প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ৫

পাঁচ 

আমাদের খাওয়া-দাওয়াটা এখন কোনো নিয়মমাফিক ব্যাপার নয়! ভাত খাওয়াটা আমাদের কাছে ভোজের মতো। ভাত না থাকলে, বনআলু না পাওয়া গেলে শুধু গাছের পেঁপে সিদ্ধ করে খাওয়া। কিছু পেঁপে শহরে নিয়ে যেতে পারলে বিক্রি হত। দু-একদিন পেঁপে বিক্রির পয়সায়ও ভাত মাছ হয়ে যায় কখনো। এবং বাবা একদিন গোটা দশেক বড় সাইজের পেঁপে পেড়ে একটা ঝোলায় নিয়ে চাল সংগ্রহের জন্য চলে গেলেন। কিন্তু আর ফিরলেন না। 

ঠিক শহরে বাবা মানুকাকার কাছে কোনো খবর পেয়ে চলে গেছেন কোথাও। ফিরবেন যখন, মাথায় বড় সব পোঁটলাপুঁটলি। আমার কেবল ধারণা হত, বাবা গোপালদির বাবুরা কোথায় আছে জানতে পারলে গুপ্তধন পেয়ে যাবেন। বাবুদের সঙ্গে দেখা হলে পূজা-পার্বণে বাবাকে ডাকবে। দেশে থাকতে ওরা খুব দিত-থুত। দু আড়াই বছরে বাবার স্বভাবধর্ম আমাদের খুব জানা। না থাকলেও এখন আর মা এবং আমরা তেমন দুশ্চিন্তা করি না। পিলুটা কেবল বনের ভেতর অন্ধকার ঢুকে গেলে রাতে ভয় পায়। ঘর থেকে বের হতে চায় না। ওর ধারণা, বাবা যেহেতু বাড়ি নেই, ভূত- প্রেত দৈত্য-দানোরা সুযোগ বুঝে নিশীথে একটা লম্বা হাত বনের ভেতর থেকে বাড়িয়ে দেবে। এবং আমাদের ছোট বাড়িঘর তুলে নিয়ে মাথায় টোপর পরে বসে থাকবে। এই ভয়টাই খুব কাবু করত পিলুকে। 

আর মা’র মনে হত, বাবা বাড়ি না থাকলে যা হোক একটা লোকের আহার বেঁচে গেল। কারণ তিনি যেখানেই যান বেশ চালিয়ে নেন। কোথাও বাবার কিছু অভাব থাকে না। এবং যদি কোনো শিষ্যবাড়ির খোঁজ পাওয়া যায়—বাবা সেখানে তো ধর্মগুরুর মতো। এমন কি তখন সেখানে মচ্ছব টচ্ছব লেগে যায়। তারপর ফেরার সময় নগদ টাকা, মার জন্য প্রণামীর শাড়ি, আমাদের জন্য শীতের চাদর নিয়ে আসতে পারেন। 

বাবা পরদিনও ফিরলেন না। আশ্চর্য, এবারে মাকে খুব চিন্তিত দেখাল। মানুষের বাড়িঘর হয়ে গেলে এমনটাই বুঝি হয়। সকালের দিকে মা বলল, একবার যা তোর মানুকাকার কাছে। মানুষটা কোথায় গেল খবর নিবি না? 

পিলু বলল, চল দাদা, বাবাকে খুঁজে আসি। এবং দুজনে কাকার বাড়ি গেলে জানলাম, বাবা গেছেন বেথুয়াডহরি। পেঁপে বিক্রির পয়সা কাকার কাছে রেখে গেছেন! কাকা আমাদের খেয়ে যেতেও বললেন। পিলু বলল, দাদা আমার তো খাবার ইচ্ছে খুবই। তোর? আমার কি ইচ্ছে কী করে পিলুকে বোঝাই, তবে অস্বস্তি এই যে, কাকার ছেলেমেয়েদের পোশাক এবং পারিপাট্য এত বেশি যে গেলে চাকর-বাকরের মতো মনে হয় নিজেদের। তবু খেতে বলায় দুজনই খুব খুশি। খাবার লোভে একটা ঘরে দুজনে চোরের মতো বসে থাকলাম। একটা কথা বললাম না ভয়ে। খুড়তুতো ভাইবোনেরা দু-একবার উঁকি মেরে গেল। আমরা তখন অন্য দিকে চেয়ে থেকেছি। যেন আমরা খাওয়া বাদে পৃথিবীতে আর কিছু জানি না বুঝি না। বড়ই সুবোধ বালক। ওদের চোখে চোখ পড়ে গেলেই টের পাই বড়ই অদ্ভুত দুটো জীব আমরা। কাকা অদ্ভুত দুটো জীব ধরে ঘরে পুরে রেখেছে। ওদের কৌতূহল মেটাবার জন্য যতটা পারলাম খাঁচায় পোরা দুটো হরিণ শাবকের মতো মুখ করে রেখেছি। যদিও খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল, তবু খাবার লোভে পালাতে পারছি না। খেতে বসে কোনোরকমে ঘাড় গুঁজে আমরা খেয়ে ফেললাম। পিলু ভাত খেতে খুব ভালবাসে বলে আকণ্ঠ খাওয়া কি ঠিক বোঝে না। ও বোধহয় ঘিলুতক ঠেসে খেল। খাওয়া দেখে হাঁ হয়ে গেল আমাদের ভাইবোনেরা। পেটে কি ধামা বাঁধা আছে—এত খায় কি করে। অন্য ঘরে ওরা ফিসফিস করে কথা বলে খুব হাসাহাসি করছিল। সবই শুনতে পাচ্ছিলাম। আর লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছিল। 

কাকা গুনে দু টাকা দশ আনা পয়সা হাতে দিয়ে বললেন, ধনদার ফিরতে দেরি হবে বলে গেছে। বেথুয়াডহরিতে দেশের লোক এসেছে অনেক। খবর পেয়েই চলে গেল। তাছাড়া তোদের কিছু শিষ্যবাড়িরও খোঁজ নিতে যাবে বলেছে। 

বাবার একটা খেরোখাতায় আজকাল রাজ্যের সব মানুষজনের নাম ঠিকানা লেখা থাকে। পিতামহের আমলের কিছু শিষ্যদের নাম বাবা ‘পুনরায়’ হেডিং দিয়ে লিখে রেখেছেন। বাবা দেশে থাকতে হেলায় এই গুরুগিরির ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন এই দুঃসময়ে তাদের খোঁজখবর করে বেড়াচ্ছেন বোধহয়। তাছাড়া নিবারণ দাসের দেওয়া পঞ্জিকাটা তো বগলে রয়েছেই। এত বড় একটা মূলধন যাঁর আছে তাঁর আবার ভাবনা কি। 

ট্রেনে বাবার যেহেতু পয়সা লাগে না, বাবা সহজেই যে কোনো সময় খুশিমত সুদূরে চলে যেতে পারেন। যারাই দেশ ছেড়ে এসেছে, সবাই প্রায় রেললাইনের লাগোয়া গ্রামে গঞ্জে অথবা কোনো পতিত জমিতে নিজেদের আবাস গড়ে তুলছে ক্রমশ। রেলে বাবার টিকিট লাগে না এটা বড়ই গৌরবের ব্যাপার আমাদের কাছে। আর বাবার অকাট্য যুক্তি, আমরা ছিন্নমূল মানুষ, সব দেশের স্বার্থে, এটা কত বড় আত্মত্যাগ! আমাদের আবার ভাড়া কি। অথবা কখনও বাবা যেন দেশ ভাগ করে নেহরু যে ভুল করেছেন বিনা টিকিটে ভ্রমণ করে তার খানিকটা উশুল করে নিচ্ছেন। বাবা তাঁর বিনা টিকিটে ট্রেনের ভ্রমণ-কাহিনী ফিরে এসে সগৌরবে বলতে খুবই ভালবাসতেন। 

আর থাকা খাওয়ার ব্যাপারটা বাবার যে কোনো জায়গায়, যে কোনো পরিচিত মানুষের বাড়িতে আজন্ম অধিকারের শামিল হয়ে গেছে। যদি খোঁজখবর মিলে যায়, আর খোঁজখবর না মিললেও কোনো লতাপাতায় সম্পর্ক খুঁজে পেলে একেবারে তখন মৌরসীপাট্টা—থাকা খাওয়া, দেশের গল্প, এমন সোনার দেশ মানুষকে ছাড়তে হয় কত বড় পাপ করলে সে সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ তাঁর বক্তৃতা। বাবার কথাবার্তা শুনলে সবার বোধহয় মানুষটার ওপর মায়া পড়ে যায় এবং সহজে ছাড়তে চায় না। এবং বাবা যখন গেছেন, আর মানুকাকাকে বলে গেছেন তখন খুবই নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। 

আমরাও ডাল ভাত মাছ খেয়ে বেজায় খুশি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাকার বাড়ি থেকে বের হওয়া দরকার। পেট ভরে খাওয়ার আনন্দটা ঠিক উপভোগ করা যাচ্ছে না। কারণ কাকার ছেলে- মেয়েদের বিরূপ কথাবার্তা খুবই খোঁচা দিচ্ছে পেটে। কাকা এবং কাকীমাকে যত দ্রুত সম্ভব টুগটাপ প্রণাম সেরে বের হয়ে পড়া গেল। এবং শহরের রাস্তায় কতসব অলৌকিক ঘটনা দেখা গেল ক্রমে। রিকশা চড়ে মানুষেরা যায়। জানলায় সুন্দর মতো মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্জুনগাছটার নিচে একটা চায়ের দোকান। সবাই চা খাচ্ছে। বিকেল পড়ে আসতেই শহরে ঠাণ্ডা ভাব। সিনেমাহাউসে রামের সুমতি বই হচ্ছে। বাদ্য বাজছিল। বইয়ের কত দোকান, জেলখানার পাঁচিল পার হয়ে গেলে জলের ট্যাঙ্ক। টাউন ক্লাব। পাশে পুলিসের ব্যারাক। উর্দিপরা ব্যাণ্ড-পার্টি আগে আগে ব্যাণ্ড বাজিয়ে যাচ্ছে। পুলিসের সব খাকি পোশাক, আর রূপোর বকলেশ নীল আকাশের নিচে এক চিত্রকরের ছবির মতো। তারপরই বালিকা বিদ্যালয়। একই রকমের নীল ফ্রক পরে দলে দলে মেয়েরা বের হয়ে আসছে। একটা সুন্দর দোতলা বাড়ির টবে গোলাপের গাছ। পাশে ইজিচেয়ারে শুয়ে বালিকা নিবিষ্ট মনে কোনো গল্পের বই পড়ছে। এতসব ঘটনা একটা শহরে রোজ ঘটে। এক জীবনে এতটা দেখা যায় যেন আমার আগে জানা ছিল না। 

তারপরই সোজা সড়ক চলে গেছে রেল-লাইন পার হয়ে। দু পাশে বড় বড় সব শিরীষ গাছ। পাতা ঝরছে। শনশন হাওয়া কবরখানা থেকে উঠে আসছে। সাহেবদের কাবরখানা ডান দিকে। এবং কত সব সমাধি ফলক আর কত প্রাচীন সব ঝাউগাছ। যত শহর শেষ হয়ে আসছে তত নিঝুম পৃথিবী। গাছপালা পাখি তত বেশি। কতশত বছরের পুরনো সেই বাড়িটা যেন, ভাঙা শ্যাওলা ধরা রাজপ্রাসাদের মতো। একটা টগর ফুলের গাছ, চত্বরে আর কিছু নেই। মজা দীঘি, ভাঙা ঘাটলা। আর এ-সব পার হয়ে ডান দিকে গেলেই সেই কারবালা। বনটার আরম্ভ। কোথাও ভিতরে কবে কোন্ আদ্যিকালের ইঁটের ভাটা। এবং এই বনেই নবমী বলে সেই বুড়িটা থাকে। পিলু বাড়ি ফেরার পথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য কারবালার মাঠে নিয়ে এল আমাকে। এবং বনের এক আশ্চর্য মোহ আছে পিলুর। সে ইতিপূর্বে এই বনের ভেতর দুটো আমড়া গাছ, কিছু পেয়ারা লিচু গাছ এবং একটা কাঁঠাল গাছও আবিষ্কার করে ফেলেছে। আর নবমীকে এই ফাঁকে দেখিয়ে নিয়ে যাবে—কারণ আমার মতে নবমী একটা ডাইনি না হয়ে যায় না। আমার ভুল ভাঙাবার জন্যই যেন পিলু এই পথটা ধরে যাচ্ছে। 

হাঁটতে হাঁটতে আমরা সামান্য ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পিলু তখন বলল, আমি খুব বেশি খেয়েছি নারে দাদা? 

সত্যি কথা বললে যদি পিলু মনে কষ্ট পায়, ভেবে বললাম, কোথায় বেশি খেলি! ওটুকু না খেলে পেট ভরবে কি করে! 

পিলু বলল, আয় দাদা, এখানে একটু আমরা গড়িয়ে নি। বড় উঁচু মতো একটা কড়ই গাছ। নিচে সবুজ ঘাসের মাঠ। বেশ অনায়াসে শোওয়া যায়। বনটার ভেতরে ঢোকার আগে নিরিবিলি জায়গাটাতে বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকা গেল। দূরে রেল-লাইন। একটা গাড়ি যায় সন্ধ্যায়। পাশে কাশের বন দিগন্তব্যাপী। কেবল কারবালার মাঠটা একটু দূরে। দুটো একটা মিনার, ভাঙা মসজিদ এবং একটা কুকুর বাদে কিছুই আর চোখে পড়ছিল না। 

পিলু বেশ নিশ্চিন্ত মনে গাছের নিচে শুয়ে আছে। আমিও পাশে। বললাম, তুই এখানে কখনও এসেছিলি? 

সে বলল, কত। কতবার এসেছি। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গরুর গাড়ি যাবার রাস্তা আছে। রাস্তাটা ধরেই যাব। 

আমার কেমন গা ছমছম করছিল। ভয় লাগছিল। পিলুটা কিন্তু দিনের বেলায় একদম ভয় পায় না। ওর শুধু ভূতের ভয়। এছাড়া ওর অন্য কোনো ভয় নেই। তার ধারণা দিনের বেলায় ভূত- টুত বের হয় না। 

বেশ লাগছিল। শহর ঘুরে দেখা গেল। বাবার খোঁজ পাওয়া গেল। আকণ্ঠ খাওয়া গেল। একজন মানুষের জীবনে আর কি দরকার তখন বুঝতে পারছিলাম না। এবং প্রকৃতির ভেতর আমরা দুই ভাই, এক অন্য জগৎ, শুধু পাতা ঝরছে আর নানা বর্ণের সব পাখিরা উড়ে যাচ্ছিল। গাছে বসে ডাকছিল। 

গাছের নিচে শুয়ে দুই ভাই কত কথা বললাম। পিলু আবার বলল, সে বড় হয়ে রানাঘাটে যাবে। বলল, দাদা, তুই লেখাপড়া শিখে মানুষ হবি। আমি একটা দোকান দেব। দুজনে রোজগার করলে বাবার কোনো দুঃখ থাকবে না। পিলু বাবারও খুব প্রশংসা করল। বলল, বাবা ভাগ্যিস জায়গাটা খুঁজে বের করেছিলেন। পিলুর মতে এমন সুন্দর জায়গা আর কোথায় আছে! আসলে তখন আমি বুঝতে পারি এই বনজঙ্গলের আশ্চর্য একটা টান আছে। ছোট্ট ঘর—মা বাবা, রাতে কখনও বাবার ফিরে আসা, কখনও বনজঙ্গলে পিলুর ভ্রমণবিলাস, সব মিলে জায়গাটার আলাদা মাহাত্ম্য সৃষ্টি হয়েছে। পিলু না থাকলে এ-বনজঙ্গলের সব সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে যায়। যেন এতদিন এই বনটা ঘুমিয়েছিল, পিলু আসায় বনটা জেগে গেছে। শীত-গ্রীষ্মে বনের পাতা ঝরা থেকে আরম্ভ করে সব প্রাণীকুল এক ছোট্ট বালকের কাছে কতকাল পর যেন ধরা পড়ে মহীয়সী রূপ ধারণ করেছে। 

পিলু কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলল, ঐ যে ঘরটা দেখছিস ওটার মধ্যে নবমী থাকে। 

—ঘর কোথায়! এ তো পুরনো ইঁটের পাঁজা। 

কাছে গেলেই নবমী পিলুকে দেখে বলল, ওমা, পিলু দাদা যে! 

আমি তো অবাক। ভারি ভাব বুড়িটার সঙ্গে। শনের মতো সাদা চুল। একটাও দাঁত নেই। ঘরের বার হতেও কষ্ট। কচুর মূল, বনআলু এবং মালসার মধ্যে ঘুসঘুসে আগুন এই সম্বল করে বেঁচে আছে। নবমী আমাকে দেখে বলল, এ কেডা পিলু দাদা? 

—আমার দাদা। তোমাকে দেখাতে এনেছি। 

নবমীর শরীরে শুধু শুকনো কলাপাতার পোশাক। কোমর থেকে হাঁটু অবধি। বোধহয় মানুষের সাড়াশব্দ পেয়েই সে তার মহামূল্য পোশাক পরিধান করে অন্ধকার থেকে বের হয়ে এসেছে। নতুবা বনের মধ্যে তার উলঙ্গ হয়ে ঘোরাফেরার অভ্যাস। এবং বয়স খুব কাবু করে ফেলেছে দেখে বললাম, নবমী, তোমার ভয় করে না? 

–না দাদা। 

—তুমি এখানে আছ একা, ভয় করে না? 

–এমন জায়গা কোথায় আর আছে দাদা! 

—অসুখ-বিসুখে তোমাকে কে দেখে? 

সে ওপরে হাত তুলে দেখাল। কি আশায় এখানে পড়ে আছ ভাবতে খুবই বিস্ময় লাগছিল আমার। কতদিন থেকে আছে কে জানে। এবং যা ভয় ছিল, তা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল ওর কথাবার্তা শুনে। একটা ছাগলের তিনটে বাচ্চা হয়েছে। সে পিলুকে বলল, দাদা তুমি বামুনের ছেলে, বলেছিলে একটা ছাগলের বাচ্চা নেবে। আর নিতে এলে না তো। 

পিলু বলল, বাবা বেথুয়াডহরি গেছে। এলে বাবার কাছে পয়সা চেয়ে রাখব। 

—পয়সা দিয়ে কি হবে গো দাদা। ওমা আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন যে গো দাঠাকুরের দল। আমার কত পাপ, বলে সে দুটো ইট পেতে দিল। বলল, বসেন। 

আমার তখন কত রকমের কূট প্রশ্ন মাথায়। বললাম, নবমী, তোমার আর কেউ নেই? 

—কেউ নেই কেন হবে গো। এত বড় একটা সংসার আমার। তার পরে পিলু দাদা শেষ বয়সে এইসে গেল—কি আর লাগে। 

—ওরা খোঁজখবর নেয় না তোমার? 

নবমীর মুখটা সরল হাসিতে ভরে গেল। বড় জানতে ইচ্ছে হয়, ওর সেই শৈশবের কথা। কত বয়স এখন—মনে হয় সত্তর আশি। তার ওপরও হতে পারে। বললাম, তোমার বয়স কত নবমী? সে বলল তিন কুড়ি বছর হবে এখানটায় আছি। সেনবাবুদের ইঁটের ভাটিতে আমার মরদ সর্দার ছিল গো বাবু। দশাসই মানুষ। সে পিলুর দিকে তাকিয়ে বলল, পিলু দাদা, আপনার বাবাঠাকুর আসবেন বলেছিলেন। এল না তো। একবার গড় হতাম। গড় হলে মুক্তি মিলে যেত। 

নবমীর এত বড় সংসারে কে কে আছে জানতে চাইলে বলল, ছিল তো অনেক দাঠাকুর। বয়স বাড়ছে, তেনারাও ছুটি নিচ্ছেন। ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম, তেনারা কারা? 

—ঘর বার হতেই কষ্ট। খোঁজখবর করতে পারি না। দু পা হাঁটলেই হাঁটু ব্যথা করে দাঠাকুর। আমি না গেলে ওরাই বা আসবে কেনে বলুন। 

কেমন রহস্যময় কথাবার্তা। বললাম, ওরা কারা? 

নবমী ঘর থেকে দুটো নারকেল বের করে দিল। বলল, বাবাঠাকুরকে দিবেন। ফের বললাম, তাহলে তোমার কেউ নেই? 

—আছে গো আছে। ওপরে হাত তুলে দেখাল—তিনি আছেন। চারপাশে গাছপালা দেখাল হাত তুলে, তেনারা আছেন। দূরে কোনো বন্যপ্রাণীর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল—বলল, তেনারা আছেন। তারপর গাছের ফল-মূল, ঋতু পরিবর্তন, ফুলের সৌরভ—তার কাছে সবই অমৃতময় এখানকার। চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে বলল, এত সব আমার দাঠাকুর। মানুষটা নেই বলে, ইঁটের ভাটা উঠি গেল বলে, একা ভাববেন না। মানুষটাকে ওই যে দেখছেন শিমুল গাছ তার নিচে রেখে দিইছি। তেনার কথাবার্তাও কানে আসে। বলতে বলতে নবমী হাঁপিয়ে উঠল। একটা কংকালসার প্রাণে কত আকাঙক্ষা। ওর চামড়া কুঁচকে স্থবিরতা এসে গেছে শরীরে। তবু এই বনভূমির মাঝে নবমীকে মনে হচ্ছিল বড়ই সুন্দরী। বয়েসকালে সে আমার মা’র মতো তার মানুষের অপেক্ষায় কত রাত না জানি জেগে থেকেছে। বনটাকে ভালবেসে ফেলেছে। সে আর কোথাও চলে যেতে পারেনি। শেষে নবমী বলল, মানুষের বাড়ি-ঘরের বড় মায়া। কোথায় আর যাব দাঠাকুর। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *