মানুষ, না পিশাচ?

মানুষ, না পিশাচ?

(ঈশানের গল্প)

আমাদের বাড়ি যে গ্রামে, তার ক্রোশ দুয়েক তফাতেই গঙ্গা। কাজেই গাঁয়ে কোনো লোক মারা গেলে, গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়েই মড়া পোড়ানো হত। সেবারে ভোলার ঠাকুরমা যখন মারা পড়ল— তখন আমরা পাড়ার জন পাঁচেক লোক মিলে মড়া নিয়ে শ্মশানে চললুম। শ্মশানে পৌঁছোতে বেজে গেল রাত বারোটা।

পাড়াগাঁয়ের শ্মশান যে কেমন ঠাঁই, শহরের বাসিন্দারা তা বুঝতে পারবে না। এখানে গ্যাসের আলোও নেই, লোকজন, গোলমালও নেই। অনেক গাঁয়েই শ্মশানে কোনো ঘরও থাকে না। খোলা, নির্জন জায়গা, চারিদিকে বনজঙ্গল, প্রতিপদেই হয়তো মড়ার মাথা আর হাড় মাড়িয়ে চলতে হয়। রাতে সেখানে গেলে খুব সাহসীরও বুক রীতিমতো দমে যায়।

আমাদের গাঁয়ে শ্মশানঘাটে একখানা হেলে-পড়া দরজা-ভাঙা কোঠাঘর ছিল। তার মধ্যেই গিয়ে আমরা মড়া নামিয়ে রাখলুম।

পাড়াগাঁয়ের শ্মশানে চিতার জ্বালানি কাঠ তো কিনতে পাওয়া যায় না, কাজেই তার আশেপাশের বনজঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনতে হয়।

ভোলা বললে, ‘আমি মড়া আগলে থাকি, তোমরা সকলে কাঠ আনো গে যাও।’

আমি বললুম, ‘একলা থাকতে পারবে তো?’

ভোলা যেমন ডানপিটে, তার গায়েও জোর ছিল তেমনি বেশি। সে অবহেলার হাসি হেসে বললে, ‘ভয় আবার কী? যাও, যাও— দেরি করো না।’

আমরা পাঁচ জনে জঙ্গলে ঢুকে কাঠ কাটতে লাগলুম। একটা চিতা জ্বালাবার মতো কাঠ সে তো বড়ো অল্প কথা নয়। কাঠ কাটতেই কেটে গেল প্রায় আড়াই ঘণ্টা; বুঝলুম, আজ ঘুমের দফায় ইতি, মড়া পোড়াতেই ডেকে উঠবে ভোরের পাখি।

সকলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শ্মশানের দিকে যাচ্ছি, এমন সময়ে আমাদের একজন বলে উঠল, ‘ওহে দ্যাখ, দ্যাখ শ্মশানের ঘরের মধ্যে কীরকম আগুন জ্বলছে!’

তাই তো, ঘরের ভিতরে সত্যিই দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে যে! অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললুম। ঘরের কাছ বরাবর আসতেই লন্ঠনের আলোতে দেখলুম, মাটির ওপরে কে একজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। লোকটাকে উলটে ধরে লন্ঠনটা তার মুখের কাছে নামিয়ে দেখলুম, সে আর কেউ নয়— আমাদেরই ভোলা। তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে, সে একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ভোলা এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আর ওখানে ঘরের ভিতরে আগুন জ্বলছে— এ কেমন ব্যাপার! সকলে হতভম্ব হয়ে ঘরের দিকটায় ছুটে গেলুম। কাছে গিয়ে দেখি, ঘরের দরজার কাছটায় কে তাল তাল মাটি এনে ঢিপির মতো উঁচু করে তুলেছে, আরও খানিকটা উঁচু হলেই দরজার পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যেত! এসব কি কাণ্ড কিছুই বুঝতে না পেরে আমরা ঘরের ভিতর উঁকি মেরে দেখলুম, এককোণে একরাশ কাঠ দাউদাউ করে জ্বলছে, একটা কাঁচা মাংস পোড়ার বিশ্রী গন্ধ উঠছে, আর কোথাও মড়ার কোনো চিহ্নই নেই!

ভয়, বিস্ময় আর দুশ্চিন্তিায় আচ্ছন্ন হয়ে আমরা আবার ভোলার কাছে ফিরে এলুম। তার মুখে ও মাথায় অনেকক্ষণ ধরে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দেওয়ার পর আস্তে আস্তে সে চোখ চাইলে। তারপর উঠে বসে যা বললে, তা হচ্ছে এই

‘তোমরা তো কাঠ কাটতে চলে গেলে, আমি মড়া আগলে বসে রইলুম। খানিকক্ষণ এমনি চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে আমার কেমন তন্দ্রা এল। চোখ বুজে ঢুলচি, হঠাৎ থপ করে কী একটা শব্দ হল। চমকে জেগে উঠে চারদিকে চেয়ে দেখলুম, কিন্তু কেউ কোথাও নেই। আমারই মনের ভ্রম ভেবে খাটের পায়াতে মাথা রেখে আবার আমি ঘুমোবার চেষ্টা করলুম। …খানিকক্ষণ পরে আবার সেই থপ করে শব্দ। এবার আমার সন্দেহ হল হয়তো মড়ার লোভে বাইরে শেয়াল-টেয়াল কিছু এসেছে। এই ভেবে আর চোখ খুললুম না— এমনিভাবে আরও খানিকটা সময় কেটে গেল। ওদিকে সেই ব্যাপারটা সমানেই চলেছে— মাঝে মাঝে সব স্তব্ধ আর মাঝে মাঝে থপ করে শব্দ। শেষটা জ্বালাতন হয়ে আমি আবার চোখ চাইতে বাধ্য হলুম। কিন্তু একী! ঘরের দরজার সামনেটা যে মাটিতে প্রায় ভরতি হয়ে উঠেছে, আর একটু পরেই আমার বাইরে যাওয়ার পথও যে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে! কে এ কাজ করলে, এ তো যে-সে কথা নয়! আমার ঘুমের ঘোর চট করে কেটে গেল, সেই কাঁচা মাটির পাঁচিল টপকে তখনই আমি বাইরে বেরিয়ে পড়লুম।

চাঁদের আলোয় চারিদিক ধবধব করছে। ঘর আর গঙ্গার মাঝখানে চড়া। এদিক-ওদিক চাইতেই দেখলুম খানিক তফাতে একটা ঝাঁকড়া চুলো লোক হেঁট হয়ে একমনে দুই হাতে ভিজে মাটি খুঁড়ছে। বুঝলুম তারই এই কাজ। কিন্তু এতে তার লাভ কী? লোকটা পাগল নয় তো?

ভাবছি, এদিকে সে আবার একতাল মাটি নিয়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হল। মস্ত লম্বা চেহারা, মস্ত লম্বা চুল আর দাড়ি, একরকম উলঙ্গ বললেই হয়— পরনে খালি একটুকরো কপিন। সে মাথা নীচু করে আসছিল, তাই আমাকে দেখতে পেলে না। কিন্তু সে কাছে আসামাত্র আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম।

সে তখন মুখ তুলে আমার দিকে চাইলে —উঃ, কী ভয়ানক তার চোখ, ঠিক যেন দু-খানা বড়ো বড়ো কয়লা দপ দপ করে জ্বলছে! এমন জ্বলন্ত চোখ আমি জীবনে কখনো দেখিনি।’

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কে তুমি?’

উত্তরে মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে নেড়ে সে এমন এক ভূতুড়ে চিৎকার করে উঠল যে, আমার বুকের রক্ত যেন বরফ হয়ে গেল। মহা আতঙ্কে প্রাণপণে আমি দৌড় দিলুম, কিন্তু বেশিদূর যেতে-না-যেতেই অজ্ঞান হয়ে পড়লুম। তারপর আর কিছু আমার মনে নেই।

ভোলার কথা শুনে বুঝলুম, সে লোকটা পিশাচ ছাড়া আর কিছু নয়। দুষ্ট প্রেতাত্মারা সুবিধা পেলেই মানুষের মৃতদেহের ভিতরে ঢুকে তাকে জ্যান্ত করে তোলে। মরা মানুষ এইভাবে জ্যান্ত হলেই তাকে পিশাচ বলে। এইরকম কোনো পিশাচই ভোলার ঠাকুরমার দেহকে আগুন জ্বেলে আধপোড়া করে খেয়ে গেছে। ভোলাকেও নিশ্চয় সে ফলার করবার ফিকিরে ছিল, কেবল আমরা ঠিক সময়ে এসে পড়াতেই এ-যাত্রা ভোলা বেঁচে গেল কোনো গতিকে।

সেবারে আমাদের মড়া পোড়াতে হল না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *