মানুষ
প্রফুল্ল রায
ঠিক দুপুরবেলা শেরমুণ্ডি পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টিটা নেমে গেল।
সেই ভোরে—আকাশ তখন ঝাপসা, রোদ ওঠেনি, বাঁশের লাঠির ডগায় রঙ-বেরঙের তালি মারা ঝুলিটা বেঁধে এবং ঝুলিসুদ্ধ লাঠিটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়েছিল ভরোসালালা সে আসছে রাজপুত ঠাকুর রঘুনাথ সিং-এর তালুক হেকমপুর থেকে, আপাতত যাবে শেরমুণ্ডি পাহাড়ের ওপারে টাউন ভকিলগঞ্জে.
ভোরে ভরোসালাল যখন হেকমপুর থেকে বেরোয় তখন আকাশের চেহারা দেখে টের পাওয়া যায়নি দুপুরের মধ্যেই চারদিক ভেঙেচুরে এভাবে বৃষ্টি নেমে যাবে। খুব নিরীহ চেহারার দু-চার টুকরো ভবঘুরে মেঘ মাথার ওপর বাতাসের ধাক্কায় ধাক্কায় এদিক-সেদিক ভেসে বেড়াচ্ছিল। তারপর বেলা একটু বাড়লে চাঁদির থালার মতো সূর্যটা আকাশের গড়ানে গা বেয়ে উঠে এসেছিল। গলানো রূপোর মতো ঝকঝকে রোদে মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গল ভেসে যাচ্ছিল তখন কিন্তু এই রোদ আর কতক্ষণ! বেলা আরেকটু চড়বার সঙ্গে সঙ্গে এক ছুঁতে বাতি নিভে যাবার মতো আচমকা চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছিল মকাইয়ের খেত, যবের খেত, আখের খেত, নানারকম ঝোপঝাড় আর হতচ্ছাড়া চেহারার দু-একটা গ্রাম পেরিয়ে আসতে আসতে ভরোসালালের অজান্তে কখন যে ভারী ভারী চাংড়া চাংড়া জলবাহী মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল, টের পাওয়া যায়নি ভরোসালাল চমকে উঠেছিল মেঘের ডাকে, সেই সঙ্গে তার চোখে পড়েছিল আকাশটা আড়াআড়ি চিরে বিদ্যুৎ ছুটে যাচ্ছে।
মাথার ওপরে মেঘ আর বিদ্যুৎচমক নিয়ে জোরে জোরে পা চালিয়ে দিয়েছিল ভরোসালালা আজ যেমন করেই হোক, তাকে শেরমুণ্ডি পাহাড়ের ওপারে ভকিলগঞ্জে পৌঁছতেই হবে।
হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ফিরিয়ে বার বার পেছন দিকটা দেখে নিচ্ছিল ভরোসালালা হঠাৎ একসময় অনেক, অনেক দূরে আকাশ যেখানে পিঠ বাঁকিয়ে দিগন্তে নেমেছে সেখানটায় বৃষ্টি নেমে গিয়েছিল। জল নামতে দেখে দৌড়তেই শুরু করেছিল ভরোসালাল কিন্তু বৃষ্টিটা নাছোড়বান্দা হয়ে তার পিছু নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত শেরমুণ্ডি পাহাড়ের তলায় এসে তাকে ধরেই ফেলেছে।
বেশ কোমর বেঁধেই নেমেছে বৃষ্টিটা। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে উল্টোপাল্টা ঝড়ো হাওয়া। এই ঝড়বৃষ্টি ঘাড়ে নিয়ে সামনের খাড়া পাহাড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভরোসালাল এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। এই মুহূর্তে মাথা বাঁচাবার জন্য কোথাও একটু দাঁড়ানো দরকার। হঠাৎ সে। দেখতে পেল, খানিকটা দূরে একটা ঝাঁকড়া-মাথা পিপুল গাছের তলায় দশ-বারোটা দেহাতী লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে একটা মেয়েও রয়েছে।
বোঝা যাচ্ছে, বৃষ্টির জন্যই ওরা ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছতলায় মাথা গুঁজে জলের ছাঁট থেকে নিজেদের যতটা বাঁচানো যায়। ভরোসালাল দৌড়ে সেখানে চলে গেল।
ভরোসালালের বয়স পঞ্চাশ-বাহান্না শরীরের কাঠামো দারুণ মজবুত চওড়া ছড়ানো কাঁধ তার, এবড়ো-খেবড়ো পাথরের মতো প্রকাণ্ড বুক, হাতদুটো জানু ছাড়িয়ে কয়েক আঙুল নেমে গেছে। গায়ের চামড়া পোড়া ঝামার মতো, সাত জন্মে সেখানে তেল পড়ে না। ফলে বারোমাস খসখসে কর্কশ গা থেকে খই উড়তে থাকে। চৌকো মুখে খামচা খামচা দাড়ি তার, থ্যাবড়া থুতনি। চেহারা যেমনই হোক, চোখদুটো কিন্তু আশ্চর্য মায়াবী যেমনি সরল তেমনি নিষ্পাপ।
ভরোসালালের পরনে হাঁটু পর্যন্ত খাটো টেনি আর ফতুয়ার মতো লাল কামিজ। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার ঘাড়ের অনেকখানি মাংস শুকিয়ে ডেলা পাকিয়ে প্রায় ঝুলে আছে। বাঘের থাবা খেয়ে ঘাড়টার অবস্থা এই রকম
ভরোসালাল একজন ‘বীটার’। এ অঞ্চলে যাকে জঙ্গল-হাঁকোয়া বলে সে তা-ই। তার কাজ হল বনে-জঙ্গলে টিন পিটিয়ে আর চেঁচিয়ে তাড়া করে করে বাঘ ভাল্লুক কিংবা অন্য জন্তু-জানোয়ারকে শিকারীদের বন্দুকের মুখে নিয়ে যাওয়া। বছর তিনেক আগে রক্সেলে এক শিকারীর জন্য টিন পেটাতে গিয়ে বাঘের থাবায় ঘাড়ের মাংস ওইভাবে ঝুলে গেছে। ‘বীটারের কাজ ছাড়া আরো একটা কাজ করে থাকে ভরোসালাল। চারিদিকে যত ছোটখাটো শহর আছে, সেসব জায়গায় মিউনিসিপ্যালিটিগুলো মাঝে মাঝে রাস্তার বেওয়ারিশ খ্যাপা কুকুর ধরে মেরে ফেলে। এই কুকুর ধরা আর মারার কাজটিও করে থাকে সে।
বীটারের কাজ কিংবা কুকুর মারার দায়িত্ব কেউ তাকে ডেকে দেয় না। ভরোসালাল নিজে থেকেই খোঁজ-খবর নিয়ে শিকারীদের বাড়ি বাড়ি কিংবা মিউনিসিপ্যালিটিগুলোর দরজায় দরজায় হানা দেয়। এটাই তার জীবিকা। খুবই নিষ্ঠুর হয়তো, কিন্তু স্রেফ পেটের জন্য এসব করতে হয় তাকে।
এদিকে বৃষ্টির জোর আরো বেড়েছে। আকাশের যা অবস্থা তাতে জল কখন ধরবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। ঝাঁকড়া-মাথা পিপুল গাছের তলায় দেহাতী মানুষগুলোর সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েও কি রেহাই আছে! ডালপালা আর পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরঝর জল পড়ে গা-মাথা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তবে খোলা জায়গায় দাঁড়ালে চোখের পলকে চান হয়ে যাবে। সেই তুলনায় এখানে ভেজাটা কম হচ্ছে, এই আর কি।
অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে তাকিয়ে বৃষ্টির ভাবগতিক দেখছিল ভরোসালাল। হঠাৎ পাশের লোকটা বলে উঠল, ‘বহোত ভারী বারিষ (বৃষ্টি)!
ভরোসালাল ঘাড় ফেরাল। দেখল—লোকটা মধ্যবয়সী, মাথায় পাগড়ী, ভাঙাচোরা চেহারা। সে বলল, ‘হাঁ–’।
লোকটা এবার বলল, মালুম হচ্ছে এ বারিষ জলদি রুখবে না। ‘ তার ভাষা হিন্দি এবং বাংলায় মেশানো। খুব সম্ভব বিহার-বাংলার সীমান্তে কোন অঞ্চলে তার বাড়ি।
ভরোসালাল বলল, ‘হাঁ–’।
মধ্যবয়সী লোকটা এবার তার সঙ্গীদের দেখিয়ে বলল, ‘দুফারে হামলোককো টেউন ভকিলগঞ্জে যাবার বাত ছিল। লেকিন কী করে যাই?
বোঝা যাচ্ছে, এরাও শেরমুণ্ডি পাহাড় পেরিয়ে ওপারে যাবে। ভরোসালাল কৌতূহলহীন চোখে লোকটার সঙ্গীগুলোকে একবার দেখে নিল। তারা অবশ্য এই লোকটার মতো মাঝবয়সী না, দামড়া মোষের মতো তারা একেকটা তাগড়া জোয়ান। তাদের দেখতে দেখতে সেই মেয়েটার দিকে নজর পড়ে গেল ভরোসালালেরা দলটার মধ্যে সে একা—একমাত্র মেয়ে।
জীবন বা মানুষ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা খুবই কম ভরোসালালেরা জোয়ান বয়সের শুরু থেকে বনের হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আর খ্যাপা কুকুরের পেছনে ছুটে ছুটে এতগুলো বছর কেটে গেছে। তার। তবু সে বুঝতে পারল মেয়েটা গর্ভিণী। দু-চার দিনের মধ্যে তার বাচ্চাটাচ্চা হবে।
পাশের লোকটা প্রচণ্ড বক বক করতে পারে। এবার সে যা বলল সংক্ষেপে এইরকম বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড়ী রাস্তার হাল খুবই বুরা (খারাপ হয়ে গেছে। এখন সেখানে উঠতে যাওয়া বোকামি,
পা পিছলে পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না—নির্ঘাত খতম হয়ে যেতে হবে মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ভরোসালাল বলল, হাঁ—’।
লোকটা এবার বলল, ‘লেকিন দুফারের ভেতর ভকিলগঞ্জে হাজির হতে না পারলে কামটা ছুটে যেতে পারে?’ তাকে খুবই চিন্তিত দেখাল।
‘কিসের কাম?’
‘ভকিলগঞ্জে নদীর কিনারে বাঁধ বানানো হবে। আমরা মাটি কাটার কামে যাচ্ছি। দেরি হয়ে গেলে গরমিন অফসর (গভর্নমেন্ট অফিসার) যদি ভাগিয়ে দ্যায়—’।
‘রামজী কিরপা করলে ভাগাবে না।’ বলতে বলতে আবার মেয়েটির দিকে তাকাল ভরোসালাল। পৃথিবীর কোন কিছু সম্বন্ধেই বিশেষ কৌতূহল নেই তারা নিজের পেটের জন্য বনে-জঙ্গলে বা লোকালয়ে সর্বক্ষণ তাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে অন্য দিকে চোখ তুলে তাকাবার সময় পর্যন্ত পায় না যদিও বা পায়, খুবই আগ্রহশূন্যভাবে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষকে দেখে থাকে। তবু আবছাভাবে ভরোসালাল ভাবল, ওই মেয়েটির পেটে অন্তত ন-দশ মাসের বাচ্চা রয়েছে। এ অবস্থায় সে-ও কি মাটি কাটতে চলেছে? জেনানাদের এ সময়টা কোনো ভারী কাজ করা ঠিক না ভাবল বটে, তবে কিছু বলল না।
সেই লোকটা ঘাড়ের পাশ থেকে বলে উঠল, রামজী কি কিরপা করবে?
ভরোসালাল এবার আর উত্তর দিল না। অন্যমনস্কের মতো মুখ ফিরিয়ে মেঘের ভারে নেমে আসা ঝাপসা আকাশ দেখতে লাগল।
কিন্তু উত্তর না দিলে কী হবে, পাশের লোকটা ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির মতো সমানে বকে যাচ্ছে।
কতক্ষণ পিপুল গাছটার তলায় দাঁড়িয়েছিল, খেয়াল নেই ভরোসালালের। হঠাৎ একসময় বৃষ্টির তোড় কমে এল, সেই সঙ্গে ঝড়ের দাপটও। তবে আকাশ ভারী হয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তে প্রবল বেগে আবার শুরু হয়ে যেতে পারে।
সেই লোকটা কানের পাশ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘বারিষ ধরে এসেছে। এই মওকায় পাহাড় পেরুতে হবে।’ বলেই সঙ্গীদের উদ্দেশে জোরে জোরে হাঁকল, ‘অ্যাই ছোকরারা—চল চল, জোরসে পা চালা’—সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে সে পাহাড়ের দিকে চলল।
দলটা আগে আগে চলেছে। তাদের পেছনে রয়েছে সেই মেয়েটা ভরোসালাল এই সুযোগটা ছাড়ল না। মেয়েটার পেছন পেছন সে-ও হাঁটতে লাগল। বৃষ্টির জোর নতুন করে বাড়বার আগেই সে-ও শেরমুণ্ডি পাহাড় পেরিয়ে যেতে চায়।
দিন কয়েক আগে ঠাকুর রঘুনাথ শিং শিকারে যাবে—এই খবরটা পেয়ে হেকমপুর তালুকে ছুটে গিয়েছিল ভরোসালাল। পুরো চারটে দিন রঘুনাথ সিংয়ের সঙ্গে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে টিন পিটিয়ে মোট দশটা টাকা আর তিন কিলো মাইললা মজুরি হিসেবে পেয়েছে। সেই টাকাটা তার কোমরে গোঁজা রয়েছে, আর মাইলোগুলো তার চিত্রবিচিত্র ঝুলিটায়।
হেকমপুরে থাকতে থাকতেই সে খবর পেয়েছিল, পূর্ণিয়া টাউনে দু-চার দিনের মধ্যে খ্যাপা কুকুর মারা হবে। তাই রঘুনাথ সিংয়ের শিকার শেষ হতে না হতেই সে বেরিয়ে পড়েছে। শেরমুণ্ডি পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারে টাউন ভকিলগঞ্জে আজকের রাতটা কাটাবে ভরোসালাল। তারপর কাল সকালে উঠে চলে যাবে সগরিগলি ঘাটে, সেখানে নদী পেরিয়ে পূর্ণিয়া টাউনের দিকে হাঁটা শুরু করবে।
যাই হোক, এই শেরমুণ্ডি পাহাড়টা ভয়ানক রকমের খাড়া তার সারা গায়ে ঘন অরণ্যা শাল আর মহুয়ার গাছই এখানে বেশি করে চোখে পড়ে। অবশ্য আমলকী, দেবদারু, কেঁদ আর ট্যারাবাঁকা চেহারার অগুনতি সিসম গাছও চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া আছে নানা ধরনের ঝোপঝাড়, সাবুই ঘাস এবং আগাছার জঙ্গল।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়ে চলার রাস্তা উঠে গেছে। সেই রাস্তা এই মুহূর্তে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেননা যদিও এটা একটা পাহাড়, তবু হাজার হাজার বছরের ঝড়বৃষ্টিতে পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এর গায়ের ওপর চামড়ার মতো মাটির একটা স্তর জমেছে। বৃষ্টিতে সেই মাটি গলা মাংসর মতো থকথকে হয়ে আছে।
খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওরা পাহাড় বাইছিলা বৃষ্টির জোর কমে এলেও অল্প অল্প পড়েই যাচ্ছে। হাওয়ার দাপটও আগের মতো নেই। দু-ধারের ঝোপ-ঝাড় থেকে ঝিঝিদের একটানা চিৎকার উঠে আসছিলা গাছের মাথায় সরু-মোটা, নানা বিচিত্র সুরে পাখিরা একটানা ডেকে যাচ্ছে। কোথায় যেন সাপেদের পেট টেনে টেনে চলার শব্দ হচ্ছে।
সেই মধ্যবয়সী লোকটা মাঝে মাঝেই তার সঙ্গীদের উদ্দেশে হেঁকে উঠছিল, ‘জলদি পা চালা। হো রামজী, দুফার পার হয়ে গেল!
চারিদিকের নানারকম শব্দ বা মধ্যবয়সী লোকটার হাঁকাহাঁকি শুনেও যেনে শুনতে পাচ্ছিল না ভরোসালাল। দূরমনস্কর মতো খাড়াই পাহাড় ভাঙছিল সো নেহাত বৃষ্টিটা হঠাৎ এসে গেছে। নইলে তাড়াহুড়ো করে ওপারে যাবার খুব একটা দরকার তার নেই। কারণ আজকের দিনটা তার বিশ্রামা টাউন ভকিলগঞ্জে একবার পৌঁছতে পারলে ধীরে সুস্থে হাত-পা ছড়িয়ে দিনের বাকি অংশটা সে কাটিয়ে দেবে। তারপর কাল থেকে আবার নতুন কাজের ধান্দা শুরু হবে। কিন্তু কালকের কথা কাল।
খানিকক্ষণ পাহাড় বাওয়ার পর হঠাৎ কাতর গোঙানির মতো একটা আওয়াজ কানে আসতে চমকে উঠল ভরোসালাল। সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সেই গর্ভিণী মেয়েটা পাহাড়ে ওঠার ক্লান্তিতে ভয়ানক হাঁপাচ্ছে। তার মুখটা খুলে অনেকখানি হাঁ হয়ে গেছে। তার ফাঁক দিয়ে থেকে থেকে গোঙানিটা বেরিয়ে আসছিল হাঁপানির দাপটে মেয়েটার বুক তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। চোখের তারা দুটো মরা মাছের চোখের মতো, মনে হচ্ছিল সে-দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।
প্রায় টলছিল মেয়েটা তার মধ্যেই হাতখানেক গভীর থকথকে কাদার ভেতর এলোপাথাড়ি পা ফেলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারছিল না। সে হয়তো ঘাড়-মুখ গুঁজে হুড়মুড় করে পড়েই যেত, তার আগেই পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল ভরোসালাল। বলল, ‘কেয়া, তুমহারা তবিয়ত আচ্ছা নেহী?
খুব নির্জীব গলায় মেয়েটা উত্তর দিল, নেহী—’। ভরোসালাল কি বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখে পড়ল সেই মাঝবয়সী লোকটা দামড়া মোষের মতো জোয়ান ছোকরাগুলোকে নিয়ে ঝোপ-ঝাড় ঠেলে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সে এবার অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘আরে তোমার সাথবালারা (সঙ্গীরা) বহোত দূর চলে গেল যে!’
মেয়েটা বলল, ‘আমি ওদের সাথে আসি নি।’
ভয়নক চমকে ওঠে ভরোসালাল, ‘মতলব (মানে)?’
‘আমি অকেলিই এসেছি।’
‘হো রামজী, শরীরের এই হাল নিয়ে তুমি অকেলিই বেরিয়ে পড়েছ!’
‘কী করব?’
‘কেন, তোমার মরদ কোথায়?’
মেয়েটা ভরোসালালের প্রকাণ্ড চওড়া বুকের ওপর শরীরের ভার রেখে খানিকটা সামলে নিয়েছিল। এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘সে আসতে পারল না’
ভরোসালাল জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’
‘মহাজনের খেতিবাড়িতে সে বেগার দিতে গেছে।‘
‘বেগার?
‘হাঁ—’ মেয়েটা এবার যা বলে, সংক্ষেপে এইরকম চার সাল আগে তাদের দেহাতের মহাজন বিষুণ আহীরের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল তার মরদা টাকাটা আর শোধ করা যায়নি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লোকটার, তার সিন্দুক সোনাচাঁদি আর জহরতের পাহাড় আর জমিজমা খেতিবাড়ির তো লেখাজোখা নেই। তাদের দেহাতে যেখানে যে জমিতে পা দেওয়া যাক না, সেটাই বিষুণ আহীরের। এত জমি, এত টাকা-পয়সা থাকলে কী হবে, লোকটা আস্ত কসাই। এই মেয়েটার মরদের সামান্য ক’টা টাকা উসুল করার জন্য বিষুণ তাকে বছরের পর বছর বেগার খাটিয়ে চলেছে। বছরে দু মাস মেয়েটার মরদকে বিষুণ আহীরের খেতিবাড়িতে বেগার দিতে হয়। সুদে আসলে বিষুণের টাকাটা ফুলেফেঁপে এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে দশ বছর বেগার দিলেও নাকি ওটা শোধ হবে না। এইরকম যখন অবস্থা তখন মেয়েটির মরদ তার সঙ্গে আসে কী করে?
সব শুনে ভরোসালাল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ঘরে মরদ ছাড়া আর কোঈ নেহী?’
‘নেহী?’
‘হো রামজী’ বলে একটু চুপ করে ভরোসালাল। পরক্ষণে আবার শুরু করে, ‘এবার তুমি চলতে পারবে?
মেয়েটা বলল, ‘পারব।’
‘বোত হোঁশিয়ার হয়ে পা ফেলে চল—‘
খুব সাবধানে চটচটে আঠালো কাদার ভেতর পা টেনে টেনে দু’জন এগুতে থাকে। সেই মধ্যবয়সী লোকটা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে শাল এবং সিসম গাছটাছের ভেতর উধাও হয়ে গেছে। এখন আর তাদের দেখা যাচ্ছে না। ইচ্ছা করলে লম্বা লম্বা পা ফেলে ভরোসালাল পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারে। কিন্তু মেয়েটাকে এ অবস্থায় ফেলে তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার, খ্যাপা কুকুর আর নিজের পেট ছাড়া পৃথিবীর কোনো ব্যাপারেই ভরোসালালের আগ্রহ নেই। তবু মেয়েটার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তার অল্পস্বল্প কৌতূহল হতে লাগল। সে বলল, তোমার গাঁও কোথায়?
মেয়েটি বলল, ‘পাঁচ মিল (মাইল) পশ্চিমে, নাম ঝুমরিতালিয়া—।’
‘গাঁও থেকেই এখন আসছ?’
‘হাঁ—’।
‘পাহাড়ের ওপারে কোথায় যাবে?’
‘টেউন ভকিলগঞ্জে—’
‘কোনো রিস্তার (আত্মীয়) বাড়ি?’
‘নেহী।’
‘তব?’
একটু চুপ করে থেকে মেয়েটা বলল, ‘আমি অসপাতাল (হাসপাতাল) যাচ্ছি।’
‘অসপাতাল কেন?’ বলেই ভরোসালালের মনে পড়ল মেয়েটা গর্ভিণী নিশ্চয়ই বাচ্চাটাচ্চা হবার ব্যাপারে হাসপাতালে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে আবার বলে উঠল, ‘সমঝ গিয়া, রামজীকা কিরপা—’
মেয়েটা মুখ নিচু করে হাঁটতে লাগল।
কিছুক্ষণ দু’জনই চুপচাপ।
এই শেরমুণ্ডি পাহাড়ের গায়ে নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নেই। ঝোপঝাড় এবং জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফাঁকা জায়গা দেখে দেখে চড়াই বেয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে।
একসময় মেয়েটি জড়ানো গলায় হঠাৎ ডেকে ওঠে, ‘এ আদমী—’।
ভরোসালাল ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়, কিছু বলবে?
‘হাঁ একগো বাত—।’
‘বল—।’
তক্ষুনি কিছু বলল না মেয়েটা। খানিকক্ষণ বাদে প্রায় মরীয়া হয়েই সে শুরু করল, ‘আমি অকেলি আওরত, তবিয়তের হালও খুব খারাপ। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড় বাইতে ডর লাগছে। তুমি আমাকে অকেলি ফেলে রেখে চলে যেও না।’
ভরোসালাল ভালো করে মেয়েটাকে লক্ষ্য করলা তার দুর্বল রক্তহীন শরীর, গর্তে বসে-যাওয়া চোখের কোলে গাঢ় কালি, পেরেকের মাথার মতো ঠেলে-ওঠা কণ্ঠার হাড়, মাংস-ঝরে-যাওয়া। লম্বাটে রোগা মুখ, শির-বার-করা সিকড়ে সিকড়ে হাত, ন-দশ মাসের বাচ্চাওলা স্ফীত পেট, বোতামহীন জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা টসটসে স্তন, স্তনের বোঁটার চারপাশে ভুসো কালির ছোপ, ইত্যাদি দেখতে দেখতে কেমন যেন মমতা বোধ করতে লাগল সে বলল, ‘আরে না-না, তোমাকে একলা ফেলে আমি যাচ্ছি না। টেউন ভকিলগঞ্জে আমিও যাচ্ছি। আমার সঙ্গে সঙ্গে তুমি সেই পর্যন্ত যেতে পারবে’।
মেয়েটির মুখচোখ দেখে মনে হল, একটা শক্তসমর্থ সবল পুরুষের ভরসা পেয়ে সে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে।
পাঁক ঠেলে ঠেলে দু’জনে চলেছে তো চলেছেই। আরো খানিকক্ষণ যাবার পর হঠাৎ ভরোসালাল লক্ষ্য করল, মেয়েটার পা ঠিকমতো পড়ছে না, আবার সে টলতে শুরু করেছে। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে তারা এবারও তাকে ধরে ফেলল ভরোসালাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল?’
মেয়েটা কাঁপা দুর্বল গলায় বলল, ‘মাথা ঘুরছে।’
হাঁটতে তখলিফ হচ্ছে?’
‘হাঁ।’
‘থোড়েসে জিরিয়ে নাও—’।
ওখানেই একটা পাথর দেখে বসে পড়ে মেয়েটা। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘চল—’কিন্তু পা ফেলতে গিয়ে আবার টলতে শুরু করে।
ভরোসালাল চিন্তিত ভাবে বলল, ‘মালুম হচ্ছে তুমি হেঁটে যেতে পারবে না। পা ফেলতে গেলেই টলছ, মাথায় চক্কর লাগছে। এক কাম করা যাক—’।
মেয়েটি নির্জীব গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী? ‘তোমাকে আমি ধরে ধরে নিয়ে যাই। তোমার যা হাল, অকেলি চলতে গেলে পড়ে গিয়ে বিপদ হয়ে যাবে।’
মেয়েটি আস্তে মাথা হেলায়। অর্থাৎ ভরোসালাল ধরে নিয়ে গেলে তার আপত্তি নেই। তা হলে সে বেঁচেই যায়।
ভরসালাল মেয়েটিকে ধরে ফেলল। এক হাতে তার কাঁধ বেড় দিয়ে আস্তে আস্তে আবার ওপরে উঠতে লাগল। খানিকটা যাবার পর সে টের পেল মেয়েটার হাঁটার শক্তি ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আর যত ফুরিয়ে আসছে ততই তার শরীরের সব ভার ভরোসালালের হাতের ওপর এসে পড়ছে। কাদাভর্তি পিছল পথে বাচ্চাসমেত একটি গর্ভিণী মেয়ের গোটা দেহের ওজন একটা হাতের ওপর নিয়ে এগুনো সম্ভব না। ভরোসালাল মেয়েটাকে প্রায় সাপটে বুকের ভিতর নিয়ে এল। সেই অবস্থাতেই তাকে নিজের সঙ্গে লেপটে নিয়ে পাহাড় ভাঙতে লাগল আর সমানে বিড় বিড় করতে লাগল, ‘হো রামজী—তেরে কিরপা, তেরে কিরপা—’
এতক্ষণ বৃষ্টির জোর ছিল না, তবে মিহি চিনির দানার মতো সেটা ঝরেই যাচ্ছিল। হঠাৎ আবার তোড়ে নেমে এল বৃষ্টিটা হাওয়া পড়ে গিয়েছিল সেটাও বৃষ্টির মতোই আচমকা উন্মাদ হয়ে পাহাড়ী জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সাঁই সাঁই ঘোড়া ছোটাতে শুরু করে দিল।
এদিকে মেয়েটির দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি শেষ হয়ে গেছে। তার কোমরের তলার দিকটা শরীর থেকে আলগা হয়ে যেন ঝুলে পড়ছে। ভরোসালাল দিশেহারা হয়ে পড়ল। গর্ভিণী মেয়েটাকে সে কথা দিয়েছে, শেরমুণ্ডি পাহাড় পার করে দেবো কিন্তু এখন, এই অবস্থায় কিভাবে যে তার এবং তার পেটের বাচ্চাটাকে রক্ষা করবে—ভেবে পাচ্ছে না।
কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই মনে মনে ভরোসালাল সব স্থির করে ফেলল।
মেয়েটার শরীরের যা হাল তাতে তাকে আর হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তা ছাড়া সেই পিপুল গাছটার মতো ঝাঁকড়া-মাথা এমন কোনো গাছ নেই যার তলায় গিয়ে কিছুক্ষণ মাথা গোঁজা যেতে পারে। আর বৃষ্টিটা এবার যেভাবে শুরু হয়েছে তাতে আদৌ থামবে কিনা, কিংবা থামলে কখন থামবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিতভাবে ভেজার চাইতে এগুবার চেষ্টা করাই ভালো।
ভরোসালাল করল কি, যেখানে কাদা কম এমন একটা জায়গা দেখে মেয়েটাকে শুইয়ে দিল। তারপর বাঁ কাঁধে লাঠির ডগায়-বাঁধা সেই চিত্রবিচিত্র ঝুলিটা নামিয়ে তার ভেতর থেকে দুটো ধুতি বার করে দ্রুত একটা বড় ঝোলা বানিয়ে ফেলল। মেয়েটাকে সেই ঝোলার ভেতর বসিয়ে, তার পাশে মাইলোগুলো রেখে নিজের পিঠে ঝুলিয়ে নিল। তারপর কাদার ভেতর বুড়ো আঙুল গেঁথে গেঁথে খুব সাবধানে পাহাড়ের গা বাইতে লাগল। দায়িত্ব যখন নিয়েছে তখন মেয়েটাকে নিরাপদে পাহাড় পার করে দিতেই হবে।
আকাশ থেকে লক্ষকোটি বৃষ্টির রেখা বল্লমের ফলার মতো ছুটে আসছিল। ঝড়ে চারপাশের অর্জুন-শাল-আমলকী আর সিসম গাছগুলো একেক বার মাটিতে নুয়ে পড়ছে, পরক্ষণেই সটান খাড়া হয়ে যায়। ঝোপঝাড় উল্টোপাল্টা খ্যাপা বাতাসে ছিঁড়ে-খুঁড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছিল। আকাশের গায়ে বড় বড় ফাটল ধরিয়ে বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টির সর্বনাশা চেহারা দেখতে দেখতে ভরোসালাল সমানে বলে যেতে লাগল, ‘হো রামজী তেরে কিরপা, হো রামজী তেরে কিরপা—’ বলতে বলতে থকথকে আঠালো কাদায় পায়ের আঙুলগুলোকে গজালের মতো গেঁথে গেঁথে সে ওপরে উঠতে লাগল।
পিঠে একটা ভরা গর্ভিণী মেয়ের বাচ্চাসুষ্ঠু দেহের সমস্ত ভার চাপানো। যদিও ভরোসালাল হাট্টাকাট্টা দুর্দান্ত শক্তিশালী মরদ, তবু তার শিরদাঁড়া যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, শ্বাস আটকে আসছে। তুমুল বৃষ্টি অনবরত চোখমুখে এমন ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে যাতে সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না ভরোসালাল। তাছাড়া দারুণ ঝড়ো হাওয়া তাকে ঠেলে দশ হাত একদিকে নিয়ে যাচ্ছে, পর মুহূর্তেই ধাক্কা মারতে মারতে পনেরো হাত অন্য দিকে সরিয়ে নিচ্ছে। জলে আর হাওয়ায় তার চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে এই প্রচণ্ড দুর্যোগের বিরুদ্ধে শরীরটাকে। ঢালের মতো খাড়া রেখে ভরোসালাল নিশানা ঠিক করে এগিয়ে যেতে লাগল আর কাতর সুরে একটানা বলে যেতে লাগল, ‘হো রামজী তেরে কিরপা, তেরে কিরপা—’
কতক্ষণ পর খেয়াল নেই, শেরমুণ্ডি পাহাড়ের মাথা ডিঙিয়ে যখন সে ওপারে গিয়ে নামল তখন বৃষ্টির দাপট থেমে এসেছে। ঝড়টাও আর নেই। আকাশের গায়ে মেঘ ক্রমশ পাতলা হয়ে যাচ্ছে। পিঠ থেকে মেয়েটাকে নামিয়ে ভরোসালাল দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ হাঁপাল, তার শরীরের সব শক্তি তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ভরোসালালের মনে হচ্ছিল শরীরের একটা হাড়ও আর আস্ত নেই, সমস্ত ভেঙেচুরে গেছে। শিরাটিরাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ঘাড়ের তলা থেকে অসহ্য একটা। যন্ত্রণা শিরদাঁড়া বেয়ে কোমরে, কোমর থেকে পা পর্যন্ত চমক দিয়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল।
অনেকক্ষণ বাদে খানিকটা ধাতস্থ হবার পর হঠাৎ সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল ভরোসালালেরা ধড়মড় করে মুখ তুলতেই দেখতে পেল তারা সারা গা, শাড়ি-জামা—সব ভিজে সপসপে হয়ে আছে। শরীরের চামড়া আর আঙুলের ডগাগুলো সিটিয়ে সাদা হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে যেই তার মুখের দিকে চোখ পড়ল অমনি চমকে উঠল ভরোসালালা মেয়েটার মুখ অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁচকে যাচ্ছে, ঠোঁটদুটো নীলবর্ণা দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা চাপতে চেষ্টা করছে সো ভরোসালাল ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল?
নিজের পেটের কাছটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গোঙানির মতো শব্দ করল মেয়েটা, এখানে বহোত দর্দা জলদি আমাকে অসপাতাল নিয়ে চল—’
পাহাড়ের তলা থেকে টাউন ভকিলগঞ্জ ঝাড়া পাঁচটি মাইল তফাতো সেখানে পৌঁছতে না পারলে হাসপাতালে যাওয়া যাবে না। ভরোসালাল শুধলো, ‘তুমি কি হেঁটে যেতে পারবে?
‘নেহী। আমার কোমর পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে।‘
ভরোসালাল সেটাই আন্দাজ করেছিল। এ অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে একটা পা ফেলাও মেয়েটার পক্ষে সম্ভব না। এদিকে ভরোসালালের শরীরে এমন শক্তি আর অবশিষ্ট নেই যাতে তাকে পিঠে ঝুলিয়ে আরো পাঁচ মাইল যেতে পারে। মেয়েটাকে পাহাড় পার করাতেই তার জিভ বেরিয়ে গেছে।
অবশ্য এই শেরমুণ্ডি পাহাড়ের তলায় ছোটখাটো একটা বাজার আছে। নামেই বাজার। একটা চাল-ডাল-নিমক-মরিচের দোকান, একটা পান-বিড়ি-খৈনিপাতার, তৃতীয় দোকানটা হল চায়েরা ব্যস, এই হল বাজারের নমুনা। তার গা ঘেঁষে একটা আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা, জনারের খেত, গেঁহুর খেত, যবের খেত আর এলোমেলোভাবে ছড়ানো নানা দেহাতের মধ্য দিয়ে টাউন ভকিলগঞ্জের দিকে চলে গেছে। ওই বাজারটার কাছে গেলে শহরে যাবার বয়েল গাড়ি পাওয়া যায়। তক্ষুনি তার খেয়াল হল, গাড়ি ভাড়া করলে কম করে পাঁচটি টাকা লাগবে। ঠাকুর রঘুনাথ সিংয়ের দেওয়া দশটি টাকা তার ট্যাঁকে গোঁজা আছে। এ-ই তার শেষ সঞ্চয়। ওই টাকা থেকে খরচ করা ঠিক হবে কিনা, ভাবতে লাগল ভরোসালাল। আর তখনই তার কানে অস্পষ্ট গোঙানির মতো আওয়াজটা এসে ধাক্কা দিল। ঘাড় ফেরাতেই সে দেখল, পেটের মাংস এক হাতে খামচে ধরে থেকে থেকে কাতর শব্দ করে উঠছে মেয়েটা।
আর কিছু ভাবার সময় পেল না ভরোসালাল। কেউ যেন আচমকা টান মেরে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। এক দৌড় বাজারের কাছ থেকে একটা বয়েল গাড়ি নিয়ে এল সে। তারপর পাঁজাকোলা করে মেয়েটাকে ছইয়ের তলায় নিয়ে শুইয়ে দিল। গাড়িওলাকে বলল, ‘জলদি টেউন চল ভেইয়া, বহোত জলদি—’।
গাড়িওলা ‘উর-র-র—’ বলে একটা শব্দ করে দুটো গোরুরই ল্যাজ মুচড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গোরু দুটো কাঁচা রাস্তা দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল।
এদিকে আকাশটা দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। মেঘের গায়ে অল্প অল্প ফাটল ধরিয়ে মরা মরা নির্জীব রোদ বেরিয়ে আসতে চাইছিল। রোদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, বেলা ফুরিয়ে এসেছে, একটু পরেই সন্ধে নেমে যাবে।
গাড়িতে উঠবার পর থেকে ভরোসালাল কোন দিকে আর তাকায়নি, মেয়েটাকেই শুধু লক্ষ্য করে যাচ্ছে। মেয়েটা কাত হয়ে বুকের কাছে হাত-পা গুটিয়ে অনবরত গুঙিয়ে যাচ্ছিল আর চোয়াল শক্ত করে শ্বাস আটকে যন্ত্রণা চাপবার চেষ্টা করছিল। ভরোসালাল ঝুঁকে খুব নরম গলায় শুধলো, এ জেনানা, খুব কষ্ট হচ্ছে?
মেয়েটা শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে মাথা নাড়ল শুধু, কিছু বলল না।
ভরোসালাল যে কী করবে, কী করলে মেয়েটার কষ্ট একটু কমতে পারে ভেবে পেল না সে শুধু শ্বাসরুদ্ধের মতো বিড়বিড় করতে লাগল, ‘হো রামজী তেরে কিরপা, হো পবনসূত তেরে কিরপা—।
মেয়েটা এবার বলল, ‘আমার বহোত ডর লাগছে।’
পরম মমতায় তার একটা হাত ধরে ভরোসালাল বলল, ‘ডর কী?’
মেয়েটার যন্ত্রণা যেন পাঁচগুণ বেড়ে গেল হঠাৎ। শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে যেতে লাগল তার, কপাল-গলা কণ্ঠ সব ঘামে ভিজে যাচ্ছে। গায়ের লোমগুলো হঠাৎ শীত লাগার মতো খাড়া হয়ে উঠেছে। চোখের তারা আস্তে আস্তে স্থির হয়ে যাচ্ছে।
ভরোসালাল অস্থির হয়ে উঠল। এই মেয়েটা পনেরো মাইল রাস্তা পেরিয়ে, মাঝখানে বিশাল পাহাড় ডিঙিয়ে মানুষের জন্ম দিতে চলেছে। মানুষ সম্বন্ধে প্রায় অনভিজ্ঞ ভরোসালাল জানে না কিভাবে তার শুশ্রষা করবো ভীতভাবে সে বলল, ‘এ জেনানা, তোমাদের এ সময় কী করতে হয়?’
কোমরের কাছটা ধরে মেয়েটা অত্যন্ত দুর্বল স্বরে বলল, ‘এখানে একটু সেঁক দিয়ে দাও—’।
এই বয়েল গাড়ির ভেতর কোথায় আগুন, কোথায় বা কী? কিন্তু যেভাবেই হোক সেঁকটা দিতেই হবে। উদভ্রান্তের মতো এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে ভরোসালালের চোখে পড়ল গাড়ির ছইয়ের নিচে এক ধারে একটা হেরিকেন ঝুলছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘাড় ফিরিয়ে গাড়িওয়ালাকে বলল, ‘ভেইয়া, তোমার হেরিকেনে তেল আছে?
গাড়িওলা বলল, ‘আছে, কেন?’
‘ওটা একটু জ্বালব। এই জেনানাকে সেঁক দিতে হবে।’
‘জ্বালতে পারো, তবে তেলের জন্য চার আনা দিতে হবে।’
‘দেব।’
‘তব ঠিক আছে।’
‘তোমার কাছে আগ আছে?’
‘আছে।‘ ‘গাড়িওলা কোমরের খাঁজ থেকে একটা দেশলাই বার করে ছুঁড়ে দিল।
ভরোসালাল হেরিকেন ধরিয়ে নিলা তারপর নিজের একটা কাপড়ের খানিকটা অংশ চার ভাঁজ করে হেরিকেনটার মাথায় বসিয়ে গরম করতে লাগল। সেটা বেশ তেতে উঠলে, আস্তে আস্তে মেয়েটার কোমরে সেঁক দিতে লাগল। অনেকক্ষণ সেঁক দেবার পর গোঙাতে গোঙাতে এক সময় মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধের অনেক পর বয়েল গাড়িটা টাউন ভকিলগঞ্জের সরকারী হাসপাতালে পৌঁছে গেল।
কিন্তু এত রাতে ডাক্তার সাহেবকে পাওয়া গেল না। তিন তাঁর কোয়ার্টারে চলে গেছেন।
যারা ছিল তারা বলল, ‘আজ তো হবে না, কাল নিয়ে এসো।’
ভরোসালালের মাথায় তখন পাহাড় ভেঙে পড়ার অবস্থা। মেয়েটাকে নিয়ে এই রাত্তিরে কোথায় রাখবে সে? সবার কাছে সে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, ‘কিরপা করে জেনানাকে ভর্তি করে নিন।’
হাসপাতালের লোকেরা জানাল, ডাক্তারসাব অর্ডার না দিলে কাউকে ভর্তি করা যাবে না। তখন মরীয়া হয়ে ডাক্তারসাবের কোয়ার্টারের ঠিকানা নিয়ে খুঁজে বার করল ভরোসালাল। তারপর তাঁর হাতে পায়ে ধরে, কিভাবে কত কষ্ট করে গর্ভিণী মেয়েটাকে পাহাড় পার করিয়ে এত দূরে নিয়ে এসেছে তার যাবতীয় বিবরণ দিয়ে বলল, ‘এখন আপনার কিরপা ডাগদরসাব।’
সব শুনে ডাক্তারসাব হাসপাতালে এসে মেয়েটিকে ভর্তি করে নিলেন।
এবারে ভরোসালালের দায়িত্ব শেষ। গাড়িওলাকে ভাড়া বাবদ পাঁচ টাকা আর তেলের দরুন চার আনা দিয়ে, আজ রাতের মতো একটা আস্তানার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল ভরোসালালা
পৃথিবীতে কেউ নেই তার। কাজেই পিছুটানও নেই। সে একেবারে ঝাড়া হাত-পা লোক। যখন যেখানে যায় সেখানে নিজের হাতে খানকতক রুটি সেঁকে নেয়। তারপর কারো বাড়ির দাওয়ায় কিংবা মাঠে-ঘাটে গাছতলায় শুয়ে পড়ে।
আজ আর কিছুই ভাল লাগছিল না ভরোসালালের আটা কিনে এনে ছানো, উনুন বানাও, কাঠকুটো জোগাড় করো—এত সব ঝঞ্চাট একটা দিনের জন্যে সে বাদ দিতে চায় ভরোসালাল করল কি, একটা দোকানে গিয়ে তেঁতুলের আচার আর নুন-লঙ্কা দিয়ে একদলা ছোলার ছাতু খেয়ে এসে এক বাড়ির খোলা বারান্দায় শুয়ে রইলা। কাল সকালে সে সগরিগলি ঘাটে যাবে। সেখান থেকে টাউন পূর্ণিয়া।
পরের দিন সকালে উঠে সগরিগলি ঘাটে যাবার সময় হঠাৎ ভরোসালালের মনে হল, মেয়েটার একটা খবর নিয়ে গেলে হয়। অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সে হাসপাতালেই এসে পড়ল এবং খবর নিয়ে জানল, এখনও মেয়েটার ছেলেপুলে কিছু হয়নি তবে যে-কোন মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে। আর জানল মেয়েটা ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে।
শেষ খবরটা পেয়ে মন খারাপ হয়ে যায় ভরোসালালেরা পৃথিবীর সব ব্যাপারেই সে উদাসীন তবু কাল পিঠে চাপিয়ে যাকে পাহাড় পার করিয়েছে, যার জন্য নিজের সঞ্চয় থেকে নগদ সোয়া পাঁচ টাকা খরচও করে ফেলেছে, গরম সেঁক দিয়ে যার সেবা করেছে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে জেনে আজ আর সগরিগলি যেতে মন করছে না। সে ঠিক করে ফেলল, ভালোয় ভালোয় মেয়েটার বাচ্চাটাচ্চা হয়ে গেলে সে পূর্ণিয়া টাউনে যাবে। গিয়ে হয়তো দেখবে মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা খ্যাপা কুকুর মারার জন্য অন্য লোক লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কি আর করা যাবে? ‘হো রামজী, হো পবনসূত—’
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এদিক-সেদিক খানিক ঘুরে বেড়াল ভরোসালাল। তারপর রুটি বানিয়ে খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে আবার সে এল হাসপাতালে। কিন্তু কোন খবর নেই। রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকাল আর বিকেলে দু’বার এল ভরোসালালা খবর। নেই।
দু’ দিন কাটবার পর উদ্বেগে তার দম যখন বন্ধ হয়ে আসছে সেই সময় ডাক্তারসাব হাসতে হাসতে বললেন, ‘বহুত বড়িয়া খবর—।
ভরোসালাল বলল, ‘হো গিয়া ডাগদরসাব?’
‘হো গিয়া।’
‘রামজীকা কিরপা, পবনসুতকা কিরপা—’ভরোসালালের চোখে আলো ঝিলিক দিয়ে গেল।
‘তোমার জেনানার লেড়কা হয়েছে। বহুত গোরা লেড়কা—’।
চমক লাগল ভরোসালালেরা ডাগদরসাব নিশ্চয়ই মেয়েটাকে তার আওরত ধরে নিয়েছে। ভুল শুধরে দেবার জন্য তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, ‘ও আমার আওরত না ডগদরসাব!’
‘তব?’ ডাক্তারসাব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ভরোসালাল বলল, ‘রাস্তায় আস্তে আস্তে জান-পয়চান (আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। আচ্ছা চলি ডাগদরসাব, রাম রাম।’ এবার পরম নিশ্চিন্তে সগরিগলি ঘাট পেরিয়ে পূর্ণিয়া যেতে পারবে।