তাই নব নব নির্মাণ ও প্রকাশের মধ্যে এই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটানো চাই — যার model দৃষ্টান্ত মান্না দে-র সমগ্র সংগীত জীবন৷ আরো একটু কথা লিখতে হবে ২০১০ সালের সাংস্কৃতিক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে, ইউরোপীয় Symphony-র যে সুস্থতা, তা আজ যেভাবে বিপন্ন, নববিশ্বায়নের অবদান cacophony-র আক্রমণে এবং তার থেকে বাঁচাবার জন্যে সুস্থ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষের যে রক্ষণশীল প্রক্রিয়া — দুটো দুভাবে সংগীতের জীবনকেন্দ্রিক দায়বদ্ধতাকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে৷ অসুস্থ সংগীত সমাজকে অসুস্থ করছে, সংগীতকে শ্মশানে পাঠাচ্ছে — আর ঐতিহ্যবাহীরা রক্ষণশীলভাবে শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যাকরণ নিয়ে ওস্তাদি ও পণ্ডিততত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সংগীতের নন্দনবোধকে ধ্বংস করছে৷ আজকের এই দুর্দিনে মান্না দে-র সাংগীতিক কর্মকাণ্ড দিকদর্শী— তাই বর্তমানে মান্না দে-র গাওয়া ও সৃষ্ট সংগীতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে গবেষণা আশু প্রয়োজন৷
এ বিষয়ে আমি মান্না দে-র এক জন্মদিনে প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থে একটি ব্যঙ্গাত্মক ছোট্ট লেখা দিয়েছিলাম যা এখানে সংযোজিত করলাম৷ এতে শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুরাগী ও অনুগামীরা কিছুটা ধারণা করতে পারবেন যে শাস্ত্রীয় সংগীতে কতটা রস আছে৷ বড় দুঃখ হয় — পৃথিবীর সব থেকে Romantic Music Indian classical৷ আর তার রস বাদ দিয়ে কেবল রাগারাগি চলছে আর অনুরাগ মমতাজের মত শাজাহানের নবাবি সৌধ জৌলুষের নিচে অন্ধ কারাগারে কাঁদছে৷ তাজমহলের সৌন্দর্য দীপ্তি সম্রাটকে বাহবা দিচ্ছে আর প্রেমহীনতায় পর্যটকের তৃপ্তি মেটাচ্ছে৷ আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞদের অধিকাংশরাই জ্ঞানী ওস্তাদ বা পণ্ডিত বেশি কেউ প্রেমরসিক শিল্পী হতে চায় না৷ অনেক বেদনা নিয়ে তাই আমি এই রচনাটির শিরোনাম দিয়েছি— রাগাতঙ্ক৷
আমরা জলাতঙ্ক রোগের নাম শুনেছি কিন্তু আমরা চিকিৎসক নই৷ তাই তার ওষুধের নাম জানি না — যাঁরা জানেন তাঁরা সবাই চিকিৎসক৷ আমরা সুরের চিকিৎসক৷ ইদানীং একটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে আমাদের সংগীত সমাজে৷ রোগটির নাম রাগাতঙ্ক৷ জলাতঙ্ক রোগী জলকে ভয় পায় আর রাগাতঙ্ক গায়ক গায়িকা রাগকে হারানোর ভয় পায়৷ তাদের ভয়, এই বুঝি অনুরাগ এসে রাগকে বিভ্রান্ত করে৷ এই বুঝি অনুরাগের ছোঁওয়া ইমনের পর্দায় ইমনের সার্কাস ছেড়ে অভিমানে বলে ওঠে ‘ডেকো না আমারে ডেকো না’৷ অনেক গায়ক গায়িকা তাই জীবনের আন্তরিক কথা সংগীতে বলতে গিয়েও ভুলে যায় না বাঁ হাতটাকে নাড়িয়ে নাড়িয়ে রাগ রাগিণীর অস্তিত্বকে সচল রাখতে৷ তাদের সকল সময় ভয় শিল্প নন্দন তত্ত্ব এই বুঝি উড়িয়ে দিল ওস্তাদি বা পাণ্ডিত্যের শিরোপা৷ ঠিক আধুনিক কবিরা যেমন তাদের সব সময় ভয়— এই বুঝি তাদের বিদ্যাবান রূপ সহজগ্রাহ্য হয়ে তাদের মান নিম্নমুখী করে৷ আসলে এটাই একটা রোগ৷ ঐতিহ্য কখনও চলমানতায় অবিশ্বাসী হয় না৷ ঐতিহ্যের সার্থকতাই সময়ের গতিশীলতার গর্ভে৷ রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায়, তাজমহলের থেকে সৌন্দর্যের প্রেরণা নেবে — কিন্তু নিজের প্রেমিকাকে নিজের মতো করে সাজাবে, রবীন্দ্রনাথের গানের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে পেট থেকে রাগ রাগিণীকে বের করে আনতে হবে, কিশোর কুমারের স্থিতধী পর্দাকে সার্কাসের ট্রাপিজের রূপকল্পে সাজাতে হবে, এসব চেতনার কথা নয়৷ তাই এই রাগাতঙ্কের জন্যে আমি চিকিৎসক হিসাবে একটি ওষুধই নির্বাচন করে থাকি, যে ওধুষটার নাম ‘মান্না দে’৷ পুছনা ক্যায়সে, বাজে গো বীণার মধ্যে যে অনুভব ঝঙ্কৃত তা শুধু রাগ না একটা অনুভবকেই পুষ্টি জোগায়৷ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ romantic music৷ রবীন্দ্রনাথ বেহাগকে নিয়ে কেঁদেছেন৷ হেসেছেন৷ গান গেয়েছেন৷ ভালবেসেছেন৷ দেশসেবা করেছেন৷ দুঃখীর বুকে সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়েছেন৷ প্রেমিকের অন্তরে চিরদিনের জন্যে গেঁথে দিয়েছেন প্রেমিকার ছবি, যাতে প্রেমিক গাইতে পারে ‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম৷’ এই বোধ, এই শিক্ষায় এক শিল্পী যদি নিজেকে বোধিযুক্ত করতে চান, কেবল মান্নাদার গান গাওয়া নিয়ে গবেষণা করুন৷ ভাবুন কী করে একই শিল্পী বাঁ হাত না নাড়িয়ে গেয়েছেন ‘তালাশ’, আবার একদিন রাত্রে-তে ‘মাতালের গান’৷ কাবুলিওয়ালার ‘পস্তুগান’৷ আবার পপঘেঁষা, ‘জীবনে কি পাবো না’৷ স্যাটায়ার গানে তিনি সমস্ত পূর্বসূরিকে শুইয়ে দিয়েছেন অথচ তিনি ধ্রুপদ থেকে উঠে আসা শিল্পী৷ কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো সাংগীতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা ওস্তাদি ও পাণ্ডিত্যে সুদক্ষ কণ্ঠ শিল্পী কীরকম ১০০% নান্দনিক তা বুঝতে হয়৷ মান্না দে-র গান শুনে লিখতে লিখতে Emotional হয়ে যাচ্ছি৷ তাঁর সঙ্গে কাজ করতে করতে কতবার যে তাঁর ছাত্র হয়ে গেছি, তার ঠিক নেই৷ আমার পূর্বজন্মের বহু সৌভাগ্য যে আমি মান্নাদার এত কাছে আসতে পেরেছি৷ আমি ধন্য৷ আমি কৃতজ্ঞ৷ বুকের আন্তরিক প্রণাম দিয়ে আমি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে পূজা করি৷
প্রয়োগশিল্পের উৎকর্ষ পরিমাপ করার কোনও এককের যন্ত্র নেই৷ হৃদয়ের মিটার, বোধের স্পন্দন, কয়েক ফোঁটা অশ্রুই প্রয়োগশিল্পের সার্থকতাকে মর্মস্পর্শী করতে পারে৷ ‘সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান করো না’ গানটির দ্বিতীয় লাইনে ‘না বলো না’ প্রকাশের অভিব্যক্তি ও ‘না না যেও না, ও শেষ পাতা গো’ গানটির ‘চিহ্নটি তার রাখো’-র পর যখন ‘না যেও না’ ফিরে আসছে, তার প্রকাশ একই কণ্ঠস্বরের ভিন্ন অভিদ্যোতনা হয়, তখন ভাবি এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব, নিশ্চয় সম্ভব৷ যখন সেই আবেদন, অন্য মনে সঞ্চারিত করার গায়কি, অনির্বচনীয় বিশেষণে বিভূষিত শিল্পী, আমার জীবনের প্রণাম-বিগ্রহ মান্না দে হন৷ পাণ্ডিত্যের কারাগার থেকে রসদ সংগ্রহ করে নন্দন-সুষমার আবেগ সৃষ্টি করা সেই মহান জাদুকর, কারিগর মান্না দে হন৷
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কমলহীরের পাথরকেই বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার৷’ এই সাংগীতিক বিদ্যাকে সংস্কৃতি বোধের রসসমুদ্রে স্নাত করে যে মাধুরী, যে সুধা মান্নাদা আকণ্ঠ পান করিয়েছেন বিশ্বজনকে তা বচনীয় নয় — তা উচ্চারণে উচ্ছিষ্ট করা যায় না৷ এ শুধু ‘হৃদয়ে হৃদয় দিয়ে অনুভবে’র বিষয় — অনুক্ত সম্পদ৷
ভক্ত চায় সাজাতে তার বিগ্রহকে, কিন্তু কিছুতেই তার মন ভরে না৷ আমারও ভরবে না, ভরতে পারে না৷ তবু বলব, কিছু বলতে চেষ্টা করব৷ শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো পাহাড়-অস্তিত্ব থেকে যে ঝর্নার নির্যাস প্রবাহিত হয়ে প্লাবিত করেছে সমতল পর্যন্ত তা তো ঐতিহাসিক৷ সর্বজনশ্রদ্ধেয় কে সি দে গাইলেন গম্ভীর গর্জনে ধ্রুপদীজ্ঞান মার্গের নাদ-সমৃদ্ধি নিয়ে ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হ’তে কী সংগীত ভেসে আসে’ — বহু সময় অতিক্রান্ত করে সেই সমুদ্রকে একই গানে প্রণাম জানালেন মান্নাদা৷ কে সি দে যেন পর্বতচূড়ায় অধিষ্ঠিত সাগ্নিক ঋষি আর মান্না দে যেন প্রেমবিগলিত ভক্ত বৈষ্ণব৷ একই গান অথচ দুজনের কী ভিন্ন অভিব্যক্তি৷ অতীন্দ্রিয় রসবোধ না থাকলে এই বিদগ্ধ অভিদ্যোতনা অসম্ভব৷ আর যথার্থ রসবোধ থাকার কারণেই, রসবিভ্রাটের বিচ্যুতি মান্নাদার গায়নকে দূষিত করতে পারেনি৷ যে গান যেমন, সে গান তেমনই পরিবেশন৷ তাঁর ব্যক্তিজীবনেও এই রসবোধ বিধৃত৷ আমায় একদিন বললেন, ‘ও ময়াই (উনি মশাইটা এইভাবে উচ্চারণ করেন) বাজারে গিয়ে দেখি ভীষণ ভাল পমফ্রেট মাছ৷ বেশ কিছু কিনে নিয়ে এলাম৷ বাড়িতে এনে নিজেই কাটাকুটি করে, শসা, টমেটো সহযোগে পুর তৈরি করে একটি মাছের দুটি টুকরোর মধ্যে পুরটা দিয়ে, সুতো দিয়ে বেঁধে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিলাম, দু’ঘণ্টা বাদে ফ্রিজ থেকে বের করে, ভাল সর্ষের তেলে একটা করে ভেজে দিচ্ছে আর আমি খেয়ে যাচ্ছি’ — একটু চুপ থেকে মুচকি মুচকি হাসি হেসে বললেন, ‘সেদিন আর নো রাইস৷’ বুঝুন রসবোধ! একটি স্বাদের সঙ্গে অন্যটি মেলাবেন না৷ একবার একটা ছবির গান তোলাতে গিয়েছি, আমাদের কাজ সমাপ্ত৷ কিন্তু প্রবল বর্ষণে রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেছে৷ আমাদের আড্ডা জমে গেল, চলছে জোরকদমে৷ হঠাৎ বললেন, ‘ও ময়াই, আপনিতো খুব ট্রিকি নোটস ব্যবহার পছন্দ করেন, দেখুন তো বারোটা গজলের একটা এল পি করছি, কেমন লাগে?’ যত শুনছি মনে হচ্ছে এখানটা এরকম করলে বেশ হত— ওখানটা ওরকম করলে ভাল হত — কিন্তু যখন বারোটা গান সমাপ্ত হল, মনে হল পায়ে পড়ে যাই৷ কী অসাধারণ শিক্ষা ও তার প্রয়োগে পরিমিতি বোধ— একটা রসের সঙ্গে অন্য রসের মিশ্রণে তার আবেগকে বিবেকবিহীন কখনও হতে দেন না৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘Art-এ থামবার জায়গাটা অত্যন্ত জরুরি— Art is never an exibition but a revealation. অর্থাৎ শিল্প প্রদর্শনী নয়, প্রকাশ৷ অনেক জ্ঞান, অনেক পাণ্ডিত্য, অনেক ওস্তাদির শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়েও নন্দনবোধে দীক্ষিত মান্নাদা জানেন, কোন গানে কোথায় কতটা দিতে হবে আর কোথায় থামতে হবে৷ সেদিন একটি চ্যানেলে বলছিলেন, গানে বেশি শাস্ত্রীয় সংগীতের ছাপ ফেললেই শচীনদা (এস ডি বর্মন) বলতেন, কালোয়াতি করিস না৷ তিনি জানেন, শুরু, মধ্যিখান ও শেষের সঙ্গতি৷ জানেন, ‘পুছোনা ক্যায়নে’, ‘লাগা চুনারি মে দাগ’, ‘অ্যা মেরে প্যারে ওতন’ আর ‘জীবনে কি পাবো না’ কি ‘আও টুইস্ট করে’ কোন গানে কোথায়, কীভাবে তার প্রয়োগ ও প্রকাশে তাঁর ‘সাংগীতিক দক্ষতা’কে সঠিক দীক্ষিতের মতো সংযুক্ত করতে হবে, এ তাঁর যথার্থ বোধসমৃদ্ধ৷ তাঁর কোনও পরিবেশনই তাই আরোপিত নয়, আকাঙ্ক্ষিত৷ তাঁর অ্যাকাডেমিক শিক্ষা, সাংগীতিক দীক্ষা ও সংস্কৃতির নন্দনবোধ মিলেমিশে পূর্ণতা পেয়েছে৷ Fantastic equation of emotional laws and versatile skill.
চৈতন্যদেব বলেছেন, রবীন্দ্রনাথও ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে লিখেছেন, প্রেমই মানুষের মুক্তি৷ সেই প্রেমের বিচিত্র রস-বিন্যাসই মান্নাদার সমস্ত গানে নানা বিভূতিতে বিভূষিত৷ ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে ‘অ্যা মেরে প্যারে ওতন’ শুনলে বোঝা যায় ঘরমুখী মানুষের দীর্ঘ পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার কান্না ও পস্তু গানের দেশজ প্রেম দুটিই কেমন তাঁর ললিত কণ্ঠে মিশে এক বোধে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে৷ শ্রবণ ও মনন সহবাস করেছে৷ সলিলদাও এক ভিন্ন হৃদয়-দর্শন দিয়ে মান্নাদাকে আবিষ্কার করেছিলেন৷ তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘দো বিঘা জমিন’তে ‘ও ভাইরে মৌসম বিতা যায়’ গানে জমিহারা কৃষকের শহরমুখী জীবনে প্রবেশের যে বেদনা তাকে রূপায়িত করার জন্যে নির্বাচন করেন মান্নাদাকে৷ আবার রাজ কাপুরের ছবি ‘একদিন রাত্রে’তে, যেখানে রাজ কাপুরের পছন্দের শিল্পী মুকেশজি বা মাতালের গানে বম্বে জগতের মহম্মদ রফি অবশ্যম্ভাবী শিল্পী নির্বাচিত হওয়ার কথা, সেখানে মাতালের মুখে গিমিক-নির্ভর গানে সঠিক শিল্পীর অভিব্যক্তি ব্যবহার করার জন্যে নির্বাচন করলেন মান্নাদাকে৷ কী অন্তর্দৃষ্টি৷ ওই চিন্তা ইতিহাস হয়ে গেল৷ সেই থেকে বাংলা ছবিতে মাতালের মুখে গান বা গিমিক-নির্ভর সংগীতে মান্নাদাই প্রতীকী শিল্পী হয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ মাতিয়ে দিলেন৷ দীনেন গুপ্তের শেষ ছবি ‘ঋণমুক্তি’-তে আমি মান্নাদার একটা গান করলাম মাতালের মুখে৷ গানটা রেকর্ডের পর দীনেনবাবু মলিন মুখে বললেন, ‘অভিজিৎবাবু, এই শিল্পী চলে গেলে আর এই ধরনের গান ছবিতে রাখা যাবে না৷’ আবার অন্য দিকে ‘বাজে গো বীণা’, ‘কাটি কাঠ’ও গাওয়ালেন ‘মর্জিনা আবদাল্লা’-তে৷ ‘আনন্দ’ ছবিতে মুকেশজি গাইছেন রাজেশ খান্নার মুখে, কিন্তু যেই জীবন দর্শনের গভীর বাণী সংযুক্ত গান এল — ‘জিন্দেগি ক্যাইসা হ্যায়’ তখনই ডাকলেন মান্না দে-কে৷ মধুমতিতে ও বিছুয়া গানে মান্না দার rendering অভাবনীয়৷ মান্নাদা যে শিল্পী হিসেবে বিচিত্রগামী, তা সলিলদার অনুভবে বহু পূর্বেই ধরা পড়েছে৷ এই বিষয়ে আমি সুধীনদাকেও প্রভূত সাধুবাদ জানাই৷ ‘ডাকহরকরা’ ছবিতে সুধীনদা যখন মান্নাদাকে নির্বাচন করেন তখন মান্নাদা সেভাবে বাংলা গানে প্রবেশই করেননি৷ অথচ তাঁর কণ্ঠস্বরে ও অভিব্যক্তিতে ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ শুনে যে মানুষ চোখের জলে ভাসবে এ কথা সুধীনদা বুঝেছিলেন৷ সুধীনদা মান্নাদাকে নানান আঙ্গিকে ব্যবহার করেছেন৷ কখনও ‘জীবনে কী পাবো না’ বা ‘হয়ত তোমার জন্য’, আবার শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিকাঠামোয় ‘বসন্ত বিলাপ’-এর ‘আগুন’ গানটিতে কী অসাধারণভাবে গিমিককে ব্যবহার করে সার্থক রূপ দিয়েছিলেন সুধীনদা৷ ছদ্মবেশীর গান তো সংলাপ হয়ে ফুটে উঠেছে৷ নচিদাও বিচিত্র ভাবে তাঁকে ব্যবহার করেছেন৷ এটা সম্ভব হয়েছিল শিল্পী মান্না দে বলেই৷
কেবল কি বড় মাপের শিল্পী? এক বড় মাপের উদার মানুষ৷ আবার মেজাজে মজলিশি৷ গৌরীদার গানের বাণী মনে করিয়ে দেয় মান্নাদার সঙ্গ করতে করতে৷ ‘মেজাজটাই তো আসল রাজা’৷ একটা গান তোলাতে গেলাম, সিল্কের লুঙ্গি ও আর একটা চকচকে শার্ট পরে প্রবেশ করলেন ঘরে৷ হাতে খাতা ও কলম৷ শুরুর সংলাপ, ‘বলেন অভিজিৎবাবু, কী খবর?’ ভূমিকার মেজাজে এমন কোনও ভাব আদৌ নেই যে আমরা কোনও একটি ছবির গান রেকর্ডিংয়ের কারণে মিলিত হয়েছি৷ বাংলা সংগীত জগতের মানুষদের কী খবর? (মুম্বই থেকে এসে গান করতেন তো!) কে কীরকম আছে? জুনিয়ররা কে কেমন গাইছে? বাংলা গানের অবস্থা কীরকম, বম্বের দক্ষতা ও দৈন্য, দেশের অবস্থা, সামাজিক পটভূমিকা— সবই আছে৷ আবার লুঙ্গি পরে বাজার করতে যাওয়ার মেজাজি সাবেকি বোধটাও আছে৷ ছেলেবয়সে কুস্তি করে যে বিরাট বক্ষের অধিকারী হয়েছিলেন অন্তর বোধের মধ্যেও সে উদারতার প্রকাশ হতে দেখেছি৷ ‘জীবন রহস্য’ ছবি আমার মুম্বইয়ে প্রথম কাজ৷ সেই কাজের সমস্ত ব্যবস্থা ও আয়োজন করেন মান্নাদা৷ আশাজির সঙ্গে যোগাযোগ, বম্বে ফিল্ম ল্যাবরেটরির শর্মাজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, মিউজিশিয়ান ঠিক করে দেওয়া, এমনকি আশাজির রেকর্ডিংয়ের সময় আগাগোড়া বসে থেকে আশাজিকে সঙ্গ দেওয়া — এক দরদি অগ্রজ যেন অনুজের কাজে দায়বদ্ধ৷ সে সময়ে সুধীনদাও আশাজির একটা গানের ট্র্যাক করে এসেছিলেন৷ যেটা মান্নাদা আশাজিকে দিয়ে ডাবিং করে কাজটি সম্পূর্ণ করেন৷ ‘সেলাম মেমসাহেব’ ছবির রেকর্ডিংয়েও তাঁর পূর্ণ সহযোগিতা পাই৷ আশাজি, ঊষাকে দিয়ে গাওয়াবার ব্যবস্থা সবই তিনি করেন৷ মুম্বই গেলে তাঁর বাড়িতে উঠতাম না কিন্তু তাঁর ভাব হত, তিনি যেন মুম্বইয়ে আমাদের স্বাগতিক আর আমরা তাঁর অতিথি৷ কী আন্তরিক সহমর্মিতা, কী লাবণ্যময় আচারণ৷ মান্নাদা স্পষ্ট বক্তা এবং সেটা খুব পরিষ্কার উচ্চারণে৷ তাঁর অতি ভাললাগা ও অতি খারাপলাগা প্রকাশকে যথাযথ করার জন্যে বিশেষভাবে তিনি নির্ভরশীল ইংরিজি শব্দের ওপর৷ চিঠি লিখতে কী কথা বলতে টানা বাংলায় বলা এবং ইংরেজি না বলার অভ্যাসটা কিছুতেই রপ্ত করতে পারেননি৷ আসলে বহু ভাষায় গান করবার সুবাদে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর দখল ও জ্ঞান অসাধারণ বলেই তিনি এভাবেই ভাষাপ্রকাশে সাবলীল৷ এই জন্যে তাঁর উচ্চারণ সাংগীতিক প্রকাশে অত্যন্ত ঐশ্বর্যপূর্ণ৷ এক লক্ষ্মীমন্ত গৃহবধু যেমন সকলকে আহার পরিবেশনে সযতন হন স্নিগ্ধ হস্তে, তেমনি ললিত লাবণ্যযুক্ত স্বরশব্দক্ষেপণ মান্নাদার৷ কোন শব্দে কতটা জোর দিতে হবে, কোন শব্দ কতটা পেলব করে বলতে হবে, এ সম্পর্কে তাঁর মার্জিত রুচিবোধ শিক্ষা, আধুনিক অনুভূতি একেবারে টু দা পয়েন্ট৷ বিভিন্ন ভাষার ওপর যথার্থ দখল থাকার জন্যেই তাঁর উচ্চারণে এই শুদ্ধতা৷ অভিপ্রেত ওজন৷ তাই তাঁর ভাললাগার ভাষা হচ্ছে, ব্রিলিয়ান্ট, ফ্যান্টাস্টিক আর গালাগালের সবচেয়ে পছন্দের ভাষা স্কাউন্ড্রেল৷ হৈমন্তী শুক্লা, নির্মলা মিশ্র, অজয় চক্রবর্তী প্রমুখের প্রশংসা করতে গিয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত তেমনি সলিলদা, নচিদা, সুধীনদা, এমনকি এই অধমের গুণ গাইতে গিয়েও তিনি স্পষ্টকণ্ঠ৷ কলামন্দিরে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে একদিন তাঁর একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মান্নাদার সুর করা ও গাওয়া ‘প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন’ — গ্রীষ্মের এই গানটির সঞ্চারির কথা বলতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘শুনতে শুনতে মনে হয় যেন আমি আমার শিক্ষকের সামনে বসে গান শিখছি৷’ প্রত্যুত্তরে মান্নাদা যা বলেছিলেন তা নিজমুখে উচ্চারণ করলে আত্মভিমান প্রকাশ পাবে, শুধু একটা কথা না বলে পারছি না৷ বলেছিলেন, ‘আমি তাঁকে যত পত্র দিয়েছি সেগুলোর উৎকর্ষের কারণে সব চিঠি তাঁর সংগ্রহে রাখা আছে৷ এ আমার জীবনে অন্যতম মহৎ পাওয়া৷’ রুচিবিকৃতি তাঁর কাছে যতটাই বর্জনীয়, ততটাই গ্রহণীয় গুণস্বীকৃতি৷ দুটি ঘটনা বলি, যা প্রমাণ দেয় গুণীর মর্যাদা তাঁর কাছে উচ্চমূল্যবোধে সম্পৃক্ত৷
‘জীবন রহস্য’ ছবিতে গান গাইছেন বম্বে ল্যাবরেটরিতে, ‘পৃথিবী তাকিয়ে দ্যাখো’, সঞ্চারিতে এসে, ‘সামনে এলাম, সামনে এসো’, বলার সময় খাদের পর্দাটা লাগাতে খুব অসুবিধা হচ্ছে৷ হঠাৎ মাইকে বললেন, ‘আরে, এই গান তো অভিজিৎবাবু হেমন্তবাবুকে ভেবে করেছেন, এ কি আমার দ্বারা হয়৷’ হয় কি না-হয় তার বিচার গণদেবতার দরবারে হয়ে গেছে৷ কিন্তু বলবার বিষয় এটাই যে, গানটি হেমন্তদারই গাইবার কথা ছিল কিন্তু হেমন্তদাকে হঠাৎ বিলেত চলে যেতে হয় বলে শিল্পী বদল হয়েছিল৷ পরিচালক ও প্রযোজকেরও মান্নাদার প্রতি অধিক দুর্বলতা ছিল৷ কিন্তু মান্নাদা হেমন্তদার দক্ষতাকে অভিমানশূন্যভাবে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা বোধ করলেন না৷ বড় মাপের মানুষ, বড় মাপের শিল্পী বলেই গুণী হয়ে গুণীর মর্যাদা দিতে পারলেন৷
আর একদিন সায়েন্স সিটির একটি অনুষ্ঠানে আমি মান্নাদাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে গণাদালতে বিচারের জন্যে একটি বিষয় পেশ করলাম যে, মান্নাদা কেন রবীন্দ্রনাথের গান তেমনভাবে গাইলেন না৷ এই সওয়ালের প্রেরণা আমার জীবনে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে —
(১) রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীতে তাঁর ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’ গানটির হিন্দি৷ আমি শুনি রেডিওতে, আমি ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মাবার সুবাদে ব্রহ্ম সংগীতের সুর আমার রক্তে স্পন্দিত বরাবরই৷ আর সুবিনয় রায়, রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমার মেজ জ্যাঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায়দের কণ্ঠে শ্রবণ করে করে এ সব গানের এক ভিন্ন অনুভূতি আমার মনে সদা অনুরণিত, কিন্তু মান্নাদা সেদিন আমার গায়ে কাঁটার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন৷ অশ্রুকে স্বতঃস্ফূর্ত করেছিলেন সেই গানে৷
(২) একটি নারীকে ভালবাসলে তার দেহস্পর্শ রক্তে নাড়া দেয় কিন্তু আঁচলটা যদি শুধু গায়ে লাগে তবে অতীন্দ্রিয় অনুভবে শরীর রোমাঞ্চিত হয়৷ এই অনুভূতি আমার পাকা হয়েছে যখন মান্নাদার গাওয়া ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ গানটির মধ্যে মান্নাদার স্পর্শস্বর লাগানো শুনে৷ এই গানে বেশ কিছু স্পর্শ স্বর আছে যা স্বরক্ষেপণের দক্ষতায় অসম্ভব পারদর্শী না হলে গাওয়া সম্ভব না৷ আবার, ‘রবীন্দ্র অনুভবের আবেশের মধ্যে থেকেই সেই প্রেমানুভূতির বিরহকে হৃদয়গ্রাহ্য করতে হবে৷ শক্ত ব্যাপার৷ আমার মনে হয়েছিল এবং এখনও বিশ্বাস করি ভারতবর্ষে দ্বিতীয় কোনও শিল্পী নেই, শিক্ষায় দীক্ষায় ভাবাবেগে গানটিকে ওই মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারবে৷
(৩) বম্বের কোনও এক দিকপাল সংগীত পরিচালক রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে অবমূল্যায়ন করেছিলেন৷ মান্নাদা তাঁকে বাড়িতে ডেকে এনে একঘণ্টা রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়ে তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন৷ এবং সবশেষে ‘ওগো স্বপ্ন স্বরূপিণী’ যখন শোনালেন সেই সংগীত পরিচালক প্রায় টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ এই সব সওয়াল নিয়ে যখন মান্নাদাকে গণ আদালতে পেশ করলাম তখন তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি রবিঠাকুরের গান কিছু গেয়েছি৷ ওঁর বাণী পাঠ করলেই তো সংগীত৷ কিন্তু আমি দেখেছি আমার থেকে এই গান অনেকেই বেশি ভাল গায়, বিশেষ করে হেমন্তবাবু৷ তাঁর কণ্ঠের তো তুলনা হয় না৷’ তখনও ফালকে পুরস্কার পাননি৷ কিন্তু পদ্মভূষণপ্রাপ্ত ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলাকার হিসেবে আদৃত তবু পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে এই স্বীকৃতি দিতে তাঁর কোনও দ্বিধা হয়নি৷ আসলে তিনি আজন্ম শিল্প পূজারী৷ সলিলদা চলে যাওয়ার পর মিডিয়াকে বললেন, আমায় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার লোকটাই চলে গেল৷ ভাললাগা না লাগাটা তাঁর আন্তরিক আবেগ থেকে প্রকাশ হয় আজও৷
শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের একটি সুন্দর শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘রসিয়ে নেওয়া’৷ শিলং পাহাড়ে অমিত যখন লাবণ্যকে ভালবেসে এতটাই রসযুক্ত তখন রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘শিলং পাহাড়টা যেন অমিতকে রসিয়ে নিয়েছে’৷ আমারও মনে হয় মান্নাদা সংগীতকে রসিয়ে নিয়েছেন৷ এই অভিব্যক্তি তাঁর গান শুনেও মনে হয়, সুর শুনেও মনে হয়৷ কাজ করতে গিয়ে আচরণেও মনে হয়েছে৷ তাঁর গান মানুষের ভাললাগার ভাণ্ডারে অজস্র থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু গায় বিস্ময়করভাবে নাড়া দেয় আমার সংগীত নির্মাণ জীবনকে৷ যেমন ‘কেউ আমাকে পাগল’ বলে আর ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’৷ এই দুটি গান শুনলে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই এই ভেবে যে, এই ভাষা গঠনকে মান্নাদা কী করে সুরের পরিকাঠামোর মধ্যে ফেললেন৷ এ তো গান নয় যেন সাংগীতিক সংলাপ৷ আর rendering-এ এই সংলাপকে যেভাবে নাটকীয় করে উপস্থাপনা করেছেন— তাতে তাঁকে মস্ত বড় অভিনেতা বলা অত্যুক্তি হয় না৷ আর কেউ আমাকে পাগল বললে আমি ধন্য হব— এই বাণীর মধ্যে থেকে জীবনের যথাযথ অভিব্যক্তিকে তুলে আনতে যে কাওয়ালি আঙ্গিককে অবলম্বন করা যায়, এ আমার কল্পনাতীত৷ আর ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’ শাস্ত্রীয় পরিকাঠামোয় একটা রাগ প্রধান সংগীতের আঙ্গিক ভেঙে সুর করা ও execution করা, দক্ষতার কোনও পর্যায় তা যারা classical-এর শাশ্বতিক সত্তা উপলব্ধি করেন তাঁরাই বুঝবেন৷ আর এই দুটি গানের সৃষ্টির উৎসে বন্ধুবর গীতরচয়িতা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অপরিসীম৷ তিনি প্রতিটি সুরকার ও গীতিকারের প্রয়োগ প্রণালী আত্মস্থ করেছিলেন, তাই বুঝতে পারতেন কোন বাণী নিয়ে কোন সুরস্রষ্টা কোন পথে হাঁটতে পারেন৷ এ দুটি গান যে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুর নির্মাণে দক্ষ হবে না এবং ইতিবাচকভাবে বলা যায় মান্না দে হবেন— তা তিনি নির্দিষ্টভাবে বুঝতেন৷ যার জন্যে মান্নাদাকে যে সব গান দেবেন স্থির করতেন আগেই বাণী রচনা করে পাশে তাঁর নাম লিখে রাখতেন৷ শাস্ত্রীয় সংগীত, ভারতীয় সংগীতকে প্রগতিশীলতায় মুক্তি দেওয়ার পথে মান্নাদার অবদান অপ্রতিন্দ্বন্দিতার উজ্জ্বলতায় উচ্চারিত হওয়ার মতো৷ সন্ন্যাসী রাজার ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজা’— গানটি সৃষ্টি হয়েও লালিত হত না যদি এ পৃথিবীতে মান্না দে-র জন্ম হত৷
আমার সুরের গান, তিলোত্তমা ছবির, ‘গোলাপের অলি আছে’— গানটি গাইবার বিকল্প কোনও শিল্পী কি খুঁজে পাওয়া যেত? বেশি যন্ত্র নিয়ে recording-এ সময় বেশি লাগে, Overtime হয়ে যায়৷ কিন্তু এই গানটি recordingটা কম যন্ত্র নিয়ে করা সত্ত্বেও Overtime হল প্রায় ২ ঘণ্টা৷ কারণটা বলি—
গানটি আমি তৈরির সময় ‘সা’ ভেবেছি B Flat-কে কিন্তু গানটি আমার শুরু ধা থেকে৷ স্বাভাবিকভাবেই open chord B Flat না— G minor৷ আমি B Flat Scale ভাবছি— অলকনাথ দে ‘সা’ করলেন ‘D’-কে৷ কিন্তু মান্নাদা মনকে গেঁথে নিলেন ‘G’-কে ‘সা’ করে, তারপর গানের ভঙ্গিকে একবারে কাওয়ালি অঙ্গে নিয়ে গিয়ে গাইতে থাকলেন৷ আর যতই বলছি, মান্নাদা এবার record করি— উনি বলছেন, দাঁড়ান মশায় আমায় একটু ভাল করে গাইতে দিন৷ তবলাবাদক রাধাকান্ত নন্দী ও তিনি দুজনে মিলে মেতে গেলেন এমনভাবে যেন গানটিতে আমার আর কোনও ভূমিকা নেই৷ তখনকার শিল্পীদের গান দিলে তারা সেটা নিজের করে নিতেন৷ মান্নাদা এই গোলাপের অলি আছে গানটি recording করার সময় এবং পরেও নানা অনুষ্ঠানে গাইবার সময় বুঝিয়ে দিয়েছেন, গানকে কী করে রবীন্দ্রভাষায় যাকে বলে ‘রসিয়ে নেওয়া’, সেই রসিয়েই তিনি নিলেন৷ ‘রাগপ্রধান গান ও কাওয়ালি’ গানকে বাংলা গানের নির্মাণে ও গায়নে তিনি মুক্তি দিয়েছেন মূল বাংলা গানের ধারার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার দক্ষতায়৷ He is great কিন্তু তিনি কালের কাছে, বাংলা গানের ইতিহাসের কাছে কী অমূল্য উপহার দিয়ে গেছেন তা যদি সংগীত সমাজ ও শ্রোতারা অনুধাবন করতে না পারেন তবে সংগীত থেকে জীবন যে রস গ্রহণ করতে পারে, এ বোধ থেকে তাঁরা নিজেরাও বঞ্চিত হবেনই৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা৷’ তাঁর এই উচ্চারণকে ভাব সম্প্রসারণ করে আমি বোধ করেছি any art is for communication from one soul to another বা আরও নিবিড় ও গভীরভাবে বলা যায় from one impulse to another impulse. এই communication fail করলেই সমস্ত সৃষ্টিটাই বিফল৷ শিল্প নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হল৷ একটি ঘটনার উল্লেখ করছি যা এই সংগীত বিষয়ক রচনায় ও ব্যঞ্জনায় অতি প্রাসঙ্গিক বলে আমি বিবেচনা করছি৷ কোনও এক সময়ে যাত্রা জগতের নটসম্রাট শ্রদ্ধেয় স্বপনকুমারের সঙ্গে কিছু কাজ করার সুযোগ এসেছিল এবং সেই সুবাদে একদিন তাঁর শয়নকক্ষে আমার যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল তাঁর ডাকে— গিয়ে দেখলাম তাঁর ঘরে bed Level-এ ঘরের তিনভাগ দেওয়াল জুড়ে আয়না বসানো৷ তিনি যখন শুয়ে থাকেন তখন একা একা ঘরে শুয়ে শুয়ে মাইম অভ্যাস করেন৷ আমি স্তম্ভিত৷ শিল্পকে সত্য করে তোলার কী অসাধারণ এক সাধন-প্রক্রিয়া৷ যে শিল্পী তার নিজস্ব শিল্প মাধ্যমের ব্যাকরণকে ব্যবহার করে বিশেষ ভাব, জীবনের নন্দনরূপ, বোধের সত্য আনন্দ তত্ত্বকে প্রকাশ করতে পারেন সেই শিল্পীই যথার্থ শিল্পী৷ জ্ঞান তত্ত্ব, পাণ্ডিত্য তত্ত্ব ওস্তাদি তত্ত্ব বা অশিক্ষা তত্ত্ব দিয়ে শিল্পকে রূপ দেওয়া যায় না৷ রবীন্দ্রনাথ সংগীতের যাবতীয় রস সমৃদ্ধিকে আত্মীকরণ করে যে রূপ দিয়েছেন সংগীতে— তাকে রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া অন্য কিছু বলে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না৷ একেবারে মৌলিক৷ সেই অর্থে এবং উপরোক্ত চিন্তা ও বোধের আলোতে আমি মান্না দে গীত, সুরারোপিত সংগীতকে ‘মান্না সংগীত’ বলে আখ্যায়িত করব৷ কেবল গায়ন শিল্পকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তা নয়, নির্মাণকেও তিনি কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বকীয় রূপ দিয়েছেন৷ যেমন রাগ ব্যবহার করেও রাগ প্রধানের নিজস্ব style-কে প্রয়োগ করেও তা রাগ প্রধান নয়— আবার সেই বিচারে কাওয়ালিও কাওয়ালি নয়৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ শৈলীর ব্যাপ্তি তাঁর ছিল না— কিন্তু তাঁর বোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি যাবতীয় প্রয়োজনীয় গুণের রসে জারিত কণ্ঠ মাধুর্য ও সুর বৈচিত্র্য যা উপহার দিয়েছে বাংলা সংগীতের ধারাকে, তাতে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকতে বাধ্য— এটা কালেরই স্বীকৃতি— যা সমস্ত পুরস্কারের ঊর্ধ্বে৷ আমার এই রকমবোধ নিয়েই সেদিন মান্নাদার শিল্পকাণ্ডের সংগ্রাহক শ্রীগৌতম রায়ের মোবাইলে মান্নাদার দুটি গুজরাটি গান শুলনাম৷ কী অসাধারণ dedication, attachment সেই rendering-এ৷ এত আন্তরিক, এত সুর ইন্দ্রজালে পরিপূর্ণ, ভরাট যে ভাষা না বুঝলেও শিল্পের প্রাথমিক শর্ত communication তার যেন এক জীবন্ত স্বমহিমা প্রকাশ৷ প্রথমেই বলেছি প্রয়োগ শিল্প লিখে বোঝানো যায় না কারণ লেখায় যা জ্ঞানতত্ব তা হৃদয়ের আঙিনায় নিয়ে বিচার না করলে, কেবল জ্ঞান নিয়ে রসের উদ্বোধন হয় না৷ আজ এই কারণে ধর্মও বিপন্ন৷ Religion is not ritual but spiritual. সাংগীতিক rituals-এ ওস্তাদি বা পণ্ডিতি করা যায়— সংগীতকে শিল্প করতে গেলে সংগীতে rituals পালন করে অনুভূতিকে সুরের তরীতে ভাসিয়ে সাংগীতিক spiritual-এ উত্তোরিত করতে হয়— যেখানে মান্নাদা 100% spiritual আর মান্না কণ্ঠী শিল্পীরা Rituals-এর অনুগামী৷ মান্নাদাকে একদিন ফোনে বলেছিলাম— মান্নাদা আপনার ভক্ত ও অনুগামীরা মান্নাদের ওস্তাদি বা পণ্ডিতি বেছে নিয়েছে কিন্তু তাকে ছাপিয়ে যে রস অবগাহন করা শিল্পী মান্না দে— তার দর্শন পায়নি৷ মান্নাদা হেসেছিলেন৷ আসলে সেটার জন্যে যে শিক্ষা ও তৎসম্পৃক্ত সংস্কৃতির সাধনা, জীবন সাধনা দরকার সেটা তারা করেনি৷
ভারতবর্ষের বহুরকম ভাষায় মান্নাদা গান গেয়েছেন এবং প্রতিটি ভাষার উচ্চারণ সম্পর্কে তাঁর সজাগ নিষ্ঠ পরিবেশন বিস্ময়কর৷ শ্রুতিমধুর৷ বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা গানটা সঠিকভাবে পাঠ বা আবৃত্তি করে না— কিন্তু হেমন্তদা, মান্নাদা এঁরা উচ্চারণ সম্পর্কে একটা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন৷ স্বরক্ষেপণের মতো বাণীক্ষেপণ তাঁদের যেমন সুললিত মাধুর্যময়, তেমন হৃদয়গ্রাহী৷
মান্নাদা শাস্ত্রীয় সংগীত শিখে আধুনিক গানে এসেছেন৷ অথচ তাঁর উচ্চারণে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কোনও সংগীতে বাণীর প্রকাশ কতটা লাবণ্যময় হওয়া উচিত৷ অনেক ওস্তাদ বা পণ্ডিতেরা তাদের ব্যাকরণ সর্বসত্তা দিয়ে সেই উচ্চারণকে চিবিয়ে কামড়ে শেষ করে দেয়— তাতে তারা আর শিল্পী পর্যায় উঠতে পারে না৷ আমির খাঁর মতো শিল্পীরা ‘ক্যায়সে কাটে রজনী’ বা ‘পিয়া কি নজরিয়া’ বলতে গিয়ে ভাষার যে বিষয় তাঁর সংবেদনশীলতাকে ব্যাহত করেন না৷ আমাদের বাংলার অজয় চক্রবর্তী যেমন কী বাংলা, কী হিন্দি, কী সংস্কৃত এমন উচ্চারণ করেন যেন কণ্ঠ থেকে শব্দটা মুক্ত হয়ে ঝরছে৷ আধুনিক সংগীতের জগতে হেমন্তদা, মান্নাদার উচ্চারণ তেমনি জ্বলজ্বলে নক্ষত্র৷ মান্নাদা ভারী কণ্ঠের শিল্পী নন, তবু গানের কথাগুলো কত মমতা দিয়ে উচ্চারণ করে গানটির সমগ্র বিষয়বস্তুকে কত আন্তরিক করে তোলেন৷ তাঁকে সংগীত পরিচালকরা intimate romantic song বেশি গাওয়াননি— এটা সংগীত পরিচালকদের দৈন্য বলব, কারণ গাওয়ালে তিনি কোথায় পৌঁছে দিতে পারেন তা বোঝাতে দুটি গানের উল্লেখ করব৷ একটি অনুভব (হিন্দি) ছবিতে ‘ফির কহী কই’ আর বাংলা শঙ্খবেলা ছবিতে ‘কে প্রথম কাছে এসেছে, কে প্রথম ভাল বেসেছে’৷ আমার মন যখন খারাপ থাকে, তখন আমার যদি হিন্দি গান শুনতে হয়, তার জন্যে কিছু হিন্দি গান এক জায়গায় সঙ্কলিত করে রেখেছি, যেখানে তালাত মামুদের ‘জ্বলতে হয় জিসকে নিয়ে’, মান্নাদার ‘ফির কহী কোই’ গানগুলো আছে, যেগুলো শুনে আমি কাঁদি৷ ভারী কণ্ঠের ব্যাপ্তি voiceকে যতটা modulation span দিতে পারে, ছোট আওয়াজ তা পারে না, তবু নিষ্ঠা, সাধনা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, কাব্য সাহিত্য বোধ জাত শিল্পীর বোধ ওই স্তিমিত পরিধির মধ্যে modulation-এর কোন চূড়ান্ত পর্যায় নিতে পারে তা প্রমাণ পাওয়া যায় পাশাপাশি মান্নাদা গীত কিছু গানকে শুনলে৷ ‘আমায় একটু জায়গা দাও’, ‘ফির কহী’, ‘ও মেরে প্যারে ওতন, আও টুইস্ট করে৷ তালাশ৷ ‘কে প্রথম কাছে এসেছে’, ‘গোলাপের অলি আছে’, মধুমতির ‘দৈয়ারে দৈয়ারে’, ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’ কী বিস্ময়কর modulation of voice. বসন্ত বিলাপ ছদ্মবেশির গানতো fantastic.
মহঃ রফি ভারতবর্ষের সংগীত জগতের গিনি সোনার অলঙ্কার তথাপি একদিন রাত্রের এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় গানটির মধ্যে মাতালের যে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি তা কিন্তু আমি জাগতে রহোর ‘জিন্দেগি খোয়াব’-এ পাইনি৷ আমি ক্ষমা চেয়েই বলছি, মান্নাদার কণ্ঠে মাতালকে মদ খাওয়া মাতাল মনে হয়েছে যেখানে রফি সাহেবের গানে মনে হয়েছে না খেয়ে মাতালের অভিনয় করছেন৷ লিখে লিখে এত বড় মাপের শিল্পীর উৎকর্ষকে প্রকাশ করা যায় না৷ যিনি মান্নাদার ভক্ত, বাংলা, হিন্দি বা ভারতীয় যে কোনও ভাষায় আধুনিক সংগীতের পূজারী, যাঁর অনুসন্ধানের প্রেরণা আছে, গবেষণার মন আছে তাঁরা মান্নাদার গান শুনুন৷ নিজে আবিষ্কার করুন তাঁর অবদান— বিমোহিত হবেন৷ বর্তমানে নানা ভাবে বিভিন্ন মানুষ সংগ্রহশালা গড়ে তুলছেন, তাঁদের সন্ধান করে বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের কাজ নিয়ে গবেষণা করুন— নিজেও তখন ইতিহাসের একজন সাক্ষী হতে পারবেন৷
‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম’— শ্রদ্ধা ছাড়া কোনও বোধই পুষ্ট হয় না৷ সমস্ত শ্রদ্ধাই বিষয়ের পদতলে শ্রদ্ধাশীল না হলে বিষয়টি আয়ত্তাধীন হয় না— বোধ বোধিতে উত্তরিত হয় না৷ মান্না দে ছোট বড় নির্বিশেষে গুণ ও গুণীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত অভিব্যক্তি দিয়ে আত্মবোধকে স্নাত করেছেন৷ আমরা যাঁরা তাঁর অনুজ আমাদের কাজকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন৷ অনুষ্ঠানে ‘গোলাপের অলি আছে’ গাইতে গাইতে শ্রদ্ধার সঙ্গে রাধাকান্তবাবুকে বাজাবার জায়গা করে দিতেন, যাতে রাধাকান্তবাবু তাঁর দক্ষতা প্রকাশ করতে পারেন৷ তবলার একক সুযোগ শেষ হতেই জনসমক্ষে বলে উঠলেন, ওঃ রাধুবাবু অভিজিৎবাবু কী সুন্দর composition করেছেন— সংলাপটি বলেই শুরু হল আবার গান৷ এই আত্মতৃপ্ত প্রকাশ সমস্ত সময় তার বোধের অন্তরঙ্গ সঙ্গী৷
শচীনদেব বর্মন মান্নাদার জীবনে এক ঘনিষ্ঠতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব৷ তাঁর কাছে মান্নাদা প্রায় তাঁর শিষ্যের মতো মনোভাব নিয়ে চলে এসেছেন৷ শচীন দেববর্মনও জীবনে যা করেছেন, যা ভেবেছেন, তার বিকল্প নিজেও ভাবতে পারতেন না৷ এদিকে মানা বলে মান্নাদাকে সবসময় কাছে টেনেছেন৷ এই কাছে আসার সুবাদে মাঝে মাঝেই unpredictable emotional ব্যক্তিত্ব শচীন দেববর্মনের নানা কার্যকলাপের শিকার হয়েছেন মান্নাদা, যা বেদনাদায়ক তবু তা মান্নাদার বিপরীত আচরণে শ্রদ্ধার আসন টলায়নি৷ দুটি ঘটনা—
শচীন দেববর্মন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অন্ধ ফুটবল প্রেমিক আর মান্নাদা তেমনি মোহনবাগানের আদ্যোপান্ত সমর্থক৷ ইস্টবেঙ্গলের খেলা হলে শচীনকর্তা দেখতে যাবেনই, এ সবাই জানে৷ এমনই একদিন ইস্টবেঙ্গল Vs মোহনবাগান খেলা৷ শচীনদা মানাকে বললেন, ‘চল মানা, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা দেখতে যাব৷’ মান্নাদা প্রমাদ গুনলেন৷ শচীনদার সঙ্গে এই খেলা দেখতে যাওয়া আর ফাঁসিকাঠে ঝুলে যাওয়া প্রায় সমান৷ কারণ তাঁর পাশে বসে ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত না হওয়া বা মোহনবাগানের প্রশংসা করা আর বদ্ধভূমিতে প্রবেশ করা সমান৷ তবু মান্নাদা কী করেন? যেমন যোগীরা কুম্ভক করেন দম বন্ধ করে সেইভাবে দম বন্ধ করে সঙ্গে গেলেন৷ কিন্তু সেদিন মোহনবাগান অসম্ভব ভাল খেলছে আর ইস্টবেঙ্গল গোল খেয়েছে৷ শচীনদার মেজাজ খারাপ৷ মান্নাদা উৎফুল্ল তবু গাইতে পারছেন না, ‘এ কি আনন্দ’ গানটি৷ পাথর হয়ে বসে আছেন৷ খুব সম্ভব খেলার মাঝখানে শচীনদা মান্নাদাকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন৷ মনে হতে পারে গানের বিষয়ে এর কী যোগ আছে৷ আলবাত আছে— ‘It is a part of the game.’ মানসিক গঠন, বোধ, অনুভূতির উচ্চ মূল্যমান বিচার— এ সব কিছুই শিল্প সৃষ্টির পরোক্ষ উপাদান৷ বড় শিল্পীরা সব সময় উচ্চ জীবন, মহান হৃদয়ের অলঙ্কারে অলঙ্কৃত৷ তা না হলে তারা সার্থক শিল্প সৃষ্টির অংশীদার হতে পারে না৷ আর একটি ঘটনা৷
শচীনকর্তা মান্নাদাকে ফোন করে বললেন, ‘মানা কাল চইল্যা আয়, একটা গান তুলতে হইব৷’ মান্নাদা শচীনদার সহকারী— মান্নাদা খুব খুশি শচীনদার সুরে তিনি গাইবেন৷ মান্নাদা গানটি শিখলেন অতি যত্ন নিয়ে৷ শেখার পর শচীনদা বললেন, ‘কাল রফি-আইব রফিরে গানটা তোলাইয়া দিবি, রফি গাইব৷’ বেদনায় বুক ফেটে গেল তবু যন্ত্রণাকে বুকে চেপে পূর্ণ স্বাভাবিকতা নিয়েই মান্নাদা কাজটি সম্পন্ন করলেন৷ শচীনকর্তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সংগীতের যথার্থ ঋত্বিক হওয়ার সুবাদেই তিনি কাজটি সহজসাধ্য ভাবে করতে পারলেন৷ আসলে তিনি সংগীতকেই পূজা করেছেন, সংগীতের বদলে নিজেকে নয়৷ এই সাধনাই তাঁকে সেই মূল্যবোধে পৌঁছে দিয়েছে যাতে নির্দ্বিধায় তিনি তাঁর পছন্দ-অপছন্দকে প্রকাশ করতে পারেন৷ যে গান ভাল লাগল, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার প্রশংসা আর খারাপ বা অপছন্দের জায়গায় ediot, অসভ্য বলতেও কুণ্ঠিত নয়— পুরো সাবলীল৷
এত বড় জীবন, এত বড় শিল্পী— ভারতের যাবতীয় আঞ্চলিক ভাষায় সংগীত পরিবেশক— মান্না দে-কে নিয়ে আন্তরিক গবেষণা আজকের এই অবক্ষয়ী সমাজ ও সাংস্কৃতিক পটভূমিকায় অত্যন্ত জরুরি৷ সমস্ত সমাজ ব্যবস্থা আর্থ সামাজিক সম্পর্কগুলো এত দ্রুত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, সেখানে অসুস্থ মন, বোধগুলোকে রক্ষা করতে সুস্থ সংস্কৃতির জাবর কাটা এক অত্যাবশ্যক চিকিৎসা৷ তাই মান্না দে-র মতো অস্তিত্বকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করে অনুশীলনের অঙ্গনে নিয়ে আসতেই হবে৷ মানুষ মানুষে সেতু বন্ধনের প্রধান রজ্জু-সংগীত— সেই সংগীত ঈশ্বরীয় হয়ে উঠেছে যে সব মহান শিল্পীস্রষ্টার অবদানে, তাঁদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মান্না দে৷
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক সংগীত ও সংগীতকার, কলাকার নিয়ে প্রামাণিক গবেষণা হচ্ছে না, হয়নি৷ কারোর দায়বদ্ধতা নেই এ বিষয়ে, অথচ এটা অত্যন্ত জরুরি৷ ঐতিহ্যের হাত ধরেই যথার্থ প্রগতি সম্ভব, তাই ঐতিহ্যের ঐশ্বর্য ও প্রগতির উৎকর্ষকে গাঁটছড়া বেঁধে এগোতে হয়৷ মান্নাদা আধুনিক বাংলা গানে যোগ্যতম প্রতীক৷ সত্যিকারের রোল মডেল৷ রাগরাগিণী গুলে খেয়েছেন অথচ রাগাতঙ্ক রোগে ভোগেননি৷ তাল লয় গুলে খেয়েছেন, তাকে হজম করেছেন, কিন্তু সাংগীতিক-মাতাল হননি৷ ওস্তাদি গান শিখেছেন কিন্তু ওস্তাদ বা পণ্ডিত হননি, হয়েছেন নন্দনবোধের রসসমৃদ্ধ শিল্পী৷ রবীন্দ্রনাথের অভিমত, আমাদের পনেরো আনা গানই তো হিন্দুস্থানি গান থেকে কিন্তু তাকে নিজের করে নিতে হবে নন্দনবোধ দিয়ে৷ বলেছেন, তাজমহল থেকে আমরা সৌন্দর্যবোধের প্রেরণা নেব কিন্তু বাড়িতে গম্বুজ লাগাব না৷ মান্নাদা কাবুলিওয়ালার পস্তু গানে, গানের সামগ্রিক বেদনাকে প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু পস্তু গানে তাঁর ওস্তাদি শিক্ষার পাণ্ডিত্যের গম্বুজ বেঁধে ভারাক্রান্ত করেননি৷ ফালকে পুরস্কার দিয়েও তাঁর ঐতিহাসিক মূল্যকে মূল্যায়ন করা যায় না৷ তবু ভাল লাগে, তবু আনন্দ পেয়েছি লোকে তাঁকে ধরতে না পারলেও চিনতে পেরেছে বলে৷ তবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সব অপরিপূর্ণতার পক্ষে ভাষা সাজিয়ে দিয়েছেন, তাই আমি বলব তাঁর ভাষায়—
বোঝা যায় আধখানি কথা
আধোখানি মন
সমস্ত কে বুঝেছে কখন?
তাঁকে কিছুটা বোঝা গেছে— দিন যাবে মানুষ তথা বিদগ্ধ শ্রোতারা তাঁকে আরও বেশি করে বুঝবে৷