মানুষ জীবনানন্দ – ৬

কবি ছিলেন ছাত্র-দরদী। ছাত্ররাও তাকে অন্তরের সঙ্গেই শ্রদ্ধা করত। সামান্য সামান্য ব্যাপারেও আমি তাঁর ছাত্র-প্রীতি লক্ষ করেছি। 

আমি যখন ব্রজমোহন কলেজে চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রী, কবি তখন সেই কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপকের পদে ছিলেন। সেবারে হোলি উৎসবে কয়েকজন ছাত্র তাঁকে আবির দিয়ে প্রণাম করতে এসেছিল। সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়েই তাঁকে আবির দিয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন আমার ঘরে ঢুকে বলল, ‘আপনাকে রং দেব।’ 

আবির জিনিসটা আমি একেবারেই পছন্দ করি না, সেজন্য সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘না।’ পাশের ঘরেই আমার শ্বশুরমশাই শুয়েছিলেন। তিনি ছেলেটিকে বিনা অনুমতিতে ঘরে ঢোকার জন্য কঠোর ভাবেই তিরস্কার করলেন। ফলে, সে রং না দিয়েই চলে যেতে বাধ্য হ’ল। পরে অবিশ্যি শুনেছিলাম যে অন্য ছেলেরাও তার এই ব্যবহারে খুবই বিরক্ত হয়েছিল। 

কবি কিন্তু একটি কথাও বলেন নি। ছেলেরা চলে যেতেই আমাকে বললেন, ‘হোলির সময় রং দেওয়াটা আমাদের দেশে একটা রীতি! এইদিনে ছাত্ররা অধ্যাপকদের বাড়িতে গিয়ে আবির দিয়ে সস্ত্রীক তাঁদের শ্রদ্ধা জানায়। তোমাকে ঠিক সেইভাবেই দিতে এসেছিল। স্নান করলেই তো রং উঠে যেত। তুমি এত বিরক্ত হলে কেন?’ 

তিনি আমাকে তিরস্কার করলেন না ঠিকই, কিন্তু ছাত্রের অপমানে তিনি যে ব্যথিত হয়েছেন, সেটা খুব ভালভাবেই বুঝিয়ে দিলেন। 

তিনি ‘দাসগুপ্ত’ না লিখে শুধু ‘দাশ’ লেখাতে তফসিলী সম্প্রদায়ের বহু ছাত্র এসে তাঁকে বলত, ‘স্যার, আমাদের সমাজে আপনার মত এইরকম একজন প্রতিভাশালী লেখক ও সহৃদয় অধ্যাপক পেয়ে আমাদের সম্প্রদায়ের প্রতিটি নরনারী ধন্য হয়ে গিয়েছে।’ 

কবি কোনও উত্তর না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসতেন। আমি রাগ করলে বলতেন, ‘দেখ, আমাকে সমগোত্রীয় ভেবে কেউ যদি ভুল করেও মনে আনন্দ পায়, তবে সে ভুল ভাঙ্গবার দরকার কি? কারো জন্যে কিছুই তো করতে পারি না। তারা নিজে থেকে যদি একটু আনন্দ পায় তো পাক না।’ 

১৯৪৬ সনের শেষদিকে তিনি স্বরাজ পত্রিকায় ছিলেন। সেই সময়কার একটি ঘটনা বলছি। 

একদিন দুপুরের দিকে তিনি ক্রীক রো দিয়ে ফিরছেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন রাস্তার লোকেরা দৌড়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, এবং প্রতিটি বাড়ির জানালা দরজা দুমদাম শব্দে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন-একটা মিলিটারী ট্রাক ছুটে আসছে। ট্রাকটা এসে তাঁর সামনেই থেমে পড়ল। একজন অফিসার নীচে নেমে বন্দুকের নলটা কবির বুকের সামনে ধরেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর য়্যু এ হিন্দু?’ 

কবি উত্তর দিলেন, ‘ইয়েস।’ 

অফিসারটি বন্দুক ধরে থাকা অবস্থাতেই বললেন, ‘আই থিংক য়্যু আর দ্য রিংলীডার অফ দিস এরিয়া। যাস্ট গেট অন্।’ 

কবি চিরদিনই ধীর স্থির প্রকৃতির সুতরাং তিনি আর একটি কথাও না বলে ট্রাকে উঠে দেখলেন তাঁর মত আরও কয়েকজন হিন্দু ভদ্রলোককে আগেই ধরে আনা হয়েছে। তাঁরাও চুপচাপ বসে আছেন। কবিকে উঠিয়ে নিয়ে ট্রাকটি বহু জায়গা ঘুরে একটি থানায় এসে থামল। সেখানে পৌঁছে একখানি বেঞ্চে সকলকে বসিয়ে রাখা হল। 

‘কতক্ষণ এখানে বসে থাকতে হবে’ একজন ভদ্রলোক একথা জিজ্ঞাসা করাতে কয়েকজন কনস্টেবল অভদ্র ভাষায় উত্তর দিল, ‘যতক্ষণ ও-সি না আসেন, চুপ করে বসে থাক।’ 

সন্ধ্যের দিকে হঠাৎ সমস্ত পুলিস শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল এবং অন্যান্য সকলকেও উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করল। কবি তাকিয়ে দেখলেন একটি অল্পবয়সী মুসলমান ছেলে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। ছেলেটি যতই সামনের দিকে এগোচ্ছে ততই ঘন ঘন অবাক হয়ে কবির দিকে তাকাচ্ছে। যখন প্রায় কাছে এসে পড়েছে, তখন এক ছুটে এসে কবির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ‘এ কী! স্যার আপনি এখানে এ অবস্থায় কেন?’ 

কবি একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, ‘আমি তো তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না।’ তখন ছেলেটি দারুণ অভিমানভরে বলল, ‘আমি আপনার বি এম (বরিশাল) কলেজের ছাত্র, আর আপনি আমাকে চিনতেই পারলেন না?’ 

কবি তখন অপ্রস্তুত হয়ে সস্নেহে তার গায়ে হাত রেখে বললেন, ‘সত্যি আমার পক্ষে তো এটা অন্যায়ই। তা, তুমি এখন কি করছ?’ 

‘আমি এখানকার ও-সি।’ কবি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে লজ্জিত মুখে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আপনি এখানে কেন, সে কথার উত্তর তো আমি পেলাম না।’ 

কবি তখন অফিসার এবং কনস্টেবলদের সব কথাই বললেন। সমস্ত শুনে ছেলেটি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যে যেমন অবস্থায় আছ, বসে থাক। আমি এসে তোমাদের ব্যবস্থা করছি।’ তারপর কবির দিকে ফিরে বলল, ‘আসুন স্যার আমার সঙ্গে।’ এই কথা বলেই সযত্নে এবং সম্ভ্রমের সঙ্গে হাত ধরে তাঁকে নিয়ে চলল। নানা রাস্তা ঘুরে অবশেষে নিরাপদ স্থানে এসে তাঁকে ট্রামে তুলে দিয়ে আবার ভক্তিভরে প্রণাম করে বলল, ‘স্যার, আপনার অসম্মান করে ওরা যে আজ কতবড় অপরাধ করেছে-সেটা বুঝবার মত শক্তি হয়তো ওদের কোনদিনই হবে না। কিন্তু আমি আজ ওদের সকলের হয়ে বারবার আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। সব দোষ ত্রুটি আমার জন্যই হয়েছে ধরে নিয়েই আপনি আমাকে ক্ষমা করতে চেষ্টা করবেন।’ 

যদি তার আবার কোনও বিপদ ঘটে সেজন্য কবি তাকে ট্রামের সামনে আসতে বারবার বারণ করেছিলেন। কিন্তু সে হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিল, ‘আপনার আশীর্বাদে কোন বিপদই আমার ধারে কাছে আসতে পারবে না। কিন্তু আজ যদি আপনি ঠিকভাবে বাড়ি পৌঁছতে না পারেন তাহলে নিজেকে আমি কোনদিনই ক্ষমা করতে পারব না।’ 

রাত্রে কবি যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল তাঁর মনটা যেন সেই ছেলেটির কাছেই চলে গিয়েছে। ছাত্রের এই মহানুভবতার কথা কবি কোনদিনই ভোলেননি–ভুলতে পারেননি। সে রাতে তিনি নীরবে যে তার সুখ, শান্তি এবং দীর্ঘজীবন কামনা করে বারবার তাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছিলেন, সেটা শুধু বুঝেছিলাম আমি। 

তাঁর এক লাইন কবিতা পাবার আশায় আমাদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে প্রতিদিন দলে দলে ছাত্রছাত্রীকে আসতে দেখেছি। সকলে কিন্তু হাসিমুখেই ফিরে যেত। কিছু বললেই উত্তর দিতেন, ‘এরাই তো আমাদের ভবিষ্যতের আশা ভরসা। এদের ভিতর দিয়েই তো আমি বেঁচে থাকব। এদের কি ফেরাতে পারি?’ 

এই আন্তরিকতা এবং স্নেহের বিনিময়ে ছাত্র এবং ছাত্রসম অন্যান্য কিশোর এবং যুবকদের অন্তরতম প্রদেশে তাঁর আসন দৃঢ়ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

একবার কোনও এক জায়গায় কবির স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির কথা ছিল। তাঁর সেদিন শরীরটা খুবই খারাপ ছিল। তিনি সজনীবাবুকে (সজনীকান্ত দাস) অনুরোধ জানালেন যে তাঁকে যেন আবৃত্তির কাজটা প্রথম দিকেই সেরে নিতে দেওয়া হয়। সজনীবাবু চটে গিয়ে বললেন, ‘আপনি তো বেশ লোক মশাই। আপনাকে প্রথমদিকে আবৃত্তি করতে দিয়ে শেষে আমি চেয়ার বেঞ্চ নিয়ে বসে থাকি।’ শেষে হাসতে হাসতে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না জীবনানন্দ বাবু, আমি জানি যে আপনার কবিতা শোনার পরে ছাত্রদলকে কিছুতেই আর আটকে রাখা যাবে না। সুতরাং আপনাকে আজ একটু কষ্ট করতেই হবে।’ 

আহত অবস্থায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শয্যা নেবার পরে দেখেছি তাঁর সেবা করবার জন্য তরুণ বয়সী ছেলেদের সে কি আগ্রহ। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার হোস্টেলেও থাকতেন। কিন্তু সেখানকার নিয়মকানুন, উপরওয়ালাদের রক্তচক্ষু, পাঁচিলের উচ্চতা-কোন কিছুই তাদের আটকাতে পারেনি। তারা ঠিক সময়েই ছুটতে ছুটতে কবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। 

আজ তাঁর আত্মা যেখানেই থাকুন না কেন, এই সব ছেলেদের আশীর্বাদ তিনি করছেন বৈকি, নিশ্চয়ই করছেন। 

তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং তাঁর সান্নিধ্যে এসে সকলে কতটা আনন্দ পেতেন তাঁর প্রমাণও যথেষ্ট পেয়েছি। তাঁর সেবারতা সিস্টার শান্তিদেবীর কথা আমার আজও মনে আছে- এবং চিরদিনই থাকবে। জীবিকার্জনের জন্য টাকা তাঁকে নিতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেবার মধ্যে যে দরদ, যে আন্তরিকতা আমি দেখেছি, তা শুধু টাকার বিনিময়ে কোনদিনই পাওয়া যায় না। কত সময় তিনি আমাকে বলেছেন, ‘বউদি, এই রকম দাদার সেবা করার সৌভাগ্য যে আমার কখনও হবে, সে কথা আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি।’ কবির মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার পরে শান্তিদেবীও চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। অন্তরের অনেকখানি টান থাকলে তবেই এ কাজ সম্ভবপর হয়। 

কবির বাল্য ও কৈশোরের স্মৃতিঘেরা বরিশাল। সেখানে দেখেছেন তিনি হিন্দু-মুসলমানের অপূর্ব ভ্রাতৃরূপ। দুঃখে, বিপদে, একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে-স্নেহ, ভালবাসায় হয়ে উঠেছে অতি আপনজন। এমনিই ছিলো তাদের একাত্মবোধ। 

কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পূর্ব মুহূর্তে একই মায়ের কোলে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি, তাদের সে রক্তের হোলিখেলা, বেদনায় মূক করে তুলেছিল কবি-চিত্তকে বিকল করেছিল তাঁর প্রাণ। অন্তরের সে ব্যথা-সে বেদনাকে মুখে প্রকাশ করার ভাষা তিনি খুঁজে পাননি। তাই লেখনীর বাহুডোরে বেঁধে রেখে গেলেন ভাবীকালের সন্তানদের পথ দেখাবার জন্যে- 

প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল 
ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে
দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
হ’য়ে আছে… 
মানুষ খেয়েছি আমি-তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহতভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজ-প্রতিম বিমূঢ়কে 
বধ ক’রে ঘুমাতেছি-তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে
মুখ রেখে… 
ঘুমাতেছে 
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে। ‘ইয়াসিন আমি, 
হানিফ-মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ–
আর তুমি? আমার বুকের ‘পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে 
চোখ তুলে শুধাবে সে-রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে 
ব’লে যাবে, গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার; 
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালীর 
কোথাকার কেবা জানে;… 
অখণ্ড অনন্তে অন্তর্হিত হ’য়ে গেছে :
কেউ নেই, কিছু নেই–সূর্য নিভে গেছে। 

ভগবানের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলে-এখানকার শোভা সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখবার জন্য, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্যই সে পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু সব কিছুই তার কাছে ব্যর্থ বলে মনে হয় কেন? জীবনকে বোঝা মনে করে তাকে দূরে ফেলে দেবার জন্য কেন সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে? 

এই সব চিন্তা কবি-মনে উদিত হয়েছে লাসকাটা ঘর দেখে। বরিশালের অযত্নে, অবহেলায় পড়ে থাকা লাসকাটা ঘর। মানুষের অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে সে কেন লজ্জানত শিরে নীরবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়ার বুক ভরা ভালবাসার, শিশুর অনিন্দ্যসুন্দর হাসি, খ্যাতি, মান, প্রতিপত্তি-জীবনের পরিতৃপ্তি, সব কিছুই হেলায় ঠেলে ফেলে দিয়ে এ হেন ঘরে গিয়ে যে মানুষ তার বুকের জ্বালা জুড়াতে চায়, দূর করতে চায় তার অবসাদ-অপরিসীম ক্লান্তি-কি তার ব্যথা! কোন্ সে মর্মন্তুদ দুঃখ! 

শোনা গেল লাসকাটা ঘরে! 
নিয়ে গেছে তারে; 
কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে 
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ 
মরিবার হ’লো তার সাধ; 
বধূ শুয়েছিলো পাশে-শিশুটিও ছিলো : 
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো-জ্যোস্নায়-তবু সে দেখিল 
কোন্ ভূত? ঘুম ভেঙে গেল তার? 
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল-লাসকাটা ঘরে 
শুয়ে ঘুমায় এবার 
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি? 
কোনদিন জানিবে না আর 
জানিবার গাঢ় বেদনার 
অবিরাম অবিরাম ভার 
সহিবে না আর- 
জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রাণ 
হেমন্তের বিকেলের 
তোমার অসহ্য বোধ হলো : 
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো 
মর্গে-গুমোটে 
থ্যাঁতা ইদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে। 

কিন্তু নারীর প্রেম, শিশুর ভালবাসা, কীর্তি, সম্পদই কি আমাদের জীবনকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দেয়? না-তাহলে? তাহলে কোন্ সে বিস্ময়কর অনুভূতি যা আমাদের রক্তে, মাংসে, অস্থিতে, মজ্জায় মিশে থেকে আমাদের দিশেহারা করে তোলে। 

জানি-তবু জানি 
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়- 
আরো এক বিপন্ন বিস্ময় 
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে 
খেলা করে ; 
আমাদের ক্লান্ত করে 
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে ; 
লাসকাটা ঘরে। 
সেই ক্লান্তি নাই : 
তাই 
লাসকাটা ঘরে 
চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।… 

কিন্তু শেষে হয়ত কবি উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। 

আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে 
যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।… 

শ্রদ্ধেয় বুদ্ধদেব বসুর কথায় মৃত্যু পার হয়ে বেজে উঠল জীবনের জয়ধ্বনি। 

কবি ছিলের প্রকৃতির পূজারী। উদার নীল আকাশ, কাশের বন, হিজলের, নারকেলের সবুজ পাতা তাঁকে হাত ইশারায় ডাক দিত। সূর্যের প্রথম আলোকরেখাটি যখন আকাশের বুকে সোনালি রং এঁকে দিত অথবা তাঁর অতি আদরের অজস্র ফুলে ভরা গন্ধরাজ ফুলের গাছটিকে রং-এ ভরিয়ে তুলত, কবি তখন বাগানে একখানি ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় সেই সৌন্দর্যনেশায় বিভোর হয়ে থাকতেন। কখনও বা সুদূর দিগন্তের পানে অবাক দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে উচ্চারণ ক’রতেন- 

রৌদ্র-ঝিলমিল 
ঊষার আকাশ, 
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে। 

এই সৌন্দর্যের অনুভূতিই নানাভাবে নানা ছন্দে রূপ নিয়েছে তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। এই অনুভূতির পথ ধরে চলতে চলতেই চিনতে পেরেছিলেন তিনি শ্যামলা, কোমলা, অপরূপা বাংলা মায়ের নিজস্ব রূপটিকে। তাই তো তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠল— 

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, 
তাই আমি পৃথিবীর রূপ 
খুঁজিতে যাই না আর : 
অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছ 
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে ব’সে আছে 
ভোরের দয়েল পাখি- 
চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ 
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ :
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে। 

সন্ধ্যেবেলা স্টিমার, লঞ্চ এমন কি নৌকার ক্ষুদ্র আলোক শিখাটিও যখন ঢেউয়ের গতিছন্দের সঙ্গে তাল রেখে ছোট্ট নদীটির বুকে শিহরণ জাগাত, তখন সেই লহরীর নৃত্য দেখতে দেখতে তিনি তন্ময় হয়ে যেতেন। কচি নরম ঘাসের পরে বসে, তারার মেঘলা পরা রাত্রির শান্ত, উদার আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি স্তব্ধ ধ্যানে মুহূর্তের পর মুহূর্ত কাটিয়েছেন। 

আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
বসে থাকি, কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মত
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান্ত অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে,
আমার চোখের ’পরে আমার মুখের ’পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোন পথ এ কন্যারে দেখেনিকো–দেখি নাই অত
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে
পৃথিবীর কোন পথে… 

বাংলা মায়ের যে কয়জন সন্তান বিশ্বের দরবারে মায়ের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন, কবি জীবনানন্দ তাঁদের অন্যতম, যশোলক্ষ্মী যখন জয়গৌরবের মালা হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন-ঠিক সেই সময়েই হেমন্তের কবি হেমন্তেরই এক কুয়াশা ঢাকা রাতে চিরদিনের মতই হারিয়ে গেলেন-হারিয়ে গেলেন রহস্যময় রাজপুরীর সোপানাবলী ধরে কোন এক অন্ধকার গুহাকক্ষে। রং-এ, রসে, স্বপ্নে ভরা এই পৃথিবী চোখে তার মায়ার কাজল। কিন্তু মহাকালের ডাক যখন আসে, তখন ধরিত্রী মায়ের বুক খালি করে নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে আমাদের পড়তেই হবে। আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালবাসা সব কিছুই মায়াবী মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়ে সমস্ত চিন্তা ভাবনার পরিসমাপ্তির রেখা টানতেই হয়। 

আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে, 
চাই আর? জানি না কি আহা, 
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো 
এসে জাগে 
ধুসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে 
স্বপ্ন ছিলো–সোনা ছিল যাহা 
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর 
প্রয়োজনে লাগে। … 

কিন্তু মাটি-মা? মাটি-মা তো সেকথা শুনতে চায় না-বুঝতেও চায় না। সন্তানকে স্নেহডোরে বেঁধে রাখার জন্য তার সে কি আকুল প্ৰচেষ্টা। অজানাকে জানবার, অচেনাকে চিনবার উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে সেটুকু মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন কবি- 

আমার এ শিরা-উপশিরা 
চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন, 
শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন-
মোর তরে পিছু ডাক মাটি-মা-তোমায়;
ডেকেছিলো ভিজে ঘাস-হেমন্তের 
হিম মাস-জোনাকির ঝড়, 
আমারে ডাকিয়াছিলো আলেয়ার লাল মাঠ… 
******************** 
নয়ন মুদিনু ধীরে-শেষ আলো নিভে গেল 
পলাতকা নীলিমার পারে, 
সদ্য-প্রসূতির মাতা অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।… 

কিন্তু বাংলার কবি-বাংলার মাটি, জল, বাংলার স্নেহনীড় ছেড়ে বেশীদিন দূরে থাকতে পারবেন না। পারবেন না তিনি হিজলের, অশ্বত্থের সবুজ আভা ছড়ান বন, বেলকুঁড়ি ছাওয়া পথ, স্নিগ্ধ মলয়-হিল্লোলিত কাশের বন, আর কোকিলের কুহুতান ছেড়ে দূরে থাকতে। তাই তো তিনি সকলকে বার বার আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন- 

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এই কাঁঠাল-ছায়ায়; 
********************* 
হয়তো বা হাঁস হবো-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে 
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়; 
********************* 
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলাজলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়;-রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকার আসিতেছে 
নীড়ে 
দেখিবে ধবল বক : আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে— 

সমাপ্ত 

1 Comment
Collapse Comments

অসম্ভব সুন্দর। সুখকর। এক বসাতেই পড়ে শেষ করলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *