মানুষ ও বেগুন

মানুষ ও বেগুন

কামিনীফুলের গন্ধ মাখানো বাতাসে প্রফুল্লবাবু বেগুনি ভাজার গন্ধও পেলেন। অল্প বৃষ্টির পর ঝিলিকমারা রোদ্দুর। স্টিলের ব্রাইটনেস বিষয়ক একটা সেমিনার সেরে দুর্গাপুর থেকে কলকাতা ফেরার পথে বুদবুদ নামের এই গঞ্জে একটু টি-ব্রেক। প্রফুল্লবাবু তো আসলে ডক্টর রায়চৌধুরী। প্রফেসর মেটালার্জি। বেগুনি-গন্ধে স্যালাইভেশন হতে থাকলেও উনি রায়চৌধুরীই।

বিস্কুট নেব স্যার? ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল।

না থাক। চায়ে চিনি দিতে না করো।

পেয়াজ কুচি ছড়ানো হলুদ হলুদ মটর সেদ্ধর স্তূপে চূড়া হয়ে আছে লাল টুকটুকে চকচকে পাকা লঙ্কা। গাড়ির বনেটে একটা ছোট্ট পাখি এসে বসল। ফিঙে? ফিঙে কি এত ছোট? তবে কি বাবুই? টুনটুনি? ওদিকে বেগুনিগুলো ফুলে ফুলে উঠে তেলের মধ্যে ছুটোছুটি লাগিয়েছে যেন বাচ্চাদের ইস্কুলের টিফিনবেলা। আঃ কী গন্ধ। ঝাঝরি হাতায় করে ঝুড়ির মধ্যে বেগুনিগুলো রাখল।

নগেন, দুটো নাও তো।

কী স্যার?

চোখ ছোট ছোট করে অল্প আওয়াজে প্রফুল্লবাবু বললেন, বেগুনি।

সে কী স্যার? বেগুনি খাবেন?

ইচ্ছে করছে। তুমি খাবে নগেন?

না স্যার, অ্যাসিড হয়।

প্রফুল্লবাবু বেগুনিটা দাঁতে মৃদু কামড়ে ভিতরের ঐ নরমে ফুঁ দিলে অতীত থেকে সেই অদ্ভুত গন্ধটা ভেসে আসে। ভীষণ আনন্দ হয়। জুল জুল করে বেগুনিটাকে দেখেন! আর তখনই লক্ষ করেন কী চকচকে শরীর।

এত চকচকে কেন হয় কেন? বেসন তো প্রোটিন-কারবোহাইড্রেট, আর তেল তো ফ্যাটি অ্যাসিডের এস্টার। তবু কেন এত উজ্জ্বল? ঠাণ্ডা হলে এই উজ্জ্বলতা, এই লাশ্‌চার আর থাকে না। মৃত মানুষেরও না। বেগুনির কি প্রাণ আছে? প্রাণের বুঝি লাশ্‌চার থাকে? বার্নিশ থাকে? কিসের বার্নিশ ঐ মটর স্তূপে উঁচিয়ে ওঠা লঙ্কাটার গায়ে? একটু আগে গাড়ির বনেটে বসা পাখিটার পালক থেকে আলো ঝলকেছিল কিসের কারণে? সেটা কোন সারফেস কভারিং? পলিমার? পলিমার অফ ফ্যাটি অ্যাসিড্স্? ক্যারোটিনায়ড্স্ নাকি স্রেফ ওয়াক্স?

ছোটখাটো বাজার বসেছে। ছাপছাপ জামা, মুখে ছুলির দাগ, লালচে চুল, একটা ছেলে একটা লাল শার্ট কিনল, শার্টের গায়ে লেখা ব্লু ব্লাড।

এই বুঝি সেই কামিনীগাছটা? যার ফুল-সুবাসে বাতাস এমন ভারী। অ্যারোমা? কামিনীডালে ঝুলিয়ে রেখেছে ব্রা! উড়ছে। মাটির হাঁড়ি, কলসি। কতদিন মাটির কলসির জল খাননি পি.সি.আর.সি.।

পোড়ামাটির ঐ মৃদু গন্ধটা জলের গভীরে গিয়ে মেশে। পোড়া মাটিতে অক্সাইড। ফেরাস আর ফেরিক। সেই গন্ধ। কালো কুচকুচে মেয়েটা বিক্রি করছে বেগুন। মেয়েটার গাটা শাইনিং, যেন বার্নিশ মেখেছে। মিসেস তো কত কী মাখেন। মেয়ে কুন্তলা। কত শিশি, কত কৌটো, কত টিউব। ডঃ রায়চৌধুরী মেয়েটার সামনে যান। সাঁওতাল? ঝলমল মেয়েটার বডি। মেয়েটা বিক্রি করছে বেগুন। ড্রাইভার হর্ন দেয়। একটা বেণ্ডন হাতে তুলে নেন উনি। মুঠোর মধ্যে রেখে মৃদু চাপ দেন। কী নরম। কী তাজা। কী মসৃণ চক চক করছে।

কত করে মেয়ে?

এক টাকা।

কিলো?

হুঁ।

পাঁচ কিলো দাও।

মেয়েটা একটু অবাক হল। বলে, কিসে লিব্যান? একটা ফোলিও ব্যাগ ছিল প্রফুল্লবাবুর হাতে, গায়ে লেখা – সেমিনার অন ক্রোমিয়াম ম্যানেজমেন্ট ইন স্টিল ফর লাশ্‌চার অ্যাণ্ড ব্রাইটনেস। ওতে পাঁচ কিলো ধরবে না। দুই হাতে, কোটের পকেটে, সারা শরীরে বেগুন নিয়ে, বেগুনের অনুভব নিয়ে ডঃ রায়চৌধুরী গাড়ির দিকে চললেন, ড্রাইভার গাড়ি এগিয়ে এনে দরজা খুলে দেয়।

সারা সিট জুড়ে ছড়ানো বেগুনের মাঝখানে বসে আছেন ডঃ রায় চৌধুরী। হাতে একটা বেগুন। বেগুনের গায়ে হাত বুলোচ্ছেন উনি। হাতের মমতা বেগুনের গায়ে লাগে, আর বেগুনের মমতা প্রফুল্লবাবুর হাতে লাগে। কত করে নিল স্যার? ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করে।

এক টাকা কেজি।

খুব চিপ স্যার।

তাজা, খুব তাজা। বোঁটার কাছটাতে এখনো কী উদ্ধত কাঁটা। কাঁটাটায় আঙুল দিলেন। কাঁটা ফোঁড়ার কষ্টের আহ্লাদ নিলেন শরীরে। এবার বেগুনটা দুহাতে ধরে মুখের সামনে ধরলেন। গন্ধ নিলেন। কত কী মাখে পূর্ণিমা। ক’বছর হল পূর্ণিমার সঙ্গে? ক’বছর হল বেগুনের? বেগুন তো মানুষেরও আগে। বেগুন আগে, নাকি মানুষ? হোমোসেপিয়েন্স, নাকি…

টমেটো ক্ষেত থেকে টমাটো তুলবার সময় গাছেদের গা থেকে একটা গন্ধ উঠে আসে, যা নাকি টমেটোর গায়ে নেই। সেই বুনো গন্ধটা মনে পড়ে গেল একবার। মনে পড়ছে শীতের ভোরের খেজুরতলা। খেজুর রসের গন্ধ, গাছের সাদা ফেনা, রস খেতে আসা পাখি। মনে পড়ছে ধান গাছের দেহ থেকে বার করে নেওয়া সাদা রঙের পাইপ যা দিয়ে সুড়সুড় করে টেনে নেয়া যেত খেজুর রস। বেগুন ক্ষেত? মনে নেই, সেই আঁচড়চিহ্ন মনে নেই? মামীমা বলছিলেন, ছুটিসনি পলু, বেগুন কাঁটা বিঁধবে। দশ বারো বছরের পলু ফড়িং-এর পিছনে ছুটছিল। বেগুনগুলো কেমন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। চুপি চুপি থাকে। যেন টু-উ-কী।

খুব ভোরবেলা মামাবাড়ির উঠোনে কী সুবাস। শিশিরের তো নিজের গন্ধ নেই, কুয়াশারও নেই। লাল রোদ্দুরের? প্রভাতী বাতাসের? ভোরবেলাকার একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে, তাই না? মনে আছে, মনে পড়ছে পলু, একদিন খুব ভোরবেলা উঠোনের বেগুন ঝোপ থেকে বেগুন তুলতে গিয়ে কী দেখেছিলি? – ঘন বেগুনি রঙ মসৃণতার গায়ে টলটল করছে দু ফোঁটা উজ্জ্বল শিশির, মনে আছে?

আয়নায় ড্রাইভারের মুখের ছায়া। তার মানে ড্রাইভারও দেখতে পাচ্ছে তাকে এই অবস্থায়, একটা বেগুনকে গালে ঘষতে। প্রফুল্লবাবু সরে যান! বেগুনটা নামিয়ে রাখেন পাশে। রোটারি ক্লাবের মেম্বার, রিসার্চ গাইড, ‘হু ইজ হু’-তে যাঁর নাম আছে, ঘন ঘন বিদেশ যান, সে কিনা বেগুন নিয়ে…

নিউজ পেপারটা খোলেন ডঃ রায়চৌধুরী। দামোদরের জলে ফার্নেস অয়েল মিশে যাবার খবরটা আবার পড়েন। জল খারাপ হয়ে গেছে। ঐ জল এখন ব্যবহার করা যাবে না। দুর্গাপুরে জলকষ্ট।

সারা গায়ে বেগুন ধারণ করে লিফ্ট-এর সামনে দাঁড়ালে প্রফুল্লবাবু। ড্রাইভারও কিছুটা শেয়ার করেছে। সেভেন্থ ফ্লোর। মিসেস রায়চৌধুরী দরজা খুললেন। বেগুন সমারোহে বড়ই আশ্চর্য। একী? এত বেগুন? ডঃ রায়চৌধুরী সোফায় ঢেলে দিলেন বেগুনগুলি। দু একটা মোজাইক মেঝেয় পড়ে অল্প বা বাম্প্‌ করল। মিসেস রায়চৌধুরী উচ্ছাসে বললেন, কী তাজা! একটু পরেই মিসেস রায়চৌধুরীর ব্যস্ততা শুরু হল। ত্রিবেদী ভেজিটেরিয়ান, খুব খুশি হবেন। জয়শ্রী, সুভদ্রা, শান্তা, সবাইকে ডিস্ট্রিবিউট করতে হল। সবাই খুব খুশি। গ্রাম থেকে আসা ফ্রেশ বেগুন।

বেগুন কোনো নতুন ব্যাপার নয়। বাজার থেকে প্রায়ই তো আসে। হয়তো এরকমই তাজা আসে মাঝে মাঝে। তবু গ্রাম শব্দটাতেই কী রকম ডাইমেনশন পেয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।

মিঃ ত্রিবেদী টবে কাঁচা লঙ্কা ফলান। মাঝে মাঝে দুটো চারটে দিয়ে যান। ঐ কটা কাঁচা লঙ্কা আলাদা রাখা হয়, গরম ভাতের সঙ্গে ঘি মেখে খাওয়া হয়। খেতে খেতে হ্যাঁ তো, প্রফুল্লবাবু নিজেও বলেছেন, – অঃ কী সেন্ট, কেমিকাল ফার্টিলাইজার ছাড়া চাষ হয়েছে না? আর, এখন, পূর্ণিমা, মানে মিসেস রায়চৌধুরী উচ্ছাসে বললেন, আজ বেগুন পোড়া খাব।

কুন্তলা এল। আজ একটু রাত্তির হল। নিজেই কৈফিয়ত দিল – নাটক দেখতে গিয়েছিলাম বাপি। কুন্তলা যাদবপুরে এম.এ. পড়ে। পূর্ণিমা তখন খুবই ব্যস্ত। বেগুনে তেল মাখানো হয়েছে। গ্যাসে বেগুনপোড়া করা খুব ঝামেলার। কুন্তলা হেল্প করছে মাকে। কাজের মেয়েটা টি.ভি.-তে ন্যাশানাল প্রোগ্রাম শুরু হতেই চলে যায় বাড়িতে। গ্যাসের আঁচ কমিয়ে রুটি জালের উপর বেগুনটাকে শুইয়ে দিয়ে…

মানুষের চেয়ে বেগুনের বয়স বেশি। কিন্তু বেগুন বেগুনেই থেমে আছে বলে মানুষ। বেগুনকে পোড়াচ্ছে। যদি মানুষ এখানেই থেমে যায়, বেগুন এগোয়, একদিন বেগুন মানুষ পোড়াবে।

বেগুনপোড়ায় সরষের তেল মেখে খাওয়া হল।

মাঝে মাঝে এরকম আনলেই তো পারা…কুন্তলা বলল।

আনব তো,বৈচিফল আনব। কোথাও দেখলেই আনব। চেনা? বৈঁচিফল?

কীরকম আবার ওটা?

চেনা না। গাব চেনা, গাব?

গাব? কি আজব নাম।

ঢেউয়া?

এবার হেসে ফেলল কুন্তলা। কী সব যা-তা বলছ না বাপি আজ…

সেই সোনালি রঙের ফল, টক-মিষ্টি, ছোট ছোট কোয়া, নরম…জানো না, তোমরা জানো না। ল্যানোলিন জানো, ও.ডি. কোলন জনে, জনে দাঁতের ক্লোরাইড।

এসময় ফোন বাজে। ত্রিবেদী স্পিকিং…। বাইগন বহুত আচ্ছা। খুব ভালো। খুব মিঠা, সফ্ট ভি। ফ্রেশ চীজ আছে না, নো ফার্টিলাইজার। মিসেসকে থ্যাঙ্কস জানিয়ে দিবেন।

নো ফার্টিলাইজার; অতএব টেস্টি। কি করে বুঝলেন ওরা, এই বেগুনে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ইউজ করা হয়নি? ওঁরা দুজনেই ফার্টিলাইজার করপোরেশন অফ ইণ্ডিয়াতে কাজ করেন বলেই বেগুন খেয়েই এ সত্যে পৌঁছনো যায় না। আসলে এটা উইশফুল থিঙ্কিং। ক’দিনই বা এমন হল সিন্থেসিস করে ইউরিয়া বানাবার কায়দা মানুষ শিখেছে, আর এখনই ফার্টিলাইজার শুনলেই বমি পাচ্ছে মানুষের, ইনসেক্টিসাইট শুনলেই অ্যালার্জিতে গা চুলকোচ্ছে। প্রোটন–নিউট্রন–ইলেক্ট্ররন শুনলেই যেন হিরোসিমার হল্‌কা হাওয়া এসে গায়ে লাগে।

টিভিতে সে সময় চিন্তাক্লিষ্ট বৈজ্ঞানিকদের মুখ। তারা ভাবছেন। দামোদরের জলে মিশে যাওয়া ফার্নেস অয়েল এগিয়ে আসছে। পূর্ণিমা বলল, ফার্নেস অয়েল মেশা জল খেলে কি মানুষ মরে যায়? প্রফুল্লবাবু বললেন, না, ঠিক মরে না…কুন্তলা বলল, দামোদর কি আলটিমেটলি গঙ্গায় মিশেছে বাপি?

একটু বিব্রত হলেন প্রফুল্লবাবু। পশ্চিমবাংলার নদী-মানচিত্রটা ঠিক মনে গাঁথা নেই। বইয়ের তাক থেকে খুঁজে একটা বই খুললেন এবং বললেন, কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে পড়েছে, সেটা মরা দামোদর। কলকাতার ভয় নেই।

পূর্ণিমা আর কুন্তল। একসঙ্গে বলল, যাক্!

প্রফুল্লবাবুর আজ কেন যে এরকম লাগছে নিজেই ঠিক বুঝতে পারছেন না। সোলানেসি ফ্যামিলির একটা নিরীহ প্রজাতি বেগুন মনটাকে এরকম করে দিল? রিলাকসনের নরম বিছানায় হাল্কা নীল আলোর ঘরে শুয়ে কেন যে ডঃ রায়চৌধুরীর মনে হল গুহাকন্দরে শুয়ে আছে একটা অস্ট্রালোপিথোকাস। চাঁদ উঠেছে আকাশে, সরোবরে জড়ো হয়েছে তৃষিত চিত্রল হরিণ। অস্ট্রালোপিথোকাসটাও জল খেতে ওঠে। ফ্রীজ খোলে, জল খায়। ফ্রীজের ভিতরের স্বল্পালোকে বেগুন-শরীর দেখে। সেই ঔজ্জ্বল যেন নেই আর বেগুনগুলোর গায়ে। ফ্রীজের শৈত্যে? একটা বেগুন-দেহ বার করে আনেন ফ্রীজ থেকে। আলো জ্বালান। এবং দেখেন বেগুনের সারা গায়ে ফোঁটা ফোঁটা সূক্ষ্ম জলবিন্দু। বুকের মধ্যে অকস্মাৎ আনন্দভৈরবী। শিশির! শিশির! বেগুন-শরীরের মসৃণ চামড়ায় ফুটে উঠেছে বাল্যস্মৃতি।

কি গো, হলটা কি? …পূর্ণিমার ঘুম ভেঙেছে টিউব আলোয়।

প্রফুল্লবাবু শুয়ে পড়েন। মানুষের জন্ম কত বছর হল? ক’লক্ষ বছর? কলমিলতা-শুশনিপাতার সঙ্গে, ছাগলছানার সঙ্গে, রাজহাস-টিয়া-বুলবুলির সঙ্গে, বৈচিফল, নারকোল পাতার ঝিরঝির এবং শিশিরসিক্ত ফল নিয়ে, ফুল নিয়ে এই প্রজাতি গত দু লক্ষ বছর কাটিয়েছে। গত দুশো বছরের কী এমন শক্তি আছে যে গত দুলক্ষ বছর থেকে টেনে হিঁচড়ে আলাদা করে দেবে?

পরদিন সকালে উঠেই ফ্রীজ খুলে একটা বেগুন বার করে ব্যালকনিতে নিয়ে গেলেন প্রফুল্লবাবু। ফ্রীজের শিশির কিছুতেই ঐ আসল শিশিরের মতো নয়। প্রফুল্লবাবু দেখেন বেগুনটার সারা গায়ে বিন্দু জল। আকাশ বাতাসের শিশির হল গলানো মুক্তোর মতো দু ফোঁটা একফোঁটা টলটল। মেশিন শিশির কিছুতেই ওরকম নয়।

কলকাতায় কি শিশির পড়ে? কতদিন সেরকম প্রভাত দেখেননি প্রফুল্লবাবু। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনোর অভ্যেস। সাতটার আগে উঠতে পারেন না। এই ফ্ল্যাটের পুব দিক বন্ধ। সদ্য সকালের আলোর ঝালর ঘরে আসে না। শীতকালে সকালে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কুয়াশা জড়ানো কলকাতা দেখতে দেখতে শিশির ভেজা কালো রাস্তার গায়ে টায়ারের জ্যামিতিক জলছবি।

প্রফুল্লবাবু ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে একটা গুলিসুতো কিনলেন।

এবং রাত্রিবেলা একটা বেগুন বার করে নিলেন ফ্রীজ থেকে। তোয়ালে দিয়ে হাল্কা করে মুছে নিলেন, সুতো দিয়ে বাঁধলেন বেগুনের বোঁটা এবং ব্যালকনিতে ঝুলিয়ে দিয়ে গ্রীলে বেঁধে নিলেন সুতোর অন্যপ্রান্ত।

পূর্ণিমা ঘুমোচ্ছে। গা থেকে হাল্কা জুঁই গন্ধ। পাউডারের। ওটা সিনথেটিক। ওটা বেনজইল অ্যাসিটেট। ভোরে উঠতে হবে। শুয়ে পড়েন। আজকাল ঘুম আসতেই চায় না। ভেড়া গোনেন, ঘুমের বড়িও খান। আজ ঘুমোতেই হবে, ভোরে উঠে সবাইকে দেখাবেন। দ্যাখ কুন্তলা দ্যাখ, শিশিরের আহ্লাদ দ্যাখ বেগুন শরীরে।

প্রফুল্লবাবু যেন স্বপ্ন দেখেন ওঁর পিঠ চড়কের ভক্তাদের মতন। শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে সেই আটকানো। আর একটা জ্যান্ত বেগুন ধরে রেখেছে সেই দড়ির অন্যপ্রান্ত। প্রফুল্লবাবুকে নামানো হচ্ছে। নীচের সাদা ধোঁয়া মেঘে ডুবে গেলে প্রচণ্ড কাশি। কে যেন মেশিন গলায় বলল, মিক্ গ্যাস। ভূপালের। ভাল লাগছে তে বেশ? তারপর ঝলকানো আলোককুঞ্জে। মেশিন গলা বলল, যাও, শিব হও। সারা গায়ে মেখে নাও চেরেনোবিলের ছাই।

প্রফুল্লবাবু ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েন। সাতটা। ব্যালকনিতে যান। সুতোটা টেনে বেগুন ওঠান। শুকনো। সাতটায় কি আর শিশির থাকে?

সেইদিনই ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার সময় অ্যালার্ম ঘড়ি কিনে ফেললেন একটা। কাণ্ডকারখানা কি একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে? একটা বেগুনের জনা নাকি এক ড্রপ শিশিরের জন্য একটা অ্যালার্ম ঘড়ি কেনা?

কোনটা বেশি বেশি আর কোনটা কম কম তার কোনো ফর্মুলা আছে? দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ শুনবার জনা একদিন এমন ইচ্ছে হয়েছিল, ছ’লিটার তেল এবং একটা রবিবার খরচা করে বারাসাত ছুটেছিল সোমেশের বাড়ি, সেটা কি বেশি বেশি? মায়ে-মেয়েতে মিলে শুধু একটা কেকের জন্য সারা দুপুর ধরে ডিমের সঙ্গে ময়দা ফেটানোটা বুঝি বেশি বেশি নয়? – তা ছাড়া একটা অ্যালার্ম ঘড়ি তো দরকারই হয়। আগের ঘড়িটা সেই কবে নষ্ট হয়ে গেছে। ভোরে ওঠা তো ভালই। হাল্কা ফ্রি হ্যাণ্ড…

কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিল কুন্তলা। কুন্তলার মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি, আর পূর্ণিমার মুখ গম্ভীর। কুন্তলা খুব মজ্জা করে বলল, তুমি বেগুন ঝুলিয়েছিলে বাপি?

হ্যাঁ।

জানো বাপি, মা যখন বলছিল, আমি বললাম, ভ্যাট। ও মা, তারপর দেখি তোমার টেবিলে খোলা সুতে, আর একটা সুতোর গুলি, গ্রীলে গিঁট।

প্রফুল্লবাবু হাসলেন, কুন্তলার কাধে হাল্কা চাপড় মারলেন। বললেন, আবার কাল, অ্যা?

পূর্ণিমা বলল, থামো। তুমি জানো মিসেস ত্রিবেদী তোমার ঐ বেগুন ঝোলানো নিয়ে কী যা-তা কমেন্ট করেছে? আচ্ছা, বল তে তুমি বুড়ো বয়সে এরকম বাচ্চাদের মতো খেলা করতে গেলে?

খেলা? না-না রিসার্চ! রিসার্চ নয়, খেলাই।

প্লীজ ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নাও। পূর্ণিমার গলায় ঝাঁঝ। আচ্ছা, একটু বলবে, বেগুন ঝোলানোর পারপাসটা কী ছিল?

শিশিরটা পড়ত কিনা বেগুনটার গায়ে।

কী হত তাতে?

কত কী হ’ত। মানুষ তো তার পুরোন ভিটেতে ফিরে যেতে চায়। তুমি যাও না তোমার বাপের বাড়ি? তোমার বাবা নেই, মা নেই তবু। এই যে তুমি জংলা শাড়িটা পরেছ, সারা গায়ে লতাপাতার ছাপ, পিলোকভারে এমব্রয়ডারি ফুল, তুমি কিন্তু বনবালিকাই হতে চাইছ, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছ। জানালায় মানিপ্ল্যান্টের লতা, ঘরের কোনায় খয়রিপাতার রাবার গাছ, দেয়ালে প্লাস্টিকের প্রজাপতি, আর যখন চামর দোলাও ঠাকুরঘরে, তখন তো ঘোড়ার লেজের কথাই ভাবো…

থাক। খুব হয়েছে।

রাত্রে ক্রিম ঘষতে ঘষতে পূর্ণিমা বলছিল– এমন ছেলেমানুষি করো না, মাঝে মাঝে আমাদের খুব বাজে অবস্থায় পড়তে হয়, প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি হয়। জানোই তো মিসেস ত্রিবেদী কী রকম ন্যারো মাইণ্ডেড, তুমি এমন করে বেগুনটা ঝুলিয়েছিলে, ঠিক ত্রিবেদীদের ব্যালকনির সামনে ঝুলছিল।

তাতে কী হয়েছে?

কী আবার হবে, যা-তা কমেন্ট করতে তো কারুর আটকাচ্ছে না, এই তো সব এডুকেটেড মহিলা!

প্রফুল্লবাবু এখন ঐ বাক্যবিন্যাসে বুঝে নিতে পারেন ওটা ভূমিকা। পূর্ণিমা এখন অনেক কিছু বলে যাবে। এখন ও ঘরে কুন্তলা পড়ছে। কুন্তলা এখনো শব্দ করে পড়ে। পূর্ণিমা মাথা আঁচড়ে নিল। রোজই এই সময়ে বলে কীরকম চুল উঠে যাচ্ছে। আজ বলল না ওসব। প্রফুল্লবাবু টেবিলে ছিলেন, টেবিল ল্যাম্পও জ্বলছিল। ফটাস করে টিউবল্যাম্প নিভিয়ে দিয়ে পূর্ণিমা মশারিতে ঢুকে যায়, দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শোয় এবং বলে – অদ্ভুত ব্যাপার! কী? না বেগুন ঝুলছে। বেগুন। ডঃ রায়চৌধুরীর ফ্লাটে সুতো বাঁধা, আর ত্রিবেদীর ফ্লাটের সামনে ঝুলছে একটা বেগুন।

জয়শ্রীই প্রথম দেখেছিল মর্নিং ওয়াকে গিয়ে। ফেরার সময় মিসেস ত্রিবেদীকে বলে, কী ব্যাপার? তখনই ওরা নাকি দেখে বেগুনটা ওপরে ঊঠে যাচ্ছে। মানে, তখন তুমি জাস্ট তুলে নিচ্ছ। মিসেস ত্রিবেদী তারপর কী বলেছে শুনবে? ওর নাকি সব মিস্ট্রি লাগছে – কী সব ব্যাপার-স্যাপার চলছে। কাঁচা বেগুন পাঠানো হল, তারপর আবার বেগুন ঝোলানো হল, নিশ্চয়ই কোনো তুকতাক চলছে। দেয়ার মাস্ট বি সামথিং। বেগুনে কোনে মন্ত্র দেওয়া আছে। আরও শুনবে? মিসেস ত্রিবেদী বলেছে আমার নাকি মিস্টার ত্রিবেদীর উপর উইকনেস আছে। আমি তাই এই সব তুকতাক চালাচ্ছি। আর জানো, সারা বাড়িতে এটা চাউর হয়ে গেছে…

পূর্ণিমা এইবার দেয়ালের দিক থেকে সরে আসে। বলে তোমার এই সব উদ্ভট খেয়ালের জন্য এই সবও শুনতে হচ্ছে আমাকে…

প্রফুল্লবাবু কোনো কথা বলেন না। টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় চলে যান। পূর্ণিমাকে কাছে টেনে নেন। ওর মাথার চুলে বিলি কেটে দেন। গালে হাত বুলোতে গেলে আঙুলের ডগা পায় জলের স্পর্শ। জলে কি বিদ্যুৎ খেলে? তখুনি আঙুল সরিয়ে নেন গাল থেকে।

প্রফুল্লবাবু তখন পালাতে থাকেন। লেকচার রুম থেকে, পি.সিআর.সি থেকে, ডঃ রায়চৌধুরী থেকে, সেমিনার, সিম্পোসিয়াম, আটশো দশ স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট থেকে পালাতে পালাতে বিশাল বিশাল জেব্রা ক্রশিং পেরিয়ে অনেক দূর চলে যান। কচুরিপানা মাড়ানোর ফটাস ফটাস শব্দ টের পান। ফড়িং ডানার ভোঁ-ভোঁ, শুকনো ডুমুর পাতা, সাদা থান পরা দিদিমার কোল, ঘুম যায়রে ঘুম যায়রে ঘুমের লতাপাতা, দুই দুয়ারে ঘুম যায়রে দুটি ডুমুর পাতা। ঘরে ঘুম যায়রে ভ্রমরা ভ্রমরী…সেই কোন কবেকার…এখন ভ্রমরডানার ভোঁ-ভোঁ ছাড়া শরীরে আর কিছু নেই। এখন ঘুম চাই, ঘুম। ঘুমের লতাপাতা, আমাকে জড়িয়ে নে, জড়িয়ে নে প্লিজ। তেষ্টা পায়। জল। ফ্রীজ খুললে আবার সেই বেগুন। ঘরে গিয়ে নীল মশারির ভিতরে পূর্ণিমার দুঃখ-ঘুম দেখে নিয়ে ফের চলে যান অপ্রতিরোধ্য বেগুনের কাছে। ফ্রীজ খুললে যেন মর্গ। কয়েকটা বেগুন স্তব্ধ শুয়ে আছে। একটা বেগুনের বোটা ধরে ঝুলিয়ে ফ্রীজ থেকে বার করে আনেন, মেঝেতে শুইয়ে দেন। বাইরের একটা হ্যালোজেন বাতির হলদে আভা কাচের শার্সির ভিতর দিয়ে ঐ নিস্তব্ধতার ভিতরে আসে। এখন সবই ঘুমোচ্ছে। আলো না জ্বালিয়ে ভীষণ সন্তর্পণে টেবিলে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে সুতোর কুণ্ডলীটা মুঠোয় নেন। না, ঐ ব্যালকনি আর নয়, ডাইনিং স্পেসের জানালাটার কাছে যান, খোলেন। রাত সাড়ে বারোটার কলকাতা শহর তখনো জেগে আছে। সেভেন্থ ফ্লোর থেকে নিচের সব খেলনা। দুজন খেলনা মানুষ খেলনা মারুতি থেকে নামল। পপ গান ভেসে আসছে কোনও ফ্ল্যাট থেকে। প্রফুল্লবাবু বেগুনটার গায়ের মেশিন শিশির তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে নিলেন। তারপর সুতোয় বেঁধে লম্বা করে ঝুলিয়ে দিলেন, যেন ত্রিবেদীদের ফিফ্থ ফ্লোরের ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে আরও নিচে নেমে যায়। এরপর ঘরে গিয়ে অ্যালার্ম ঘড়িটা বের করে আনেন প্রফুল্লবাবু। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে ঘড়িতে চাবি দেন, যেন ঐ চাবির শব্দ চরাচরে কেউ না শুনতে পায়। অ্যালার্মের সময় দেন সাড়ে চারটে, তারপর কাঁটাটা আর একটু ঘুরিয়ে পৌঁনে পাঁচটা করেন এবং ঘড়িটা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েন। সারা রাত কটু কটু করতে করতে ঘড়িটা একসময় চিৎকার করে ওঠে, তক্ষুণি ঘড়িটাকে থামিয়ে দিয়ে প্রফুল্লবাবু বিছানা ছাড়েন। সোজা জানালাটার কাছে চলে যান। সুতোটা ধরে টানেন, সুতোটা হাল্কা। শুধু সুতেটাই, আর কিছু নয়। জানালার গ্রীলে মাথা চেপে প্রফুল্লবাবু দেখেন ভোরের বাতাসে ছিন্ন সুতোর অবোধ ওড়াউড়ি। প্রফুল্লবাবু তখন ঐ পা-জামা এবং গেঞ্জিপরা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন এবং ছুটে যান রাস্তায়।

সূর্য ওঠার আগে আগে চরাচরে এক ধরনের নরম নীল আভা ব্যাপ্ত থাকে। ওরকম আলোয় বেগুনটাকে দেখতে পান প্রফুল্লবাবু। রাস্তায়।

বেগুনটার অর্ধেক পিষ্ট হয়ে গিয়ে ওর সাদা মাংস মিশে আছে রাস্তার কালোয়, আর তার উপরে ফুটে উঠেছে টায়ার-জ্যামিতি। আহত, রক্তাক্ত যে বাকিটা ছিল, বোঁটাটা তখনো আটকে আছে সেই বাকি শরীরে, আর, প্রফুল্লবাবু দেখেন সেইখানে, সেই বেগুনি মসৃণতার উপরে টলটল করছে, টলটল করছে একফোঁটা শিশির।

প্রফুল্লবাবুর হাতটা তখন ক্রেন। ধীরে, সন্তর্পণে তুলে নেয় ছিন্নভিন্ন বেগুন শরীর। ঢাক বাজে, উলুধ্বনি। হিরোহুণ্ডা ছুটে গেল এইমাত্র পিছনে। মাথা উঁচু করে সামনে তাকালে মায়াবী পাহাড়। গুহা, গুহাকন্দর। ওখানে কে দাঁড়িয়ে? আদিমানবী? সি সিকসটিন, সেভেন্থ ফ্লোর, তবে কি পূর্ণিমা? পূর্ণিমা – দেখো দেখো…

প্রফুল্লবাবু দেখেন পূর্ণিমার হাতও তখন ক্রেন। চোখের দিকে যায়। ও চোখ মোছে…

শিশির! শিশির!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *