প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ৮

আট 

সকালে ঢাকের বাদ্যিতে বনভূমিটা জেগে গেল। ঠাকুরের নতুন ঘর উঠছে। ঠাকুর ঘরের জন্য শেষ পর্যন্ত দু বান টিন কিনে এনেছেন বাবা। এক বান টিন দিয়ে ঠাকুরের দোচালা ঘর, বাঁশের চাটাই-এর বেড়া। ছোট্ট একটা কাঠের সিংহাসনও রাজু মিস্ত্রি বানিয়ে দিয়ে গেছে। 

বাবা ফেরার পর একটা দিন আমরা দিনের বেলায় দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে বাবা কথাবার্তায় সাধু ভাষা প্রয়োগ করলে টের পেতাম, বসে থাকার সময় আর নেই। শুধু কাজ কাজই মানুষকে বড় করে দেয়। সুতরাং লিস্টি মিলিয়ে সওদা এল শহর থেকে। জীবনে প্রথম বাবার সঙ্গে রিক্‌শয় চড়ে সওদা করে ফিরলাম। অবশ্য এই নিয়ে একটা গন্ডগোল দেখা দিয়েছিল— রিক্‌শয় ফিরব শুনে পিলু এবং মায়া বায়না ধরেছিল, তারাও যাবে। কিছুতেই যখন বাবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না, তখন কথা দিতে হল, একদিন বাবা ওদের দুজনকে নিয়ে রিক্‌শয় চড়বে। এবং যখন ফিরলাম, আমার সৌভাগ্যে পিলু ভীষণ হতাশ গলায় বলল, সে কোনো কিছুই বাড়ি অবদি বয়ে নেবে না। বড় রাস্তা থেকে বেশ দূরে বাড়িটা বড় বড় ব্যাগ, চালের বস্তা। এবং আলু, পটল, ঝিঙে, আতপ চাল, মুগের ডাল, সব মিলে একটা বেশ বড় রকমের উৎসবই বাবা যখন করছেন, তখন পিলুর এই বাঁদরামো আমার কাছে ভীষণ অসহ্য ঠেকল। ইচ্ছে হল বলি তোর ঘাড় নেবে, কিন্তু পিলুকে জানি বলেই অমন রূঢ় গলায় কিছু বলতে সাহস হল না। 

বাবা রিক্‌শ থেকে নেমেই বললেন, পিলু ধর বাবা। ব্যাগটা ধর, পিলু যখন ভাল করে চেয়ে দেখল, রিকশ ভর্তি ছোট বড় ব্যাগ, হাঁড়ি পাতিল, চালের বস্তা, তখন সে আর স্থির থাকতে পারল না। ব্যাগ নিয়ে দৌড়ল। আমিও দুটো ব্যাগ নিয়ে ফিরলাম। মায়া খবর পেয়ে ছুটে এল বড় রাস্তায়। সে হাঁড়ি পাতিল যতটা পারল নিল। বাবা বাকিটা। চালের বস্তাটা রিশওয়ালা মাথায় নিয়ে যখন এল মা তখন গাছের নিচে বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে। 

ক’দিন ধরে বাবা পড়াশোনার কথা একদম বলছেন না। কুলদেবতাকে নিয়ে এসেছেন, এবং কত বড় ভরসা এখন তাঁর এই বাড়িতেই আছে, ছেলেরা এখন ঠাকুরের কৃপাতেই সব পার হয়ে যাবে। বাবার কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল, মাথায় তাঁর ঠাকুরের অভিষেক ভিন্ন অন্য কোনো ভাবনা নেই। ঠাকুরঘর, তেপায়া দুটো, তামার পাত্র, কোষাকুষি, পেতলের থালা দুখানা—গজ খানেক নতুন গরদ এবং লাল সিল্ক অর্থাৎ ঠাকুরের পোশাক-আশাক, তারপর শঙ্খ ঘন্টা কাঁসি, একটা জল-শঙ্খ দরকার।— বাবা সারাক্ষণ মার সঙ্গে পরামর্শ করছেন, আর কি লাগবে দ্যাখো। কিছু বাদ গেল না তো। 

মা কি বলবে! একেবারে মুহ্যমান মা। মানুষটা ঈশ্বর ভরসা করে আছে, তাঁর ঈশ্বর দুটো পয়সার মুখ দেখিয়েছেন। তিনি দিচ্ছেন। এবং মার কাছে বাবা একসময় সবই খুলে বললে, মা বলল; শেষ পর্যন্ত দেবে তো। 

—দেবে না কেন? ওরাই তো বলল, কর্তা, বাড়ির ঠাকুর, বাড়ি নিয়ে যান। আমরা তো আছি। ঈশরের সেবায় কিছু দিলে পুণ্যটা আপনার হবে না। আমাদের হবে। 

এবং বোঝা গেছিল আমার দাদুর বড় বড় শিষ্যদের বাবা ঠিক খুঁজে বের করেছেন। দেশের সব যজমান, কে কোথায় আছে খুঁজে খুঁজে বের করেছেন। কেউ বোধহয় বাদ যায়নি। তারাই বাবাকে ঠাকুরের নামে মাসোহারা পাঠাবে বলেছে। এবং সঙ্গে যে কিছু দিয়েও দিয়েছে খরচ-পত্তরের বহর দেখেই তা আমরা টের পাচ্ছিলাম। কে কে খাবে, তারও একটা লিষ্টি হয়ে গেছে। মানুকাকা আসবেন, ছেলেরা মেয়েরা আসবেন তাঁর। নিবারণ দাসের বাড়িতে সবাইকে বলা হয়েছে। শহর থেকে আসবেন দুজন পন্ডিত। বাবা এ-সব ব্যাপারে মানুকাকার পরামর্শ ছাড়া চলেন না। এবং সকালে উঠে পিলু চলে গেছে গোবর আর ষাঁড়ের চনা সংগ্রহ করতে। দুটো বড় গর্ত করা হচ্ছে উনুনের জন্য। মা ঘর, দরজা উঠোন লেপে বাড়িটাকে ঝকঝকে করে তুলেছে। পুনুও বুঝেছে বাড়িতে কিছু একটা হচ্ছে। এক্কা দোক্কা সে বেশ একা একাই খেলছিল। আর ঢাকের বাদ্যি বাজতেই মায়া পুনুকে কোলে নিয়ে ঢাকির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আর বেশ বাজাচ্ছিল লোকটা। ঘুরে ঘুরে আর নেচে নেচে বাজাচ্ছিল। কাঁসি বাজছিল ট্যাং ট্যাং করে। দুলে বাগদি খুব খাটছে। সে-ই প্রায় এক হাতে সামিয়ানা টাঙিয়েছে- সকালেই সব লোকজন চলে আসবে। তাদের বসার জায়গা চাই। এবং আমাদের পরিবারে এমন একটা দিন আসবে আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি। নিবারণ দাস এলে বাবা বলেছিলেন, দাসমশাইকে বসতে দে। 

—তা হলে কর্তা সব ঠিকমতোই হয়ে যাচ্ছে। 

বাবা নতুন ধুতি পরেছেন। দুলে তামাক সেজে দিচ্ছিল। কে বলবে, আমরা এখানে এসে একটা প্ল্যাটফরমে পড়ে থেকেছি দিনের পর দিন। কি করে যে মানুষ তার বাড়িঘর ঠিক এক সময় বানিয়ে ফেলে। বাবার হয়ে আজ নিবারণ দাস সব দেখাশোনা করবে। কারণ বাবা তো সারাটা দিন ঠাকুরঘরেই থাকবেন। এবং নিবারণ দাস বেশ নিজের বাড়ির লোকের মতো বলল, কর্তা মা, উনুনে কটা কাঠ ফেলে দিই। আগুন ধরিয়ে দিই। কাকিমা এলে মা বঁটি দিয়ে বলল, বসে যা নেরু। পটলের ঝুড়ি এগিয়ে দিল মা। নিবারণ দাসের লোক গেছে বাজারে। সে পছন্দমতো মাছ কিনে আনবে বলেছে। 

এক একজন আসছে আর আমি পিলু মায়া হৈ-চৈ করে খবর দিচ্ছি বাড়িতে। মা আরতিদিরা আসছে, মা সুজয়দারা আসছে। যাদের চিনি না, বাবাকে বলছি ঠাকুরঘরে গলা বাড়িয়ে—বাবা কে এসেছেন দ্যাখো। এবং বেশ বোঝা গেল বাবা এখানে আসার পর পরিচিত ব্যক্তি বলতে আর কাউকে বাদ রাখেননি। যেখানে যার সঙ্গে দু দন্ড কথা হয়েছে, পরিচয় হয়েছে, সুখ-দুঃখের দুটো কথা হয়েছে তারা সবাই আজ আমাদের উৎসবে আমন্ত্রিত। 

দুপুরের মধ্যেই বাড়িটা লোকজনে ভরে গেল। দুলে রাশি রাশি কলাপাতা কেটে রেখেছে। পিলু মায়া কলাপাতার মুখোস পরে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে। কাকপক্ষিদেরও যেন জানতে বাকি নেই। সবাই টের পেয়ে গেছে আজ আমার বাবা তাঁর কুলদেবতার অভিষেক করছেন। সারা রাস্তায় রেলগাড়িতে ঠাকুর গলায় ঝুলেছে… বাছ-বিচার কিছু ছিল না, শোধন করে নিচ্ছেন সে-জন্য। 

নিবারণ দাসের বড় মেয়ে আরতি এসে বলল, সাধন মামা আসছে। বড় ঝুড়িতে বিরাট একটা রুই মাছ। সবাই রাস্তায় ছুটে গেছি। মাছটা নামালে আমরা ঘিরে বসলাম। পিলু খুঁটে দুটো আঁশও তুলে ফেলল। সাধনদা নিবারণ দাসের শ্যালক। সে বড় বঁটি নিয়ে এল। মাছ কাটা দেখার জন্য আমাদের উৎসাহের শেষ ছিল না। বড় গামলা কেউ টেনে আনছে। কেউ ড্রামে জল ভর্তি করছে। রান্না হচ্ছে দুটো বড় উনুনে। মুগের ডাল, তিতের ডাল, বেগুন ভাজা, শাক হয়ে গেলে সব মা আর কাকিমা ঘরে নিয়ে সাজিয়ে রাখছে। তখনই পিলু বলল, মা নবমীর জন্য দুটো ভাত নিয়ে যাব? সবাই খাবে, এই বনভূমির কাক পক্ষীরাও যখন বাদ যাচ্ছে না, তখন নবমী খাবে না সে হয় না। পিলু বোধহয় সেই ভেবে কথাটা বলেছে। 

অন্যদিন হলে নিজেই দেওয়া যাবে কি যাবে না মা সাফ বলে দিতে পারত। সংসারে আমার মা’র ওপর আর কারো কোনো কথা নেই, কিন্তু মা কেন জানি আজ বড় বেশি বাবার অনুগত। বলল, তোর বাবাকে বলে দেখ, কি বলে। 

পিলু ঠাকুরঘরের দরজায় এসে বলল, বাবা নবমী কতদিন কিছু খায় নি। দুটো ভাত দিয়ে আসব? বাবা তখন গদগদ চিত্তে ঠাকুরের দিকে তাকিয়েছিলেন। কেমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য মানুষ। পিলুর মনে হল বাবা ইচ্ছে করেই তার কথা শুনছেন না। এবং এ-সব সময়ে পিলুর যা হয়, মেজাজ চড়ে যায়, সে হেঁকে ডাকল, বাবা! 

বাবা ঘাড় ফিরিয়ে পিলুকে দেখল। 

—নবমীকে দুটো খেতে দেব? 

বাবা বললেন, নবমী! 

—ইটের ভাটার ওদিকটায় একটা বুড়ি থাকে না! 

—দাও। যখন ইচ্ছে হয়েছে দেবে বৈ কি। সংসারে সবাই খাবে নবমী খাবে না সে কি করে হয়!

আশ্চর্য এক সুঘ্রাণ। ফল, বাতাসা, ধুপ দীপের গন্ধে বাড়িটা ভরে আছে। সকালে মা বাড়ির আঙিনায়, ঠাকুরঘরের মেঝেতে আলপনা এঁকে দিয়েছিল। মানুষজনের হাঁটাহাটিতে সব মুছে যাচ্ছে। ঠাকুরঘরে পূজা-আর্চা চলছে সেই কখন থেকে, ঢাকের বাদ্য বাজছে সেই কখন থেকে। বাবা কাপড়ের খুঁট থেকে এটা ওটা আনার জন্য মাকে টাকা পয়সা বের করে দিচ্ছিলেন কখনো। সাধন এবং মানুকাকা এবং আর যারা যারা এসেছে সবাই প্রণিপাত হচ্ছে, ধুলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছে। নিবারণ দাস কিছুক্ষণ ঠাকুরঘরের বাইরে থম মেরে বসেছিল। দেব-দেবীর মুখ দেখতে দেখতে কখনও মা মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠছিল। কেউ কেউ বাবার বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখছে। আশ্রমের মতো মনে হচ্ছে, একটা আগাছা নেই, জমি উঁচু নিচু নেই—দুটো চারটা ফলের গাছ মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। 

কুকুরটা আরও বড় হয়েছে। মানুষজন দেখে প্রথমে ক্ষেপে গিয়েছিল, পরে বোধহয় বুঝতে পেরেছে ওরা বাড়িরই লোক, কিছু আর বলছে না। লেজ নাড়ছে আর পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করছে। মাঝে মাঝে পিলুর খবরদারি, ওদিকে যাবে না। এদিকে এস। ওখানে রান্না হচ্ছে। কথা না শুনলে বেঁধে রাখবে ভয় দেখাচ্ছে। 

এত সবের মধ্যে সবই হয়ে যাচ্ছিল। সামিয়ানার নিচে শতরঞ্চ পাতা। বাবা সবাইকে ঠাকুরঘর থেকেই বসতে বলছেন। বিকেল হলেই খেতে বসবে সবাই। দূর দূর থেকে যারা এসেছে সন্ধ্যার মধ্যেই রওনা হয়ে যাবে। দুটো প্যাট্রোম্যাক্স আনিয়ে রেখেছে নিবারণ দাস। বড় আপনজনের মতো সে কোনো কিছুর ত্রুটি রাখছে না। 

এবং নিবারণ দাসই বলল, কর্তা, পূজো শেষ হতে আর কত দেরি? 

বাবা বললেন, এর শেষ নেই দাসমশাই। যতদিন আছি ততদিন শুধু তাঁর সেবা করে যেতে হবে। 

ধার্মিক মানুষের কথাবার্তা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবা এবং অন্য সকলের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারতাম, জীবনে সব কিছু বলতে আমার বাবা এর চেয়ে বেশি কিছু বোঝেন না। বাবা এতদিন একটা ছিন্নমূল, ছন্নছাড়া মানুষ ছিলেন। এই বাড়িঘর এবং দেব- দেবীর প্রতিষ্ঠা করে বাবা ফের তার শেকড়-বাকড় মাটিতে ছড়িয়ে দিতে দিতে কখন দেখি বাবার মুখে ভারি প্রসন্নতা বিরাজ করছে। বাবার এমন সুন্দর মুখ কখনও আর এর আগে দেখিনি। অকারণে আমার চোখ দুটো জলে ভার হয়ে এল। বাবার মুখ দেখে এই প্রথম বুঝি টের পেলাম জীবন কত বড়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *