মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই
শিক্ষা কথাটা ল্যাটিন ব্যুৎপত্তি, যাকে আমরা এডুকেশন বলি, তা হচ্ছে, ই ডিউকো মানে টু ব্রিং আউট’ অর্থাৎ বার করে আনা। ছাত্রের ভেতরে সুপ্ত যে ক্ষমতা তাকে বার করে আনা সে কোন ক্ষমতা? তার চিন্তার ভিতর দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে জীবন পরিচালনা করার ক্ষমতাকে উদ্বুদ্ধ করাটাই হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষাবিদদের কাজ এবং শিক্ষণের সেই হচ্ছে উদ্দেশ্য। এই নিরিখে যদি আমরা বিষয়টাকে বিচার করি, দেখতে পাব, সঙ্ঘ পরিবার শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তনের নামে যা করছে, সেটা হচ্ছে ঠিক উল্টো। ছাত্রের ভিতরে যে যুক্তিমত্তা, বুদ্ধিমত্তা এবং তর্ক করে গ্রহণ করার যে প্রবণতা তাকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে বা অবনত করে বাইরে থেকে তাকে এমন কিছু উপকরণ দেওয়া হচ্ছে, যা ইতিহাসসম্মত নয়, বিজ্ঞানসম্মত নয়, তবু ছাত্রের মধ্যে তা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে তার স্বাধীনচিন্তা করার ক্ষমতাকে প্রতিহত করে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে ভবিষ্যৎকে সে নিজের মতো করে জানতে বুঝতে বোঝাতে পারবে না।
কেন আমি এমন কথা বলছি— তার কারণ, বাইরে থেকে যে উপকরণ তাকে সরবরাহ করা হচ্ছে বা করার চেষ্টা হচ্ছে, সে তো স্বাধীন চিন্তাকেই খর্ব করার জন্য। তার প্রমাণ,— বিজ্ঞান প্রসঙ্গে এরা বলছে, খ্রিস্টীয় প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে অথর্ব পরিশিষ্টের যে ষোলোটা সূত্র ছিল, সে ষোলোটা সূত্রের মধ্যে বর্তমান বিজ্ঞানের যা কিছু উদ্ভাবন তা নিহিত আছে। এ কথা যে কত বড় মিথ্যে তা যে কোনও সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ বুঝতে পারবে। কারণ, এ কথা স্বীকার করা মানে, গত সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে কোনও উন্নতিই হয়নি বিজ্ঞানের। এরা সেই জাতের লোক, যারা বলে থাকে, প্রাচীন ভারতে এরোপ্লেন ছিল, কারণ সাহিত্যে পুষ্পক রথের বর্ণনা আছে। পৃথিবীতে মাছও আছে মেয়েও আছে কিন্তু মৎস্যকন্যা নেই, সেটা আছে কবির কল্পনায়। উঁচু বাড়ি থেকে পৃথিবী যেমন দেখায়, উঁচু পাহাড় থেকে পৃথিবীকে যেমন দেখায়, তার থেকে পুষ্পক রথ কল্পনা করা যায়। কেন বলছি ভারতে পুষ্পক রথ ছিল না, তার সোজা কারণ, পুষ্পক রথ তৈরি করতে যে পদার্থবিদ্যার উন্নতির দরকার ছিল, বীজগণিতের চর্চার প্রয়োজন ছিল, ভারতে বহু দিন আগেই তা থেমে গেছে। কাজেই বীজগণিত নেই পদার্থবিদ্যাও নেই, সুতরাং পুষ্পক রথ কোথায় পাবে? আকাশ থেকে তো কেউ ফেলে দেয়নি। বড় কথা হচ্ছে, প্রাচীন ভারত যদি এরোপ্লেন তৈরি করতে জানত, তা হারিয়ে যেত না। মানুষের পক্ষে কল্যাণকর কোনও কিছুই হারিয়ে যায় না। দেখুন আমরা সাধারণ কথায় বলি, আদা, তুলসীপাতা, মধুর রসে সর্দিকাশে কমে, সে তো হাজার বছর ধরে চলেছে, হারায়নি। মানুষ তার হিতকর কোনও জিনিসকে হারিয়ে যেতে দেয় না, ভোলে না।
বিজ্ঞান প্রযুক্তি বহুদিন ধরে বন্ধ হয়েছিল। প্রমাণ, আমরা জানি সমুদ্রযাত্রা করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত; বাইরে থেকে জ্ঞান আহরণ বন্ধ হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে বহির্জগতের সঙ্গে যে নৌ-বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল প্রাগার্য যুগে, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে, তাতে মিশর, চিন, আলেকজান্দ্রিয়া, পারস্য, রোম, দক্ষিণ ইয়োরোপ, গ্রিস, আলবেনিয়া পর্যন্ত বাণিজ্য ছিল। এতে শুধু পণ্যের বিনিময় হত না, চিন্তা ও ভাবনারও বিনিময় হত। বাইরের জগৎ থেকে আমরা পেয়েছি অনেক নতুন চিন্তার উপাদান, দিয়েওছি। আর্যরা আসার একটু পরেই এটা বন্ধ হয়ে যায়। তার কারণ, এরা নিরক্ষর ছিল; লেখাপড়া জানত না, বাণিজ্য করার বিদ্যে ছিল না। এরও কিছুদিন পরে এরা কিছু লেখাপড়া শিখে বাণিজ্য করে; এই বাণিজ্যও ধীরে ধীরে থেমে যায়। গুপ্তযুগের পরে কমে যায়, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে বহির্বাণিজ্য হয়, সেখানে ভারত দিয়েছে অনেক, পায়নি কিছুই
নতুন চিন্তা পায়নি। দূরপ্রাচ্যেরও নতুন কিছু দেবার আন্তর-সম্পদ ছিল না। এটা বিজ্ঞানের দিক থেকে ক্ষতিকর হয়েছে। শুধু পুষ্পক রথ ছিল বললে তো হবে না। রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, আয়ুর্বেদ, পদার্থবিদ্যা এ সবের প্রকৃত চর্চা বহুদিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পরে আমাদের দ্বৈপায়ন অর্থাৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ যে গ্রামীণ সভ্যতা সৃষ্টি হল, তাতে জেলে, কুমোর, কামার, নাপিত, মুচি নিয়ে যে গ্রাম সৃষ্টি হল, তাতে কারও গ্রামের বাইরে যেতে হবে না। গ্রামে এই সংকীর্ণতা বাড়ছিল। স্মৃতির চর্চায় আমরা এটা বেশ বুঝতে পারি। শাস্ত্র, ধর্মগ্রন্থ, নিবন্ধ শাস্ত্রের মধ্যে ক্রমশ সংকীর্ণতা বাড়ছে এবং এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতা একেবারেই কমে যাচ্ছে। ধরুন, রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতি তত্ত্বে নানা রকম স্মৃতির চর্চা আছে যা আজ পড়তেও লজ্জা করে। যেমন, মঙ্গলবারে লাউ খেতে আছে কি না, বুধবারে কুমড়ো খেতে পারে কি না, এই সব চর্চা, এবং সুস্থ পরিণত বয়স্ক পুরুষ চর্চা করছে বিধবা মাথায় কতটা তেল দিতে পারবে, সে তেল কপালে এসে পড়বে কি না। সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তেলটা যেন কপালে গড়িয়ে না পড়ে। ভাবতেও অবাক লাগে, লজ্জা করে এদের এর থেকে বেশি চিন্তার দরকার ছিল না? বিধবা যত বেশি মাথায় তেল দিক না, তাতে সমাজের কী এসে যায়? এ কোন সমাজ যাতে বিধবা মাথায় তেল দিলে মানুষের কিছু এসে যায়? এক কথায় বিজ্ঞানমনস্কতা একেবারেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ অত্যন্ত সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে চিন্তাভাবনাকে আবদ্ধ রেখেছিল। এরা সেই অবিজ্ঞান চর্চাকে বিজ্ঞান বলছে।
মুঘল আমলে আবার বিজ্ঞানচর্চা কিছুটা শুরু হয়, ব্রিটিশ আমলে ভাল করে হয়। আর এদের ইতিহাসচর্চা সম্বন্ধে তো আমরা সকলেই জানি, সমুদ্র গুপ্তের বিষ্ণু স্তম্ভটাই হচ্ছে কুতুব মিনার। সাতশো চল্লিশ বার আরব থেকে আক্রমণ হয়েছিল ভারতবর্ষে এবং প্রতিবারই প্রতিহত করেছিল হিন্দু রাজারা, বীর ছিল তারা। পৃথ্বীরাজ পরাজিত হয়নি, জিতেছিল। এ সব টিভিতেও দেখাচ্ছে। পাঠ্যগ্রন্থেও বলছে। পাঠ্যগ্রন্থে তো ইতিহাসকেই তছনছ করে ফেলছে, তথ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন ইতিহাস লিখছে, শেখাচ্ছে অনৈতিহাসিক, অবৈজ্ঞানিক এই মানসিকতা শিক্ষার পরিপন্থী। কারণ, শিক্ষা হচ্ছে সুস্থ যুক্তিপূর্ণ মানসিকতার নির্মাণ। যে কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
এরা আজকাল সরস্বতী বন্দনা দিয়ে লেখাপড়া শুরু করতে বলে, প্রথমত সরস্বতী এ দেশের সব মানুষের দেবী নয়, স্বীকার্যও নয়। যেমন মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ব্রাহ্ম— এরা কেন সরস্বতী বন্দনা করতে যাবে? বন্দেমাতরম এরা ভয়ঙ্কর ভাবে প্রচলন করতে চাইছে। ‘ত্বং হি দুর্গা দশ প্রহরণ ধারিণী’ এ সব কথা কেবল বলবে একজন মুসলমান বা খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ, শিখ? তারা তো বিশ্বাস করে না। অন্যে যা বিশ্বাস করে না তাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার উগ্র প্রবণতার সঙ্গে শিক্ষার মৌলিক বিরোধ আছে। বিশ্বাস চাপিয়ে দেবার অন্ধ অযৌক্তিক এই প্রবণতা থেকে দু’বেলা টিভিতে দেখা যায় সিঁদুর, চন্দনের ফোঁটা দিয়ে পুরুষরা ঘোরাফেরা করছে। এদের নাম করার প্রয়োজন নেই। এরা কি একবারও ভেবেছে, সিঁদুর খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর আগে চিন থেকে ভারতবর্ষে পৌঁছয়নি। ওরা কি ভেবেছে, চন্দন জন্মায় দাক্ষিণাত্যে, আর্য সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল আর্যাবর্তে। চন্দন এসে পৌঁছেছে অনেক পরে। ওরা তো বৈদিক সভ্যতা ফিরিয়ে আনছে ঘটা করে। কিন্তু এর সঙ্গে সিঁদুর চন্দনের কিছুমাত্র যোগ নেই। এ তো সে দিনের জিনিস।
***
এরা এখন বলছে হিন্দু সভ্যতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সভ্যতা, প্রাচীনতম সভ্যতা। শ্রেষ্ঠ কথাটা আপেক্ষিক। শ্রেষ্ঠের যুক্তি ভাল, আরও ভাল, সবচেয়ে ভাল। এ কথা বলতে গেলে তাবৎ ধর্ম সম্বন্ধে জানতে হয়। এদের আছে সেই সুগভীর প্রজ্ঞা? ভারতবর্ষে কম লোকেরই, খুব কম ঐতিহাসিকেরই এ নিয়ে চর্চা করার, আপেক্ষিকতার বিচার করার ক্ষমতা আছে। তাঁদের আঙুলে গোনা যায়। এঁরা তো বেশির ভাগই মিথ্যা কথা বলেন, জেনেশুনে মিথ্যা বলেন। আর প্রাচীনতম সভ্যতা বললে তো বিরাট মিথ্যে কথা বলা হয়।
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে আর্য সভ্যতা হচ্ছে কনিষ্ঠতম। আসিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া, মিশর, চিন, গ্রিস, রোম; এদের সভ্যতা অনেক পুরনো সভ্যতা। কত হাজার বছরের লিখিত তথ্য অনেক সভ্যতাতে পাওয়া যায়। আর্যরা এ দেশে এল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে, লিখতে শিখল আরও অনেক পরে, কাজেই লিখিত আর্য সভ্যতা অনেক পরে। বেদকে যদি শ্রুতি বলে ধরেও নিই, দ্বাদশ শতকের আগে বেদের তো কোনও চিহ্নই পাচ্ছি না। কাজেই প্রাচীনতম গ্রন্থ বলছে কেন? প্রাচীন বললে মানুষের মনে একটা সম্ভ্রমের উদ্রেক হয়, প্রাচীনতম বললে আরও তীব্র হয় সেটা। এ মিথ্যেটা দরকার বিজ্ঞানমনস্কতা নেই বলে।
আমাদের যদি রবীন্দ্রনাথকে সম্মান জানাতে হয়, তবে কি বলতে হবে তিনি বেঁচে আছেন? আমায় যদি প্রপিতামহকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়, তো বলতে হবে তিনি বেঁচে আছেন? অনেক মৃত লোককে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। কেন আমরা বলতে পারব না প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় উৎকর্ষ ছিল, ঐশ্বর্য ছিল, অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। আমরা বলব, খোলা চোখে বলব, ভুলগুলোকে ভুল আর ঠিকগুলোকে ঠিক বলব। পৃথিবীকে ভারতবর্ষ অনেক কিছু দিয়েছে, তা নিয়ে মাথা উঁচু করব। যেখানে ভুল করেছে তা বর্জন করব। এই খোলা দৃষ্টি দিয়ে শ্রদ্ধা করব, চর্চা করব— ভারতের প্রাচীন সভ্যতাকে। এটা করতে ওরা রাজি নয়।
ওরা ধরেই নিয়েছে ভারতীয় সভ্যতাটাই প্রাচীনতম। কাল্পনিক ভাবে ধরে নিয়েই দুটো জিনিস প্রবর্তনের চেষ্টা করছে। প্রথমত, সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হবে। এ তো পাগলের প্রলাপ। এদের মতাবলম্বী বেশ কিছু লোক বলে, ভারতবর্ষে কয়েকশো লোক এখন সংস্কৃত ভাষাকে মাতৃভাষার মতো ব্যবহার করে থাকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদা এ কথা বলা হয়েছিল, উদ্দেশ্য আমি। আমি সংস্কৃতকে মৃত ভাষা বলে অভিহিত করি। কেউ কেউ বলে, যেহেতু কিছু লোক কথা বলে এ ভাষায় তাই এটা জীবিত ভাষা। আমি বলেছি, যদি ধরেও নিই তা হলে তারা বাজারে আলু, পটল কেনে কোন ভাষায়? ট্রেনের টিকিট, ডাক টিকিট কেনে কোন ভাষায়? তার মানে তারাও জানে আর একটা ভাষা, দৈনন্দিন কাজ চালায় সে ভাষায়। জীবিত ভাষায় তারা প্রয়োজন মেটায় প্রতিদিনের। ইউরোপে এমন অনেক মানুষ আছে যারা অনায়াসে অনর্গল ল্যাটিন, গ্রিক ভাষায় কথা বলে। তারা কি বলবে সেটা তাদের মাতৃভাষা? জীবিত ভাষা? চর্চা করলে আমরা যে কোনও ভাষায় কথা বলতে পারি। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে অনেকে অনর্গল সংস্কৃত ভাষা বলতে পারে— তাতেই সেটা তাদের মাতৃভাষা হয় না। জোর করে সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দেবার অর্থ কী?
যে ছেলেটি বায়োকেমিস্ট্রি পড়বে বা যে মেয়েটি ডাক্তারি পড়বে, ওকালতি করবে, তাদের তো সংস্কৃত পড়ার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কোনও প্রয়োজন নেই। যদি কোনও প্রয়োজন থাকে, সংক্ষিপ্ত চালু করে শব্দসম্ভার, ব্যাকরণটা শিখিয়ে দেওয়া যায়। যার প্রয়োজন, সে সেটা শিখবে কিন্তু সকলের ওপর কোনও ভাষাই চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ইউরোপের শিক্ষাব্যবস্থায় কোথাও গ্রিক, ল্যাটিন ভাষা জোর করে শিখতে বাধ্য করা হয় না। কারণ মানুষের শিক্ষণীয় বিষয় বেড়েই চলেছে, তার মধ্যে যদি সংস্কৃত ভাষা শিখতে হয় বাধ্যতামূলক ভাবে, তবে তো চব্বিশ ঘণ্টায় দিন চলবে না। তাই মানুষ সদ্ধি প্রণোদিত হয়েই একে বাদ রেখেছে। যারা শিখবে, শখে শিখবে। কিছু লোক চিরদিনই শিখবে। বলতে লজ্জা করে, পাশ্চাত্য জগতে আসিরিয়ান, ইজিপশিয়ান, সুমেরিয়ান ভাষা শিখবার জন্য যে উন্নত চর্চা রেখেছে, উন্নত মান রেখেছে, সে উন্নত মানে সংস্কৃত ভাষার চর্চা ভারতে কোথাও হয় না। পুণেতে অনেকটা আছে আর কোথাও নেই। চেষ্টাও নেই। তাই এ কথা বলে লাভ নেই যে, সংস্কৃত শ্রেষ্ঠ ভাষা, প্রাচীনতম ভাষা। জীবিত ভাষা
এ সব কোনওটা না বলেও সংস্কৃত ভাষার চর্চা করা যায়। প্রথমত সেটা বৈজ্ঞানিক চর্চা হবে, ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। অন্য অনেক প্রাচীন ভাষার সঙ্গে তুলনা করেই সংস্কৃতকে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ভারতের অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সামাজিক খবরগুলো জানতে হবে। অথচ এ সব কোনওটাই এরা করে না। এরা মনে করে, সংস্কৃত অনেকটা ‘হট হাউস’-এ তৈরি ফলমূলের মতো, চারদিক বন্ধ করে সংস্কৃত চর্চা করা— তা হয় না। এবং তা মিথ্যা।
এই সংস্কৃতকে ওরা আবশ্যিক শিক্ষণীয় বলে চাপিয়ে দিতে চায়। যার ফলে ছেলেমেয়েদের পাঠ্যতালিকা থেকে অনেক কিছু বাদ দিতে হবে। কারণ, সময়ের নির্দিষ্টতা আছে। ফলে এ এক আজগুবি প্রচেষ্টা, সমাজের সব দিক থেকে ক্ষতিকর হবে। এটা জেনেই করছে সঙ্ঘ পরিবার।
ওরা আরও বলে, সংস্কৃত ভাষা ধর্মের বাহন— কতক দূর পর্যন্ত কথাটা ঠিক। প্রাচীন ভারতে ধর্মের বহু গ্রন্থ সংস্কৃতে রচিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে, নাস্তিকতার স্বপক্ষে অনেক বইও সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে। চার্বাক, বৃহস্পতি আছে, জয়রাশির তত্ত্বোপপ্লবসিংহ যা নাস্তিক্যবাদ প্রচার করে, তাও সংস্কৃত ভাষায় আছে। বৌদ্ধ, জৈন, যা বেদকে স্বীকার করে না তাও সংস্কৃতে রয়েছে। উল্টোদিকে বলতে হবে, ভারতীয় ধর্মের বহু গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষা বাদে অন্য ভাষাতে আছে, আজও লেখা হচ্ছে। পালি প্রাকৃত আঞ্চলিক ছাড়া ইংরাজি ভাষাতেও লেখা হয়। তথ্যমূল্যের দিক থেকে তার গুরুত্ব কম নয়। ন্যায় শাস্ত্রে আমরা যাকে বলি অ-ব্যাপ্তি আর অতিব্যাপ্তি, সংস্কৃতে এ দুটোই হয়েছে— সংস্কৃতকে ধর্মের বাহন বললে অ-ব্যাপ্তি হয়। কারণ, সংস্কৃতের বাইরে অন্য ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। আর অতি-ব্যাপ্তি হয় কারণ, সংস্কৃতে ধর্ম ছাড়াও আরও বহু কিছুই রয়েছে। সংস্কৃতে ডিকশনারি লেখা হয়েছে, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য সবই লেখা হয়েছে। তাই সংস্কৃতকে ধর্মের বাহন বললে সংস্কৃত ভাষার অপমান করা হয়।
একটি ভাষা সাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অর্থই হচ্ছে, মুষ্টিমেয়র হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার একটা চেষ্টা। এই মুষ্টিমেয় হচ্ছে সংস্কৃত জানা কিছু ব্যক্তি। আপনারা জানেন কি না জানি না, যাঁরা টিভিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, অর্গানাইজার পত্রিকায় দাপিয়ে বেড়ান— এঁদের অনেকেই সংস্কৃত জানেন না। তাঁদের লেখা পড়েই বলছি। ভুল জানেন। কষ্ট করে সংস্কৃত শেখেনও না। তবু ওরা বলছে সংস্কৃত পাঠ্য করো। জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষের জন্য নয়, মানুষ এর ফলে বিশ্বাস করবে সংস্কৃত হচ্ছে হিন্দুধর্মের বাহন। ভারতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে হিন্দুধর্ম। এ দুটো মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত করে আগামী প্রজন্মের মনকে তৈরি করা। তারা এ জন্যই সংস্কৃত পড়বে এবং হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে মনে কোনও সন্দেহকে স্থান দেবে না।
***
এরা একই সঙ্গে বলছে, হিন্দুত্বচর্চা ও বেদচর্চা করতে হবে। আমরা জানি বেদপাঠের দুটো দিক আছে। একটা প্রকরণ ও অন্যটা শিক্ষাগত। অর্থাৎ একদিকে বেদের বিষয়বস্তুকে জানা আর একটা বেদের যজ্ঞ ও বৈদিক ধর্মকে প্রবর্তন করা। এ দুটোই ওরা করতে চায়। ২৫-৩০ বছর আগে পুনেতে এক ডাচ সাহেব যজ্ঞের ছবি তুলেছিলেন, এত হতাশ লাগে তা দেখলে— কারণ, যজ্ঞ সম্পর্কে এক মহিমান্বিত চিত্র আমাদের মনে রয়েছে। যখন দেখি, হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পরে খালি গায়ে লোকেরা কাঠ ঘষে ঘষে আগুন জ্বালছে, একটা কুণ্ডের মধ্যে দুধ জ্বাল দিচ্ছে মন্ত্র বলতে বলতে, তখন আর যাই হোক সেই মহিমান্বিত রূপটা ধরা পড়ে না। মনে হয়, সাধারণ কিছু একটা করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানুষ কখন এই সব করত, কী জন্য করত— পৃথিবীর সমস্ত দেশে যজ্ঞ এই রকমই ছিল। পৃথিবীর প্রত্যেক সভ্যতার আদিতে কোনও না কোনও রূপে যজ্ঞ ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে আয়ারল্যাণ্ডে শেষ ‘হর্স-স্যাক্রিফাইস’ হয়েছিল— এটাকে ঠিক অশ্বমেধ বলা যাবে না। যদিও এতেও ঘোড়াকে নিহত করে যজ্ঞ করা হয়েছিল। যজ্ঞ ছিল। আমরাই একমাত্র যজ্ঞের ধারক-বাহক নই।
সেই যজ্ঞকে এরা আজকের দিনে প্রকরণ ভাবে আনতে চায় এবং যজ্ঞের বিষয়কেও এরা চর্চায় আনতে চায়। যজ্ঞ ছাড়াও বেদে যা লেখা আছে তাকেও এরা পুনঃপ্রবর্তন করতে চায়। এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া হয়তো অসঙ্গত হবে না, বেদের মধ্যেও বহু লোককে আমরা পাচ্ছি যাঁরা বেদের কথাও বিশ্বাস করতেন না। ইন্দ্র কে ছিলেন? ইন্দ্রকে কেউ জন্মাতে দেখেছে— ‘আমি নেম ভার্গব বলছি, ইন্দ্ৰ বলে কেউ নেই’, এ কথা ঋগ্বেদেই আছে। অথচ ইন্দ্র কিন্তু বেদের শ্রেষ্ঠ দেবতা, ঋগ্বেদের এক চতুর্থাংশ শুধু ইন্দ্রের উদ্দেশে প্রযোজ্য। আর নেম ভার্গব বলছেন ইন্দ্র নেই। অন্য ঋষিরা বলেছেন, বায়ু, পর্জন্য, মিত্র, সূর্য, অগ্নি এঁদের কেউ জন্মাতে দেখেছে? যে অগ্নিকে আমরা দেখেছি, দু’বেলা দেখতে পাই, তাকে জানি। সূর্য আকাশে ওঠে, তাকে জানি। কিন্তু সূর্য দেবতা, এ কথা কে বলে দিল? সূর্য যখন অস্ত যায় তখন কোথায় সে থাকে? আমি আক্ষরিক অনুবাদ বলছি। সূর্য যখন অস্ত যায়, সে কোথায় ঘুমোয়? তার বাসস্থান কোথায়? আমাদের প্রার্থনা যে দেবদেবীদের কাছে পৌঁছয়, কে বলে দিল? কাকে বলে দিল? আমাদের প্রার্থনা যে গ্রহণ করল— যজ্ঞ যে ভাবে করছি, তা গ্রহণযোগ্য কে বলে দিল? তারা যে গ্রহণ করে আমাদের ভাল করতে চায়, তার প্রমাণ কী? তাই বেদেই পদে পদে সন্দেহ। কারা করছেন? সেই ঋষিরা, এ তো বেদ থেকেই পাচ্ছি। এ কারণেই বেদ আমার কাছে এত মূল্যবান গ্রন্থ, এত ঐশ্বর্যময়। মানুষের আশঙ্কা, সন্দেহ, ত্রাস সবই বেদের মধ্যে নিহিত। আজকের সঙ্ঘ পরিবার যদি খোলা চোখে বেদ পড়ত, ওদের মোহমুক্তি ঘটত।
বেদে সাড়ে তিনটি সূক্ত রয়েছে রুদ্রের সম্বন্ধে, বলা আছে, হে রুদ্র আমাদের বাড়ির দ্বিপদ অর্থাৎ মানুষ, চতুষ্পদ অর্থাৎ পশুপাল এদের ওপর কোনও অস্ত্র নিক্ষেপ কোরো না। ঠিকানা দিচ্ছি, আমার শত্রুর বাড়ি গিয়ে ওদের নিকেশ করে দাও। এ কি কোনও উঁচু মানসিকতা— শত্রু ধ্বংস করে দাও, তার সন্তান ও পশুকুল ধ্বংস করে দাও। এমন বহু প্রার্থনা বেদে রয়েছে। আমি অমুক বাড়ির মেয়ে চুরি করতে যাব, রাত্রিটা যেন অন্ধকার হয়, মেয়েটার ভাইগুলো যেন জেগে না ওঠে, বাড়ির কুকুরগুলো যেন না চেঁচিয়ে ওঠে। খুব ভাল জিনিস? ভাল হোক মন্দ হোক ঘটত, পৃথিবীতে ঘটেছে। বেদে এই যে তথ্যদলিল রেখে গেছে, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। বেদ হচ্ছে একটা জীবন্ত সমাজের জীবন্ত দলিল।
এ ভাবেই বেদকে দেখা উচিত। ভালমন্দ সমস্ত প্রবণতা বেদের মধ্যে রয়েছে। ঈর্ষা, দ্বেষ, জিঘাংসা সব মন্দ প্রবণতা রয়েছে। এই তো বলেছে ‘কীকট’ সম্বন্ধে মানে আমাদের বাংলাদেশ বলা আছে কিং তে বৃদ্ধন্তি কীকটেষু গাবঃ— বাংলাদেশের লোক গরু নিয়ে কী করবে? কারণ, ওরা তো যজ্ঞ করে না। কারণ, গরুর একটাই কাজ, ঘিয়ের জন্য দুধ দেওয়া। তাই ইন্দ্র ওদের গরুগুলো নিয়ে এসে আমাদের দাও। একাধিক জায়গায় রয়েছে। কীকটের গরুগুলো কি কাজে লাগবে ওরা তো যজ্ঞ করে না, ওগুলো চুরি করে এনে দাও। ইন্দ্র চুরি করে এনে দিয়েছেন তাই অনেক জায়গায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ রয়েছে। এমন সূক্তের পর সূক্ত রয়েছে যেখানে রাজারা দান করেছেন তার লম্বা ফিরিস্তি। এতগুলো ঘোড়া, এতগুলো গরু, এত নারী, এত সোনা— পড়তে ভীষণ ক্লান্তিকর লাগে। কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ, যে মানুষের চিরকালের প্রার্থনা এতে রয়েছে, অন্নপূর্ণে এশো দেহি দ্বিষো জহি— এ প্রার্থনা স্বাভাবিক, চিরকালের, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। সমস্ত মানবিক প্রার্থনা রয়েছে বেদে। কিন্তু ওরা যে বেদ ফিরিয়ে আনতে চায়, তা গোবর-জল ছড়া দেওয়া এমন এক বেদ যার অধিকাংশই ত্যাজ্য।
সমস্ত ঋগ্বেদে চার ভাগের তিন ভাগই হচ্ছে অর্থনৈতিক দেনা-পাওনার। যেমন, হে দেবতা তোমাকে আমরা এই গরুর মাংস, এই রুটি, এই সুরা, দুধ-দই এই সব দিচ্ছি, তুমি তার বদলে এই শত্রুগুলোকে জয় করে দাও, পরমায়ু দাও, সন্তান দাও, পশুপাল বৃদ্ধি করো, আরোগ্য দাও। চার ভাগের তিন ভাগ এই কথা। বাকি এক ভাগের মধ্যে বহু সুন্দর জিনিস রয়েছে। খুব উঁচু চিন্তা রয়েছে, চমৎকার প্রকৃতি বর্ণনা। মানুষের সম্পর্কে মানুষের মঙ্গল কামনা। যে মানুষ মন থেকে বিশ্বাস করতে জানে, সন্দেহ করতেও জানে— সেই মানুষই। বেদে আমরা বিশ্বাসের কথাও পাই, সন্দেহের কথাও পাই। বেদে মানুষ ভালবাসতে ও জানে, হিংসে করতেও জানে, এ দুটোই পাই। বেদ এখানেই মহৎ যে, এ সব লুপ্ত করে দেয়নি। সন্দেহের কথাও উল্লেখ রয়েছে—। আর একটা প্রশ্ন হল, ওরা যখন যজ্ঞ ফিরিয়ে আনার কথা বলছে, তখন যজ্ঞে গো-হত্যা করতে হবে আর ওরা তো আবার গো-হত্যার বিরোধী। যজ্ঞে তো শয়ে শয়ে গো-হত্যা করতে হবে। দানদক্ষিণা বাদ দিলেও অনেক পশু মারতে হবে।
আজকে গো-হত্যা নিবারণের কথা কেন বলছে, যদিও গাভী-হত্যা কেউ করে না, হয় বলদ হত্যা, সেটা বন্ধ করতে চাইছে মুসলমানকে তার সস্তার প্রোটিন থেকে বঞ্চিত করার জন্য। এ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য নেই। যেমন সংবাদপত্রেই দেখেছি, দিল্লির চিড়িয়াখানায় পশুরা একদিন চব্বিশ ঘণ্টা চেঁচিয়েছিল একটানা, কারণ দুটো; স্টেশন থেকে দূরে পশু মারা হয়, গাড়ির টায়ার ফেটে যাওয়ায় মাংস আনা যায়নি। বেচারিরা খেতে পায়নি। কথা হচ্ছে, সেই গরু মেরেই খাওয়াচ্ছ, দিল্লিতে করা চলবে না। দিল্লিতে গো-হত্যা বন্ধ। দিল্লিতে ‘গোমাংস’ রান্না চলবে না। অথচ যে বেদ তোমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছ, তখন মানুষ গরু ছাড়া কিছু খেতেই জানত না, সে সমাজ প্রধানত গো-মাংসই খেত। যাজ্ঞবল্ক্য শতপথ ব্রাহ্মণে বলেছেন, এই কারণে গো-মাংস খাওয়া উচিত নয়, বলেও বলছেন, ‘আমি কিন্তু খাব, যদি রান্নাটা ভাল হয়।’ দেখুন মানুষের প্রবণতা কোথায়, তার রুচি আছে গো-মাংসে! সে তাই স্বীকার করছে আমি খাব যদি রান্নাটা ভাল হয়।
কেন তখন বলছে গো-মাংস খাওয়া বা গো-হত্যা করা উচিত নয়? কারণ, খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকে এ দেশে প্রথম লোহা আসে আর সপ্তম শতকের মধ্যে লোহার বহুল ব্যবহার হয়। সপ্তম শতকের গোড়ায় প্রথম লোহার লাঙলের ফলা এ দেশে পাচ্ছি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এর ফলে অল্প পরিশ্রমে অনেকটা জমি চাষ করা যায়। ফলে বলদের দাম অনেক বেড়ে যায়। বলদকে অযথা খুন করলে চাষে টান পড়ে। বলদের দ্বারা তারা অনেক জমি চাষ করবে। ওই সপ্তম শতকের সময় বাণিজ্য থেকে টাকা আসছিল, তা জমা হচ্ছিল একটি মুষ্টিমেয় সম্প্রদায়ের হাতে। এই সময়ই সমাজে আরও দুটো জিনিস ঘটে— এক, শ্রেণিবিভাগ বড়লোক এবং গরিব। এবং কায়িক শ্রম, বা হাতে পায়ে খাটা নিচু জাতের কাজ আর মাথা দিয়ে যে কাজ অর্থাৎ চিন্তা, তা উঁচু জাতের কাজ বলে মেনে নেওয়া। অর্থাৎ শ্রমের জাতি বিভাগ ঘটে, এখনও যার উত্তরাধিকার আমরা বহন করছি। যারা মাথায় কাজ করে, তাদের কাছে কায়িক শ্রম যারা করে, তারা হল ‘ওরা’ এবং যারা মাথা দিয়ে কাজ করি তারা হচ্ছি আমরা, এ ধারণা তো সুপ্ত আছে। সচেতন ভবে যদি শ্রেণি বিভেদের বিষকে ভিতর থেকে দূর করতে হয়, প্রথমেই এটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে— কারণ, এ ভাবনা প্রোথিত হয়ে আছে আমাদের চেতনায়।
সে যুগে যারা বহির্বাণিজ্য থেকে প্রচুর অর্থ করেছে, চাষ থেকেও যাদের প্রভূত আয় হচ্ছে, তাদের তো লোভ হয়েছে। দেখল, শতকরা নব্বই জনকে যদি বঞ্চিত করে, কার্যত আরও বেশি পঁচানব্বই-ছিয়ানব্বইজন না খেয়ে মাত্র পেটভাতায় কাজ করত, বাকি অল্প ক’জন টাকার অধিকার পেয়েছে। তারা এ সুখ ছাড়বে কেন? তাই লাভের লোভে বেশি চাষের জন্য, গো-হত্যা নিবারণের দিকে ঝুঁকল
***
একই সময় বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম একই কথা বলছে। অহিংসার কথা বলছে। আমরা যারা সাম্যবাদে বিশ্বাসী তারা জানি, এ কথা কেউ এমনি বলেনি। এর পিছনে অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল। কারণ, বলদগুলো বাজে খরচ হয়ে গেলে, যারা ধনিক সম্প্রদায় তাদের টাকায় টান পড়বে। চাষ থেকে শস্য এবং তা থেকে পণ্য উৎপাদন বাড়বে, কুটিরশিল্পে উৎপাদন বাড়বে। তার বদলে বেশি অর্থ আসবে বিদেশ থেকে। সে টাকা জমবে মুষ্টিমেয়র হাতে এবং সেই লোভ তাদের বেড়ে গিয়েছিল, এটা অহিংসা প্রবর্তনার একটা কারণ।
মহাভারতে একটা দীর্ঘ অধ্যায় রয়েছে তার বিষয় হল, বেদে যে যজ্ঞে পশুবধ করা হয় তা কি ধর্ম না অধর্ম? এটা সে সময়ের লেখা। বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম পরে পরেই এটা লেখা হচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে লেখা এগুলো। এ সন্দেহ সে দিন এসেছিল— এত পশুবধ করে যে যজ্ঞ করা হচ্ছে সে তো হিংসা। এ হিংসাকে ত্যাগ করে অহিংস হতে গেলে আজ তো যজ্ঞই হয় না? তাই দেখলাম, ধীরে ধীরে যজ্ঞ কিন্তু চলেও গেল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে আরম্ভ করে যজ্ঞটা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে দেখা যাচ্ছে, পূজা আর যজ্ঞ পাশাপাশি রয়েছে। এখন এরা যাকে হিন্দুত্ব বলে সেটা কিন্তু একেবারেই বেদত্বের বিরোধী। পৃথক মেরুর ব্যাপার।
কারণ, বেদের সময়ে মন্দির ছিল না। বিগ্রহ ছিল না— বেদে ‘বেদি পরিষ্কৃতাৎ ভূঃ’ মাটি পরিষ্কার করলে বেদি। সেখানে আমি প্রধানত গরুর মাংস, ইডলি; পুরোটা হচ্ছে দুধ, দই, ঘি, মাখন, ছানা, ছানার জল, সোমরস, মধু, সুরা দিয়ে। দেবতাকে বলছি, তোমরা এই সব নাও, আমাকে তার বদলে এই সব দাও। খাবার প্রশ্নেও দুটো বিষয় আছে। দেবতা এসে খাবেন এমন কথাও কোনও কোনও জায়গায় রয়েছে। এ দেবতা কিন্তু তার দৃষ্টিগোচর দেবতা নয়, কাল্পনিক, শুধু তার চেতনায় আনাগোনা করছে। কোথাও আছে পুড়িয়ে দিচ্ছি যজ্ঞে, এই ধূম তোমরা পান করো, পান করলে তার মধ্যে মাংসের স্বাদটা পাবে। এই ভাবে দেবতার কাছে নৈবেদ্য পৌঁছনো হত। আজ যদি এরা যজ্ঞ প্রবর্তন করতে চায়, গরু হত্যা করতে হবে, এ ছাড়া বহু সংখ্যক ছাগল, ভেড়া হত্যা করতে হবে। এটা তো ওদের আর একটা নীতি— গোহত্যা নিবারণ নীতিতে বাধছে। উল্টো দিকে যদি পুজো করতে চায়, সেটাও তো বেদের বিরোধী। তাতে মন্দির আছে, বিগ্রহ আছে, মানত আছে, আরও দক্ষিণা আছে, তীর্থ আছে, জপ আছে, হোম আছে, নানান ব্যাপার, শাপ-বর, স্বর্গ-নরক। বেদের যুগে, যজ্ঞের যুগে এ সব একেবারেই ছিল না। শাপ কিছু ছিল। বর-স্বর্গ-নরক কোনওটাই ছিল না। স্বর্গ-নরকের বদলে মৃত্যুর পরে একটা আবছা অন্ধকার জগতের কথা পাওয়া যায়। যেখানে পাছে যেতে হয় তাই প্রার্থনা আছে। তাই হিন্দুত্বের প্রণালীতে, প্রথাতে যা প্রার্থনীয়, সমস্তই বেদের বিরোধী। প্রশ্ন হল, এরা কোনটা চায় তা নিজেরাও জানে না। দুটো যে পরস্পরবিরোধী সে খবরও রাখে না।
স্বাভাবিক ভাবে মনে আসে, এমনটা কেন করছে? এই দুটোই কিন্তু ওদের হাতিয়ার। এর মধ্য দিয়ে ওরা যা দৃঢ় ভাবে প্রোথিত করতে চায়, তা হচ্ছে ‘তথাকথিত’ ধর্ম। তথাকথিত বলছি কেন? সংস্কৃতে আমরা পড়ি, সমাজকে যা ধারণ করে তাই ধর্ম। একটা সময় এমন হয়েছিল সব দেশেই, যখন আপনার কথার বিরুদ্ধে আমার কথা থাকার সম্ভাবনা ছিল, কাজেই তৃতীয় বা চতুর্থ লোক কার কথা মানবে— এই সংশয় থেকে বাঁচবার জন্য পৃথিবীর সব দেশের প্রথম ধর্মগ্রন্থকে বলা হয়েছে অপৌরুষের। বেদ কোরান বাইবেল আবেস্তা ও রেড ইণ্ডিয়ানদের যে ধর্মগ্রন্থ, এর প্রতিটিই অপৌরুষের। চিনা ধর্মগ্রন্থও। এ কথা না বললে দ্বন্দ্ব হবে, সংঘর্ষ হয়ে পরস্পর বিরোধিতার মধ্যে কোনও সংহতি হবে না— অর্থাৎ সমাজকে ধারণ করা যাবে না। ধারণ করার জন্য ধর্মকে মানতে হবে, তাকে সমাজ মানবে। তাই এ বার ওরা বেদের থেকেও নেবে ওইটুকুই যেটা নিজেদের অনুকূল, হিন্দু ধর্ম থেকেও নেবে ওইটুকুই যেটা নিজেদের অনুকূল। এটা একটা মিশ্র ব্যাপার।
আমরা জানি, যাঁরা সত্যকার ধর্মবিশ্বাসী তাঁরা বেছে নেন না, সবটুকুই নেন। তাঁর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন অন্ধতা থাকে। আবার যারা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে ধর্মকে নেয়, তাদের কাছে যুক্তির দাম বেশি, ধর্ম তাদের জীবনধারণের প্রক্রিয়ার অঙ্গ বা আনুষঙ্গিক বিষয়। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় ক্যামেরা ঘুরে ঘুরে যখন একজন হিন্দু বিধবা বুড়ির কাছে গিয়ে থামল— বলল, মাতাজি আজকে এই যে সাড়ে পাঁচঘণ্টা ধরে ভাঙার ব্যাপারটা ঘটল তা আপনার কেমন লাগল? তিনি কপাল চাপড়ে বললেন, ‘হায় রায়, তোমার এই দশা হল অন্যের বাড়ি ভেঙে তোমায় থাকতে হবে?’ এই মহিলা ধর্মবিশ্বাসী হিন্দু, এঁর কাছে রামের ব্যাপারটা একটা ধর্ম। যাঁর অপমান ঘটেছে সে দিন। তাই তিনি লজ্জিত, কুণ্ঠিত, অপমানিত বোধ করছেন। অথচ সঙ্ঘ পরিবারের এ অপমানবোধ নেই।
এরা মাঝে মাঝে বড় বড় কথা বলে, ভাল ভাল কথাও বলে। প্রসঙ্গ গণেশের দুধ খাওয়া। মুরলীমনোহর যোশী প্রথমে বললেন, গণেশ দুধ খায়নি, খেতে পারে না। প্রশ্ন এই যে, যুক্তিমনস্কতা আর পাঁচ জায়গায় তোমার থাকে না কেন? এটা বলেছিলেন নাম কিনতে। কারণ, এটা এত বড়ই অবিশ্বাস্য ব্যাপার, যেখানে সন্তানসম্ভবা নারী দুধ পায় না, শিশু দুধ পায় না, রোগী বৃদ্ধ দুধ পায় না, সে দেশে এক লক্ষ লিটার দুধ দিব্যি খরচ হয়ে গেল, এ ঘটনা তো সুস্থ-বুদ্ধির মানুষ বিশ্বাস করতে পারবে না। আবার একই সময়ে লণ্ডনে, নিউ ইয়র্কে, মধ্যপ্রাচ্যে ভারতে গণেশ দুধ খেয়ে বসল। এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কাজেই মুরলীমনোহর যোশী এ কথা বলেছেন। যখন রূপ কানোয়ারকে খুন করে সতী করা হল, প্রথমে শিবসেনা কিন্তু বলেছিল, কাজটা ভাল হল না।
মাঝে মাঝে এই ভাবে আমাদের ধোঁকা দেওয়া হয়। যাতে আমি আপনি মনে করি, এরা যুক্তি নিয়েই চলে। ঘটনা বিপরীত। এরা যুক্তি নিয়ে চলে না। ওরা জানে হিন্দুত্ব আর বেদত্ব পরস্পরবিরোধী। জেনেই বলে। ওরা কি জানে না, বেদে বলা হয়েছে খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে? বেদে আছে, ‘ভুত্ত্বা উচ্ছিষ্টং বধ্বৈ দদ্যাৎ’। স্বামীর এঁটো খেতে হবে এ শর্তে আজ কোনও মেয়েই বিয়েতে রাজি হবে না। এবং বলা আছে— যাতযামানি বস্ত্রো পানস্থ ত্ৰাণি ভত্যায় দেয়ানি। অর্থাৎ যে বস্ত্ৰ-জুতো-জামা-ছাতা ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে গেছে, সেটা ভৃত্যকে দেবে। ভৃত্য সেটা নিয়ে কী করবে? মাথায় করে রাখবে? ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য জিনিস নেবে, এই শর্তে আপনি আজকে ভৃত্য পাবেন না। আমি দুটো ছোট্ট উদাহরণ দিলাম। কাজেই বেদ আজকে মানা সম্ভব? বলা হয়েছে, একটি নারীর পক্ষে একটি পুরুষ যথেষ্ট, একটি পুরুষের পক্ষে দুটো নারী প্রয়োজন। ভোগ্য নারীর সংখ্যাতে চার থেকে চারশো পর্যন্ত আছে।
আজকের সংবিধানে যদি কোনও পুরুষ দু’টি তিনটি বিবাহ করতে চায়, পারবে? তাই মনে রাখতে হবে, বেদকে ফিরিয়ে আনার মানে কিন্তু এত সব। বেদে ঋত্বিক অর্থাৎ পুরোহিতকে দক্ষিণা দেওয়া হচ্ছে শয়ে শয়ে নারী এবং তাদের জাতিভেদ করা আছে, কুমারী, স-পুত্রা এবং অ-পুত্রা। প্রশ্ন, এত নারী নিয়ে পুরোহিত কী করবে? কিছু দাসী হবে, কিছু ভোগ্য হবে, তারা আস্তে আস্তে গণিকালয়ে যাবে ঘুরপথে। কিন্তু এই জিনিস সমাজ তো মেনে নেয়নি। তারা গণিকাকে নিন্দেই করেছে, ভাল বলেনি। এই ভাল না বলাটা আজকেও রয়েছে। রাস্তাটা কিন্তু খোলা রয়েছে, যজ্ঞ করে যদি এ ভাবে নারীদের দক্ষিণা দিতে হয় শয়ে শয়ে, তা হলে অনিবার্য ভাবে তারা শেষে গণিকালয়েই ঠাঁই পাবে। বলা আছে, এত শূদ্র, এত নারী, গরু, সোনা, ছাগল, এত জমি দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নারীও। আজকের দিনে এ কথা তো সংবিধানবিরোধী। কাজেই এ কথা তাদের কাল্পনিক, শুধুই যজ্ঞের মহিমা প্রচার করার জন্যই এ সব কথা তারা বলে।
***
সবশেষে আসা যাক যজ্ঞের মহিমা প্রচার করার উদ্দেশ্যটা কী? সত্যি কি এরা যজ্ঞে বিশ্বাস করে? যে মানুষ ভগবানকে বিশ্বাস করেন, তিনি তো মনে করেন ভগবান বিশ্বস্রষ্টা, যিনি হিন্দুকেও সৃষ্টি করেছেন, মুসলমাকেও সৃষ্টি করেছেন। তিনি কি করে মুসলমানকে মারেন? সেই একজন নিরপরাধ মানুষ— যিনি আঠারো বছর ধরে কুষ্ঠ রোগীদের সেবা করছিলেন, সেই কুষ্ঠ রোগী যাদের আমরা ছুঁই না— কী করে তাঁকে ও তাঁর দুই নাবালক শিশুপুত্রকে পুড়িয়ে মারে? এ কোন ধর্মের বিধান? কোন ধর্মে বিশ্বাস করলে এ জঘন্য কাজটা করা যায়? আজ যতই ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করা হোক, ‘রিপোর্টে আমরা সকলেই জানি, ‘জয় বজরঙ্ বলী’ ধ্বনি দিয়ে আক্রমণ শুরু হয়েছিল। গুজরাতে ঝুপড়ি পোড়াবার আগে একটি একটি করে বাইবেলের পাতা ছিঁড়ে তার ওপর বুট পরে মাড়িয়ে গিয়ে ঝুপড়ি পোড়ানো হয়েছে। এ তো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। আজকে আপনি কল্পনা করুন, কোনও হিন্দুর একটি বস্তির ঘরে সযত্নে রক্ষা করা গীতার পাতা এই ভাবে মাড়িয়ে দরিদ্রদের সব পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এরা বলেছিল, খ্রিস্টান ধর্মের উপাসনা ঘরে উপাসনা হয় না, ওখানে সুরাপান হয়। কিছু জানে না। সমস্ত ক্যাথলিক চার্চের কোথাও সমবেত ধর্মমণ্ডলী সুরা পান করেন না, তাঁদের হয়ে পৃথক ভাবে পুরোহিত সামান্য সুরাপান করেন। এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতে, এতটুকু পাত্রে যতটা দ্রাক্ষারস (সুরা নয়) দেওয়া হয় তাতে নেশা হয় না। এই কথা যারা বলছে তাদের ধর্মে কিন্তু ‘কারণবারি’ পানের কোনও পরিমাণ নেই। তারা কালীপুজোর সময় প্রচুর ‘কারণবারি’ পান করতে পারে, নিষেধ নেই। ভণ্ডামিটা থাকলে তার সঙ্গে ধর্মকে না জড়ানোই ভাল। এরা ধর্মকে জড়াচ্ছে কেন? তাতে ইষ্টসিদ্ধি হবে। ধর্ম এখনও ভারতবাসীর মনে এমন অনুরণন তোলে। সলজ্জ ভাবে স্বীকার করি আমরা, বামপন্থীরা তার বিকল্প এখনও দিতে পারেনি। আর পারেনি বলেই ওরা সেই অনুরণনটাকে মূলধন করে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। তাতেই যত রকম অপকর্ম ধর্মের নামে চালানো যেতে পারে। এই ধর্মে যদি ডান হাত দিয়ে বেদ দিয়ে আসে তবে তাই হোক, যদি বাম হাতে হিন্দুধর্ম আসে তবে তাই হোক। যতক্ষণ কর্ম মানুষকে অসচেতন, অন্ধ রেখে মূঢ়, যুক্তি থেকে বিচ্যুত করবে ততক্ষণ সে ধর্মকে এরা লালন করবে।
কদিন বাদে সকলে একটা বাক্সে একটা কাগজ ফেলে দেবেন। ব্যাপারটা কিন্তু সেইখানে চুকে যাবে না। সে কাগজ ফেলার ভিত্তিতে কিন্তু নির্ধারিত হচ্ছে— আজকে যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে আমার আপনার বাড়ি থেকে, ঝুপড়ি বস্তি থেকে, তাদের ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হবে এই কাগজ ফেলায়। তারও আগে আমার মধ্যে আপনার মনের মধ্যে নির্বাচন ঘটছে বা আমরা মনে মনে ঠিক করছি, আমরা এই অতলস্পর্শী খাদের মধ্যে পরবর্তী প্রজন্মকে ফেলে দেব, না যে দিকে আলো, যে পূর্ব দিকে সূর্য ওঠে সে দিকে আগামী প্রজন্মকে আমরা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব? দু’-দিকই খোলা আছে। এ বার না হলে পরের বার। না হলে পরের পার। এই সংগ্রামটা আমাদের করতেই হবে।
ঋগ্বেদে রয়েছে সাংমনস্য সূক্ত— যেটা করে গান গাই আমরা ঋগ্বেদের শেষ সূক্ত ‘সংবো মানসি বারোযা জয়েতাম্’ অর্থাৎ সকলে যেন একমনা হই, সমান ভাবে চিন্তা করি। যজুর্বেদে আছে শিবসংকল্প সূক্ত, যাতে সকলে ভাল ভাবে থাকতে পারি। শিব মানে মঙ্গল সংকল্পে বাস করতে পারি। অথর্ববেদে বলা হয়েছে, (আমি আক্ষরিক অনুবাদে বলেছি)— ‘যে আমার পর, যে আমার প্রতি বিদ্বিষ্ট, যে বাইরের থেকে এসেছে, যে আমাকে গ্রহণ করে না, তাকে গ্রহণ করে আমি যেন শোভন ভাবে বাস করতে পারি।’
এ কথা তো আমার আবিষ্কারের দরকার ছিল না। এ কথা তো বহুকাল ধরে শাস্ত্রে রয়েছে। এ কথা আজ কেউ বলে না কেন? তা হলে যে স্বীকার করে নিতে হয় আর্যরাও বাইরে থেকে এসেছিল, প্রাগার্যরা শোভন ভাবে তাদের স্বীকার করে নিয়েছিল। স্বীকার করতে হয়, এতদিন ধরে— আর্যরা এসেছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে, তার পর গ্রিকরা, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এল, তার পর একে একে পারদ, পহ্লব, মূতিব, কুষাণ, শক, হূন আটশো বছর ধরে বাইরে থেকে মানুষ এসেছে। প্রথমে তাদের ম্লেচ্ছ বলা হয়েছে, শূদ্র বলা হয়েছে, পরে তারা যখন বিজয়ী হয়েছে তখন ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে; কিন্তু সমাজে তাদের স্থান দেওয়া হয়েছিল। আজকের অবস্থাটা ভাবুন; আপনি আঙুল তুলে বলতে পারবেন না ওই লোকটার পূর্বপুরুষ কুষাণ ছিল, শক ছিল না যবন। কেমন ভাবে মিলে গেছে। ওই যে প্রার্থনা— যে আমার প্রতি বিদ্বিষ্ট, যে বাইরে থেকে এসেছে, যার সঙ্গে আমার কিছু মেলে না, তাকেও যেন শোভন ভাবে গ্রহণ করতে পারি, এ প্রার্থনা মুখের ছিল না, মনের প্রার্থনাও ছিল। তাই সে প্রার্থনা এমন সুন্দর ভাবে পূর্ণ হয়েছে।
আজকে ভারতের জনতায় আগন্তুক মুসলমান মিশে গিয়েছে, তাকে আজ চিহ্নিতকরণ সম্ভব নয়। এমন ভাবেই মিশেছে কুষাণ, শক, হুন। ভুললে চলবে না, মুসলমান যখন এসেছিল, তিনশো বছর ধরে আরবে বা পারস্যে একটি নয় পয়সাও যায়নি। বরং সেখানকার শিল্পী এসেছে, ভাস্কর-স্থপতি এসেছে, চিত্রকর-গায়ক এসেছে, তারা ভারতবর্ষকে যা দিয়েছে তাতে আমরা সকলে গর্ব করার মতো অনেক পেয়েছি। ভাবা যায় দরবারি কানাড়া, মিঞা কি মল্হার, ইমনকল্যাণ, বিলাবল বাদ দিয়ে কোন মার্গ সঙ্গীত হতে পারে? ভুলে যাব কেমন করে, মুসলমান গায়ক গাইছেন ‘মথুরা না যাইয়ো কান্হাইয়া’ এ তো রাধাকৃষ্ণের প্রেমের গান, তাঁর তো গাইতে বাধছে না। এমন ভাবেই মিশেছিল মুসলমান আমাদের সঙ্গে, এমন ভাবেই আমরা তাদের আপন করতে পেরেছিলাম। মুসলমান দরাফ খাঁ গঙ্গা-স্তোত্র লিখেছিলেন, সেটা এখন আর পারলে মনে করতে চাই না। মুসলমান সাধক অল্লোপনিষদ আল্লার ওপর উপনিষদ লিখেছিলেন। দারা শুকো উপনিষদ অনুবাদ করেছিলেন। এগুলো মনে করতে খারাপ লাগে, আকবরের তো বহু হিন্দু রানি ছিল। ঔরঙ্গজেব, যাঁর ওপর আমরা এতটা চটা, আমরা খবর রাখতে চাই না যে, তিনি যখন জিজিয়া কর হিন্দুদের ওপর বসান, ঠিক তখনই মুসলমানদের ওপর একটা কর বসান এবং তাঁর বেশ ক’জন হিন্দু বধূ এবং হিন্দু সেনাপতি ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের যোধপুরী বেগম ছিলেন, উদিপুরী বেগম ছিলেন, যাঁদের জন্য আলাদা পাচক ছিল, আলাদা মহল ছিল। এঁরা ছিলেন রাজস্থানের রমণী। কাজেই এই সহাবস্থান, পরমত সহিষ্ণুতা তাঁরা দেখিয়েছেন, অন্য ধর্মে হস্তক্ষেপ করেননি। আমরা বলি, হিন্দুর মতো সহিষ্ণুতা আর কারও নেই। ছিল, বহুদিন হিন্দুর মধ্যে অনবদ্য পরমত-সহিষ্ণুতা ছিল। মানুষকে মানুষের মতো জ্ঞান করতে সে জানত। ব্ৰাহ্মণ্য সমাজেও তা গ্রাহ্য ছিল। কিন্তু আজকে শুনি, বলা হয় যে, বৌদ্ধধর্ম কিছু নয়, বুদ্ধ কিছু দেননি। তাঁর ধর্ম ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই একটি অনুবর্তন মাত্র। এ তো সভা করে বৌদ্ধ পুরোহিতের সামনে ওরা বলেছে। যে- বুদ্ধদেব যজ্ঞ তুলে দিলেন, জাতিভেদ মানলেন না সমস্ত হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করলেন, তিনি সমাজকে নতুন কিছু দেননি? এ ধরনের গোঁড়ামি, অন্ধতা সগৌরবে এরা প্রচার করছে।
ভারতবাসীর কাছে কোনও একটি ধর্মমত সকলের গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ দেশে বৌদ্ধ আছে, জৈন আছে, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ আছে, বহু ধর্মমত রয়েছে। বহু ধর্ম, জাতি নিয়ে একটি মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে ইচ্ছে করলেই আমরা ফিরে যেতে পারব না। আজকে যদি কোনও জিনিস ভবিষ্যতের জন্য নিরূপণ করতে হয়, তা হলে মিশ্র সংস্কৃতি, মিশ্র ঐতিহ্যকে মনে রেখে তার অনুকূলে ধর্ম বা নিয়ম প্রবর্তন করতে হবে। উনিশশো নিরানব্বই সালের ধর্ম উনিশশো নিরানব্বইয়ের তরুণ-তরুণীরাই ঠিক করুক। তার জন্য অত হাজার বছর আগের ধর্ম আওড়াবার দরকার নেই। তার প্রয়োজন মিটে গেছে। যজ্ঞের সময় যজ্ঞই একমাত্র উপায় ছিল। সারা পৃথিবীই কাল্পনিক দেবতাকে ডেকে যজ্ঞ করত। চারদিকে বিপৎসঙ্কুল পরিবেশে বাঁচার আর কোনও রাস্তা জানা ছিল না। প্রিয় খাদ্যবস্তু দিয়ে দেবতাকে বলা হত, তুমি আমার হয়ে কিছু করে দাও। বারবার সে দেখেছে যজ্ঞ করলে কিছু হয় না, ‘মীমাংসা শাস্ত্রে’ এর উল্লেখ আছে; যজ্ঞ নিষ্ফল হয়েছে বারেবারে। লোকের বিশ্বাস কি চলে যায়নি? কিন্তু কী করবে, আর তো কিছু জানা নেই। ফলে, প্রকৃতিকে জয় করার যে একটাই রাস্তা জানত তা হল যজ্ঞ, তাই যজ্ঞই করত।
আজকের উন্নত বিজ্ঞানের জগতে সেই যজ্ঞকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে? পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক হাজার বছর দূরে? সে চেষ্টাই চলছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দেবার এই দূরভিসন্ধিটা বুঝতে হবে। দেশময় একটা মিথ্যা অজ্ঞতা সৃষ্টি করতে চায় ওরা। যার মধ্য দিয়ে আমি ভারতীয়, আমি বাঙালি এটাই আমার একমাত্র পরিচয় নয়, আমি মানুষ, ওই সব আমার গৌণ পরিচয়, হিন্দুত্বই আমার একমাত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচয়, এত নীচ উদ্দেশ্য আর সংকীর্ণতার মধ্যে এরা এ পরিচয়কে টেনে নামাচ্ছে। অন্যের প্রতি জিঘাংসা দ্বেষ আসছে এখান থেকেই। নমস্য যাঁরা তাঁরা অন্যের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেন। কিন্তু আজ ওরা যে বিদ্বেষ হিংসা ছড়াচ্ছে, তার ফলে মানুষের মানবিক পরিচয় মূল্যহীন হয়ে দানবিক পরিচয়ই প্রধান হয়ে যাচ্ছে।
পাঠককে ১৯২৮-২৯ সালের জার্মান ইতিহাসকে স্মরণ করতে বলব। ইহুদিরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে জার্মানদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। জার্মানরা ওদের প্রতিরোধ করতে পারছিল না। কাজেই, ইহুদি নিকেশ করতে হবে। কেমন ভাবে? ইহুদিদের ল্যাবরেটরিতে ঢোকাচ্ছে আর বলছে, ওদের সব ‘ও’ গ্রুপের রক্ত। কথাটা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। প্রথমত ‘এ’-বি’ গ্রুপ যে আর্য রক্ত, এ কথাও অবৈজ্ঞানিক। একটা রক্তের চেয়ে অন্য রক্ত ভাল, সেটাও অবৈজ্ঞানিক। এই অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে পঁচাত্তর লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলেছিল। একটা মিথ্যা তত্ত্বের ওপর এত বড় নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। একই সময়ে হিটলার আবিষ্কার করল, ভারতীয়দেরও আর্য রক্ত। হঠাৎ ভারত ভাল হয়ে গেল, এখানেও ওদের স্তাবক জুটে গেল। যেন চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। এরই সঙ্গে যেটা ঘটল তার ফলে শুধু ইহুদি নয়, অন্য অনেকেই, ধনী ব্যবসায়ী শ্রমিক ও অন্য জাতি ওদের অসহিষ্ণুতার লক্ষ্য হয়েছে। ১৯২৮-২৯ সালের সময়ে জার্মানিতে বারবার ঘটেছে। এর পরিণতিও আমরা সকলেই জানি। এই ভাবে ফ্যাসিবাদ নাৎসিবাদ পৃথিবীর যেখানে যেখানে এসেছেন একই পথে এসেছে। আমরা এত দিনের ইতিহাসের আলোয় তাকে নিরূপণ করতে পারছি। বুঝতে হবে, এ দেশেও তাকে রুখতে না পারলে রক্তে প্লাবিত হয়ে যাবে ভারতবর্ষ।
জার্মানিতে হিটলার বলেছিল— এক হাজার বছর টিকবে তৃতীয় রাইখ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানির সেনাপতিকে মাথা হেঁট করে সন্ধিপত্রে সই করতে হয়েছিল ট্রেনের কামরায় বসে। সেই শোধ তোলবার জন্য বলেছিল, হিটলার এ সব করেছিল।
‘এই রাইখ এক হাজার বছর অব্যাহত রাজত্ব আমাদের টিকবে’, এই স্বপ্ন দেখিয়ে জার্মান জাতটাকে এক করা হচ্ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে ওটা স্বপ্ন নয়, ভারতবর্ষে স্বপ্ন ধৰ্ম। এখানে ধর্মের একটা ভ্রান্ত চিত্র দিয়ে মানুষকে প্রবঞ্চনা করা হচ্ছে।
ভ্রান্ত কেন? কারণ, এই ভারতবর্ষের মহাভারতেই উচ্চারিত হয়েছে, পিতামহ ভীষ্ম মরবার আগে যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘গুহ্যং ব্রহ্মে যদিদং তে ব্রধীমিন মানুষা শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ’– একটি গোপন সত্য তোমাকে বলি যুধিষ্ঠির, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। কিছু নেই, মানে দেবতারাও নয়। সে দিন কত দেবতায় বিশ্বাস করত ব্রাহ্মণ্যসমাজ। ভীষ্ম বলেছেন, কিছু নেই, মানুষের ওপর কিছু নেই। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে পিতামহ ভীষ্ম এ কথা স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললেন। এই মহৎ কথাগুলিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও পাচ্ছেন ওদের লেখাতে? সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই। এ তো আমাদের দেশই উচ্চারণ করেছে। আমার দেশের মানুষ আবার বলেছে— ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথায় খুঁজিছ ঈশ্বর।’ ঈশ্বরকে খুঁজতে হলে মানুষের মধ্যে খুঁজতে হবে। বলেছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
‘নিদারুণ দুঃখরাতে মৃত্যুঘাতে। মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্ত-সীমা। তখনও দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?’ রবীন্দ্রনাথ বলছেন।
ফাঁসির কাঠে যে দিন ক্ষুদিরাম জীবন দেয়, সে দিন সেই দেহ, সেই মন, দেবত্বকে স্পর্শ করেছিল— এর চেয়ে বড় দেবত্ব মানুষ কল্পনা করতে পারে না। ‘গ্রেটার লাভ হ্যাথ নো ম্যান দ্যান দিস দ্যাট এ ম্যান লেড ডাউন হিজ লাইফ ফর হিজ ফলো মেন’– এর চেয়ে বড় প্রেম হতে পারে না, অন্য মানুষের জন্য নিজের জীবনকে ত্যাগ করার চেয়ে। তখনই মানুষ দেবত্বকে স্পর্শ করে। এই দেবত্বকে এরা চেনে না। পরিবর্তের ধর্মের নামে চাইছে দানবিকতা, অসহিষ্ণুতা, যা নিজের শ্রেষ্ঠত্বকেই বিশ্বাস করে শুধু, আর কাউকে সম্মান করতে জানে না।
আমরা আজকে সংশয়ের একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি, দু’-রাস্তার মোড়ে বলাই ভাল। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা মনের মধ্যে একটা নির্বাচন করে নেব, আগামী প্রজন্মদের কী উত্তরাধিকার দিয়ে যাব। সে অনুসারে আমাদের সমস্ত আচরণ, কথাবার্তা, আলোচনা— যার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ হবে, সবাইকে বোঝাতে হবে কেন, কোথায় বিপথে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। রেহাই পাবার পথই বা কী। ঠিক ঠিক এটা করলে যা রক্ষা পাবে সেটা হিন্দুত্বের চেয়ে অনেক বড় জিনিস – মানবিকতা।