মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে
শীত এখনাে পড়েনি। ভাের রাতে চাদর লাগে বিছানায়। পাখার রেগুলেটর নেই। না চালালে গরম লাগে। চালালে শীত করে। তাই অখিল একবার উঠে চালায়। চালিয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমােয়। শীত করলে উঠে নিভিয়ে দেয়। দিয়ে আবার ঘণ্টাখানেক ঘুমােয়। এইভাবে রাত এগারােটা থেকে পরদিনের ভাের সাতটায় পৌছে তবে উঠে বসে সকালের বেড টি খেল।
বেড টি দিল তার সাতান্ন বছরের বউ। খুকু। অখিলের চেয়ে তিন বছরের ছােটো। দুই ছেলের মা। ছেলেরা চাকরি নিয়ে দূরে দূরে। সেখানে যে-যার সংসার, অফিস, অফিসের বন্ধু, বন্ধুদের সঙ্গে ফ্যামিলি নিয়ে পিকনিক নয়তাে এল টি সি নিয়ে বেড়াতে যেতে মেতে থাকে। তবে দুজনই বিজয়ার পর পােস্টকার্ড দেয়। শ্রীচরণকমলেষু মা ও বাবা। আশা করি তােমরা ভালাে আছ। তােমরা আমাদের ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করিয়াে। পূজায় পাঠানাে টাকা দিয়া তােমরা গায়ে দেবার চাদর কিনিয়াছ তাে? এখন আর জমাইয়া কী করিবে?
এই দুই ছেলেকে নিয়ে অখিল আর খুকু তাদের জীবনের চব্বিশ-পঁচিশ বছর খুব ব্যস্ত ছিল। দাঁত ওঠা, দুধের দাঁত পড়া, হাতেখড়ি, হাতের লেখা লেখানাে, স্কুলে ভর্তি, টনসিল, হুপিং কাফ, অ্যানুয়াল এগজামিন, কলেজ, ইন্টারভিউ, প্রথম চাকরিতে জয়েন, বিয়ে, বাচ্চা হলে তাদের খানিক খানিক বড়াে করে দেওয়া—এইসব করতে করতেই অখিলের মাথার চুল পিছিয়ে গেল। খুকুর এলােখোঁপায় এখন অনেকটাই সাদার প্যাচ। ঠিক যেন নদীর কালচে-সাদা ঘূর্ণি ঢেউ।
বেড টি খেয়ে অখিল বিছানাটার দিকে তাকাল। একটা পাশবালিশের ওপাশেই সারা রাত খুকু শুয়ে ছিল। কোনাে দাগ নেই বিছানায়। কালীপুজোর পরেকার রােদ। বেশ চকচকে। সে আলােয় খুকুর মুখখানিও ঝকমক করছে। খুব গম্ভীর হয়ে খাবার টেবিলে চা নিয়ে বসেছে। এইসময় ওর মুখখানি দেখে অখিলের মনে হল–নিশ্চয় মনে মনে হিসেব কষে দেখছে—জীবনে কী হল ?
কিংবা নিজের জীবনটাই খুকু এখন বাতাসের ভেতর দেখতে পায়। দেখে মনে মনে হয়তাে বলে—জীবনে কিছুই তাে হল না। কত কী করার ছিল। এইসব ভাবে খুকু আর এক সিপ করে চা খায়।
কাছেই বাজার। থলেটা হাতে নিয়ে গায়ে জামা গলিয়ে বলে, কী আনব? তােমার যা ইচ্ছে। কঁচালঙ্কা আছে? হুঁ। পঞ্চাশ এনাে। আর এক প্যাকেট নুন। কালকের মাছ আছে না? তিনটে পারশে আছে। গরম করে দেখি ঠিক আছে কিনা।
অখিলের মনে পড়ল, দশ-বারাে বছর আগেও বাজার করে ফেরার সময় একটা জয়ের আনন্দে তার বুক ভরে থাকত। বড়াে খােকনের জন্যে কাটা পােনা। ছােটোজনের জন্যে অসময়ের দামি ফুলকপি, খুকুর জন্যে নতুন ওঠা জলপাই—কত কী নিয়ে সে ফিরত। এখন সে জানে শরীরের ভেতর কঙ্কালটার কাঠামাের ওপর বেশি বেশি মাংসের চাপান রাখা ভালাে নয়। তাতে বুকের ভেতর বাঁদিকের ছােট্ট পাম্পসেটের ওপর চাপ পড়ে। সেই কবে থেকে পাম্প করে আসছে সেটটা। একদম জিরােয়নি। তা ছাড়া যে ভাত রুটি নিয়ে এত চাষবাস, আন্দোলন, ইকনমিকস–সেই ভাত-রুটিই এই শরীরটাকে অযথা ঢ্যাপঢেপে করে তােলে। মাছ মাংসে যতই শক্তি থাক না কেন—সমান ঘাম ঝরানাে খাটুনি না খাটলে—তাই-ই নাকি মুখে—-এখানে-সেখানে থপথপে মেদ লেপে দেয় শরীরে। তার চেয়ে হালকা সবজি দই শরীরটাকে হালকা-পলকা সতেজ রাখে।
তব বাজারে বেরােবার সময় অখিল জানতে চাইল, কোন মাছ আনব? যা-ই আনাে—কাটিয়ে আনবে। বঁটিতে ধার নেই। কেন? নেপালের মা কুটে দেবে— আজ আসবে না নেপালের মা। কোন মাছ বললে না তাে? না, মাংস আনি। মুরগির ? আমার কোনাে পছন্দ নেই।
এ কী রকম বউ রে বাবা!—মনে মনে একথা বলে অখিল এগােল। তার মনে হল, বিয়ের বত্রিশ বছর পরেও শ্বশুরবাড়ি, স্বামী, সংসার হয়তাে পছন্দ হয়নি খুকুর। কোনাে কোনােদিন অখিলের আগে ঘুম থেকে উঠে খুকু স্যান্ডেল পায়ে হাঁটতে বেরােয়। ফেরার সময় ঝরা শিউলি কুড়িয়ে এনে খাবার টেবিলে একটা প্লেটে রেখে তাতে সামান্য জল দেয়। পাছে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়।
এ পাড়ায় মাসখানেক হল এসেছে ওরা। জায়গাটায় ফোন, ইলেকট্রিক, ডাক্তারখানা থাকলেও গুচ্ছের পুকুর, সূর্যের অঢেল আলাে, মশা, অ্যাসশ্যাওড়ার জঙ্গল আছে। গ্রিল কারখানা ছাড়া আর কোনাে কারখানা নেই। বাতাস পরিষ্কার। ভােটের সুবিধার জন্যে কয়েকটা পিচ আর কয়েকটা খােয়ার রাস্তাসমেত জায়গাটাকে বছর পাঁচেক হল কলকাতা কর্পোরেশনে ঢােকানাে হয়েছে। অটোতে পাতাল রেল মিনিট পনেরাে মাত্র। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে
অখিল বলল, মাজার ব্যথাটা কমেছে?
অনেক কম। তাহলে তাে হােমিওপ্যাথিতে কাজ হয়েছে— বােলাে—মাথা ঝিমঝিম করে। ঘুম আসে না। আমারও ওষুধটা আনব। ফের বুকে সর্দি জমে ঘড়ঘড় করছে। আজ কি থাকবেন সরকারমশাই? । বেস্পতিবার দক্ষিণ বারাসাত না কোথায় দেশ—সেখানে ফ্যামিলি—চলে যান। শনিবার শনিবার সবজির ফাস্ট ট্রেনে ফিরে আসেন। পসার তাে ভালােই জমিয়ে ফেলেছেন।
খুকু বলল, ভাগ্যিস ওর কারখানা আজ ছ-বছর বন্ধ। শুনলাম চাকরি নট হওয়াতে সরকারমশাই হােমােপ্যাথির বই আর বাক্সো নিয়ে বসে যান!
আমাদেরও ভাগ্যি বল! কেন? কেন?
আগে আগে এমন সর্দি জমলে প্রায় পঞ্চাশ টাকার এক কোর্স অ্যান্টিবায়ােটিক খেতাম। এখন দেখছি তিন থেকে ছ-টাকার হােমােপ্যাথি করলে বুক বিলকুল পরিষ্কার।
ভালােই তাে! দু-মাস মাইনে পাও না। কবে পাবে—তাও জানাে না।
কীভাবে চলবে তাও জানি না। বাড়ি বদলে এখানে উঠে এলাম—আর অমনি অফিসে এই দশা। কবে যে নর্মাল হবে জানি না। ভাগ্যিস কিছু জমানাে ছিল। কিন্তু তাই বা কতদিন চলবে? বাড়িভাড়া আছে—ইলেকট্রিক বিল। নেপালের মায়ের মাইনে। কেরােসিন। কঁচা বাজার | সব অঙ্ক একসঙ্গে মনে মনে যােগ দিতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে উঠল অখিলের। বছর পাঁচেক আগে প্রথম যেদিন এভাবে মাথা ঘুরে ওঠে—তখন তখনই ডাক্তার দেখিয়ে ঘাড়ের ছবি তুলে জানা যায় অখিলের স্পনডােলেসিস হয়েছে। ওজন চাপিয়ে ঘাড়ে টানা দেওয়া থেকে বিশেষ বিশেষ ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করে সে ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ঝিমঝিম করে মাথা ঘুরে যাওয়া তাে কোনাে ব্যায়ামেই সারার নয়। একে বলে সংসার-চিন্তামণি! চাল চিনি নিয়ে চিন্তা করতে করতে তলিয়ে যাওয়া। তবে ভরসা এই—এখন খুকু বা অখিল—কেউই খুব একটা ভাত খায় না। চায়ে চিনিও নেয় আধ চামচেরও কম। কিন্তু ডাল ? চোদ্দোটাকা! পটল? দশটাকা! আলু ? তিনটাকা চল্লিশ। আড়াইশাে মাছ ? পনেরাে টাকা ! তেল? চৌত্রিশ টাকা !
অখিল বলল, কী যে হল অফিসটার বুঝি না। এত ভালাে অফিস ছিল।
তােমরা সবাই মিলে বুড়ােকে ধর।
চার পুরুষের কোম্পানি। বুড়াে তাে দ্বিতীয় পুরুষ। বয়স বলে নব্বই। আসলে একশাে পেরিয়ে গেছে। কিন্তু জ্ঞান টনটনে। ইউনিয়ন মামলা করে কোর্টে তুলেছিল বুড়ােকে। কাঠগড়ায় গিয়ে বুড়াে বলেছে—আমি কিছু জানি—
–বােঝাে খুকু! |
খুকু চটেমটে বলল, বাঃ! আব্দার? তুমি ম্যানেজিং ডিরেক্টর—এত বড়াে একশাে বছরের পুরনাে কোম্পানির তুমি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তুমি কিছু জানাে না বললেই ছেড়ে দেওয়া হবে? এতগুলাে লােকের মাইনে দাওনি। পি এফ, গ্র্যাচুইটি, এল আই সি-র টাকা তলে তলে সরিয়েছ—ব্যাঙ্ক থেকে সরিয়েছ।
মেশিনপত্তর বেচে দিয়েছে—ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে কাঠগড়ায় গিয়ে বুড়াে চেয়ার চাইল। বলল, ধর্মাবতার! আমার হাত-পা কঁপে। বসার জন্যে একটা চেয়ার পেতে পারি? জজ তাে ভয় পেলেন। এই বুঝি হার্টফেল করে বুড়াে। চেয়ার দিতে, বসেই বুড়াে বলল, বছর দশেক হল কিছুই মনে রাখতে পারি ধর্মাবতার। এই মাত্তর যা শুনলাম খানিকবাদে তাই ভুলে যাই। জজ তাড়াতাড়ি উঠে এসে বললেন, আপনি বাড়ি যান। বুড়াে চলে এল।
খুকু বেশ দেমাকি গলায় বলল, ওসব খােকাপনার কথা তােমাদের যেন বলে বুড়াে। অ্যাতাে তাে সম্পত্তি আছে। কে খাবে? মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে। এত জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর-বাগান—কতদিন আর উনি বাঁচবেন। সব বেচে ব্যাঙ্কের দায় শােধ দিলেই তাে তােমাদের অফিস ফের ভালাে করে চলে।
একটু আগে মাথাটা ঘুরছিল অখিলের। সেই ঘূর্ণির ভেতর খুকুর একটা কথা তিরের মতাে অখিলের মাথার ভেতরে গিয়ে বিধে গেল। মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে। সে খুকুকে বলল, জানাে রিটায়ারের পর ছাব্বিশজন মরে গেছেন। তাঁরা পি এফ পাননি। গ্র্যাচুইটি পাননি। অনেকে রিটায়ার করে এল আই সি-র টাকা পাচ্ছেন না।
কেন?
মাইনে থেকে কেটে নিয়ে সে-টাকা জমা দেয়নি। ব্যাঙ্কের লােন নিয়ে আসল, সুদ—কোনওটাই ফেরত দেয়নি। পাওনাদারদের টাকা দেয়নি। কয়েক লাখ টাকা ইলেকট্রিক আর টেলিফোনের বিল বাকি করে ফেলেছে।
গুণের আর ঘাট নেই কোনাে ! ইলেকট্রিক লাইন মাঝে মাঝে কেটে দেয়। তখন ?
তখন গিয়ে কয়েক হাজার টাকা জমা দিয়ে বলে—এই দিয়ে দিচ্ছি। তখন আবার অফিসে আলাে আসে।
খুকু রায় দিল। গম্ভীর গলায়। বুড়ােকে তােমরা সবাই গিয়ে বল—আপনি আর কতদিনই বা বাঁচবেন। আপনার বাবার প্রতিষ্ঠান আপনার হাতে বড়াে হয়েছে। আপনার হাতেই মরে যাবে—এই চান? তিন পুরুষের পাছার কাপড় তুলে টিকের আগুন ঘষে দিতে হয়!
কোম্পানির নতুন বিল্ডিংটা বানাল পেল্লায় দশতলা— সেটা ভাড়া দিলেও তাে তােমাদের মাস মাইনে হয়ে যায়।
তা দেবে না! ফিনিশ না করে ফেলে রেখেছে। লিফ্ট বসায়নি। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে দম বেরিয়ে যায়।
উঠেও তাে স্বস্তি নেই। ওপরে উঠে নিজের চেয়ারে বসে শুনতে হয়—মাইনে কবে হবে কেউ জানে না।
আমি ভাবি খুকু একটা লােকের কত টাকা লাগে ?
একটা বলছ কেন? বল তিনটে। বুড়াে, তার সত্তর বছরের ছেলে—আর বছর পঁয়তাল্লিশের নাতি—তিনজনের—
বুড়ােকে বাদ দাও। কলকাতার বাইরে বিশাল বাগানবাড়িতেই পাখির ডাক শুনে দিন কাটান। সেখানেই প্রাইভেট সেক্রেটারিকে সঙ্গে নিয়ে সকাল বিকেল নিয়ম করে মাইল দুই ঘুরে ঘুরে হাঁটেন। আতস কাচ দিয়ে চিঠিপত্তর দেখেন।
আর খাবার বলতে কঁচাকলার ঝােল আর মাগুর মাছ। তাহলে ছেলে আর নাতির অন্য গুণ আছে নিশ্চয়।
তা তাে আছেই। দুজনেরই আছে। কিন্তু সেজন্যে এত টাকা সরাতে হবে? সেজন্যে এত টাকা লাগে? ওসবে একজন পুরুষের কতই বা লাগতে পারে ?
খুকু অখিলকে শুধরে দিল। একজন নয় দুজন। দুজনেরটাই ধর। ছেলে আর নাতি—দুজনের ওসবে এত কোটি টাকা লাগে? না লাগতে পারে! এত তাে জাহাঙ্গির বাদশারও লাগত না। একজন দিল্লিতে বসে থাকেন। আরেকজন কলকাতায়—বােম্বেতে নানান ফ্ল্যাটে।
বুড়াের ছেলেই বা আর কতদিন বাঁচতে পারে। তারও সত্তর হল। কিংবা কিছু বেশি। দু-চার বছর হাতে রেখেছে হয়তাে। খুকু বলল, এই বয়সে কত আর সুখ আহ্লাদ করতে পারে একজন মানুষ। নিয়মে থেকে এখন অখিলের ব্লাডপ্রেসার, কোলেস্টেরল, ব্লাড-সুগার একদম কপিবুকের সুস্থ মানুষের মতােই বলা যায়। সে মনে মনে বলল, ইচ্ছে থাকলে অনেকদিন পারে। মুখে বলল, পয়সার তাে অভাব নেই—
খুকু খেপে উঠল। বলল, তােমাদের মাস মাইনে মেরে দেওয়া পয়সা তাে। তাই কোনাে অভাব নেই।
যে-পয়সাই হােক। বছর দুই আগে একবার অফিসে এসেছিল বুড়াের ছেলে। ব্যাঙ্কে এত কোটি দেনা—বাজার পাওনাদারে ভর্তি—আমাদের এত টাকা গায়েব—হাঁটছে যেন অমিতাভ বচ্চন। মাথায় তিনথাক অ্যালবার্ট। পরনে। চুড়িদার। ভাবখানা-অফিসে যেন সেট পড়েছে—শুটিং করতে এসেছেন।
তা হিরােকে তােমরা ঘিরে ধরলে না কেন?
তখনাে তাে পিকচারটা এত ঘােলাটে হয়ে পড়েনি। তখনাে তাে আমাদের দিচ্ছি, দেব বলে চলেছেন। কী চেহারা–বছর তিরিশেকের ছােকরার চলাফেরা। আর লম্বাও তাে অনেকটা। বেশ দেখতে–দ্যাখাে গিয়ে বিলেত থেকে অপারেশন করে এসেছেন হয়তাে। ওঁদের তাে ইন্টারন্যাশনাল যােগাযােগ। আজারবাইজানের পাহাড় থেকে শেকড়বাকড় আনিয়েও বেটে খেতে পারেন।
খেলে কী হয়?
ওখানকার মানুষ তাে ওসব খেয়ে হামেশাই দেড়শাে, পৌনে-দুশাে বছর বাঁচে। প্রথম বউয়ের বয়স হয়ে গেলে দিব্যি একশাে, সওয়া-শাে বছর বয়সে ফের বে করে, ছেলেমেয়েও হয়। যতদিন বাঁচতে পারে—তার চেয়ে বেশিই তাে বাঁচতে চায় মানুষ! বুড়াের ছেলে কলকাতায় এলে কিছু শেকড়-বাকড় চেয়ে নেব।
বকেয়া মাইনে—দু-বছরের বােনাস পাওনি—সে-সব চাইবে না? নাঃ! ওসব চাইলে তাে পাব না। তার চেয়ে কিছু শেকড় যদি কী করবে? দেখি যদি ফের ছেলে-পেলে হয়। বেশি বয়সে তারাই আমাদের দেখবে। আমায় দিয়ে হবে না কিন্তু। অন্য জায়গায় চেষ্টা কোরাে।
বাজারের ব্যাগ হাতে খাবার টেবিলেই চেয়ার টেনে বসে পড়ল অখিল। বসে বলল, কতদিন বাঁচব কে জানে! পি এফ, গ্র্যাচুইটিও গায়েব। ক-মাস পরে কী হবে বলতে পার খুকু?
কী আর হবে। অন্য জায়গায় চাকরি নাও।
এই বয়সে কে নেবে আমাকে? এখনাে প্রায় দু-বছর কাজ ছিল। সার্টিফিকেটে বাইশ মাস বয়স কমানাে ছিল।
তাহলে তাে প্রায় ঠিক বয়সেই চাকরি গেল!
পি এফ গ্র্যাচুইটি নিয়ে যদি অফিস বন্ধ হত তাে আপত্তি ছিল না। পেনশন নেই আমাদের। এই অবস্থায়, এতগুলাে টাকা গায়েব। ভাব তাে। খালি হাতে বসে খাব?
তাহলে চল, বড়ােখােকনের ওখানে গিয়ে উঠি আমরা। তা পারব না খুকু। আমি চলে যাই। একজনের খরচ তাে কমে যাবে।
আমি একা থাকতে পারি না। তােমারও গিয়ে ভালাে লাগবে না। বড়ােখােকনের বাচ্চার ঠাকুমা হয়ে গিয়ে উঠবে। শেষে বেবি সিটার হয়ে যাবে। যাই বাজারটা সেরে ফেলি।
এখানে একটা মুণ্ডুকাটা বটগাছের নীচে বাজার বসে একবেলা। সবাই বলে বটতলার বাজার। সেখানে গুলকয়লা থেকে ব্লাডপ্রেসারের ডায়টাইড বড়ি, দর্জি থেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, জমির দালালের ঘাঁটি থেকে লােকাল পার্টি অফিস সবই গােলকধামের কোর্টের মতােই সাজানাে। পুরাে ভিউটার ওপর একটা রুরাল ধুলাে। তার দখল নিতে পনেরাে মিনিটের ডিসট্যান্স থেকে একটা পুরােদস্তুর আরবান থাবা এসে মাথার ওপর ঝুলছে। কেননা পাঁচ বছর আগের বাঁশ বাগানেও এখন প্রােমােটারের ছ-তলা ফ্ল্যাট বাড়ি।
সেদিকে তাকিয়ে বাজে লাগল অখিলের। সেই একই মাছ। একই ঝিঙে। কাঁচালঙ্কা। টমেটো। শসা। একই পথ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে একই পথ দিয়ে বের করে দেওয়া। এই করে দিনের পর দিন জঠরের আগুন শান্ত করা। একইভাবে। তিনশাে পটল। দুটো চারাপােনা। পঞ্চাশ লঙ্কা। দেড়শাে টমেটো। ভীষণ বাজে লাগল অখিলের। এই করে করে পুষ্টি, আয়ু, প্রভা, তেজকত কী! এসব ডানদিকে।
বাঁদিকের রাস্তা ধরে এগােলে কাঠের মিস্ত্রি, মুদিখানা, সংগীত শিক্ষায়তন। তারপরেই সরকার ফার্মেসি। সরকার ডাক্তার টালির চালের নীচে টেবিল ফ্যান। আর একডুমের আলাে নিয়ে বাক্স খুলে বসে গেছেন ভাের ভাের। দেশে এত লােক। তাদের সবাইকে ধরে ফেলার মতাে খবরের কাগজ, ট্রানজিস্টার, টিভি, সিনেমা, মদের দোকান কিংবা ফার্মেসি নেই।
শীতের শুরুতে সর্দি ঘড়ঘড় রােগীই বেশি। একটা আধটা কালীপুজোর তারাবাজির বার্নিং কেস। দুটো ভয়ঙ্কর বুড়াে। তাদের একজনের একদম দাঁত নেই। অন্যজনের ওপর পাটিতে মাত্র তিনটি। তারাই জড়ানাে কথাবার্তায় আউ আউ করে সিমেন্টের মেঝেতে চ্যাটাই বেড়ার ভেতর কাঠের বেঞ্চে বসে মানুষের এই মিউজিয়াম সকালবেলাই মাত করে রেখেছে।
সরকার ডাক্তার অখিলের নাড়ি হাতে নিয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বাহ্যে হয়েছে?
এই তাে আপনার ওষুধ নিয়ে বাজার করে ফিরব। আরেক কাপ চা খেলে তবে—
বাহ্যেটা হওয়া দরকার। ওই পথ দিয়েই তাে সর্দির সিক্সটি পারসেন্ট বেরােবে।
বাকি ফর্টি পারসেন্টের দশ পারসেন্টও তাে গলা দিয়ে বেরােচ্ছে না ডাক্তারবাবু।
বেরােয়, আপনি দেখতে পান না।
তর্ক করল না অখিল। সরকার ডাক্তার তাকে দিনে একবার করে খেতে বলেছিলেন। আটটি করে গুলি। কাশির ঘং ঘং—বুকের ভেতর সোঁ সোঁ থামানাের জন্যে সে মাঝরাতে উঠে আরও দু-একবার খেয়ে তবে রিলিফ পেয়েছে।
সরকার ডাক্তার খুদে শিশিতে খুদে গুলিগুলােকে একটা তরল ঢেলে শুকিয়ে নিচ্ছিলেন। অখিল ঠিক তখনই কথাটা পাড়ল। সরকার জ্ঞানের কথা খুব ভালবাসেন।
আচ্ছা মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে।
এই একটা প্রশ্নের মতাে প্রশ্ন করলেন। দেখুন—এক সময় তাে মানুষ হাজার বছরও বাঁচত শুনেছি—
হাজার ?—বলে চুপ করে গেল অখিল। যে কারখানা বন্ধ হওয়ায় সরকারবাবু হােমিওপ্যাথিতে নামেন—রােগী দেখতে দেখতে তা দখলেও এনে ফেলতে পেরেছেন–সেই কারখানায় কী করতেন তিনি? কোনাে তর্কে গেল—
অখিল। মানুষ কি হাজার বছর বাঁচতে পারে? কী দরকার কোশ্চেন তুলে। সরকার ডাক্তারের খুদে খুদে গুলিতে—পুরিয়ায় যখন সর্দিটা সল হচ্ছে—-খুকুর কোমরের ব্যথাটা যখন নরম হচ্ছে। কী শুনেছে কে জানে! হাজার বছরের কথাটা তাহলে শােনা।
সরকার ডাক্তার লম্বা পজ দিয়ে খুব অর্ডিনারি কথা বলেন। এই যেমন : বাহ্যে হয়েছে? বুকটা কেমন বুঝছেন? একটু পরিষ্কার লাগছে না? এইসব কথার ফি-শব্দের মাঝখানে অন্তত দশ সেকেন্ডের গ্যাপ থাকে। সেইসব গ্যাপের মাঝখানে সর্দি ঘড়ঘড়, পােড়া তারাবাজির গরম কাঠি মাড়িয়ে ফেলার বার্নিং কেস, কনস্টিপেশনের রােগীরা চোখের পলক না ফেলে এমনভাবেই তাকিয়ে থাকে—যেন কোনাে অবতারের বাণী শুনছে। যেমন কিনা, পেঁয়াজ খাবেন—না কিন্তুক। এইসব শূন্যস্থান দশ সেকেন্ডের একটি চুপ করে থাকা দিয়ে ভরানাে। ওইসব চুপ করে থাকার ভেতর আবছা মতাে ফার্মেসির ঝাপসা—
আলােয় শিশির গুলিগুলােকে তিনি তরল ওষুধে সােক করিয়ে নেন। শিশিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।
তখন অখিলের মনে হয়—সরকার ডাক্তার তাে আমার চেয়ে বছর দশেকের ছােটো। ইট চাপা ঘাসের মতাে গায়ের রঙ। মৃদু গলা। ক্ষীণ শরীর। হপ্তায় একবার দক্ষিণ বারাসাতে ফ্যামিলির কাছে কাটিয়ে আসেন। আর হপ্তাভাের এখানে পসার জমান। কতদিন বা বাঁচবেন মানুষটি। কতদিন বাঁচতে পারেন ? বটতলা বাজারের হােটেলের ভাত। তার সঙ্গে নরম হয়ে আসা চারপােনা মাছের ঝােল। তাই দিয়ে লাঞ্চ। জলখাবার খেতে তাে দেখি না কখনাে।
শুনেছি—আমার ঠাকুর্দার যৌবনে— (সে কতদিন আগে? একশাে বছর?)
রামায়ণের দারা সিংয়ের মতাে একটা তাগড়া লােক এসেছিল দক্ষিণ বারাসাতে
(টিভিতে হনুমানের রােলে দারা সিং?) তার একটা লেজ ছিল— (যা ভেবেছি—)
লােকটা এসেই দক্ষিণ বারাসাতের রেল প্ল্যাটফর্মে একটা চড় মারে। সঙ্গে সঙ্গে সিমেন্ট করা প্ল্যাটফর্ম ফেটে যায়—
(তখন কি সিমেন্ট আবিষ্কার হয়েছিল ?) তাই বলছিলাম—
প্রতিটি শব্দের মাঝখানে দশ সেকেন্ডের গ্যাপ। সে-সব অদৃশ্য গ্যাপের দিকে রােগীরা সব চোখ বড়াে বড়াে করে তাকিয়ে। এরাই গত কর্পোরেশনের ভােটে একবগা ভােট দিয়েছে। কারণ, রাস্তা সারাই হবে বলে একটি রােড রােলার ও দশ লরি ঝামা বটতলায় এনে ফেলা হয়। ভােটের মাসখানেক আগেই।
বলছিলাম কী—খুকুর মাথা ঝিমঝিম করে—ঘুম হয় না একদম। আপনার মিসাসের ? হা। আমার মিসাসের।
তা মানুষের আয়ু সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে কমে এল। সেই কমা আয়ু অ্যালােপ্যাথি এসে আরও
তবু একজন মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে। ওবেলাও মরতে পারে। আবার টিকে থাকল তাে— টিকে থাকল?
ধরুন ঠিক ঠিক ডায়গনসিস হলে—ঠিক জায়গায় ঠিক ব্রায়ােনিয়া কি সাইলেসিয়া—কিংবা নাক্স ভমিকা–বা এক পুরিয়া লাগদার ক্যালি ফসেই টাটুঘােড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল।
তবু ? কতদিন বাঁচতে পারে ? এ প্রশ্ন কেন করছেন?
অখিল বলল, ধরুন একজন লােক অনেকদিন বাঁচতে চায়। কিন্তু তার টাকা ফুরিয়ে গেল। তখন সে কী করবে? হাতে আর টাকা নেই তার। অথচ বাড়িভাড়া-মুদিখানা—
ওঃ! এটা কোনাে মেডিক্যাল কোশ্চেন নয়। কিংবা ধরুন ব্যাঙ্কে একজন লােকের অনেক টাকা। বাড়িতে তার মিসাস। খুব ভালাে রাঁধেন। লােকটা ফট করে মরে গেল।
তার মিসাস পায়ের ওপর পা দিয়ে সেই টাকা ভােগ করবেন। ব্যাপার কী জানেন—আয়ু বা টাকা কোনটা আগে ফুরােবে কেউ জানে। । তাই যদি জানা থাকত—একজন মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে।
সরকার ডাক্তার একগাল হেসে বলল, আপনি চাইছেন—আয়ু আর টাকা একসঙ্গে ফুরােক! এটাও কোনাে মেডিক্যাল কোশ্চেন নয়।
আসলে আমি চাইছি–মানুষ অনেকদিন বাঁচুক—নীরােগ শরীরে— কতদিন ? এই ধরুন–দেড়শাে বছর।
ওরে বাবা! নীরােগ দেহে দেড়শাে বছর? তাহলে তাে ফার্মেসিতে আমাদের মাছি তাড়াতে হবে।
আর ওই দেড়শাে বছরে হাতে টাকাও যেন না ফুরােয় মানুষের।
এটাও কোনাে মেডিক্যাল কোশ্চেন নয়। এই নিন আপনার মিসাসের ওষুধ। ভােরে খালি পেটে এক পুরিয়া।
চা খেয়ে?
খেতে পারেন। আর রাতে শােয়ার সময় এক পুরিয়া। আপনি কি খুব স্বপ্ন দেখেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ?
তা হয়তাে দেখি। তবে এই সর্দির ওষুধটা খাবার পর থেকে কোনাে স্বপ্ন টপ্ন আর দেখি না। কাশতে কাশতে জেগে উঠতে হয় তাে। স্বপ্ন দেখতে থাকলেও তা ওই ঘং ঘং কাশিতে ছিড়ে ফর্দাফাই হয়ে যায়।
এই কোর্সটা শেষ হােক। আপনাকে দু-হপ্তার ওষুধ দেব। কোনাে স্বপ্ন আর দেখবেন না তাহলে।
আর নন্ মেডিকেল হলেও আপনার প্রশ্নের একটা জবাব দিতে পারি। কোনাে কাগজে পড়ে থাকব—প্রতি পনেরাে ষােলাে বছর অন্তর আমাদের দেহের সব কোষ আগাগােড়া পাল্টে যায়। পশ্চিম পুটিয়ারি থেকে বালিগঞ্জে বাসা বদল করে আসার মতাে।
আমিই তাে দু-তিন বছর অন্তর বাড়ি বদলাই। এই আছি পাইকপাড়ায় তাে চলে গেলাম বেহালার শকুন্তলা পার্কে।
ধরুন তাই। এই পনেরাে ষােলাে বছর অন্তর আমাদের দেহের এক একটা গাঁট। এই গাঁটেই বিপদ ওত পেতে থাকে। কোষ বদলের সময় মৃত্যু এসে হানা দেয়। একটা গাঁটের শেষে—আরেকটা গাঁট শুরু হওয়ার ঠিক আগে।
তাহলে যে যটা গাঁট পেরােতে পারে—সে পনেরাে ষােলাে বছরে ততটা করে আয়ু পায় ?
এই তাে। ঠিক ধরেছেন। তাহলে দশটা গাঁট পেরােলে একশাে পঞ্চাশ ষাট বছর বাঁচতে পারি। রাইট।
ওষুধ নিয়ে বাজারের দিকে চলল অখিল। আমি তাহলে জীবনের চারটে গাঁট পেরিয়ে এসেছি প্রায়। আর একটা পেরােলেই পঁচাত্তর ক্রস করব। অথচ দু-মাস হল মাইনে পাই না। ব্যাঙ্কের টাকা তাে গােনাগাঁথা। জীবনের পঞ্চম গাঁটে পৌছবার আগেই যদি টাকা ফুরিয়ে যায়? | বাজারের কাছাকাছি সে এসে পড়ল। চল্লিশ টাকা কেজির খােকা ভেটকিরা তাকে ডাকছে। আয় অখিল। আয়—| আমাকে কিনে নিয়ে যা। আমি চারশাে। মােট ষােলােটাকা পড়বে। বেশি না। মাঝখান থেকে দুফালি করলে লেজা খাবে তাের মিসাস। তুই মাথা। আমার শরীরে শুধু শিরদাঁড়াতেই কাটা।
দূর থেকেই থমকে দাঁড়াল অখিল। মহেঞ্জোদাড়ােতেও তাে এইভাবেই হাট বসত। এখন অব্দি পৃথিবীর ইতিহাসে বিজ্ঞানীদের হিসেবে মােট ছ-হাজার কোটি মানুষ জন্মে মারা গেছে। তাদের ছাই–তাদের হাড় এই মাটিতে মিশে আছে। তাদের আরও বেঁচে থাকার ইচ্ছে এই বাতাসে কেমিকালি অকসিজেন হয়ে আছে। আমরা খালি চোখে রাতের আকাশে মাত্র ছ-হাজার পর্যন্ত তারা দেখতে পাই। বিজ্ঞানীরা বলছেন—ওখানে ছ-হাজার কোটি তারা আছে। সারা ইন্ডিয়ায় ছ-হাজার রেলস্টেশন—ছ-হাজার সিনেমা হল-ছ-হাজার পােস্টঅফিস আছে। ফি গাঁট পনেরাে ষােলাে বছর ধরলে আমি কি আয়ুর ছ-টা গাঁট পেরােতে পারব ? | বাজারে ঢুকে অখিল কোনােরকমে ছ-শাে ভােলা ভেটকি কিনল। তিনটে সবজ শশা। চারটে মলাে। আর পঞ্চাশ লঙ্কা। আরও কী কিনত। কিন্তু সেই সিক্সটি পারসেন্ট সর্দির কথা মনে পড়ল। সেই সর্দিও একই পুরনাে পথ দিয়ে বেরােয়। আর কিছু কিনতে পারল না।
বাড়ি ফিরছিল তাড়াতাড়ি।
সরু রাস্তার গায়ে ঢােল কলমির অগােছালাে বেড়ার ভেতর একখানি টালির ঘর। অখিল জানে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমস্ত ইয়াংকি সােলজাররা এই অমর আগাছাকে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইন্ডিয়ায় সঙ্গে করে এনেছিল। বেড়া দেবার জন্যে। এদের কেটে মেরে ফেললেও আবার জন্মায়। আসলে এরা কতদিন বাঁচতে পারে—তার কোনাে আন্দাজ নেই কারও।
কে যেন ডাকল। অখিলদা—এই অখিলদা—ফিরে দেখল। মাঝবয়সি, প্রায় ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ বছর বয়সের একজন সুঠাম কালাে পুরুষ–চোখে চশমা-খালি গা—পাজামা গুটিয়ে ধারালাে দায়ে ঢােলকলমির ডালগুলাে কচকচ করে কাটছে।
চিনতে পারলাম না তাে।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে কাশীপুরে গঙ্গার ধারে আপনাদের বাড়ির পাশে থাকতাম। আমি কুনাল। আমার ছােটোভাই কিন্নর। আমরা আপনার ছােটো ভাইদের সঙ্গে নেতাজি সঙ্রে ক্লাবঘরে ক্যারম খেলতাম। মনে পড়ছে?
স্মৃতির পাতালে কুনালকে খুঁজে পেল অখিল। তুমি তাে বড়ােভাই কুনাল। সি এ পড়তে।
হা। দুটো পাস করে আর পড়িনি। এই তাে আমার বাড়ি ওঃ! এই টালির ঘর তােমার? হা। ইচ্ছে করেই পাকা বাড়ি তুলিনি। ইচ্ছে করলেই পারি। আসুন না—
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অখিল বলল, কতটা জায়গা? এখন তাে এখানে লাখ টাকা কাঠা।
চার কাঠা। প্রােমােটার বলছে—জমিটা দিন। রাস্তার গায়ের জমি তাে। বারােটা ফ্ল্যাট বানিয়ে দুটো আমায় ফ্রি দেবে।
নিয়ে নাও। ভালােই তাে।
নাঃ! ভাবছি নিজেই বাড়ি তুলব। তুলে ভাড়া দেব। আমি কিনেছি এইটি ওয়ানে। এগারােশাে টাকা কাঠা।
তাই নাকি? বাঃ! বলে অখিল নিজের মনে বলল, এইট্টি ওয়ানে কত এগারােশাে টাকা হাত দিয়ে গেছে। তখন যদি জানতাম। তখন যদি কিনতাম। তাহলে আমি দুটো না হােক একটা ফ্ল্যাট তাে ফ্রি পেতাম—এই বাচ্চাটি কার ? একটি বছর খানেকের মেয়ে মেঝেতে হামা দিচ্ছে। তাকে ধরতে অল্পবয়সি একটি বউ পাশের রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
আমার। এই আমার বউ অখিলদা— অখিল অবাক হয়ে তাকাল। কুনালের এত বাচ্চা বউ? এত কচি মেয়ে ?
তার মুখে তাকিয়ে কুনাল একগাল হাসল। আপনি অবাক হচ্ছেন তাে। ও আমার শালি ছিল আগে। এখন বউ। আমার স্ত্রী মারা গেছেন।
কীসে?
ক্যান্সারে। আধুনিক হােমিওপ্যাথির কোনাে চিকিৎসাই বাকি রাখিনি। ওই দেখুন।
অখিল কুনালের আঙুল বরাবর চ্যাটাই বেড়ার দেওয়ালে তাকাল। সেখানে বড়াে একখানা অয়েল পেইন্টিং। কপালে ডগডগে সিঁদুর। বাচ্চা বউটি বলল, আমার দিদি-বউটির দিদি সর্বক্ষণ তার ছােটোবােনের এই সংসারের দিকে তাকিয়ে আছে।
অখিল জানতে চাইল, কোনাে বাচ্চা-টাচ্চা?
না। হয়নি। ইউটেরাসে ক্যান্সার। বিয়ের দু-বছরের মাথায় ধরা পড়ল। শেষদিকে সরকার ডাক্তারের পুরিয়া এনে দিতাম। ভালাে হয়ে যাচ্ছিল মনে হয়। কিন্তু ফট করে মরে গেল।
অখিল জানে না শালিকে বিয়ে করলে কেমন লাগে। ক্যান্সারে শেষ পর্যন্ত সরকারকে? আশ্চর্য! সে বাজারের থলে হাতে বাড়ি ফিরে এল। আসার সময় জানতে চাইল, তােমাদের অফিস কোথায়?
কুনাল একটা বড়াে নামি কোম্পানির নাম বলে জানাল, ওদের অ্যাকাউন্টস সবটাই আমায় দেখতে হয়। ব্যালান্স শিট আমারই হাতে। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা-নটা হয়ে যায়। বাচ্চা বউটি নালিশ জানাল অখিলকে। দেখুন না দাদাবাড়ি ফিরেও অন্যসব অফিসের খাতা লেখে-খাতা ঠিক করে দেয়। ভাত নিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসে। এক একদিন রাত একটা দেড়টা হয়ে যায়। আপনি ওকে একটু সকাল সকাল খেয়ে নিতে বলুন তাে।
খেয়ে নিলেই পারাে কুনাল।
নেবাে। নেবাে। কিন্তু এই খাতা লিখেই তাে সােনারপুর স্টেশনের গায়ে ছ-কাঠা কিনি সেভেন্টিনাইনে। ছ-শাে টাকা করে কাঠা। সেখানে পার কাঠা পঞ্চাশ হাজার হয়েছে। আরও বাড়বে—সােনারপুরের ওপর দিয়ে সত্তরখানা ট্রেন যায়। আসেও রােজ সত্তরখানা ট্রেন।
তাই নাকি?
বলেন কেন! আরও দশ কাঠা আছে বেহালার গােড়াগাছায়। সাড়ে তিনশাে টাকা করে কাঠা। এখন বেড়ে কাঠা দশ হাজার। লাইট গেলেই ডবল হয়ে যাবে। অটো দৌড়চ্ছে দিন-রাত।
তাহলে কোথায় তুমি বাড়ি করবে?
সেটাই ভাবছি। কোনটা কোথায় শেষ পর্যন্ত কত টাকার কাঠায় গিয়ে ঠেকে—তাই বুঝে একটা ডিসিশন নিতে হবে। সামনের বছর ঠিক এইসময় নিয়ে ফেলব।
তাড়াতাড়ি নাও। ল্যান্ড সিলিং আইন কিন্তু কলকাতার বাইরেও আরও কড়া হয়ে যাবে।
কবে থেকে বলুন তাে?
তা জানে না অখিল। বেরিয়ে আসার সময় দেখল, কুনালের মুখে বেশ উদ্বেগ।
সেদিনই অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বারান্দায় বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাল অখিল। ধরিয়ে দেখতে পেল, কুনালের ঘরের চ্যাটাই বেড়ার দেওয়াল দিয়ে বাইরের শীতের নিশুতি রাতে আলাে এসে পড়ছে। নিশ্চয় খাতা লিখছে ও এখন। আর অয়েল পেইন্টিংয়ের বউ চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে। ঘুপচি মতাে রান্নাঘরে ভাতের থালা ঢাকা দিয়ে বাচ্চা বউটি বসে ঢুলছে সম্ভবত। তার দিদির আরও বাঁচার ইচ্ছে ছিল। আরও বাঁচতে পারত।
যদি অ্যালােপ্যাথি হত। আচ্ছা মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে!