মানুষের পৃথিবী

মানুষের পৃথিবী

রুক্ষ পাথুরে মাটি, ট্যাংনার কোপ পড়ে পাথরে, আগুনের ফুলকি ওঠে, ধাতব শব্দ ওঠে মাটির বুক থেকে। গদাধর তবু থামে না। গজ গজ করে।

—শালা পাথরের নিকুচি করেছি। পাথরগুলো বেছে ফেলে দে নিতে আর বৌ কোদাল নিয়ে মাটিগুলো চারিয়ে যা তুই আর রূপসী দুজনে।

চড়চড়ে রোদে ক’টি প্রাণী ওই নির্জন বন্ধুর প্রান্তরে এই রোদের মধ্যেও কাজ করে চলেছে। কাজ নয়, ওরা যেন লড়াই-ই করছে এই কঠিন পরিবেশে, বাঁচার লড়াইই। এই শক্ত পাথুরে অহল্যা মাটিতে ওই ক’টি প্রাণী বাঁচার লড়াই করছে। হাসিল করছে এই রুক্ষ মাটিকে। একেই তারা ফলবতী করে তুলবে। এইখানেই তাদের বাঁচার রসদ সংগ্রহ করতে হবে। বন পাহাড় ঘেরা ছোট একটা উপত্যকাই চারিদিকে ন্যাড়া পাহাড়। আশপাশে কিছু শাল, মহুয়া কেঁদ গাছ রয়ে গেছে। রয়েছে কিছু আটালি লতা-ল্যান্টার্ন, লতাপলাশের ঝোপ, ওই রুক্ষতার বুকে একটা ঝোরায় সামান্য জল বয়ে চলেছে। কাচধার জল, পাথরে পাথরে ঘা খেয়ে নেচে চলেছে চঞ্চলা দুরন্ত একটি কিশোরীর মত ওই উপত্যকার বুক চিরে। গ্রামবসত এদিকে বড় একটা নেই, বসতি যা আছে তা পাহাড়ের ওদিকে, ওদিকেই চলে গেছে একটা রাস্তা, দিনান্তে কয়েকখান বাস, মাঝে মাঝে দু’একটা মাল বোঝাই ট্রাকও ছুটে যায়, সভ্যজগতের সঙ্গে এইটুকুই যোগসূত্র।

এই পথ ধরেই একদিন গদাধর নস্করও এসেছিল এই ফুলপাহাড়ীর ডুংরীতে সপরিবারে, তার গ্রামের মাটি থেকে বিতাড়িত হয়ে। সঙ্গে তার স্ত্রী কুসুম, মেয়ে রূপসী আর ছেলে নিতাই। আজও গদাই সেই দিনগুলোর কথা ভোলেনি। এই রুক্ষ মাটির বুকে ট্যাংনা কোদাল চালিয়ে কিছু জমিকে আল দিয়ে হাসিল করেছে তারা দিন পনের অক্লান্ত পরিশ্রম করে। ওই ঝোরাটাকে উপরের দিকে পাথর নুড়ি মাটি দিয়ে কিছু বাঁধের মত করে আটকে ওই ঝোরার জলের কিছুটা ঢালু পাহাড়ী পথ বেয়ে তাদের জমিতে এনে ফেলেছে। ওই প্রবহমান জলধারার সোহাগে তাদের রুক্ষ জমিগুলোও ক’দিন বেশ নরম সরস হয়ে উঠেছে। এসেছে নতুন প্রাণের সম্ভাবনা। ভিজে মাটিতে একটা মিষ্টি সুবাস ওঠে।

ওদিকে রুক্ষতার মাঝে একটা পিপুল আর কয়েকটা শাল কেঁদ গাছ এখনও টিকে আছে পাহাড়ির গায়ে। ওখানটা একটু ছায়াশীতল। ওই গাছগুলোর আশপাশেই গদাধর পাথর মাটির দেওয়াল দিয়ে ওদিকে গ্রাম থেকে তালপাতা এনে ছাউনি দিয়ে ঘরও বানিয়েছে। ঘর নয় মাথা গোজার মত ঠাঁই। গদাই বলে—এই ঘরেই থাকতে হবে এখন। তারপর যদি দিন বদলায় তখন ঘরই করব রে বৌ। কুসুম চেয়ে থাকে এই রুক্ষ পর্বতসানুর ওই বিচিত্র আশ্রয়ের দিকে। মনে পড়ে তাদের নিজের ঘরের কথা। সেই জগতের কথা।

ছোট্ট সবুজ ধানমাঠ গাছ-গাছালি ঘেরা তার ফেলে আসা সেই নশীপুরের কথা। কুসুম বলে—ঘর ভগবানের দয়ায় এটুকু তবু মিলেছে। গদাইও জানে ওই কথার অর্থ, গদাই বলে—সাতপুরুষের ভিটেই তো তোর ভগবান কেড়ে নিয়েছেরে, সব হারিয়ে পথে-পথে ছেলেমেয়ের হাত ধরে ঘুরেছি কতদিন পথের কুকুরের মত, তবু এখানে এসে কিছু তো পেয়েছি রে। দেখি তোর ভগবান এখানেই ক’দিন অন্ন মাপে। সবই তো কেড়ে নিলেন ওই ভগবান।

সেই দুঃখটাকে আজও ভুলতে পারেনি গদাই। নশীপুরে তার বাপ পিতেমর ভিটেতে শান্তিতেই ছিল। মাাটির কোঠা বাড়ি পাঁচিল ঘেরা বাড়িটার উঠানে একটা আম, নারকেল গাছও কটা ছিল। পাতকুয়োর জলে সেচ দিয়ে বড় উঠানে কুসুম নিজেই শাক, লাউ পেঁপে কুমড়ো এসবের চাষ করত। লাউমাচায় ঝুলত অসংখ্য লাউ; গদাইও তার বিঘে কয়েক জমিতে চাষ করত আর ভুবন দত্তের কাছে বিঘে পাঁচেক জমি নিয়ে ভাগচাষ করত। সরেস জমি, বর্ষার প্রথম দিকেই ধান পুঁতত, আবার গ্রীষ্মেও কিছু জমিতে বোরো ধান হতো, এছাড়া সরষে, আলু, পিঁয়াজ এসবও করত।

কুসুম আর গদাই-এর সংসারে এল প্রথমে মেয়ে, সুন্দর চেহারা। কুসুমের রূপ যৌবন ছিল দেখার মত।

গদাই বলত—এই মাটির ঘরে তুকে মানায় না বৌ! কুসুম গদাই-এর বাহুবন্ধনে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলত।

—তালে পাকা দালানই বানাও?

গদাই বলে—দিন দেয় তো তাও হবেক রে। ভুবনবাবু বলেছে আর বিঘে পাঁচেক সরেস জমি ভাগে দিবেক আর নেতাইকেও ইস্কুলে পাঠাব। পড়াশোনা করে ছেলে লায়েক হলে তখন দালান দিবই।

—রূপসীর বিয়ে দিতে হবেক নাই? পাকা গৃহিণীর মত প্রশ্ন করে কুসুম। গদাই দিনের শেষে মাঠের কাজ সেরে ফিরে এবার দাওয়ায় হুঁকো নিয়ে বসে আরাম করে হুঁকো খেতে খেতে বলে,

—হবেক, হবেক? রূপসী বড় হোক, তারপর সব হবেক, উর আমি খুব ভাল ছেইলার সাথে বিহা দিব রে!

সেবার বর্ষাও তেমন ভাল হয়নি।

আকাশে আসে কালো মেঘের দল। ছায়া নামে বাঁশবন আমবাগানে, মাঠে বীজধানগুলো লকলকিয়ে উঠেছে, ওদের এবার চাষ করা জমিতে পুঁততে হবে। আষাঢ়ের বর্ষার জলে ওরা লকলক করে বাড়বে, গোছ বাঁধাবে, আসবে আগামী ফসলের সম্ভাবনা।

কিন্তু সেই মেঘের দল ঝড়ো হাওয়ায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দু’এক পশলা বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, আবার থেমে যায়, মাঠের বুকে জলও জমেনা। পাখনা দেবার মত জল নেই জমিতে, ধান চারা পুঁতবে কোথায়?

আকাশ থেকে কালো বাদল মেঘের দলও কোথায় হারিয়ে গেছে চাষ আবাদও তেমন হয় না। কুসুম ঠাকুরমন্দিরে প্রণাম করতে যায় রোজ। ভক্তিভরে প্রণাম করে, হরিতলায় গোবরা মাডুলী দেয়। গদাধর বলে,

—তোর ভগমান ইবার গেল কুথাকে রে? চাষ বাস নাই—ঘরে ঠায় বসে আছি। জল বৃষ্টি দিতে বল।

কুসুম বলে—তার ইচ্ছা হলেই বৃষ্টিও হবেক।

—ছাই হবেক। ইবার না খেয়ে মরতে হবেক। গদাই গজগজ করে।

কথাটা তার একেবারে মিথ্যা হয় না। সেবার ওই অঞ্চলে বৃষ্টিও তেমন হয়নি। বেশির ভাগ মাঠই অনাবাদী পড়ে থাকে। দু’দশ বিঘে শোল জমিতে কিছু ধান হয়, তাও সামান্যই। এবার সাধারণ মানুষ বিপদেই পড়ে। পৌষ মাস পূর্ণতার নয়, এবার শূন্যতার মাস। তবু কারও সর্বনাশ, কারও পৌষ মাস।

নিশিকান্তবাবু গ্রামের মধ্যে সঙ্গতিপন্ন লোক। ইদানীং কবারই তিনি নানা কৌশলে ভোটে জিতে পঞ্চায়েতের প্রধান হয়েছেন। তার জমি জমাও কম নয়, ক’বছরেই আরও অনেক জমি তার হাতে এসেছে। এখন জিপ নিয়ে ঘোরেন, শহরেও কি সব ব্যবসাপত্র চালু করেছেন। গ্রামেও তখন তার খুব রমরমা। এই অজন্মার বছরে এবার নিশিকান্ত সরকারী রিলিফ দেবার ব্যবস্থাও করেছেন। নিজেরই পুকুর কাটাচ্ছেন সরকারী পয়সায়, গম আর টাকা দিয়েছে সরকার, নিশিকান্ত যেন দয়া করে ওই বেচারাদের কাজ দিচ্ছেন।

গদাই-এর ধানের দরকার। নিশিকান্তের গোলা ভরা ধান—এদের ঘরশূন্য। সেদিন নিশিকান্ত দেখে এসেছে গদাই-এর বৌ কুসুম তার বাড়িতে ক্ষেতের ফসল, মাঠে ধানের হিসাব নিয়ে আসে। গদাই হিসাবপত্র তেমন বোঝেনা। ও খাটতে পারে গাধার মত। সংসার চালায় কুসুমই। সেইই মাঝে মাঝে আসে এ বাড়িতে। গদাই চুপ করে থাকে—কথা বলে কুসুমই।

নিশিকান্ত দেখেছেন মেয়েটাকে। এখনও ওর দেহে টান টান যৌবনের মত্ততা। নিটোল মসৃণ হাত। চোখ দুটোয় কি যেন গহীন রহস্য লুকানো। নিশিকান্তের মনে ঝড় ওঠে। টাকার অভাব তার নেই, এখন সে চায় অন্য কিছু। শহরের উপকণ্ঠে ধানকল রয়েছে, তারই এক দিকে একটা সৌখীন বাংলোও করেছে। বেশ নিরিবিলি ঠাঁই। নিশিকান্ত সেখানে মাঝে মাঝে থাকে—মেয়েদের প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণ তার আছে। আর সেটা কেন্দ্রীভূত হয় ওই কুসুমকে দেখেই, তার মনের অতলে ঝড় ওঠে।

কুসুমের সংসারে এখন টানাটানি চলেছে, এবার ধান তেমন হয়নি। কিন্তু নিশিকান্ত গদাইকে বলে ধান হয়নি মানে? আমারও জমি আকাল, আকালেও ধান হয়, সব তুই গিলেছিস, এখন ‘না’ বললে হবে? বের কর ধান।

গদাই জবাব দিতে পারেনি, বোঝাতেও পারেনি যে ধান এবার তেমন হয়নি, গা বেয়ে বৃষ্টির জল, কোতরায় বৃষ্টি না হলে ধান তেমন হয় না। তাই কুসুমকেই পাঠায় সে—তুই বলগে দত্ত মাশায়কে।

তাই কুসুম এসেছে নিশিকান্তর কাছে। দুপুরের দিকে লোকজন কম থাকে, নিশিকান্ত একাই বৈঠকখানায় বসে আছে—একঝলক আসার মত কুসুমকে দেখে চাইল। কেমন যেন ঘোর লাগে নিশিকান্তর।

কুসুম বলে—ধান ইবার হয়নি দত্ত মশায়। নিজেরাই উপোস দিছি।

দত্ত মশায় বলে—তাই নাকি রে, গদাই তো কিছু বলেনি।

স্তব্ধ দুপুর, একটা ঘু ঘু কোথায় উদাস সুরে ডেকে চলেছে, হাওয়া কাঁপে বাঁশবনে, নিশিকান্ত কিছু টাকা বের করে বলে,

—নিয়ে যা টাকাটা, আর কাল এসে খোরাকি ধান নিয়ে যাবি মণ দশেক। গদাইকে আসতে বলবি।

গদাই কুসুমের পথ চেয়েছিল। কে জানে দত্তমশায় আবার কি বলে, কুসুম ফিরে এসে সব জানাতে গদাই বলে,

—বুঝলি দত্তমশাই মানুষ লয়রে, দেবতা। আকালের বছর ধান টাকা তো দিল, কালই যাব ওনার কাছে।

নিশিকান্ত জানত গদাই আসবে, সেও এর মধ্যে কাগজপত্রও তৈরি করিয়ে রাখে পঞ্চায়েতের কেরাণী হরিপদকে দিয়ে, হরিপদ এসব কাজে খুবই পটু, তার নিষ্ঠায় কোন ফাঁকফোকর থাকে না।

গদাই আসতে নিশিকান্ত বলে—তুই এক নম্বর গাড়োল। ঘরে খোরাকি নেই বৌ বাচ্চার খাবার নেই, বলবি তো। তোদের জন্য এত ভাবি আর তোরা পর ভাবিস আমাকে? নে, দুশো টাকা রাখ—আর এখানে টিপ ছাপ দে। সরকারী টাকা তো রসিদ লাগবে তাই গদাধরও টিপছাপ দিয়ে দেয় সেই কাগজে নিশ্চিন্ত মনেই।

কুসুম আসে, ধান ত নিয়ে যায় খুশি মনে, তবু ছেলেমেয়েকে খাবার দিতে পারব এই অজন্মার বছরে।

গ্রামে গ্রামে নামে অভাবের করাল ছায়া, অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলেছে রুজি রুটির সন্ধানে, গদাই বলে,

—আমাদের ত যেতে হত রে, দত্ত মশাই বাঁচিয়েছেন।

কুসুমের তবু কেমন ভাল লাগে না। পাড়ার অনেকেই চলে গেছে। তাদের চালাঘরগুলো পড়ে অছে। জনমানব নেই। রাতের অন্ধকারে শিয়ালগুলো ঘোরে শূন্য ভিটেতে। কুসুমের চোখে ভেসে ওঠে অকারণেই নিশিকান্তর সেই নীলাভ চাহনি, সেই চাহনি যেন ফুটে ওঠে ওই শিয়ালগুলোর চোখে।

সেদিন গদাই গেছে মাঠে, যোড়ের জল সেঁচে কিছু আনাজপত্র করেছে সেগুলোতে জল দিতে হবে। রূপসী নেত্যও গেছে বাবার সঙ্গে, তারাও জল দেবে। কুসুম একাই রয়েছে বাড়িতে। আশপাশের ঘরগুলোও শূন্য, কেদারদা, ভূষণকাকা নীপুরা সবাই চলে গেছে শহরে কাজের সন্ধানে।

হঠাৎ নিশিকান্তকে ঢুকতে দেখে চাইল কুসুম। নিশিকান্ত বলে—এদিকে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখেই যাই তোমাদের। সারা পাড়া যে খাঁ খাঁ করছে রে।

কুসুম বলে, কাজের সন্ধানে শহরে গেছে সব্বাই।

নিশিকান্ত এদিকে ওদিকে চেয়ে বলে গদাইকে দেখছি না।

ও যোড়ধারে গেছে জলসিয়াত করতে, কুসুম জানায়।

নিশিকান্ত এবার নিজেই একটা মোড়া দেখে টেনে নিয়ে বসে বলে,

—তা ভাল আছ তো কুসুম। তোমার কথা প্রায়ই মনে হয়। তা এখানে এ ভাবে না থেকে তুমি চল না আমার শহরে ধানকলে, কাজ তেমন কিছুই না। মেয়ে কামিনদের হাজিরা রাখবে, ওদের কাজ করাবে। থাকার জায়গা পাবে, খোরাকিও পাবে আর দশ টাকা রোজ। তুমি পারবে এসব কাজ।

রাজী থাকলে বল—হপ্তায় একদিন ছুটি পাবে। বাড়ি আসবে। তারপর চাষ বাস শুরু হলে গাঁয়ে চলে আসবে।

কুসুম চুপ করে থাকে, নিশিকান্ত বলে—কথাটা ভেবে দেখ, তোমার জন্য না হয় পনের টাকা রোজই দোব, যেতে চাও কাল খবর দিও গদিতে। আমি যাব আমার সঙ্গেই না হয় যাবে। বাসের হাঙ্গামা থাকবে না।

কুসুম দেখছে লোকটাকে। কেমন ওই রাতের শিয়ালগুলোর মতই লোভী চাহনি ওর চোখে কেমন ভয় ভয় করে। আবার ও চাকরীর কথাটাও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। গদাই আসতেই কথাটা বলে গদাইকে। গদাইও ভাবছে কথাটা। বলে,

—কি করবি বৌ?

কুসুম ভেবেই রেখেছে, সে বলে—না উখানে চাকরি করব নাই।

কুসুম এর মধ্যে শুনেছে নিশিকান্তের চাকরী দেবার কথা। নামোপাড়ার সৌরভী, বিশু খয়রার বৌ হেমাকেও নিয়েছেন নিশিকান্ত। তারা আর কেউ ঘরে ফেরেনি। ধানকলেও আর কাজ তাদের নেই, কেষ্ট বলে—উরা এখন শহরের খারাপ পাড়াতেই পড়ে আছে। ইখানে ফেরার মুখতো নেই। ওই নরকপুরীতেই মরবেক নষ্টা মেয়েগুলান।

কুসুম ওইভাবে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চায়না। বলে সে,

—না, উ চাকরী করব নাই গ! উখানে যেতে বলোনী। না খেতে পাই তবু ইমাটিতেই পড়ে থাকব।

কিন্তু নিশিকান্ত হাল ছাড়েনি। একবার এখান থেকে নিয়ে যেতে পারলে সে কুসুমের সর্বনাশ করে ওই নরকেই পাঠাবে। ইদানীং নিশিবাবু শহরের দু’একজনের সঙ্গে এই অন্ধকারে নারী বসতির কারবারেও নেমেছে।

কিন্তু কুসুম কেন, এবার গদাইও বলে

—উ কাজ করতে যাবেক নাই বাবু।

নিশিকান্ত গদাই এর দিকে চাইল। বলে— তোদের ভালর জন্যেই বল্লাম। না যাস—যাবি না। তবে হ্যাঁ আমার ধান টাকা মায় সুদ এবার ফেরৎ দিতে হবে।

চমকে ওঠে গদাই। কুসুমও। বাধা পেতেই নিশিকান্ত যেন বদলে গেছে।

গদাই বলে—ধান না উঠলে দোব কোথা থেকে বাবু?

নিশিকান্ত বলে—সে তুই বুঝবি। কালই আসবি কাছারিতে।

এবার গদাই প্রমাদ গণে। বলে,

—কি হবেক রে বৌ?

কুসুমও তা জানে না। বলে টাকা দেবে কোথা থেকে এখন?

—তাই তো ভাবছি। গদাইও কোন পথ পায় না।

এবার নিশিকান্ত বুঝেছে কুসুম তার হাতে আসবে না। যত সহজে কাজ হয়েছিল, এক্ষেত্রে তা হবে না বলেই মনে হয়। তাই সেও এবার অন্যপথই ধরবে। গদাই আসতে এবার নিশিকান্ত সেই কাগজ বের করে বলে তোর পাঁচ বিঘে জমিই বন্ধক রেখেছিলি। দেনা দিতে না পারলে ও জমি আমারই হয়ে যাবে। ও জমি আর তুই চাষ করবি না—আমি দখল নিলাম।

আর্তনাদ করে ওঠে গদাই— তিনশো টাকা আর পাঁচ মন ধান দে পাঁচ বিঘে জমির দখল নেবে? ই ক্যামন কথা গ?

কেরাণী হরিপদই বলে— কি বলছিস রে? এ্যা—তিনহাজার টাকা নগদ আর পঁচিশমন ধান নিলি আর এখন ছাপ মিছে কথা বলছিস? কাগজে যা লেখা আছে আজও তাতো মানবি? গর্জে ওঠে গদাই, ওসব মিছে কথা। তুমাদের জোচ্চুরি, তুমরা সবাই জোচ্চোর চোর।

—কি বললি? নিশিকান্ত গর্জে ওঠে যতবড় মুখ নয় তত বড় কথা।

বিপদের সময় দিলাম দয়া করে, এখন বলে কিনা জোচ্চোর? নিশিকান্ত ওকে সপাটে একটা চড় মারতে ছিটকে পড়ে গদাই। চেয়ারের হাতলে লেগে কপালটাই কেটে যায়, রক্ত পড়তে থাকে।

গর্জাচ্ছে নিশিকান্ত—শেষ করে দোব ব্যাটাকে।

গদাইও গর্জে ওঠে শ্যাষ করবেক? মিথ্যে দেনার দায়ে সব কেড়ে নেবা আইন নাই? এর বিচার হবেক নাই?

বের হয়ে যায় গদাই। থানা পাশের গ্রামেই। রক্তাক্ত অবস্থাতেই সে থানাতেই যায়। এর বিহিত সে করবেই। দু’চারজন কৌতূহলী লোকও জুটে গেছে। কে বলে বাড়ি যা গদা, গদাই এত সহজে থামবে না। সে থানাতেই এসেছে বিচারের আশায়। দারোগাবাবু বলেন সব শুনে দলিল করেছিস। টাকা ধান নিলি ফেরৎ দিবি না? আইন মানবি না? উল্টে নালিশ করতে এসেছিস? ওই নিশিবাবুই মেরেছে না আর কোথাও মারামারি করে নিশিবাবুর নামে দোষ দিতে এসেছিস রে?

গদাই অবাক। বলে সে—উ মিছে কাগজ। এত টাকা, ধান লিইনি। দারোগাবাবু বলে—কাগজে যা লেখা আছে তাই মানতে হবে। আর নিশিবাবু তোকে মেরেছেন কোন সাক্ষী আছে?

গদাই এবার বোবা। সত্য ঘটনাকে এরা মানবে না। সাক্ষীও দেবে না কেউ। দারোগাবাবু কোন জরুরী কাজে বের হয়ে যায়। মেজবাবু বলে—যাতো এখন! সাক্ষী টাক্ষী আনগে। গদাই ফিরে আসে। অবশ্য তার আগেই থানার বড়বাবুই নিজে গিয়ে খবরটা দেয় নিশিবাবুকেই। জানায়—ওকে তাড়িয়ে দিইছি। তবুও নিশিকান্ত গর্জে ওঠে, থানায় যায় ব্যাটা, এত বড় হিম্মৎ। পদা, কালই ওর সব জমিতে লাঙল দিয়ে দখল নে। বাধা দিতে এলে ঠ্যাং ভেঙে দিবি ওর।

গদাই এর পর কি করবে জানে না। কুসুমও অবাক হয়।

—এত টাকা ধান কবে নিলাম গো?

গদাই বলে—কাগজে তো টেক লিখেছে, এখন কি হবেক?

ওদের ভাবনার কূল তল নেই।

এমনি সময় নিত্য এসে খবর দেয়—বাবা, আমাদের জমিতে দত্তবাবুর কিরষাণ পদ খুড়ো লাঙল দিচ্ছে। বোড়ধারের জমির সব শশা-ঝিঙে রামঝিখের গাছগুলান তুলে ফেলাইছে—সে কি? সদাই ছুটলো, পিছনে কুসুম রূপসীও। নেত্য বাবার সঙ্গে দৌড়চ্ছে। কিন্তু গদাই দেখে মাঠের আগে চারপাঁচ জন লাঠিয়ালও মজুত। পদা খান দুয়েক লাঙল নামিয়ে তারই জমিতে চাষ দিচ্ছে। গর্জে ওঠে গদাই—খবরদার, পদা উঠে আয় জমি থেকে।

পদা বলে—কোটে যা। নিশিবাবু এসব জমির দখল নেছে। মাঠে নামবিনা।

গদাই দেখে দুজন লাঠিয়াল তাকে ঘিরে ফেলেছে। কুসুমও এসে পড়ে। সেই বলে—সরে এস। ভগবান ইয়ার বিচার করবেক। কান্নায় ভেঙে পড়ে কুসুম।

আজ বেশ বুঝেছে কুসুম, ওই লোভী শয়তান তাদের সবই কেড়ে নিতে চায়। জমিজমা গেছে কেড়ে নিয়েছে মুখের গ্রাস। এবার বাঁচাই তাদের কাছে সমস্যা হয়ে উঠেছে। গদাই বলে,

—এতকাল দিনে রাতে ভগমানকে ডেকেছিস। ইবার দ্যাখ তুর ভগবান কি বলে? গরীরের ভগমানও নাইরে। নাহলে ইয়ার বিচার হয় না। কুসুম চুপ করে থাকে। জানে না কি করে চলবে তাদের দিন। নেত্য রূপসীও বুঝেছে এবার তাদের সামনে অন্ধকারই নামছে।

রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন গদাই জানেনা। হঠাৎ ঘুম ভাঙে চারিদিকে আগুন— হকচকিয়ে যায় সে, কুসুমও উঠে পড়ে। গোয়ালের চালায় গরুগুলো বিকট চিৎকার করছে। চিৎকার করে গদাই—আগুন আগুন!

পাড়াপড়শীও বিশেষ নেই। তারা আগেই চলে গেছে শহরে রুজি রুটির সন্ধানে। সাহায্য করারও কেউ নেই। কোনমতে ওই বেড়া আগুন থেকে রূপসী নেত্যকে নিয়ে বাইরে আসে। দেখে রাতের অন্ধকারে তাদের ঘরটা জ্বলছে। গরু দুটো দড়ি ছিঁড়ে আতঙ্কে কোনদিকে পালিয়েছে।

…পিঠ গা পুড়ে যাচ্ছে গদাই, কুসুমের। এই রোদের তীব্র উত্তাপের স্পর্শে ওদের মনে পড়ে সেই ঘর পোড়ার রাত্রির কথা। সে এক দুঃস্বপ্নের রাত্রি। সব হারানোর রাত্রি। মানুষের আশ্রয় হারানোর মত যন্ত্রণা আর নেই।

সেই যন্ত্রণাকে তিলে তিলে অনুভব করেছে তারা। সব হারিয়ে সেদিন গ্রাম ছেড়ে অজানার সন্ধানে বের হয়ে বহু ঘাট পার হয়ে বানে ভাসা খড়কুটোর মত এই নির্জন উপত্যকায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল।

এখানেই ঘর বেঁধেছে এই অচেনা অজানা পরিবেশে। সমতল সবুজের ছোঁয়া নেই এখানে। কুসুম বলে—ওই নীচু জমি দুটোতে ধান হবেক, জলও কাছেই আর উপরে জমিতে মকাই দাও। ইখানে ওটারই চাষ বেশি দেখছি। এর মধ্যে ওরা বাড়ির আশপাশের কিছু জায়গায় পাথর ফেলে দিয়ে সেখানে আলু, বেগুন, কুমড়ো, শাক লাগিয়েছে। অহল্যা মৃত্তিকা ছিল প্রাণরসে ভরপুর। সেই মাটিতে ফসল হয়েছে চমৎকার। মৃত্তিকা যেন ব্যগ্র হয়ে থাকে মানুষের হাতের স্পর্শের জন্য, সেটা পেলেই সে ফলবতী হয়ে ওঠে।

রূপসী, নেত্য ঘর তাদের গ্রাম, খেলার সাথীদের ছেড়ে এসে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছিল। এখানে গ্রামের সেই কলরব নেই। তারা মাত্র দু’জনেই ঘোরে ওই বনে, ঝর্ণার ধারে। স্তব্ধ চারিদিক। ওঠে ঝোরার ঝর ঝর সুর, পাখীদের ডাক। একটা কুকুরও এসে জুটেছে দূরের গ্রাম থেকে।

এখানে সেও আশ্রয় পায়। নেত্য ওর নাম রেখেছে কালি। মিশকালো রং-এর বেশ তাগড়া একটা কুকুর। রূপসী নেত্য ক্রমশ মাঠের কাজের ফাঁকে পাহাড়ের এদিক ওদিকেও ঘোরে। নেত্য সেদিন বাবার সঙ্গে পাহাড়ের ওদিকের কোন গ্রামে হাটেও গেছলো তাদের ক্ষেতের বেগুন টম্যাটো কুমড়ো নিয়ে।

নেত্য দেখে গ্রামটাকে। দোকান পাশারও রয়েছে। হাটে মাল বিক্রীর পর গদাই কিছু জিনিসপত্রও কেনে, নিত্য একটাকার জিলাবীও কেনে। চারটে জিলাবী।

রূপসী ক্রমশ বড় হচ্ছে। প্রকৃতির ঋতু বদলের পালা যেমন থামে না, দিনরাতের গতিও থামে না, তেমনি রূপসী এখন ছোট্ট থেকে একটি কিশোরীতে পরিণত হয়েছে। এই নির্জন পরিবেশেও তার বাড়বাড়ন্ত থেমে যায়নি।

এই নির্জন পরিবেশেও বসন্ত আসে। গাছগাছালিতে আসে নতুন পাতা, শাল ফুলের গন্ধে মেশে ল্যাটানল—বনচাপার সুবাস পাখীদের কলরব ওঠে। রূপসী নেত্য বের হয়ে ঝোরার ধারের বনে, বনফুলের সন্ধানে। বনজামের চারাগাছে এসেছে ফুলের গুচ্ছ, বর্ষার সেই কালো মেঘের হানা নেই—নেই শীতের রুক্ষতা। এসেছে বসন্তের দিন।

নেত্য বলে—গাঁয়ে যাবি দিদি। ওখানকার মন্দিরে খুব ধুমধাম করে দোল খেলা হয়।

রূপসীর এই নির্জন নিঃসঙ্গতা ভাল লাগে না। সে দেখে পাখীগুলোকে। ওরা নীল আকাশে উড়ে যায় পাহাড় সীমা পার হয়ে কোন দূর দিগন্তে। ওর মনও তেমনি উধাও হতে চায়। ছোট এই পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় তার মন বন্দী হয়ে থাকতে চায় না।

কুসুম এই জীবনকেই মেনে নিয়েছে। কঠিন পরিশ্রমের জীবন। তবু এই পরিশ্রম তাদের ব্যর্থ হয়নি। ঊষর উপত্যকা মানুষের স্পর্শে এখন যেন বদলে গেছে। মকাই খেতে এখন সবুজ গাছে মকাই এসেছে। নীচু জমিতে ওরা অক্লান্ত পরিশ্রমে ধানও ফলিয়েছে। কোন ধান-এর শীষগুলো নুইয়ে পড়ে। গদাই-কুসুম নিজেরা বাঁকে করে ঝোরা থেকে জল এনে গাছগুলোকে আজ ফলবতী করে তুলেছে। ওই ফসলে ওদের ঘাম রক্ত মেশান।

গদাই বলে—সামনের বার ঝোরায় আরও বড় বাঁধ দেব বৌ, জল তখন আপনিই ক্ষেতে আসবে। মকাই-অড়হর ক্ষেতে জল কিছু না হয় দোব। ধান ক্ষেতে জল দিতে হবে না। নতুন ফসল ওঠে। এ মাটির প্রথম ফসল। সোনা ধান দেশঘর হারিয়ে এই নতুন পরিবেশে এসে আবার বাঁচার আশ্বাস পায় তারা।

গদাই বলে, চল, গ্রামের মন্দিরে পুজো দিতে যাব।

এ যেন তাদের কাছে এক উৎসবই।

গদাই কুসুম নেত্য রূপসী আসে পাহাড়ী পথ বেয়ে এদিকের জগতে। রূপসী দেখে এক নতুন পরিবেশ। গ্রামের হাটতলা সেদিন জমজমাট। কয়েকটা প্রাচীন শাল মহুয়া গাছের জটলা—ওদিকে দোকানপাট। গদাই-এর চেনা জানা দু’একজনও রয়েছে এখানে। হাটেই আলাপ।

ওদিকে একটা সিনেমা হলও রয়েছে। রূপসী বলে—এখানে সিনেমাও আছে তাহলে?

নেত্য বলে—বড় জায়গারে। ওদিকে ইস্কুল বাড়িও রয়েছে। বাবা বলেছে সামনের বছর থেকে ওই ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে।

মন্দিরে এসেছে কুসুম। সেই দেশ ছাড়ার পর কটা বছর যেন ভগবানকে ডাকতেই ভুলে গেছল সে। আজ মন্দিরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে দেবতার সামনে। পুজো দিচ্ছে পূজারী ঠাকুর, ঘণ্টা বাজে, কুসুম বলে,

—সব হারিয়ে আবার তোমার চরণেই ফিরে এসেছি ঠাকুর।

এবার শান্তি দাও, দুমুঠো অন্ন, একটু আশ্রয়, এর বেশি কিছু চাই না ঠাকুর। দয়া কর।

রূপসী নেত্য দু’জনে ঘুরছে মন্দিরের আশপাশের দোকানে।

ওদিকে হাটতলার ভিড় তখনও চলেছে। একটা তাঁবুর সামনে একজন তরুণ প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে মাইকে কি বলে চলেছে।

রূপসী দাঁড়িয়ে পড়ে। তাঁবুর ভিতর কি সব খেলা চলেছে। এক টাকার টিকিট। সেই ছেলেটা তখন মাইকে কথা বলা বন্ধ করে কাগজের টুকরো খাচ্ছে আর সেই টুকরোগুলোকে লম্বা কাগজের নল করে বের করছে। মন্ত্রের জোরে তার টুপি থেকে রুমাল, মায় পায়রাও বের হয়। রূপসী বলে,

—যাদুকর বুঝলি!

নেত্যর পকেটে পয়সা নেই। তাহলে ঢুকে আরও যাদুর খেলা দেখতো। হতাশ হয়ে ফেরে। রূপসী বলে—পয়সা পেলে একদিন যাদু দেখতে আসব।

দিনশেষে পড়ন্ত বেলায় আবার ঘরে ফেরা। একটা দিন রূপসীর মনে কি যেন উত্তেজনা আনে। পাহাড়ের ওদিকে আলো আনন্দ কলরব। ঘর বাড়ি, এদিকের উপত্যকায় স্তব্ধতার মাঝে জাগে পাখীর ডাক। অন্ধকার নামে পাহাড়ের গায়ে। এক নির্জন জগৎ। রূপসীর ভাল লাগে না।

কুসুম এসে আজ সন্ধ্যাদীপ জ্বালে, শাঁখ বাজায়। তুলসী গাছটাও এখন সবুজ সজীব। কুসুম বলে ভগবান ঠিক মুখ তুলে চাইবেন দেখ। গদাই বিড়ি খাচ্ছে দাওয়ায় বসে। বলে সে—ভগমান! গরীবদের কুন ভগবান নাইরে।

কুসুম বলে—উ কথা বলে না গো। তিনিই কেড়ে নেন। আবার দেনও তিনি। তবু পায়ের তলে মাটিতো আবার দিয়েছেন। এবার মকাই বিচেও ভাল পয়সাই পাবে। তারপর আবার ধান হবে। আর আনাজ বিচেও তো খর্চা চলছে।

—দিনরাত খেটে তো মরছিস!

গদাই-এর কথায় কুসুম বলে ইবার নেত্যকে ইস্কুলে পড়াব। আর অচেনা জায়গা তবু স্বজাতের ঘরে ছেলেও দ্যাখো, রূপসীর বিয়েও দিতে লাগবে।

ঝর্ণার জলে রূপসী স্নান করতে আসে। জায়গাটা বেশ নির্জন। ঝর্ণার দুপাশে বুনো জমি, শাল গাছের জটলা। এখানে পাহাড়ের কোলে ঝর্ণার জল গ্রীষ্মেও থাকে বুক ভোর। গাছের ছায়া পড়ে, কাঁচধার জলে দেখা যায় মাছগুলো ঘুরছে। নেত্য মাঝে মাঝে ছিপ ফেলে এখানে পুঁটি, ট্যাংরা, আর মাছও ধরে। সেদিন মুখ বদলাতে পারে তারা। মাঝে মাঝে রূপসীও এখানে এসে বসে। একটা গাছের গুঁড়ি ভেঙে পড়ে আছে জমির ধারে। ওখানে বসে থাকে, কি এক নতুন জগতের স্বপ্ন দেখে রূপসী।

আজও এসেছে স্নান করতে এখানে।

বুক ভোর জলে স্রোতও থাকে। নির্জন এই অরণ্যে রূপসী মুক্ত প্রকৃতির মাঝে একা। নিজেকে দেখে বার বার; তার সদ্য উন্নত বুক, নিটোল দুটো পা— দেহের সোচ্চার রেখাগুলোকে নিজেই দেখে আর মনে হয় এ যেন কোন এক নতুন রূপসী যাকে সে চেনেনা। নতুন করে দেখছে।

হঠাৎ একটা শব্দ শুনে সচকিত হয়ে চাইল। দেখে একটি তরুণ ওই ল্যান্টার্ন ঝোপের মধ্য থেকে তাকে দেখছে। দেখছে তার উন্মুক্ত উন্নত বুক, মসৃণ নাভিমূল— নিটোল জঙ্ঘা। অস্ফুট আর্তনাদ করে রূপসী ঝোরার জলে ডুবিয়ে নেয় নিজেকে ওর দৃষ্টির আড়াল করতে। নিজেকে জলে ডুবিয়ে ওই দিকে ভীত চকিত চাহনিতে চাইল। ছেলেটি এবার বের হয়ে আসে ঝোরার ধারে। বলে ভয় পেয়ে গেলে নাকি? আরে আমি বাঘ ভালুক নই। তুমি বুঝি নতুন এসেছ ওই যে ওদের বাড়িরই?

কোনমতে ঘাড় নাড়ে রূপসী। নির্জন নিভৃতে একান্তে এমনি করে কোনও ছেলের সঙ্গে সে কথা বলেনি। ছেলেটিকে দেখে চিনতে পারে এবার। সেই তরুণ যাদুকর। ওকেই সেদিন হাটতলায় দেখেছিল। ছেলেটি বলে,

—এদিকে এসে পড়েছিলাম ঘুরতে ঘুরতে। যাক দেখা হয়ে গেল তোমার সঙ্গে।

রূপসী এর মধ্যে উঠে পড়েছে জল থেকে। তার নিটোল সদ্যযৌবনা দেহের সঙ্গে ভিজে শাড়িটা বসে গেছে। তার দেহের এত সম্পদের খবর আজ যেন সে পেয়েছে ওই তরুণের মুগ্ধ চাহনিতে।

তরুণই বলে—একদিন এস যাদু দেখতে। নিজেই পকেট থেকে একটা চিরকুট দিয়ে বলে—এটা গেটে দেখালে কেউ পয়সা চাইবে না। আসবে কিন্তু!

ছেলেটি চলে যায়। এবার রূপসীও খুশী। আজ এই নিভৃত বনভূমিতে ওই তরুণটির চোখে যেন নিজেকেই নতুন করে আবিষ্কার করেছে। তাকে যাদু খেলা দেখার আমন্ত্রণও জানিয়ে গেছে। কি খুশীতে মন ভরে ওঠে রূপসীর। জীবনে সে কিছুই পায়নি। এবার তার বঞ্চিত মন যেন অনেক কিছুই পেতে চায়।

নেত্য এখন বড় হয়েছে। হাট বাজার করতে সে নিজেই এখন পাহাড় পার হয়ে ওই গ্রামে যায়। এবার ওখানের স্কুলেও পড়তে যাবে। যাতায়াতে মাইল ছয়েক পথ। তবু ওটুকু পথ যাতায়াত করবে সে। এবার মকাইও ভাল হয়েছে, সারা উঠান ভরে গেছে মকাই-এর কাটা গাছে। এবার রাশিকৃত মকাই দানা ছাড়াতে হবে। নতুন করে আরও বিঘে খানেক জমি হাসিল করেছে গদাই। এবার একজন কাজের লোক রাখতে হবে। দুটো গরুও কিনেছে নেত্য। তাদের দুধ নিয়ে যায় হাটে।

রূপসীই বলে—নেত্য, চল যাদুকরের খেলা দেখে আসি। নেত্যও তাই চায় কিন্তু পয়সা? রূপসীই বলে—তার ব্যবস্থা করেছি। চলতো। মাকে বলি—

কুসুমও দেখেছে ছেলে-মেয়ে দুটোর জীবনে গ্রামের সেই খেলা আনন্দের অবকাশ কিছুই নাই। এখন এখানের জীবনে কিছুটা আহার আশ্রয়ের ব্যবস্থা হতে এবার তাই কুসুম রূপসী নেত্যর কথা ভাবছে। নেত্য বলে—মা, দিদি আর আমি হাটতলায় যাদুকরের খেলা দেখতে যাব। দেরী হবে না।

কুসুম বলে—যা। আসার সময় হাট থেকে গরুর খোল আর সরষের তেল আনবি। পয়সা নিয়ে যা।

এত সহজে মুক্তির অবকাশ মিলবে ভাবেনি রূপসী। আজ দু’জনে বের হয় সেই আনন্দের জগতে। হাটতলার ওদিকে বাদ্যি বাজনা বাজছে। যাদুকরের তাঁবুর সামনে বেশ ভিড়। রূপসীকে দেখে সেই তরুণ এগিয়ে আসে—এসে গেছ? এস, এস। এটি?

—ও নেত্য, আমার ভাই। রূপসী জানায় তরুণকে।

নেত্যও দেখছে তাকে। ফুল প্যান্ট শার্ট পরেছে। গলায় টাই। বেশ ছিমছাম চেহারা। সেইই নিয়ে যায় ওকে একটা ছোট তাঁবুতে। ক্যাম্প খাট পাতা। কোথা থেকে চা বিস্কুটও আনে ওদের জন্য।

—নাও চা খেয়ে নাও। তারপর খেলা দেখতে যাবে নেত্যবাবু।

রূপসী একটা টুলে বসেছে। ছেলেটি দেখছে ওকে । রূপসীর মনে ওই বাজনার সুর।

যাদুকরের খেলাও বিচিত্র। সেই তরুণটিকেও দেখা গেল মঞ্চে। যাদুকরের সঙ্গে সেও খেলা দেখাচ্ছে। শূন্য থেকে খপ করে টাকা ধরছে অনেক টাকা— আর উড়িয়ে দেয়, টাকা পরিণত হয় পায়রায়, হাততালি পড়ে। রূপসীও হাততালি দেয়। একটা মানুষকেই চোখের সামনে বাক্সে পোরে। বাক্স খুলতে দেখে কেউ নেই। রূপসী চমকে ওঠে, নেত্যও; এ যেন এক সুর-স্বপ্ন-আলোর জগৎ।

খেলার শেষে ওরা বের হয়। তরুণও আসে কেমন দেখলে খেলা?

—দারুণ! নেত্য বলে।

রূপসীর চোখে কি নেশা। সে শুধু চেয়ে থাকে। সেই দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে নীরব তৃপ্তির আবেশ। বাড়ি ফিরে নেত্য—রূপসীর সেই গল্প আর থামে না। কুসুম গদাইও অনেকদিন পর ছেলে মেয়ের খুশী দেখে খুশী হয়।

রূপসী সেদিন স্নান করে ফিরছে, হঠাৎ দেখে সেই তরুণকে। সবুজ ফুলফোটা পাখী ডাকা জগৎ। রূপসীর মনে কি স্বপ্ন জাগে। যেন কোন রাজপুত্তুর এসেছে তার সামনে, অবশ্য পক্ষীরাজ ঘোড়ায় নয় সাইকেলে। রূপসী অবাক হয়—তুমি!

তরুণ বলে—তোমাকে দেখতে মন চাইল, চলে এলাম।

নেত্যও মাঠে কাজ করছিল, সেও এগিয়ে আসে। ওরাই নিয়ে আসে তরুণকে তাদের বাড়িতে।

তরুণ দেখছে ঝোরার ধারে সবুজ ক্ষেত, ওদিকে ধান গাছ-এর সবুজে এসেছে প্রকৃতির দাক্ষিণ্য, এ মাটিকে এরা ফলবতী করেছে। মাঠে শশা, বেগুন, টমেটো সবই রয়েছে। প্রকৃতি এই নিভৃতে একটি নিঃস্ব পরিবারকে তার সব দাক্ষিণ্য উজাড় করে দিয়েছে।

কুসুমও এগিয়ে আসে।

নেত্য বলে—দারুণ যাদুকর মা।

তরুণ বলে—না-না। এমনিই খেলা দেখাই।

হঠাৎ আগমনে যেন খাবলে একটা টাকা ধরে দুটো টাকা— নিজের মাথা থেকেই ধরে একটা টাকা। হাসছে রূপসী। বিকালে নামছে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য, ঢলে গেলেই এখানে বিকাল নামে। রূপসী নেত্য তাকে এগিয়ে দিতে আসছে।

রূপসী আজ কি স্বপ্ন দেখে। এ তার একান্ত নিজস্ব একটি স্বপ্ন। তরুণ বলে—এই অন্ধকার বন পাহাড়ে থাক কি করে?

রূপসীও এটা বারবার ভেবেছে, বলে—যাব কোথায়?

তরুণ বলে—তোমার ঠাঁই এখানে নয়, ওই শহরে, সেখানে নতুন করে বাঁচবে তুমি। এত কষ্টের মধ্যে নয়।

—কি করে তা হবে? রূপসী বলে।

তরুণ বলে—সবই হতে পারে, সবই সম্ভব। অবশ্য যদি চাও ব্যবস্থা করতে পারি।

রূপসীর মনে কথাটা সাড়া জাগায়, সে এই নির্জন বনপাহাড় থেকে অন্যত্র গিয়ে নতুন করে বাঁচবে। তরুণই বলেছে তাকে, পথ চেয়ে থাকে তার, সেই নির্জন বনভূমিতে আসে তরুণ। রূপসীও সেখানে যায়। দু’জনে সেই ছায়া অরণ্যভূমিতে ঘনিষ্ঠ হয়—রূপসী স্বপ্ন দেখে। অনেক স্বপ্নই। ক্রমশ দুঃসাহসী হয়ে ওঠে সে।

সেদিন কুসুম গদাই ধান নিড়াচ্ছে, ধানগাছগুলো সবুজ সতেজ হয়ে উঠেছে, ওদিকে আখের খেতও করেছে, হাটে আখ ভাল দামে বিক্রী হয়, একটা খেতে কলার চাষও করেছে, উপত্যকার বুকে এসেছে সবুজের প্রশান্তি, বেলা পড়ে আসছে, ওরা ঘরে ফিরে দেখে রান্নাও হয়নি, রূপসীও ঘরে নেই। নেত্য হাটে গেছলো সে ফিরে এসেছে, হাটের মেলা উঠে গেছে, সেই যাদুকরের তাঁবুও আর নেই। জায়গাটা ফাঁকা—ওরা চলে গেছে অন্য কোন শহরের মেলায়।

বাড়ি ফিরে দেখে মা বাবা এদিক ওদিক খুঁজছে। রূপসীকে আর পাওয়া যায় না। ডাকছে ওরা বনে পাহাড়ে রূপসী—ডাকটা শূন্য উপত্যকায় ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে আসে, রূপসী আর নেই। সে যেন অসীম শূন্যে মিলিয়ে গেছে, নেত্যও খোঁজে দিদিকে, কালী কুকুরটাও এদিকে ওদিকে দৌড়ায়, সেই ডোবার ধারে বনেও আসে, কিন্তু কোন চিহ্নই নেই। গদাই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে—কাঁদছে কুসুম, নেত্যর মনে সেই তরুণের কথা। দিদি যেন ওর সঙ্গে থাকলে বদলে যেত, দিদিটা খুব স্বার্থপর—তাকে ছেড়ে চলে গেল।

রূপসী বোঝেনি এতো যাদুকরের এক খেলা। সবকিছুই সে অদৃশ্য করে দিতে পারে। বদলে দিতে পারে। তরুণও তাই করেছে। রূপসীকে শহরে এনে অন্ধকারের জগতেই অদৃশ্য করে দেয়, অবশ্য তার জন্য সে বেশ কিছু টাকাই পেয়েছে, স্বপ্ন দেখে আরও অনেকটা পাবার। তার ব্যবস্থাও করে ফেলেছে সে। তার জন্যও কম নয়—অনেক টাকাই পাবে।

শহরের পরশমল শেঠ ধনী ব্যবসায়ী, ইদানীং সে সুন্দর পরিবেশে একটা ফার্ম হাউস করার কথা ভাবছে, ওই যাদুকরের দলের মালিকও সে, তাই তরুণও এখানে আসে, সেই সন্ধান দেয় ওই বনপর্বত ঘেরা সুন্দর উপত্যকার। খবর দেয়। পরশমল ফের হাঁক পাড়ে সরেজমিনে জায়গাটা দেখতে—খোঁজ খবর দিতে।

পরশমলের লোকবল—অর্থবলও আছে, তাই সব খবরই পায় সে, আর কিছু টাকার বিনিময়ে বনবিভাগ থেকে ওখানে ট্যুরিস্ট স্পট বানাবার অনুমতিও পেয়ে যায়।

গদাই কুসুমরা রূপসীর খোঁজখবর করেও কোন সন্ধানই পায়নি, নেত্যও বুঝেছে দিদি তার ফিরবে না, ক্ষেতের ধান পেকেছে, টিয়াপাখির ঝাঁক নামে, কালী তাড়া করে তাদের, ওরা ধান কাটছে।

হঠাৎ দু’তিনটে জিপ ওই পাহাড়ী পথে এসে তাদের ক্ষেতের ধারেই থামল, বনবিভাগের উর্দিপরা লোকজন-পুলিশও নামে, সঙ্গে শেঠ পরশমল, বনবিভাগের লোকরাই বলে—এসব ফরেস্টের জায়গা, তোমাদের কে এখানে বসতে বলেছে, বেআইনী দখল করেছ, ছেড়ে দাও, না হলে জোর করে তুলে নিয়ে যাব থানায়।

গদাই চমকে ওঠে, তার চোখের সামনে যেন অন্ধকার নামছে, এই মাঠ জমি-ফসল-এতদিনের এত চেষ্টা সব অর্থহীন হয়ে গেছে।

কুসুম কেঁদে ওঠে—এ জমি আমরা হাসিল করেছি কত কষ্টে।

ওরা অনড়, কে গর্জে ওঠে চলে যাও—না হলে তুলে নে গিয়ে জেলে পুরে দেব, ওঠ ওঠ জমি থেকে, জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে যাও এখান থেকে।

কুসুমের চোখে জল, গদাই পায়ে পায়ে উঠে আসে নিজে জমি থেকে। বাতাসে দুলছে সশীষ পাকা ধানের মঞ্জরী, আখ খেতে এসেছে সবুজের আভাস—এই মাটিতে তাদের কোন হকই নেই।

আবার সেই বাঁকের দুদিকে সংসার, তাদের ঘরগুলো টিলার উপরে থেকে পিছন ফিরে দেখে সেই সবুজ উপত্যকাকে শেষ বারের মত, ওরা এসেছিল চারজন, আজ ফিরে চলেছে তিনটি প্রাণী—আর সেই কুকুরটাও, কোথায় যাবে তা জানেনা ওরা, হাটতলার মন্দিরে ঘণ্টা বাজে।

গদাই বলে—বৌ তুর ভগমান সত্যিই নাইরে, গরীবের জন্য একটুকু ঠাঁই, দুমুঠো অন্ন—ভগমান কোন কিছুই নাই। তারা সবুজ উপত্যকা থেকে বিতাড়িত হয়েছে আবার মানুষের কঠিন রুক্ষ্ণ বাস্তব জগতে যেখানে সবুজের কণামাত্র স্নিগ্ধতা-আশ্বাস কিছুই নেই তাদের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *