প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ১৬

ষোল 

আমি বাড়ি ফিরে আসায় পিলু ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পিলুর সব ছিল, গাছপালা, শস্যক্ষেত্র, বনজঙ্গল, খোঁড়া গরু—সব। কেবল দাদা নেই। দাদা ফেরার। সে নিজে কত জায়গায় দাদাকে খুঁজতে গেছে। নিবারণ দাসের আড়তে গিয়ে বলেছে, দাদা আমার কোথায় চলে গেছে! রেলগাড়ি চড়ে দাদা চলে গেছে। রেলগাড়ি কতদূর যায়। সকাল বিকেল সে স্টেশনে গিয়ে বসে থাকত, দাদাটা যদি ফেরে। বাবা বলতেন, মতিচ্ছন্ন। মতিচ্ছন্ন না হলে এমন হয় না। 

বাবার সম্বল ছিল তখন গ্রহগুরু। সকাল হলেই গ্রহগুরুর দরজায় হাজির হয়ে ডাকতেন, ও সুবল, কিছু টের পেলে? 

গ্রহগুরু বলত, ভালই আছে কর্তা। ভাববেন না। সব গ্রহের ফের। ফিরে আসবে। 

বাবা বলতেন, এমন একটা ভাল কাজ মানু ঠিক করে দিল, ক’জনের হয়! মানুর বন্ধু এই করে বাড়ি গাড়ি সব করেছে। তোর যে হত না কে বলবে। তুই একটু ধৈর্য ধরে কাজটা শিখতে পারলি না। চিরকুটে লিখে রেখে গেছে,—আমি যাচ্ছি, ভাববেন না। বড় হয়ে ফিরব। 

বাড়ি ফেরার আমার খুব একটা মুখ ছিল না। কত দিন বাড়ি ছাড়া-মা নাকি একদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। আর বাবাকে দোষারোপ করছিল। আমি যা ছিলাম তাই আছি। বড় হয়ে ফিরব এই চিরকুটটি বাবা পুঁটলিতে ঠিক যত্ন করে বোধহয় রেখে দিয়েছেন। আসলে আমার মুখ নেই। বাবাই খবর পেয়ে আমাকে গিয়ে নিয়ে এসেছেন। আমার বড় হওয়াটা কী, বাড়ি ফিরে নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। 

দু-তিনদিন পিলু আমার সঙ্গ ছাড়ল না। আমি যেখানে পিলু সেখানে। কী জানি, আবার যদি দাদা ফেরার হয়! দাদাটি তার বড় হয়ে কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। মা-বাবার জন্য টান নেই। ভাই- বোনের জন্য ভাবে না। মায়া তো বাড়ি ফিরে এলে রাস্তায় দৌড়ে গিয়েছিল। তারপর জড়িয়ে ধরে ভ্যাক করে কেঁদে দিয়েছিল। –দাদা তোর সঙ্গে আর আমরা কথা বলব না। কোনদিন কথা বলব না। তারপর দৌড়। –মা, বাবা দাদাকে ধরে এনেছে। প্রায় চোরের মতো দেখছি সব। পলাতককে দেখার জন্য কলোনির ধীরেনের মা, গোপালের পিসি, সুবোধ, পল্টু যেখানে যে ছিল ছুটে এসেছিল। 

—কোথা থেকে ধরে আনলেন? কত রকমের প্রশ্ন। তখন পিলুই আমার ত্রাণকর্তা। সে ডাকল, দাদা, এদিকে আয়। বলে সে আমাকে বাড়ির পেছনটাতে নিয়ে গেল। —খোঁড়া গরুটার বাচ্চা হয়েছে- আয়, দেখবি। 

বাড়ি থেকে ফেরার হবার পর কী ঘটেছিল পিলুই সব এক এক করে বলল। দু-তিনদিন শুধু এই। একটা কথা মনে হয় আর বলে, – বুঝলি দাদা, সেই লোকটা রেগোবিন্দ না কী নাম, সকালে মানুকাকার কাছে হাজির। বলল, মানুকর্তা, আপনার ভাইপো কুড়ি টাকা চুরি করে পালিয়েছে। 

—বলল! 

—কী মিছে কথা, বল। তুই কখনও চুরি করতে পারিস? আমি বড় হলে লোকটার মুখ ঘুষি মেরে ভেঙে দেব। কী সাহস, আমার দাদার নামে মিছে কথা! আমি বললাম, না, মিছে কথা বলেনি রে! গোবিন্দর কৌটো থেকে কুড়ি টাকা নিয়েছি। 

—সত্যি নিয়েছিস? 

—তা না হলে ট্রেনে চড়ে যাব কী করে। 

পিলু কেমন গুম মেরে গেল। এতদিন যে বিশ্বাস দাদার উপর ছিল তা যেন নিমেষে উবে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছে পিলুর। সান্ত্বনার স্বরে বললাম, গোবিন্দদার কৌটোয় আর একটা চিরকুটে লিখে গেছি। 

—কী লিখে গেছিস? 

—টাকা মান যশ হলে সব দিয়ে দেব। 

পিলুর পায়ে বোধহয় একটা পিঁপড়ে কামড়ে ছিল, সেটা সে ঝেড়ে ফেলে বলল, মানুকাকাকে তো বলেনি সে-কথা। জানিস দাদা, তুই কাউকে বলিস না, একদিন বিকেলে আমি না গেছি। রেললাইন পার হয়ে গেছি। লোকটাকে আমি চিনে রেখেছি। বড় হই, তারপর মজা দেখাব। 

পিলু কি জানে, গোবিন্দ আমাকে মারধোর করত? বাবার কত বড় বাসনা ছিল, আমি একজন মোটর মেকানিক হই। একটা গ্যারেজে মানুকাকা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কমপারমেনটাল পরীক্ষায় পাস করলে এর চেয়ে বড় সুযোগ আর নাকি মিলবে না। বাবাকে মানুকাকা এমন বোঝাবার পরই গ্যারেজের কাজটা বাবার কাছে হাতে পাওয়া স্বর্গ ছিল। সেসব ছেড়ে ফেরার হওয়ায় বাবা নাকি খুব মনোকষ্টে ভুগছিলেন। 

—মা, জানিস, খুব ক্ষেপে যেত। একেবারে রণচণ্ডী। কি মানুষ রে বাবা, ছেলেটা কোথায় ফেরার হল কোনো খোঁজখবর করছে না কেউ! 

বাবা বলতেন, গেছে যখন ফিরে আসবে। কার জন্য তবে গাছপালা লাগিয়েছি, বাড়িঘর করেছি। ছেলে বোঝে না—কার জন্য! 

—আর ফিরেছে!—বলেই মা’র কান্না। 

—আরে ফিরবে। দেখো না দু-চারদিন! না খেতে পেলেই সুড়সুড় করে ফিরে আসবে।

—তুমি আমাকে জ্বালিও না। 

সেই বাবা নাকি তিন-চারদিন পর নিজেই সকালে উঠে গ্রহগুরুর কাছে গেছিলেন। এ-দেশে আসার পর বাবার অনেক নতুন বিষয়ের উপর বিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। যেমন তাঁর গ্রহগুরু। তিনিই ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্তমান। গ্রহগুরুর কাছ থেকে খবর নিয়ে এসে মাকে জানালেন, খুব বেশি দুরে যায়নি। কাছে পিঠে কোথাও আছে। মতিচ্ছন্নভাব কাটলেই চলে আসবে। ওটা এ বয়সে হয়। একটু গৃহহারা হবার শখ জাগে। তারপর নাকানিচুবানি —সংসার নিত্য হাঁ-করা জিভ, সব গিলে খেতে চায়। যখন বুঝতে পারবে সুড়সুড় করে বাছাধন ফিরে আসবে। তারপরই বাবা গাছের সবচেয়ে পুষ্ট আতা, পেঁপে এবং একথালা চাল ডাল গ্রহগুরুর সেবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাবার বিশ্বাস, গ্রহগুরু সন্তুষ্ট থাকলে সংসারে কোনো অমঙ্গল ঢুকতে পারে না। তাঁর পুত্র যেখানেই অবস্থান করুক কোনো অমঙ্গলের ভয় নেই। 

মা আমার জেদি এবং একরোখা। দেশ ছেড়ে আসার পর ওটা আরও বেড়েছে। বাবার প্রতি তাঁর বিশ্বাস কম্। সবকিছুতে অদৃষ্টবাদী যে মানুষ তাঁকে মা বিশ্বাস করেন কী করে। সেই বাবার ছেলে আমি। বাপের স্বভাব ছেলে পাবে, মার এটা জানাই ছিল। বাবার অবিচল গ্রহভক্তিতে মার মেজাজ নাকি খুবই তিরিক্ষি ছিল। কথায় কথায় কান্না জুড়ে দিত। রাতে ঘুমাত না। গাছের একটা পাতা খসে পড়লেও উঠে বসত। পিলু জানাল, বাবা ঘুমালে মা আর সহ্য করতে পারত না। যার ছেলে নিখোঁজ সে এভাবে নিদ্রা যেতে পারে! তুমি কি মানুষ না। দেখ পিলু, কে বলবে তোর দাদা বাড়ি নেই। কে বলবে দেখে, আমাদের সময় খারাপ। কেমন নিশ্চিন্তে হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। চেঁচামেচিতে রাতে বাবার ঘুম ভেঙে গেলে বলতেন, ঘুমাও ধনবৌ। মন শান্ত কর। শরীর নষ্ট করে লাভ নেই। তেনার ইচ্ছের উপর আমাদের হাত নেই। শুধু লড়ালড়ি সার। বলে বাবা আবার শুয়ে পড়তেন এবং কুম্ভকর্ণের মতো নিদ্রায় মগ্ন হতেন। বাবার নিস্পৃহতা যখন চরম বোধ হত, মা আহার বন্ধ করে দিতেন। এটাই ছিল বাবার প্রতি মার মোক্ষম ওষুধ প্রয়োগের বিধি। বাবা খুব বিড়ম্বনাবোধ করতেন। খোঁজাখুঁজি শুরু হতো। মানুকাকার কাছে ছোটাছুটি, গ্যারেজে ছোটাছুটি, চিরকুটটি আমার হস্তাক্ষরে লিখিত কিনা, না গুমখুন, এসব নিয়ে বাবার দুশ্চিন্তা দেখা দিলে, ঠাকুরঘরে ঢুকে যেতেন। যখন একান্ত অসহায় তখন দেশ থেকে আনা শালগ্রামশিলা ভরসা। পুজোর ঘরে বসে রোজ একশ একটা তুলসীপাতা শালগ্রামশিলার মাথায়। মা’র তাতেও ভরসা কম। বিপদনাশিনী ব্রত প্রতি বৃহস্পতিবার শুরু করে দিল। এই করতে করতে বাবার কাছে এক চিঠি হাজির। আপনাদের বিলু রহমানের কাছে আছে। ঠিকানা সমেত চিঠি পেতেই বাবা দুর্গানাম সম্বল করে সোজা সেই শহরে। 

ফিরে আসার পর পিলু কলোনির সর্বত্র খবর দিয়ে এসেছে, দাদা ফিরেছে। 

দাদা আমার কত বড় হবে, দেখিস। একা একা বর্ধমান পার হয়ে চলে গেছে। দাদা এম এ বি এ পাস করবে। আমার বাবাটা না দাদাকে ড্রাইভার বানাতে চায়। আচ্ছা, বাবা যে কী না! মানুকাকা- যে কী না। এক বিষয়ে ফেল করলে কী হয়? বাবা তো বলেছে, কিছু হয় না। সেই বাবাটাই মানুকাকার বুদ্ধিতে দাদাকে গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিল। আমরা গরিব বলে মানসম্ভ্রম নেই। দেশবাড়িতে থাকলে মানুকাকা এমন বলতে সাহস পেত! দাদা চলে গিয়ে বেশ করেছে। এখন বোঝো! 

এক বিকেলে আমরা সবাই বারান্দায় বসেছিলাম। অঝোরে বর্ষণ শুরু হয়েছে। ব্যাঙ ডাকছে। মাঠঘাট জলে ভেসে গেছে। অঘ্রাণের মাঝামাঝি খুব বর্ষা হলে যা হয়। এখানে আসার পর এবারেই প্রথম বাবার লাগানো গাছে কাঁঠাল ধরেছে। আম গাছগুলিতে মুকুল দেখে গিয়েছিলাম। কিছু আমও হয়েছে। বাড়ি ফিরে আসব আসব করে মা কটা আম রেখেছিল, কিন্তু শেষে পচে যায় দেখে আমার জন্য আমসত্ত্ব বানিয়ে রেখেছে। আঝোরে বর্ষণ হলে আমার খুব ভালো লাগে। সব গাছপালা বাড়ির চারপাশে সজীব। মা রান্নাঘরে কাঁঠাল বীচি ভাজছে। গরম গরম কাঁঠাল বীচি ভাজা অঝোর বর্ষণের দৃশ্য দেখতে দেখতে খাওয়ার কী যে মজা! পিলু খোঁড়া গরুটাকে নিয়ে আসছে। দু’জনেই ভিজে গেছে। দূর থেকেই বললে, দাদা, কী খাচ্ছিস রে! 

বললাম, কাঁঠাল বীচি ভাজা। 

—মা, আমি খাব। 

মা বলল, কটা তো ছিল। সব তো সাবাড় করেছিস। মা যে গোপনে কাঁঠাল বীচি ও আমসত্ত্ব আমার জন্য তুলে রেখে দিয়েছে, পিলু জানত না। পিলু অন্য সময় হলে মারদাঙ্গা শুরু করে দিত, কিন্তু আমি ফিরে এসেছি এই পুণ্যফলে সে কিছু আর বলল না! বারান্দায় উঠে গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে পিলু বলল, দাদা, আমাকে একটা দিবি? 

আমি বললাম, সবার জন্যই করেছে! 

মায়া কোঁচড় থেকে তুলে বলল, নে না। 

পিলু কিন্তু নিল না। 

আমি বললাম, নে, আমার কাছ থেকে। 

পিলু বলল, না, খা। আমাকে মা দেবে। 

মা বলল, খুব যে ভালো ছেলে রে! সইবে তো! বলেই মা একটা বাটিতে বীচি ভাজা এনে পিলুকে দিল। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কী গো, খাবে? খাও না দুটো! বিলুর জন্য তুলে রেখেছিলাম। 

আমাদের বারান্দাটা টালির। বেশ লম্বা বারান্দা। আগে খুব ছোট ছিল। পা ছড়িয়ে বসা যেত না। বাবার কাছে শুভাশুভ জানতে সব যজমানরা আসে। তাদের বসার জন্যই বারান্দাটা করা হয়েছে। এবং বড় বলে, আমাদের পোষা কুকুরটাও ভিজতে ভিজতে উঠে এল। ছোট ভাইটা হাঁটতে শুরু করেছে। ঝড়বৃষ্টিতে বড় ভয় পায়। মেঘ ডাকলে ভয় পায়। সে বাবার কোলে ভালো মানুষটি হয়ে বসে আছে। আমাদের সংসারে এই আমরা ক’জন। সামনের জমিতে বাবা কিছুটা জায়গায় পাট, লাগিয়েছিলেন। সেগুলো কবেই কাটা হয়ে গেছে। নারকেল গাছের মাথায় বসে একটা কাক ভিজছিল। ছাতা মাথায় রাস্তায় লোকজন দেখা যাচ্ছে। পরে খালের মতো একটা সরু ফালি বাদশাহী সড়কের দিকে গেছে। জল উপচে পড়লে কই, শিঙি, মাগুর, বড় পুঁটি, ট্যাংরা বৃষ্টির জলে ভেসে আসবে। বৃষ্টিটা আরো হোক, আরও জোরে, মেঘের দিকে তাকিয়ে পিলু এমনই বোধ হয় ভাবছে। লেখাপড়া করা ছাড়া পিলুর সব কাজেই ভারি উৎসাহ। কত খবর সে রাখে। কোন মাছ কখন ডিম পাড়ে, কোন মাছ বর্ষা হলে রঙবেরঙের হয়ে যায় সে ছাড়া এ খবর আমাদের আর কেউ রাখে না। সেই পিলু বীচি ভাজা খেতে খেতে বলল, দাদা, যাবি? মাছ উঠবে! 

মা বলল, সেবারের কথা মনে নেই? তোমাদের আক্কেল বড় কম। 

—কী হয়েছে। পিলু তেতে উঠল। 

বাবা খুব উদাস গলায় বললেন, ধনবৌ, রাখে কৃষ্ণ মারে কে। 

মা খুব তপ্ত হয়ে উঠল—হয়েছে ধর্মের কথা আর শুনিও না। ঐ করে তো গেলে! 

কী যে গেল বাবা বুঝল না। কপর্দকশূন্য মানুষের এখন যা হোক বাড়িঘর হয়েছে, ছেলেপুলে বড় হচ্ছে, বিলুটাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে, মানুকেও খবর দেওয়া হয়েছে, শ্রীমান ফিরে এসেছেন। নিয়ে আসা হল, এখন কিছু একটা করতে হয়। শ্রীমানের বড় ইচ্ছা কলেজে পড়ে। এই পড়া নিয়ে একটা গণ্ডগোল বাধবে বোঝাই যাচ্ছিল। মানুকাকার জবাব, পড়াবেন কী করে! খাওয়াতে পারেন না, ছেলেরা বোঝে না? এখন সংসারে কী করে দুটো পয়সা আসবে না দেখলে চলবে কেন? বাবার কাছে মানুকাকার কথাই শেষ কথা। কিন্তু এবারে মানুকাকার পরামর্শমতো কাজ করবেন কিনা, সেই নিয়ে তাঁর কিছু বোধ হয় সংশয় জন্মেছে। মানু তো বলেই খালাস, হয়তো চেনাজানা কোনো কাপড়ের দোকানে লাগিয়ে দেবে। সে তো জানে না তার ধনবৌদিটি কী বস্তু! 

আমি বাড়ি ফেরার পরই মা বাবাকে শাসিয়ে রেখেছিল, ছেলে যা চায় তাই কর। পড়তে চায়। ভর্তি হবার টাকা ছেলে তোমার রোজগার করে এনেছে। বাধা দিলে অনর্থ ঘটবে। 

তা সত্যি, রহমানদা ফেরার সময় বাবাকে লেছে, এই নিন, কটা টাকা দিলাম। বাবা এখানে আসার পর একসঙ্গে এত টাকা কখনও হাতে পাননি। শিষ্যরা পাঁচ দশ টাকা বেশি হলে দেয়। ঠাকুরের নাম করে পাঠায়। কলোনিতে নিত্যপূজা আছে নিবারণ দাসের ঘরে। কিছু জমি এবং যজমান এই ভরসা বাবার। পড়াবার জন্য বাড়তি টাকা হাতে কমই আসে। বাবার সাহসে কুলোচ্ছিল না। কিন্তু মা এবং পিলু ও মায়া চায় তাদের দাদা কলেজে পড়ুক। এতে সংসারের ইজ্জত বাড়ে, বাবাটা কেন যে বোঝে না! মা তো সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, ছেলে আমার কলেজে পড়বে। বাবা বুঝতে পারেন, মানুষের বাড়ি-ঘর হয়ে যাবার পর একটা নীল লণ্ঠনের দরকার। সেটা ধনবৌ এখন জ্বালতে চায়। সলতে পাকানো আছে। শুধু জ্বেলে দেওয়া বাকি। 

বাবা বললেন, মানুকে বলে দেখি, দু-একটা টিউশন ঠিক করে দিতে পারে কিনা। 

অনেকদিন পর আবার মনে হলো, মানুষটার বিষয়-আশয়ে ভক্তি বেড়েছে। সুবুদ্ধি গজিয়েছে মাথায় প্রবল বর্ষণে বাবার কথা শোনা যাচ্ছিল না। টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। গরুটা ডাকছে। আমাদের কাঁঠাল বীচি খাওয়া শেষ। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। মা ঘরে ঢুকে হারিকেন জ্বালাল। দুদিকে দুটো বড় বাঁশের মাচান। বাবার অনেকদিন থেকে শখ একটা তক্তপোশ করাবেন। উত্তরের দিকের জমিতে বড় একটা শিশুগাছ আছে। ওটা কেটে বানালে শুধু মজুরির খরচা। আমি যদি দুটো টিউশন করি, বাড়তি পয়সা আসবে সংসারে। মারও মনঃপুত হয়েছে কথাটা। কবে যাওয়া হবে এই নিয়ে কথা হতেই বারান্দায় হারিকেন রেখে মা বলল, কালই যাও। ঠাকুরপোকে বলো, তার তো শহরে চেনাজানা মানুষজন আছে। ওকে বললে ঠিক করে দিতে পারবে। 

রাতে পিলু ঘুমাচ্ছিল না। কেবল এ-পাশ ওপাশ করছিল। এটা হয়। রাতে আমাকে কিছু বলতে চাইলেই তার এটা হয়। কিন্তু আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি, ডাকলে ঘুম ভেঙে যাবে, ঘুম ভাঙলে আমার ভারি রাগ হয় সেটা সে জানে। বুঝতে পারছিলাম, আমি সাড়া না দিলে সে কিছু বলবে না। বললাম, কীরে ঘুম আসছে না। 

পিলু খুব সতর্ক গলায় বলল, দাদা তুই সত্যি কলেজে পড়বি? তুই টাকা রোজগার করেছিস?

আমি যে টাকা রোজগার করে এনেছি, পিলু জানে না। রহমানদার সামান্য কাজকর্ম করেছি। ট্রাক নিয়ে কয়লা খনিতে গেছি। ওজন মিলিয়ে কয়লা চালকলে সাপ্লাই করেছি এবং রহমানদার খুব বিশ্বাসভাজন লোক হয়ে গেছিলাম, সে তা জানে না। আমার ইচ্ছে ছিল, টাকা জমলে বাড়ি ফিরে আসব। কিন্তু রহমানদা আমাকে আশ্রয় দেওয়ায় কী দেবে-থোবে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আসার সময় যে সে এতগুলি টাকা বাবাকে দেবে তাও বিশ্বাস হয়নি। টাকা কটা আসার সময় বাবার কাছেই ছিল। বাড়ি ফিরে বাবা টাকা কটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, মার হাতে দাও। প্রথম উপার্জনের টাকা মার হাতেই দিতে হয়। হাতে দেওয়ার পর মাকে প্রণাম করবে। পৃথিবীতে আজীবন তিনিই তোমার সবচেয়ে অধিক মঙ্গলাকাঙক্ষী। 

.

আমাদের বাড়ি থেকে শহরটা বেশি দূর নয়। ক্রোশ দুই লাগে যেতে। পুলিস ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা বাদশাহী সড়কে উঠে গেছে। বিরাট এলাকা নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প। দেশছাড়া মানুষ যারা, বনজঙ্গল কেটে ঘর বানাচ্ছে যারা, তাদের পক্ষে ক্যাম্পটা বড় কাজে লাগে। সুমার মাঠ ক্যাম্পের মধ্যে। সবুজ ঘাসপাতা—গরু-বাছুর সব ছাড়া থাকে সেখানে। ক্যাম্পের সব হাবিলদার সুবাদার থেকে সি ডি আই পিলুর অনুগত। ফলে গোটা এলাকাটাই যেন তার নিজস্ব জায়গা। অন্যের গরুবাছুর চরে বেড়াচ্ছে কে খবর রাখে। কেবল পিলু সব খবর রাখে। তাকে মাঠে দেখলে মনে হবে, সে এত বড় বিশাল ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক। ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে বাদশাহী সড়কে উঠতে আমাদের কম সময় লাগত। এমনিতে সাধারণের যাওয়া নিষিদ্ধ। পিলু আমাদের গাড়াটার পাসপোর্ট। বন্দুক উঁচিয়ে যে যখন সেনট্রি দেয়, পিলুর নাম বললেই হল, পিলুদের পাড়ার লোক আমরা। 

সেই পিলু এখন বাড়ি-ছাড়া হচ্ছে না। দাদা কলেজে পড়বে, এটা ঠিক হয়ে যাওয়ার পর সে আরও অহংকারী হয়ে উঠল। তার দলবলের সংখ্যা বেড়েছে। সেখানে এখন তার একটাই গল্প। দাদা কীভাবে ট্রেনে চড়ে কলকাতায় গেছে। কলকাতা কত বড় শহর। রেলগাড়ি চড়ে যেতে হয়। চেকার টিকিট চায়। টিকিট না থাকলে তোমাকে ট্রেনে উঠতে দেওয়া হবে না। রেলগাড়ি চড়ে পিলু যখন এদেশে আসে, তখন তার সব ভালো মনে ছিল না। দাদার কাছ থেকে আবার জেনে নিচ্ছে সব। বাবার কাছে রানাঘাটের গল্প শুনেছে। দাদার কাছে কলকাতার। আর একটা শহর বর্ধমান পার হয়ে। এখন এই তিনটি শহর সম্পর্কে সে প্রায় অভিধান, এমন একটা ভাব নিয়ে আছে দলবলের কাছে। ট্রামগাড়ি দেখতে কেমন লম্বা স্কুলবাড়ির মতো। শিয়ালদা ইস্টিশনে রেলগাড়ি বিরাট একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। টিকিট না কেটে ট্রেনে উঠলে জেল। 

পিলুর যে কত প্রশ্ন থাকে। পিলু যে ভাবে কথা বের করে নিচ্ছে, কখন না জানি ফস করে ছোড়দির কথা বলে দিই। সেই লম্বা ফ্রক গায় দেয়া মেয়েটা, সুন্দর মুখ, সবসময় বাড়িতে জুতো পরে থাকে। সবসময় পরীর মতো বাগানে ঘুরে বেড়াত। রহমানদাকে নাম ধরে ডাকত। একসময় ছোড়দির বাবার গাড়ি রহমানদা চালাত। একটা এত্ত বড় কুকুর ছিল ছোড়দির সঙ্গী। তেমন একটা পরীর মতো মেয়ে আমার খুব বন্ধু হয়ে গেছিল। বাবা নিয়ে আসার পর আমার এখন একটাই কষ্ট। সকাল হলে আর ছোড়দিকে দেখতে পাই না। কী যে থাকে মনে। ছোড়দির কথা মনে হলেই কেমন একটা রূপকথার রাজত্ব চোখে দেখতে পাই। ছোড়দি গাড়িতে উঠছে। পায়ে সাদা কেডস, সাদা মোজা, ফ্রক, নীল বেল্ট, মাথায় নীল চুল। বিকেলে সাইকেল চালাচ্ছে বাড়ির লনে। আমাকে পিছনে নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। ছোড়দি যা বলত, তাই করতাম। একদিন ছোড়দি সাইকেলটা হাতে দিয়ে বলল, বিলু ধর। আসছি—ছোড়দি সেই যে গেল, আর এল না। পাঁচিলের পাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রহমানদা বলেছিল, কীরে, ছোড়দির সাইকেল নিয়ে কী করছিস! পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলেছিল, ছোড়দি ভুলেই গেছে। সাইকেলটা দিয়ে আয় বাড়িতে। ছোড়দি এমন স্বভাবেরই ছিল। সে-ই বাবাকে চিঠি লিখেছিল, বিলুকে নিয়ে যান। বিলু আমাদের এখানে আছে। ছোড়দির প্রতি আমার এজন্য একটা অভিমানও আছে। কিন্তু কেন জানি পিলুকে সব কথা বললেও ছোড়দির কোনো গল্প তাকে করতে পারিনি। কোথায় যেন এই প্রথম কিছু গোপন করতে শিখে গেছি। 

পুলিস ক্যাম্প পার হলেই বাদশাহী সড়ক। দু’পাশে আম জামের গাছ। কোথাও বড় বড় রেনট্রি। সোজা জেলা বোর্ডের অফিসের পাশ দিয়ে রেললাইনে উঠেছে। একটা জেলখানা, তারপর সাহেবদের কবরভূমি। শেষে সরকারি খামার ডাইনে ফেলে রাস্তাটা শহরে ঢুকে গেছে। যেতে আসতে আমার এই রাস্তাটার প্রতি একটা মায়া পড়ে গেছিল। পৃথিবীতে এমন সুন্দর রাস্তা আর কোথাও বোধ হয় নেই। দু’পাশে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত এবং মাঝে মাঝে আকাশের প্রান্ত দিয়ে পাখিদের উড়ে যাওয়া আমাকে মুগ্ধ করত। ছোড়দির কথা মনে এলে রাস্তাটায় একা একা হেঁটে বেড়াতাম। ইট সুরকির তৈরি রাস্তা। বৈশাখের ঝড়ে কখনও সেই লাল ধুলো আমাদের বাড়ি পর্যন্ত উড়ে আসত। বাবা এখানটায় বাড়ি করার পর সব কিছুর সঙ্গে কী করে যেন একাত্ম হয়ে উঠছি। আমার মা, বাড়ির গাছপালা, খোঁড়া গরু, শালগ্রামশিলা, পিলুকে নিয়ে শীতকাল পর্যন্ত একরকম কাটল। বাবা একদিন শহর থেকে ফিরে এসে বললেন, হয়ে গেল। 

বাবার এমনই স্বভাব। বাড়ি এসে বারান্দায় বসলেন। মায়া পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। কি হয়ে গেল কিছু বলছেন না। বাড়িতে দু’জন অতিথি আছেন সপ্তাখানেক ধরে। দেশ থেকে বাবা খবর দিয়ে আনিয়েছেন। এখনও সময় আছে, চলে এসো। জমিজমা কিনে এদেশে ঘরবাড়ি করে ফেল। মা এতে মনে মনে সাংঘাতিক চটে থাকে। নিজেরই খাবার নেই, শংকরাকে ডাকে। —মার এই রকম ক্ষুরধার বাক্যে বাবা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলেও দমে যান না। 

বাবার কথা, মানুষের দুঃসময় যাচ্ছে ধনবৌ—খোঁটা দিয়ে কথা বল না। চলে তো যাচ্ছে। কোনদিন না খেয়ে আছ বল! 

এসব কথাবার্তা অতিথিরা বাড়িতে না থাকলে বলতেন। এরাই নয়—বাবা যেখানেই যান, সবাইকে বলে আসেন, আসবেন, ঘরবাড়ি কেমন করলাম দেখে যাবেন। দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই এই কথা। লোকজন, আত্মীয় কুটুম বাড়ি না এলে ঘরবাড়ি কার জন্য। বাবা নিজে খেতে ভালোবাসতেন, আত্মীয় কুটুমের বাড়ি বেড়াতে ভালোবাসতেন। খাওয়াতে ভালোবাসতেন। বাড়িঘর হয়ে যাওয়ার পরই দেশের আত্মীয় কুটুম চেনাজানা লোকের কাছে চিঠি। ও-দেশে আর থাকতে পারবে না। বৃথা আশা। দেশটা আবার এক হয়ে যাবে ভেব না। থাকার তো অভাব হবে না। আমি যখন আছি 

মা’র কাছে এই ‘আমি যখন আছি’ খুবই বিরক্তিকর। ছেলেটাকে যার পড়াবার মুরদ নেই, তার আবার এসব লেখা কেন। বাবার চিঠির বিশ্বাসেই দেশ থেকে দুই চৌধুরী এখন এখানে এসে উঠেছেন। রোজই রাজবাড়ি যেতে হচ্ছে। জমির বিলি বন্দোবস্ত দেখতে। বাবা প্রথম দু’দিন গেছিলেন সঙ্গে। উপেন আমিনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। এখন ওরা নিজেরাই যায়। আমাদের বাড়ির পেছনটাতে কিছু ডোবা জঙ্গল আমবাগান আছে। তাই আপাতত কিনে রাখা। বাবা যে ভালো আছেন, সচ্ছল পরিবার বাবার, এসব বোঝানোর জন্য বেশ ভালো মাছ-টাছ বাজার থেকে আসছে। একটা আস্ত ইলিশ পর্যন্ত। যে দামই হোক বাবার যেন অর্থের কমতি নেই—ফিরে গিয়ে কেউ না বলে বাবা আমার ভারি কষ্টে আছেন। 

বাবা মনে করেন সংসারের অভিভাবক হিসাবে এটা তাঁর বড়ই কৃতিত্ব। বিলুটা কলেজে পড়বে— এই খবর দিতে নিবারণ দাসের আড়তে ছাতা বগলে চলে গেছেন কদিন। নতুন বাজার বসেছে সেখানে চেনাজানা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। –কি কত্তা ছেলের খোঁজ পেলেন? 

—পাব না কেন! ও তো আর বাড়ি ছাড়া হয়নি। মতিচ্ছন্ন হয়েছিল। আবার সব ঠিক হয়ে গেছে। ফিরে এসেছে। কলেজে পড়তে চায়। যখন চাইছে পড়ুক। আমার একভাবে চলে যাবে। আসলে বাবার এতসব কথা বাড়িঘর করার মতোই। ছেলে আমার আর একটা পাস দেবে। এখানে যারা বাড়িঘর করেছে, কেউ কলেজের মুখ দেখার সুযোগ পায়নি, কেবল তার ছেলে বিলু কলেজে পড়ে। এই একটা বড় খবরে বাবা কিছুদিন মশগুল থাকলেন। যজমান বাড়ি গেলেও আমি জানি একথা সে কথায় তিনি তাঁর পুত্রের কথা টেনে আনবেন। এবং এমন যখন চলছিল তখনই সেদিন শহর থেকে ফিরে এসে বাবা বারান্দায় বসতে না বসতেই জানালেন, হয়ে গেল। হয়ে গেল কথাটার কত রকম মানে হতে পারে বাবা যদি বুঝতে পারতেন। মা কুমড়ো ফুলের বড়া করছিল, খুন্তির শব্দে ঠিক শুনতে পায়নি। কেবল বলল, কি বললে? 

—হয়ে গেল। 

মা এবার সবটা শোনার জন্য কড়াই নামিয়ে বারান্দায় উঠে এল। –কি হয়ে গেল! 

—বিলুর পড়ার ব্যবস্থা। সামনের ছুটির পরই ভর্তি হবে। কি যেন বলল, মানু, তবে হয়ে যাবে। কোনো চিন্তার কারণ নেই। সব ক্লাস ভর্তি হয়ে গেলেও মানু যখন আছে, বিলুর জন্য আটকাবে না। মা বোধ হয় বাবার সব কথা বুঝতে পারছিল না। আমাকে ডেকে আনল। কাছে গেলে বলল, তোর বাবা দেখ কি বলছে। আটকাবে না বলছে। 

বাবা বলল, আগে এক গেলাস জল দাও, খাই। বাবা জলটা খেয়ে পিলুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন গরুটা নেড়ে দিয়েছে কিনা, না এক খোঁটাতেই আছে। বাবা তাঁর দ্বিতীয় পুত্রটিকে সব সময় সংশয়ের চোখে দেখেন। সে সহজেই কাজ না করেও বলে দিতে পারে, হ্যাঁ দিয়েছি। এই তো দিয়ে এলাম। বাবা বাড়ি না থাকলে দ্বিতীয় পুত্রটি একটু বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। এতে সংসারের অনিষ্ট হলেও প্রতিবেশীরা পিলুর সুখ্যাতি করতে ছাড়ে না। সে তার বাবার কাজের প্রতি বড়ই অমনোযোগী। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখে আয় নেড়ে দিল কি না। 

গরুবাছুর আমি নাড়ানাড়ি করি পিলুর পছন্দ নয়। দাদার আভিজাত্য নষ্ট হবে ভাবে। দাদা কলেজে পড়বে, সেই দাদা মাঠে গরুবাছুর টানাটানি করুক সে চায় না। সে বাবাকে আশ্বস্ত করে বলল, যাচ্ছি। তোমার যে বাবা-আর কি যেন বলার ছিল বলতে পারল না। মুগুরটা কাঁধে ফেলে চলে গেল। যাবার সময় বাবা হেঁকে বললেন, শোনো, পুকুরে এখন নেমো না। যদি নামো দু’ডুব দিয়ে উঠে আসবে। যদি দেখি দেরি হচ্ছে ভালো হবে না। 

এটা অবশ্য পিলুর হয়। গরমকালটায় সে পুকুর পাড়ে গেলেই কিছুক্ষণ পুকুরে সাঁতরে নেয়। 

কখনও সখনও গামছায় ছেঁকে কুচো চিংড়ি ধরে আনে। আর কিছু না পারুক, ঘাসপাতা পেলে তাও জড় করে নিয়ে আসবে। বাইরে গেলে ফেরার সময় তার হাতে কিছু থাকবেই। পিলু খালি হাতে বাড়ি ঢুকতে শেখে নি। মা’র তর সইছিল না। এমনই স্বভাব মানুষটার। সবটা না বলে অস্বস্তির মধ্যে রাখা। মা একটু রুখে উঠল, কি বলছিলে বিলুকে বল। 

—বলছি বলছি। বলে কাপড়ের খুঁট দিয়ে মুখের ঘাম মুছলেন। মানু তো বলল, আই এস সি না কি বলে ওটা হবে না। এফ এ-টাও হবে না। আই কম-টা হবে। নতুন খুলেছে। কিছু সিট খালি আছে। 

আমার অবস্থা যা হয়। কলেজে পড়া নিয়ে কথা। ছোড়দিও আমাকে বলে দিয়েছে, পড়াটা ছেড় না বিলু। আমি বুঝি আমাকে বড় হতে হলে পড়তে হবে। বড় হওয়ার সঙ্গে কলেজে পড়াটার এমন একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে আগে যদি বুঝতাম। মাকে বুঝিয়ে বললাম, কমার্স নিয়ে পড়ব। 

বাবা যা বললেন, তার মধ্যে এফ এ-টা বুঝেছে। মা’র এক মামা এফ এ পাস ছিল। স্বদেশী করত। মানুষজন তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। তার মতো ছেলে হবে ভাবতেই মা’র গর্ব বোধ হত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না শুনে খুব দমে গেল। আর জেদি এক রোখা হলে যা হয়, বলল, বিলুকে এফ এ পড়তে হবে। ও সব আইকোম টোম চলবে না। ওতে কিছু হয় না। 

বাবা নিরাশ গলায় বললেন, বোঝো। 

—বোঝার কি আছে। সারাজীবন বুঝিয়ে তো এই হাড়মাসে এনেছ। 

এ-দেশে আসার পর দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় মা’র শরীরটা বেশ ভেঙে গেছে। বাবা আমার কেমন অতলে ডুবে যাচ্ছিলেন। কি করে বোঝান, বিষয়টা একই। লাইন আলাদা। বাবা অগত্যা পার পাবার জন্য বললেন, মানু তো বলল, আজকাল আর এফ এ পড়ে লাভ নেই। 

–রাখ তোমার মানু। উই তো ডোবাল। কে বলেছিল একটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিতে। জলে পড়ে গেছি বলে, আমরা বুঝি আর মানুষ না। 

বাবা অগত্যা বললেন, তালে মানুকে বলতে হবে বিলু এফ এ পড়বে। তার ব্যবস্থা কর।

—তাই বলগে। 

মা এইটুকু বলে নিষ্ক্রান্ত হলেন। বাবার অবস্থা এখন খুবই বিপজ্জনক। মানুকাকাকে চটাতে পারেন না। মাকেও না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি করবি? 

তখনই আবার আমার মা রান্নাঘর থেকে বারান্দায় হাজির, টিউশনির কথা কিছু বললে না?

বাবা খুব ক্ষিপ্ত। বোঝে না সোঝে না—কেবল ত, বাবা বললেন, জানি না! মা আরও এক ধাপ ক্ষেপে গেল। —ঠিক আছে, নিবারণ দাসকে বলছি। সেতো মরে যায় নি। 

নিবারণ দাস বাবার অবস্থাপন্ন যজমান। বাবা না থাকলে বিপদে আপদে সে আমাদের দেখে থাকে। বাবা নিবারণ দাসকে শেষ সম্বল মনে করেন। কোথাও কিছু না হলে সেতো আছেই। তাকে এ- নিয়ে জ্বালাতন করা বাবার বোধহয় পছন্দ নয়। অগত্যা বললেন, বলেছি। সব বলেছি। ঠিকও হয়েছে। কালীবাড়িতে বিলু থাকবে। ওখানকার সেবাইত নাকি একজন মাস্টার খুঁজছে। বিলুকে দিয়ে হয়ে যাবে মানু বলল। বাবার এই আশ্বাসে মানুকাকার উপর মা’র আবার আস্থা ফিরে এল। একেবারে শান্তশিষ্ট বালিকা তখন মা আমার। খুব অল্পতেই মা’র বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায় আবার খুব অল্পতেই মা’র আস্থা চলে আসে। যাবার সময় শুধু বলল, তোমরা যা ভালো বোঝো কর। বিলু আবার যেন ফেরার না হয়। বড় চাপা স্বভাবের। 

বুঝতে পারছিলাম মা তার পছন্দ-অপছন্দের চেয়ে আমার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে বেশি ভাবছিল। মাকে বললাম, কর্মার্স পড়লে সহজেই চাকরি পাওয়া যায়। আমার ওটাই পড়ার ইচ্ছে! 

সুতরাং পুজোর পর বাবা আমার যাত্রার আয়োজন করলেন। খুব দূর নয়। আমাদের বাড়ির পেছনটাতে বড় একটা পুরনো ইটের ভাটা আছে। ওখানে নবমী থাকে। পিলু আমাকে নিয়ে সেখানে দু-একবার গেছেও! আমি ফেরার হলে পিলু নবমীকে বলে এসেছিল, দাদাটা যে কোথায় চলে গেল! পিলুকে মনমরা দেখে নবমী বলেছিল, আপনার দাদা একজন গুণীমানী মানুষ হবে গ দাঠাকুর। তার কি কলোনি ভালো লাগে। বড় হলেই চলে আসবে। সেই থেকে পিলু নাকি স্বপ্ন দেখত, দাদা রোজই সকাল বিকেল একটা গাড়িতে বাড়ি আসছে। পিলুর জন্য নতুন প্যান্ট, মার জন্য শাড়ি, আর এক হাঁড়ি রসগোল্লা। পিলু রসগোল্লার কাঙাল। স্বপ্নে সে কতদিন নাকি দাদার হাত থেকে নিয়ে রসগোল্লা খেয়েছে। 

আমি বাড়ি ফিরলেও পিলু নবমীকে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছে। দাদাকে বাবা গিয়ে নিয়ে এসেছেন। ছোড়দির চিঠি পেয়ে বাবা যে আমাকে আনতে রওনা হয়েছে, সে খবরও দিয়েছিল। পিলুর সব সুখ- দুঃখের খবর নবমী বুড়িকে দেওয়া চাই। তার যত কাজ থাক, যত ফলপাকুড় সংগ্রহের বাতিক থাক, নবমীকে সব খবর না দিয়ে থাকতে পারে না। সেই নবমী বুড়ির বনটা পার হলে, কারবালা। তারপর একটা ইট সুরকির রাস্তা এবং পরে কাশের বন—রেল লাইন। রেললাইন পার হলেই সেই কালীবাড়ি। পিলু শুনে বলল, ওতো খুব কাছেরে দাদা। আমি রোজ এক দৌড়ে যাব, এক দৌড়ে আসব। পিলু বোধহয় ভেবেছে বাড়ি ছেড়ে আমার থাকতে কষ্ট হবে। দাদা ঘাবড়ে না যায়। সে দাদাকে সাহস দিচ্ছে। 

বাবা সকাল থেকেই আমার যাবার আয়োজনে ব্যস্ত। পঞ্জিকায় শুভ দিন দেখে যাওয়া হবে। যাবার আগে বাবার পুজো-আর্চার সময় বেড়ে গেল। বিগ্রহ খুশি থাকলে সব ঠিক থাকবে। আগে তাঁকে খুশি করা দরকার। নীল অপরাজিতা তুলে এনেছেন—নেংড়ি বিবির হাতা থেকে পদ্মফুল তুলে এনেছেন, একশ একটা। খোঁড়া গরুটার দুধের সবটাই পায়েস হয়েছে। মা সকাল সকাল রান্নাঘরের কাজ সেরে ঠাকুরঘরে ঢুকে গেছে। বাবা এক হাতে পুজোর আয়োজন করতে দেরি করে ফেলবেন—কারণ সব সময়ই বাবার ধারণা পুজোর কোনো ত্রুটি থাকলে বাড়িঘরে অমঙ্গল ঢুকবে। কিনা অঘটন ঘটে। কাজেই সব দিক বজায় রাখতে হলে মা টের পায়, তারও হাত লাগানো দরকার। মায়া আজ পিলুকে আমাকে সকালের খাবার দিল। দুপুরের খাবার মা পুজোর ঘর থেকে বের হয়ে দেবে। স্নান করে গরদের শাড়ি পরে পায়েস রান্না, তারপর ঠাকুরঘরে মা চন্দন বেটে আতপ চাল ধুয়ে তিল তুলসী হরিতকী সাজিয়ে এবং ধূপ দীপ জ্বেলে যখন বুঝল বাবা খুব প্রসন্ন তখনই বের হয়ে এল। আমাকে বলল, চান করে ঠাকুরঘরে গিয়ে বস। 

পুজোর সময় বাবা কেমন নির্বিকল্প মানুষ হয়ে যান। পুত্র-কলত্র সব তাঁর কাছে তখন অর্থহীন। ধ্যানে মগ্ন থাকেন আর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঘণ্টা বাজান। তুলসীপাতা একের পর এক চাপান বিগ্রহের মাথায়। বাবার ধারণা বিগ্রহের সেবা ঠিকঠাক হচ্ছে বলেই আমরা সব বেঁচে বর্তে আছি। আমি যে ফিরে এসেছি, সেও বিগ্রহের অসীম কৃপায়। বোঝাই যায় বাবা কেমন এক মহাবিশ্বের খবর পেয়ে যান এই ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। মানুষের জন্মমৃত্যু, বেঁচে থাকা সবই অপার রহস্যময়। যেন সব কিছুর অস্তিত্বের মূলে তিনি। 

বাবার পুজো শেষ হলো বেলা করে। একসঙ্গে আমরা খেলাম। খেতে বসে বাবা বললেন, বিলু তোমার নতুন জীবন শুরু। মনে রেখ পৃথিবীতে কেউ তোমার পর নয়। বাবা সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করলেন—তার অর্থ বোঝালেন। তুমি একা এ বিশ্বসংসারে। আবার তুমিই এই বিশ্বসংসার। তুমি নিজেও একজন ঈশ্বর। সবই তাঁর লীলা তোমার মধ্যে। 

বাবা খুব বিচলিত হয়ে পড়লে এমন সাধুবাক্য সব আমাদের বলেন। আমার কষ্ট হচ্ছিল, কারণ যত কাছেই হোক— অন্যের বাড়ি—তারা কেমন হবে জানি না, তাছাড়া পিলুকে ছেড়ে থাকতে আমার কেন জানি কষ্ট হয়। সেই শহরটাতেই হয়েছিল, কিন্তু ছোড়দি অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল–অত খারাপ লাগে নি। পিলুকে বললাম, যাস কিন্তু! 

যাবার সময় দেখলাম মা আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা বললেন, এখন মন খারাপ করতে নেই।

মা’র মন খারাপ। এটা কি মা টের পায় আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। খুব বেশি দূর না। কালই হয়তো সকালে চলে আসব হাঁটতে হাঁটতে। কিন্তু মা কি আমার সেই গোপন রহস্যের খবর জেনে গেছে। মা কি জানতে পেরেছে বিলুর পৃথিবীতে আর কেউ ঢুকে যাচ্ছে। সাদা জ্যোৎস্নায় সে কোন এক পরী কে জানে। 

বেলা থাকতেই রওনা দিলাম। বাবা পিছনের বনজঙ্গল পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে হেঁটে এলেন। পিলুর হাতে আমার জামাকাপড়ের পুঁটলি। ওতে আছে দুটো প্যান্ট, গোটা তিনেক হাফ শার্ট। একটা বাবার পুজো-পার্বণে পাওয়া কোরা অল্পদামের ধুতি। বাবার ধারণা একজন মানুষের পক্ষে এর চেয়ে বেশি পোশাক-আশাক নিষ্প্রয়োজন। বাড়িতে খালি গা, খালি পা এবং হাফ প্যান্ট পরনে—কারণ বাবার কাছে আমি এখনও খুব ছোট আছি। আমারও মনে হয় এই যথেষ্ট। কেবল ছোড়দি আমাকে বুঝিয়েছে, খালি গায়ে থাকিস না। অসভ্যতা। ছোড়দির ভয়ে সবসময় গায়ে জামা রাখতে ভারি কষ্ট হতো। এখন এসব দেখার কেউ নেই। কিন্তু যেখানে যাচ্ছি, সেখানে আবার যদি কোনো ছোড়দির উদয় হয় তবেই হয়েছে। পায়ে জুতো পর্যন্ত আছে! শার্ট গুঁজে পরতে শিখেছি। পিলুর কাছে আমি এখন একজন বাবু মানুষ। বাবু মানুষের হাতে গামছার পুঁটুলি শোভা পায় না। সে সেজন্য আমার সঙ্গে যাচ্ছে। তার হাতেই সব। পরনে তার ইজের। মা যত্ন করে দু-জায়গায় তালি মেরে দিয়েছে। সেই পরে একটা মারকিন কাপড়ের জামা গায় সে আমার সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। সে ওটা কালীবাড়িতে রেখে আবার দৌড়ে ফিরে আসবে। দাদার জায়গাটাও ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখে আসবে। তার দাদা মাস্টার—ছাত্র পড়াবে। কেমন বয়সের ছেলে বোধহয় সেও দেখার বাসনা। যেতে যেতে কত গল্প তার। কিছুদূর এসেই পিছনে তাকিয়ে দেখলাম গাছপালার আড়ালে আমাদের বাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা নবমীর বনটায় ঢুকে গেছি। 

—দাদারে? 

দাঁড়ালাম। —কিছু বলবি। 

—নবমীর সঙ্গে দেখা করবি না? 

—দেরি হয়ে যাবে। তোকে আবার ফিরতে হবে। অবশ্য বললাম না, বনজঙ্গলে সাপখোপের উপদ্রব থাকে। পিলুর অবশ্য বেজায় সাহস। এ ব্যাপারে সে বাবার স্বভাব পেয়েছে। রাতবিরেতে বাবা কখনও আলো নিয়ে বের হন না। বাবার কথা—তুমি অনিষ্ট না করলে তিনি তোমার অনিষ্ট করবেন কেন। তিনি বলতে মা মনসা। মনসার বাহন মাত্রেই দেবতা। তাঁকে সংশয়ের চোখে দেখলে সেও সংশয়ের চোখে দেখবে। সংসারে এমনই নাকি নিয়ম। পিলু এ বিষয়ে বাবার কিছুটা স্বভাব পেলেও সবটা পায়নি। সে সাপের খোঁজ পেলে তেড়ে যাবেই। বাবা কতবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, পিলু ওটা করিস না। বনজঙ্গলে থাকি। জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে লড়াই ঠিক না। তুই কবে যে তেনার কোপে পড়ে যাবি। 

নবমীর সঙ্গে দেখা না করে যাব ভাবতেই পিলু বোধহয় রুষ্ট হলো। সে আর একটাও কথা বলছে না! পুঁটুলিটা বইতেও কষ্ট যেন। 

অ্যাঁ, নিজে বাবুর মতো যাবে। আমি নিতে পারব না। বলেই পুঁটুলিটা মাটিতে ফেলে দিল। পিলু আমার চেয়ে বেশ ছোট। তবু মনে হয় বিষয়বুদ্ধিতে সে আমার চেয়ে প্রবল। আমার আলাদা একটা সম্ভ্রমবোধ গড়ে উঠেছে সেও যেন পিলুর জন্য। সেই এমন ভাব করে যে আমি আলাদা জাতের। দাদার সুখ্যাতির জন্য সে বড় কাঙাল। নিজে যা পারছে না, দাদার মধ্যে সেটা দেখতে পেলে সে খুশি হয়। সেই দাদার পুঁটুলিটা এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পিলু কি নবমীর সঙ্গে দেখা করা না করার মধ্যে কোনো মঙ্গল-অমঙ্গলের আভাস দেখতে পায়। নবমীর সঙ্গে দেখা না করলে দাদাটার কি না জানি অনিষ্ট হবে—এমন সংস্কারে তাকে পেয়ে বসতে পারে। পাশ দিয়ে যাচ্ছ, একটু ভিতরে ঢুকে দেখা করে যাওয়া এমনকি কষ্টের। আর কতটুকুনই বা দেরি হবে। বললাম, সেই ভালো পিলু। নবমীর সঙ্গে দেখা করেই যাব। 

পিলুর মুখে আশ্চর্য সরল মধুর হাসি। এমন উজ্জ্বল চোখ মুখ যে নিমেষে সে ভুলে গেল দাদাটার উপর তার অভিমান হয়েছিল। পুঁটুলিটা তুলে ঝেড়েঝুড়ে আবার বগলে নিল। শেষে একটা কচুবন পার হয়ে যেমন অন্যবার ডাকে, এবারেও ডাকল, আমি দাঠাকুর, নবমী। নবমী টের পায় সেই সরল বালক, তার জন্য কোনো খবর বয়ে এনেছে। পৃথিবীতে নবমীর কাছে খবর পৌঁছে দেবার কেউ নেই। সে বনের ফল-পাকুড় খেয়ে থাকে, কচু-ঘেচু সিদ্ধ করে খায়। আর আছে একটা ছাগল আর তার দুধ। বনটা পুরো পার হয়ে যাবার ক্ষমতা সে কবেই হারিয়েছে। পিলুই একমাত্র তার ডাকপিয়ন। বনটার বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব খবর দেয়। বন কেটে যারা ঘরবাড়ি বানাচ্ছে তাদেরও। 

বুঝতে পারি, নবমী এক্ষুনি সাড়া দেবে। ঠিক জবাব এল, একটু দাঁড়াওগো দাঠাকুর। এই ফাঁকে সে পিলুর দেওয়া বাবার পুজো-পার্বণে পাওয়া খোঁট পরে নেবে। বনের ভিতরে কে আর দেখে। লজ্জা নিবারণের দায় তার থাকে না। গাছপালার মধ্যে অবিরাম যে কথাবার্তা চলে তার মধ্যে লজ্জা নিবারণের কথা থাকে না। সে পিলুর ডাকে সাড়া দেয়। ছাগলটা ব্যা ব্যা করে ডাকে মানুষের, সাড়া পেয়ে। ছাগলটার যে বাচ্চাটা নবমী বুড়ি পিলুকে দিয়েছিল, পিলুর অত্যধিক যত্ন এবং পর্যাপ্ত আহারে পেট ফেঁপে মরে গেছে। নবমী বলেছে, বাচ্চা হলে আবার তাকে একটা দেবে। 

নবমীকে সহসা দেখলে এখন সত্যি ডাইনী বুড়ির মতো মনে হয়। চেহারাটা হাড় জিরজিরে আরও কঙ্কালসার। দাঁত দু’পাশে দুটো বের হয়ে আছে। আলগা মতো দাঁত দুটো কথা বলতে গেলে নড়ে। চোখ কোটরাগত। নাক বাজপাখির মতো লম্বা। ত্যানাকানি পরে সে যখন বনের ভিতর থেকে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বের হয়ে এল তখন পিলুর কি আনন্দ! পিলু বোধহয় ভাবে, একদিন নবমী বুড়ি আর তার ডাকে সাড়া দেবে না। মরে যাবে। যেতে আসতে একবার খোঁজ নিয়ে যায়, সে শুধু বুড়ি বেঁচে আছে কি না। বুড়ির খোঁজ-খবর নেয়। কি খায় জিজ্ঞেস করে। সেই নবমী কাছে এলে পিলু বলল, আমার দাদা। চিনতে পারছ। 

—ও মা, কি মানুষগো। আমি কি কালা না হাবা চিনতে পারব না। তারপরেই লম্বা হয়ে গেল। গড় হলে আমার ভারি লজ্জা করে। পিলুকে এখন সাক্ষাৎ দেবতা ভেবে থাকে। সেই যেন কখন আসে, এমন এক অপেক্ষা তার। কে জানে, এভাবেই কোন শবরীর প্রতীক্ষা ছিল কি না সেকালে। নবমী আর পিলুকে দেখে আমার কেন জানি চোখে রামায়ণের সেই সুন্দর কাহিনীটি ভেসে ওঠে। 

পিলু বলল, দাদা আমার মাস্টার হয়েছে! 

—মাস্টার! 

—হ্যাঁগো, দাদা ছাত্র পড়াবে। কালীবাড়ি চেন? আমরা সেখানে যাচ্ছি। দাদাকে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরব। 

—তবে আর দেরি করবেন না গো দাঠাকুর। ফিরতে ফিরতে সাঁজ লেগে যাবে। ভয় পেলে বুলবেন, বন-বাদাড়ে কতকিছু থাকে, এরা আমাকে চেনে আমার কথা বুলবেন—নবমী বুড়ির দাঠাকুর আমি। কেউ ছুঁতে সাহস পাবে না। 

নবমীর কাছ থেকে এভাবেই বুঝি পিলু ভয় জয় করার সাহসের মন্ত্র পায়। সে বলল, আমার দাদার গায়ে হাত বুলিয়ে দাও। আমায় যে দিয়েছিলে। 

আমার গাটা ভয়ে কেমন শিরশির করছিল। পিলুর যে কতরকমের বিশ্বাস গড়ে উঠেছে। লাঠি ঠুকে ঠুকে নবমী আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি পালাব কিনা ভাবছি। পিলু বুঝতে পেরে বলল, ভয় পাস না দাদা। নবমী বলেছে, আমি ওর মতো পরমায়ু পাব! এখন দাদারও এমন হয় সে চায়। ততক্ষণে নবমী আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বলল, আমার মতো পেরমায়ু পানগো দাঠকুর। আমার কেশের মতো। 

দেশ ছাড়া হয়ে আমরা কত অসহায় পিলুর আচরণ দেখলেই টের পাওয়া যায়। এদেশে এসে হেজেমজে না যাই তার জন্য পুিল সব দিকে খেয়াল রেখে চলে। নবমীকে দেখলে পুণ্য হয়, আয়ু বাড়ে, পিলুর ধারণা। বাবার সম্বল, শালগ্রাম শিলা। মা’র বিপদনাশিনী ব্রত। এত সব আছে বলেই কেন জানি মনে হলো আমরা ঠিক বেঁচে থাকব। পিলুর এখন আর কোনো ভয় নেই। দাদাকে বনবাসে দিয়ে এলেও না। সে বরং আমাকে গার্জিয়ানের মতো শেখাচ্ছে। 

–দাদারে!

–কী! 

আমরা হাঁটছি আর কথা বলছি। ইঁটের ভাটা পার হলে সেই কারবালা। ডান দিকে মাইলখানেক জুড়ে মাঠ, মুসলমানদের সারি সারি কবরখানা, মিনার, বাঁধানো শান, রুপোলি চাঁদ তারা আঁকা। আর উপরে বিশাল সব বৃক্ষ। মিনারে কত স্মৃতিকথা লেখা। পড়া যায় না। উর্দু ভাষায় লেখা। সোজা গরুর গাড়ি চলার মতো। একটা পথ, উঁচু নিচু ঝোপঝাড়। 

পিলু দু-লাফে আমার আগে এসে গেল—বলল দাদারে! 

—কী বলবি তো!

–পেট ভরে খাবি। 

—খাব না কেন। 

—তুই ঠিক লজ্জায় পেট ভরে খাবি না।

—হ্যাঁ বলেছে। 

—ঠিক জানি। আমরা কাঙাল হয়ে গেছি 

–কাঙাল হব কেন? 

—মা যে বলে তোমাদের রাক্ষুসে ক্ষুধা, কার ক্ষমতা নিবারণ করে। 

পিলু ঠিকই বলেছে। ছোড়দির ওখানে এর জন্য আমার ভোগান্তি গেছে। পিলু কষ্ট পাবে বলে তাকে গল্পটা বলিনি। পাইস হোটেল বলে অবশ্য সেখানে আমার খেতে কোনো লজ্জা ছিল না। পয়সা দিয়ে খাব—যত খুশি খাব। যত খুশি খেতে গিয়েই ঝামেলাটা হয়েছিল। কিন্তু যদি কালীবাড়িতে ছোড়দির মতো কেউ থাকে, মুখ তুলে খেতেই পারব না। পিশু কি করে যে টের পায়! 

—কি রে খাবি তো? 

—হ্যাঁ হ্যাঁ খাব। 

—আমার কি, না খেলে নিজেই কষ্ট পাবি। বড় হলে কেউ সঙ্গে থাকে না। নিজেরটা নিজেই দেখে নিতে হয়। 

—হয়েছে, আর পাকা পাকা কথা বলতে হবে না। 

রেল লাইনে উঠে বলল, জানিস দাদা, এখানে একটা লোক কাটা পড়েছিল। 

–কবে? 

–সেই যে মেলা গেল। মেলাতে লোকটা এসেছিল কালীথানে পুজো দিতে। পিলু কেমন ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে। ভয় ভিতরে ঢুকে গেলে পিলুর চোখ খুব ভ্যাবলা হয়ে যায়। সে গুছিয়ে তখন কথা বলতে পারে না। 

—কি করে কাটা পড়ল। কথা বলছিস না কেন। এসে তো গেলাম। 

দূর থেকে কালীবাড়ির বিশাল নিমগাছটা দেখা যাচ্ছে। রেল লাইনের গুমটি ঘর পার হলেই দেখা যায়। ওকে বললাম, তুই আর যাবি? পিলু কিছুক্ষণ কি ভাবল। আমার উপর বিশ্বাস কম। বলল, তুই যেতে পারবি। 

—খুব পারব। তুই যা। নালে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। 

আবার ডাকে, দাদারে! 

—বল। 

— তুই কিন্তু রেল-লাইন পার হোস না। 

—কেন? 

—কখন গাড়ি এসে ঘাড়ের উপর পড়বে। 

এতক্ষণে বুঝতে পারলাম পিলুর ভয়টা কোথায়। কালীবাড়ির সীমানা ঘেঁষে রেল লাইন চলে গেছে। পিলুর ধারণা রেল লাইনটা ভাল না। কালীবাড়ির কাছটায় ফি বছর কেউ না কেউ কাটা যায়। কেউ এখানে আত্মহত্যা করতে চলে আসে। জায়গাটার কোনো অশুভ প্রভাব আছে। কেউ বলে মা কালীর ভোগে গেছে। তার দাদাটাকে কাজে অকাজে রেল লাইন পার হতেই হবে। যা অন্যমনস্ক। যদি কিছু হয়ে যায়। সেই ভয়ে কেমন ভ্যাবলু বনে গেল পিলু। 

—আমি ঠিক দেখে পার হব। ভাবিস না। 

পিলুর এইভাবে কতরকমের যে ভয় তার দাদাটাকে নিয়ে। সে নিমগাছটার কাছে এসে বলল, আমি যাই। 

কিন্তু আশ্চর্য কালীবাড়ির সামনের রাস্তাটায় কেউ নেই। সেবাইত কোন দিকটায় থাকে জানি না। পকেটে মানুকাকার দেওয়া একখানা চিঠি সম্বল। লম্বা পাঁচিলের মতো মন্দির চলে গেছে। কিছু কাক হাহাকার করে ডাকছে অশ্বত্থ গাছের মাথায়। দুটো বড় পেল্লাই দরজা। দুটোই বন্ধ। মন্দিরের বাঁ দিকে এক ফালি একটা দরজা চোখে পড়ল। দুটো লোক মন্দিরটার দক্ষিণের মাঠে ঘাস কাটছে। একটা রিকশ ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজিয়ে এল আবার নিমেষে উধাও হয়ে গেল। পিলু তার দাদাকে এভাবে একা ফেলে যেতে ভরসা পেল না। এ যেন দাদাকে একটা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে যাওয়া হবে। সে খুব সাহসী হয়ে যায়। 

আমি খুব সন্তর্পণে এগোচ্ছি। গাছপালার ফাঁকে বিকেলের রোদ নেমে যাচ্ছে। বিরাট এলাকা জুড়ে এই মন্দির। শনি-মঙ্গলবারে মানত দিতে লোকজন আসে। আমরাও দু-একবার ওইসব দিনে ঘুরে গেছি। ঢাক বাজছে ঢোল বাজছে। বলির পাঁঠার আর্তনাদ আর মন্দিরের ভিতর কেউ জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ করছে। লোকজনে ভরে থাকে। মাথায় কপালে পাঁঠার রক্ত। বৌ-ঝিরা নানারকম মানতে ব্যস্ত। সারি সারি রিকশ, গাড়ি লেগে থাকে। আজ সে সবের কিছু নেই। কেমন খাঁ-খাঁ করছে। মন্দির থেকে কাউকে বের হতে দেখা গেল না। মহামারীতে সব শেষ হয়ে গেলে যেমন জনশূন্য হয়ে যায় গাঁ-গঞ্জ আমার আর পিলুর কাছে এখন জায়গাটা সে রকমের 

পিলু তবু এগিয়ে যাচ্ছে। সে ইঁটের রাস্তাটা পার হয়ে মন্দিরের রোয়াকে উঠে গেল। তারপর ফালি দরজাটা ঠেলতেই দেখল—সামনে বড় কোঠাঘর—তক্তপোশে তিনচারজন ছেলে বুড়ো শুয়ে। আসলে সবাই দিবানিদ্রা যাচ্ছে। সে সন্তর্পণে নেমে এসে বলল, দাদা সবাই ঘুমোচ্ছেরে। এ কেমন জায়গারে! বেলা পড়ে এল, তবু ঘুমোচ্ছে। তারপর বলল, ডাকব! 

আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। পরের বাড়ি। আমি এদের আশ্রিত হয়ে থাকব। আমার এ অসময়ে কতটা ডাকার দাবি আছে সে নিয়ে যখন ভাবচি, তখনই মন্দিরের দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। বিরাট পেল্লাই দরজা ঠেলে ঠেলে কেউ খুলে দিচ্ছে। আমারই বয়সী একটি মেয়ে। ডুরে শাড়ি পরনে। মাথায় ঘোমটা। পিলু ছুটে গিয়ে বলল, আমার দাদা, এখানে থাকবে। ভিতরে খবর দাও না। বালিকাটি কিছু বুঝতে পারল না। সে ঘড়া করে জল এনে ঢেলে দিচ্ছে মন্দিরের চাতালে। উঁকি দিয়ে দেখলাম, কেউ যেন মন্দিরের ভিতর গেরুয়া নেংটি পরে শুয়ে আছে। মানুষ না বলে কঙ্কালই বলা ভালো। আমাদের কথাবার্তায় কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে বালিকাটি সদর দরজার বাইরে বের হয়ে বলল, কাকে খুঁজছ 

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পিলু বাধা দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। বলল, আমার দাদা। মাস্টার। পকেটে চিঠি আছে। দেখানারে দাদা। 

বালিকাটি হঠাৎ ফিক করে হেসে দিল, অমা! আমাদের নতুন মাস্টার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে গো। আসেন, আসেন। তা অত ছোট কেন? ভিতরে আসেন। আপনার সকালে আসার কথা ছিল না? বলেই সে ভিতরে দৌড়ে খবর দিতে গেল। কোন দিক দিয়ে যায় লক্ষ্য করছি। চাতালের পাশে মন্দিরের মিনা করা থাম। মেয়েটি থামের আড়ালে হারিয়ে গেল। তারপরই ফের হাজির। — অমা, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন গো? আমার সঙ্গে আসেন। 

–এটা কে?

—আমার ভাই। 

—আপনিও আসেন। 

পিলু বলল, দাদাকে দিয়ে গেলাম। আমি যাব না। বাড়ি ফিরতে হবে। দাদাকে দেখে রাখবে কিন্তু। বলেই দৌড়। 

মেয়েটি এবারেও হাসল। বলল, আমরা খেয়ে ফেলব না। আপনার দাদাটি আস্তই থাকবে।

বুঝতে পারছি বয়েস কম হলেও অনেক অভিজ্ঞতার ছাপ মেয়েটির মুখে। জানি না, এ বাড়ির সে কে হয়। এতটুকুন মেয়ের ঘোমটা কেন। চোখ ডাগর। মুখে আশ্চর্য সজীবতা। শরীরে বড় বেশি লাবণ্য। পিলুর চেয়েও বেশী পাকা, পাকা কথা। চাতাল পার হয়ে যাবার সময় বলছিল, ভয়ে কুঁকড়ে আছেন গো দেখছি। দিন পুঁটুলিটা হাতে দিন। বলেই আমার দিকে ভারি চোখে তাকাল। এমন চোখ এবং চোখে টান আমি জীবনেও দেখিনি। যেতে যেতে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। পুঁটুলিটা সে যেন জোর করেই হাত থেকে কেড়ে নিল। 

এভাবে আমার পৃথিবী ক্রমেই বড় হয়ে যেতে থাকল। এখানে এসে টের পেলাম, ধর্মস্থানে খাবারের অভাব হয় না। দেশ ছেড়ে আসার পর এই প্রথম পর্যাপ্ত আহারের মুখ দেখলাম। সেবাইত মানুষটি যে এ অঞ্চলের একজন মানী ব্যক্তি, দু-একদিনেই তা টের পাওয়া গেল। জেলা কংগ্রেসের প্রভাবশালী ব্যক্তি। মানুকাকাও কংগ্রেসের হয়ে জেল খেটেছে—সেই সুবাদে আলাপ এবং ঘনিষ্ঠতা। ফলে আমার আরও দু-চারজন আশ্রিতের মতো এখানটায় জায়গা হয়ে গেল। তবু প্রথমটায় দু-দিন খুবই আড়ষ্ট ছিলাম। বাইরের ঘরে চুপচাপ বসে থাকতাম। স্নানের সময় হলে সেই ঘোমটা দেওয়া বালিকাটি আসত। বলত, চান করে নিন। খাবেন না? জড়ভরত হয়ে থাকেন কেন? 

মেয়েটা এত চোপা করে কেন বুঝি না। এখানে বোধহয় সবাই হৈচৈ করে থাকতে ভালবাসে। বাড়ির হালচাল বুঝতে সময় লাগে, এই কথাটা কি করে যে মেয়েটাকে বোঝাই। ওর নামও জেনে গেছি। সবাই লক্ষ্মী বলে ডাকে। ভিতরে গেছি—দেখেছি পাকশালার দরজায় কলসি কাঁখে দাঁড়িয়ে আছে। একবারও ওকে কাঁখে কলসি ছাড়া দেখিনি। এর কি শুধু এই কাজ। আর মাঝে মাঝে ইদানীং আর ও একটা কাজ পেয়েছে, সেটা বোধহয় আমার দেখাশুনা করা। 

চিঠিটা দেখার পরই সেবাইত মানুষটি বলেছিল, থাকতে পারবে তো! বাড়ির জন্য মন কেমন করবে না তো? 

মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েছিলাম। 

—যখন যা দরকার বলবে। কোনো সংকোচ করবে না। নিজের বাড়ি মনে করবে। যে যার মতো এখানে থাকে খায়। এটা এজমালি সংসার। লক্ষ্মীকে ডেকে বলল, ওর ঘরটা দেখিয়ে দে। হাত-পা ধুয়ে নাও। চা খাও তো? চা না খাও মুড়ি সন্দেশ, যেটা ভালো লাগে বলবে! তারপরই ডেকেছিল, শুনছ—মাথায় বেশ ঘোমটা দিয়ে যিনি এলেন তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, মাস্টারদার ভাইপো। দেশ থেকে সবাই এরা চলে এসেছে। তোমাদের নতুন মাস্টার। খেয়াল রেখ। এত ছেলেমানুষ বুঝতে পারিনি। এখান থেকেই কলেজে পড়বে। নটু পটুকে পড়াবে। পছন্দ কিনা দেখ। 

আমি বাড়িতে থাকব শুনেই তিনি মাথার ঘোমটা কিছুটা টেনে কপালের উপর তুলে নিলেন। নিজের লোক—ঘোমটা দেওয়া ঠিক না। – ছেলে দুটো ভারি দুষ্টু। পড়তে চায় না। তোমার নাম কি? 

— বিলু। 

—আমি কিন্তু বিলু বলেই ডাকব। 

সেবাইত বললেন, তোমার বৌদি। যা কিছু দরকার এর কাছে চাইবে! কোনো সংকোচ করবে না।

আমার বৌদিটির রূপের বর্ণনা দিলাম না। কারণ এমন কিছু সৌন্দর্য থাকে যার বর্ণনা দেওয়া যায় না। এতে বৌদিকে আমার খাটোই করা হবে। দীর্ঘাঙ্গী। পরনে লাল পেড়ে শাড়ি। হাতে দুটো সাদা শাঁখা। খুব লক্ষ্য না করলে শাঁখা এবং হাতের রঙ পার্থক্য করা যায় না। বৌদি লক্ষ্মীকে ডেকে বলল, নটু পটুকে ডেকে দে। ওদের মাস্টারমশাই এয়েছেন। প্রণাম করে যেতে বল। লক্ষ্মী বলেছিল, তোমার ছেলেরা ঘুমাচ্ছে। 

—ঘুমাচ্ছে, তুলে দে। 

ভাবতে পারছি না, কার্তিকের বেলা পড়ে আসে সহজে, সহজেই সন্ধ্যা নেমে আসে। অবেলায় কেন এরা ঘুমায়। লক্ষ্মী আমাকে বারান্দায় টুলে বসিয়ে সেদিন প্রায় সবাইকে চেঁচামেচি করে জাগিয়ে দিয়েছিল। নিজেই বিরক্ত বোধ করছিলাম ওর চেঁচামেচিতে। কি না জানি ভাবে। অথচ সেবাইত মানুষটি ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিলেন, কে এসেছে বললি? 

—নতুন মাস্টার এয়েছে। তোমরা ঘুমোচ্ছ আর মানুষটা কি ভাববে বলত! মানুষটা মানে আমি। 

—নতুন জায়গা, ভিনদেশী। দেখলে সব কি ভাবে! 

এ বাড়ি কার বাড়ি, কে আসল মহাজন, কাকে বেশি সমীহ করতে হবে এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। নটু পটু এসেছিল, তবে তখন নয়। সন্ধ্যায় লক্ষ্মী হারিকেন জ্বালিয়ে দেবার পর। কারণ ভিতর বাড়িটাতে অসংখ্য ঘর। ছোট ছোট দরজা, জানালা আরও ছোট। ছোড়দির বাড়ির মতো বিশাল বিশাল দরজা জানালা এ বাড়িতে নেই। মন্দিরের দুটো বিশাল দরজা বাদে আর সর্বত্র কেমন কানা গলিগুঁজির মধ্যে ঘরগুলি হারিয়ে গেছে। আমাকে লক্ষ্মী যখন পড়ার ঘরটায় নিয়ে গেছিল তখন প্রায় হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। রাস্তার পাশে, রোয়াকের উপর ঘর। একটা দরজা সামনে, ভিতরের দিকে আর একটা দরজা। রাস্তার উপর দু-দিকে দুটো জানালা। আর দক্ষিণের দিকেও একটা জানালা আছে। ওটা খুলে দিতেই সামনের মাঠ দেখতে পেয়েছিলাম। আর মনে হয়েছিল এই ঘরটাই সবচেয়ে বেশি বড়। দু-পাশে দুটো বড় তক্তপোশ। মাঝে তিনটে হাতল ভাঙা চেয়ার। একটা টেবিল চাকচিক্যবিহীন। সামনে তাক। নটু পটুর স্লেট পেন্সিল খাতা বইতে ঠাসা। বাড়িতে ঢোকার আগে এখানেই তিন চারজন লম্বা হয়ে শুয়েছিল। ঘুমোচ্ছিল। পিলু দরজা ফাঁক করে বলেছিল, এ কেমন বাড়িরে দাদা। অবেলায় সবাই ঘুমায়। 

দু-রাত কাটাবার পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে গেছি। বাড়িতে অতিথি অভ্যাগত, আশ্রিতের সংখ্যা অনেক। সবার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে—শুধু একজন বাদে। তিনি মন্দিরেই থাকেন খান। একটা গেরুয়া নেংটি পরে থাকেন। গায়ে জামা দেন না। চোখ সব সময় লাল। যেন সেই মহাভারতের দুর্বাশা মুনি। সকালবেলায় হোতার সাঁকো থেকে বড় নিমগাছটা পর্যন্ত কেবল পায়চারি করেন— আর সংস্কৃত শ্লোক অনর্গল আওড়ে যান। যেন পৃথিবীটাকে পবিত্র রাখার দায়িত্ব, ধর্মাধর্ম রক্ষার দায়িত্ব তাঁকে কেউ অর্পণ করে গেছেন। এমন কঙ্কালসার মানুষ অথচ কি দৃপ্ত আর তেজী। মন্দিরের আসনে যখন বসে থাকেন, আমার মাঝে মাঝে তাঁকে কাপালিকের মতো লাগে। যদি কখনও তার চিৎকার ভেসে আসে, বাড়ির সবাই কেমন তটস্থ হয়ে পড়ে। নটু বলেছিল, নরেন খ্যাপা। কাছে যাবেন না। চোখ পড়ে গেলে রক্ষা নেই। মন্দিরে বসিয়ে সারাদিন গীতাপাঠ করাবে। উঠতে দেবে না। চান করতে দেবে না। কেবল বলবে, খা খা। আমারে খা। ভয়ে এই ঘরটা থেকে সহজে তাই বের হই না। 

সেবাইতের ছেলে নটু। পটু ওর বোনের ছেলে। বোন এখানেই থাকে। মাথায় সিঁদুর নেই। হাতে শাঁখা নেই। পটুর বাবা কোথায় থাকে জানি না। তবে তিনি বেঁচে আছেন জানি। গতকাল পিয়ন পটুর বাবার চিঠি দিয়ে গেছে। ধনঞ্জয় বলে একজন এ বাড়ির আশ্রিত, পটুর জ্যাঠতুতো দাদা। পঁয়ত্রিশ চল্লিশ দেখতে। ধনঞ্জয়ও ঘরের বার হয় না। পটুর মার ঘরে দিন রাত শুয়ে থাকে। ঘরটার জানালা ছোট বলে বারান্দার আলো থেকে সব কিছু ভিতরে স্পষ্ট দেখা যায় না। পটুর মাকে আমি দিদি ডাকার পর স্নেহশীলা রমণীর আচরণ লক্ষ্য করেছি। বাইরে বড় কম বের হন। সকালবেলায় তাঁকে দেখলে মনে হবে, সারারাত যেন না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। চোখ বসে গেছে। সুশ্রী দেখতে, তবে লাবণ্য নেই তেমন। কোনো রোগ-টোগ থাকলে মেয়েদের যেমন লাগে দেখতে পটুর মা সে রকমের। 

আমার ঘরের ও পাশের তক্তপোশটায় আরও একজন এ বাড়ির আশ্রিতজন থাকেন। কালো কুচকুচে দেখতে। মাথায় বিশাল টাক। বেঁটেখাটো মানুষ। এ বাড়ির আদায়পত্র তাঁর হাতে। নটু পটু দাদু ডাকে- আমি আর কি ডাকি, দাদুই ডাকতে শুরু করেছি। এতে খুব খুশী তিনি। আমার খাওয়া চান নিয়ে তাঁর দেখছি বেশ একটা ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। 

আমার জামা প্যান্ট কোরা কাপড় দু’দিন ধরে কুলুঙ্গিতে পড়ে আছে। সকালে লক্ষ্মী মুড়ি সন্দেশ আর গ্লাসে জল নিয়ে এ-ঘরে একবার আসে। তিন চেয়ারে আমরা তিনজন। পড়ার চেয়ে নানারকম মুখরোচক খবর নিতে নটু পটু বেশি ভালোবাসে। খাবার এলে সেটা বেড়ে যায়। আমি আশ্রিত বলে, সন্দেশের পরিমাণ কখনও কম হতো না। বরং আমার মুড়ির সঙ্গে চারটে কাঁচা গোল্লা থাকলে নটু পটুর ভাগে দুটো বরাদ্দ থাকত। সকালের জলখাবার আমাদের তিনজনের একসঙ্গে, দুপুরের খাবার একসঙ্গে রাতেও তাই। সকালের তদারকির দায় লক্ষ্মীর। দুপুরে বৌদি নিজ হাতে দেন। রাতেও তাই। নটু পটুর স্কুল নেই। আমার কলেজে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি দাদাই ভার নিয়েছেন। সময় মতো হবে। লক্ষ্মী দু’দিনেই কেমন তেরিয়া হয়ে বলল, মাস্টার, তোমার কিছু হবে না। ও ভাবে সব ফেলে রাখে। বলে সে নিজেই নিয়ে এল একটা তার। সেটা টানিয়ে দিয়ে বেশ সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখে দিল জামাকাপড়। লক্ষ্মীর এ ঘরে আর একটা কাজ রাতে থাকে। আমাদের বিছানা করে মশারি টানিয়ে দেওয়া। নটু পটু আর আমি এক বিছানায় পাশাপাশি। পটুর শোওয়া খারাপ বলে লক্ষ্মী বলে গেছে, ওটারে একপাশে দেবেন। খুব লাথি মারে। 

জামা প্যান্টের দুরবস্থা নিয়ে এখন আর আমার ভাবনা হয় না। একটা হাফপ্যান্ট পরে সহজেই এ-ঘর ও-ঘর করতে পারি। এ বাড়িতে পোশাক-আশাকের প্রাবল্য খুব কম। আমার ছাত্ররাও দেখছি খদ্দরের প্যান্ট জামা পরে। বদরিদাও তাই। বদরিদা হাতে কাচা কাপড় পরেন। ধোপা বাড়ির সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্ক কম। কেবল দিদি একটু সাজগোজ করতে ভালোবাসেন। তাঁকে কখনও দেখেছি, আয়নার সামনে বসে সাজগোজ করছেন। বৌদির তিনবেলা স্নানের অভ্যাস। বাড়িতেই চান করেন। আমারও তাই নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু কালীবাড়ির পিছনে বিশাল ঝিল, বাঁধানো ঘাটলা দেখার পর দাদুর সঙ্গে সেখানে চান করাই শ্রেয় বোধহয়। সারাদিন লক্ষ্মীর কাজ ছিল ঝিল থেকে জল টানা। আমার জন্য বাড়তি জল ওর আর টানতে না হয় সেটাও বোধহয় মনের মধ্যে কাজ করছিল। আর তারপরই লক্ষ্মী কেমন আমার প্রতি সদয় হয়ে গেল। কোনো কথায় আর চোপা করত না। বরং মাঝে মাঝে লক্ষ্য করেছি কথা বলতে বলতে চোখ নামিয়ে নেয় সে অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে এসেছে, এটাও টের পেলাম আর টের পেলাম লক্ষ্মীর ইতিপূর্বে দুবার বিয়ে হয়েছে। বর কপালে সয়নি। মা বাবা নেই। শেষে কাগে বগে ঠুকরে খাবে এই ভয়ে এ বাড়ির আশ্রয়ে এসে উঠেছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম, লক্ষ্মীর জন্য আমার ভিতরে আর একটা কষ্ট তৈরি হচ্ছে। কেন এমন হয় বুঝি না! 

আসলে এরি নাম বড় হওয়া। খেপে খেপে কষ্ট রেখে যাচ্ছি এক এক জায়গায়। আগে দেশ বাড়ির জন্য কষ্ট হতো। পরিচিত গাছপালা, মানুষজন, গোপাট, স্কুলবাড়ির সঙ্গে মানুষের নাড়ির টান জন্মে যায়। চলে আসার সময় কেবল মনে হতো এখানে আর আমি থাকব না, কখনও আর আসব না, অথচ এরা শীত গ্রীষ্মে একই রকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। যে বালক দৌড়ে যেত, গ্রীষ্মের দিনে আম পাড়ত, সে থাকবে অনেক দূরে। শস্যক্ষেত্রগুলিতে ফসল ফলবে, কিন্তু যে বালক ক্ষেতে ফসল বেড়ে ওঠার সৌন্দর্য উপভোগ করত, সে আর থাকবে না। দেশ ছাড়ার সময় আমার চোখে জল এসে গেছিল। এদেশে এসেও যখন যেখানে ছিলাম সে জায়গাটার জন্য মায়া পড়ে গেছে। এখানে এসেও তাই। এত কম বয়সে লক্ষ্মীর দুবার বিয়ে হয়েছে। অথচ কেউ বেঁচে নেই। মা নেই, বাবা নেই। লক্ষ্মীর চালচলন দেখলে বোঝাই যায় না সে এত শোকতাপ পেয়েছে। বরং ওই যেন এত বড় বাড়িটার আসল চাকা। কারণ এ বাড়িতে সবাই যে যার, নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, এমন কি তারা চান করে জামা কাপড় পর্যন্ত কেচে দেয় না। সব লক্ষ্মীর জন্য পড়ে থাকে। পাকশালায় আর দু’জন মাঝবয়সী বৌ থাকে। কার্তিকের বৌ আর সদি পিসি। ওরা রান্নাবান্নার তদারক করে। উত্তর দিকের অতিথিশালার পাশে কার্তিকের থাকার ঘর। সে মোড়ে একটা মুদি দোকান করেছে। বৌ তার পাকশালে থাকে। বিনিময়ে সেও খেতে পায়। সে অবশ্য বলে, দুবেলা প্রসাদ পায়। বদরিদাকে মামা ডাকে। সম্পর্কে তাই হয়। আমি বদরিদাকে দাদা ডাকি বলে সে আমাকে মামা ডাকে। মাস্টার ডাকে না। আমার ঘরটার ভিতর দিয়েই যেতে হয় সবাইকে। চার পাঁচটা সাইকেল আছে, সাইকেলগুলি সব পড়ার ঘরের এক কোণায় জমা হয়ে থাকে। সাইকেলের গায়ে কারো নাম লেখা নেই। যার যখন যেটা দরকার নিয়ে বের হয়ে যায়। বদরিদা বলেছে, এজমালি সংসার। আসলে বুঝি তিনি বলতে চেয়েছিলেন, পান্থশালা। 

সকাল থেকেই পান্থশালায় লোক আসা শুরু হয়। মন্দিরের সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে ঘুরে যেতে হয় বলে আমার ঘরটা দিয়ে সর্টকাট করে। যাবার সময়, সবার একটা কথা, কি মাস্টার তোমার ছাত্ররা পড়ছে ত। এরা এখন ভিতরে গিয়ে বদরিদার ঘরে তাস খেলতে বসবে। তারপর দুপুরে খেয়ে কখনও ঘুমিয়ে শেষ বেলায় বাড়ি ফেরে। কেউ যাবার সময় নটু পটুর মাথায় গাঁট্টা মেরে যায়। নটু যে এ বাড়ির হব মালিক কেউ মানতেই চায় না। তার বাবার বন্ধুরা আসে শহর থেকে। কেউ আবার বৌ বাচ্চা নিয়েও চলে আসে। ভিতর বাড়িতে ঢুকলেই বোঝা যায় কত বিচিত্র মুখ। সবারই লোভ প্রসাদে। এবং এই লোভেই বোধহয় বদরিদার চেনাজানার জগৎ এত বিশাল হয়ে যাচ্ছে। বদরিদার এক কথা, এসেছ, মার প্রসাদ না নিয়ে যাবে কি করে। 

নটু বলল, স্যার শনিবার কিন্তু সকালেই দরজাটা বন্ধ করে দেবেন। 

আমি বললাম, কেনরে? 

—শনি মঙ্গলবারে বড় ভিড় হয়। সকাল থেকেই দেখবেন কতদূর থেকে সব লোকজন আসছে। মানত দিতে আসে। নটু আমাকে আরও খবর দিল, রাতে সদু পিসির ভর উঠবে কালীর থানে। লোকজন তখন—এ ঘর দিয়েই ছোটাছুটি করবে। আপনারও পড়া হবে না। আমাদেরও না। 

শনিবারে সেটা যথার্থই টের পেলাম। সকাল হতে না হতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। মন্দিরের চতালে ঢাক বাজছে। পাঁঠার আর্তনাদ। যে-সব ছাড়া পাঁঠাগুলি অতিথিশালার ওদিকটায় শুয়ে থাকে তারাও আর্তনাদ করছে। চাতালে ঢাক বাজলে কেমন গুমগুম শব্দ হয়। কার্তিক সকাল থেকেই কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে বসে থাকে। শনি মঙ্গলবার তার দোকান বন্ধ থাকে। বড় রামদাটা বালিতে ঘষে ধার তোলে। পট্টবস্ত্র পরে নেয়। এবং তাকে দেখলে বোঝা যায়, সে একজন তখন তান্ত্রিক মানুষ। আমাকে মামা পর্যন্ত ডাকে না। গাঁজা ভাঙ খায় বোধহয়। না হলে এত গুম মেরে থাকে কেন? মানত করা পাঁঠাগুলি চাতালের এক কোণায় জড় থাকে। মন্দিরের মধ্যে কেউ যেতে পারে না। বাইরে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে সন্দেশের ঠোঙা, অথবা নৈবেদ্য ছুঁড়ে দিতে হয়। সবারই কত রকমের যে দুঃখ। কত রকমের যে প্রার্থনা। ছেলেবুড়ো যুবতী মেয়ে বৌ বেটি সবার এত কি প্রার্থনা থাকে। অবশ্য আমি একবার মাত্র বের হয়ে দেখেছিলাম। তারপর মনে হয়েছে, ঐ গণ্ডগোলের মধ্যে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘুরবে। নিজের ঘরে এসে নটু পটুকে নিয়ে বসলাম। ওদের এ ব্যাপারে কৌতূহল খুবই কম। বরং নটুর ‘দেখলাম সিঁড়িভাঙা অঙ্ক শেখার আজ বেশ আগ্রহ। এটা দেখে আমার মাস্টারি করার প্রবণতা চাঙ্গা হয়ে উঠল। খুব অভিনিবেশ সহকারে পড়াচ্ছি। পটু কিন্তু জানালায় বার বার কি দেখছে। পটুর টাস্ক দেওয়া আছে সেটা সে করছে না। 

—কি হচ্ছে পটু, ওদিকে মন কেন! একেবারে গুরুজনের মতো গলা আমার। 

পটু বলল, এই ওখানে কি করছিস রে! জানালায় কাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছে।

তাকিয়ে আমি অবাক! দেখি ওখানটায় পিলু দাঁড়িয়ে আছে। সে দাদার টানে চলে এসেছে। আমি কিভাবে পড়াচ্ছি, ভীষণ গর্বের সঙ্গে দেখছে। 

পিলুকে দেখে যতটা চঞ্চল হয়ে পড়ব ভেবেছিলাম, ঠিক ততটা হওয়া গেল না। আমার ভাই বলতেও কেমন সংকোচ হচ্ছিল। সে জানালার সিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ইজের, খালি গা, উষ্কখুষ্ক চুল। ও এরকমভাবেই থাকে। সকালবেলায় উঠে ঠিক দাদার জন্য মন কেমন করায় দৌড়ে চলে এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে বললাম, ভিতরে আয়। তারপর একটু শাসনের গলায় বললাম, কি করতে এসেছিস? 

নটু বলল, স্যার কে ছেলেটা? 

আমি বললাম, তোমরা ভিতরে যাও। তারপরই মনে হলো হাফপ্যান্ট পরা স্যারের এত গাম্ভীর্য শেষ পর্যন্ত টিকতে নাও পারে। বললাম, পিলু। 

পিলু কিন্তু বেশ খোস মেজাজে তক্তপোশে বসে পা দোলাচ্ছে—আমার দাদা। আমি দাদার ছোট ভাই। তোমরা দাদার স্টুডেন্ট? নটু বলল, হ্যাঁ। নটু পটু সঙ্গে সঙ্গে যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। ওদের সমবয়সী আমার একটা ভাই থাকতে পারে বিশ্বাসই ছিল না। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার ভিতরে যাব। পিলুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি নটু, ওর নাম পটু। 

—যাও। 

—এই পিলু ভিতরে যাবি? 

পিলু আমার দিকে তাকাল। নটু কি তার মাকে দেখাতে চায়—এই পিলু মাস্টারমশাইর ভাই। সকালবেলায় দাদাকে দেখতে চলে এসেছে। বৌদি যদি কিছু ভাবে, কিংবা বদরিদা। বাড়িটার এমনিতেই এত বেশি আকর্ষণ যে কেউ এলে যেতে চায় না। পিলু যা স্বভাবের তাকে এমন বাড়িই মানায়। আমি বললাম, পিলু এক্ষুনি চলে যাবে। ওকে ভিতরে নিয়ে যেও না। যেন নিয়ে গেলেই পিলু ধরে ফেলবে, এখানে দাদার মতো সেও থেকে যেতে পারে। কেউ কিছু বলবে না। মন্দিরের ডাঁই করা সন্দেশ, দুপুরে সরু আতপ চালের ভাত, মাছ ভাজা, পটল ভাজা, মুগের ডাল, শনি মঙ্গলবারে বাটি ভর্তি পাঁঠার মাংস, চাটনি। পাত পেতে বসে গেলেই হলো। যে আসে সেই যখন পাত পেতে বসে যেতে পারে তবে তার বেলায় কতটা আর রামায়ণ মহাভারত অশুদ্ধ হবে। কিন্তু পিলটা বোঝে না কেন, আমার ইজ্জত আছে। তুই তো আর কার্তিক ভাদুড়ি নোস, যে পাঁঠা কেটে বাড়ির লোক হয়ে যাবি তুই যে নটু পটুর স্যারের ভাই। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেল। লক্ষ্মী এসে গেছে এক বাটি মুড়ি আর চারটে কাঁচাগোল্লা নিয়ে। তার সকালের টিফিন। পিলু বড় বড় চোখে বাটিটা দেখছে। 

লক্ষ্মী বলল, ধরো মাস্টার। তারপরই পিলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ও মা এ যে তোমার সেই ভাইটাগো। লক্ষ্মী পিলুকে একবার দেখেই চিনে রেখেছে। কি গো দেখতে এলে দাদাকে খেয়ে ফেলেছি কি না। 

লক্ষ্মীর ভিতরে অন্য এক ব্যথা কাজ করে বুঝতে পারি। সে কি টের পায়, যাকে সে ভালোবাসে সে মরে যায়। তার কি ভয় থাকে গভীরে। কোনো গোপন ভালোবাসায় পড়ে গেলে আমাকে নির্ঘাত গিলে ফেলা হবে। এবং লক্ষ্মীর আচরণ মাঝে মাঝে আমাকে বিস্মিত করে। আমার সমবয়সী অথচ এই বাড়িতে তার কি হম্বিতম্বি। সারাটা দিন কাজ, কেবল সন্ধ্যার পর সে আর কোনো কাজ করে না। ভিতর বাড়ির বারান্দার এক পাশে শরীর মুখ ঢেকে শুয়ে থাকে— ভোঁসভোস করে ঘুমায়। রাত বারোটার পর শিবা ভোগ হয়। তারপর বদরিদা, বৌদি নটু পটু দিদি অর্থাৎ সেবাইত বংশের সবাই খাবে। অবেলায় কেন ঘুমায় সবাই, এখন বুঝতে পারি। বৌদি আমাকে বলেছিলেন, তুমি কি আগে খেয়ে নেবে ভাই। খেলে বলো। আমার কেমন সংকোচ হয়েছিল বলতে, এত রাতে কখনও খাই না বৌদি। আবার মনে হয়েছিল, আমার দুই ছাত্র যদি এত রাত করে খেতে পারে, আমি পারব না কেন। বলেছিলাম, না না, ঠিক পারব। কোনো অসুবিধে হবে না। রাত জাগা অভ্যাস নেই বলে ঘুমিয়ে পড়তাম। লক্ষ্মী এসে ডেকে দেয়, ও মাস্টার ওঠো। খাবে চলো। দাদা বৌদি সবাই বসে আছে। আমার এত ঘুম যে কখনও বিরক্ত হয়ে যেত ডাকতে ডাকতে—কি যে মরণ, বুঝি না বাপু। খিদে পায় না। খিদের চেয়ে ঘুমটা বেশি। সেই কখন চাট্টি খেয়েছ—দেখ কেমন হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। দেব জল ঢেলে বলছি। উঠে বসলে দেখতাম লক্ষ্মী আমার দিকে তাকিয়ে নেই। যেন দেয়াল টেয়াল দেখছে। আসলে এ বাড়িতে লক্ষ্মীর পছন্দ মতো লোকের অভাব। আমাকে তার পছন্দ, সেটা প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিলাম। বয়সের তুলনায় হাতে পায়ে লম্বা হয়ে গেছি বেশি। সোনালী দাড়ি গোঁফ অল্প অল্প সারা গালে। লক্ষ্মী ঠাট্টা করে কাল বলেছিল, নবীন সন্ন্যাসী ঠাকুর গো, কি যে আমার হবে? 

সেই লক্ষ্মী পিলুকে দেখে ছাড়বে না বোঝাই যাচ্ছিল। এতেই আমি আরও বেশি কাবু হয়ে গেছিলাম। নটু পটু দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গে করে ভিতরে নিয়ে যাবে বলে। পিলু পা পা করে এগুচ্ছিল। কিন্তু চারটে বড় বড় কাঁচাগোল্লা এক জামবাটি মুড়ি দেখে তার এগোনো বন্ধ হয়ে গেল। লক্ষ্মী সব রেখে ছুটে গেছে ভিতরে। কেন গেল বুঝি না। পিলু কি সং। তামাশা! ভিতরে ভিতরে পিলুর উপর ক্ষেপে যাচ্ছিলাম। এলি তো একটা জামা গায়ে দিয়ে আসতে কি ক্ষতি ছিল। জামাটা ছেঁড়া— তাহোক না, জামাতো। ওর নাকটা দেখলাম। পোঁটা লেগে থাকে— বড় খারাপ স্বভাব। সেই কবে থেকে গায়ে রিফ্যুজি ছাপ লেগেছিল, সেটা বাড়িঘর হয়ে যাওয়ার পর থাকা ঠিক না। তবে রক্ষে নাকে পোঁটা নেই। ওর রঙ শ্যামলা। মুখে মায়ের আদল। চোখ দুটো বড়ই মায়াবী। যা কিছু দেখে, তাই ওর কাছে বিস্ময়। ফলে চোখ দুটো বোধহয় দিনে দিনে আরও বেশি ডাগর হয়ে উঠছে। এ হেন বালকের প্রতি লক্ষ্মী নটু পটু সবাই টান বোধ করবে সেটা আর বেশি কি। কিন্তু ওর এই বিস্ময়ে আমার যে সম্ভ্রম যায়। চকিতে এতসব ভাবনা মাথায় খেলে গেল। কেউ নেই দেখে বললাম, পিলু বাড়ি যা। এক্ষুনি চলে যা। 

পিলু যেন আমার কথা শুনছে না। দাদা তুই চারটে কাঁচাগোল্লা খাবি? তারপর আর আমার জবাবের প্রতীক্ষা না করে নিজেই ছুটে কাঁচাগোল্লা তুলে একটা মুখে পুরে দিল। কাঁচাগোল্লা একসঙ্গে মুখে পুরে দিলে গলায় আটকে যায়। পিলুর অভ্যাস নেই—সে মুখে দিয়েই বুঝল, গলা দিয়ে ঢুকছে না। আমি চিৎকার করে উঠলাম, শিগগির জল খা। জল খেলে এমন সুস্বাদু খাবার মিলিয়ে যাবে–সে কিছুতেই জল খেতে রাজি না। কিন্তু চোখ মুখের অবস্থা খারাপ। জল ঠেসে ধরলাম মুখে। বিষম খাচ্ছে—এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা—আর তখনই দেখি, বৌদি, লক্ষ্মী নটু পটু হাজির। সবাই পিলুকে দেখতে এসেছে। দেখবে কি, সে তো বিষম খেয়ে অস্থির। তার হাতে আরও একটা কাঁচাগোল্লা। বৌদি কাছে গিয়ে মাথায় ফুঁ দিল, এবং দেখলাম পিলুর চোখ আবার সহজ হয়ে আসছে। হাতে আর একটা কাঁচাগোল্লা, দাদার বাটি থেকে তুলে নিয়েছে—কে কি না জানি ভাবে, সে পিছনে নিয়ে গেল হাতটা। কেউ আর দেখতে পাবে না। বৌদি বলল, তোমার ভাই? 

—হ্যাঁ। 

—কি নাম?

—পিলু। 

—কি সুন্দর দেখতে। এ যে একেবারে যশোদা দুলাল। এ-বাড়ির কথাবার্তাই এই রকমের। বৌদির ঘরে একটা ছবি দেখেছি। মুখটা ঠিক পিলুর মতো মাথায় ময়ুরের পালক— ওটা না থাকলে হুবহু পিলুর ছবি হয়ে যেত। বৌদি বলল, লক্ষ্মী ওকেও দুটো খেতে দে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, পিলু দুপুরে মার প্রসাদ খেয়ে যাবে। পিলুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিন্তু যেও না। 

এ সময় আমার গম্ভীর থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। পিলুকে এরা জানে না। পিলু যদি আসকারা পেয়ে যায় তবে এমন সুস্বাদু খাবার হাতছাড়া ক ে নড়বেই না। পিলু আরও একজন আশ্রিতজন হয়ে যেতে পারে ভাবতেই আমার কেমন সম্ভ্রমে লাগল। যেভাবেই হোক পিলুকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে। লক্ষ্মীর ছোটাছুটি বেড়ে গেছে। সে পিলুর জন্য দুটো কলা, এক বাটি মুড়ি, চারটে কাঁচাগোল্লা নিয়ে এসেছে। পিলু এখন খুব ভালো ছেলে। সে কলা দুটো খেয়ে ফেলল, কাঁচাগোল্লা খেল। মুড়ি খেল। তারপর আমার পড়ে থাকা বাটর দিকে তাকিয়ে থাকল। 

—খাবি। 

—তুই খাবি না দাদা? 

—না! 

—দে। বলে সে বাকি দুটো কাঁচাগোল্লা খেয়ে কুর তুলে বলল, এদের বাড়িতে কাঁচাগোল্লার গাছ আছে নারে দাদা? 

—তাই। আমার ক্ষোভে দুঃখে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। পিলু তুই বুঝলি না, এ বাড়ির আমি কে? লক্ষী বৌদি নটু পটু না কি ভাবল! আমরা হাভাতে, তাই বলে লোকের কাছেও সেটা প্রকাশ করতে হবে। তোর বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে। ভালো খাবার দেখলে তুই মাথা ঠিক রাখতে পারিস না। এসব কথা বললে পিলু দুঃখ পেতে পারে, বলাও যায় না—বড় অবোধ আমার এই ভাইটি। নটু পটু দাঁড়িয়েছিল—খাওয়া হলেই তাকে নিয়ে যাবে – ঘুরবে, সব গাছপালার ভিতর হেঁটে বেড়াবে সমবয়সী হলে যা হয়। ওরা আমার শুধু অনুমতির অপেক্ষায় আছে। নটু পটুকে বললাম, তোমরা এখন যাও। 

ওরা চলে গেল। পিলু অবাক হয়ে দেখল। দাদাটার কি প্রভাব প্রতিপত্তি। সে তো তার দাদাকে একদম মানে না। আর সে দাদার এমন গম্ভীর ভারিক্কি মুখ কখনও দেখেনি। সে যেন কিছুটা ঘাবড়েই গেল। বলল, দাদারে আমি চলে যাব? 

—এখুনি যা। 

—খেতে বলল যে! 

—আর একদিন খাবি। ওকে বলতে পারতাম, ওরা জানে আমরা খুব গরিব পিলু। গরিব হলেই কি সব সময় হাভাতে হতে হয়। তুই বাবার মানসম্ভ্রম বুঝবি না। কিন্তু সেসব বলতে কষ্ট হলো। সে চুপচাপ বের হয়ে গেল। লাফিয়ে নেমে গেল রোয়াক থেকে। তারপর রেললাইন পার হয়ে গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

পিলু চলে যেতেই মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। একবার ইচ্ছে হলো, বের হয়ে ডাকি – পিলু যাস না। খেয়ে যাবি। এমন সুস্বাদু খাবার পিলু কতদিন খায়নি। টানাটানির সংসারে নিত্য দিনের খাওয়া খুব একটা ভালো হয় না। পিলু এখানে খেলে বাড়ি গিয়ে বলত, মা কালীবাড়িতে ভোজ খেয়ে এসেছি। শুধু মাকে কেন, যাবার সময় নবমীকেও খবরটা দিয়ে যেত। কি সরু চাল নবমী, আর কি সুঘ্রাণ। পাঁঠার মাংস এক বাটি। মুগের ডাল, মাছভাজা, টক মিষ্টি। কালীবাড়িতে শনি- মঙ্গলবারে এত প্রসাদ হয় কি বলব। ভোগের রান্না, স্বাদই আলাদা। মুখে লেগে আছে। তোমাকে একদিন ধরে ধরে নিয়ে যাব। তারপর মনে হল ভালোই হয়েছে। পিলুর বড় পেটুক স্বভাব! খাবার লোভে পড়ে গেলে সে সহজে নড়তে চায় না। সে দাঁড়িয়ে থাকে। রোজ এসে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বাড়িতে খাওয়া নিয়ে যত ঝামেলা তার। সে মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। বাজার না হলে সে নিজেই যায় ডোবা নালায়। কুঁচো চিংড়ি, কাঁকড়া যা পায় কোঁচড়ে করে নিয়ে আসে। আর মাংস কেনার এত পয়সা কোথায়। একবার মাংস খাব খাব করছিল—কিন্তু হয় না। সে নিজেই গুলতি মেরে দুটো খরগোশ শিকার করে নিয়ে এল। 

নটু পটু দুবার উঁকি দিয়ে গেছে। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের মুখ গম্ভীর দেখে ঢুকতে সাহস পায়নি। তবু নটু একবার সাহস করে ঢুকে বলল, পিলু কোথায় স্যার? 

—পিলু? পিলু তো চলে গেল। 

—পিলু চলে গেছে। মা যে বলল, মাস্টারের ভাই এয়েছে। ও খাবে এখানে। রান্নাঘরে খবর দিল। 

লক্ষ্মীও হাজির, কৈগো মাস্টার তোমার ভাইটি কোথায়! বদরিদা ভিতরে নিয়ে যেতে বলল। দেখতে চেয়েছে। 

ওরা কি ভাবে! পিলু কি সং। ভিতরে আমার কেমন অহংকারে বাধল। তারপরই মনে হলো, আমি অন্যায় অভিমানে ভুগছি। মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে পারে, ঘৃণাও করতে পারে। সব মানুষ সমান হয় না। পিলুকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেছি ঠিক, বাবারও সম্ভ্রম রক্ষা করা গেছে কিন্তু ঠিক মনুষ্যত্ব রক্ষা হয়নি। এমন একটা সরল বালকের প্রতি আমি ভারি অবিচার করেছি। ততক্ষণে খবরটা ভিতরে পৌঁছে গেছে। 

লক্ষ্মী কলসী কাঁখে ঠায় টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। আর হাজার রকমের প্রশ্ন, চলে গেল কেন?

—চলে গেছে। আমি কি করব। নিজের ইচ্ছায় এসেছিল, নিজের ইচ্ছাতে চলে গেছে। ও কারো কথা শোনার পাত্র নয়। 

—তুমি মিছে কথা বলছ মাস্টার। কালীর থানে মিছে কথা বলতে হয় না জান! যেচে খেতে এসেছে ভেবেছ! 

আমার ভিতরে ক্ষোভ বাড়ছিল। মেয়েটার এমন রূঢ় কথা আমার সহ্য হচ্ছে না। মিছে কথা বলছি, তুই তো এ বাড়িতে জল তুলিস, খেটে খাস—তোর এত আস্পর্ধা হয় কি করে! বললাম, লক্ষ্মী তুমি পিলুকে চেন না। মিছে কথা বলার কি আছে। 

কিন্তু যখন বৌদি আর বদরিদা এলেন, আমার সত্যি তালগোল পাকিয়ে গেল। এবার আর খুব জোর ছিল না কথায়। বদরিদা বললেন, কোথায় সে? কোথায় গেল! 

লক্ষ্মীই জবাব দিল, কোথায় আবার যাবে! বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন মাস্টার।সম্ভ্রমে লাগে।

মেয়েটা এত বোঝে কি করে। কিন্তু সবার সামনে লক্ষ্মীকে বলতেও পারছি না, কেন বাজে বকছ। সম্ভ্রমের কি আছে। আমিও তো আশ্রিতজন। 

বদরিদা রোগা মানুষ। গলায় লম্বা পৈতা। খদ্দরের মোটা ধুতি মালকোচা করে পরা। দেখলে মনে হবে, যেন ক্ষিপ্ত হয়েই ভিতর বাড়ি থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু আমি জানি, এই অমায়িক মানুষটির ভিতরে একটা বড় মাপের মানুষ বাস করে। তার কাছে মিছে কথা বলতেও বাধছে। বৌদি শুধু বলল, মাস্টার এটা ভালো কাজ হলো না। কতদূর থেকে দাদাকে দেখতে এয়েছে। আবার যাবে রোদে! 

আমার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে বললাম, বাড়িতে কিছু বলে আসেনি। খেয়েদেয়ে ফিরলে বাবা মা খুব চিন্তায় পড়ে যেতেন। 

বৌদি-দাদা কথাটার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পেয়ে আর কিছু বললেন না। নটু পটু পিছনে দাঁড়িয়ে। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে। ওকে বড় ভয় করছে। সে সবার সামনেই না বলে দেয়, সব মিছে কথা। মাস্টারের বানানো কথা। কি নিষ্ঠুররে বাবা! ভাইটাকে দুটো ভালো মন্দ খেতে পর্যন্ত দিল না। 

খেতে খেতে বেলা দুটো আড়াইটা বেজে যায় এবাড়িতে। ভোগের রান্না শেষ হয় দেরি করে। পাঁঠা বলি হয় বারোটার মধ্যে, মানুষের তো মানতের শেষ নেই। যারা বলি পছন্দ করে না, পাঁঠা উৎসর্গ করে ছেড়ে দেয়। শনি মঙ্গলবারে একটা দুটো ছাড়া পাঁঠা থাকেই। দিনে দিনে এরা জমে যায়। বাড়ে— বড় হয়। শনি মঙ্গলবারে মানতের পাঁঠা না পাওয়া গেলে, ছাড়া পাঁঠা বলি হয়। ওদিকটায় আমি যাই না। ঘরের মধ্যে বসেই টের পাই কার্তিক রামদা নিয়ে এগোচ্ছে। ঢাক কাঁসি এবং গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ আরম্ভ হলেই বুকটা আমার কাঁপে। পাঁঠা ধরার লোক ধনঞ্জয়। সে সকাল সকাল চান করে মন্দিরে এ দিনে চলে যায়। 

পিলু চলে যাবার পর আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। এমনকি মন্ত্রপাঠ ঢাক-ঢোলের বাজনা সব কিছুতেই মেজাজ অপ্রসন্ন হয়ে উঠছে। ঝিল থেকে স্নান সেরে আসার সময় দেখেছিলাম – কত বিচিত্র মানুষ মন্দিরের চারপাশে জড় হয়ে আছে। সাধু, ভিখিরি, ছেলেমেয়ে বউ বুড়ি গর্দানমোটা ব্যবসায়ী, জমিদার বাড়ির মানুষজন সব যে যার মতো অশ্বত্থ গাছগুলির নিচে শুয়ে বসে আছে। চা খাচ্ছে ফ্লাস্ক থেকে। পিলু এসেছিল দাদাকে শুধু দেখতে। তার কিছু আশা ছিল না। এত মানুষের মধ্যে পিলু থাকলে কি আর বেশি বাড়তি মানুষ হতো। লক্ষ্মী এসে বলল, খেতে যান গো মাস্টার। খাবার দেওয়া হয়েছে। 

বলার ইচ্ছে ছিল, খিদে পায়নি। কিন্তু জানি কথাটা লক্ষ্মী শেষও করতে দেবে না। খিদে পায়নি কেন? মন খারাপ। অত দেমাক ভালোনাগো মাস্টার। কালীর থানে এয়েছ, কপালে না থাকলে হয় না। মান অভিমান কমাও। গরিব বলে কি মানুষ ছোট হয়ে যায়। 

খেতে গেলাম অগত্যা। কিন্তু খেতে পারলাম না। বার বারই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। পিলুটা হয়ত ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে গেছে। কিছু ভাজা, কুমড়ো ফুলের বড়া আর কি বেশি রান্না হতে পারে। দুই চৌধুরী থাকার সময়ই বাবা ফতুর। আমার উপার্জনের টাকাও বোধহয় শেষ। খাওয়া- দাওয়া কষ্টে চলছে এখানে থেকেও তা বুঝতে পারি। লক্ষ্মী বারান্দায় একপাশে দাঁড়িয়ে। কলাপাতায় নুন, লেবু, কাঁচালঙ্কা জল সে সবাইকে দেয়। তার চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন বলে, চোখ ঝাপসা হলে মুখ নিচু করে রেখেছি। যতদুর জানি ভিতরের দুঃখটা কেউ টের পায়নি। লক্ষ্মীকেও পেতে দিইনি। চুপচাপ খেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম। তক্তপোশে মাদুর পেতে জানলা ঘেঁষে শুয়ে পড়েছি। চোখে হাত রেখে কত কিছু ভাবছি। নতুন জীবন শুরু। বদরিদা দু-একদিনের মধ্যে কলেজে যাবেন বলেছেন আমাকে নিয়ে। ভর্তি করার দায়িত্বটা মানুকাকার কথায় তিনিই ভার নিয়েছেন। মানুকাকা নাকি বলেছেন, বাবা খুব অসহায় মানুষ! তা বলতেই পারেন। যজনযাজন ছাড়া তাঁর আর কিছু কাজ জানা নেই। এদেশের মানুষদের এমনিতেই ধারণা, দেশ ছেড়ে এসে সবাই কুলীন বামুন কায়েত হয়ে গেছে। বাবা যে তেমন নয় কে জানে। মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লাগে। 

আর তখনি কার মৃদু পায়ের শব্দ। টেবিলে খুটখুট করছে। নটু আসতে পারে পটুও। এরাও আমার পাশে শুয়ে দিবানিদ্রা দেবে। বদরিদা ওদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। পাশে শোয় ঠিক, কিন্তু ঘুমাতে চায় না। এ-পাশ ও পাশ করে। কখনও দু’জনে মারামারি পর্যন্ত শুরু করে দেয়। সবকিছুর মীমাংসা আমাকে করতে হয়। চোখ খুলে দেখলাম, তারা কেউ কিনা। না। তারা নয়। লক্ষ্মী। সে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খেলে না কেন মাস্টার। 

একটা কড়া জবাব দেব ভাবলাম। কিন্তু চোখ দুটো এত মায়াবী যে কড়া কথা বলা গেল না। আমি খাইনি বলে যেন এক গোপন কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে। থাকতে না পেরে এখানে চলে এসেছে। বললাম, খেলাম তো। 

—এটা খাওয়া। তুমি কতটা খাও আমি দেখি না। তুমি খেতে খেতে চোখের জল ফেলছিলে কেন? 

—লক্ষ্মী। কেমন চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারলাম না। পাশ ফিরে শুয়ে বললাম, এখন যাও। আমি ঘুমাব। 

—ঘুমাতে কে বারণ করেছে। ঘুমাও না। তাই বলে তুমি আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। একবার বলার ইচ্ছে হল, তুমি কি এ বাড়ির গোয়েন্দা। বৌদিকে না আবার বলে দেয়। ওরা তবে কি ভাববে! উঠে বসলাম। ধরা পড়ে গেছি যখন উপায় কি! বললাম, কাউকে বলো না। 

লক্ষ্মী কেমন মাথা নিচু করে বলল, তুমি এটা মাস্টার ভাবলে কি করে আমি সবাইকে বলে বেড়াব। আমি ছোট জাতের বলে মনটা ছোট হবে কেন। কালীর থানে থাকলে মন ছোট রাখতে নেই। তিনি তো সব দেখতে পান। গোঁসা হবে না তাঁর। 

এ-হেন মেয়েটির সঙ্গে আমি কথায় কি করে পারি। চুপচাপ থাকলাম। লক্ষ্মী তবু দাঁড়িয়ে আছে। যাচ্ছে না। কি ভাবছে কে জানে। লক্ষ্মী গায়ে কিছু পরে না। অথচ শরীর আশ্চর্যভাবে ঢেকে ঢুকে রাখতে শিখেছে। এ বয়সটা এমন যে সব কিছু ফুটে বের হতে চায়। লক্ষ্মী টের পায় বলেই শরীর নিয়ে এবং তার ডুরে শাড়ি নিয়ে সব সময় খুব সতর্ক থাকে। আমার ঘরে হুট হাট চলে আসে, ওতে আমি শঙ্কিত থাকি। এই সেদিনও এটা ছিল না। ছোড়দির কথা মতো সব করতে পারতাম। ছোড়দির পিছনে সাইকেলে চেপে কতদিন দামোদরের পাড়ে চলে গেছি। নদীর চরায় হেঁটে বেড়িয়েছি। ছোড়দি কত কথা বলত, বিলু তুই বড় হবি কিন্তু। পিলু ছোড়দি মা বাবা সবাই চায় আমি বড় হই। সেই বড় হওয়াটা লক্ষ্মীও চায় বুঝি। কলেজে যাবার দিন দেখলাম, আমার একটা মাত্র ফুলপ্যান্ট ধুয়ে সুন্দর করে ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দিয়েছে। আমি কি পরে যাব না যাব, আমার চেয়ে লক্ষ্মী সেটা যেন বেশি জানে। কে তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। বৌদি, বদরিদা না সে নিজেই এভাবে মানুষের দায়িত্ব নিতে ভালোবাসে। অন্যমনস্ক হলেই দেখছি, লক্ষ্মী কখন এসে আমার জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে বসে গেছে। বুঝতে পারছি সাপের খোলস ছাড়ার মতো আমার পুরনো খোলসটা এবার শরীর থেকে ধীরে ধীরে খসে যাচ্ছে। নতুন খোলস—নতুন এক আশ্চর্য ছাপ এবং দারুচিনি গাছের মতো সুঘ্রাণ—কে যেন ধীরে ধীরে এসে একটা সঠিক আস্তানা গাড়তে চাইছে। তার জন্য প্রায় জানালায় অথবা জ্যোৎস্না রাত্রে, কোন নিরিবিলি আকাশের নিচে নক্ষত্র দেখতে দেখতে ভাবি সে কে! সে কোনো রহস্যময়ী নারী-যে আমায় কোনো ফুলের উপত্যকায় নিয়ে যেতে চায়। পিলু সেটা টের পেয়ে গেছে কিনা কে জানে। সে আর আসে না। প্রায়ই জানালায় মনে হয় সে এসে দাঁড়িয়ে ডাকবে, দাদা আমি রে। সেই স্বর্গীয় হাসিটি লেগে থাকবে পিলুর মুখে। আমি বলব, আয় ভিতরে আয়। আজ তুই এখানেই খেয়ে যাবি। লক্ষ্মী টের পেয়ে বলেছিল, বাড়ি যাও না মাস্টার। ভাইয়ের জন্য মন কেমন করছে! 

কেমন উদাস গলায় বললাম, অনেকের জন্যই মন কেমন করে। কিন্তু কাউকে বলতে পারি না। পিলু কেবল সেটা ধরে ফেলেছে। সে আর সে ভাবে বুঝি আমার কাছে আসবে না। লক্ষ্মী কি বুঝে মাথা নিচু করে রাখল। যে মেয়েটা সারাদিন চোপা করে তার চোখও দেখলাম কেমন জলে ভার হয়ে উঠছে। ধরা পড়ে যাবে বলে, সে দৌড়ে ভিতরে চলে গেল। 

এরপর অনেকদিন লক্ষ্মী আমার সামনে আসেনি। তাকে আর আগের মতো কাছাকাছি দেখতে পাই না। 

রাতে যখন খেতে যাই ভিতর বাড়িতে তখন সে বিছানা করে রাখে। কলেজ থেকে ফিরে দেখি আমার বইপত্র খাতা সব তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। সকালের খাবার নটু পটুকে নিয়ে আসতে হয়। আমারটাও তারাই নিয়ে আসে। লক্ষ্মীকে কাছে পাবার যা কিছু উপলক্ষ্য ছিল, সব থেকেই সে কেমন দূরে সরে থাকছে। লক্ষ্মী যত দূরে সরে যাচ্ছিল, তত ভিতরে এক আশ্চর্য টান বোধ করছি। সে দুরে থেকে আমার সব কিছু লক্ষ্য রাখছে। আমার সব কিছুতেই তার অদৃশ্য হাত কাজ করে চলেছে। এমন কি সে আমার জন্য আলাদা স্নানের জলও তুলে রাখে। জামাপ্যান্ট ধুয়ে মেলে দেয়। তারপর যেখানে যা রাখবার রেখে দেয়। সাঁঝবেলায় জানি লক্ষ্মী জল আনতে যাবে ঝিলে। তাকে সেখানে একা পেতে পারি ভেবেই কেন যে গিয়ে সিঁড়ির চাতালে বসে থাকলাম। লক্ষ্মী এল, দুবার জল নিয়ে গেল। সে যেন আমাকে চিনতেই পারে না। মরিয়া হয়ে শেষ বেলায় বললাম, লক্ষ্মী, দাদাকে বলে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছি। মজা বুঝবে। লক্ষ্মী কেমন আঁৎকে উঠল। লক্ষ্মী ভারি যুবতী নারীর মতো বলল, মাস্টার, কপালে আমার সয় না। সে মানুষটার অনিষ্ট হোক আমি চাই না। এই ভাল আছি। এইটুকু বলে সে চলে গেল। বুঝতে পারছিলাম, লক্ষ্মী নিজেকে আর জড়াতে চায় না। তার ধারণা, সে মানুষের জন্য টান বোধ করলে জগৎ-জননী রাগ করে। তাকে কেড়ে নেয়। সে সারা জীবনের জন্য বোধহয় এইখানে সেবাদাসী হয়ে পড়ে থাকতে চায়। আর কিছু জীবনে তার কাম্য নয়। 

ঝিলে কিছু পাখি উড়ে এল, ওপাড়ের বাঁশবনে কারা আগুন জ্বেলেছে। শীত শীত করছিল। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। আকাশে কিছু নক্ষত্র। নিরিবিলি এক জনশূন্য পৃথিবীর আমি বাসিন্দা। মানুষের কত রকমের সংস্কার গড়ে ওঠে বড় হয়ে উঠতে উঠতে। এক সময় দেখলাম, লক্ষ্মী লন্ঠন হাতে চলে এসেছে। হাতে শীতের চাদর। শুধু বলল, বাড়ি চল মাস্টার। ঠান্ডা লাগবে। এটা গায়ে দাও। ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বর বাধালে কে দেখবে। 

–কেন তুমি। 

—আমি তোমার কে? কেউ না। আমার দায় পড়েছে দেখার। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাগুলি বলল লক্ষ্মী। লণ্ঠনের আলোয় মুখ দেখা যাচ্ছিল না। বুঝতে পারছি লক্ষ্মী আমার অমঙ্গল আশঙ্কায় কাতর হয়ে পড়ছে। কিছু একটা না আবার মাস্টারের হয়। সে তারপর বলল, বাড়ি চল মাস্টার। মানুষের মুখে আকথা কুকথা লেগেই থাকে। তুমি আর আমাকে জ্বালিও না। অনেক রাত হয়েছে। এবারে ওঠো। তারপর লক্ষ্মী আমাকে দরজায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় শুধু বলল, ভারি ছেলেমানুষ তুমি। 

এ কথায় কেন যে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলাম। দৌড়ে গেলাম, সে মন্দিরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। লন্ঠনটা কেড়ে মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। —দেখি তোমার মুখ। আমি ছেলেমানুষ, তুমি কে! কেমন মাথাটা লক্ষ্মীর কথায় ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। প্রায় পাগলের মতোই কান্ডটা করে ফেলেছি। —দেখি মুখ, খোল। খোল বলছি। লক্ষ্মীর আঁচল নিয়ে কাড়াকাড়ি করছি। 

লক্ষ্মী শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে রেখেছে। না না দেখ না মাস্টার, পায়ে পড়ি। আমার মুখ দেখলে তোমার অনিষ্ট হবে মাস্টার। তারপরই কেমন আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল। সত্যি ভারি ছেলেমানুষী করে ফেলেছি। কেউ দেখে ফেললে কি ভাবত। চুপচাপ ঘরে এসে বসলাম। নটু পটুকে বললাম, আজ তোদের ছুটি। 

আজ পড়াব না। ওরা চলে গেলে রেল লাইন ধরে অনেকটা হেঁটে গেলাম। জ্যোৎস্না রাত— আমার কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না। কেমন ভিতরে চঞ্চল বালকের মতো এক তীব্র অস্থিরতায় পাগল হয়ে উঠেছিলাম। তারপরই দেখলাম হাঁটতে হাঁটতে সেই নবমী বুড়ির বনটার কাছে এসে গেছি। মানুষ বুঝি শেষ পর্যন্ত এখানেই এসে থামে। কখনও খর রোদ, কখনও জ্যোৎস্না, কখনও গাছপালার নিরন্তর ছায়া। মানুষ এভাবেই সামনে হেঁটে যায়। বনভূমির এক আশ্চর্য নিথর সৌন্দর্যে আমি কেমন মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার চাঞ্চল্য কমে গেল। ধীরে ধীরে ফের রেল লাইন ধরে হেঁটে ফিরতে থাকলাম। মনে হচ্ছিল যেন কারা আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। তাদের পায়ের শব্দ আমাকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেন যেতে বলছে। হাহাক্কার হাসিতে টের পাচ্ছিলাম। তারা আমায় কোন ফুলের উপত্যকায় নিয়ে যেতে চায়। আমি সব ছেড়ে, ঘরবাড়ি ফেলে, এখন সেদিকেই হাঁটছি। উপত্যকার দুই প্রান্তে আমি আর পিলু দাঁড়িয়ে। নির্জন সেই উপত্যকায় আমাদের দু’জনের মাঝখানে কেউ কেবল আঁচল উড়িয়ে নৃত্য করছে। পিলুর আর সেই ডাক ‘দাদারে’ শুনতে পাচ্ছি না। সে বার বার ডেকেও আমার সাড়া পাচ্ছে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *