মানুষ পিশাচ
প্রথম পরিচ্ছেদ – জনশূন্য আলিনগর
সন্ধ্যার আগেই আজ পৃথিবী অন্ধকার হবে৷ পশ্চিমের আকাশে এখনও খানিকটা জায়গা জুড়ে অস্তগত সূর্যের বুকের রক্ত-মাখানো আলো ছড়ানো আছে বটে, কিন্তু তার চিহ্ন তাড়াতাড়ি মুছে ফেলবার জন্যে হুহু করে বিরাট এক কালো মেঘ ধেয়ে আসছে৷
চারিদিকে ছোটো-বড়ো পাহাড় আর বনজঙ্গল; মাঝখানের উঁচু-নীচু পথ দিয়ে একখানা মোটরগাড়ি ছুটে আসছে ঊর্ধ্বশ্বাসে৷
গাড়ির ভিতরে বসে রয়েছে তিনজন যুবক ও একটি ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে; যুবকদের পরনে খাকি শার্ট ও প্যান্ট এবং প্রত্যেকেরই হাতে একটি করে বন্দুক৷
এ-অঞ্চলের ম্যাজিস্ট্রেট মি. সেনের পুত্র অমিয় আজ তার তিন অতিথি-বন্ধুর সঙ্গে পাখি-শিকারে বেরিয়েছে৷ তার বোন শীলাও আবদার ধরে তাদের সঙ্গে এসেছে৷ সারাদিন বনজঙ্গলে ঘুরে এখন তারা বাড়ি ফিরছে৷
অমিয়ের বন্ধু পরেশ বলল, ‘অমি, গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না৷ ঝড় উঠল বলে! কাছে কোথাও লোকালয় নেই?’
অমিয় গাড়ি চালাচ্ছিল৷ সে জবাব না দিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল৷
নিশীথ বলল, ‘অমি, যতই স্পিড বাড়াও, আজকের এই ঝড়কে তুমি কিছুতেই হারাতে পারবে না৷ ওই দেখো, আকাশের শেষ আলোও নিবে গেল৷’
শীলা আমোদ-ভরে গাড়ির গদির উপর বসে-বসে নেচে উঠে বলল, ‘ওহো, কী মজা! বন-জঙ্গলের ভিতরে থেকে আমি কখনো ঝড় দেখিনি! ভাগ্যিস আজ দাদার সঙ্গে এসেছি৷’
পরেশ ও নিশীথ হাসিমুখে শীলার দিকে তাকাল৷ বনজঙ্গলে ঝড় যে কী ভয়ানক, শীলা যদি তা জানত!
অমিয় বলল, ‘পরেশ, আর ঝড়কে এড়াবার চেষ্টা করা মিছে৷ ওই দেখো, মাঠের ওপারের গাছপালাগুলো দুলতে শুরু করেছে৷’
কালো আকাশে বজ্রবিদ্যুতের অভিনয় আরম্ভ হল৷ এবং শূন্যে মেঘপুঞ্জের তলায় দূরে এক তীব্রগতি ধুলোর মেঘ জেগে উঠল৷ এবং তফাত থেকেই শোনা গেল, বাতাসের মধ্যে ফুটল কেমন এক অশান্ত প্রলাপ৷
নিশীথ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দূরে লোকালয়ের মতো কী দেখা যাচ্ছে না?’
অমিয় এ-অঞ্চলে পথঘাটের খবর রাখত৷ সে বলল, ‘আমি ওইদিকেই যাচ্ছি৷ ওখানে আলয় আছে বটে, কিন্তু লোক নেই৷’
পরেশ বলল, ‘তার মানে?’
‘ওটা একটা ছোটো শহর৷ অনেক দিন আগে মড়কে ওখানকার বেশির ভাগ লোকই মারা পড়ে-বাকি সবাই পালিয়ে যায়, আর ফিরে আসেনি৷ ওর নাম আলিনগর৷ ওখানে এখন জনশূন্য পোড়ো ভাঙা বাড়ি আর ধ্বংসস্তূপ ছাড়া অন্য কিছুই নেই৷ তবে, ওরই মধ্যে কোনোখানে হয়তো মাথা গুঁজে আজকের মতো ঝড়কে ফাঁকি দিতে পারব৷’
পরেশ ও নিশীথ খুশি হয়ে বলল, ‘ব্যস, অল রাইট!’
শীলা কিন্তু কেমন যেন কুঁকড়ে পড়ে বলল, ‘ও দাদা, এই অন্ধকারে আলিনগরে গিয়ে কাজ নেই! তার চেয়ে মাঠে ঝড়ের ধাক্কা খাওয়া ঢের ভালো!’
অমিয় বিস্মিত স্বরে বলল, ‘কেন রে শীলা, আলিনগরে যেতে তোর আপত্তি কীসের?’
শীলা বলল, ‘আমাদের বাবুর্চির মুখে শুনেছি, আলিনগরে এখন যারা থাকে, তারা মানুষ নয়!’
‘মানুষ নয়? তুই কি বাঘ, ভালুক, হায়েনার কথা বলছিস?’
‘না দাদা, না! তারা নাকি মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু তারা মানুষ নয়! শুনেছি, তারা দিনে কবরে গিয়ে ঘুমোয়, রাত্রে বেরিয়ে এসে দেখা দেয়!’
তিন বন্ধুতে একসঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠল৷ এই একেলে মানুষগুলোর কানে সেকেলে ভূতের কথা ঠাট্টা-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ আজগুবি ভূতের গল্প শুনে বড়োজোর সকৌতুকে সময় কাটানো চলে, কিন্তু তা বিশ্বাস করবে খালি খোকা-খুকি আর মূর্খরা৷ অতএব অমিয় বলল, ‘তুই কি ভূতের কথা বলছিস? ছিঃ শীলা, এখনও তোর ও-সব কুসংস্কার আছে?’
কিন্তু শীলা কোনো জবাব দেওয়ার আগেই ঝোড়ো হাওয়া পাগলের মতো হুংকার দিয়ে তাদের উপরে লাফিয়ে পড়ল৷ প্রথম আক্রমণেই সে নিশীথের মাথা থেকে টুপি এবং শীলার হাত থেকে রুমাল কেড়ে নিয়ে ধূলায় ধূলায় চতুর্দিক আচ্ছন্ন করে দিল৷ অন্ধকার আকাশে বাজ চ্যাঁচাতে লাগল গলা ফাটিয়ে এবং এখানে ওখানে মড়মড় করে দু-তিনটে গাছ ভেঙে পড়ল৷ এক মুহূর্তেই পৃথিবীর রূপ গেল বদলে৷
তীক্ষ্ণ ধূলাবৃষ্টির মধ্যে অনেক কষ্টে তাকিয়ে অমিয় হেডলাইট জ্বেলে দেখল, খানিক তফাতেই ভাঙা মসজিদের মতো একখানা সাদা বাড়ি দেখা যাচ্ছে৷
তিরের মতো গাড়ি ছুটিয়ে সেইখানে গিয়ে থেমে পড়ে অমিয় বলল, ‘পরেশ, নিশীথ! শীলাকে নিয়ে শিগগির নেমে পড়ো! ওই মসজিদে গিয়ে ঢোকো!’
মসজিদের এক দিক ভেঙে পড়েছে, কিন্তু আর একটা অংশ তখনও কোনোগতিকে দাঁড়িয়ে আছে৷ সকলে তাড়াতাড়ি সেই অংশে গিয়ে আশ্রয় নিল৷
বাইরে তখন যে কাণ্ড হচ্ছে ভাষায় তা বোঝানো যায় না৷ কষ্টিপাথরের মতো কালো নিরেট অন্ধকারে পৃথিবীকে কানা করে খ্যাপা ঝড় আজ যেন বিশ্ব লুন্ঠন করতে চায়৷ দিকে দিকে বিদ্যুতের শত-শত অগ্নি-সর্প লেলিয়ে দিয়ে বজ্রভেরিতে মৃত্যু-রাগ পূর্ণ করে এবং অরণ্যের যন্ত্রণা-ভরা ছটফটানি শুনে বিপুল অট্টহাসি হেসে প্রলয় আনন্দে ঝঞ্ঝার তাণ্ডব চলতে লাগল৷
পরেশ সভয়ে বলল, ‘অমি, এ ভাঙা মসজিদ থরথর করে কাঁপছে! মাথার উপরে ভেঙে পড়বে না তো?’
শীলাকে নিজের আরও কাছে টেনে এনে অমিয় নাচারভাবে বলল, ‘ভেঙে পড়লেই বা উপায় কী?’
শীলা কাতরভাবে বলল, ‘ও দাদা, চলো, আমরা বাইরে পালিয়ে যাই!’
‘পাগল! বাইরে গেলে ঝড়ে উড়ে যাবি!’
প্রায় আধঘণ্টা পরে ঝড়ের বেগ কিছু কমে এল বটে, কিন্তু ঝম-ঝম-ঝম-ঝম করে বিষম বৃষ্টি শুরু হল৷ মসজিদের একটা দরজা-জানলারও পাল্লা ছিল না, বেগবান হাওয়ায় হুহু করে ভিতরেও জল ঢুকতে লাগল৷
নিশীথ বলল, ‘অমি, গাড়ি, থেকে টর্চটা এনেছ?’
‘এনেছি৷ কেন?’
‘একবার জ্বেলে দেখো তো কোনোদিকে শুকনো ঠাঁই আছে নাকি? অন্ধকারে আমার পা বাড়াতে ভয় হচ্ছে, যদি সাপ-টাপ কিছু থাকে!’
টর্চটা জ্বেলে একদিকে আলোর রেখা ফেলতেই অমিয় চমকে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে শীলা প্রায় কান্নার স্বরে বলে উঠল, ‘ও কে দাদা, ও কে?’
প্রকাণ্ড ঘরের আধখানা ছাদ ভেঙে পড়েছে, এবং মেঝের উপরে স্তূপের মতো জমে রয়েছে ভাঙা টালি, ইট, বালি-সুরকির চাঙড়, কড়ি ও বরগা প্রভৃতি৷ তারই ভিতরে স্থিরভাবে দুই হাঁটুর উপরে মুখ রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে অদ্ভুত এক মানুষের মূর্তি৷
দীর্ঘ, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দেহ, লম্বা লম্বা চুল মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে, গোঁফ-দাড়ি কামানো, পরনে একটা কালো ওভারকোট ও ঢিলে ইজের৷ কিন্তু তার চোখ দু-টো! মোটরের হেডলাইটের মতো সেই চোখ তীব্র দীপ্তিতে এমন উজ্জ্বল যে, তাদের দিকে তাকাতেও কষ্ট হয়৷ তার কালো পোশাক আর কালো মুখ কালো অন্ধকারে মিশিয়ে প্রায় অস্পষ্ট হয়ে আছে, কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে চোখ দুটো অপার্থিব বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে৷ দেখলেই বুকের কাছটা ধড়ফড় করতে থাকে৷
অমিয় অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে তুমি?’
গম্ভীর স্বরে মূর্তি বলল, ‘পথিক৷’
‘তোমার নাম কী?’
‘আমি পথিক, এই পরিচয়ই যথেষ্ট৷’
‘এখানে কেন?’
‘যেজন্যে তোমরা এখানে এসেছ, আমিও সেইজন্যেই এখানে৷’
‘এতক্ষণ সাড়া দাওনি কেন?’
‘দরকার হয়নি বলে দিইনি৷’
অমিয় টর্চ নিবিয়ে ফেলল, চারিদিকে আবার অন্ধকার নেমে এল৷ কিন্তু সকলের মনে হতে লাগল, সেই অন্ধকারের ভিতর হতে অপরিচিত মূর্তি যেন থেকে থেকে আগুনের ফিনকি ছড়িয়ে দিচ্ছে৷
অমিয়কে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে শীলা ভয়ার্ত স্বরে চুপিচুপি বলল, ‘দাদা, শিগগির, এখান থেকে বেরিয়ে চলো, নইলে আমি হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাব!’
পরেশ ও নিশীথও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিল৷ এতক্ষণ পরে পরেশ বলল, ‘অমি, এখানে দাঁড়িয়েও যখন ভিজতে হচ্ছে, তখন গাড়িতে গিয়ে বসাই ভালো৷’
বাইরে তখনও আঁধার রাত্রির বুকে মাথা ঠুকে ঝড় চ্যাঁচাচ্ছে গোঁ-গোঁ-গোঁ-গোঁ, গাছেরা পরস্পরের গায়ে আছড়ে পড়ে কেঁদে ককিয়ে বলছে সর-সর-সর-সর এবং শূন্যের অসীম সাগর উছলে জলের ধারা ঝরছে রম-ঝম, রম-ঝম৷
অমিয় কান পেতে শুনে বুঝল, পাহাড়ের পথের উপর দিয়েও কলকল করে জলস্রোত ছুটছে৷ এ-পথে মোটর চালানো এখন মোটেই নিরাপদ নয় বটে, কিন্তু এই ভাঙা মসজিদের ফুটো ছাদের তলায় অন্ধকারে এই বিচিত্র মূর্তির সঙ্গে এখানে থাকতে তারও আর ইচ্ছা হল না৷ সে শীলার হাত চেপে ধরে বলল, ‘চলো, আমরা গাড়িতে গিয়ে বসি৷’
অন্ধকারে ভিতরে একটা অস্ফুট শব্দ হল-কে যেন চাপা গলায় হাসল৷
অমিয়ের ভয়ানক রাগ হল; তারা ভয় পেয়ে পালাচ্ছে ভেবে ওই লোকটা কি ঠাট্টার হাসি হাসছে? কিন্তু শীলার কথা ভেবে রাগ সামলে সে একেবারে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল৷
শীলা বলল, ‘তখুনি বলেছিলাম দাদা, এখানে এসো না!’
অমিয় জোর করে হেসে বলল, ‘আরে গেলো, তুই কি ভেবেছিস লোকটা ভূত?’
শীলা বলল, ‘ও ভূত কি না জানি না, কিন্তু ওকে দেখে আমার বুকের রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছিল!’
‘তোর সবতাতেই বাড়াবাড়ি৷ নে, এখন গাড়িতে উঠে বোস!’
গাড়ির উপরে উঠে ধুপ করে বসে পড়ে, শীলা বলল, ‘শিগগির স্টার্ট দাও দাদা, এখানে আর আধ মিনিটও নয়!’
পরেশ ও নিশীথ গাড়িতে গিয়ে বসল৷ অমিয় গাড়ি স্টার্ট দিল৷
কিন্তু পথ তখন ছোটোখাটো নদীতে পরিণত হয়েছে-প্রায় হাঁটু-সমান জল সশব্দে ছুটে চলেছে৷ এ-পথে কেমন করে গাড়ি চালাবে তাই ভাবতে ভাবতে অমিয় হেডলাইটটা জ্বেলে দিল৷
কিন্তু ওরা আবার কে? হেডলাইট-এর জোর আলো সুমুখের পথে পড়তেই দেখা গেল, ছয়জন লোক পাশাপাশি গাড়ির দিকেই পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে৷
পরিত্যক্ত আলিনগর, দিনের বেলাতেই সেখানে মানুষের দেখা মেলে না, কিন্তু আজ সন্ধ্যার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে, জলে-ঝড়ে-দুর্যোগে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কারা এরা? এই কি পথে বেড়াবার সময়?
শীলা, পরেশ ও নিশীথ তাদের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল৷
পাশের জঙ্গল থেকে কতকগুলি শেয়াল সমস্বরে কেঁদে উঠল৷ যেন তারা এদের চেনে, যেন তারা এদের ভয় করে, যেন তারা পৃথিবীর জীবদের সাবধান করে দিচ্ছে!
অমিয় ঘন ঘন মোটরের হর্ন বাজাতে লাগল৷
কিন্তু তারা যেন শুনতে পেল না,-তালে তালে যেন মেপে মেপে পা ফেলে তারা সমানে এগিয়ে আসছে-যেন সব দম-দেওয়া কলের মূর্তি! প্রত্যেকের পরনে সাদা কাপড়, প্রত্যেকের দেহের উপর দিকটা আড়ষ্ট এবং প্রত্যেকের হাতদুটো পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর হাতের মতো দু-পাশে স্থিরভাবে ঝুলছে,-চলছে কেবল তাদের পাগুলো-
সেই জলে-ঝড়ে অমিয়ের দেহ ঘেমে উঠল; চেঁচিয়ে বলল, ‘কে তোমরা? আমার হর্ন শুনতে পাচ্ছ না? সরে যাও-নইলে মরবে!’
তারা কেউ সাড়া দিল না, পথ জুড়ে তালে তালে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷ যেন তারা থামতে জানে না, কার অভিশাপ যেন তাদের কিছুতেই থামতে দেয় না, যন্ত্রচালিতের মতো তাদের যেন চলতেই হবে সারা পৃথিবীর মাটি মাড়িয়ে অনন্ত-অনন্তকাল ধরে!
অমিয় বলল, ‘ডাকাত নয় তো? পরেশ! নিশীথ! বন্দুক নাও!’
সকলে আপন-আপন বন্দুক তুলে নিল৷ তবু যারা আসছে তারা থামল না, ভয়ও পেল না৷
অমিয় চেঁচিয়ে বলল, ‘আর এক-পা এগোলেই গুলি করব!’
ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ করে পায়ের শব্দ তুলে মূর্তিগুলো আরও কাছে এসে পড়ল৷
অমিয় মহা ফাঁপরে পড়ে ভাবতে লাগল-কারা এরা? ডাকাত, না পাগল? না এরা ভাবছে যে, বন্দুক ছুড়ব বলে আমরা ঠাট্টা করছি? কিন্তু আর তো ওদের কাছে আসতে দেওয়া উচিত নয়, গাড়িতে শীলা রয়েছে, কোনো বিপদ হলে বাড়িতে গিয়ে মুখ দেখাব কেমন করে? যা হয় হোক, আমার কথা না শুনলে এবার আমি বন্দুক ছুড়বই!
সে আবার শুষ্ক স্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘এই শেষবার বলছি, পথ ছেড়ে দাও৷’
তারা সমানে এগিয়ে আসছে, আসছে, আর আসছেই৷ হেডলাইট-এর তীব্র আলোকে তাদের রুক্ষ চুল ও বিস্ফারিত স্থির চোখের পাতা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ ছয়জোড়া নিষ্পলক চোখের পূর্ণদৃষ্টি অমিয়দের দিকে স্থির হয়ে আছে-প্রত্যেক চোখ যেন মড়ার চোখ৷
তিনজনেই বন্দুক তুলে লক্ষ্য স্থির করল৷ মূর্তিগুলো যখন গাড়ির কাছ থেকে দশ-বারো হাত তফাতে এসে পড়েছে অমিয় তখন বলল, ‘আমি তিন গুনলেই তোমরা বন্দুক ছুড়ো!’
তবু তারা থামল না৷
‘এক!’ . . .
‘দুই!’ . . .
‘তিন!’ . . .
গুড়ুম, গুড়ুম, গুড়ুম! তিনজনেই বুঝল, তাদের লক্ষ্য ভুল হয়নি-এত কাছ থেকে ভুল হতেই পারে না, কিন্তু তবু সেই মূর্তিগুলো তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে-আরও এগিয়ে- আরও এগিয়ে আসতে লাগল৷
এ কী অসম্ভব ব্যাপার!
আচম্বিতে ভাঙা মসজিদের ভিতর থেকে হা-হা-হা-হা করে কে বন্য পশুর কন্ঠে মানুষের স্বরে ভয়াবহ অট্টহাসি হাসতে লাগল৷
শীলা আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গদির উপর লুটিয়ে পড়ল৷
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মরা মানুষের জ্যান্ত চোখ
‘দিনে দিনে হল কী? দুনিয়ার বড়ো বড়ো সাধুর অভাব হয়েছে অনেক দিনই৷ আজকাল আবার বড়ো অসাধুরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না৷ পুলিশ কোর্টের রিপোর্টে দেখছি খালি কতকগুলো গাঁটকাটা আর ছিঁচকে চোরের ইতিহাস৷ দুত্তোর খবরের নিকুচি করেছে!’-এই বলে জয়ন্ত খবরের কাগজখানা সজোরে মাটির উপরে ছুড়ে ফেলে দিল৷
মানিক কফি তৈরি করতে করতে বলল, ‘শহরে বড়ো বড়ো চোর-ডাকাত-খুনে নেই, এটা তো পুলিশের কৃতিত্বের পরিচয়৷ এ-জন্যে আমাদের সুন্দরবাবুও অনায়াসে বাহাদুরি দাবি করতে পারেন৷’
‘কিন্তু চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাপি না থাকলে পুলিশেরও চাকরি থাকবে না, আর আমাদেরও সময় কাটবে না৷’
মানিক কফির পেয়ালা জয়ন্তের সামনে এগিয়ে দিল৷
পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘কেবল তাই নয়৷ অপরাধীর অভাবে কোনো-কোনো দেশে পুলিশের অত্যন্ত দুর্দশাও হয়৷ ইউরোপের একটা শহরে চোরেরা একবার ধর্মঘট করেছিল তা জানো?’
মানিক আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কীরকম? চোরদের ধর্মঘট? এ যে গৃহস্থের পক্ষে মস্ত বড়ো সুখবর!’
‘হ্যাঁ, গৃহস্থের পক্ষে৷ কিন্তু যে শহরের কথা বলছি, সেখানকার পুলিশ এটা সুখবর বলে মনে করেনি৷ শহরবাসীরা হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখল, রাস্তায় রাস্তায় দেওয়ালের গায়ে এই বিজ্ঞাপন : চুরি-ব্যবসায় অচল হইয়া পড়িয়াছে৷ পুলিশ এত বেশি ঘুস দাবি করে যে, চোরাই মাল বেচিয়া আমাদের আর কোনো লাভ থাকে না৷ পুলিশের এই অন্যায় দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার জন্য এই নগরের চোর-সম্প্রদায় অদ্য হইতে চৌর্যবৃত্তি পরিত্যাগ করিল৷’
‘তার পর৷’
‘তার পর আর কী! দু-চারদিন পরেই সেখানকার পুলিশ মানতে বাধ্য হল যে, অঃতপর চোরদের কাছ থেকে আর অত বেশি ঘুস দাবি করবে না৷ তখন চোরেরা আবার ধর্মঘট বন্ধ করল৷’
এমন সময় পায়ের শব্দে বাড়ি কাঁপিয়ে এবং সুবিপুল ভুঁড়ি দুলিয়ে ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন৷ এদিকে-ওদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘এই যে, চা খাওয়া হয়ে গেছে দেখছি!’
জয়ন্ত বলল, ‘না, আমরা এইমাত্র কফি শেষ করলাম৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! কফি? এই গরমে? ওরে বাপরে, তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে! একশো টাকা বখশিশ দিলেও আমি এখন এক কাপ কফি খাব না!’
জয়ন্ত বলল, ‘একশো টাকা বা কফির কাপ কিছুই আপনার ভাগ্যে নেই৷ আপনার জন্যে এখনই এক পেয়ালা চা আসবে৷’
‘আর টোস্ট, ডিম, জ্যাম?’
‘তাও আসবে৷ আপনি নির্ভয়ে চেয়ারে বসে পড়ুন৷’
ইতিমধ্যে মানিক খবরের কাগজখানা কখন মাটি থেকে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে৷ সে বলল, ‘জয়, তুমি কি আজকের কাগজখানা ভালো করে পড়নি?’
‘না, পুলিশ-কোর্টের কলম ছাড়া আর কিছু আমি দেখিনি৷’
‘চট্টগ্রাম থেকে এদের নিজস্ব সংবাদদাতা কী লিখেছে জানো?’
‘না৷’
‘শোনো তা হলে,’ বলে মানিক পড়তে আরম্ভ করল :
‘বিভীষণ বিভীষিকা! রহস্যময় মেয়ে-চুরি!
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের চতুর্দিকস্থ গ্রামে গ্রামে ভীষণ বিভীষিকার সঞ্চার হইয়াছে! মাসাধিক কালের মধ্যে এখানে তিন-তিনটি পরিবারের তিনটি মেয়েকে কে বা কাহারা চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে৷
‘আসল ব্যাপার কিছুই বুঝা যাইতেছে না৷ এমন অদ্ভুত কাণ্ড এ-অঞ্চলে আর কখনো হয় নাই৷ পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে বটে, কিন্তু যে তিমিরে সেই তিমিরেই পড়িয়া আছে৷
‘প্রথম ঘটনাটি এই : বীরনগর গ্রামের মধুসূদন কর্মকারের বড়ো মেয়ে প্রমদা, সন্ধ্যার সময়ে গ্রামের প্রান্তে পুষ্করিণীতে গিয়াছিল৷ কিন্তু সে আর ফিরিয়া আসে নাই৷ প্রথমে সবাই ভাবিয়াছিল, সে জলে ডুবিয়া গিয়াছে৷ কিন্তু পুষ্করিণীর তলা পর্যন্ত তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও তাহার দেহ পাওয়া যায় নাই৷ প্রমদার বয়স পনেরো বৎসর মাত্র৷ সবে গত মাসে তাহার বিবাহ হইয়াছে৷
‘দ্বিতীয় ঘটনার বিবরণ : বীরনগর হইতে দশ মাইল তফাতে চণ্ডীপুর৷ শ্রীযুক্ত পঞ্চানন চৌধুরী এখানকার একজন বিশিষ্ট গৃহস্থ৷ তাঁহার দৌহিত্রীর নাম কুমারী কমলা দেবী, বয়স ষোলো বৎসর৷ এক রাত্রে গুমোট গরমে ঘুম হইতেছিল না দেখিয়া কমলা বাহিরের বারান্দায় আসিয়া শয়ন করে৷ শেষ রাত্রে হঠাৎ কমলার ভীত চিৎকারে বাড়ির আর সকলের ঘুম ভাঙিয়া যায়৷ কমলার পিতা ও পঞ্চাননবাবু প্রভৃতি বারান্দায় ছুটিয়া আসেন৷ কিন্তু কমলা তখন অদৃশ্য হইয়াছে৷
‘পুলিশের তদন্তে আর একটি অদ্ভুত বিষয় প্রকাশ পাইয়াছে৷ বাড়ির সকলে যখন কমলার জন্য খোঁজাখুঁজি ও ছুটাছুটি করিতেছিলেন, তখন গ্রামের পথ হইতে কে নাকি ভয়াবহ অট্টহাস্য করিয়া উঠিয়াছিল৷ সেদিন অমাবস্যার রাত্রি ছিল, সকলে অন্ধকার পথে ছুটিয়া যায়; কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পায় নাই৷ কেবল এক আশ্চর্য শব্দ শোনা যায়৷ অনেকগুলি লোক যেন একসঙ্গে সৈন্যদলের মতো সমতালে সশব্দে পা ফেলিয়া চলিয়া যাইতেছে৷
‘তৃতীয় ঘটনা ঘটিয়াছে মাত্র দুই দিন আগে৷ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি. আর. এন. সেনের একমাত্র কন্যা কুমারী শীলা, তাঁহার ভ্রাতা মি. অমিয় সেনের সঙ্গে শিকার দেখিতে গিয়াছিলেন৷ পোড়ো শহর আলিনগরের কাছে কাহারা নাকি আক্রমণ করিয়া কুমারী শীলাকে লইয়া পলাইয়া গিয়াছে৷ এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এখনও প্রকাশ পায় নাই, যথাসময়ে আমরা সব কথা জানাইব৷
‘এখন প্রশ্ন হইতেছে, এ-কালে ইংরেজ রাজত্বের কোনো জায়গায় উপরি-উপরি এমন তিন-তিনটি ঘটনা ঘটা সম্ভব কি না? যদি সম্ভবপর বলিয়া স্বীকার করিতেই হয়, তবে অনর্থক এই বিপুল পুলিশ বাহিনী পুষিয়া লাভ কী! যেখানে ম্যাজিস্ট্রেটের কন্যা পর্যন্ত চুরি যায়, সেখানে সাধারণ দরিদ্র প্রজারা কাহার মুখ চাহিয়া বাস করিবে? আমরা পুলিশের এই অকর্মণ্যতার দিকে গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি৷’
ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু শুনতে শুনতে মুখগহ্বরে আধখানা টোস্ট নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়েছিলেন৷ কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে তাঁর আর টোস্ট খাওয়া হল না, তিনি চটে-মটে বলে উঠলেন, ‘হুম! যত দোষ নন্দ ঘোষ! যেখানে যা-কিছু দুর্ঘটনা ঘটবে তার জন্যে দায়ী হচ্ছি আমরাই!’
জয়ন্ত জবাব দিল না, নীরবে নস্যদানি বার করে একটিপ নস্য নিল৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘সব ব্যাপারগুলোই আজগুবি! চোরেরা যে চুরি করতে এসে অট্টহাসি হাসে আর গোরাদের মতো তালে তালে পা ফেলে চলে, এটা এই প্রথম শুনলাম৷ তারা তো উদয়শঙ্করের মতো তালে তালে নাচতে নাচতে পালালেও পালাতে পারত৷’
বেয়ারা ঘরে ঢুকে বলল, ‘একজন সায়েববাবু ডাকছেন৷’
জয়ন্ত বলল, ‘এখানে নিয়ে এসো৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘সায়েববাবু আবার কী জীব?’
‘আমাদের বেয়ারা বিলাতি পোশাকে বাঙালিকে ওই নামে ডাকে৷’
ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল একটি তরুণ যুবক৷ তার পরনের বিলাতি পোশাক ইস্ত্রিহীন, এলোমেলো, মাথায় টুপি নেই-ব্যান্ডেজ বাঁধা, চক্ষের দৃষ্টি উদভ্রান্ত৷ দেখলেই মনে হয় সে যেন অত্যন্ত চিন্তিত ও বিপদগ্রস্ত৷
জয়ন্ত শুধাল, ‘আপনি কাকে চান?’
‘জয়ন্তবাবুকে৷ আমি ভয়ানক বিপদে পড়ে ছুটে এসেছি-‘
‘আমারই নাম জয়ন্ত৷ আপনার নাম জানতে পারি কি?’
‘আমার নাম অমিয় সেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে আসছি৷’
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি একখানা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসুন৷ খবরের কাগজে বোধ হয় এইমাত্র আপনারই নাম দেখেছি৷ আপনি তো চট্টগ্রামের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি. আর. এন. সেনের পুত্র?’
অমিয় চেয়ারে বসে পড়ে বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ ব্যাপারটা যখন আগেই শুনেছেন তখন আমি কেন যে এখানে এসেছি, সেটাও বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন?’
‘আপনার ভগ্নীকে আপনি উদ্ধার করতে চান?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, শীলাকে উদ্ধার না করে বাবার কাছে আর মুখ দেখাব না৷’
‘তাহলে আগে সমস্ত ঘটনা আমাদের কাছে খুলে বলুন৷’
অমিয় খানিকক্ষণ চুপ করে রইল৷ তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘কিন্তু সব শুনে আপনি হয়তো পাগল বা মিথ্যাবাদী বলে মনে করবেন৷’
‘কেন?’
‘সমস্ত ঘটনাটাই এমন অসম্ভব যে, আমার বাবাও আমার কথা বিশ্বাস করেননি৷ অথচ আমার প্রত্যেক কথাই সত্য৷’
‘হোক অসম্ভব, তবু কোনো কথাই আপনি যেন গোপন করবেন না৷ কিছু লুকোলে আমি আপনার কোনো উপকারেই লাগব না, এইটুকু খালি দয়া করে মনে রাখবেন৷’
অমিয় তার কাহিনি বলতে লাগল৷ সে যা বলল তার অধিকাংশই আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেছি-গাড়ির উপরে শীলার মূর্ছিত হয়ে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত৷ অতএব এখানে অমিয়ের কথার শেষ অংশ মাত্র দেওয়া হল :
‘ওদিকে ভাঙা মসজিদের ভিতর থেকে সেই অমানুষি হাসি, এদিকে বন্দুকের গুলিতে আহত হয়েও নির্বিকারের মতো সেই ছয়টা আড়ষ্ট দেহ একেবারে আমাদের গাড়ির কাছে এসে পড়েছে৷ আমার পাশেই শীলার মূর্ছিত দেহ পড়ে রয়েছে, চারিদিকে ঝোড়ো হাওয়ার প্রচণ্ড নিশ্বাস, বৃষ্টির ঝরঝর কান্না, মাথার উপরে আকাশ ঘন ঘন জ্বালছে বিদ্যুৎ-চকমকির ফিনকি৷ আমি যেন কেমন আচ্ছন্নের মতন হয়ে গেলাম এবং সেই অবস্থাতেই বুঝতে পারলাম, পরেশ ও নিশীথও গাড়ির ভিতরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে৷
‘গাড়ির সামনে এসে মূর্তিগুলো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ সেই সময়ে তাদের চোখগুলো দেখে আমার বুক শিউরে উঠল৷ মরা মানুষ তাকিয়ে দেখলে বোধ করি তাদের দৃষ্টিও এইরকম দেখতে হয়! সে চোখগুলো যেন তাকিয়ে আছে মাত্র, কিন্তু তাদের ভিতরে কোনো ভাবেরই আভাস নেই এবং তারা চোখ খুলে তাকিয়েও যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না!
‘মূর্তিগুলো হঠাৎ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল৷ তিনজন এল গাড়ির বাঁ পাশে, আর তিনজন এল ডান পাশে৷ সঙ্গে সঙ্গে হেডলাইটের আলোক-রেখা ছাড়িয়ে তাদের দেহগুলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল৷
‘তার পর আমি কী করব-না-করব ভাবতে-না-ভাবতেই আচম্বিতে দুখানা বিষম কঠিন হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরল৷ সে-হাত দু-খানা কেবল কঠিন নয়, কী অস্বাভাবিক ঠান্ডা! আমি প্রাণপণে বাধা দিয়েও তাদের ঠেকাতে পারলাম না, হাত দুখানা আমাকে এক টানে শূন্যে তুলে ধরে ছুড়ে ফেলে দিল,-মাটিতে পড়ে মাথায় চোট লেগে আমিও তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলাম এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে আবার শুনতে পেলাম সেই অমানুষি হা-হা-হা-হা হাসি৷
‘যখন জ্ঞান হল তখন মেঘলা আকাশে ঝাপসা ভোরের আলো ফুটে ওঠবার চেষ্টা করছে৷
‘গাড়ির হুডের উপরে মাথা রেখে পরেশ ও নিশীথ অভিভূতের মতো পড়ে রয়েছে৷
‘আমি পাগলের মতো গাড়ির কাছে ছুটে গিয়ে ডাকলাম, শীলা! শীলা! পরেশ ক্ষীণ স্বরে বলল, শীলা নেই!
‘আমার কথা আর বেশি বাড়াব না৷ কেবল এইটুকুই জেনে রাখুন, প্রায় বৈকাল পর্যন্ত আমরা তিনজনে আলিনগরের সমস্তটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলাম৷ কিন্তু পেলাম খালি পোড়ো বাড়ির পর পোড়ো বাড়ি, ধ্বংসস্তূপের পর ধ্বংসস্তূপ-সেখানে কোথায় শীলা, কোথায় সেই ছয়টা অদ্ভুত মূর্তি, আর কোথায় ভাঙা মসজিদে দেখা সেই ঘোর কালো লম্বা লোকটা! কারুর কোনো চিহ্ন নেই৷
‘কীরকম মন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম, আর সমস্ত শুনে মা ও বাবার অবস্থাই বা হল কীরকম, এখানে সে-সব কথা বলবার দরকার নেই৷
‘নিশীথ আপনার শক্তির কথা জানে৷ সেই-ই আমাকে পরামর্শ দিল আপনার কাছে আসতে৷ তখন আহত দেহে চট্টগ্রাম থেকে আপনার কাছে চলে এসেছি জয়ন্তবাবু, এখন আপনার সাহায্যই আমার শেষ ভরসা৷’
অমিয় স্তব্ধ হল, জয়ন্ত গম্ভীর মুখে বারবার নস্য নিতে লাগল৷
মানিক খবরের কাগজখানা নিয়ে আর-একবার পড়তে বসল৷
খানিক পরে এই নীরবতা সইতে না পেরে সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘হুম! মি. সেন, আপনি যা বললেন তার কিনারা করা জয়ন্ত বা পুলিশের কাজ নয়!’
অমিয় করুণ স্বরে বলল, ‘তবে আমার কী হবে?’
‘যা শুনলাম তা যদি পাগলের প্রলাপ না হয়, তাহলে রীতিমতো ভৌতিক ব্যাপার বলেই মানতে হয়৷ জয়ন্ত কি পুলিশ, ভূত ধরতে পারবে না, আপনি কোনো ভালো রোজার খোঁজ করুন৷ আপনার বোনকে ভূত উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে৷’
অমিয় অসহায়ের মতন কাতরভাবে জয়ন্তের মুখের পানে তাকিয়ে রইল৷
জয়ন্ত আর-একটিপ নস্য নিয়ে বলল, ‘মানিক, জিনিসপত্তর সব গুছিয়ে নাও৷ অমিয়বাবুর সঙ্গে আজই আমরা চট্টগ্রাম যাত্রা করব৷’
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পদচিহ্ন ও গোরস্থান
জনশূন্য আলিনগর৷ চারিধারে ছোটো ছোটো পাহাড়ের ঢেউ-খেলানো প্রাচীর, বাতাসের ছোঁয়ায় ঐকতান-বাজানো বনভূমির শ্যামলিমা, মাঠে মাঠে জলের আলপনা আঁকতে আঁকতে নদীর রুপালি খেলা, কোথাও ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায় বনমুরগিরা, কোথাও হঠাৎ শিস দিয়ে ওঠে অজানা গানের পাখি, কোথাও অনেক দূর থেকে শোনা যায় কার বাঁশির হারিয়ে-যাওয়া সুর৷ এরই মধ্যে ঘুমিয়ে নিঃসাড় হয়ে আছে জনশূন্য আলিনগর৷ পাহাড়ের উপর থেকে তাকে দেখায় একখানি ছবির মতো৷
বাড়ির পর বাড়ি-কোনো কোনো বাড়ির বয়সও বেশি নয়, আকারও জীর্ণ নয়৷ মাঝে মাঝে এক-একখানা বাগানবাড়িও চোখে পড়ে-এখনও দু-চারটে কঠিন প্রাণ ফুলগাছ অযত্নেও বেঁচে থেকে রং ফুটিয়ে আগেকার গৌরবের পরিচয় দেবার ক্ষীণ চেষ্টা করছে৷
কিন্তু অধিকাংশ বাড়িই নীরবে যেন প্রচার করতে চায় ধ্বংস-দেবতার মহিমা৷ তাদের দেখলেই মনে পড়ে খণ্ড-বিখণ্ড মাংসহীন কঙ্কালকে৷ স্থানে স্থানে ধ্বংসস্তূপের জন্যে চলবার পথ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে৷ এ-যেন কোনো অভিশপ্ত পৃথিবীর এক অংশ-মৃত মানুষের স্মৃতি আছে, কিন্তু জ্যান্ত মানুষের দেখা নেই৷ মাঝে মাঝে এক-একটা মসজিদ, কিন্তু তাদের ছায়ায় আজ আর কেউ উপাসনা করতে আসে না৷ থেকে থেকে এক-একটা ঘুঘুর বিষাদমাখা সুর যেন মৌন বিজনতার দীর্ঘশ্বাসের মতো জেগে উঠেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে৷
জয়ন্ত সারাদিন ধরে আজ আলিনগরের জনশূন্যতার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তার সঙ্গে আছে মানিক, অমিয়, পরেশ, নিশীথ ও সুন্দরবাবু৷
জয়ন্তের সঙ্গে ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু এখানে আসবার কোনোই দরকার ছিল না, কিন্তু খানিকটা কৌতূহলে পড়ে ও খানিকটা এই নূতন দেশে বেড়াবার ঝোঁকে সুন্দরবাবুও কিছুদিনের ছুটি নিয়ে জয়ন্ত ও মানিকের সঙ্গী হয়েছেন৷
সারাদিন কোথাও উল্লেখযোগ্য কিছুই আবিষ্কার করা গেল না৷ বৈকালে তারা শহরের প্রান্তে একটা ছোটো নদীর ধারে এসে দাঁড়াল৷
সুন্দরবাবু সারাদিনই কাঠফাটা রোদে অমন টোটো করে ঘুরে বেড়ানোর বিরুদ্ধে কঠিন কঠিন মত প্রকাশ করে আসছিলেন, কিন্তু এইবারে তিনি রীতিমতো বিদ্রোহ প্রকাশ করে বললেন, ‘হুম! আমি বাবা আর এক পা নড়ছি না! তোমাদের খাতিরে পড়ে শেষটা কি আত্মহত্যা করব? এখানে সর্দিগরমি হলে দেখবে কে?’
জয়ন্ত একবার সুন্দরবাবুর দিকে ফিরে তাকাল৷ মরুভূমিতে দরিয়ার মতো তাঁর বিপুল টাকের উপর দিয়ে দরদর ঘামের ধারা নেমে আসছে এবং পথশ্রমে তাঁর বিরাট ভুঁড়ি হাপরের মতো একবার ফুলে উঠছে ও একবার চুপসে যাচ্ছে দেখে তার দয়া হল৷ বলল, ‘আচ্ছা সুন্দরবাবু, এইবারে আমরা খানিকটা বিশ্রাম করতে পারি৷ আমাদের শহর দেখা শেষ হয়েছে৷’
সুন্দরবাবু উচ্চৈঃস্বরে একটি সুদীর্ঘ ‘আঃ উচ্চারণ করে নদী-তীরের বালির উপরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন৷
অমিয় বলল, ‘তাহলে এর পরে আমরা কী করব?’
জয়ন্ত বলল, ‘আজকের রাতটা আমরা এইখানেই কাটিয়ে দেব৷’
সুন্দরবাবু ভয়ানক চমকে উঠে বললেন, ‘অ্যাঁ, সে কী কথা? থাকব বললেই তো থাকা হয় না, এখানে থাকব কোথায়?’
জয়ন্ত বলল, ‘যদিও আজ চাঁদ উঠবে না, তবু মাথার উপর আকাশের চাঁদোয়া আছে তো!’
‘যদি বৃষ্টি আসে?’
‘এখানে মাথা গুঁজবার জন্যে পোড়ো বাড়ির অভাব নেই৷ গোটা শহরটাই তো আজ আমাদের দখলে৷’
সুন্দরবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘আ-হা-হা-হা, মরে যাই আর কি! সব ব্যবস্থাই তো করে দিলে দেখছি! কিন্তু পোড়ো বাড়িতে পোড়া পেটের অন্ন জোটাবে কে?’
‘অন্ন আজ জুটবে না৷’
‘হুম! মাফ করো ভাই, আমি বিধবা স্ত্রীলোক নই, উপোস-টুপোস আমার ধাতে সহ্য হয় না!’
‘তাহলে আপনি বাসায় ফিরে যান!’
‘একলা?’
‘কাজেই৷’
‘হুম!’ সুন্দরবাবু একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন,-সূর্য ডুবু-ডুবু৷ সন্ধ্যা আসি-আসি করছে৷ রাত-আঁধারে এখানে কী সব কাণ্ড হয় অমিয়র মুখে তা শুনতে বাকি নেই৷ একলা এখান থেকে ফেরা অসম্ভব, কারণ সুন্দরবাবু ভূত-পেতনি মানেন৷ এবং অমিয়র বোন শীলাকে যে মানুষ চুরি করেছে, এ-কথাও তিনি বিশ্বাস করেন না৷ একলা বাসায় ফেরবার সময়ে যদি তাদের কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় . . . সুন্দরবাবু অত্যন্ত অসময়ে এখন বুঝতে পারলেন যে, এই সব নির্বোধ, গোঁয়ার ছোকরার দলে ভিড়ে তিনিও বুদ্ধিমানের কাজ করেননি৷
জয়ন্ত তাঁর মনের ভাব আন্দাজ করে মৃদু হেসে বলল, ‘ভয় নেই সুন্দরবাবু, আজ রাত্রে অন্ন না জুটলেও অন্য কিছু জুটতে পারে৷ . . . নিশীথবাবু, বলুন তো, আপনাদের গাড়িতে রসদ কী আছে?’
নিশীথ বলল, ‘এক কাঁদি মর্তমান কলা, ল্যাংড়া আম, সন্দেশ, ছয় ডজন চিকেন স্যান্ডউইচ, কিছু কেক, আর কিছু বিস্কুট৷’
জয়ন্ত বলল, ‘অতএব সুন্দরবাবু, আজ উপোস করবার ভয় নেই৷’
সুন্দরবাবু অল্প একটু হেসে বললেন, ‘তাহলে তোমরা এখানে রাত্রিবাস করবার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছ?’
‘কতকটা তাই বটে৷’
‘এটা আগে আমাকে জানালেই পারতে! এখানে রাত কাটাবার প্রস্তাব আমার ভালো লাগছে না!’
এমন সময়ে মানিক বলল, ‘অমিয়বাবু, আপনি না বলেছিলেন, মানুষ এখানে আসতে চায় না?’
‘হ্যাঁ৷ এ-জায়গাটার বদনাম আছে৷ আর সে বদনাম যে মিছে নয়, তারও প্রমাণ আমরা পেয়েছি!’
‘তাহলে বালির উপরে এই পায়ের দাগগুলো কীসের?’-বলে মানিক নদীর তীরে অঙ্গুলি নির্দেশ করল৷
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল৷
বালুতটে লম্বা পায়ের দাগের সারি,-নদীর জলের দিক থেকে উপর দিকে উঠে এসেছে৷ আর সবগুলিই হচ্ছে মানুষের পায়ের দাগ৷
জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, আপনি পায়ের দাগ পরীক্ষা করতে জানেন?’
‘পুলিশে কাজ করি, তা আর জানি না?’
‘আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানরা পুলিশে কাজ করে না, কিন্তু পায়ের দাগ দেখে অপরাধী ধরতে তারা যেমন ওস্তাদ, পৃথিবীর কোনো বড়ো ডিটেকটিভও তেমন নয়৷ কিন্তু সে-কথা এখন থাক৷ আমাদের সামনের এই দাগগুলো দেখে অনেক কথাই বলা যায়৷’
‘হুম! কী বলা যায় শুনি?’
জয়ন্ত পকেট থেকে গজকাঠি বার করে একমনে দাগগুলো মাপতে লাগল৷ তারপর বলল, ‘দাগগুলো যখন এত স্পষ্ট তখন নিশ্চয় পুরোনো নয়৷ হয়তো কালই দাগগুলোর উৎপত্তি হয়েছে৷ এখান দিয়ে একদল লোক গিয়েছে৷ যে দলের একজন লোক খুব বেশি ঢ্যাঙা! বেঁটেদের চেয়ে লম্বা লোকদের পায়ের দাগের মধ্যে ব্যবধান হয় বেশি৷ দলের একজন লোক খুব মোটা, তাই তার পায়ের দাগ বালির ভিতরে বেশি গভীর হয়ে বসেছে৷ দলের একজনের ডান-পা খোঁড়া-বালির উপরে তার ডান পায়ের আঙুলের চিহ্ন রয়েছে, কিন্তু গোড়ালির চিহ্ন নেই৷
‘এখানে ছয়জন লোকের পায়ের দাগ আছে৷ আমি ছয়জোড়া আলাদা পায়ের দাগ পেয়েছি৷ অমিয়বাবু, আপনাদের যারা আক্রমণ করেছিল-‘
বিবর্ণ মুখে অমিয় বলে উঠল, ‘তাদের দলেও ছয়জন লোক ছিল৷’
জয়ন্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘এ-গুলো তাদেরই পায়ের দাগ হলে বলতে হয়, তাদের ভূত-প্রেত বলে সন্দেহ করবার কোনো কারণ নেই৷ তারা ছায়ামূর্তি হলে এখানে তাদের পায়ের দাগ পড়ত না৷’
পরেশ বলল, ‘তারা ভূত-প্রেত কি না জানি না, কিন্তু আমাদের বন্দুকের গুলি খেয়েও তারা যে এগিয়ে এসেছিল, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই৷’
মানিক বলল, ‘কিন্তু তখন আপনাদের মাথার ঠিক ছিল? নিশ্চয়ই আপনাদের গুলিতে তারা আহত হয়নি?’
নিশীথ বলল, ‘আমাদের পক্ষে জোর করে কিছু বলা সাজে না, আর অসম্ভবে কেউ বিশ্বাস করবেই বা কেন? কিন্তু জানবেন, তারা আমাদের এত কাছে ছিল যে অতি বড়ো আনাড়ির বন্দুকের গুলিও ব্যর্থ হবার কথা নয়৷’
জয়ন্ত বলল, ‘যাক, এখন আর ও-নিয়ে তর্কের দরকার নেই, কারণ সেই মূর্তি-ছটা সামনে না থাকলে ও-তর্কের কোনো মীমাংসাই হবে না৷ তার চেয়ে এখন দেখা যাক, ওই দাগগুলো কোন দিকে গিয়েছে৷’
সুন্দরবাবু তখন ‘রসদ’ খানাতল্লাস করবার জন্যে নিশীথদের মোটরের ভিতর প্রবেশ করেছেন৷
আগেই বলা হয়েছে পায়ের দাগগুলো উঠে গিয়েছে উপর দিকে৷ সকলে সেই রেখা ধরে ঢালু জমির উপর দিয়ে অগ্রসর হল৷ কিন্তু বেশি দূর যেতে হল না৷ কারণ নদীর প্রায় ধারেই রয়েছে একটা জঙ্গলময় জমি, এক সময়ে তার চারিদিকে যে প্রাচীর ছিল, স্থানে স্থানে তার কিছু কিছু চিহ্ন আজও বর্তমান রয়েছে৷ পায়ের দাগগুলো সেই জমির ভিতরেই প্রবেশ করেছে৷
সকলে ভাঙা প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে রইল৷ মানিক উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘সারাদিনের পর একটা হদিস মিলল বটে, কিন্তু আজ বোধ হয় আর কিছু নতুনত্ব পাওয়া যাবে না৷ সূর্য ডুবে গিয়েছে৷’
পশ্চিমের আকাশে তখন সোনালি ও লাল রং গুলে কে যেন নূতন ছবি আঁকবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল৷ কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ করবার জন্যে অন্ধকার খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছে৷ . . . সুমুখের জমির ঝোপঝাপের আশেপাশে অন্ধকার এখনই ঘন ও রহস্যময় হয়ে উঠেছে, চারিদিক এমন স্তব্ধ যে একটা সুচ পড়লেও শোনা যায়৷ সেই মৌনতার ভিতরে মাথার উপর দিয়ে যখন একঝাঁক বক উড়ে গেল তখন তাদের ডানাগুলোর ঝটপট শব্দ শুনে মনে হল, যেন অনেকগুলো ভৌতিক আত্মা যন্ত্রণায় ছটফট করছে৷
এমন সময় দেখা গেল, সুন্দরবাবু হাঁসফাঁস করতে করতে দৌড়ে আসছেন-তাঁর এক হাতে খান কতক স্যান্ডউইচ এবং অন্য হাতে এক ছড়া কলা-কাছে এসেই তিনি বললেন, ‘এই ভর সন্ধেবেলায়, এই মারাত্মক জায়গায় আমাকে একলা ফেলে তোমরা কোথায় পালিয়ে যেতে চাও?’
মানিক বলল, ‘সে কি সুন্দরবাবু, অমন ঝুড়ি-ভরা আম, কলা, কেক, সন্দেশ, বিস্কুট আর স্যান্ডউইচের মাঝখানেও নিজেকে আপনি একলা বলে মনে করছিলেন?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ঠাট্টা আমি পছন্দ করি না! কিন্তু জয়ন্ত, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
‘ওই জমির মধ্যে৷ পায়ের দাগগুলো ওর মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে৷’
সুন্দরবাবু দু-চারবার উঁকিঝুঁকি মেরে বললেন, ‘বাব্বাঃ, ওটা যে গোরস্থান বলে মনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ, ওটা গোরস্থানই বটে৷ এখনও দু-চারটে কবরের পাথর অটুট আছে৷ আমি জানতে চাই, পরিত্যক্ত শহরে এই পোড়ো গোরস্থানে ছয়জন মানুষ কী উদ্দেশ্যে এসেছিল? হয়তো তারা এখনও ওর মধ্যেই আছে৷ কারণ পায়ের দাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এ-পথ দিয়ে এখনও তারা বেরিয়ে আসেনি৷’
‘হয়তো তারা অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে৷’
‘হতে পারে৷ কিংবা এখনও তারা বেরিয়ে যায়নি৷’
‘কিন্তু আর যে আলো নেই!’
‘আকাশের আলো নেই, আমাদের আলো আছে৷ সুন্দরবাবু, ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমরা ছ-ছটা বড়ো বড়ো পেট্রলের লন্ঠন এনেছি৷ সেগুলো জ্বাললে এখানটা আলোয় আলো হয়ে উঠবে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘শোনো জয়ন্ত, রাত্রিবেলায় বেড়াবার পক্ষে গোরস্থান খুব ভালো জায়গা নয়! আমরা তো কাল সকালেও ওর মধ্যে যেতে পারি৷’
জয়ন্ত দৃঢ়স্বরে বলল, ‘এক রাত্রের হেরফেরে সমস্ত সুযোগও নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ আমি আজকেই এই গোরস্থানটা দেখব৷’
আচম্বিতে খানিক তফাতে হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে একটা অত্যন্ত কঠিন ও নিষ্ঠুর অট্টহাসি জেগে উঠল৷
সুন্দরবাবু চমকে একেবারে দলের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন-তাঁর হাত থেকে কলার ছড়া খসে পড়ে গেল৷
সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক তখন ঝাপসা, জয়ন্ত কারুকেই দেখতে পেল না-সে বুকের উপরে দুই হাত রেখে স্তব্ধ ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সেই আশ্চর্য অট্টহাসি শুনতে লাগল৷
অমিয় ম্লান মুখে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘সেদিনও আমরা এই অমানুষি হাসিই শুনেছিলাম!’
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – আবার সেই মারাত্মক ‘ছয়’
নদীর মতো শব্দেরও স্রোত আছে৷ নদীর স্রোত দেখা যায়, কিন্তু শব্দের স্রোত ধরা পড়ে কানে৷
খানিকক্ষণ ধরে সেই ভয়াবহ অট্টহাসির শব্দ ঠিক স্রোতের মতোই শূন্যতার মধ্য দিয়ে অবিরাম বয়ে চলল৷ তারপর হঠাৎ হাসি থেমে গেল এবং তার প্রতিধ্বনিগুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল যেন নিস্তব্ধতার মহাসাগরে৷
সুন্দরবাবু তখন দুই হাতে দুই কান চেপে মাটির উপর উবু হয়ে বসে পড়েছেন৷
অমিয়, নিশীথ ও পরেশ প্রাণপণে পরস্পরের হাত চেপে ধরে আড়ষ্টের মতো দাঁড়িয়ে রইল৷
জয়ন্ত বলল, ‘যে হাসছে সে হয় পাগল, নয় আমাদের ঠাট্টা করছে৷’
মানিক কিছু বলল না, কেবল নিজের বন্দুকের কুঁদোটা মাটির উপরে ঠক-ঠক করে ঠুকতে লাগল৷
রাত্রিময়ী বনভূমি, ভয়-ভরা রহস্যময় তার রূপ৷ মাথার উপরে অন্ধকারে আকাশ-দানবের হাজার হাজার তারকা-চক্ষু মিটমিট করে তাকিয়ে আছে৷ তার তলায় আরও ঘন অন্ধকারে পর্বতশিখরগুলো যেন দৈত্যপুরীর বিচিত্র ও বিরাট অভিনয়-ভঙ্গিতে স্থির ও স্তম্ভিত হয়ে আছে এবং তারও তলায় যেন সীমাহারা বিশাল অরণ্য সভয়ে বদ্ধ স্বরে থেকে থেকে আর্তনাদ করে উঠছে৷
ঘুঘুর ম্রিয়মাণ সুরকে ঘুম পাড়িয়ে জেগে উঠছে প্যাঁচার বিরক্ত কর্কশ কন্ঠ-সে যেন বিপুল বনকে এবং এই বনের ভিতরে আজ যারা এসে পড়েছে তাদের সবাইকে ক্রমাগত অভিশাপের পর অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে এবং তারই সঙ্গে তাল রেখে ঘন ঘন বেজে উঠছে কালো বাদুড়দের অলক্ষুণে ডানাগুলো৷
সুন্দরবাবু শিউরে শিউরে বলে উঠলেন, ‘আলো জ্বালো, আলো জ্বালো, আলো জ্বালো!’
পেট্রলের লন্ঠন আনবার জন্যে পরেশ গাড়ির দিকে অগ্রসর হল৷
জয়ন্ত একখানা হাত ধরে তাকে থামিয়ে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আর যে অন্ধকার সইতে পারছি না, আলোগুলো এনে জ্বেলে ফেলি!’
‘না, যদি এখানে সত্যিই শত্রু থাকে, তাহলে আলো জ্বাললে আমাদের দেখতে পাবে৷ এখন অন্ধকারই আমাদের বন্ধু৷’
সুন্দরবাবু বসে বসেই পিছন হটতে হটতে বললেন, ‘কিন্তু শত্রুরা অন্ধকারেই আমাদের দেখতে পেয়েছে-ওই ঝোপের ভিতর থেকে তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!’
মানিক দেখল, সামনের একটা ঝোপ থেকে সত্য সত্যই চার-চারটে চোখের আগুন জ্বলছে আর নিবছে-জ্বলছে আর নিবছে৷
অমিয় ও নিশীথ বন্দুক তুলল৷
জয়ন্ত হেসে বলল, ‘খুব সম্ভব দুটো শেয়াল আশ্চর্য হয়ে আমাদের দেখছে৷’
তারপরেই আগুন-চোখগুলো আর দেখা গেল না৷
জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, মিছে ভয় পেয়ে রজ্জুতে সর্পভ্রম করবেন না৷ ভয় বড়ো সংক্রামক৷ একজন ভয় পেলে আর সকলেও ভয় পাবে! অথচ এখানে ভয় পাবার মতো কিছুই আমি দেখছি না৷’
কিন্তু সুন্দরবাবু জয়ন্তের কথা শুনতে পেলেন বলে মনে হল না-তিনি তখন কান পেতে অন্য কী যেন শুনছিলেন৷
মানিক চুপিচুপি বলল, ‘জয়, নদীর জলে ছপছপ শব্দ হচ্ছে৷ কে যেন নদী পার হচ্ছে!’
তারপরেই শব্দটা থেমে গেল৷
খানিক পরে খুব কাছেই শোনা গেল কার পায়ের শব্দ৷ কে যেন দ্রুতপদে গোরস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে৷ কিন্তু সে যে কে, কিছুই নজরে পড়ল না, ছিদ্রহীন অন্ধকার তার মূর্তিকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে৷
পায়ের শব্দও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল৷
অমিয় অস্ফুটস্বরে বলল, ‘জয়ন্তবাবু, যেখানে দিনের বেলায় মানুষ আসতে ভয় পায়, সেখানে এমন সময়ে এই অন্ধকারে যে বেড়াতে আসে, তাকে কি সাধু বলে মনে হয়?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! কিন্তু এখান দিয়ে যে গেল সে কি মানুষ? এই রাত্রে এই পোড়ো শহরের গোরস্থানের সঙ্গে জ্যান্ত মানুষের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আমরা চোখে দেখছি খালি অন্ধকার, ও কিন্তু দিব্যি হনহন করে এগিয়ে গেল!’
মানিক বলল, ‘জয়, আমরাও কি ওর পিছনে গোরস্থানে গিয়ে ঢুকব?’
জয়ন্ত বলল, ‘গোরস্থানে ঢুকতে হলে আলো জ্বালতে হয়৷ কিন্তু এখন আলো জ্বালা আর নিজে-থাকতে ধরা দেওয়া একই কথা৷ কী যে করব বুঝতে পারছি না৷’
সুন্দরবাবু বললে, ‘এখন আমাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে মানে মানে গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়া৷ নইলে ভূত কি মানুষ শত্রুর হাতে না হোক, সাপ কি বিচ্ছুর কামড়ে আমাদের মৃত্যু হবে অনিবার্য!’
পরেশ বলল, ‘এইমাত্র আমার পায়ের উপর দিয়ে সড়সড় করে কি চলে গেল!’
সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে লাফাতে লাফাতে ও পা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ‘হুম! আমার পায়ে উঠলে সে নিশ্চয়ই আমাকে কামড়ে দেবে! এই-হুস হুস! এই-হুস হুস!’ মানিক হেসে ফেলে বলল, ‘সুন্দরবাবু, হুস হুস করে আপনি কি কাক তাড়াচ্ছেন?’
সুন্দরবাবু চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘মরছি নিজের জ্বালায়, এখন আর ঠাট্টা করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ো না মানিক! . . . ওরে বাস রে, এ কী অন্ধকার! দুনিয়ায় এত অন্ধকারও থাকতে পারে! অ জয়ন্ত, কোন দিকে গাড়ি আছে বলে দাও! তোমরা না-যাও, আমি একলাই গাড়িতে গিয়ে বসে থাকব!’
সুন্দরবাবু পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন, এবং আচম্বিতে বনের ভিতর থেকে জেগে উঠল বাঘের গভীর গর্জন৷ . . . তিনি চমকে আবার পায়ে পায়ে পিছিয়ে দলের মাঝখানে এসে হতাশভাবে বললেন, ‘তাহলে উনিও এখানে আছেন?’ তাড়াতাড়ি পিঠ থেকে বন্দুকটা নামিয়ে তিনি আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হলেন ও সাপের ভয়ে মাঝে মাঝে পা ঝাড়তে লাগলেন৷
শৃগালদের সম্মিলিত কোলাহল জানিয়ে দিল, এখন দুপুর রাত্রি৷ নদীর কলতান শোনাচ্ছে কান্নার মতো৷ আকাশ একে অন্ধকার কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল অধিকতর পুরু আর-একটা অন্ধকারের ঘোমটা ছড়িয়ে পড়ে আকাশের তারকা-নেত্রগুলোকে ঢেকে দিচ্ছে৷
জয়ন্ত বলল, ‘মেঘ উঠেছে৷ আজও হয়তো ঝড়-বৃষ্টি হবে৷’
অমিয় বলল, ‘তাহলে আমাদের দুর্দশার বাকি কিছু আর রইল না৷ এইবেলা-‘
কিন্তু তার মুখের কথা মুখেই রইল-সেই আসন্ন দুর্যোগের বিভীষিকা, সেই নিবিড় তিমিরের ভয়াল অন্ধতা, সেই নানা-শব্দ-বিচিত্র রাত্রির গভীরতা, সেই পরিত্যক্ত সমাধিক্ষেত্রের অমানুষিকতার ভিতর থেকে জাগ্রত হল ভয়ংকর অস্বাভাবিক এক কন্ঠধ্বনি৷ যেন আকাশ-বাতাসকে কাঁপিয়ে কাদের ডেকে ডেকে তীব্রস্বরে বলছে-‘ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয়, আয় তোরা আয় রে! অন্ধকারে যারা দেখতে পায় তারা আসুক এখন অন্ধকারে যারা দেখতে পায় না তাদের কাছে! আকাশের মেঘ তোদের ডাকছে, নিঝুম রাতের আঁধার তোদের ডাকছে, মৃত আত্মার বন্ধু তোদের ডাকছে! কবরে কবরে দুয়ার খুলে যাক, কফিনে কফিনে জীবন জাগুক, মরা চোখে আলো ফুটুক! বেগম-সাহেবা বসে বসে কাঁদছে, বাঁদিরা অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না, আলো নিয়ে তোরা সবাই আয় আয়-ওরে আয় রে!’
বোঁ-বোঁ-বোঁ-বোঁ করে হঠাৎ একটা পাগলা হাওয়ার ঝাপট বয়ে গেল, কড়-কড়-কড়-কড় করে বজ্রের ধমক শোনা গেল, মড়-মড়-মড়-মড় করে বড়োবড়ো গাছের মাথা মাটির দিকে নুয়ে পড়ল৷ বাঘ আর ভয়ে গর্জন করছে না, প্যাঁচা-বাদুড় ভয়ে আর ডানা ঝটপটিয়ে উড়ছে না, শৃগালরা ভয়ে আর আগুন-চোখ মেলে তাকাচ্ছে না৷
তারপরেই খল-খল-খল-খল করে আবার সেই অট্টহাসির পর অট্টহাসির স্রোত৷
অমিয় প্রায় আর্ত স্বরে বলে উঠল, ‘ও হাসি আমি চিনি; কিন্তু অমন করে কথা কইল কে?’
সুন্দরবাবু ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘কে ডাকছে, কে আসবে, কে অন্ধকারে দেখতে পায়, কে বেগম আর কেই-বা বাঁদি? আমরা কি সশরীরে নরকে এসে পড়েছি?’
জয়ন্তও যেন আপন মনেই অস্ফুট স্বরে বলল, ‘বেগমই বা কে, আর বাঁদিই বা কারা? এ কি পাগলের প্রলাপ? মানিক, তোমার কী মত? লন্ঠনগুলো জ্বেলে আমরা কি গোরস্থানে ঢুকে ওই পাগলটাকে আক্রমণ করব?’
মানিক সজোরে জয়ন্তর কাঁধ চেপে ধরে বলল, ‘চুপ চুপ! ওই দেখো!’
জয়ন্তর দুই চক্ষে অত্যন্ত বিস্ময়ের ভাব জেগে উঠল৷ তাদের কাছ থেকে প্রায় দুই শত গজ তফাতে, গোরস্থানের ভিতরে নড়েনড়ে বেড়াচ্ছে কতকগুলো আলো৷ তাহলে ওই গোরস্থান নির্জন নয়? ওখানে আলো নিয়ে কারা কী করছে?
আবার সেই কন্ঠস্বর-‘ওরে আয়, ওরে আয়, আয় তোরা আয় রে! রোশনাই কই, খানা কই৷ বিছানা কই?’
আলোগুলো এতক্ষণ এলোমেলো ছিল, হঠাৎ এখন সার বেঁধে একদিকে এগিয়ে চলল৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! ও হচ্ছে আলেয়ার আলো!’
পরেশ বলল, ‘না, ও আলো নয়৷ যাদের হাতে আলো আছে, তাদেরও আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে৷’
নিশীথ বলল, ‘কিন্তু ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ কে ওরা? এই গোরস্থানের ভেতরে কি ডাকাতদের আড্ডা আছে?’
জয়ন্ত বলল, ‘অমিয়বাবু, আপনাদের ছয়জন লোকে আক্রমণ করেছিল তো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
‘মানিক, নদীর তীরে আমরাও আজ ছয় জোড়া পদচিহ্ন আবিষ্কার করেছিলাম তো?’
‘হ্যাঁ৷’
‘এখন ওই আলোগুলো গুনে দেখ দেখি৷’
মানিক গুনতে গুনতে বলল-‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়৷ ছ-টা আলো-তার মানে, ছ-জন লোক৷’
অমিয় উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘জয়ন্তবাবু! তাহলে ওরাই আমাদের শীলাকে চুরি করেছে! ওরা ভূতই হোক আর মানুষই হোক, কিছুই আমি কেয়ার করি না-আমি এখনই ওদের আক্রমণ করব-আবার বোনকে উদ্ধার করব-হয় আমি মরব, নয় ওদের মারব!’
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরে ধীরে বলল, ‘শান্ত হোন অমিয়বাবু, এখন গোঁয়ারতুমি করবার সময় নয়! ওখানে যদি ডাকাতের দল থাকে তাহলে ওদের দলে কত লোক আছে তা কে বলতে পারে? আমরা ওখানে গিয়ে প্রাণ দিলে তো আপনার বোনের উপকার হবে না!’
মানিক বলল, ‘আলোগুলো আবার কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল!’
জয়ন্ত স্থিরভাবে বলল, ‘যাক গে৷ আমাদের এখানে অপেক্ষা করা সার্থক হয়েছে৷ কাল সকালে এই গোরস্থানই হবে আমাদের কার্যক্ষেত্র৷ আজ এই অন্ধকারে অজানা জায়গায় গোলমাল করে কিছুই হয়তো করতে পারব না, মাঝখান থেকে শত্রুরা সাবধান হয়ে সরে পড়বে৷ বৃষ্টি এল বলে, রাত পোয়াতে আর ঘণ্টা-কয়মাত্র দেরি আছে; বাকি রাতটুকু মোটরে বসে কাটিয়ে দিই গে চলো৷’
অমিয় নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও জয়ন্তর কথামতো নিজেদের মোটর গাড়ির দিকে যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল৷
সঙ্গে সঙ্গে সকলে শুনতে পেল, বনের পথে আবার কার একখানা মোটর গাড়ির গর্জন- গাড়িখানা যেন খুব তাড়াতাড়ি ছুটছে!
অমিয় আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘এখানকার সবই কি অস্বাভাবিক! এমন জায়গায় এমন সময়ে কে আবার মোটরে চড়ে হাওয়া খেতে এল?’
নিশীথ বলল, ‘একখানা নয়, আবার আর-একখানা মোটর! ওই শোনো, এখানাও খুব জোরে ছুটে চলেছে!’
মানিক বলল, ‘ডাকাতরা আমাদের আক্রমণ করবার জন্যে কি মোটরে করে দলবল নিয়ে এল?’
আচম্বিতে অরণ্যের ভিতরে দূরে একটা ভয়ানক শব্দ হল৷ সকলে সবিস্ময়ে শুনছে, এমন সময়ে আবার সেইরকম আর-একটা শব্দ৷
অমিয় বলল, ‘এ যে কোনো accident-এর শব্দ!’
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি এগিয়ে শুকনো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, accident -ই বটে! আমাদের সর্বনাশ হল বোধ হয়!’
যেখানে তাদের গাড়ি ছিল, সেখানে গিয়ে দু-খানা মোটরই আর খুঁজে পাওয়া গেল না৷
জয়ন্ত তিক্ত স্বরে বলল, ‘আমরা এখন অসহায়! আমাদের অদৃশ্য শত্রু এসে দু-খানা মোটরই চালিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, আর চালকহীন গাড়ি দু-খানা খানিক দূরে এগিয়েই গাছে কি পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! তাতে শত্রুদের লাভ?’
জয়ন্ত বলল, ‘আমাদের পালাবার পথ বন্ধ হল৷ হয়তো শত্রুরা এখনই আমাদের আক্রমণ করবে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! আমি এখন পায়ে হেঁটেই পালাতে চাই৷ এ-বিষয়ে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ তোমরা আসো আর নাই-ই আসো, এই আমি দৌড় মারলাম!’
সুন্দরবাবু সত্য সত্যই সকলের মায়া কাটিয়ে দৌড় দিলেন, কিন্তু জয়ন্ত এক লাফে তাঁর সুমুখে গিয়ে পড়ে বলল, ‘সুন্দরবাবু, একটু দাঁড়ান! বোধ হয় আমরাও আপনার সঙ্গী হতে বাধ্য হব!’
হঠাৎ পিছনে আর একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল৷ মাটির উপরে ধুপ-ধুপ করে পায়ের শব্দ-যেন একদল সৈন্য তালে তালে পা ফেলে ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে৷
জয়ন্ত বলল, ‘যা ভেবেছি তাই! ওই ওরা আক্রমণ করতে আসছে! এখন পালানো ছাড়া উপায় নেই!’
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – নবাব
অনেক কষ্টে মাইলের পর মাইল পাহাড়ে পথ হেঁটে পার হয়ে পরদিন তারা যখন লোকালয়ে গিয়ে পৌঁছোল, তখন বেলা দুপুর৷ তাদের দুঃখের পাত্র পূর্ণ করবার জন্যে বৃষ্টি পড়ছে তখনও৷ এবং সে বৃষ্টি সে-দিন সে-রাত আর থামবার নাম করলে না৷
লোকালয়ে পৌঁছে তারা প্রথমেই পেল পুলিশের একটা ফাঁড়ি৷ জয়ন্ত ও মানিক ছাড়া বাকি সকলের শরীরের অবস্থা হয়েছিল এমন ভয়ানক যে, ফাঁড়ির সামনে গিয়ে তারা একেবারে ভেঙে পড়ল৷ কাজেই জয়ন্ত ও মানিক বাধ্য হয়ে তাদের নিয়ে ফাঁড়ির ভিতরেই প্রবেশ করল৷ তাদের অবস্থা দেখে কাহিনি শুনে ও পরিচয় পেয়ে দারোগা পির মহম্মদ সাহেব সকলকে যারপরনাই আদরযত্ন করলেন এবং সেদিনকার মতো তাদের ফাঁড়ির ভিতরেই থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন৷
কালকের রাত্রের দুঃস্বপ্ন জয়ন্তর মতো লোককেও আজ পর্যন্ত বিস্ময়ে অভিভূত করে রেখেছে৷ সে কী নিরেট অন্ধকার! যেন মুগুরের বাড়ি মারলে সশব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়! সে কী দুর্যোগ! যেন ঝড় আর বৃষ্টি তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেই উন্মত্ত ও নিষ্ঠুর আনন্দে আকাশ ও পৃথিবীকে ব্যাকুল করে তুলেছিল অশ্রান্তভাবে৷ সে কী বিভীষিকা! প্রেতাত্মা-জগতের সিংহদ্বার খোলা পেয়ে যেন মূর্তিমান অভিশাপের দল সেদিন মানুষের জগৎ আক্রমণ করেছিল!
সেই মুহুর্মুহু নব নব ভয়-বিস্ময়ের অভিনয়ের ক্ষেত্রে বৃষ্টির কনকনে শীতলতায়, বজ্রসাথী ঝড়ের ঝাপটায় ও ধাক্কায়, কখনো উপল-সংকুল দুর্গম পার্বত্য চড়াই-উৎরাইয়ের ভিতর দিয়ে, কখনো বর্ষাধারায় হঠাৎ-বেগবতী নদীর তীব্র স্রোত ঠেলে ঠেলে, তীক্ষ্ণ কাঁটা-ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে এবং কখনো-বা ধুধু খোলা মাঠের তৃণহীন পিচ্ছিল পাথুরে জমির উপর আছাড় খেয়ে তারা প্রাণপণে পালিয়ে আসবার চেষ্টা করছে-এবং তাদের পিছনে পিছনে বরাবর ধেয়ে এসেছে সে যে কারা কেউ তা জানে না, কেবল তাদের কানের কাছে একটানা সমানে বেজে বেজে উঠেছে সেই মহা-অমানুষিক আশ্চর্য পায়ের শব্দ-একদল সৈন্য যেন সমতালে পা ফেলতে ফেলতে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে, আসছে আর আসছে আর আসছে-সে ভয়াবহ পা-গুলো যেন থামতে জানে না, যেন কখনো থামবেও না, যেন তারা চিরদিন ধরে এই মাটির পৃথিবীকে দলিত, শব্দিত ও স্তম্ভিত করে চলে চলে বেড়াবে!
উঃ! সে-কথা ভেবে ভেবে জয়ন্ত এখনও থেকে থেকে শিউরে শিউরে উঠতে লাগল৷
জয়ন্তর দেহ লম্বায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি, তার বুকের ছাতি পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি চওড়ায় এবং তার ব্যায়ামপুষ্ট সুদীর্ঘ দেহকে দেখায় ঠিক দানবের দেহের মতো৷ মানিকের দেহ অতটা জাঁকালো দেখতে না হলেও যে-কোনো পালোয়ানেরই মতো বলবান৷ কিন্তু তাদের এমন বলিষ্ঠ দেহও কালকের রাত্রের ব্যাপারে যথেষ্ট কাবু হয়ে পড়েছে৷ দলের অন্যান্য লোকেদের কথা না তোলাই ভালো৷ তারা আজ শয্যাশায়ী, উত্থানশক্তিশূন্য৷
কিন্তু কে তারা এমন একতালে পা ফেলে ফেলে আসে? মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ-আলোতে কতকগুলো ধবধবে সাদা মূর্তির মতো কী যেন দেখা গিয়েছে, কিন্তু সেটা চোখের ভ্রমও হতে পারে৷ মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক হি-হি-হি-হি হাসিও শোনা গিয়েছে৷ হাসেই-বা কে, আর আসেই-বা কারা? অনেক মাথা ঘামিয়েও জয়ন্ত কিছুই আন্দাজ করতে পারল না৷
আর একটা জায়গায় তার মনে খটকা লেগে রয়েছে৷ ভোরবেলায় পূর্ব-আকাশে উষা যেই সিঁথায় সিঁদুরের রেখা টেনেছিল, কোথা থেকে বনমুরগি জাগরণের প্রথম ডাক ডেকে উঠেছিল, আবছা আলো এসে অন্ধকারকে কাচের মতো স্বচ্ছ করে তুলেছিল, অমনি থেমে গিয়েছিল তাদের পিছনকার সেই একগুঁয়ে পায়ের শব্দগুলো৷ যারা তাদের আক্রমণ করেছিল তবে কি তারা রাত্রির রহস্যযাত্রী-প্রভাতকে তারা ভয় করে?
কিন্তু এক বিষয়ে এতটুকু সন্দেহ নেই৷ জয়ন্ত জানে, সে ঠিক সূত্রই ধরেছে-ওই গোরস্থানে বা তার আশেপাশেই আছে সমস্ত রহস্যর মূল৷ ওখানে ভাসা ভাসা যাদের দেখেছে এবং যাদের হাসি ও পায়ের শব্দ শুনেছে, তারাই হচ্ছে আসল পাপী ও অপরাধী৷ নইলে একটা পোড়ো শহরের পরিত্যক্ত গোরস্থানের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সাধু ব্যক্তিরা লুকিয়ে রাত্রিবাস করতে আসে না, নইলে বাইরে থেকে কেউ সেখানে এসেছে জেনে মোটরগাড়ি ভেঙে তারা পালাবার পথ বন্ধ করে দেয় না, নইলে অকারণে কেউ কারুকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয় না৷
আজ সকালে সে যদি ঘটনাস্থলে থাকতে পারত, তাহলে কতটা সুবিধাই হত৷ ওখানে নিশ্চয়ই আরও অনেক আবিষ্কার করা যেতে পারে৷
কিন্তু আজ আর ওখানে যাবার কোনো উপায় নেই৷ তাদের গাড়ি দু-খানা শত্রুর চক্রান্তে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, তাদের সঙ্গীদের গতরও চূর্ণ হয়ে গেছে-তার উপর এই অশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি৷-একটা মূল্যবান দিন মিথ্যা নষ্ট হল৷
লম্বা ঘরে পাশাপাশি ছয়খানা খাটিয়ায় জয়ন্ত, মানিক, সুন্দরবাবু, অমিয়, নিশীথ ও পরেশ আশ্রয় নিয়েছে৷ সন্ধ্যার কিছু আগে তাদের জন্যে চা এল, আর সকলের সঙ্গে সুন্দরবাবুও নিতান্ত চা খাবার লোভেই নারাজভাবে উঠে বসলেন৷ কিন্তু পেয়ালায় প্রথম চুমুক দিতে গিয়েই তিনি করে উঠলেন আর্তনাদ৷
জয়ন্ত বলল, ‘কী হল সুন্দরবাবু? হঠাৎ অমন করে উঠলেন কেন?’
সুন্দরবাবু ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘হুম! অমন করে উঠলাম কেন? জেনেশুনে ন্যাকা সাজা হচ্ছে? মনে নেই, কাল পাহাড়ের উপর থেকে এই বুড়ো বয়সে ডিগবাজি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলাম? এখনও চোয়াল নাড়াবার জো নেই৷’
জয়ন্ত বলল, ‘ও! আচ্ছা, এইবার মনে থাকবে!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তোমার পাল্লায় পড়েই তো আজ আমার এই দুর্দশা! দিব্যি সুখে ছিলাম, মরতে আমায় ভূত কিলোল, তাই তোমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছি! এ কী কাণ্ড রে বাবা! ভূতে-মানুষে টানাটানি! নিতান্ত এখনও পরমায়ু আছে, তাই এত বড়ো ফাঁড়া কাটিয়ে উঠেছি৷ হুম, কাল সকালেই আমি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব৷ জয়ন্ত, মানিক, তোমরাও বাঁচতে চাও তো আমার সঙ্গে চলো৷ অমিয়বাবু, আমি আপনাকে আগেই বলেছি, আর এখনও বলছি, আপনি শিগগির ভালো রোজা ডাকুন৷ আপনার বোনকে উদ্ধার করা পুলিশ কি শখের ডিটেকটিভের কাজ নয়! কুমারী শীলাকে ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে-আপনি রোজা ডাকুন!’
কিন্তু অমিয় মোটেই সুন্দরবাবুর দামি উপদেশ শুনছিল না৷ সে এতক্ষণ চা পান করতে করতে জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং হঠাৎ এখন চমকে দাঁড়িয়ে উঠল৷ তারপর চায়ের পেয়ালাটা সশব্দে টেবিলের উপরে রেখেই ঝড়ের মতো বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷
ঘরের ভিতরে বসে যখন সকলে সবিস্ময়ে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে, তখন রাস্তা থেকে অমিয়র উচ্চ চিৎকার শোনা গেল-‘জয়ন্তবাবু! মানিকবাবু! শিগগির আসুন-তাকে ধরেছি!’
ঘরের ভিতর থেকে সবাই ছুটে বাইরে গিয়ে পড়ল-এমনকী সুন্দরবাবু পর্যন্ত তাঁর ডিগবাজি খাওয়ার বিষম ব্যথা ভুলে গেলেন৷
বাইরে বেরিয়েই দেখা গেল, একটা দীর্ঘকায় লোক অমিয়কে ধাক্কা মেরে পথের উপরে ফেলে দিল-তারপর হনহন করে এগিয়ে চলল৷ যেরকম অনায়াসে অমিয়কে সে ভূতলশায়ী করল তাতে বেশ বোঝা গেল যে, তার শরীরে রীতিমতো ক্ষমতা আছে৷ কিন্তু অমিয় তবু ভয় পেল না বা তাকে ছেড়ে দিল না, সে মরিয়ার মতো পরমুহূর্তেই মাটি থেকে উঠে ছুটে গিয়ে আবার তাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল৷ এবার তার হাত ছাড়াবার আগেই আর-সকলে গিয়ে লোকটাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল৷
অমিয় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এই সেই লোকটা৷ যেদিন শীলা চুরি যায়, সেদিন একেই আমি ভাঙা মসজিদের ভেতরে দেখেছিলাম৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ডাকাতরা যখন আমাদের আক্রমণ করেছিল, তখন এই লোকটাই হা-হা করে হেসেছিল৷ পথ দিয়ে আজ ফাঁড়ির দিকে বার বার তাকাতে তাকাতে এ যাচ্ছিল, কিন্তু আমি দেখেই একে চিনতে পেরেছি!’
নিশীথ পরেশ একবাক্যে বলল, ‘হ্যাঁ, এই সেই লোক!’
জয়ন্ত লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল৷ দীর্ঘদেহ, ঘোর কালো মুখের উপর লম্বা কালো চুলগুলো ঝুলে পড়েছে, পরনেও কালো ওভারকোট ও কালো পাজামা৷ তার তীক্ষ্ণ চোখ দুটো দেখলেই গোখরো সাপের চোখের কথা মনে হয়৷ সেরকম চোখ কেউ কখনো দেখেনি বোধ হয়! সে চোখদুটোতে যেন পলক পড়ে না! তাদের ভিতর থেকে এমন একটা দুষ্ট ক্ষুধার ভাব ফুটে উঠছে যে একবার দেখবার পর কেউ জীবনে আর কখনো সেই দুটো চোখকে ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না৷
দারোগা মহম্মদ সাহেবও গোলমাল শুনে এসে পড়েছিলেন৷ তিনি লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
‘হাজি নবাব আলি৷’
‘এই বাবুদের তুমি চেনো?’
‘না৷ ওঁদের আমি কখনো দেখিনি, ওঁরা কী বলছেন তাও বুঝতে পারছি না৷’
‘আলিনগরের ভাঙা মসজিদে তুমি কী করতে গিয়েছিলে?’
‘জীবনে কোনোদিন আমি আলিনগরেই যাইনি৷’
অমিয় বলল, ‘মিথ্যে কথা!’
নবাবের সাপের মতো চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল৷ কিন্তু মুখে সে শান্ত হাসি হেসে বলল, ‘আমি হাজি! মিথ্যে বলা আমার পাপ৷’
মহম্মদ সাহেব বললেন, ‘তুমি হাজিই হও আর কাজিই হও আর পাজিই হও, আজ তোমাকে ফাঁড়িতে বন্ধ থাকতেই হবে৷ এখন আমার সময় নেই, কাল সকালে তোমাকে ভালো করে পরীক্ষা করব৷’
নবাবের চোখ আবার ধক করে জ্বলে উঠল৷ সে বলল, ‘কোন আইনে আপনি আমাকে বন্ধ করে রাখতে চান?’
মহম্মদ সাহেব বললেন, ‘আইনের কথা তুমি সেই উকিলদেরই জিজ্ঞাসা কোরো৷ আমি উকিল নই-আমি দারোগা৷ এই সেপাই! একে নিয়ে যাও-‘
গভীর রাত্রে ঘুমন্ত সুন্দরবাবুর মনে হল কে যেন তাঁর কানের কাছে হি-হি-হো-হো করে অট্টহাসি হেসে উঠল৷
জেগে বিছানার উপর ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সুন্দরবাবু চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘জয়ন্ত! জয়ন্ত! তারা এসেছে-তারা এসেছে-তারা এসেছে!’
সেই বিষম চিৎকারে ঘরসুদ্ধ লোকের ঘুম ভেঙে গেল৷
জয়ন্ত বলল, ‘অত চ্যাঁচাচ্ছেন কেন সুন্দরবাবু, কী হয়েছে?’
‘হুম! আমার কানের কাছে একটা বিদঘুটে হাসি শুনলাম!’
‘পাগল নাকি?’
বৃষ্টির জন্যে ঘরের সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ ছিল৷ অমিয় আলো জ্বেলে বলল, ‘কই, ঘরে তো আর কেউ নেই!’
জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবুর ঘাড়ে স্বপ্নভূত চেপেছে!’
সুন্দরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ হে, হ্যাঁ! তবু তো আমার ঘাড়ে স্বপ্নভূত চেপেছে, কিন্তু তোমার ঘাড়ে চেপেছে যে আসল ভূত সে খেয়ালটা আছে কি? হুম, অট্টহাসিতে আমার কান গেল ফেটে, আমার ঘুম গেল ভেঙে, তবু ওঁদের বিশ্বাস হচ্ছে না!’
মানিক একটা জানলা খুলে দিল৷ ঘরের ভিতর এসে ঢুকল হুহু করে জোলো হাওয়া৷ বৃষ্টিপাতের শব্দে বাইরের অন্ধকার মুখরিত৷
কিন্তু মানিকের কান আর-একটা কিছু শুনল৷ অন্ধকারের ভিতর দিয়ে সমতালে পা ফেলে কারা চলে যাচ্ছে৷
সে শব্দ জয়ন্তও শুনতে পেলে৷ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে লন্ঠনটা তুলে নিয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘এসো মানিক!’ এবং তারপরই দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল-সঙ্গে সঙ্গে আর সকলেও তার পিছনে চলল৷
নবাব যে-ঘরে বন্দি ছিল জয়ন্ত সিধে সেই ঘরের সুমুখে গিয়ে দাঁড়াল৷ ঘরের দরজা খোলা-ভিতরে নবাব নেই৷
সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘ফুসমন্ত্র, ফুসমন্ত্র! ফুসমন্ত্রে নবাব উড়ে গেছে, আর যাবার সময়ে ফুসমন্ত্রেই আমার কানের কাছে মুখ এনে হেসে গেছে!’
জয়ন্ত বলল, ‘ফুসমন্ত্রের নিকুচি করেছে! এই দেখুন, দরজার তালায় চাবি লাগানো রয়েছে৷ বাইরে থেকে কেউ তালা খুলে নবাবের পালাবার সুবিধা করে দিয়েছে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! কে সে? নিশ্চয়ই মানুষ নয়!’
জয়ন্ত বলল, ‘যদি কোনো মূর্তিমান অলৌকিক শক্তি এসে দরজা খুলতে চাইত তাহলে কুলুপ আপনি খুলে যেত, এর মধ্যে আবার চাবি ঢুকিয়ে কুলুপ খুলতে হত না৷ যখন চাবির দরকার হয়েছে তখন বুঝতে হবে যে, আমাদের মতো কোনো রক্ত-মাংসের হাত এই দরজার কুলুপ খুলেছে৷ আরও একটা ব্যাপার বেশ বোঝা যাচ্ছে৷ অমিয়বাবু ঠিক লোককেই ধরেছেন! এই নবাব আলি যেই-ই হোক, নিশ্চয়ই সে অপরাধীদের একজন৷ হয়তো সে-ই হচ্ছে দলপতি, নইলে এমন করে পালিয়ে যেত না৷’
নিশীথ বলল, ‘কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে ফাঁড়ির ভিতরে নবাবের পালাবার সাহায্য করল কে?’
মানিক বলল, ‘দরজার সামনে যে একজন চৌকিদার ছিল, সে কোথায় গেল?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘এও বুঝতে পারছ না? ফুসমন্ত্রে উড়ে গেছে!’
জয়ন্ত লন্ঠনটা মাথার উপরে তুলে এদিকে-ওদিকে চেয়ে দেখল৷
মানিক এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘উঠানের উপরে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে ও কে বসে আছে?’
সেই চৌকিদার৷ মানিক তার কাঁধে হাত দিতেই সে এলিয়ে একদিকে হেলে পড়ল৷
মানিক সচমকে বলল, ‘জয়, এ একেবারে মরে কাঠ হয়ে আছে! কিন্তু এর গায়ে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই৷’
জয়ন্ত লন্ঠন নিয়ে এগিয়ে চৌকিদারের মরা মুখ দেখেই স্তম্ভিত হয়ে গেল৷ তার ভুরু দুটো কপালের দিকে উঠে গেছে, তার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে যেন বাইরে ঠিকরে পড়তে চাইছে এবং তার মুখ হাঁ করে আছে৷ মৃত মানুষের মুখে এমন ভীষণ ভয়ের চিহ্ন সে আর কখনো দেখেনি৷ সে যেন চোখের সামনে নরক-দৃশ্য দেখেই আত্মহারা হয়ে মারা পড়েছে!
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – প্রান্তর-সমুদ্রে
খানিকক্ষণ পরে জয়ন্ত ধীরে ধীরে বলল, ‘হ্যাঁ, এ লোকটকে কেউ খুন করেনি৷ কেবল ভয় পেয়েই এ মারা পড়েছে৷’
মানিক বলল, ‘ভেবে দেখো জয়, যা দেখলে মানুষ মারা পড়তে পারে, সেটা কতদূর ভয়ানক দৃশ্য!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘এই চৌকিদার বেচারা চোখের সামনে নিশ্চয় কোনো আস্ত জলজ্যান্ত ভূত দেখেছিল!’
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘আস্ত বা আধখানা, জ্যান্ত বা মরা-কোনোরকম ভূত-টুতই আমি বিশ্বাস করি না৷ চৌকিদার সত্যই যদি কোনো ভূত দেখে থাকে তবে বুঝতে হবে যে, ভূতের ছদ্মবেশে সে কোনো মানুষকেই দেখেছে৷’
ইতিমধ্যে মহম্মদ সাহেব ও থানার অন্যান্য লোকেরাও গোলমাল শুনে বেরিয়ে এসে ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷
মৃত চৌকিদারের সেই ভয়বিকৃত ভয়ানক মুখ এবং বিস্ফারিত ও স্তম্ভিত দৃষ্টি আর তাকিয়ে দেখে সহ্য করা যাচ্ছিল না, একজন তাড়াতাড়ি গিয়ে লাশের উপর কাপড় চাপা দিল৷
মহম্মদ ভাবতে ভাবতে বললেন, ‘ইসাক খুব সাহসী চৌকিদার ছিল, শয়তানের সুমুখে গিয়েও বোধ হয় দাঁড়াতে ভয় পেত না৷ অথচ বেশ বোঝা যাচ্ছে, বিষম ভয়েই তার প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে৷ তাকে এমন আশ্চর্য ভয় কারা দেখাল? নবাব ছিল ঘরের ভিতরে বন্ধ, আর দরজার কুলুপের চাবি ছিল ইসাকের পকেটে৷ কারা এসে সেই চাবি নিয়ে দরজা খুলে নবাবকে খালাস করে দিল? বুঝতে পারছি, নবাবের একটা দল আছে৷ কিন্তু তারা এর মধ্যে খবর পেল কেমন করে? সুন্দরবাবু, আপনি তো কলকাতা পুলিশের পুরোনো আর পাকা লোক, আজকের রহস্য কিছু বুঝতে পারছেন কি?’
সুন্দরবাবু বিষণ্ণভাবে মাথার টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘হুম! এর মধ্যে আর না-বোঝবার কী আছে? আমি তো গোড়া থেকে বলছি, এসব হচ্ছে ভৌতিক ব্যাপার! শিগগির রোজা না ডাকলে আমাদের সবাইকেই অমনি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মরে থাকতে হবে!’
হঠাৎ মানিক বলে উঠল, ‘আচ্ছা, এইমাত্র এখানেও তো আমরা তালে তালে পা ফেলে কাদের চলে যেতে শুনেছি৷ কে তারা?’
গোলে-হরিবোলে জয়ন্তও এতক্ষণ সে কথাটা ভুলে গিয়েছিল৷ সেও উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ‘মানিক, মানিক! শিগগির আমাদের বন্দুকগুলো আনো! তারাই হচ্ছে নবাবের দল! মহম্মদ সাহেব, আর এক মিনিটও দেরি নয়-চলুন আমরা তাদের পিছনে ছুটি,-তারা এখনও বেশি দূরে পালাতে পারেনি৷’
মহম্মদ নারাজ হলেন না৷ তখনই সশস্ত্র হয়ে সবাই থানা থেকে বেরিয়ে পড়ল৷
মহম্মদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জয়ন্তবাবু, তাদের দলে কত লোক আছে?’
‘জানি না৷ হয়তো ছ-সাতজন, হয়তো আরও বেশি৷’
‘তাদের দেখেই কি ইসাক মারা পড়েছে?’
‘হতে পারে৷’
‘দূর থেকে খালি কতকগুলো অস্পষ্ট সাদা সাদা মূর্তি দেখেছি৷’
সকলে একটা তে-মাথার উপর এসে দাঁড়িয়ে পড়ল৷
তখনও ঝরছে সেই অশ্রান্ত বৃষ্টি এবং থেকে থেকে কেঁদে কেঁদে উঠছে ঝোড়ো বাতাস৷ বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কালো মেঘ থেকে ঘন অন্ধকারও যেন পৃথিবীর বুকে ঝরঝর করে ঝরছে ক্রমাগত৷ সেই জমাট অন্ধকারকে ছ্যাঁদা করে পুলিশদের লন্ঠনের আলো বেশি দূর অগ্রসর হতে পারছিল না৷
মহম্মদ বললেন, ‘এইবারই তো মুশকিল! পথ গিয়েছে তিন দিকে, কিন্তু সেই বদমাইশরা গিয়েছে কোন দিকে?’
জয়ন্ত বলল, ‘এক কাজ করা যাক৷ মহম্মদ সাহেব আর সুন্দরবাবু যান সামনের দিকে৷ অমিয়বাবু, নিশীথবাবু যান বাঁদিকে, আমি আর মানিক যাই ডানদিকে৷ সব দলেই জন-কয় করে চৌকিদার থাকুক৷’
মহম্মদ বললেন, ‘এ-ব্যবস্থা মন্দ নয়৷ যে-দল প্রথমে শত্রুর দেখা পাবে, তখনই যেন তিন বার বন্দুক ছোড়ে৷ তাহলেই অন্য দু-দল তাদের সাহায্য করতে যেতে পারবে৷’
ডানদিকের পথ হচ্ছে আলিনগরে যাবার পথ৷ জয়ন্তর ধারণা, নবাব সদলবলে এই পথই ধরেছে৷ জয়ন্ত ও মানিকের সঙ্গে রইল ছয়জন চৌকিদার৷
জলমাখা অন্ধকারের গায়ে বার বার ধাক্কা খেতে খেতে দুটো লন্ঠনের আলো অগ্রসর হচ্ছে এবং তারই পিছনে চলেছে জয়ন্ত, মানিক ও চৌকিদাররা৷ দুই ধারের ঘনবিন্যস্ত গাছপালার মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যেন বজ্রাগ্নিদগ্ধ বিনিদ্র রাত্রির যন্ত্রণাভরা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস৷ চিরকাল যারা কালো রাত্রির সঙ্গী, সেই নিশাচর পেচক ও বাদুড়দেরও আজ দেখা নেই এবং শৃগালরাও আজ এই বীভৎস রাত্রের কালিমার চেয়ে গর্তের অভ্যস্ত কালিমাকে নিরাপদ ভেবে শিকারের লোভ ছেড়ে বাসার ভিতরে বসে আছে৷ ঘ্যানঘেনে ঝিঁঝিপোকাগুলোও মুখ বুজে যেন কোনো অভাবিত অমঙ্গলের জন্যে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে৷
বৃষ্টি, বাতাস ও তরুমর্মর ছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না৷
জয়ন্ত এগোতে এগোতে বারংবার বলছে, ‘আরও তাড়াতাড়ি-আরও তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলো৷ তারা অনেকটা এগোবার সময় পেয়েছে, তবু তাদের ধরতে হবেই!’ যে দুনিয়ায় আজ কীটপতঙ্গের মতো জীবেরও সাড়া নেই সেখানে মানুষের এই উৎসাহিত কন্ঠস্বর কী অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে! তার গলার আওয়াজ শুনে গর্তের ভিতরে ঘুমন্ত বন্য পশুরা সভয়ে চমকে জেগে উঠতে লাগল৷
লোকালয় পিছনে ফেলে তারা এখন একটা বনের ভিতরে এসে পড়েছে৷ মানিক হতাশ কন্ঠে বলল, ‘জয়, হয়তো তারা এ-পথে আসেনি৷’
জয়ন্ত বলল, ‘অন্য দুটো পথের দিক থেকেও তো আমাদের কারুর বন্দুকের আওয়াজ শুনছি না৷ তুমি কি বলতে চাও তারা কোনো পথে না গিয়ে হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে? তুমিও কি ভূত মানো? যতক্ষণ না ওরা বন্দুক ছোড়ে, ততক্ষণ আমাদের এগিয়ে যেতে হবেই৷’
‘কিন্তু যদি তারা এই বনে ঝোপেঝাড়ে কোথাও গা-ঢাকা দেয়? অন্ধকারে তাদের কি আর খুঁজে বার করতে পারবে?’
‘সে মুশকিলের সম্ভাবনা আছে বটে, কিন্তু তবু থামলে আমাদের চলবে না৷ এগিয়ে চলো-আরও তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলো!’
সারা বন যেন আজ বিভীষিকার মদে মাতাল হয়ে টলোমলো৷ বড়ো বড়ো গাছের ডালপাতার জালে বাঁধা পড়ে ঝোড়ো হাওয়া কখনো করছে তীক্ষ্ণ স্বরে হাহাকার, কখনো করছে ভৈরব বিক্রমে ভীষণ গর্জন৷ সেইসঙ্গে ছোটো-বড়ো দমকা হাওয়ার দল গলা মিলিয়ে আরও যে কতরকম অদ্ভুত আওয়াজে চতুর্দিক পরিপূর্ণ করে তুলেছে, তা বর্ণনা করবার ভাষা কারুর কলমে নেই৷
বন শেষ হল-তারপরেই সকলে একটা মাঠের উপরে এসে পড়ল৷
একজন চৌকিদার লন্ঠনটা উঁচু করে তুলে ধরে সামনের দিকে দেখবার বৃথা চেষ্টা করে বলল, ‘হুজুর, মাঠে জল থইথই করছে, পথ আর দেখা যাচ্ছে না৷’
জয়ন্ত দৃঢ়স্বরে বলল, ‘জল ভেঙে এগিয়ে চলো৷’
‘কিন্তু কোনদিকে যাব? পথ কোথায়?’
‘সোজা চলো৷’
‘এই মাঠে যে খানাডোবা-পুকুর আছে! যদি কোনো পুকুরে গিয়ে পড়ি?’
‘আমি তোমাকে টেনে আবার ডাঙায় তুলব৷ কিন্তু এগিয়ে চলো-এগিয়ে চলো!’
আর একজন চৌকিদার বলল, ‘হুজুর, এ-মাঠে এখন কোমর ভোর জল আছে, তার ওপরে এ-হচ্ছে বানজল-এর টানে আমরা ভেসে যেতেও পারি৷’
জয়ন্ত বলল, ‘এই জল ভেঙে নবাব যখন তার দলবল নিয়ে যেতে পেরেছে, তখন আমরাই বা ভেসে যাব কেন?’
‘না হুজুর, নবাবরা নিশ্চয় এদিকে আসেনি৷’
‘যদি এসে থাকে, তাহলে তারা ওই বনের ভিতর লুকিয়ে আছে৷’
জয়ন্ত ও মানিক বুঝল, চৌকিদাররা আর এক-পা এগোতে রাজি নয়৷ আর তাদেরই বা দোষ কী? এই অন্ধকার, এই ঝড়ের দাপট, মাঠ দিয়ে এই বন্যার মতো জলপ্রবাহ, এই অবিরাম বৃষ্টির কনকনে ঝাপটা-যা তাদের হাড়ের ভিতর পর্যন্ত ভিজিয়ে স্যাঁতসেঁতে করে দিয়েছে, তার উপরে অজানা ভয়ানক শত্রুর ভয় তো আছেই৷ আর, সে বড়ো যে-সে শত্রু নয়-কেবলমাত্র তাদের স্বচক্ষে দেখেই সাহসী চৌকিদার ইসাক ইহলোক ছেড়ে পালিয়ে না গিয়ে পারেনি৷
জয়ন্ত ও মানিক দোমনা হয়ে অতঃপর কী করা উচিত তাই ভাবছে, এমন সময় দেখা গেল সেই জলমগ্ন প্রান্তরের মাঝখানে নিবিড় অন্ধকারের গলায় দুলছে যেন একসার আলোর মালা৷
জয়ন্ত চমকে বলে উঠল, ‘ও কী ব্যাপার!’
চৌকিদাররা বলল, ‘আলেয়া!’
মানিক বলল, ‘এতক্ষণ ও-আলোগুলো কোথায় ছিল?’
জয়ন্ত উচ্চৈঃস্বরে গুনল, ‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়! মানিক, মানিক, আবার সেই ভয়ংকর ছয়!’
‘তাহলে ওরাই হচ্ছে নবাবের সাঙ্গোপাঙ্গ! আঁধারে গা ঢেকে ওরা তো বেশ পালিয়ে যাচ্ছিল, মরতে আলো জ্বেলে আবার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল কেন?’
‘আর একটা কথা বুঝে দেখো মানিক৷ আমাদের লন্ঠন দুটো সমানে জ্বলছে; এ-আলো ওরা দেখেছে, আর নিশ্চয়ই বুঝেছে যে আমরা ওদের ধরবার জন্যেই ছুটে এসেছি৷ সেটা বুঝেও ওরা আমাদের চোখের সামনেই আলো জ্বালতে ভয় পায়নি৷’
‘তাহলে কি হঠাৎ ওদের আরও অনেক নতুন লোক এসেছে? ওরা কি ভাবছে যে, আর আর ভয় করবার দরকার নেই?’
‘ওরা কী ভাবছে তা কে জানে! এসো, আগে আমরা তিনবার বন্দুক ছুড়ে আর সবাইকে জানিয়ে দি যে, শত্রুদের দেখা পাওয়া গেছে!’
জয়ন্ত ও মানিক তিনবার বন্দুক ছুড়ল-তার তীব্র শব্দে চারিদিক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল৷
দূর থেকে আঁধার রাত্রির বক্ষ ভেদ করে আরও কয়েকটা বন্দুকের গর্জন বাতাস-তরঙ্গের ভিতর দিয়ে শব্দ-তরীর মতো ভেসে এল৷ বোঝা গেল, আর সবাই তাদের সংকেত শুনেই সাড়া দিল এবং শীঘ্রই তারা তাদের কাছে এসে হাজির হবে৷
জয়ন্ত বলল, ‘আমরা কোথায় আছি, আলো জ্বেলে রেখে শত্রুদের সেটা আর দেখিয়ে দেবার দরকার নেই৷ লন্ঠন দুটো নিবিয়ে ফেলো৷’
কিন্তু ইতিমধ্যেই আর-একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে মানিক উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ‘জয়, জয়! ওদের আলোগুলো যে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে!’
সত্যই তাই! ছয়টা আলো দুলতে দুলতে জয়ন্তদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে৷
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি বলল, ‘আলো নেবাও! ওরা আমাদের আক্রমণ করতে আসছে!’
চৌকিদাররা চটপট আলো নিবিয়ে ফেলল৷
তারপর ওদিককার আলোগুলো আসতে আসতে আবার থেমে পড়ল৷
জয়ন্ত বলল, ‘এসো, আমরা জলে নেমে খানিকটা এগিয়ে থাকি৷ আমাদের দলবল এসে পড়লেই আমরা ওদের আক্রমণ করব৷ বন্দুক তৈরি রাখো, ওরা কাছে আসবার বা পালাবার চেষ্টা করলেই যথাসময়ে আমাদের আত্মরক্ষা বা আক্রমণ করতে হবে৷
জয়ন্ত ও মানিকের সঙ্গে চৌকিদাররাও অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও জলের ভিতরে নামল৷ জল কোথাও প্রায় কোমর পর্যন্ত, কোথাও তার চেয়ে কম৷
আঃ, সেই অস্বাভাবিক বৃষ্টি-আকাশে এত জলও থাকতে পারে! সারা প্রান্তর যেন সমুদ্রের ক্ষুদ্র সংস্করণে পরিণত হয়েছে এবং ঝড়ের উদ্দামতা তার মধ্যে রীতিমতো তরঙ্গের পর তরঙ্গ সৃষ্টি করছে৷ ধারাপাতের রমঝম রমঝম ধ্বনির সঙ্গে জেগে আছে সেই সুবৃহৎ প্রান্তর-দিঘির পাগলা স্রোতের কলকল কলকল শব্দ৷ সে জলের কী প্রচণ্ড টান! প্রতি পদেই সকলকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে৷ তার উপরে রাত্রির কালো রং এত পুরু যে, প্রান্তরের মাঝে মাঝে যে গাছগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে, একেবারে তাদের উপরে গিয়ে পড়ে ধাক্কা না-খাওয়া পর্যন্ত কারুর অস্তিত্ব জানবার উপায় নেই৷
বহু দূরে ছয়টা আলো কালো শূন্যের কোলে কখনো দেখা দিচ্ছে, কখনো নিবে যাচ্ছে, জয়ন্তর মনে হল, আলোগুলো যেন তাদের চেয়ে উঁচুতেই রয়েছে৷
জয়ন্তই সকলের আগে আগে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ সে পায়ের তলায় আর মাটি পেল না এবং অতলের দিকে তলিয়ে গেল৷ তাড়াতাড়ি জলের উপরে ভেসে উঠে সে বলল, ‘হুঁশিয়ার! এখানে একটা পুকুর আছে!’
আন্দাজে আন্দাজে পুকুরের গভীরতা এড়িয়ে অন্য দিক দিয়ে তারা আবার অগ্রসর হতে লাগল৷
মানিক সভয়ে বলে উঠল, ‘আমার পায়ের উপর দিয়ে সাপের মতো কি একটা সাঁৎ করে চলে গেল!’
জয়ন্ত বলল, ‘সাপের মতো বলছ কেন মানিক, ওটা সাপ ছাড়া আর কিছুই নয়৷’
একজন চৌকিদার বলল, ‘এ-সময়ে মাঝে মাঝে মাঠের জলে কুমিররাও ভেসে আসে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ, তারাও আর বাকি থাকে কেন? কেবল কুমির নয়, আমি শুনেছি বানের জলে বাঘ-ভাল্লুকও বাধ্য হয়ে সাঁতার কাটে৷’
ছয়টা আলো বেশ খানিকটা কাছে এসে পড়েছে৷ সেগুলো এদিক-ওদিক নড়ছে বটে, কিন্তু অন্য কোনোদিকে আর অগ্রসর হচ্ছে না৷
জয়ন্ত বলল, ‘নবাব বোধ হয় বুঝতে পেরেছে, আমরা তাদের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি৷ সে হয়তো দলবল নিয়ে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্যেই প্রস্তুত হয়ে আছে৷’
মানিক নিজের বন্দুকটা আরও জোরে চেপে ধরল৷
আরও কিছুদূর এগিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘নবাব খুব চালাক লোক বটে৷ দেখছ মানিক, আলোগুলো এখনও আমাদের কত উপরে নড়াচড়া করছে? এই মাঠের কোনো-একটা উঁচু জায়গা নিশ্চয় দ্বীপের মতো জলের উপর জেগে আছে৷ নবাব তার দল নিয়ে তার উপরে উঠে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে৷ যুদ্ধ বাধলে আমাদেরই বিপদ৷’
মানিক ভাবতে লাগল, নবাবকে আজ তারা দেখেছে বটে, কিন্তু তার দলের লোকগুলো দেখতে কেমন? অমিয় যে বর্ণনা করেছে, তাতে তো তাদের আকৃতি অমানুষিক বলেই মনে হয়৷ চৌকিদার ইসাকও তাদের চেহারায় অমানুষিক কোনো ভাব দেখে ভয়ে মারা পড়েছে৷ এ-রহস্যের কারণ কী? কে তারা?
এমন সময়ে দুই-তিনবার বন্দুকের শব্দ হল৷
সকলে ফিরে দেখল, পিছনে-যেদিক থেকে তারা এসেছে সেইদিকে অনেক দূরে চারটে আলো দেখা দিয়েছে৷
জয়ন্ত ও মানিক আবার তিনবার বন্দুক ছুড়ে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানিয়ে দিল, কারণ এই নতুন আলোগুলোর সঙ্গে আসছে যে তাদেরই বন্ধুরা সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷
কিন্তু শত্রুদের আলোগুলো তখনও নিবে বা পালিয়ে গেল না৷
জয়ন্ত বলল, ‘নবাব কী বুঝেছে তা সেই-ই জানে৷ এত লোক দেখেও সে ভয় পেল না? না, বানের জলে তার পালাবার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই সে মরিয়া হয়ে আমাদের সঙ্গে লড়াই করবে?’
মানিক চোখের সুমুখে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল, কতকগুলো ভৌতিক মূর্তি দীর্ঘ দীর্ঘ বাহু বাড়িয়ে তাদের সকলকে এগিয়ে আসবার জন্যে আগ্রহে আহ্বান করছে৷
সপ্তম পরিচ্ছেদ – রক্তশূন্য মড়া
ঘুটঘুটে কালোর কোলে মিটমিটে আলোর মালা৷ এতগুলো বন্দুকের আওয়াজ শুনেও মালাকাররা মালা ছিঁড়ে পালিয়ে গেল না৷
অথচ তারা এত কাছে এসে পড়েছে!
মানিক বলল, ‘জলের ভিতর নিশ্চয়ই একটা উঁচু জমি আছে, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না৷ কিন্তু সেই জমির উপরেই গাছপালার ভিতর থেকে যে ওই আলোগুলো দেখা যাচ্ছে এটা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি৷ জয়, ওরা হয় পাগল, নয় মরিয়া৷ আমার মতে, আমাদের দল যখন সাড়া আর দেখা দিয়েছে, তখন তাদের জন্যে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত৷ তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে আক্রমণ করব৷’
জয়ন্ত বলল, ‘তোমার পরামর্শই শুনব৷ আমাদের পুরো দলে থাকবে পঁচিশটা বন্দুক নিয়ে পঁচিশজন লোক৷ এদের নিয়ে দস্তুরমতো একটা খণ্ডযুদ্ধের আয়োজন করা যেতে পারে৷’
তারা সেইখানে প্রায় বুক পর্যন্ত জলে শরীর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে সঙ্গীদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল৷
এতক্ষণ পরে আকাশের বজ্র, মেঘের বৃষ্টি ও ঝড়ের রুদ্রগতি শান্ত ও ক্ষান্ত হবার চেষ্টা করল৷ তারপর যখন সদলবলে মহম্মদ, সুন্দরবাবু, অমিয়, নিশীথ ও পরেশ এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল, তখন বজ্র বৃষ্টি ও ঝড় পৃথিবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে বটে, কিন্তু অন্ধকারের নিবিড়তা ও প্রান্তর-সমুদ্রে বন্যার কলকল্লোল জেগে রইল আগেকার মতোই৷
সুন্দরবাবু এসে জয়ন্তর সুবৃহৎ দেহের উপরে হেলে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলেন, ‘বাস রে বাস! চরকির মতো ছুটোছুটি করে এক মিনিট যে বসে জিরিয়ে নেব তারও উপায় দেখছি না! এই অগাধ সাগরে বসে পড়লেই ডুবে যাব, আর ডুবে গেলেই ভেসে যাব! হুম!’
মানিক বলল, ‘ভয় কী সুন্দরবাবু, ভেসে গেলে আপনি তো চিতসাঁতার কাটতে পারবেন৷’
সুন্দরবাবু ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠাট্টা কোরো না মানিক, এ-ঠাট্টা-ফাট্টা ভালো লাগে না!’
মহম্মদ বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, ও-গুলো নিশ্চয়ই শত্রুদের আলো?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে৷ নইলে এই দুর্যোগে এখানে এসে দেওয়ালি-উৎসব করবার শখ হবে কার?’
‘কিন্তু নবাবের আস্পর্ধা তো কম নয়! সে আলো জ্বেলে বসে আছে, যেন আমাদের কোনো তোয়াক্কাই রাখে না!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ভূত আবার কবে মানুষের তোয়াক্কা রাখে? মানুষ হলে ওরা এতক্ষণে বাপ-বাপ বলে পালিয়ে যেত!’
মহম্মদ বললেন, ‘রাতও আর বেশি নেই, কথায় কথায় সময় কাটাবারও আর দরকার নেই৷ চলুন, আমরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এগিয়ে যাই, ওদের একেবারে ঘিরে ফেলি৷’
সকলে অর্ধচন্দ্রাকারে সামনের উঁচু জমির দিকে এই অবস্থায় যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি অগ্রসর হল৷ আলোগুলো তবু নেববার বা পালাবার চেষ্টা করল না৷
মহম্মদ বললেন, ‘এখান থেকে বন্দুক ছুড়ে আমরা অনায়াসেই ওদের মারতে পারি! আচ্ছা, একবার বন্দুক ছুড়ে ওদের ভয় দেখানো যাক৷’
মহম্মদ ও তাঁর দেখাদেখি আরও কেউ কেউ বন্দুক ছুড়লেন, ওদিক থেকে তবু কোনো উত্তরই এল না, ফিরে এল খালি তাঁদের নিজেদের বন্দুক-গর্জনের প্রতিধ্বনি এবং বেপরোয়া আলোগুলো তখনও অচল৷
সুন্দরবাবু রেগে তিনটে হয়ে বললেন, ‘ওরা ভূতই হোক আর রাক্ষসই হোক, ওদের আস্পর্ধা আর আমি সইতে পারছি না! আমরা পুলিশের লোক-বিশেষ করে আমি হচ্ছি গিয়ে ক্যালকাটা পুলিশের লোক-আমাদের সঙ্গে চালাকি? আমি এইবার সত্যি সত্যি ওদের হাতের আলো টিপ করে গুলি ছুড়ব!’
সুন্দরবাবু লক্ষ্য স্থির করে দু-বার বন্দুক ছুড়লেন৷ একটা আলো নিবে গেল, কিন্তু অন্য আলোগুলো তবু সরে গেল না৷
অমিয় বলল, ‘নাঃ, দেখছি ওরা এইবার সত্যিই অবাক করল! ওদের কি ভয়ডর কিছুই নেই?’
মহম্মদ বললেন, ‘চলো, আমরা সবাই এইবারে জমির উপরে উঠে ওদের আক্রমণ করি৷’
সুন্দরবাবু সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, ‘হুম! মহম্মদ সায়েব, আমার মনে হয় ওরা অন্ধকারে আমাদের জন্যে কোনো ফাঁদ পেতে রেখেছে! ওই আলোগুলো হচ্ছে টোপ৷ এগুলে বিপদ হতে পারে!’
মহম্মদ বললেন, ‘হ্যাঁ, হতে পারে৷ তবু আমি এগোব৷ চলো সবাই, হুঁশিয়ার!’
সবাই অগ্রসর হল৷
জয়ন্ত চুপিচুপি বলল, ‘মানিক, আমার মনে একটা সন্দেহ জাগছে৷’
‘কী?’
‘হয়তো আমরা এখনই নিরেট গাধা বলে প্রমাণিত হব৷’
‘তার মানে?’
‘এই তো উঁচু জমির তলায় এসে দাঁড়িয়েছি৷ মহম্মদ সায়েব উপরে উঠে গিয়েছেন৷ আলোগুলো এখনও জ্বলছে৷ না, এ অসম্ভব!’
জয়ন্ত ও মানিক পাশাপাশি থেকে জমির উপরে উঠতে লাগল৷ তখনও কোনো শত্রু কি বীভৎস মূর্তির সাড়া পাওয়া গেল না৷
কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল মহম্মদের৷ নীচে যারা ছিল তারা সবাই শুনল, মহম্মদ বিপুল বিস্ময়ে চিৎকার করে বলছেন, ‘কেউ এখানে নেই, কেউ এখানে নেই৷’
তারপরই সুন্দরবাবুর কন্ঠস্বর, ‘হুম! গাছের ডালে খালি লন্ঠনগুলো ঝুলছে৷ আমাদের ভয়ে ভূতগুলো চম্পট দিয়েছে!’
উঁচু জমি উপরে জল ওঠেনি৷ বৃষ্টি-ভেজা জমির উপরে বসে পড়ে জয়ন্ত বলল, ‘মানিক পূর্বদিকে মেঘের পর্দা ছিঁড়ে গিয়েছে৷’
মানিক বলল, ‘কিন্তু এ কীরকম ব্যাপার?’
জয়ন্ত পূর্বাকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত মৃদুস্বরে বলল, ‘প্রথম উষার স্বপ্নময় আলো ফুটছে৷ বর্ষা-প্রভাতে আলোকের নবজন্ম কী মধুর!’
সুন্দরবাবু এসে বললেন, ‘এখন তোমার কবিত্ব রাখো জয়ন্ত৷ নবাব কোনদিকে গেল বলো দেখি?’
‘যেদিকে রাত্রি গেছে সেইদিকে৷’
‘কী বলছ হে?’
‘যারা রাত্রির অনুচর তারা প্রভাতের প্রতীক্ষা করে না৷ চেয়ে দেখুন, উষা এখন সিঁথায় সিঁদুর পরেছে৷ মানিক, ভৈরব রাগে এখন একটা ভজন গাইতে পার?’
বন্ধুর মাথা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে ভেবে জয়ন্তর মুখের দিকে মানিক কটমট করে তাকিয়ে দেখল৷
জয়ন্ত হঠাৎ অট্টহাস্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল৷ সুন্দরবাবু ভয় পেয়ে দুই-পা পিছিয়ে গেলেন৷ তিনিও ঠাউরে নিলেন জয়ন্ত পাগল হয়ে গিয়েছে, হয়তো এখনই সে তাঁকে কামড়ে দেবে!
মহম্মদ আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, এত হাসছেন কেন? এই কি হাসবার সময়?’
জয়ন্ত হাসতে হাসতেই বলল, ‘বলেন কী মহম্মদ সায়েব! এত বড়ো প্রহসনেও হাসব না? ওই লন্ঠনগুলো আলো নয়, আলেয়ার মতোই আমাদের বিপথে চালনা করে সাত ঘাটের জল খাইয়ে, কাদা ঘাঁটিয়ে এখানে এনে ফেলেছে৷ বুঝেছেন? নবাব আমাদের চেয়ে ঢের বেশি চালাক৷ সে অন্ধকারে গাছের ডালে এই লন্ঠনগুলো ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছে কেবল আমাদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্যে৷’
‘অর্থাৎ?’
‘অর্থাৎ আমরা যখন আলোর দিকে ছুটে আসব তারা তখন অন্যদিকে ছুটে পালিয়ে কলা দেখাবার সময় পাবে৷ বাহাদুর নবাব, বাহাদুর! কাজেই এখন প্রভাতের সূর্যোদয় দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করবার নেই৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমি ওই হতভাগা সূর্যোদয় দেখতে চাই না!’
‘তাহলে কী করবেন?’
‘আমি এখন ঘুমোতে চাই৷’
‘তাহলে ঘুমিয়ে পড়বার আগে নবাবের নামে একবার জয়ধ্বনি দিন৷’
‘হুম! নিজের মুখে চুনকালি মাখিয়ে শত্রুর নামে জয়ধ্বনি দেবার ইচ্ছে আমার নেই!’
‘কিন্তু সুন্দরবাবু, আমার ওটুকু উদারতা আছে৷ আমাদের মতো এতগুলো মাথাকে যে পাঁকে ডুবিয়ে দিয়ে গেল, সে অসাধারণ ব্যক্তি! এমনধারা অসাধারণ শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে নেমে যদি কেল্লা ফতে করতে পারেন, তাহলে সেই জয়ই হবে অতুলনীয়৷ এতদিন পরেই তো খেলা জমে উঠল! এখন দেখা যাক কে হারে কে জেতে!
উপরি উপরি বিষম কর্মভোগের পর প্রায় সকলেরই শরীরের অবস্থা হল এমন শোচনীয় যে, তার পরদিন কেউ আর বিছানা থেকে উঠবার নাম করল না৷
তার পরের দিনের রাত্রি প্রভাত হলে পর মানিক বিছানা থেকে উঠে দেখল, জয়ন্তর শয্যা শূন্য৷ সে কখন উঠে বেরিয়ে গিয়েছে৷
সুন্দরবাবুও তখন গাত্রোত্থান করে দাড়ি কামাতে বসে গিয়েছেন৷
এমন সময় মহম্মদ এসে ঘরের ভিতর ঢুকলেন৷
মানিক শুধোল, ‘কী মহম্মদ সায়েব, এর মধ্যে নবাবের আর কোনো খবর পাননি?’
তিনি বললেন, ‘না৷ কিন্তু এখানকার এক মুসলমান দোকানির একটি মেয়ে চুরি গিয়েছে৷’
মানিক উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘আবার মেয়ে-চুরি!’
‘হ্যাঁ৷ কিন্তু এবারে কেবল মেয়ে-চুরি নয়, সঙ্গে সঙ্গে খুন৷’
সুন্দরবাবু চমকে উঠে দাড়ির উপরে ক্ষুরের কোপ বসাতে বসাতে ভারি সামলে গেলেন৷
মহম্মদ বললেন, ‘কাল রাত্রে দোকানি বাসায় ছিল না৷ ঘরের ভিতরে তার প্রৌঢ়া স্ত্রী আর সতেরো বছরের মেয়ে ঘুমোচ্ছিল৷ গভীর রাত্রে পাড়ার লোকে শুনতে পায়, দোকানির ঘরের ভিতর থেকে মেয়ে-গলায় চিৎকার হচ্ছে৷ পাড়ার লোক যখন বাইরে বেরিয়ে আসে, চিৎকার তখন থেমে গেছে৷ কিন্তু চিৎকারের বদলে তারা তখন আর একটা শব্দ শুনতে পেল৷ কারা যেন সমতালে পা ফেলে ফেলে অন্ধকারে গা ঢেকে চলে যাচ্ছে৷ এই পায়ের শব্দের কথা এখন এ-অঞ্চলের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ সেই শব্দ শুনেই পাড়ার লোকের সমস্ত সাহস উবে যায়,- সকলে আবার যে যার ঘরে ঢুকে খিল এঁটে দেয়৷ আজ সকালে উঠে সবাই দোকানির ঘরে ঢুকে দেখে, তার মেয়ে অদৃশ্য, আর তার বউ মরে কাঠ হয়ে মেঝের উপর পড়ে রয়েছে৷’
সুন্দরবাবু ক্ষুর নামিয়ে ঘুরে বসে বললেন, ‘হুম! আধখানা দাড়ি আমি পরে কামাব, আগে সব গল্পটা শুনেনি!’
মহম্মদ বললেন, ‘খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হলাম৷ ভয়ানক দৃশ্য! একটি আধবয়সী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ, আর তার আতঙ্কভরা চোখ-মুখ দেখে আমার ইসাক বেচারির মুখ মনে পড়ে গেল৷ ইসাকের মুখ-চোখেও ঠিক এইরকম বীভৎস ভয়ের ভাব মাখানো ছিল৷ স্ত্রীলোকটির গলায় একটা মস্ত ছ্যাঁদা, কিন্তু ঘরের কোথাও রক্তের একটুও চিহ্ন নেই৷ অথচ তার দেহ একেবারে সাদা, যেন সমস্ত রক্তই সেই গলার ছ্যাঁদা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে৷ ঘরের কোথাও রক্ত নেই, দেহেও রক্ত নেই-অথচ গলায় কত বড়ো ছ্যাঁদা! আমি তো হতভম্ব হয়ে গিয়েছি!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমি বরাবরই বলছি এ-সব ভূতুড়ে কাণ্ড, তা তোমরা কেউ তো আমার কথায় কান পাতবে না!’
মহম্মদ বললেন, ‘তা যদি হয়, তবে এ-সব কাণ্ডের সঙ্গে নবাবের কোনো সম্পর্ক নেই৷ কারণ নবাবকে আমরা গ্রেপ্তার করেছিলাম, সে আমাদেরই মতো রক্ত-মাংসের মানুষ৷’
নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে অমিয়ও সব শুনছিল৷ এখন সে উঠে বসে বলল, ‘কিন্তু আলিনগরে যে ছয়টা মূর্তি তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে এসে আমাদের আক্রমণ করেছিল, আমাদের বন্দুকের গুলিও যাদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি, তাদের চেহারাও ছিল অবিকল সাধারণ মানুষের মতো৷’
পরেশ ও নিশীথ উঠে বসে বলল, ‘আমরাও এ-কথায় সায় দিই৷’
মহম্মদ বললেন, ‘সমস্ত ব্যাপারই রহস্যময়৷ নবাব কেমন করে পালাল? কে তার ঘরের দরজা খুলে দিল? ইসাক কেন মারা পড়ল? পরশু রাত্রে গাছের ডালে আলো ঝুলিয়ে কারা আমাদের চোখে ধুলো দিল? কারা মেয়ে চুরি করে? কেন করে? পাড়া জাগিয়ে কারা তালে তালে পা ফেলে চলে যায়? এ-সব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই৷ আমি স্থির করেছি, আজই সদরে রিপোর্ট পাঠিয়ে সাহায্য চাইব৷’
অমিয় বলল, ‘কিন্তু এই সব রহস্যেরই মূল আছে সেই আলিনগরের ভগ্নস্তূপের মধ্যে৷’
মহম্মদ বললেন, ‘বেশ, সদর থেকে সাহায্য পেলে আমরা সদলবলে আলিনগরেও গিয়ে হাজির হতে পারব৷’
এমন সময় জয়ন্ত ফিরে এল৷ তার গম্ভীর মুখে চিন্তার রেখা৷
সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘জয়ন্ত! ভয়ানক খবর!’
জয়ন্ত ভুরু কুঁচকে সুন্দরবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে বলল, ‘এমন কী ভয়ানক খবর থাকতে পারে, যা আমি জানি না?’
‘হুম! এবার মেয়ে-চুরির সঙ্গে মেয়ের মা খুন!’
‘আমি জানি৷ এইমাত্র ঘটনাস্থল থেকেই ফিরে আসছি৷’
‘মহম্মদ সায়েব সদর থেকে সাহায্য আনিয়ে আলিনগর আক্রমণ করবেন৷’
‘কবে মহম্মদ সায়েব?’
‘দিন চারেক পরে৷’
জয়ন্ত আর কিছু না বলে মানিককে ইশারা করে আবার ঘরের বাইরে গেল৷
মানিক তার কাছে গেলে পর জয়ন্ত বলল, ‘আমি আরও দিন চারেক অপেক্ষা করতে পারব না৷ বিশেষত, এত লোকজন নিয়ে শোভাযাত্রা করে আলিনগরে গেলে আসামিরা সাবধান হয়ে পালাতে পারে৷’
‘তুমি কী করতে চাও?’
‘তুমি আর আমি কাল রাত থাকতে উঠে চুপিচুপি আলিনগরে যাত্রা করব৷’
‘সে কি, পায়ে হেঁটে? আলিনগর যে এখান থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে!’
‘না, এখানে আমার পরিচিত এক জমিদার-বন্ধু আছেন শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম৷ তিনিই মোটর দেবেন৷ অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হয়, তুমি আমি দু-জনে যেতে পারব৷ আগে নিজেরা খোঁজ নিয়ে আসি, তারপর দরকার হলে মহম্মদ সায়েবের সাহায্য নেব৷ মানিক, আজ যে অমানুষিক কাণ্ড স্বচক্ষে দেখে এসেছি, তারপর আর এখানে হাত-পা গুটিয়ে অপেক্ষা করা চলে না৷ সেই রক্তশূন্য মড়ার মুখ চিরদিন আমার মনে থাকবে! গলার ছ্যাঁদা নিয়ে নিশ্চয় রক্তের ঝরনা ঝরেছিল, কিন্তু সে রক্ত কোথায় গেল? আর, তার গলার ক্ষতটা কীরকম দেখতে জানো মানিক? যেন কোনো রক্তলোলুপ জন্তু ধারালো দাঁত দিয়ে তার গলা কামড়ে ধরেছিল-আর তার দেহের সমস্ত রক্ত সেই-ই প্রাণপণে শুষে পান করে ফেলেছে!’
অষ্টম পরিচ্ছেদ – প্রেতের প্রতিহিংসা
ভোরবেলায় মোটর ছুটে চলেছে আলিনগর৷
জয়ন্ত গাড়ির হুইল ধরে চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘মানিক, মাঠে মাঠে আর পথের মাঝে মাঝে দেখছি এখনও মন্দ জল জমে নেই৷ আমরা বেলা দুটো-আড়াইটের আগে আলিনগরে গিয়ে পৌঁছোতে পারব বলে মনে হচ্ছে না৷’
মানিক বলল, ‘কিন্তু আমরা দু-জনে আলিনগরে গিয়ে কী করব? সেখানে তুমি কী দেখবার আশা কর?’
‘তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে : গোয়েন্দার কাজ দল বেঁধে চলে না৷ তাতে শত্রুরা সাবধান হবার সুযোগ পায়৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রথম দিনেই আমাদের দলে যদি বেশি লোক না থাকত, তাহলে এতক্ষণে সমস্ত রহস্য হয়তো আমরা আবিষ্কার করে ফেলতে পারতাম৷ তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে : আলিনগরে গিয়ে যে কী দেখব, সেটা আমি নিজেই জানি না৷ গত পরশু পর্যন্ত এই রহস্য সম্বন্ধে আমার যে-ধারণা ছিল, গেলকাল সকালে সেই রক্তহীন মৃতদেহ দেখবার পর থেকে সে-ধারণা একেবারে বদলে গেছে৷ মাঝে মাঝে এখন মনে হচ্ছে, হয়তো সুন্দরবাবুর সন্দেহই সত্য, হয়তো এইসব মেয়ে-চুরির মধ্যে অলৌকিক কোনো ব্যাপারই আছে৷’
মানিক চকিত কন্ঠে বলল, ‘অলৌকিক বলতে তুমি কী বুঝেছ? ভৌতিক ব্যাপার?’
জয়ন্ত বলল, ‘ভূত বলতে লোকে যা মানে, আমি তা মানি না৷ ভূতে বেছে বেছে খালি মেয়ে চুরি করবে কেন? তবে, ভূতে যে মানুষ চুরি করে এমন এটা বিলাতি গল্প আমি পড়েছিলাম৷ আলিনগর এখনও অনেক দূরে৷ সময় কাটাবার জন্যে তুমি যদি সেই গল্পটা শুনতে চাও, আমি বলতে রাজি আছি৷ কিন্তু মনে রেখো, এটা গল্প ছাড়া আর কিছু নয়৷’
মানিক মোটরের একটা কোণ নিয়ে আরাম করে বসে বলল, ‘বলো৷’
জয়ন্ত গাড়ির গতি একবার থামিয়ে, রুপোর শামুকের ভিতর থেকে একটিপ নস্য নিয়ে নাকে গুঁজে গল্প আরম্ভ করল :
‘লন্ডন শহরের পথ৷ শীতার্ত রাত্রি৷ একখানা বাস ছুটেছে-আজকের মতো এই তার শেষ যাত্রা৷ বাসের ভিতরে নীচের তলায় লোকজন বেশি নেই৷
‘দোতলায় কেউ উঠেছে বলে কন্ডাক্টরের মনে হল না৷ তবু একবার নিশ্চিত হবার জন্যে সে বাসের দোতলায় গিয়ে উঠল৷
‘সামনের আসনে একজন আরোহী৷
‘কন্ডাক্টরের বিস্ময়ের সীমা রইল না৷ এই যাত্রীটি তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কখন উপরে উঠে বসে পড়েছে?
‘যাত্রী মাথার টুপিটা মুখের উপরে টেনে নামিয়ে দিয়েছে এবং মাফলার ও কোটের কলার দিয়ে মুখের নীচের দিকটা ঢেকে ফেলেছে-শীতে হাড়-কাঁপানো হাওয়ার চোট সামলাবার জন্যে৷ স্থিরভাবে বসে যেন আড়ষ্ট হয়েই সে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল৷
‘বোধ হয় সে কন্ডাক্টরের পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল৷ কারণ সে দুই আঙুলে একটি আনি ধরে হাত বাড়িয়ে বসে আছে৷
‘কন্ডাক্টর বলল, ওঃ, ভারি ঠান্ডা রাত মশাই!
‘যাত্রী জবাব দিল না৷
‘কোথায় যাবেন?
‘ক্যারিক স্ট্রিট৷
‘যাত্রীর উচ্চারণ অদ্ভুত৷ কন্ডাক্টর আবার শুধোল, কোথায় বললেন?
‘ক্যারিক স্ট্রিট-ক্যারিক স্ট্রিট-
‘আচ্ছা, আচ্ছা, আমি জানি-অতবার আর বলতে হবে না! বলেই কন্ডাক্টর যাত্রীর হাত থেকে আনিটা টেনে নিল!
‘যাত্রী একটুও না ফিরে বলল, জানো? কী জানো তুমি?
‘কিন্তু কন্ডাক্টরের বুকের ভিতর পর্যন্ত তখন শিউরে শিউরে উঠছে৷ আনিটা কী অস্বাভাবিক ঠান্ডা! যেন সেটাকে জমাট বরফের ভিতর থেকে টেনে বার করা হয়েছে!
‘টিকিট কেটে কন্ডাক্টর যাত্রীকে হাত বাড়িয়ে দিতে গেল৷
‘যাত্রী বলল, যেখানে আনি ছিল টিকিটখানা সেইখানে গুঁজে দাও৷
‘কেন তা সে জানে না, কিন্তু কন্ডাক্টরের ইচ্ছা হল না যে, যাত্রীর হাতে হাত দেয়৷ তার হাতখানা আড়ষ্ট, বোধ হয় পক্ষাঘাতে পঙ্গু৷ টিকিটখানা কোনোরকমে গুঁজে দিয়ে কন্ডাক্টর বলল, কেমন, পেয়েছেন জগন্নাথমশাই?
‘তাকে ঠুঁটো জগন্নাথ বলে কৌতুক করা হচ্ছে ভেবেই বোধ হয় যাত্রী বলল, তুমি আর আমার সঙ্গে কথা কোয়ো না৷
‘কে কথা কইতে চায়! বলে কন্ডাক্টর নেমে গেল৷
‘বাস ক্যারিক স্ট্রিটের মোড়ে এসে থামল৷ কন্ডাক্টর চ্যাঁচাতে লাগল-ক্যারিক স্ট্রিট! ক্যারিক স্ট্রিট!
‘কিন্তু দোতলা থেকে আড়ষ্ট যাত্রী নামবার নাম করল না৷
‘কন্ডাক্টর আপন মনে বলল, ও যদি সারারাত টঙে বসে থাকতে চায়, থাকুক৷ আমি আর ওপরে উঠছি না৷ . . . এও হতে পারে, হয়তো কখন সে নেমে গিয়েছে, আমি দেখতে পাইনি৷
‘সেইদিন সন্ধ্যাতেই ক্যারিক স্ট্রিটের একটি হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল একখানা ট্যাক্সি৷
‘ট্যাক্সি থেকে মোটঘাট নিয়ে যে ভদ্রলোকটি নামলেন তাঁর নাম মি. রামবোল্ড৷ কয়েক বছর আগে তিনি এই হোটেলেই ঘর ভাড়া নিয়ে বাস করতেন৷ তারপর অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন ব্যাবসাবাণিজ্য করতে৷ এতকাল পরে আবার তাঁর পুরোনো হোটেলে ফিরে এলেন৷
‘হোটেলের কর্তা তাড়াতাড়ি অভ্যর্থনা করতে এলেন৷-এই যে মি. রামবোল্ড! জানি ব্যবসায়ে লক্ষ্মীলাভ করে আবার আপনি আমাদের কাছে ফিরে আসবেন৷
‘মি. রামবোল্ড হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ, আমি লক্ষ্মীলাভ করেছি৷ আমি মস্ত ধনীই বটে৷
‘হোটেলের কর্তা বললেন, কিন্তু তবুও আপনি যে আমাদের মতো গরিবদের ভোলেননি এইটেই যথেষ্ট!
‘কী করে ভুলব? এ হোটেল যে আমার নিজের বাড়ির মতো প্রিয়! এখানকার পুরোনো চাকর ক্লুটসাম কোথায়! এখানেই কাজ করে? বেশ বেশ, তাকেই আমি চাই৷
‘রাত্রে মি. রামবোল্ড নিজের ঘরে বসে কথা কইছিলেন৷ ক্লুটসাম জিজ্ঞাসা করছিল, আচ্ছা হুজুর, অস্ট্রেলিয়া দেশটা কেমন?
‘ভালোই৷
‘সেখানকার আইন বোধ হয় এখানকার মতো কড়া নয়?
‘কীরকম?
‘ধরুন, আপনি যদি সেখানে কোনো মানুষ খুন করেন, তাহলে পুলিশ আপনাকে ধরে ফাঁসি দেবে তো?
‘মি. রামবোল্ড অত্যন্ত বেশি চমকে উঠলেন৷ শুকনো গলায় থতমত খেয়ে বললেন, আমিই বা মানুষ খুন করব কেন, আর আমাকেই বা ফাঁসি দেবে কেন?
‘না হুজুর, আমি কথার কথা বলছি! বাপরে, মানুষ খুন করার মতো বিপদ! পুলিশ ফিরবে পাছে পাছে-
‘রামবোল্ড বাধা দিয়ে জোরে জোরে বললেন, কেন, পুলিশ পাছে পাছে ফিরবে কেন? যদি আমি কারুকে খুন করি, তার লাশ লুকিয়ে ফেলি, কেউ সাক্ষী না থাকে, তাহলে পুলিশ জানতে পারবে কেমন করে?
‘কিন্তু হুজুর, যাকে খুন করেছেন সে যদি ভূত হয়? প্রতিশোধ নেবার জন্য আপনাকে খুঁজতে আসে?
‘রামবোল্ডের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল৷ তিনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, থামো থামো!
‘ক্লুটসাম আশ্চর্য হয়ে বলল, ওকী হুজুর, আপনি অমন করছেন কেন? আমি কথার কথা বলছি৷
‘আমার গলা শুকিয়ে গেছে! শিগগির এক গেলাস জল আনো!
‘ক্লুটসাম তখনই জল এনে দিল৷ রামবোল্ড জল পান করে অন্য কথা পেড়ে বললেন, আচ্ছা ক্লুটসাম, তোমাদের হোটেল এখন কেমন চলছে?
‘খুব ভালো চলছে হুজুর৷ এই আজকের কথাই ধরুন না! আজ রাত্রে যদি কেউ এসে ডবল টাকাও দিতে চায়, তাহলে তাকে আমরা ঘর দিতে পারব না৷ হোটেলের কোনো ঘর খালি নেই৷
‘ক্লুটসাম, দেখছ আজকের রাত কী ঠান্ডা? বাইরে বরফ পড়ছে৷ আজ কোনো বেচারি যদি এখানে এসে ঘর না পায়, তাহলে তার কষ্টের আর সীমা থাকবে না৷ আমার তো দুটো ঘর, দুটো বিছানা৷ আর যদি সত্যিই কেউ আসে, তাকে তাড়িয়ে দিয়ো না, অন্তত আজকের জন্যেও তাকে আমি আমার একটা বিছানা ছেড়ে দিতে রাজি আছি৷
‘আচ্ছা হুজুর৷
‘মাঝরাত্রি৷ দেউড়ির ঘণ্টাটা হঠাৎ খুব জোরে খুব তাড়াতাড়ি বেজে উঠল-এক বার, দু বার, তিন বার৷
‘হোটেলের দ্বারবান অবাক হয়ে ভাবল, এই তুষার-ঝরা নিশুতি রাতে কে অতিথি বাইরে থেকে এল!
‘আবার সেইরকম খুব জোর আর তাড়াতাড়ি তিন বার ঘণ্টাধ্বনি৷
‘দ্বারবান বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে দেউড়িতে গিয়ে দরজা খুলে দিল৷
‘ভিতরে এসে দাঁড়াল এক অদ্ভুত মূর্তি৷ তার মাথার টুপিটা মুখের উপর টেনে নামানো, আর তার গলার কলারটা টেনে চিবুকের উপর তুলে দেওয়া৷ সর্বাঙ্গ ঢাকা মস্ত বড়ো ঝলঝলে এক কালো মিশমিশে ওভারকোট৷ ওভারকোটের একদিকটা ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে-বোধ হয় তার হাতে একটা চুপড়ি কিংবা একটা ব্যাগ আছে৷
‘দ্বারবান বলল, সেলাম হুজুর! আপনার কী দরকার?
‘আগন্তুক কোনো জবাব না দিয়ে এক কোণে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল৷ তার পর বলল, আমি আজকের রাতের জন্যে হোটেলে একখানা ঘর চাই৷
‘হুজুর, আজ যে হোটেলের সব ঘর ভরতি হয়ে গেছে!
‘তুমি ঠিক জানো?
‘হ্যাঁ হুজুর!
‘কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখো!
‘ভালো করে ভাববার দরকার নেই হুজুর! আমি জানি৷
‘আগন্তুক এতক্ষণে মুখ তুলে দ্বারবানের দিকে দৃষ্টিপাত করল-তারপর ধীরে ধীরে বলল, আর একবার ভালো করে ভেবে দেখো দেখি?
‘কেন তা সে জানে না, কিন্তু দ্বারবানের মনে হয়, তার দেহের ভিতর থেকে যেন কী-একটা জিনিস-হয়তো তার জীবনই-ঠেলে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ সে ভয়ানক ভয় পেয়ে বলে উঠল, দাঁড়ান হুজুর! আমি জেনে এসে বলছি!
‘সে হোটেলের ভিতর দিকে চলে গেল৷ কিন্তু খানিক পরে খবর নিয়ে ফিরে এসে আগন্তুককে আর দেখতে পেল না৷ কোথায় গেল সে? হোটেলের ভিতরে না বাইরে?
‘হঠাৎ তার চোখ পড়ল আগন্তুক যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানটায়৷ সেখানে মেঝের উপরে লম্বা এক টুকরো বরফ পড়ে চকচক করছে৷
‘তার বিস্ময়ের আর অবধি রইল না৷ চারিদিক ঢাকা, তবু এখানে বরফ এল কেমন করে?
‘সেই কনকনে শীতের রাতেও দ্বারবানের কপালের উপর ঘামের ফোঁটা দেখা দিল৷ রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নিজের মনেই সে বলল, যাকে এইমাত্র দেখলাম, কে সে? মানুষ?
‘দোতলার হলঘরে দাঁড়িয়ে ক্লুটসাম দেখল, সিঁড়ি দিয়ে এক অচেনা ভদ্রলোক নিঃশব্দে উপরে উঠে আসছেন৷
‘এগিয়ে এসে বলল, কে আপনি? কাকে চান?
‘তুমি মি. রামবোল্ডকে জিজ্ঞাসা করে এসো, আজ রাত্রে তাঁর অন্য বিছানাটা আমি ব্যবহার করতে পারব কি না?
‘ক্লুটসাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আগন্তুকের মুখের পানে তাকাল৷
‘মি. রামবোল্ডের বাড়তি বিছানার কথা এই অচেনা লোকটি কেমন করে জানতে পারল? কিন্তু সে-কথা নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা না ঘামিয়ে সে আগন্তুকের অনুরোধ রাখবার জন্যে ভিতর দিকে চলে গেল৷ অল্পক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, মি. রামবোল্ড আপনার নাম জানতে চাইলেন৷
‘আগন্তুক পকেট থেকে বার করল খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া এক টুকরো কাগজ৷ সেই কাগজের টুকরোটা এগিয়ে দিয়ে সে বলল, মি. রামবোল্ডকে এটা দিয়ে এসো৷ আর তাকে জানিয়ো আমার নাম হচ্ছে, জেমস হাগবার্ড৷
‘ক্লুটসাম সেই কাগজখানা পড়তে পড়তে আবার হোটেলের ভিতর দিকে চলে গেল৷ তাতে লেখা রয়েছে-
‘অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের মি. জেমস হাগবার্ড কোথায় অদৃশ্য হয়েছিলেন, এতদিন সে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না৷ সম্প্রতি একটা জঙ্গলের ভিতর থেকে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে৷ বন্দুকের গুলিতে তিনি মারা পড়েছেন৷ এখন প্রকাশ পেয়েছে, মি. রামবোল্ড নামে তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে তিনি ওই জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু সেই দিন থেকে
মি. রামবোল্ডেরও আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না৷
‘একটু পরে ক্লুটসাম আবার ফিরে এল৷ তারপর তফাতে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, মি. রামবোল্ড বললেন-আপনি নরক থেকে এসেছেন, আবার নরকেই বিদায় হোন!-এই বলেই সে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল৷ মিনিট পাঁচেক পরেই রামবোল্ডের ঘর থেকে ভেসে এল ঘন ঘন বিষম আর্তনাদ ও ভীষণ গর্জনধ্বনি৷
‘ক্লুটসাম ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সেইদিকে ছুটে গেল৷ কিন্তু ঘরের ভিতর কোনো জনপ্রাণী নেই৷
‘ঘরের বিছানা, চেয়ার ও টেবিল প্রভৃতি উলটে-পালটে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে এবং রক্তের দাগে চারিদিক হয়ে উঠেছে ভয়ানক৷ এবং ঘরের মাঝখানেই মেঝের উপর পড়ে চকচক করছে ইঞ্চি কয়েক লম্বা এক টুকরো বরফ৷
‘রামবোল্ডের সঙ্গে ক্লুটসামের আর কখনো দেখা হয়নি৷
‘কিন্তু সেই রাত্রে হোটেলের সামনের রাস্তায় যে কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছিল, সে একটা সন্দেহজনক দৃশ্য দেখেছিল৷
‘কালো ওভারকোট-পরা একটা আড়ষ্ট মূর্তি তুষারবৃষ্টির মধ্য দিয়ে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তার কাঁধে রয়েছে মস্ত মোটের মতো কী একটা জিনিস৷
‘কনস্টেবল তাকে ধরবার জন্যে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু খানিক দূরে গিয়ে আর তাকে দেখতে পায়নি৷’
মানিক বলল, ‘তাহলে ঘটনাটার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, মি. জেমস হাগবার্ডকে খুন করে মি. রামবোল্ড অস্ট্রেলিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলেন৷ তারপর মি. হাগবার্ডের প্রেতাত্মা প্রতিহিংসা নেবার জন্যে বিলাতে এসে মি. রামবোল্ডকে হত্যা করে তার দেহ নিয়ে নরকে ফিরে গেল৷ তুমি কী বলতে চাও, এখানেও মেয়ে চুরি করেছে ভূতেরা?’
জয়ন্ত গাড়ি চালাতে চালাতে গল্প করছিল৷ সে মাথা নেড়ে বলল, ‘পাগল! আমি বললাম গালগল্প,-কেবল খানিকটা সময় কাটাবার জন্যে৷ তার সঙ্গে এখানকার মেয়ে-চুরির কোনো সম্পর্ক নেই৷ . . . এখন এ-সব কথা থাক৷ ওই দেখো, সামনেই আলিনগরের ভাঙা বাড়িগুলোর এলোমেলো চুড়ো দেখা যাচ্ছে৷ এদিকে পথেই পড়েছে নদী৷ গাড়ি নিয়ে আর এগোবার উপায় নেই, এগোবার দরকারও নেই৷ গাড়িখানাকে একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে এইবারে আমাদের পদব্রজে এগোতে হবে৷’
মোটর থামিয়ে দু-জনে নামল৷ তারপর গাড়িখানাকে লুকিয়ে এবং চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অগ্রসর হল৷
কিন্তু পথ যেখানে নদীর ধারে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেইখানে বালির উপরে পাওয়া গেল আবার সেই ছয়জোড়া পায়ের দাগ৷
জয়ন্ত হাঁটু গেড়ে বসে খানিকক্ষণ ধরে পায়ের দাগগুলো পরীক্ষা করল৷ তারপর মুখ তুলে বলল, ‘মানিক, এবারের পায়ের দাগে বিশেষত্ব আছে৷ দাগগুলো বড়ো বেশি গভীর হয়ে বালির ভিতর বসে গেছে৷ যেন এরা সকলে মিলে কোনো একটা ভারী মোট বহন করে নিয়ে গিয়েছে৷’
মানিক চমকে উঠে বলল, ‘ভারী মোট! কী হতে পারে সেটা?’
‘হয়তো কোনো মানুষের-অর্থাৎ স্ত্রীলোকের দেহ! নয় তো অন্য কিছু৷ সেটা যাই-ই হোক, কিন্তু আমাদের অদৃষ্টের খুব জোর বলতে হবে! এসেই এই দাগগুলো চোখে পড়ে গেল৷ এ-সূত্র আর ছাড়ছি না, কারণ এই সূত্র ধরেই এবার নিশ্চয়ই সেই ছয় মূর্তিকে আবিষ্কার করব- তারা আর আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না৷’
নবম পরিচ্ছেদ – মৃত্যুপুরে
আলিনগরে কোনো বিভীষিকাই তখন সেখানে জেগে নেই৷ সূর্যকরের সোনার ঢেউ আকাশের নীলিমাকে অম্লান করে তুলেছে৷ পাখিদের গানের তানের ঢেউ বনের শ্যামলিমাকে উচ্ছ্বসিত করে তুলেছে, নদীর জলের রুপোলি ঢেউ দুই তটের মাটি, বালি আর পাথরকেও সংগীতময় করে তুলেছে৷ চারিদিকে আলো আর গান, শান্তি আর কান্তি৷
তারই মধ্যে অন্ধকারের দুঃস্বপ্ন বহন করে আনছে কেবল এই ছয় জোড়া পদচিহ্ন৷ এই ছয় জোড়া পায়ের অধিকারী, কে তারা? কেন তারা সর্বদাই একসঙ্গে থাকে, কেন তাদের দলের লোক বাড়েও না কমেও না, কেন তারা একতালে পা ফেলে চলে-আর কেন তারা মেয়ের পর মেয়ে চুরি করে? আর, তাদের সঙ্গে নবাবের কোনো সম্পর্ক আছে, কিংবা নেই? আর, আলিনগরে এসে তারা সবাই মিলে কী করে?
জয়ন্ত ও মানিক এইসব কথাই ভাবছিল৷
জয়ন্ত বলল, ‘কিন্তু এই ছয়টা মূর্তি যে প্রেতমূর্তি নয়, এদের দেহ যে ছায়াময় নয়, এরা যে আমাদের মতোই রক্ত-মাংসে গড়া, পা দিয়ে মাটি মাড়িয়ে চলে, এখানকার দাগগুলো সে-সত্যও প্রকাশ করেছে৷ সেদিনের পায়ের দাগগুলোর ভিতর যা লক্ষ করেছিলাম আজও তাই লক্ষ করছি; এদের মধ্যে একজন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, একটা পায়ের গোড়ালি মাটির উপর ফেলতে পারে না৷ এটাও মনুষ্যত্বের আর একটা লক্ষণ-খোঁড়া ভূতের কথা কখনো শুনেছ?’
দু-জনে নদীগর্ভের দিকে নামতে লাগল৷
মানিক বলল, ‘দাগগুলো দেখছি নদীর জলের ভিতরে নেমে গেছে৷ তার মানে, সেই ছয়টা মূর্তি এইখানেই নদী পার হয়েছে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ, তাই আমাদেরও এইখানে নেমেই পার হতে হবে৷ গেল-দুর্যোগে নদীর জল বেড়ে উঠেছে বটে কিন্তু বোধ হয় আমাদের কোমরের বেশি উঠবে না৷ এই সব ছোটো ছোটো পাহাড়ি নদীর রীতিই এই-এরা যেমন হঠাৎ বড়ো হয়ে ওঠে, তেমনি হঠাৎ ছোটো হয়ে পড়ে; এরা যেন প্রকৃতির আবুহোসেন-আজ বড়ো, কাল ছোটো৷ . . . এই আমি দুর্গা বলে নেমে পড়লাম,-যা ভেবেছি তাই৷ জল খুব কম৷ এসো মানিক, কিন্তু দেখো, বন্দুক রিভলবার আর রসদ যেন জলে ভেজে না৷’
নদীর ওপারে উঠে একটুও খুঁজতে হল না, আবার পাওয়া গেল সেই ছয়-জোড়া পায়ের দাগ৷ নদীর বালির বিছানা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেও মাটির উপর দিয়ে চলে গিয়েছে পদচিহ্নের সারি৷
মানিক খুশি গলায় বলল, ‘জয়, সেদিনকার বিষম বৃষ্টি আমাদের ভারি কষ্ট দিয়েছে বটে, কিন্তু আজ আমরা তাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিতে পারি! সেই বৃষ্টিতে ভিজে মাটি খুব নরম ছিল বলেই পায়ের এমন স্পষ্ট আর স্থায়ী ছাঁচ তুলতে পেরেছে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ, আর এটাও বোঝা যাচ্ছে, এই ছাঁচগুলো টাটকা, এদের সৃষ্টি হয়েছে বৃষ্টির পরেই৷ প্রথম শ্রেণির পথপ্রদর্শকের মতো এখন এই পায়ের দাগগুলোও আমাদের নিয়ে যাবে যাদের খুঁজতে এসেছি তাদের ঠিকানায়৷ হ্যাঁ, ধন্যবাদ দিই বৃষ্টিকে!’
পায়ে-হাঁটা মেটে পথ৷ কোথাও ঝুপসি গাছের তলা দিয়ে, কোথাও কাঁটা-ঝোপ ও জঙ্গলের তলা দিয়ে, কোথাও ভাঙাচোরা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ বা ঢিপিঢাপার পাশ দিয়ে অজগরের মতো এঁকেবেঁকে, উঠে, নেমে, মোড় ফিরে ফিরে অগ্রসর হয়েছে৷ পথের উপরে পায়ের দাগগুলো মাঝে মাঝে অস্পষ্ট হয়ে গেছে বটে, কিন্তু একটু পরেই আবার স্পষ্ট হয়ে গিয়ে তারা জয়ন্ত ও মানিককে ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু জমির অন্য প্রান্ত থেকে আবার আত্মপ্রকাশ করছে৷ পায়ের দাগ তাদের সঙ্গে যেন লুকোচুরি খেলা খেলছে৷
জয়ন্ত বলল, ‘মানিক, পৃথিবীর সব দেশেরই গোয়েন্দাগিরির ইতিহাস পড়লে দেখতে পারে, পায়ের দাগ, রক্তের দাগ, আর আঙুলের ছাপ দেখেই গোয়েন্দারা বেশির ভাগ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে৷ আঙুলের ছাপ দেখে অপরাধী ধরবার প্রথা একশো বছর আগেও আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু পায়ের দাগ আর রক্তের দাগ মানুষের কাজে লেগে আসছে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই-মানুষ যখন সভ্যও হয়নি৷ এই দু-রকম দাগের কোনো-না-কোনোটি দেখে আদিম মানুষ বনেজঙ্গলে শিকারের খোঁজ পেয়ে জীবন ধারণ করেছে-এখনকার শখের শিকারিদেরও কাছে ওই দু-রকম দাগই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো সম্বল৷ আর পাপীদেরও জব্দ করেছে চিরকাল ওই দু-রকম দাগই৷ সব পাপীই এই দু-রকম দাগকে ভয় করে, কিন্তু তবু এদের কবল থেকে নিস্তার পায় না-যেমন আজও পাবে না আমাদের হাত থেকে মুক্তি এই ছয়জন মেয়ে-চোর!’
মানিক বলল, ‘এরা খালি মেয়ে-চোর নয়, হত্যাকারীও বটে৷’
জয়ন্ত ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে বলল, ‘হুঁ৷ শেষে যে মেয়ে চুরি গেছে, এরা তার মাকে খুন করেছে৷ কিন্তু মানিক, এখনও এ-রহস্যটা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না যে, মৃতদেহের গলায় অত বড়ো ক্ষতচিহ্ন, কিন্তু তার দেহের রক্ত গেল কোথায়? এক হতে পারে হত্যাকারী দাঁত দিয়ে তার গলায় ছ্যাঁদা করে সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে-আর যেটুকু রক্ত মাটিতে পড়েছিল তাও জিভ দিয়ে চেটেপুটে তুলে নিয়েছে; কিন্তু মানুষের পক্ষে এও কি সম্ভব? এই ছয়জন খুনে মেয়ে-চোর যে মানুষ, সে-বিষয়ে তো সন্দেহ করবার উপায়ই নেই!’
হঠাৎ মানিক উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘দেখো জয়, দেখো!’
মানিকের দৃষ্টি অনুসরণ করে জয়ন্ত দেখল, যে-দুখানা মোটরে চড়ে তারা সেদিন আলিনগরে এসেছিল, তাদেরই ভগ্নাবশেষ৷ একখানা প্রকাণ্ড ভাঙা বাড়ির স্তূপের উপরে দু-জায়গায় গাড়ি দু-খানা চুরমার হয়ে পড়ে আছে৷
জয়ন্ত কৌতূহলী চোখে দেখতে দেখতে পায়ে পায়ে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ তাদের ভিতর থেকে এটা-ওটা-সেটা তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল৷ খানিকক্ষণ পরে ফিরে বলল, ‘মানিক একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ কি?’
‘কী?’
‘গাড়ির ভিতরে আমাদের খাবার ছিল৷ হয়তো ফল বা পাঁউরুটি প্রভৃতি চারিদিকে ঠিকরে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে বনের পশুপক্ষীরা সেগুলোর সদ্ব্যবহার করেছে৷ কিন্তু গাড়ির ভিতরে ছিল বন্ধ একটিন বিস্কুট আর তিন টিন জ্যাম আর চায়ের ফ্লাস্ক৷ সেগুলোর একটা ভাঙা টুকরোও এখানে নজরে পড়ছে না৷ খাবারের চাঙাড়িরও টুকরো এখানে নেই-তাও কি জন্তুরা খেয়ে ফেলেছে?’
মানিক আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তাই তো দেখছি! সত্যি, অতি বড়ো পেটুক জন্তুও তো টিন বা ধাতু বা ভাঙা চাঙাড়ি হজম করতে রাজি হবে না! সেগুলো গেল কোথায় তবে?’
‘কোথায় আর? ওই নবাব, কি ছয় মূর্তির বাসায়! গাড়ি দু-খানাকে ধ্বংসের পথে চালিয়ে দেবার আগে খাবারগুলোকে বাজে নষ্ট হবার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করা হয়েছে আর কি! মানিক, যারা স্যান্ডউইচ আর কলা খায়, জ্যাম আর বিস্কুটের টিন খোলে, নিশ্চয়ই তারা ভূত নয়! এইসব মেয়ে-চুরি আর খুনের মূলে আছে তোমার আমার মতো মানুষই৷’
মানিক বলল, ‘এ প্রমাণটা পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! চলো তবে আবার সেই খুনে মেয়ে-চোর আর খাবার-চোর মানুষদের পদচিহ্ন অনুসরণ করা যাক৷’
তারা জনশূন্য আলিনগরের এক প্রান্ত দিয়ে চলেছে৷ ছোটো বড়ো মাঝারি, বিবর্ণ, সংস্কার-অভাবে জীর্ণ কঙ্কালসার বা একেবারে ভাঙা বাড়ির পর বাড়ি যেন নিজেদের দুর্ভাগ্যের ভারে স্তম্ভিত ও স্তব্ধ হয়ে আছে, কিন্তু একদিন তারা অনেক আলোকমালা দেখেছে, অনেক উৎসব-কোলাহল শুনেছে৷ তাদের ছায়ায় ছায়ায় কত হাসি আর অশ্রুর বিচিত্র অভিনয়ের যবনিকা বারংবার উঠেছে ও পড়েছে, সে হিসাব যেন তারা আজও ভুলে যায়নি৷ যেখানে আগে শত শত সংগীতের ও শত শত নূপুরের ধ্বনি জেগে উঠত ক্ষণে ক্ষণে, সেখানে আজ স্তব্ধতার মৃত্যু নিদ্রা ভঙ্গ করেছে কেবল দেয়ালে দেয়ালে গজিয়ে-ওঠা অশথ-বটের শাখায় শাখায় বন্য বাতাসের দীর্ঘশ্বাসের কান্না৷ যাদের চাতালে চাতালে আগে জীবন্ত ফুলের মতো শিশুরা করত সুমধুর লীলাখেলা, সেখানে আজ পাথরে পাথরে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে কেবল সাপ, বিছা ও গিরগিটির দল৷
মানিক দুঃখিত স্বরে বলল, ‘জয়, আমার পারসি কবি ওমর খৈয়ামের কবিতা মনে পড়ছে :
‘রাজার বাড়ির থামের সারি আকাশ-ছোঁয়া তুলত মাথা,
রতন মুকুট পরে হেথায় সোনার তোরণ ধরত ছাতা৷
আজ সেখানে আঁধুল মায়ায় বিজন ছায়া দুলিয়ে দিয়ে,
ঘু-ঘু-ঘু-ঘু-র আকুল স্বরে গাইছে কপোত অশ্রুগাথা৷’
জয়ন্ত বলল, ‘এখন মনে হচ্ছে, এই ছয়জন দুরাত্মা বাস করবার ঠিক জায়গায় বেছে নিয়েছে! যারা সমাজের আর মানুষের শত্রু, জ্যান্ত শহরের জনতা তাদের ভালোও লাগবে না, সহ্যও হবে না৷ তাই এসে আস্তানা গেড়েছে তারা এই মরা শহরে৷ ভাই মানিক, ঘরবাড়ির আত্মা থাকে না জানি, কিন্তু এখানকার বাড়িঘরগুলোকে দেখলে প্রেতাত্মার ছবি দেখছি বলেই কি সন্দেহ হয় না?’
মানিক বলল, ‘হ্যাঁ, এরা প্রেতাত্মার মতোই ভয়ের ভারে প্রাণ-মন অভিভূত করে দেয়!’
জয়ন্ত দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘এই আমরা সেই গোরস্থানের আর-একদিকে এসে পড়লাম৷ এরই মধ্যে সেই ভয়ানক রাতে ছয়টা আলোকে চলাফেরা করতে দেখেছিলাম!’
মানিক বলল, ‘পায়ের দাগের রেখা যে এরই মধ্যে দিয়ে ঢুকেছে!’
‘তাহলে আমরাও এর মধ্যে ঢুকব৷ মানিক, বন্দুক প্রস্তুত রাখো, হয়তো এইটেই সেই শয়তানদের আড্ডা৷ হয়তো এইবারে তারা আমাদের দেখতে পাবে, আর দেখতে পেলে যে জামাই আদর করবে না, সে-বিষয়ে একতিল সন্দেহ নেই৷’
তারা দু-জনেই সেখানে দাঁড়িয়ে বন্দুকে টোটা ভরে নিল, নিজের নিজের রিভলভার পরীক্ষা করল৷
মানিক বলল, ‘কিন্তু অমিয়বাবু আর তাঁর বন্ধুদের মতে, বন্দুকের গুলি বেমালুম হজম করে তারা আক্রমণ করতে পারে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘আমি ও-কথা বিশ্বাস করি না৷ ‘গোলা-খা-ডালা’-র যুগ আর নেই৷ অমিয়বাবুদের গুলি খেয়েছিল বনের গাছ আর পাহাড়৷’
তারা চারিদিকে সাবধানে তাকাতে তাকাতে গোরস্থানের ভিতরে প্রবেশ করল৷ আলিনগরের কোথাও জীবনের পরিচয় নেই বটে, কিন্তু, এইবার দেখা দিল খালি মৃত্যুর চিহ্ন৷ এখানকার প্রত্যেক উঁচু ঢিপিটাও এক-একটি বিয়োগান্ত জীবন-নাট্যের শেষ নিদর্শন-মানুষের অশান্ত উচ্চাকাঙ্খার তুচ্ছ পরিণাম! চঞ্চল আলোছায়ার জীবন্ত লীলা বুকের উপরে নিয়ে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে কবরের পর কবরের সার৷ তাদের তলায় চিরনিদ্রার স্বপ্নহীনতার মধ্যে শুয়ে আছে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে বিতাড়িত কত মানুষের কঙ্কালের পর কঙ্কাল এবং তাদের উপর দলে দলে ফুটে আছে কত আগাছার কত রঙের ফুলের পর ফুল৷ মানুষের স্মৃতি যাদের ভুলেছে, প্রকৃতির প্রেম তাদের মনে রেখেছে৷
দু-ধারের কবরের মাঝখান দিয়ে চলে পদচিহ্নরেখা গোরস্থানের আর-একপ্রান্তে যেখানে গিয়ে শেষ হল, সেখানেই মস্ত ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে একখানা প্রকাণ্ড অট্টালিকা৷
জয়ন্ত ও মানিক তার দিকে তাকিয়ে দেখল, এই অট্টালিকাও বহুকালের পুরোনো বটে, কিন্তু আলিনগরের অন্যান্য বাড়ির মতো এখানা ততটা জীর্ণ ও ভাঙাচোরা নয়৷ এর অনেকগুলো দরজার কবাট ও জানলার পাল্লা এখনও অটুট আছে এবং এক সময়ে এখানা যে খুব বড়ো ধনীর বা রাজা-উজিরের প্রাসাদ ছিল, তাও অনুমান করা যায়৷
অট্টালিকার প্রবেশপথটিও প্রকাণ্ড৷ হয়তো আগে এখানে জমকালো সাজ-পরা সেপাই-সান্ত্রিরা বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে পাহারা দিত, হয়তো আজ তাদেরও কঙ্কাল নিঃসাড় হয়ে আছে ওই গোরস্থানেরই কোনো বুজে-যাওয়া গর্তে৷ কিন্তু আজ এই দেউড়ি হয়েছে শেয়াল কুকুরের আনাগোনার রাস্তা৷
কিন্তু দেউড়ির সামনেই কী ওটা পড়ে পইতার মতো সরু সরু ধোঁয়া ছাড়ছে?
ধোঁয়া৷ জনহীনতার রাজ্যে ধোঁয়া? ধোঁয়ার সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে অগ্নি৷ এবং অধিকাংশ অগ্নির সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে মানুষ৷ মানিক আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে গেল এবং তাড়াতাড়ি একটা জিনিস তুলে জয়ন্তর চোখের সামনে ধরল৷
জয়ন্ত সবিস্ময়ে চেয়ে দেখল, একটা আধপোড়া ‘কাঁচি’ সিগারেট, তখনও তার আগুন নেবেনি৷
দুজনেই বুঝল, শত্রু একটু আগেই এখান দিয়ে চলে গিয়েছে এবং খুব কাছেই কোথাও আছে-হয়তো আড়ালে গা ঢেকে তাদেরই গতিবিধি লক্ষ করছে৷
দুই বন্ধুর সন্দিগ্ধ ও সতর্ক চক্ষু চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল-কিন্তু কোথাও কারুর দেখা বা সাড়া পাওয়া গেল না৷
মানিক চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন কী করবে?’
জয়ন্ত তেমনি স্বরে বলল, ‘বাড়ির ভিতরে ঢুকব৷’
‘শত্রু আছে জেনেও?’
‘আমরা তো এখানে বন্ধুদের সঙ্গে খোশগল্প করতে আসিনি! যত শীঘ্র শত্রুর দেখা পাওয়া যায় ততই ভালো৷’
‘তা বটে৷’
বন্দুক দুটো তারা পিঠের উপরে বাঁধল৷ তারপর বেল্ট থেকে রিভলবার খুলে হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল৷
একটা বুকচাপা ভয়ানক নীরবতায় সেই বিশাল অট্টালিকার ভিতরটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে৷ খানিক দূর এগিয়ে পাওয়া গেল প্রকাণ্ড এক উঠান-তার ভিতরে বোধ হয় দুই হাজার লোকের স্থান সংকুলান হয়৷ উঠানের চারিদিকে সারি সারি থাম ও দালান এবং দালানের পরেই চক-মিলানো ঘর৷ উঠানের সর্বত্রই বড়ো বড়ো ঘাস ও আগাছার ঝোপ৷ কোথাও জীবনের এতটুকু লক্ষণ নেই-কেবল গাম্ভীর্য গমগম করছে,-সে যেন মৃত্যুপুরীর গাম্ভীর্য! দেউড়িতে এইমাত্র সেই জ্বলন্ত সিগারেটটা না দেখলে জয়ন্ত ও মানিক কিছুতেই সন্দেহ করতে পারত না যে, এই নিদ্রিত অট্টালিকার ত্রিসীমানায় বহু বৎসরের মধ্যে কোনো জ্যান্ত মানুষের ছায়া এসে দাঁড়িয়েছে৷ এখানকার নির্জনতা যেন ভৌতিক,-বুকের রক্ত জমে যায়, গা ছমছম করে, পা এলিয়ে পড়ে৷ অসহনীয়৷
মানিক ফিসফিস করে বলল, ‘এই বিশালতার মধ্যে আমরাই হারিয়ে গেছি বলে মনে হচ্ছে! এর মধ্যে কোন দিকে কাকে আমরা খুঁজব?’-তার সেই অতি মৃদু গলার আওয়াজও সেই নিঃসাড় পুরীর মাঝখানে উচ্চকন্ঠের গর্জনের মতো শোনাল৷
জয়ন্ত আরও খাটো গলায় মানিকের কানে কানে বলল, ‘কিন্তু খুঁজতে হবেই৷ এসো, আগে একতলার সব ঘরেই একবার করে উঁকি মেরে আসি-তারপর দোতলা, তারপর তেতলা৷
তারা একে-একে প্রত্যেক ঘর খুব সন্তর্পণে ঢুকে পরিদর্শন আরম্ভ করল৷ ঘরে ঘরে বাস করছে যুগযুগান্তর ধূলা ও সন্ধ্যার আলো-আঁধারি৷ একটা ঘরের কোণ থেকে সাপ ফোঁস করে উঠল৷ প্রত্যেক ঘরের দরজাই খোলা৷
মানিক বলল, ‘এই পোড়ো বাড়ির একতলা ঘরে মানুষ থাকতে পারে না, মানুষের মন এখানে কুঁকড়ে পড়ে!’
জয়ন্ত বলল, ‘কিন্তু আমরা খুঁজছি সেই সব অমানুষিক মানুষকে, পৃথিবীর সাধারণ মানুষ যাদের ভূতের চেয়ে কম ভয়ে করে না৷ ভালোমানুষের প্রাণ যারা মাটির খেলনার মতো ভেঙে ফেলতে পারে, এমন জায়গায় এলে তারা হয়ে উঠে খুব বেশি খুশি৷’
ডানদিকের দীর্ঘ দালানের শেষ ঘরটায় দরজার বাইরে থেকে শিকল তোলা ছিল৷ শিকল নামিয়ে মানিকই প্রথমে ঘরের ভিতরে ঢুকল, এবং তার পরমুহূর্তেই চমকে বাইরে বেরিয়ে এল, তার মুখ একেবারে সাদা৷
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে মাথাটা একবার গলিয়ে দিল৷
ধূলিধূসরিত মেঝের উপর পাশাপাশি শুয়ে আছে ছয়টা মানুষের মূর্তি৷
দশম পরিচ্ছেদ – জীবনহারা জীবন্তের দল
যে ছয়টা বিভীষণ মূর্তির জন্যে চতুর্দিকে এমন হুলুস্থুলু বেধে গিয়েছে, এই আধা-আলোয় ও আধা-অন্ধকারে তারাই শুয়ে আছে পাশাপাশি৷
কিন্তু ওরা জেগে, কি ঘুমিয়ে? ওরা তাদের সাড়া পেয়েছে, কি পায়নি? আর অমন আদুড় মাটিতে, ধুলো-জঞ্জালেই বা ওরা শুয়ে আছে কেন? ওরা মটকা মেরে পড়ে নেই তো?
অসম্ভব নয়! এই ছয়টা মূর্তির প্রকৃতি যে হিংস্র, প্রথম দিনেই আলিনগরে এসে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে৷ এই ছয় চোরে চোরে মাসতুতো ভাই যে কত বেশি চালাক, প্রান্তর-সমুদ্রে তারও পরিচয় পাওয়া গিয়েছে৷ এদের কাছে জয়ন্তদের দুই-দুইবার পরাজিত হতে-এমনকী প্রায় গালে চুন-কালি মাখতে হয়েছে৷ তারাই এত সহজে এত অসহায়ভাবে ধরা দিতে রাজি হবে? এদের এই চুপ করে শুয়ে থাকা অত্যন্ত সন্দেহজনক৷
জয়ন্ত ও মানিক বাইরে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবতে লাগল৷ . . . এক দুই করে ছয়-সাত মিনিট কেটে গেল৷ এই অসম্ভব নিস্তব্ধতার মুল্লুকে মূর্তিদের কেউ পাশ ফিরলেও তারা সেটা টের পেত, কিন্তু ঘরের ভিতর কোনো সাড়া নেই-একটা নিশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত না৷ যদি তাদের জন্য কোনোরকম ফাঁদ পাতা হয়ে থাকে, তবে এ কীরকম ফাঁদ? ওরা ছয়জন, তারা দুইজন মাত্র; তবু ওরা আক্রমণ করবার জন্যে একটু উশখুশ পর্যন্ত করছে না কেন?
জয়ন্ত রিভলবারটা ধরে দরজার পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে একটুখানি মুখ বাড়িয়ে আবার চট করে দেখে নিল৷
তারা ঠিক তেমনিভাবেই পাশাপাশি শুয়ে আছে৷ তবে কি সত্যিই তারা ঘুমোচ্ছে? কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কই? দুষ্টুমি করে তারা কি দম বন্ধ করে আছে? কিন্তু দম বন্ধ করে মানুষ আর কতক্ষণ থাকতে পারে?
আরও মিনিট পাঁচেক পরেও তারা তেমনিভাবেই রইল দেখে জয়ন্ত নিজের মুখখানা ভিতরে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিল৷ তখনও মূর্তিগুলোর সেই ভাব৷ শেষটা যা থাকে কপালে ভেবে সে একেবারে ঘরের ভিতর ঢুকল এবং মানিকও সাহস সঞ্চয় করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল-
এবং প্রথমেই যা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হচ্ছে এই :
একটা মূর্তি ড্যাবড্যাব করে তাদের পানে নিষ্পলক চোখ মেলে তাকিয়ে আছে৷
জয়ন্তর হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল! মানিক রিভলভারের ঘোড়া টিপে দেয় আর কি,-কিন্তু জয়ন্ত তার হাত চেপে ধরে মৃদু স্বরে বলল, ‘অন্য মূর্তিগুলোর চোখ দেখো৷’
কোনো মূর্তির চোখ আধখোলা, কোনো মূর্তির চোখ একেবারে মোদা৷ . . . যে মূর্তিটা পুরো চেয়ে আছে, তারও চোখে কোনো ভাব নেই৷
‘জয়! জয়!’
‘মানিক, এগুলো মড়া!’
জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে একে-একে মূর্তিগুলোর বুকে হাত দিয়ে দেখল, শ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো লক্ষণ নেই৷ গা কাচের মতো ঠান্ডা৷
‘কিন্তু মানিক, কী করে এরা মরল? কে এদের মারল?’
‘জয়, ডানদিকের ওই মূর্তিটার কপালের উপরে তাকিয়ে দেখো!’
জয়ন্ত হেঁট হয়ে দেখে বলল, ‘হুঁ, বুলেটের দাগ৷ এখনও শুকোয়নি, দাগটাও নতুন নয়৷’
‘তবে কি অমিয়বাবুদের বুলেটের এই কীর্তি?’
‘হতে পারে৷ কিন্তু কপালে অমনভাবে গুলি খেয়ে কেউ কি বেঁচে থাকতে পারে? . . . আরে আরে, এই যে! এ মূর্তিটারও পেটে একটা ছ্যাঁদা-এখানেও বুলেট ঢুকেছে! আর, এটারও পায়ে লেগেছে বন্দুকের গুলি৷ হুঁ, এই মূর্তিটাই তাহলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত,-পায়ের দাগ দেখেই আমি যা ধরতে পেরেছিলাম৷ কিন্তু বাছারা, কে তোমরা? বন্দুকের বুলেট খেয়েও তোমরা মরো না-বড়োজোর খুঁড়িয়ে হাঁটো, কিন্তু আজ তোমরা পটল তুলেছ কেন?’
‘দেখো জয়, যদি ধরে নেওয়া যায় যে ওই সব বুলেটই ওই তিনটে লোকের মৃত্যুর কারণ, তাহলে বাকি তিনটে লোক মরল কেন? ওদের গায়ে তো দেখছি একটা আঁচড় পর্যন্তও নেই৷ কীসে ওরা মরেছে? বিষে? কেউ বিষ দিয়েছে, না ওরা একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছে?’
‘মানিক, এদের কারুর দেহেই বিষের কোনো লক্ষণ নেই৷ এদের কেউ কোনো উপায়ে হত্যা করেছে বলেও মনে হচ্ছে না৷ এরা এসে যেন পাশাপাশি শুয়ে পড়ে পরম নিশ্চিন্ত আর শান্তভাবে মৃত্যুঘুমে ঢুলে পড়েছে৷ অথচ এরা যে পরশু রাত পর্যন্ত বেঁচে ছিল সে প্রমাণও রয়েছে-অবশ্য যদি মানা যায় যে পরশু রাতে এরাই মেয়ে চুরি আর খুন করেছিল৷ এমন বিচিত্র ব্যাপার আমি কখনো কল্পনা করিনি-এমন আশ্চর্য মৃত্যুও কখনো দেখিনি! মানিক, স্বীকার করতে লজ্জা নেই-মনের মাঝে আমি ভয়ের সাড়া পাচ্ছি৷ ভবতোষ মজুমদারের বজরায় আমরা জ্যান্ত মড়া দেখেছিলাম, কিন্তু সে হচ্ছে ভিন্ন ব্যাপার, তার মধ্যে ছিল বৈজ্ঞানিক সত্য, কিন্তু এ কী কাণ্ড! বুলেট খেয়ে এরা মরে না, অথচ আজ অকারণেই এখানে এসে মরে পড়ে রয়েছে৷ মানুষের রক্ত-মাংস বুলেটকে অগ্রাহ্য করে, এটাই বা কী অস্বাভাবিক কথা!’
মানিক মূর্তিগুলোর উপরে আর একবার শিউরে-ওঠা চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘জয়, ভালো করে লক্ষ করে দেখো, এ মড়াগুলো কি অনেক দিনের পুরোনো পচা মড়া বলে মনে হয় না? এই ঘরের ভিতরে কি একটা কবরের ভাব আড়ষ্ট হয়ে নেই? এখানকার বাতাসেও যেন পচা মড়ার দুর্গন্ধ৷ আমার দেহ কেমন কেমন করছে, আমার বমন করবার ইচ্ছে হচ্ছে-চলো জয়, এই কবরের বিভীষিকার ভিতর থেকে পালিয়ে যাই!’
আচম্বিতে দরজার কাছটা অন্ধকার হয়ে গেল৷
জয়ন্ত ও মানিক চমকে ফিরে দাঁড়াল এবং ঘরের ভিতরে এক পা বাড়িয়ে আবির্ভুত হল নবাবের সুদীর্ঘ মূর্তি-কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার সে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
‘মানিক-মানিক!-এসো আমার সঙ্গে’-বলতে বলতে জয়ন্ত ঘর থেকে তেড়ে বেরিয়ে গেল ঝড়ের মতো৷
তারা বাইরে বেরিয়ে দেখল, নবাব তখন দালানের উপর দিয়ে ছুটছে৷
‘মানিক, ওকে কিছুতেই আর পালাতে দেওয়া হবে না, প্রাণ যায় তাও স্বীকার-তবু ওকে ধরতেই হবে!’
নবাব হঠাৎ বাম দিকে ফিরে আবার অদৃশ্য হল৷ জয়ন্ত সেখানে গিয়েই পেলে প্রকাণ্ড এক সিঁড়ি-দুমদাম পায়ের শব্দে বুঝল নবাব সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে৷ তারাও এক-এক লাফ মেরে দুই-তিনটে করে ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠতে লাগল৷
একেবারে দোতলার দালানে৷ নবাব আবার এক জায়গায় গিয়ে অদৃশ্য হল-সঙ্গে সঙ্গে দুমদুম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ৷
সেইখানে গিয়ে পড়ে মানিক বলল, ‘এখন উপায়?’
‘উপায়? মিছেই কি আমি ব্যায়াম করি-ছয়-সাত মন ওজনের মাল তুলে ছুড়ে ফেলে দি?’
মানিক দরজার উপরে সজোরে পদাঘাত করল-দরজা একটু কাঁপলও না৷ হতাশভাবে বলল, ‘এ দরজা ভাঙতে গেলে হাতি আনতে হবে৷’
‘কিছুই আনতে হবে না, আমার মাংসপেশির জয় হোক’-বলেই জয়ন্ত দরজার উপরে পিঠ রেখে দেহের সমস্ত মাংসপেশি ফুলিয়ে রুদ্ধশ্বাসে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল এক বার, দু-বার, তিন বার৷ দড়াম করে খুলে গেল দরজা-সঙ্গে সঙ্গে টাল সামলাতে না পেরে জয়ন্ত ঘরের ভিতরে পড়ে গেল৷
মানিক একলাফে জয়ন্তর দেহ টপকে ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখল, নবাব একটা গরাদ-ভাঙা জানলা দিয়ে গলে বাইরে লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে৷
মাটির উপরে লম্বমান অবস্থাতেই জয়ন্ত মাথা তুলে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেহের নীচের দিকে গুলি করো মানিক! লাফ মারলে আর ওকে পাব না!’
জয়ন্তর মুখের কথা শেষ হবার আগেই মানিকের রিভলভার গর্জন করে উঠল৷ বিকট আর্তনাদ করে নবাব জানলা ছেড়ে ঘরের ভিতর বসে পড়ল৷
জয়ন্ত ততক্ষণে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে৷ সে ও মানিক এগিয়ে গিয়ে নবাবের দুই পাশে স্থান গ্রহণ করল৷
জয়ন্ত বলল, ‘মানিক, এর মাথা টিপ করে রিভলভার ধরে থাকো৷ আমি এর হাতে হাতকড়ি পরিয়ে দিই৷ এ একটু বাধা দিলেই রিভলভার ছুড়বে৷’-জয়ন্ত হাতকড়া বার করল, নবাব ভালোমানুষের মতো হাত বাড়িয়ে দিল৷
মানিকের রিভলভারের গুলি লেগেছিল নবাবের ঊরুর পাশে৷ সেখান থেকে দরদর ধারে রক্ত ঝরছে৷
তার ক্ষতটা পরীক্ষা করে জয়ন্ত বলল, ‘না, ভয় নেই৷ এ মরবে না৷ . . . তারপর নবাব, এইবার তোমার নবাবির খবর বলো!’
তখন দিনের আলো ম্লান হয়ে এসেছে-ঘরের ভিতরে একটু একটু করে আসন্ন রাত্রির আভাস জেগে উঠছে৷ বাহির থেকে গাছের পাতারা তাদের মর্মর-বার্তা প্রেরণ করছে, তা ছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দ নেই৷
‘কী হল নবাব, তুমি চুপ করে রইলে কেন?’
নবাবের সেই সাপের মতো নির্দয় চক্ষে এতক্ষণ পরে আবার আগুন ফিরে এল৷ সে একবার মুখ তুলে জানালা দিয়ে বাইরের রৌদ্রহীন আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর জয়ন্ত ও মানিকের মুখের উপরে চোখ বুলিয়ে সহজ ও শান্ত স্বরেই বলল, ‘তোমরা কী জানতে চাও?’
‘তুমি মেয়েদের চুরি করে লুকিয়ে রেখেছ?’
‘জানি না৷’
‘জানো না?’
‘না৷’
‘এখানে তুমি কী কর?’
‘জানি না৷’
‘তোমার ওই ছয় স্যাঙাত মরল কেন?’
‘জানি না৷’
‘অর্থাৎ তুমি কিছুই বলবে না?’
‘না’৷
‘আমি এখনই দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে তোমার চিবুকের তলায় ধরব-ধীরে ধীরে তোমার দেহের মাংস পোড়াব৷’
‘পোড়াও, তবু কিছু বলব না৷’
‘আচ্ছা, আগে তো তোমায় নিয়ে গিয়ে ফাটকে আটক করি, তারপর তোমার মুখ খোলবার ভালো ব্যবস্থাই করব৷’
‘একবার তো সে চেষ্টা করেছিলে৷ পেরেছিলে কি?’
‘ও ভাবছ আবার তুমি পালাবে? বেশ, দেখা যাবে৷ এখন তো আমার সঙ্গে চলো!’
‘আমি এখান থেকে যাব না৷’
‘যাবে না? তোমার ঘাড় যাবে! আমরা তোমাকে মারতে মারতে নিয়ে যাব!’
নবাবের দুই চক্ষু দ্বিগুণ প্রজ্বলিত হয়ে উঠল৷ জয়ন্তর দিকে চেয়ে অগ্নিবৃষ্টি করে সে বলল, ‘তুমি আমাকে মারতে মারতে নিয়ে যাবে? মারতে মারতে? পারবে না!’
‘দেখবে, পারি কি না?’
নবাব আর জবাব দিল না৷ হাঁটু গেড়ে মাটির উপরে বসেছিল৷ সেই অবস্থায় তার দেহ হঠাৎ সোজা হয়ে উঠল, তার অগ্নিবর্ষী চক্ষু দুটো মুদ্রিত হয়ে গেল,-তাকে দেখলেই মনে হয়, ধ্যানমগ্ন নিষ্কম্প এক প্রতিমূর্তি!
মানিক হেসে ফেলে বলল, ‘এ আবার কী নতুন ঢং!’
জয়ন্ত বলল, ‘জানোই তো প্রবাদ আছে-দুরাত্মার ছলের অভাব নেই! নবাব বাহাদুরের কালো আলখাল্লার তলায় কত কলাকৌশল লুকানো আছে, কে তা জানে? বিড়াল আহ্নিকে বসেছেন, বোধ হয় আমাদের প্রশ্ন এড়াবার জন্যে!’
কিন্তু সে-সব কথা যে তার কানে ঢুকল, নবাব তেমন কোনোই ভাব প্রকাশ করল না৷ তার সমস্ত বাহ্যজ্ঞান তখন যেন লুপ্ত হয়ে গেছে-কেবল থেকে থেকে তার কপালের উপরের শিরাগুলো ফুলে ফুলে উঠছে৷ ওদিকে তার আহত ঊরু দিয়ে রক্ত ঝরে যে কাপড় ও ঘরের ধুলো ভিজিয়ে আরক্ত করে তুলছে, নবাবের সে খেয়াল পর্যন্ত নেই৷ যন্ত্রণাও তার হচ্ছিল নিশ্চয়, কিন্তু তার মুখে যন্ত্রণার কোনো চিহ্নই ফুটে ওঠেনি!
মানিক জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল৷ একবার নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল৷ জানলার ঠিক তলাতেই রয়েছে বালির স্তূপ৷ সেইদিকে জয়ন্তর দৃষ্টি আকৃষ্ট করে বলল, ‘জয়, নবাবটা কীরকম ধড়িবাজ দেখো! এখান থেকে বা তিনতলা থেকেও ওই বালির স্তূপের উপর লাফিয়ে পড়লে হাত-পা ভাঙবার কোনো ভয়ই নেই৷ বিপদের সময়ে পালাবার ব্যবস্থা আগে থাকতেই করে রাখা হয়েছে৷ কিন্তু তবু সে পালাতে পারল না, তোমার দেহের অদ্ভুত শক্তির জন্যে৷’
‘আর তোমার রিভলভারের জন্যে৷’
‘কিন্তু আর কতক্ষণ আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নবাবের ভণ্ডামি দেখব? আধঘণ্টার মধ্যেই রাতের অন্ধকারে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, নবাবকে এইবার জাগাও!’
কিন্তু তাকে আর জাগাতে হল না, সে নিজেই আবার চোখ খুলে বলল, ‘তোমরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাও? পারবে না৷’
জয়ন্ত হো-হো করে হেসে বলল, ‘ওহো হো, তুমি বুঝি ধ্যানদৃষ্টিতে নিজের ভবিষ্যৎ দেখে নিয়ে বুঝে ফেললে যে তোমাকে এখান থেকে সরাবার শক্তি আমাদের হবে না?’
নবাবও দ্বিগুণ জোরে হা-হা-হা-হা অট্টহাস্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘তোমরা পারবে না- পারবে না! আমাকে এ-ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না! জানো, তোমরা কার সঙ্গে লড়তে এসেছ? আমাকে গুলি মেরে জখমই করো আর আমার হাতে হাতকড়িই পরিয়ে দাও, তবু আমি হব তোমাদের প্রভু! পৃথিবীর কোনো সম্রাটের যে-শক্তি নেই, আমার বুকে আছে সেই বিপুল শক্তি! মানব-দানব-ভূত-প্রেত-আমার আজ্ঞা পালন করবে সবাই৷ আমি এই মৃত আলিনগরের একচ্ছত্র সম্রাট, এখানে আমার উপরে আর কারুর আজ্ঞা চলবে না, তোমাদেরও জীবন-মরণ এখন আমারই হাতে৷ তোমরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না, পারবে না, পারবে না! হা-হা-হা-হা-হা-হা-হা-‘ তার ভীষণ ও অলৌকিক অট্টহাস্য সেই সুবিশাল মৃত্যু-প্রাসাদের মহাস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে প্রত্যেক খিলানে খিলানে গিয়ে যেন আছড়ে পড়ে ছুটোছুটি করতে লাগল,-ঘরের ছাদের তলা থেকে শয়তানের অভিশাপের মতো কালো একঝাঁক বাদুড় ভয় পেয়ে অন্ধকার দিয়ে বোনা ডানা ঝটপট করে জানলা দিয়ে গলে বাইরে উড়ে গেল, কোথায় শুয়ে শুয়ে জুতোর কালির চেয়ে কালো একটা বিড়াল বোধ হয় ঘুমোচ্ছিল, অট্টহাসির ঘটায় জেগে উঠে দরজার কাছে এসে আগুন চোখে একবার ভিতরে উঁকি মেরে তীক্ষ্ণস্বরে একবার ম্যাও বলে প্রতিবাদ জানিয়েই আবার ছুটে পালাল৷
হঠাৎ তার মূর্তির এত পরিবর্তন হয়েছে যে নবাবের দিকে তাকালেও এখন বুক ধুকপুক করে ওঠে! আচম্বিতে তার এই ভাবান্তরের, এই আস্ফালনের কারণ কী? জয়ন্ত মনের ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল; কিন্তু তখনই জোর করে সেই ভাবটা দমন করে সে ধমকে বলে উঠল, ‘নবাব, তোমার ও-বিদঘুটে হাসি থামাও!’
নবাব তার দিকে দৃকপাতমাত্র না করে গম্ভীর কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয় রে আয় জীবনহারা জীবন্তের দল! সূর্যের চোখ কানা হয়েছে, দিনের আলো নিবে গেছে, বাদুড়ের ঘুম ভেঙেছে, কালো বিড়াল জেগেছে, কবরের দরজা খুলেছে-এইবারে তোরাও উঠে দাঁড়া, গোরস্থানে আলো জ্বাল, নরকের ফটকে সন্ধ্যাবাতি দে! ঝরে পড়ুক তোদের গায়ের ধুলো, জাগুক তোদের বুকে বুকে রক্ততৃষ্ণা, দুলুক তোদের গলায় গলায় নরমুণ্ডমালা! রাত তোদের ডাকছে, শ্মশান তোদের ডাকছে, আমি তোদের ডাকছি! ওরে আয়, ওরে আয় রে আয় প্রাণহারা মহাপ্রাণীর দল!’
জয়ন্ত সক্রোধে মাটির উপরে পদাঘাত করে বলল, ‘মানিক, মানিক, আমরা কি এখানে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে পাগলের প্রলাপ শুনব? ওই বদমাইসটার ঝাঁকড়া চুল ধরে মাটি থেকে টেনে তোলো তো দেখি, ও আমাদের সঙ্গে যায় কি না?’
কিন্তু জয়ন্তর কথা মানিকের কানে ঢুকল না, সে তখন কান পেতে আর একটা শব্দ শুনছিল৷ একতলায় সমতালে পা ফেলে কারা চলছে! ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ! যেন শিক্ষিত সৈন্যদলের পদশব্দ! ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ! যেন কাদের পরলোক থেকে ইহলোকে আনাগোনার শব্দ! জয়ন্তরও মুখ সাদা হয়ে গেল৷ তালে তালে সেই পদশব্দ সিঁড়ির ধাপ দিয়ে উপরে উঠছে৷
নবাব আবার ডাক দিল-‘ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয় রে আয় সজীব মৃত্যুর দল! আয়, আয়, আয়, আয়!’
ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ৷ শব্দ ক্রমেই নিকটস্থ হচ্ছে৷
মানিক ছুটে দরজার কাছে গেল৷ মুখ বাড়িয়ে দেখল, সিঁড়ি পার হয়ে প্রথমে যে মূর্তিটা আবিভূÍত হল, তার কপালে সেই বুলেটের দাগ৷ তার পিছনেই দেখা দিল আর-এক মূর্তি৷
যেটুকু দেখল তাই-ই যথেষ্ট! খানিক আগে একতলার কোণের ঘরের সেই তাপহীন, শ্বাসহীন, প্রাণহীন আড়ষ্ট দেহগুলোর মধ্যেই মানিক এদের দেখে এসেছে৷ দ্বিতীয় মূর্তির পিছনে যখন আবার একটা মূর্তি খোঁড়াতে খোঁড়াতে দালানের উপর এসে উঠল, মানিক বেগে সেই জানলার কাছে দৌড়ে এসে বলল, ‘জয়, জয়! বাইরে লাফিয়ে পড়ো! সেই মড়াগুলো জ্যান্ত হয়েছে!’
নবাব হাঁকল-‘ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয় রে আয় কবরবাসীর দল!’
ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ! দরদালান দিয়ে বাঁধা তালে পা ফেলে তারা এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে, আরও এগিয়ে আসছে৷ তাড়াতাড়ি আসবার জন্যেও তারা কেউ যেন বেতালে পা ফেলবে না,-কিন্তু প্রতি পদক্ষেপেই সেই মৃত্যুচরের দল কাছে-আরও কাছে এগিয়ে আসছে৷
জয়ন্ত রুখে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুক ওরা! আমি ওদের ভয় করি না!’
মানিক তাড়াতাড়ি জয়ন্তর হাত ধরে জানলার দিকে তাকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘জয় দুঃসাহসেরও সীমা আছে! মনে রেখো, বন্দুকের বুলেটও ওদের গতিরোধ করতে পারে না! ওই ওরা এসে পড়ল! শিগগির লাফ মারো!’
নবাব এতক্ষণে উঠে দাঁড়াল-মুখে তার নিষ্ঠুর হাসি৷ কিন্তু মানিক তৎক্ষণাৎ তার এক পা লক্ষ্য করে আবার রিভলবার ছুড়ল, বিকৃত মুখে নবাব তীব্র চিৎকার করে আবার ভূতলশায়ী হল৷
প্রথমে জয়ন্ত, তারপরে মানিক জানলা গলে নীচেকার বালির স্তূপের উপর লাফিয়ে পড়ল৷ তখনও একেবারে অন্ধকার হয়নি৷ শেষ আলোর শিখারা তখনও আকাশে আঁধারের সঙ্গে যুদ্ধ করছে৷
জয়ন্ত ও মানিক কোনোদিকে না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে নদীর পথে ছুটল৷
ছুটতে ছুটতে মানিক একবার পেছন ফিরে দেখল, দোতলার ভাঙা জানলায় মুখ বাড়িয়ে আছে কতকগুলো রক্তশূন্য সাদা মূর্তি৷
সে চেঁচিয়ে বলে উঠল-‘জয়! আরও জোরে-আরও জোরে ছোটো!’
একাদশ পরিচ্ছেদ – মানুষে অমানুষে যুদ্ধের আয়োজন
এদিকে ফাঁড়ির সবাই ভেবেই অস্থির৷
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে সকলে যখন জয়ন্ত ও মানিকের দেখা পেল না তখন মনে করল, তারা কোথাও বেড়াতে গিয়েছে, যথাসময়ে ফিরবে৷
কিন্তু যথাসময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল-কোথায় জয়ন্ত আর কোথায় মানিক!
সুন্দরবাবু মত প্রকাশ করলেন, ‘ও দুই ছোকরাই অত্যন্ত বারফটকা! হুম, এত যে সাত-ঘাটের জল খেয়ে মরিস, তবু কি বেড়াবার শখ মিটল না? আরে এ পোড়ো দেশে দেখবার আছে কী?’
একটু বেশি বেলা করেই সেদিন দুপুরের খাওয়া শেষ করা হল৷ তবু তাদের দেখা নেই৷
বৈকালি চা-পানের সময় এল৷
অমিয় একবার জয়ন্ত ও মানিকের মোটঘাট নাড়াচাড়া করে বলল, ‘জয়ন্তবাবু আর মানিকবাবু অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই বেরিয়েছেন দেখছি৷ তাঁদের রসদের ব্যাগ দুটোও নেই৷ তবে কি তারা আলিনগরেই গিয়েছেন?’
সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ‘অ্যাঁ, বলো কী? সেই যমালয়, যেখানে যমদূতেরা হানা দিয়ে ফিরছে, সেইখানে তারা দুটো প্রাণী গিয়ে কী করতে পারবে?’
পরেশ ও নিশীথ বলল, ‘অমিয় বোধ হয় ঠিক আন্দাজ করেছে৷ নইলে এতক্ষণে তাঁরা ফিরে আসতেন৷’
সুন্দরবাবু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তাদের ফেরবার আশা ছেড়ে দাও! আর তারা ফিরছে না!’-এই বলে তিনি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন, কারুর সঙ্গে আর একটা কথাও কইলেন না৷
সন্ধ্যা এল৷ রাত হল৷ সকলেরই মন খারাপ৷ মহম্মদ, অমিয়, নিশীথ ও পরেশ টেবিলের ধারে বসে চুপিচুপি পরামর্শ করছেন৷ সুন্দরবাবু মুড়ি দিয়ে সেইভাবেই পড়ে আছেন৷
রাত্রের খাবার সাজিয়ে দেওয়া হল৷ অমিয় ডেকে বলল, ‘উঠুন সুন্দরবাবু, খাবেন আসুন৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! আমি খাব না৷ জয়ন্ত আর মানিক বেঁচে নেই৷ আমার মন কেমন করছে৷ আমার গলা দিয়ে খাবার গলবে না৷’ তাঁর গলা ধরা ধরা৷ বোধ হয় মুড়ি দিয়ে কাঁদছেন৷
মহম্মদ বললেন, ‘আপনি না পুলিশে কাজ করেন৷ এত সহজে কাবু হয়ে পড়লেন?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘পুলিশে কাজ করি বলে কি আমি মানুষ নই? আমার প্রাণ পাথর? আমি খাব না৷’
মহম্মদ বললেন, ‘শুনুন সুন্দরবাবু৷ পরামর্শ করে ঠিক হল যে, কাল সকলেই আমরা সদল-বলে আলিনগরে যাত্রা করব৷ সদর থেকে হুকুমও এসেছে৷ দু-দিন পরেই যেতাম, কিন্তু যেরকম ব্যাপার দেখছি, আর দেরি করা চলে না৷’
সুন্দরবাবু উঠে বসলেন, ‘ঠিক বলছেন তো?’
‘হ্যাঁ৷’
‘কিন্তু জয়ন্ত আর মানিককে কি পাওয়া যাবে? আলিনগর ভূতের রাজ্য!’
‘সুন্দরবাবু, ভূত-টুত সব বাজে কথা! কোনো বদমাইস ভূতের ভয় দেখায়৷ জয়ন্তবাবু বোকা নন-আত্মরক্ষা করতে জানেন৷’
‘হুম! সে বোকা নয় বটে, কিন্তু গোঁয়ার৷ তাই তার জন্য ভয় হয়৷’
‘কোনো ভয় নেই৷ আপনি খেতে বসুন৷’
‘হুম, আচ্ছা! দুটো খাবার মুখে দিই তাহলে৷ কিন্তু কাল সকালেই যাচ্ছেন তো?’
‘হ্যাঁ৷’
‘কত লোক নেবেন?’
‘আমরা পাঁচজন তো আছিই, আরও জন-বারো চৌকিদারও যাবে৷’
‘জন-বারো? জন-চব্বিশ নেওয়া উচিত!’
‘তাহলে আরও দু-দিন অপেক্ষা করতে হয়৷ আপাতত অত লোক নেই৷’
‘না, না, অপেক্ষা নয়-ওই জন-বারোতেই হবে৷’
আহারাদির পর আরও খানিকক্ষণ পরামর্শ চলল৷ তারপর রাত বারোটা বাজল দেখে মহম্মদ উঠে দাঁড়ালেন৷
ঠিক সেই সময় ফাঁড়ির দরজায় একখানা মোটর সশব্দে এসে দাঁড়াল৷ মহম্মদ বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘এত রাত্রে কে আবার কেস নিয়ে জ্বালাতে এল?’
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল-দুজনের পায়ের শব্দ৷
সুন্দরবাবু তার বিপুল ভুঁড়ির ভার ভুলে গিয়ে শূন্যে এক লাফ মারলেন৷ মহা উল্লাসে বলে উঠলেন, ‘ও পায়ের শব্দ আমি চিনি! জয়ন্ত আর মানিক আসছে!’
তারাই বটে৷ গায়ে, কাপড়চোপড়ে ধুলো আর কাদা, মাথার চুল উসকোখুসকো, কিন্তু মুখে প্রচণ্ড উৎসাহের ঔজ্জ্বল্য৷
সুন্দরবাবু একসঙ্গে তাদের দুজনকে চেপে ধরে বললেন, ‘আঃ, বাঁচলাম! কী ভাবনাটাই না হয়েছিল, হুম!’
মহম্মদ বললেন, ‘কোথায় ছিলেন আপনারা৷ আমরা যে কাল সকালেই আপনাদের খুঁজতে আলিনগরে যাচ্ছিলাম!’
জয়ন্ত একখানা চেয়ারের উপর বসে পড়ে বলল, ‘কাল সকালে? না না, নবাবকে যদি ধরতে চান, আজ এখনই চলুন!’
‘তার মানে?’
‘নবাবের আড্ডা আমরা আবিষ্কার করেছি, মানিকের দুই গুলিতে তার দুই পা খোঁড়া হয়ে গেছে, এমনকী নবাবের হাতেও আমরা হাতকড়া পরিয়ে দিয়ে এসেছি-দেরি করলে সে হয়তো সরে পড়বে৷’
মহম্মদ বললেন, ‘এতই যখন করেছেন, তখন দয়া করে নবাবকে ধরে আনলেন না কেন?’
‘ধরে আনলুম না কেন’-বলেই জয়ন্ত থেমে গেল৷ তার চোখের সামনে ফুটে উঠল প্রায়-অন্ধকার গৃহতলে শায়িত সেই ছয়টা মৃতদেহ৷ নিরালা, নীরব, নির্জন অট্টালিকার ধাপে ধাপে সেই ধুপ-ধুপ ধুপ-ধুপ করে জ্যান্ত মড়ার অলৌকিক পদশব্দ আবার যেন সে শুনতে পেলে স্বকর্ণে! . . . থেমে থেমে বলল, ‘মহম্মদ সাহেব, বলতে পারেন, মড়া কখনো বাঁচে?’
‘মড়া?’
‘হ্যাঁ, ছয়টা মড়া আমাদের আক্রমণ করতে এসেছিল৷ তাই নবাবকে আনতে পারিনি৷ পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি৷’
‘কী বলছেন!’
‘মানিককে জিজ্ঞাসা করুন! আমি খালি পায়ের শব্দ পেয়েছি, মানিক স্বচক্ষে দেখেছে৷’
অমিয়, নিশীথ ও পরেশ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমরাও তাদের দেখেছি!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! আমার কথাই সত্যি হল৷ কাঙালের কথা বাসি হলে টিকে!’
মানিক বলল, ‘আপনি কাঙাল নন সুন্দরবাবু, তিনশো টাকা মাইনে পান৷’
সুন্দরবাবু রেগে বললেন, ‘ঠাট্টা কোরো না মানিক! এখন ঠাট্টা আমার ভালো লাগছে না!’
মহম্মদ মাথা নেড়ে বললেন, ‘এর ভিতরে নিশ্চয় কোনো কারসাজি আছে৷ মড়া আক্রমণ করে? অসম্ভব!’
‘বেশ তো, এখনই দলবল নিয়ে চলুন না৷’
‘তা হয় না৷ যেতে হলে বড়ো মোটর চাই৷ মোটর কাল সকালের আগে পাওয়া যাবে না৷’
জয়ন্ত নাচারভাবে বলল, ‘তাহলে কাল সকাল পর্যন্তই অপেক্ষা করি, কী আর করব!’
পরিত্যক্ত আলিনগরের প্রাচীন পথ ধরে দু-খানা সাধারণ মোটরগাড়ি ও একখানা মোটরবাস অগ্রসর হচ্ছে৷ জয়ন্ত, মানিক ও সুন্দরবাবু ছিলেন একখানা টু-সিটারে, জয়ন্ত নিজেই তার চালক৷ তার পরের গাড়িতে আছেন মহম্মদ, অমিয়, নিশীথ ও পরেশ৷ বাসে আছে বারোজন চৌকিদার, ড্রাইভারদের নিয়ে মোট একুশজন লোক৷
জয়ন্তর মতে একুশজন লোকই যথেষ্ট৷ সুন্দরবাবু খুঁতখুঁত করে বললেন, ‘মোটেই যথেষ্ট নয়! হানাবাড়িতে একশোজন লোকও যথেষ্ট নয়! হুম! একটা ভূত দেখা দিলে একশো জনের একজনেরও আর দেখা পাওয়া যাবে না! আর, এখানে একটা নয়-ভূত আছে নাকি ছয়-ছয়টা! বাপরে!’
মানিক বলল, ‘একজনেরও দেখা পাওয়া যাবে না? তাহলে আপনিও কি পালাবেন?’
‘পালাব না তো কি, নিশ্চয় পালাব৷ আমি হচ্ছি পুলিশ, আমি ভূতের রোজা নই; ভূত দেখলে পালাব না তো কি দাঁড়িয়ে থাকব?’
‘তবে আপনি এলেন কেন?’
‘সেই ছয়টা লোক তো ভূত নাও হতে পারে? হয়তো তোমাদের ছেলেমানুষ পেয়ে কেউ মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে! বিশেষত, এটা দিনদুপুর৷ কে না জানে, দিনদুপুরে ভূত বড়ো একটা দেখা দেয় না৷’
মানিক মুখ টিপে হেসে বলল, ‘কেন সুন্দরবাবু, আপনি কি প্রাচীন শাস্ত্রবাক্য শোনেননি?’
‘কী শাস্ত্রবাক্য?’
‘ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা?’
‘হুম! আবার ঠাট্টা হচ্ছে?’
গাড়িগুলো গোরস্থানে এসে উপস্থিত হল৷ জয়ন্ত চেঁচিয়ে বলল, ‘এখানেই সকলকে নামতে হবে৷’
সকলে একে-একে গাড়ি থেমে নেমে পড়ল৷ একসঙ্গে এত লোকের ভিড় হতভাগ্য আলিনগর অনেক কাল দেখেনি৷ পথের উপরে শুয়ে একটা গোখরো সাপ নিশ্চিন্ত মনে কুণ্ডলী পাকিয়ে রোদ পোয়াচ্ছিল, সে তাড়াতাড়ি ফোঁস করে ফণা তুলে উঠেই কালো বিদ্যুতের মতো চকিতে একখানা পাথরের আড়ালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করল৷
চারিদিকে তাকিয়ে মহম্মদ বললেন, ‘এমন জায়গা কখনো দেখিনি! নগর বললেই লোকের মনে জেগে উঠে জনতার দৃশ্য৷ কিন্তু জনতাহীন-জলশূন্য সাগর! চারিদিকে খালি ভাঙা বাড়ি আর ঘুঘুর কান্না৷ দিনের বেলাতেই এখানে বুকের কাছটা ছাঁৎ ছাঁৎ করে ওঠে! এখানে একলা এলে রজ্জুতে সর্পভ্রম হওয়াই স্বাভাবিক!’
জয়ন্ত অল্প হেসে বলল, ‘আপনি বোধ হয় ভাবছেন, আমরাও রজ্জুতে সর্পভ্রম করেছি? কিন্তু এইটেই আপনার ভ্রম৷ এই পথে আসুন৷’
গোরস্থানের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে মহম্মদ বললেন, ‘কিন্তু একটা কিছু গোলমাল আছে, আপনারা যা দেখেছেন তা ভূতের চেয়েও আশ্চর্য৷ জ্যান্ত মড়ার কল্পনাও আমি করতে পারছি না!’
মানিক বলল, ‘তারা যদি এখানে থাকে, তাহলে আপনিও স্বচক্ষে দেখতে পাবেন৷’
জয়ন্ত বলল, ‘অনেক সময় বাজে নষ্ট হয়েছে৷ তারা কি আর এখানে আছে?’
সেই বিশাল অট্টালিকার বিবর্ণ উচ্চ চূড়া চতুর্দিকের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অনেক দূর থেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ সকলে সেই বাড়ির যত কাছে এগিয়ে যাচ্ছে, সুন্দরবাবু একটু একটু করে ততই পিছিয়ে পড়ছেন৷ ক্রমে তিনি চৌকিদারের দলে গিয়ে ভিড়লেন৷ তাঁর যুক্তি হচ্ছে, পিছিয়ে থাকলে ভূতের আবির্ভাব হলে সর্বাগ্রে তিনিই দৌড় মারতে পারবেন৷
মহম্মদ বললেন, ‘অত বড়ো বাড়ি ঘেরাও করতে গেলে একশোজন লোকের দরকার৷’
জয়ন্ত বলল, ‘বাড়ি ঘেরাও করে যখন কোনো লাভ নেই, তখন ভিতরের উঠানে চৌকিদাররা অপেক্ষা করুক৷ আমরা ডাকলেই তারা যেন ছুটে আসে৷’
সুন্দরবাবু মনে মনে বললেন, ‘তারাই ছুটে আসবে বটে! ছুটে আসবে, না ছুটে পালাবে? ভূতের সঙ্গে লড়বে এই তালপাতার সেপাইরা! হুম!’
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – হুম-হুম-হুম-হুম
সকলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল৷ এতগুলো জুতোর শব্দে অট্টালিকাবাসী নির্জনতা যেন চমকে উঠল সবিস্ময়ে৷
জয়ন্ত মনে মনে ভাবল, নবাব যদি এখনও এখানে থাকে, তাহলে এ পায়ের শব্দগুলো সেও শুনতে পেয়েছে নিশ্চয়ই৷
আর সেই জ্যান্ত মড়াগুলো? তারাও কি এখন উৎকর্ণ হয়ে তালে তালে পা ফেলে আক্রমণ করতে আসবার জন্যে অপেক্ষা করছে না?
সুন্দরবাবু মনে মনে ভাবছেন, এবার তো খাঁচার ভিতরে ইঁদুরের মতো বাড়ির ভিতরে বন্দি হলাম৷ কোন দিক দিয়ে ভূত এলে কোন দিক দিয়ে পালানো উচিত, কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না৷ আর চৌকিদারদের সঙ্গে থেকে কোনো লাভ হবে না, এদের হাতে বন্দুক নেই! . . . তিনি দৌড়ে মহম্মদের সঙ্গ নিলেন৷
জয়ন্ত সর্বাগ্রে একতলা দালানের সেই কোণের ঘরে গিয়ে ঢুকল৷ চারিদিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে হতাশভাবে বলল, ‘তারা এখানে নেই৷’
সুন্দরবাবু আস্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, ‘তারা নেই, বাঁচা গেছে৷ আপদ বিদেয় হয়েছে!’
মহম্মদ বললেন, ‘আপনি ঘর ভুল করেননি তো?’
জয়ন্ত বলল, ‘না৷ ওই দেখুন৷’ বলেই সে টর্চ টিপে মেঝের উপরে আলো ফেলল৷ মেঝের উপরে পুরু ধুলো৷ আর ধুলোর উপরে পাশাপাশি ছয়টা দেহের পরিষ্কার ছাপ৷
মানিক বলল, ‘এ-ঘরে মড়াগুলো ছিল ঠিক মড়ারই মতো৷ তাদের গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি, নাকে হাত দিয়ে দেখেছি৷’
মহম্মদ খালি বললেন, ‘আশ্চর্য!’
সুন্দরবাবু সকলের পিছন থেকে উঁকি মেরে দেহের ছাপগুলো একবার দেখেই শিউরে উঠে বললেন, ‘হুম! আমার নাকে পচা মড়ার গন্ধ আসছে!’
মানিক বলল, ‘সত্যি সত্যিই সেদিন এখানে মড়া-পচা গন্ধ ছিল৷’
মহম্মদ বললেন, ‘সুন্দরবাবুর ঘ্রাণশক্তি বেশি৷ আমি কোনো গন্ধ পাচ্ছি না৷’
জয়ন্ত বলল, ‘চৌকিদারদের উঠানের সব ঘর খুঁজে দেখতে বলুন৷ ততক্ষণে আমরা উপরটা ঘুরে আসি৷ কিন্তু বোধ হয় মিথ্যা ঘোরাঘুরি৷ শিকার পালিয়েছে৷ আমরা যে আবার আসব নবাব সেটা আন্দাজ করতে পেরেছে৷ সে বোকা নয়৷’
দোতলার দালানের কোলে শুয়ে ছিল সেই কালো বিড়ালটা৷ লোক দেখেই ‘ম্যাঁও’ বলে আপত্তি জানিয়ে ল্যাজ তুলে দৌড় মারল৷
মহম্মদ বললেন, ‘হানাবাড়ির সব লক্ষণই এখানে আছে দেখছি!’
মানিক বলল, ‘হ্যাঁ, কেবল কালো বিড়াল নয়, কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে দেখুন, দলে দলে কালো বাদুড়ও ঝুলছে৷ যেন আঁধারে তৈরি অতিকায় প্রজাপতি!’
‘কেবল আসল দ্রষ্টব্যই নেই৷ ভূত, কি জ্যান্ত মড়া৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ভূত আবার দ্রষ্টব্য কী, না থাকাই তো ভালো!’
যে-ঘরে নবাব আহত হয়েছিল সকলে সেই ঘরে প্রবেশ করল৷ ঘরে জনপ্রাণী নেই৷
মেঝের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জয়ন্ত খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷ যেন নিশ্চল জড় পাথরের মূর্তি৷ তারপর হঠাৎ কী উৎসাহে তার বিপুল বক্ষ স্ফীত হয়ে উঠল৷ তারপর পকেট থেকে রুপোর শামুক বার করে দু-বার সশব্দে নস্য নিল৷
মানিক জানে, এটা জয়ন্তর বিশেষ আনন্দের লক্ষণ৷ কিন্তু হঠাৎ সে এমন আনন্দিত হল কেন?
মহম্মদ বললেন, ‘বাড়ির সব ঘরই যে এমন খালি দেখব, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই৷’
জয়ন্ত খুশি গলায় বলল, ‘সব ঘর হয়তো খালি নেই!’
‘কী করে জানলেন?’
‘এখনও ঠিক করে কিছু বলতে পারছি না৷ আসুন আমার সঙ্গে৷’
জয়ন্ত অগ্রসর হল৷ আর সবাই চলল তার পিছনে পিছনে৷
সে-ঘর থেকে বেরিয়ে জয়ন্ত খুব ধীরে ধীরে দালান দিয়ে এগোতে লাগল৷ দালানের পূর্ব প্রান্তে একটা দরজা৷ সেটা ভিতর থেকে বন্ধ৷
মহম্মদ বললেন, ‘এ দরজা বন্ধ করল কে?’
জয়ন্ত বলল, ‘যেই-ই বন্ধ করুক, আমি খুলে দিচ্ছি৷ আপনাদের বন্দুক তৈরি রাখুন৷’
তার বিপুল দেহের ধাক্কায় দরজার খিল ভেঙে গেল৷
কিন্তু সেটা ঘরের দরজা নয়৷ অন্দর-মহলের দরজা৷
জয়ন্ত আবার অগ্রসর হল৷ অন্দরেও একটা উঠান রয়েছে, কিন্তু বাইরের মতন অত বড়ো নয়৷ আবার একটা দালান৷ তারপর আবার একসার সিঁড়ি৷ জয়ন্ত এবার নীচে নামতে লাগল৷ তারপর ডানদিকে ফিরে এগিয়ে চলল৷ সে আবার একটিপ নস্য নিল এবং মনের আমোদে শিস দিতে শুরু করল৷
মানিক অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, জয়ন্ত কোথায় যাচ্ছে? এ বাড়ির কিছুই সে চেনে না, এদিকে কখনো আসেওনি, কিন্তু এমন নিশ্চিতভাবে কোথায় যাচ্ছে সে? জয়ন্ত তো অকারণে কিছু করবার পাত্র নয়, কী সূত্রে সে পেয়েছে, কখন পেল এবং কেমন করে পেল?
দ্বিতীয় উঠানের পূর্ব প্রান্তে ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা ঘর৷ জয়ন্ত সোজা সেই ঘরের ভিতর গিয়ে ঢুকল৷ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার টর্চটা জ্বেলে কী যেন দেখল৷
সে ঘরেও কেউ নেই৷
মহম্মদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে এলেন কেন?’
জয়ন্ত সে-কথার জবাব না দিয়ে যেন নিজের মনেই বলল, ‘দেখছি, এ ঘর দিয়ে বেরোবার আর কোনো পথ নেই৷ তাহলে কোথায় গেল?’
‘কে কোথায় গেল?’
‘নবাব৷ সে এই ঘরেই ঢুকেছে৷ কিন্তু দরজা দিয়ে আর বেরোয়নি৷’
মহম্মদ একটু বিরক্ত স্বরেই বললেন, ‘আপনার এমন আশ্চর্য অনুমানের কারণ কী?’
‘কারণ? রক্তের প্রমাণ মহম্মদ সাহেব, রক্তের প্রমাণ! আপনারা চোখ ব্যবহার করতে শেখেননি কেন?’
‘আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না৷’
‘মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখুন৷’
মানিক সবিস্ময়ে দেখল, গৃহতলে একটা সুদীর্ঘ কালো রেখা৷ ঘর থেকে মুখ বাড়িয়েও দেখল, সে রেখা দালান দিয়ে সমানে চলে গেছে৷ রক্ত জমাট বাঁধলে কালো দেখায়৷ এত বড়ো একটা সূত্রও তার চোখে পড়েনি বলে সে রীতিমতো লজ্জা অনুভব করল৷
জয়ন্ত বলল, ‘মহম্মদ সাহেব, শুনেছেন তো, মানিকের রিভলবারের গুলিতে কাল নবাবের ঊরু আর পা জখম হয়েছিল? নবাব যেখান দিয়ে গিয়েছে, কিংবা তাকে যেখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সারা পথেই রক্ত ঝরে ঝরে পড়েছে৷ সেই রক্তরেখা অনুসরণ করেই উপরের ঘর থেকে আমি এখানে এসে হাজির হয়েছি৷ এখন বুঝতে পারলেন?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! জয়ন্ত, তুমি আমার কান মলে দাও! আমরা কি চোখের মাথা খেয়েছিলাম? এমন সহজ প্রমাণটাও আবিষ্কার করতে পারিনি!’
মহম্মদ চমৎকৃত স্বরে বললেন, ‘ধন্য জয়ন্তবাবু, ধন্য! . . . কিন্তু সে শয়তানটা গেল কোথায়?’
‘সেইটেই হচ্ছে সমস্যা৷ দেখছেন তো, রক্তের একটা রেখাই এই ঘরে এসে ঢুকেছে৷ নবাব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আর একটা রেখাও দেখতে পাওয়া যেত৷ মহম্মদ সাহেব, আপনি সব চৌকিদারকে এখানে আসতে বলুন, আমি ততক্ষণ নবাবকে পুনরাবিষ্কারের চেষ্টা করি৷’
জয়ন্ত টর্চ জ্বেলে দেখে বলল, ‘মানিক রক্তের দাগ ওই দেওয়ালের গায়ে শেষ হয়েছে৷ কিন্তু দেওয়ালের সামনে গিয়ে নবাব অদৃশ্য হল কেমন করে, সে তো আর হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যেতে পারে না? . . . হয়েছে, ওই দেখো, দেওয়ালের গায়ে দুটো কড়া৷ এ-সব সেকেলে পুরোনো বাড়িতে প্রায়ই গুপ্তদ্বার থাকে৷ মানিক, কড়া দুটো ধরে জোরে টান মারো তো!’
মানিক তাই করল৷ খুব সহজেই দেওয়ালের খানিকটা অংশ হড়হড় করে দরজার মতো খুলে গেল৷ ভিতরে একটা পথ৷
জয়ন্ত বলল, ‘সবাই রিভলবার নাও৷ ছয়জন চৌকিদার গুপ্তদ্বারের সামনে পাহারা দিক৷ ছয়জন আমাদের সঙ্গে আসুক৷’
পথটা গিয়ে আর-একটা দরজার সামনে শেষ হয়েছে৷ দরজার সঙ্গে আর একবার জয়ন্তর শক্তিপরীক্ষা শুরু হল৷ কিন্তু এ-দরজা জয়ন্তর প্রবল আক্রমণ তিন-তিন বার ব্যর্থ করল৷
জয়ন্ত তখন দরজার উপরে পৃষ্ঠদেশ রেখে দেহের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে প্রাণপণে চাপ দিতে লাগল-টর্চ-এর আলোতে দেখা গেল, তার সারা মুখ রাঙা টকটকে হয়ে গেছে৷
মহম্মদ মাথা নেড়ে বললেন, ‘অসম্ভব চেষ্টা! মানুষ ও-দরজা গায়ের জোরে ভাঙতে পারে না৷ অন্য ব্যবস্থা করতে হবে৷’
হঠাৎ মড়াৎ করে একটা শব্দ হল৷ জয়ন্ত সরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দেখুন, ভেঙেছে কি না?’
মহম্মদ এগিয়ে সবিস্ময়ে দেখলেন, দরজার দু-খানা কপাটই চৌকাট থেকে ভেঙে বেরিয়ে এসেছে৷ সসম্ভ্রমে জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি অসাধারণ মানুষ!’
তারপর দু-তিনটে লাথি মারতেই হুড়মুড় করে পাল্লা দু-খানা ভেঙে পড়ল৷
খোলা দরজা দিয়েই দেখা গেল, একখানা বড়ো হলঘর এবং ঘরের ওদিককার দেওয়ালের সামনে খাটের বিছানার উপরে হাসিমুখে বসে রয়েছে নবাব স্বয়ং!
জয়ন্ত চেঁচিয়ে বলল, ‘সেলাম আলিনগরের সম্রাট! ঘরের ভিতরে যেতে পারি কি?’
নবাব খুব মিষ্ট গলায় বলল, ‘এসো৷’
‘তোমার সেই জীবনহীন জীবন্তরা কোথায়?’
নবাব আবার ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বলল, ‘বড়ো হঠাৎ এসে পড়েছ, তাদের জাগাবার আর সময় পেলাম না৷’
‘তাহলে এ-জীবনে আর সময় পাবেও না!’-বলেই জয়ন্ত ভিতরে গিয়ে ঢুকল সর্বপ্রথমে৷ অন্য সবাই তার পিছনে পিছনে এগিয়ে গেল৷
হঠাৎ সুন্দরবাবু ‘ওরে বাপরে-হুম!’ বলে চেঁচিয়ে উঠে সামনে অমিয়কে পেয়েই দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন৷
সকলে ফিরে স্তম্ভিত নেত্রে দেখল, দরজার দিকে দেওয়ালের তলাতেই পাশাপাশি শুয়ে আছে সেই ছয়টা মূর্তি৷ তাদের কারুর চোখ মোদা, কারুর চোখ আধ খোলা, কারুর চোখ পুরো খোলা৷ কিন্তু সব চোখই আড়ষ্ট-মড়ার মতো দৃষ্টিহীন!
জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে তাদের বুকে হাত দিয়ে বলল, ‘মহম্মদ সাহেব, দেখে যান-এই ঠান্ডা বুকে শ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো চিহ্ন আছে কি না!’
কিন্তু মহম্মদের রুচি হল না৷ দূর থেকেই বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছি ওগুলো মড়া৷’
মানিক বলল, ‘কিন্তু এই মড়াগুলোই সেদিন বেঁচে উঠেছিল৷’
মহম্মদ অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন৷
সুন্দরবাবু চোখ ছানাবড়া করে বললেন, ‘ওরা আবার যদি জাগে? আবার যদি তেড়ে আসে? এই চৌকিদার! লাশগুলো শিগগির এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যা!’
কিন্তু চৌকিদাররা কেউ মড়া ছুঁতে রাজি হল না৷
নবাব হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় নেই, ওরা কেউ আর জাগবে না৷ এইবারে আমিও ওদের মতো ঘুমিয়ে পড়ব৷’
জয়ন্ত চমকে উঠে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়বে-মানে?’
‘হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়ব৷ তোমরা জ্যান্ত নবাবকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না৷ এই দেখো৷’ নবাব বিছানার উপর থেকে একটা খালি শিশি তুলে নিয়ে দেখাল৷
‘তুমি বিষ খেয়েছ?’
‘হ্যাঁ, তোমরা হঠাৎ এসে পড়লে, নইলে ওদের আর একবার জাগিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখতাম৷ বিষ না খেয়ে উপায় কী?’
মহম্মদ বললেন, ‘তুমি সত্যি সত্যিই ওই মড়াগুলোকে বাঁচাতে পার?’
‘পারি৷ অবিশ্বাস হচ্ছে? দেখবে?’
সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না না, আর দেখে কাজ নেই! আমার খুব বিশ্বাস হচ্ছে!’
নবাব বলল, ‘তোমরা কি পিশাচসিদ্ধ মানুষের কথা শোননি? আমি বহু সাধনায় সেই বিদ্যা অর্জন করেছি৷ নানান দেশের নানান কবর খুঁজে আমি বেছে বেছে খুব জোয়ান আর টাটকা মড়া তুলে এনেছি৷ যখন দরকার হয় তখন আমি তাদের নিজের আত্মার অংশ দিই৷ কিন্তু ওদেরও দেহ তাজা রাখবার জন্যে জ্যান্ত জীবের রক্তের দরকার হয়৷ তাই যখন ওই মড়ারা বাঁচে, বনের জীব ধরে তাদের ঘাড় ভেঙে রক্ত খায়, সুবিধা পেলে মানুষের রক্তও পান করে; আর তারপর গোলামের মতো আমার হুকুমে ওঠে বসে চলে ফেরে৷ . . . তোমরা আর কী জানতে চাও বলো, আমার ঘুমোবার সময় ঘনিয়ে আসছে৷’
জয়ন্ত বলল, ‘তুমি মেয়ে চুরি করতে কেন?’
হা-হা করে হেসে নবাব বলল, ‘কেন? বলেছি তো, আমি আলিনগরের রাজা৷ তাই তো আমি নবাব নাম নিয়েছি৷ আমার বেগম নেই, তাই মেয়ে ধরে আনি বেগম করব বলে৷ কিন্তু একটা মেয়েও আমার বেগম হবার উপযুক্ত হল না৷ তবু তাদের ধরে রেখেছি-মনের মতো বেগম পেলে পর তাদের বাঁদি করে রাখব বলে৷’
অমিয় ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠল, ‘কোথায় আমার বোনকে লুকিয়ে রেখেছিস?’
‘পাশের ঘরে গিয়ে দেখোগে৷’
অমিয় নিশীথ ও পরেশ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘কোন দিক দিয়ে যাব?’
‘ওই দরজা দিয়ে৷’
পশ্চিম দিকে একটা দরজা৷ সেটা ঠেলতেই খুলে গেল, সেদিকেও একটা পথ রয়েছে৷
তারা তিনজনে ভিতরে ঢুকে চেঁচিয়ে ডাকল-‘শীলা, শীলা!’
কে ক্ষীণ, কাতর কন্ঠে সাড়া দিল, ‘দাদা! দাদা!’
মিনিট-তিনেক পরেই অমিয় তার বোনের হাত ধরে ফিরে এল৷ নিশীথ ও পরেশের পিছনে পিছনে এল আরও তিনটে মেয়ে, সকলেই ভয়ে থরথর করে কাঁপছে৷
ছয়টা মৃত মূর্তির দিকে তাকিয়েই শীলা আর্তনাদ করে আতঙ্কগ্রস্ত স্বরে বলে উঠল, ‘দাদা! দাদা! আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো!’
অমিয় বলল, ‘আমরা এসে পড়েছি, আর তোর ভয় নেই শীলা!’
শীলা ভয়ে চোখ মুদে শুকনো গলায় বলল, ‘কিন্তু ওই মড়াগুলো? ওরা যে এখানে রয়েছে! ওরাই যে আমাকে ধরে এনেছে! ওরা যে রোজ আমাকে ভয় দেখায়!’
শীলাকে নিজের আরও কাছে টেনে এনে তার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে অমিয় বলল, ‘ওরা আর কারুকে ভয় দেখাতে পারবে না! ওদের আবার আমরা মাটির তলায় পুঁতে ফেলব৷’
নবাব গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তোমাদের সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে তো? এখন এখান থেকে বেরিয়ে যাও দেখি! আমাকে মরতে দাও৷’
মহম্মদ বললেন, ‘তা হয় না! তুমি মরবে কি না কে জানে?’
নবাব টলে পড়ে যাচ্ছিল৷ তাড়াতাড়ি দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমার মৃত্যু নিশ্চিত৷ তোমরা নির্ভয়ে যেতে পারো৷’
মহম্মদ মাথা নেড়ে বললেন, ‘চোখের সামনে তোমার মৃত্যু না দেখে আমরা এখান থেকে এক পাও নড়তে পারব না৷’
নবাবের ঝিমিয়ে-আসা চোখে আবার বিদ্যুৎ খেলে গেল৷ অস্পষ্ট জড়ানো স্বরে সে গর্জন করে বলল, ‘কী, আমাকে একলা মরতে দেবে না? বটে!’ হঠাৎ সে সিধে হয়ে উঠল, এবং তার দুই চোখ বন্ধ হয়ে গেল৷
মানিক সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল, ‘ও মরল নাকি?’
জয়ন্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নবাবের মুখের পানে চেয়ে রইল৷
আচম্বিতে সুন্দরবাবু মেঝের উপর প্রচণ্ড এক ঝাঁপ খেয়ে আছড়ে পড়লেন এবং বেগে গড়াতে গড়াতে নবাবের খাটের তলায় ঢুকে পড়ে ক্রমাগত বলতে লাগলেন, ‘হুম হুম হুম হুম!’
ওদিকে ঘরের ভিতরে আরম্ভ হয়েছে চিৎকার ও আর্তনাদের সঙ্গে বিষম হুটোপাটি ও ছুটোছুটি৷ চৌকিদাররা দল বেঁধে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে গেল অন্য তিনটি মেয়ে-কেবল শীলা তার দাদার দুই বাহুর উপরে এলিয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ল৷
সেই ছয়টা মৃতদেহ টলতে টলতে মেঝের উপরে উঠে বসেছে-তাদের প্রত্যেকেরই ভাবহীন চক্ষু একেবারে বিস্ফারিত৷
মহম্মদ পিছনে হটে দেওয়ালের উপরে পিঠ রেখে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন৷
মানিক উপরি-উপরি রিভলভার ছুড়ল, কোনো কোনো দেহে গুলি ঢুকে বীভৎস ছিদ্রের সৃষ্টি করল, কিন্তু আশ্চর্য এই যে, একফোঁটাও রক্ত বেরোল না, কিংবা মূর্তিগুলোর মুখেচোখে যন্ত্রণার আভাসটুকুও ফুটে উঠল না৷ কী ভয়ানক! সে অসম্ভব, অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখলেও বুকের রক্ত জমে বরফ হয়ে যায়!
জয়ন্তর হঠাৎ তখন খেয়াল হল, নবাব নিশ্চয় মরবার আগে শেষবার মড়া জাগাবার জন্যে ধ্যানাসনে বসেছে৷ সে এক লাফে বিছানার উপর গিয়ে পড়ে নবাবকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল৷ নবাব তীব্র কন্ঠে ‘আঃ বলে শয্যায় এলিয়ে পড়ল৷
ওদিকে সেই মুহূর্তেই ছয়টা মূর্তিই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আবার অবশ হয়ে প্রথমে বসে- তারপর মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল৷ আবার তারা যে মড়া সেই মড়া৷
জয়ন্ত হেঁট হয়ে নবাবের বুকে হাত দিল৷ তার বুক স্থির৷ তার নাকে হাত দিল৷ নিশ্বাস পড়ছে না৷
মানিক খাটের তলা থেকে সুন্দরবাবুর দেহ টেনে বার করল৷ তিনি তখন আর ‘হুম’ বলছেন না৷ অজ্ঞান৷