মান্নাদা – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
এখন যেন শুধু স্মৃতির প্রাোজেক্টর-এ সেইসব দিনগুলোর ছবি দেখা৷ আমাদের অল্প বয়েস থেকেই মান্নাদাকে দেখেছি৷ তাঁর পিতৃব্য অবিস্মরণীয় কৃষ্ণচন্দ্র দে মঞ্চে গান করছেন, আর পাশে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তরুণ মান্নাদা তানপুরা ছাড়ছেন৷ পরে জীবনের নিজস্ব টানে ও পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে তিনি সেই সেকালের বম্বেতে চলে গিয়েছিলেন৷ প্রতিষ্ঠা পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি৷ হিন্দি ছায়াছবিতে গান চিরকালই একটা বাড়তি আকর্ষণের উৎস৷ আজও মনে আছে অশোককুমার অভিনীত ‘পরিণীতা’ ছবিতে ওঁর গাওয়া৷ কীর্তন অঙ্গের সেই ছবিতে ‘রাধে চলে রাধে রানি’ আর ‘চলি রাধে রানি’ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম৷ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী তিনি৷ নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতায় মহীরুহ হয়ে উঠেছিলেন৷
তখন বম্বেতে থাকা দূরের শিল্পীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছে অনেক পরে৷ বাংলা সিনেমায় মান্নাদার গাওয়া বিস্তর হিট গান আমার ঠোঁটেও বিকশিত হয়েছে৷ পেশার টানে সেই কাজটা সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের করতে হয়৷ তবে রক্ষে এই যে, অভিজ্ঞ দর্শকরা সকলেই জানেন আসল কাজটা মান্নাদা করছেন, আমি নই৷
এখানে একটা প্রাসঙ্গিক সত্য বলা দরকার৷ শিক্ষাটা উত্তমদার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে পাওয়া৷ দিন-ক্ষণ মনে নেই, দুজনে শুটিং-এর অবসরে বসে গল্প করছিলাম৷ টালিগঞ্জের টেকনিসিয়ানস স্টুডিওর পাশের মাঠে৷ হঠাৎ দেখলাম একজন এসে উত্তমদাকে একটা কাগজ ও একটা ক্যাসেট দিয়ে গেল৷ জিজ্ঞাসা করলাম— ‘এগুলো কী কাজে লাগবে?’ উত্তমদা সহজ গলায় জবাব দিল— ‘কাগজটায় গানটা লেখা আছে, আর ক্যাসেটে গানটা গেয়ে দেওয়া, আমায় লিপ দিতে হবে, প্র্যাকটিস করব৷’ আমি রীতিমতো অবাক৷ বলেই ফেললাম— ‘তুমি এত ভাল গান জানো, তুমিও প্র্যাকটিস করবে?’ মৃদু হেসে উত্তমদা বলল— প্র্যাকটিস করব এই জন্য যে যখন টেপটা বাজবে না তখনও যেন মসৃণভাবে গানটার সুরের চলন অনুযায়ী গানটা গাইতে পারি৷’ একেবারে বেসিক টিপস৷
সত্যিকথার আগে একটা প্রাক-সত্যিকথা থাকে৷ উত্তমদার বাস্তবিক পরামর্শটা পাওয়ার আগে গানের দৃশ্যের প্রস্তুতি হিসেবে সময় দিতে ঠিক রাজি ছিলাম না৷ তেমন সুযোগ ও টেকনিক্যাল সাহায্যও পাইনি, কারণ তখন তো ক্যাসেটই ছিল না৷ ফলে প্রকৃত অর্থে প্রস্তুতি ছাড়াই প্রায় তাৎক্ষণিক তৎপরতায় কাজটা করতে হত৷ তবে নিজের স্বপক্ষে, একটু দুর্বিনীত শোনালেও বলতে হবে, আমি অনেক কিছুই চটপট শিখে নিতে পারি৷
এত কথা লিখতে হল মান্নাদার জন্যই৷ ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে নায়কের মুখে রাখা গানের চরিত্র ছিল একটু অন্যরকম৷ বসে বা দাঁড়িয়ে প্রাণের আবেগে প্রেম নিবেদনের গান সেটা নয়৷ সেই ‘লেগেছে লেগেছে লেগেছে লেগেছে আগুন’-এ নাটকীয় ভঙ্গিতে দিদিমণিদের সুখের হস্টেলে অশান্তির আগুন লাগাতেই পরম আনন্দময় কৌতুকে উল্লসিত নায়কের মুখে পরপর চারবার ‘লেগেছে’ বলতে হবে৷ তারপর অন্যসব প্রয়োজনীয় অভিব্যক্তি তো আছেই৷ ষড়যন্ত্রটা আসলে সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্ত ও মান্নাদার যৌথ নির্মাণে ঘটেছিল৷ গানটা কোনও বিচারেই সহজ সুরের গান নয়৷ অসামান্য গুণী মানুষ ছিলেন সুধীনবাবু৷ কম কথার মানুষ৷ ততদিনে অবশ্য মান্নাদার সঙ্গে আলাপ রীতিমতো জমে উঠেছে৷ চমৎকার মানুষ, বাইরে অধিকাংশ সময়ে একটা গম্ভীর, সিরিয়াস মেজাজের বলে মনে হলেও মান্নাদা প্রকৃত বিশ্লেষণে খুবই মধুর স্বভাবের মানুষ৷ সুতরাং পরিচয়ের শুরুটা গম্ভীর হলেও অন্তরা অবধি পৌঁছেই তাঁর মুখ টেপা হাসিটা দেখা যেত৷ ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলত দিব্যি৷ বয়সের অনেকটা ব্যবধান-জনিত সতর্কতা সেখানে অনুপস্থিত৷ সুতরাং সুযোগ পেয়েই বলে দিলাম— ‘মান্নাদা, আপনার আর কী, দিলেন তো বংশদণ্ডটা আমায়৷’ উনি তো হেসে খুন৷ হিন্দি সিনেমার জন্য প্রবল ব্যস্ত থাকার মধ্যেও কলকাতায় এসে বাংলা সিনেমার জন্য এত অসংখ্য স্মরণীয় গান উনি করেছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর৷ ষাটের দশকে ওঁর গাওয়া বাংলা ছবির গান শ্রোতারা অবাক হয়ে শুনেছে৷ এই তালিকায় বোধহয় সবচেয়ে উজ্জ্বল ছবির নাম ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’৷ অবিস্মরণীয় গানে মাতিয়ে দিয়েছিলেন মান্নাদা৷
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আধারে নির্মিত সুরবৈচিত্র্য থাকলেই যেন মান্নাদার খোঁজ পড়ত৷ এবং এ কথা বাংলা ও হিন্দি সিনেমা— দুটো ক্ষেত্রেই সমানভাবে সত্য৷ বাংলা সিনেমায় যে তিনি গাইছেন— ‘আমি যে জলসাঘরে’, ‘শাওন রাতে যদি’, ‘বড় একা লাগে’, আবার সেই তিনিই গাইছেন জ্যাজধর্মী ‘কে তুমি নন্দিনী’৷ আবার হিন্দি ছবিতেও বহুকাল ধরে নানা ধরনের গান তিনি গেয়েছেন৷ তার তালিকা বিস্তারিত ভাবে পেশ করবেন বিশেষজ্ঞরা৷
জ্যাজধর্মী প্রাণবন্ত গানগুলো সুর ও গাওয়ার মেজাজের জন্য গানগুলো যেন একালের জন্যও আধুনিক৷ ‘জীবনে কী পাব না’, বা ‘হয়তো তোমারই জন্য’ সেই সময়ে মান্নাদাকে ক্রমাগত জলসায় গাইতে হয়েছে৷ একই সঙ্গে বলতে হবে নচিবাবুর সুরে নির্মিত ‘রং-বেরঙের জেল্লা’ গানটির কথাও৷
যে-কোনও বড় মাপের গাইয়ের মতোই মান্নাদার গানে বিরাট বৈচিত্র্য চিরকালই অন্যদের মতো আমাকেও অবাক করেছে৷ প্রবল জনপ্রিয়তার জন্য সকলেই হয়ত আগে ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবির গান দুটোর কথা বলবেন৷ সেই মন্তব্যে আমারও কোনও আপত্তি নেই৷ কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র ও মেজাজের গান গাওয়ার প্রশ্নে আমি ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবির দুটো গানের কথাও মনে করিয়ে দিতে চাই৷ এতকাল পরে কালগুণে সেইসব ছবির গানের স্মৃতি গুছিয়ে লেখা খুব সহজ কাজ নয়৷ মনে পড়ছে ‘সুদূর নীহারিকা’ ছবির ‘কেন ডাকো মিছে পাপিয়া’ গানটার স্মৃতি৷ অসামান্য স্বরনিয়ন্ত্রণ ও মেজাজের পরিচয় ছিল গানটাতে৷ প্রেয়সী ছবির ‘এখন বুঝি মজনু কেন পাগল হয়েছিল’ গানটাও আমৃত্যু মনে থাকবে৷
গানের মধ্যে গায়ক-গায়িকাদের গায়নভঙ্গিতে যে অভিনয় করতে হয় তার এক চিরকালের উদাহরণ মান্নাদা৷ ‘পড়োশান’ ছবিতে কিশোরকুমারের সঙ্গে গাওয়া ‘এক চতুর নার করকে সিঙ্গার’ গানটি৷ একই সঙ্গে মনে পড়ে সলিল চৌধুরির সুরে ‘একদিন রাত্রে’ ছবির ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’ গানটার গায়নভঙ্গি৷ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের উঁচুমানের তালিম থাকা মান্নাদা একাধিক অর্থে ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে বিপদতারণের ভূমিকা গ্রহণ করে গেছেন৷ অসংখ্য অবিস্মরণীয় গানের সুর যে-কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে তাকে সঙ্গীত রসিকদের পক্ষে বিস্মৃত হওয়া কঠিন হবে৷ জেগে থাকবে ব্যক্তিগত স্মৃতিও৷