প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ১৫

পনের 

খোঁড়া গরুটাকে নিয়ে আসার পর বাবার ঘরবাড়ি ষোলকলা পূর্ণ হয়ে গেল। কারণ অভাব বলতে তাঁর তখন সন্তান-সন্ততিদের পাতে একটু দুধ দেওয়াই ছিল প্রাণাধিক ইচ্ছা। ইচ্ছা-পূরণে বাবা আমার ক’দিন থেকে মেজাজী মানুষ। তারপর এল বাবার জীবনে আরও বড় সুখবর—তাঁর প্রথম সন্তান বিলু সব বিষয়ে পাস। বিলু অর্থাৎ এই অধম জীবনে ন’টা বিষয়ে পাস করে বসে আছে—বাবা আমার তাতেই খুশি ছিলেন। জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাস করে। বাকি একটা বিষয়ে পাসের খবর আসায় বাবা আমার একবারে হতভম্ব। 

বাবা আমার দেশে থাকতে জমিদারী সেরেস্তায় আদায়পত্র করতেন। আর ছিল যজন-যাজন। পৈতৃক সম্পত্তি মন্দ ছিল না। ভালভাবে চলে যেত। বাবার জীবনে পরীক্ষায় পাস করার কোন দায় ছিল না, এ দেশে এসে অথৈ জলে পড়ে গেলেও খুব একটা ঘাবড়ে যান নি। আমার সব বিষয়ে পাস করার কথা শুনে কেমন হয়ে গেলেন। ঠাকুরঘরে ঢোকার আগে ডেকে বললেন, সত্যি তুমি সব বিষয়ে পাস করেছ? 

বললাম, হ্যাঁ বাবা। 

মা রান্নাঘর থেকে বললেন, ওটা কি আবার হাতি-ঘোড়া নাকি, পাস করতে পারবে না।

—না, বলছিলাম, সব বিষয়ে পাস ভাবা যায়না। 

আসলে আমাদের পরিবারের জীবনে কেউ কোন বড় পাস দেয় নি। আমিই প্রথম, এবং এতে বাবা খুব অহংকারী ছিলেন—বাবার কাছে পাস করাটা কোন কৃতিত্বের বিষয় নয়, এমনই জানতাম। কিন্তু আজ দেখছি অন্যরকম। পিলু তখন তাড়া লাগাচ্ছিল, চল না দাদা? ঠাকুরঘর থেকে বাবার গম্ভীর গলা, না, দাদা যাবে না। বিলু তুমি চান করে এস। আমার পাশে বসে থাক। ঠাকুর সুপ্রসন্ন না হলে মানুষ কখনও এত বড় কাজ করতে পারে না। 

আমরা বাবাকে ভয় করি কি সমীহ করি, ঠিক বুঝি না। এই ভয় কিংবা সমীহ সবটাই নির্ভর করত মা’র উপর। তিনি বাবার উপর প্রীত থাকলে বুঝতে পারতাম, পিতৃদেবের উপর কোন কথা নেই। প্রীত না থাকলে বুঝতাম, নির্দেশ অমান্য করাই বিধেয়। কিন্তু বাবা দীর্ঘ তিন চার মাস বাড়ি ছাড়া হন নি বলে, মা’র এখন বাবা ছাড়া কথা নেই। আমরা মায়ের সন্তান। বাবা সংসারী মানুষ হয়ে গেছেন প্রমাণ করার জন্য শেষ পর্যন্ত একটা দানের গরু পর্যন্ত সংগ্রহ করে এনেছিলেন। এ- হেন সময়ে পিলুর সঙ্গে বন-বাদাড়ে ঢুকে যাব না বাবার ঠাকুর ঘরে বসে স্তোত্র পাঠ শুনব, বুঝতে পারছিলাম না। 

পিলু অবশ্য বাবার কথা খুব গ্রাহ্য করে না। মা’র কথাও না। তার উপর দাদা প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করে যাওয়ায় কিছুটা বিজয়ী আলেকজাণ্ডার সে আজ। বাতা কেটে তরবারি বানিয়ে ইতিমধ্যেই কোমরে গুঁজে ফেলেছে। মাথায় পাতার টুপি পরে পড়শীদের বাড়ি, বাড়ি খবর দিয়ে এসেছে, দাদা সব বিষয়ে পাস করেছে। কারণ এত বড় খবরটা পৃথিবীর কেউ জানবে না, সে হয় না। বাকি আছে, নবমী বুড়ী, সে থাকে ইটের ভাটা পার হয়ে, কারবালার রাস্তার ধারে। এখনও সে দিকটায় মানুষের বসতি হয়নি। কবরভূমি বলেই হয়ত মানুষের ভয়। দলে দলে যে সব ছিন্নমূল মানুষ আসছে তারা তো খালি জায়গা দেখলেই বাঁশ পুতে খুপরি বানিয়ে আস্তানা গেড়ে নিচ্ছে। আগে অনেকটা হেঁটে গেলে শহরের ঘরবাড়ি দেখা যেত, এখন রেল-লাইন ঘর বাড়ি পর্যন্ত এসে যাওয়ায় বাবা আরও স্থিতিশীল মানুষ হয়ে গেছেন। কারণ জমির দাম যে ভাবে বাড়ছে তাতে কবে না হাজার টাকা বিঘে হয়ে যায়—আজকাল এমন স্বপ্ন বাবা প্রায়ই দেখতে পেতেন বলে বোধহয় এখন আর ঘরবাড়ি ছেড়ে ডুব দিচ্ছেন না কোথাও। 

এ-সব মুহূর্তে পিলুই আমার ত্রাণকর্তা, সে হাত ধরে টানতে থাকল, চল না দাদা! ও দাদা, যাবি না?

বাবা পাটায় চন্দন ঘষছিলেন, হাত থামিয়ে বললেন, কোথায় যাবে শুনি? তুমি ওকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও? সে তো তোমার মতো বাউণ্ডুলে নয়। 

পিলু বলল, আমার কী দোষ? 

বাবা এ সময় প্রশ্ন করতে পারতেন, তবে কার? কিন্তু তিনি জানেন, উত্তরটা সুখের হবে না। পিলুর যা একখানা স্বভাব, বলেই না ফেলে, তোমার। বাবার বাউণ্ডুলে স্বভাবের জন্য মা আমাদের গালাগাল দিয়ে বলতেন, যেমন বাপ, তেমনি ছেলে। সেই থেকে পিলু জেনে ফেলেছে, আসল দুরাত্মা সংসারে বাবা। বাবার স্বভাব সে পেয়েছে, এটা তার কাছে বড়ই অহংকারের বিষয়। চন্দন ঘষতে গিয়ে বাবা টের পেয়েছেন, দ্বিতীয় পুত্রটির মাথা তার মা চিবিয়ে খেয়েছেন। সুতরাং কিছুটা ইতস্তত করে বললেন, তোমার মাকে জিজ্ঞেস কর। 

কি জিজ্ঞেস করবে পিলু বোধহয় বুঝতে পারেনি। বাবার বাউণ্ডুলে স্বভাব সম্পর্কে সত্যাসত্য যাচাই করবে, না সে এ সময় কোথাও দাদাকে নিয়ে যেতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করবে,–কোনটা? সে মাকে ডেকে বলল, মা, বাবা আমাকে বাউণ্ডুলে বলছে। দাদাকে নিয়ে যাব? 

মা রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছে বের হয়ে আসছে। বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল মাকে। লাল পেড়ে শাড়ি পরনে, শরীরে মা মা গন্ধ। আমি বললাম, পিলু বলছে নবমী বুড়ীর কাছে আমাকে নিয়ে যাবে। 

—তা যা না, ধরে রেখেছে কে? 

—এই তো ধনবৌ, সংসারের ভাল-মন্দটা তুমি বোঝ না। যার কৃপায় সব হয়, এই যেমন ধর ঘরবাড়ি, গাছপালা, দুধালো গাই, তার কাছে না বসে তুমি বিলুকে নবমীর কাছে পাঠাচ্ছ। বাবা যে বিষয়ী মানুষ সেটা প্রমাণ করার জন্য বললেন, রোদে ঘুরে জ্বরজ্বালা হলে ওকে মানুর কাছে নিয়ে যাব কী করে? একটা কাজটাজ হয়ে গেলে, তোমার হাতে দুটো পয়সা বেশি পড়বে। 

মা বলল, কেন দুধালো গাই! 

বাবা মার কথায় ভড়কে গেলেন। 

দুধালো গাই বলার অর্থ গরুটার পর সংসারে আর একজন আমি, যাকে নিয়ে সাশ্রয়ের স্বপ্ন দেখছেন বাবা। 

দানের গরুটি অস্থিচর্মসার এবং বুড়ো তা ছাড়া তিন পা অবলম্বন করে যার বেঁচে থাকা সে সংসারে উৎপাত ছাড়া আর কি। তবু বাবা পুজো-আর্চার নাম করে বের হয়ে পড়ছেন না, এবং খোঁজখবর না দিয়ে দেশের মানুষের খোঁজে ঘুরে বেড়ানোর বাতিক কমে গেছে বলে গরুটির প্রতি সদয়ই ছিলেন মা। দুধালো গাই বলাটা বাড়াবাড়ি। দুধ না হয়, গোবরটুকু তো হয়, এই আপ্তবাক্য সার করে মা মুখ বুজে সব সয়ে গেছেন। তা ছাড়া দানের গরু আর কতটা ভাল হতে পারে, এমনও একটা সংশয় তিন মাস ধরে মা’র মধ্যে কাজ করছিল। তার সেবাযত্ন একটু অধিক মাত্রাতেই চলছে। পিলু কচি ঘাসের খোঁজে একটু বেলা বাড়লেই বের হয়ে যায়। মা জল গরম করে ভাতের মাড় সহ কিছু খোল মিশিয়ে দেয়। সন্ধ্যায় পিতা, পুত্র এবং জননী মিলে সাধ্য-সাধনা চলে—যদি শরীরে ভগবতীর মাংস লাগে। কিন্তু তিনি যেমন ছিলেন, তার বেশি এক পা নড়ছেন না। এই নিয়ে মহাভারত পাঠ যে কোন সময় শুরু হয়ে যেতে পারে। প্রতিদিনই আমরা এমন একটা প্রবল আশঙ্কায় ভুগছিলাম— এখন পর্যন্ত পাঠ শুরু হয়নি। মা বরং আজকাল সাংসারিক বিরোধে বাবার পক্ষই নিয়ে থাকেন। মা, বাবার পক্ষ নিলে আমার পিলুর সংসারে গুরুত্ব কমে যায়, বিশেষ করে পিলুর স্বাধীনতা খর্ব হয়। বাবার সংসারী মানুষ হয়ে যাওয়াটা পিলুর পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। 

মা শুনে বললেন, তাই তো। এই দুপুরে যাবার কী হল? 

পিলুর প্যান্ট কোমরে থাকে না। হড়হড় করে নেমে যায়। নাকে সর্দি স্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। যতবার প্যান্ট নেমে যায় ততবার তাকে ওটা তুলে পরতে হয়, নাক মুছতে হয় বারবার। এজন্য সে কিছুটা সময় নিয়ে বলল, মা, তুমি বুঝছ না দাদা পাস করেছে খবরটা না দিলে নবমী বুড়ী খারাপ ভাববে। ওকে ভাল খবর দেবার তো কেউ নেই। 

এমন কথায় বাবা ভিতরে কেমন চমকে উঠলেন। দ্বিতীয় পুত্রটির কথাবার্তাই এই রকমের। নবমীর কেউ নেই, বাড়ির ভালমন্দ হলে কলাপাতায় বনজঙ্গল ঠেঙিয়ে দিয়ে আসার মধ্যে পিলুর কী যেন এক আলাদা জগৎ আছে। যা তিনি ঠাকুরঘরে বসে টের পাবার চেষ্টা করেন, পিলু সেটা টের পায় বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে। তিনি বললেন, যাও, তবে ওখানে আটকে থেকো না। 

সঙ্গে সঙ্গে মাও বললেন, হ্যাঁ, যাও—তবে ওখানে আটকে থেকো না। 

এত সহজে ছাড়পত্র মিলে যাবে, অনুমান করতে পারি নি। মনে হল বাবা-মা আমাদের কত ভাল। আমরা হাঁটতে থাকলাম। বাড়িটা আম জাম কাঁঠালের চারাগাছে ভর্তি। বাবার সংসারে এখন একটাই কাজ, গাছপালা পুঁতে যাওয়া। কত যে গাছের খবর নিয়ে আসছেন। আমলকী গাছটা ঘরবাড়ির উপর দু’বছরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্রমের মতো বাড়িটার জন্য দিন দিন মায়া বেড়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে সব কেমন টের পাচ্ছিলাম। আমরা, বাবার ঘরবাড়ির সব। আমরা না থাকলে বাবার কিছু থাকে না। বাবা না থাকলে আমাদের কিছু থাকে না। 

শরৎকাল বলে সূর্যের তাত কম। চারপাশে সবুজের সমারোহ। যেতে যেতে বন-জঙ্গলের সুঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। তখনই কেউ যেন ডাকল, দাদা, দাঁড়া, আমি যাব। দেখি পেছনে মাঠের ভেতর দিয়ে দৌড়ে আসছে মায়া। পিলু মায়াকে দেখে ভারি গম্ভীর হয়ে গেল। 

বন-জঙ্গলের ভেতর তার দুই দাদা যাচ্ছে, সে বাড়িতে একা থাকে কি করে। আর সঙ্গে আসছে হেমন্তের কুকুর। সংসারে সেও আমাদের একজন। মায়া, হেমন্তের কুকুর, আমি, পিলু এই মিলে যাত্রা, মন্দ না। কিন্তু পিলু মায়ার ছোড়দা। শাসন করার সুবর্ণ সুযোগ—সে বলল, বাড়ি যা বলছি। মা’র কত কাজ। 

মায়া বলল, না, আমি যাব। 

—যাবে না! পিলু ধমক লাগাল। 

মায়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদার সঙ্গে যাব। তোর সঙ্গে যাচ্ছি না। 

পিলু ক্ষেপে গেল—যা, যা না। দাঁড়ালি কেন? আমি যাচ্ছি না। 

পিলুকে অগত্যা বললাম, আসুক না। নবমী আমাদের সবাইকে দেখলে খুশি হবে। এমন কথায় পিলুর মনটা নরম হয়ে গেল। বলল, দাদা, তুই চাকরি করলে, নবমীকে বাড়িতে নিয়ে আসব, কেমন। পিলুর এই স্বভাব। আমাদের ভারি অভাব-অনটনের সংসার। সম্বল বলতে ক’ বিঘা উড়াট জমি, কিছু শিষ্য আর বাবার বাড়ি বাড়ি পূজা-আর্চা। পিলুর বড়ই অভিযোগ, এ-দেশে এসে আমরা কত গরিব হয়ে গেলাম! অভিযোগটা আমারও। আমাদের বাবা এ-দেশে এসে বড় গরিব হয়ে গেলেন, এ-কথা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। 

তবু একটা আশ্রয় মানুষের জন্য কত দরকার, আমাদের ঘরবাড়ি হয়ে গেলে টের পেলাম। আমরা যে অন্য একটা পৃথিবীতে এসে উঠেছি, এখন আর মনেই হয় না। উঁচু নীচু মাঠ, কাঁটা গাছ, কোথাও ঢিবি, কোথাও অজানা ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক, নীল আকাশ মিলে আমাদের যেন সেই পুরনো অস্তিত্ব। কোথাও একটা খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে, যেন কতকালের চেনা। কোথাও বাবলার বন, তারপর সেই প্রাচীন ইঁটের ভাটা। অনেকটা জায়গা জুড়ে। বড় মজা দীঘি, শান বাঁধানো পরিত্যক্ত ঘাটলা, পাড়ে পাড়ে অজস্র দেবদারু গাছ। জনহীন গভীর নির্জনতা তখন আমাকে গ্রাস করে। দূরের স্বপ্ন দেখতে পাই। কেউ যেন আমার সামনে ফুলের টব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কে, এখনও বুঝতে পারি না। মা-বাবা ভাই-বোন ছাড়া আরও কেউ পাশাপাশি পথ হাঁটছে, শুধু এইটুকু টের পাই। 

পিলু, মায়া, অজস্র কথা বলছিল। 

পিলু বলছিল, দাদা, তুই চাকরি করলে, একদিন পেট ভরে রসগোল্লা খাব। 

মায়া বলল, দাদা কলেজে পড়বে। কি মজা! 

পিলু বলল, বাবা যে বলল, মানুকাকাকে চাকরির কথা বলে এয়েছে। 

সংসারে বাবার দু’জন মানুষ সম্বল। দেশে থাকতে বাবার জমিদার দীনেশবাবু। 

আর এখানে এসে মানুকাকা। তিনি যা বলবেন তাই হবে। 

পিলুই বলল, মানুকাকা বলেছে, পড়িয়ে আর কি হবে। একটা কাজেটাজে ঢুকে যাক। 

কবে বলেছে? মজা দীঘির ধারে কেমন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। গাছপালা, নীল আকাশ নির্জনতা ভেঙে কেমন খানখান হয়ে গেল। চিৎকার করে ফের বললাম, কবে বলেছে? বল কবে বলেছে! আমার স্বভাব নয় জোরে কথা বলা। কেন যে এত রেগে গেলাম! কার উপর রাগ, তাও বুঝতে পারছি না। বাবার উপর, না মানুকাকার উপর। না দেশ ভাগ—কারণ দেশ ভাগ না হলে আমরা এত গরিব হয়ে যেতাম না। পিলু দাদার চণ্ডমূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেল। তার দাদাটি বড় শান্ত স্বভাবের। মায়া বলল, দাদা, তুই কলেজে পড়বি। কারো কথা শুনবি না। 

নবমীকে খবর দেবার আমার আর কোন ভরসা থাকল না। আসলে যে ফুলের টব হাতে নিয়ে আমার সামনে মাঝে মাঝে এসে দাঁড়ায়, সে কেমন ভ্রু কুঁচকে বলল, ও মা, তুমি আর পড়বে না! তালে তুমি মানুষ হবে কী করে? বড় হবে কী করে? 

বড় হওয়াটা যে আমার খুবই দরকার। পিলুকে বললাম, আমি যাব নারে। তোরা যা! 

তবু পিলু ছাড়ল না। বন-জঙ্গলের মধ্যে নবমী থাকে। ট্যানাকানি পরে। না থাকলে পরে না। এখানে আসার পর পিলুর সাম্রাজ্যের মধ্যে নবমী বুড়ীও পড়ে গেছে। বাড়িতে ভালমন্দ হলে আগে নবমীর জন্য চুরি করত, এখন করে না। বাবার ছাড়পত্র মিলে গেছে। 

অভাবের সংসারে মা গজগজ করলে বলতেন, আরে দিলে কখনও ফুরায় ধনবৌ? যতটুকু দিতে পারলে, ততটুকুই আখেরের কাজ করলে। তেনার মাপা জিনিস। তাঁর সব। তুমি দেবার কে ধনবৌ? 

পিলু মজা দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ল, নবমী! কারণ সে জানিয়ে দিল, নবমীর দাঠাকুর এই বনের মধ্যে হাজির। যেন তাড়াতাড়ি গায়ে ট্যানাকানি না থাকলে পরে নেয়। আগে বোধ হয় কখনও পিলু বন-বাদাড়ে ঘুরতে গিয়ে দেখেছে—উলঙ্গ এক বুড়ী বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। পিলুর কেমন লজ্জা লেগেছে। আবার পূজা-পার্বণের দানের কাপড় একটা চুরি করলেই হয়ে যায়। এবং তা দিতেই পিলু বোধ হয় নবমীর দা-ঠাকুর হয়ে গেছিল। দা-ঠাকুরের জন্য নবমীও কিছু রেখে দেয়। এই সেদিন একটা ঝুনো নারকেল নিয়ে গেছে পিলু। গাছতলায় কুড়িয়ে পেয়েছে নবমী। দা-ঠাকুরকে না খাইয়ে সে খায় কী করে? এই বনটার মধ্যে আমরা এখন তিনজন প্রাণী। আর আমাদের হেমন্তের কুকুর। পিলুর পার্টনার। কুকুরটাও মুখ তুলে ঘেউঘেউ করে উঠল। পিলু ডাকছে, সে ডাকবে না, কী করে হয়? আর তখনই খসখস শব্দ। খুব ক্ষীণ গলায় সাড়া দিচ্ছে নবমী, আসেন গা দা-ঠাকুর। 

মণীন্দ্র কাঁটাগাছের জঙ্গলে জায়গাটা ভরা। ইচ্ছে করলেই ছোটা যায় না। পিলু ছুটতে চেয়েছিল, কাঁটায় জামা আটকে গেছে। মায়া উবু হয়ে জামাটা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। তার অবশ্য হুঁশ নেই। চিৎকার করে বলছে, আমার দাদা পাস করেছে নবমী। দাদাকে নিয়ে এসেছি। মায়া এয়েছে। 

এবং যখন কাঁটা গাছ এবং আগাছা মাড়িয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম, নবমীর কি আনন্দ। যেন তার কত নিকট আত্মীয়স্বজন আমরা। নবমী বলল, কি পাস গ‍ 

পিলু বলল, ওমা তোমাকে বলেছি না, দাদা এ বছর একটা পাস দেবে। মেট্রিক পরীক্ষা। সে তুমি বুঝবে না। তোমার কিছু মনেও থাকে না। কত বার বলেছি, দাদা ন’টা বিষয়ে পাস করে গেছে। আর একটা বিষয়। ব্যস, তাও পাস। বাবা তো বিশ্বাসই করেন না, সব বিষয়ে মানুষ পাস করতে পারে। জীবনে নাকি সেটা হয় না। 

বাবার কথায় নবমী কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল, তিনি দেবতা আছেন গ। তারপরই নবমীর যা স্বভাব গড় হয়ে গেল। পিলু এটা তার প্রাপ্যই মনে করে থাকে। কিন্তু আমার বড় সংকোচ হল। বললাম, ছি ছি, কী করছ? বলে পা সরিয়ে নিতেই শীর্ণ হাতটা কেমন কেঁপে গেল। যেন সে কি অপরাধ করে ফেলেছে! খোনা গলার স্বর স্পষ্ট নয়। এখন তার চলতে ফিরতেও কষ্ট। একদিন পিলু তাকে ধরে ধরে নিয়ে গেছিল, বাবার ঠাকুরঘরে সে মাথা ঠেকিয়ে আসতে পেরেছে—আর এই যে আমাদের দর্শন, সেটা তার নিতান্ত পুণ্যফল। এ-হেন সময়ে আমার এমন বলা বোধহয় উচিত হয় নি। নবমী কেমন শুকনো গলায় বলল, দা-ঠাকুর, কত ভাগ্যিমানী হলে পায়ের ধুলো পড়ে। দ্যান চরণখানা মুঠা করে লই। 

ওকে বঞ্চনা করতে কেন জানি আর মন চাইল না। পা দু’খানা পিলুর মতো আমিও বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলাম। 

আসলে এ সবই আমায় কোন দূরবর্তী নক্ষত্রের খবর দিচ্ছিল। সেটা কোথায় খুঁজে বের করতে হবে। নবমী আমার দিকে কিছুটা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভাল দেখতে পায় না। একটা পাস দেওয়া মানুষ তার সামনে। সে কোন রকমে উঠে, সারা গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, বাপের মুখ উজ্জ্বল করেন গ দা-ঠাকুর। 

মায়া বলল, জান নবমী, আমার দাদা কলেজে পড়বে। 

নবমী এ সব কিছুই বোঝে না। মুখে তার আশ্চর্য সরল হাসি। যেন এটা এমন কাজ, যা আমিই একমাত্র পারি। কম্পার্টমেন্টালে পাস করার মত এত বড় কাজ আমার পক্ষেই সম্ভব। সে বলল, একটা শীতের চাদর দেবেন গ দা-ঠাকুর? বড় হয়ে গেলে দিতে হয়। 

নবমীর পক্ষে এত দিন বেঁচে থাকা সম্ভব না। এই শীতে অথবা আগামী শীতে সে মরে যাবে। তবু মানুষের মরণ বাঁচন বলতে কথা দিলাম, বড় হয়ে তাকে একটা শীতের চাদর দেব। এই আমার কাউকে প্রথম কথা দেওয়া। 

.

বাবার ফিরতে বেশ রাত হল। শরতের শেষ বেলা বলে বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মা বারান্দায় হারিকেন জ্বালিয়ে বাবার প্রতীক্ষায় বসে আছেন। মানুষটা ফিরলে তাঁর অনেক কাজ। আমারও ঘুম আসছিল না। বাবা কি খবর নিয়ে আসবেন কে জানে? কারণ মানুকাকার ইচ্ছা না হলে আমার কলেজে পড়া হবে না জানি। ঈশ্বরের কাছে কেবল প্রার্থনা করছি, হে ঠাকুর, বাবা-মানুকাকার সুমতি দাও। ওঁরা যেন এখনই আমার পড়াশোনা বন্ধ করে না দেন। রাস্তা থেকেই বাবার গলা পাওয়া গেল।— বেড়াটা কে ভেঙেছে? তিনি বাড়িঘরে যখন থাকেন, খুবই সংসারী মানুষ। গাছের একটা পাতা খসে পড়লেও তিনি টের পান। মা বললেন, দানের গরু ভেঙেছে। মানু ঠাকুরপো কি বলল? 

দানের গরু ভেঙেছে যখন সাত খুন মাপ। বাবা খুব সদাশয় ব্যক্তি হয়ে গেলেন। অবলা জীব বলে কথা। 

বারান্দায় উঠে এলে ফের মা বললেন, ঠাকুরপো কি বলল? 

—খুব সুখবর। 

আমার ভেতরে উল্লাস। তবে ঈশ্বর মানুকাকার সুমতি দিয়েছে। 

বাবা আরও কি বলতে যাচ্ছিলেন, মা মাঝপথে থামিয়ে বললেন, পরে শুনছি। আগে হাত-মুখ ধুয়ে নাও! ঠাকুরের বৈকালী হয় নি। 

—কেন, কেন তোমার বড় পুত্র, কি করছিল? 

—দেয় নি তো! কিছু নাকি ওর ভাল লাগছে না। 

—পিলু! 

—সারাক্ষণ ঝগড়া করেছে মায়ার সঙ্গে। আমার কথা কে শোনে? 

বাবা ওসব কথা একদম শুনতে চাইছেন না।—সব হবে ধনবৌ। তোমার বাড়িঘর যখন হয়ে গেছে, সব হবে। মানু যা আমাদের জন্য করছে! 

মা বললেন, ভাই হয়, করবে না? 

—না করলেও পারত। বাড়িঘর সব তো বলতে— 

—তোমার আবার বাড়াবাড়ি। 

আসলে বুঝতে পারছিলাম, বাবাকে মানুকাকা খুব বড় খবর দিয়েছেন। বাবা এজন্য মানুকাকার ওপর খুবই প্রসন্ন। বাবা প্রসন্ন হলে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। আগের দুর্ব্যবহারের কথা মনে রাখতে পারেন না। মা’র সব মনে থাকে। কারণ দেশ থেকে এসে মানুকাকার বাড়িতে উঠলে কাকা যে খুব বিরক্ত বোধ করেছিলেন, সেটা চোখ বুজলে এখনও টের পাই। আমাদের ক্যাম্পে পাঠাবার জন্য তিনি অনেক হাঁটাহাঁটিও করেছেন। কিন্তু বাবার এক কথা। জাত খোয়াব মানু! ও তো হয় না। মা তখন তাঁর শেষ সম্বলটুকু মানুকাকার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, একটু জমি, আর কিছু চাই না। ক’দিনেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম, আমরা মানুকাকার সংসারে উচ্ছিষ্ট। অবশ্য বাবার স্বভাব কিছুই গায়ে না মাখা। সুতরাং এ-হেন বাবা আজ কি না জানি খবর নিয়ে এসেছেন। বিছানা থেকে লাফিয়ে নামতেই শুনলাম, বাবার বেশ ক্ষুণ্ণ গলা—ধনবৌ, মানুষের খারাপটা মনে রাখতে নেই। ভালটা মনে রাখলে কষ্ট পাবে কম। মানুষ এতে বেশি সুখী হয়, ঈশ্বর প্রসন্ন থাকেন। 

বাবা তারপর খাটো গলায় বললেন, বিলুটা ঘুমিয়ে পড়েছে? 

মা বললেন, বোধ হয়। 

ভেতর থেকে বললাম, না বাবা, ঘুমাই নি। 

এবং সঙ্গে সঙ্গে পিলুর গলা, আমিও ঘুমাই নি বাবা। 

মায়া বলল, আমার খুব ভয় লাগছিল তুমি আসছ না, চিন্তা হয় না? 

মায়া আজকাল পাকা পাকা কথা বলে। আসলে সবাই জেগে আছে। বাবা আমার কি ভাগ্যফল লিখে আনছেন জানার জন্য কেউ ঘুমোতে পারছে না। 

অনেকক্ষণ হয়ে গেল, বাবা আর মানুকাকার কথায় যাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে বললাম, মানুকাকা কি বলেছে? 

—বলেছে। অনেক কথা বলেছে। তোমার তা শুনে দরকার নেই। তোমার একটা কাজও ঠিক করে ফেলেছে। 

—কাজ! 

—হে, যে সে কাজ নয়, বড় কাজ। মানু বলল, কলেজে পড়লে ত, কেরানীগিরি করতে হয়, মাথা ঠিক থাকে না। তোমার পাসটাও খুব ভাল না বলল। বললাম কত, দেখ মানু, আমাকে পাস নিয়ে বোঝাস না। সব বিষয়ে পাস কে করে রে? তুই করেছিস? করলে তোকে কেরানীগিরি করতে হত? 

আমি জানি, আসলে বাবা এসব কিছুই বলেন নি। তবে মনে মনে হয়তো বলেছেন! মনে মনে বলাটাকেও তিনি ভাবেন বলাই হল। আমার সব কেমন গোলমাল ঠেকছে। বললাম, কি কাজ? 

—খুব বড় কাজ। এ কাজ করে মানুর বন্ধু শহরে তিনটে বাড়ি করেছে, গাড়ি করেছে। বাসরুট করেছে। জলঙ্গী ডোমকল বাস যায়, সব ওদের। কত বড় কথা! 

মা বললেন, কাজটা কি বলবে তো। 

—মোটর মেকানিকের কাজ। এই যে গাড়ি দেখছ, বেগড়বাই করলে তোমার পুত্র কান মলে দিতে পারবে। তোমার পুত্র কত দূরে যেতে পারবে জান। একটু-আধটু কালি-ঝুলি মাখতে হবে, তা বড় কাজে মাখতেই হয়। সাধু-সন্ন্যাসীরা ছাইভস্ম মাখেন, সে কি খুব খারাপ কাজ? 

বাবা জলচৌকিতে বসে অনর্গল কথা বলছেন—কোথায় কবে মানুকাকার বন্ধু এমন একটা কাজেই প্রথম হাত দিয়েছিল। গাড়ি চালাতে শিখল। দূর দূর জায়গায় চলে যেত। যখন খুশি তুমিও যেতে পারবে, ইচ্ছে হলে একটু পদ্মাপাড়ে ঘুরে আসবে, সে তোমাকে গাড়ি চড়িয়ে নিয়ে যাবে। মাকে বাবা খুশি রাখবার জন্য বললেন, এখন তুমি যা বলবে তাই হবে। 

–বিলু তো বলছিল কলেজে পড়বে। 

—কলেজ! না না ধনবৌ, তোমাদের সবারই দেখছি মতিভ্রম হয়েছে। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই। একটা আস্ত গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কি কম বড় কথা। গাড়িতে কত মানুষ, কত কাজ, অফিস কাছারি সব সে টাইম মতো করাবে। ওর মর্জির ওপর সব। 

আমার রা সরছিল না। বুঝতে পারছিলাম, মানুকাকা আমার যে কাজটি ঠিক করেছে, তা তার বন্ধুর গ্যারেজে। প্রথমে হেপ্পার নাম দিয়ে সব রকমের কাজ চালিয়ে নেওয়া। মানুকাকা আমাদের দুরবস্থার কথা ভেবে, তাড়াতাড়ি কাজে লাগিয়ে দিতে চান। যা বিদ্যে হয়েছে, ওতেই ও কাজ চলে যাবে। আমরা গাঁয়ের মানুষ, দেশের বাড়িতে ঠাকুরদার টোল ছিল, সেই সুবাদে বাবার মন্ত্রপাঠ, পুজা- আর্চা নিখুঁত। প্রথমে এ দেশে এসে বাবা ভেবেছিলেন, তাঁর হাতের সম্বলটুকুই যথেষ্ট। গ্রাসাচ্ছাদনের পক্ষে খুব বেশি আর কিছুর দরকার নেই। কিন্তু তাঁর যে মন্ত্রপাঠের ঠিকুজী কুষ্ঠি ঠিক আছে, এই নিয়েই বড় সংশয় মানুষের। মানুকাকাই পূজা-পার্বণে শ্রাদ্ধে বাবার হয়ে পার্টি ঠিক করে দিতেন। ঠাকুর প্রতিষ্ঠার সময় কিছু লোকজনও বাবা খাইয়েছিলেন। তাঁর খেরো খাতায় দেশের মানুষজনের সব খবর লেখা আছে। তারা কোথায় কে থাকে, তিনি চোখ বুজে বলে দিতে পারেন। অভাবের তাড়নায় পূজা-পার্বণের নাম করে বের হলে আর বাড়ি ফিরতে চাইতেন না। সেই বাবার ছেলের এ-দেশে একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছে মানু, তাতেই আমার সুমহান পিতৃদেব গদ্‌গদ। 

আমি বললাম, বাবা! 

বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমার চোখে মুখে কি লেখা ছিল জানি না, বাবা কি পড়লেন জানি না—তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। মাথা নীচু করে বসে থাকলেন। আর ঠিক এ সময়েই বাবা আমার কত অসহায় উপলদ্ধি করলাম। কলেজে পড়ানো বাবার ক্ষমতার বাইরে। পিতার এই চোখ-মুখ আমাকে বড় পীড়া দিল। বাবাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললাম, গাড়ি চালিয়ে নেওয়া কত বড় কাজ না বাবা! 

বাবা খুব প্রফুল্ল হয়ে উঠলেন, তালে তুই বুঝেছিস। কথায় বলে না, বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে। ছোট কাজে কোন লজ্জা রাখতে নেই বিলু। সব কাজই মানুষ করে। আসল কথা স্বভাব। স্বভাব ঠিক থাকলে সব কাজ বড় কাজ 

আমাদের স্বভাব ঠিক আছে, এটাই বাবার এখন আপ্তবাক্য। তাঁর কথা পরের দ্রব্য না বলিয়া লইলে অপহরণ করা হয়। আমি এ বিষয়ে পিতার মতোই শুচিবাইগ্রস্থ। অবশ্য পিলুটা অন্য রকমের। তার এতটা শুচিবাই নেই। বাবা একবার স্টেশনে ফেলে রেখে আমাদের উধাও হয়েছিলেন। পিলু তখন সংসারে স্বাধীনতা সংগ্রামী। যত্র তত্র তার বিচরণ। সে যেখানে যা পেত, তুলে নিয়ে আসত। শসা চুরি করতে গিয়ে সে মারও খেয়েছে। অবশ্য অতটা দৈন্যদশা এখন আমদের আর নেই। মানুষের ঘরবাড়ি হয়ে গেলে যা হয়। আকাশ মাটি শস্যক্ষেত্র সব এখন পাপপুণ্যের কথা বলে। বাড়িঘর করার পর পাপপুণ্য বোধ সংসারে বাড়ে। বাবা বললেন, বুঝলে না, এ সব কাজে বিশ্বাসী মানুষদের দরকার। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কিন্তু বংশের মান রাখিস। মানুর মুখ রক্ষা করিস। 

পিলু বলল, দাদা, তুই এ কাজ করবি না। 

মায়া বলল, দাদা আমার কলেজে পড়বে না বাবা? 

মা খুবই নিরুপায় চোখেমুখে তাকাচ্ছিলেন। লণ্ঠনের আলোটা দপদপ করে জ্বলছে। শরতের গাছপালা বাতাসে দুলছিল। অন্ধকার অরণ্যে একটি ছোট্ট ঘরের বারান্দায় আমরা চার জন মুখোমুখি বসে। কেউ আর কোন কথা বলছিলাম না। আমার কেমন কান্না পাচ্ছিল। কারণ কোন দূরবর্তী নক্ষত্রে কে যেন ডাকে। বড় হই, গাছপালা মাঠের সঙ্গে সেও আমার পাশাপাশি হাঁটে। গোপনে কত কথা বলি। কখনও সুদূরের মাঠ পার হই হাত ধরে। কখনও শস্যক্ষেত্র মাড়িয়ে যাই দুজনে। কেউ পৃথিবীর এই গোপন খবর টের পায় না। রাতে ঘুম হয় না। ছটফট করি। মাথার ঘিলু পোকায় কাটে। এবং সেদিনটি এসে যায়। বাবা আমাকে মানুকাকার দোকানে বুঝিয়ে দিয়ে আসেন। মানুকাকা একটা স্যাঁতসেঁতে পুরনো ভাঙা চালাঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, গোবিন্দ, ওকে দেখে-টেখে রাখিস। লোহালক্কড়ে ভর্তি ভাঙা গাড়ি, মানুষের ভিড়ভাড়াক্কা দিনের বেলায়। নাট-বোল্ট খোলা, রেঞ্চ আর হাতুড়ি সম্বল, সকালে একখানা পাঁউরুটি দুপুরে ডাল ভাত, রাতে তড়কা আর রুটি। খিস্তি-খেউড় আর দাবানলের মতো অনন্ত জ্বালা। বিকেলে দেখি লালদীঘির পাড় ধরে ছেলেরা যায় মেয়েরা যায়। কী সুন্দর নীল রঙের পোশাক শরীরে। মনে হয়, ওরা কোন স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা। আমার বুঝি সেখানে আর কোনকালে যাওয়া হবে না। গাড়ির ফুটবোর্ডের নীচে মাথা, ভিতরে গাড়ির কলকব্জা, তার নীচে জীবনের সব বিষয়ে পাস বাবার নিরীহ এক কৃতী ছেলে। 

সবই সহ্য হচ্ছিল। কেবল খিস্তি-খেউড় বাদে। গোবিন্দ-পঞ্চানন আমার মনিব। তার মনিব গোলক দাস। বাসে ঘন্টি বাজায়। বাস মালিক কিংবা কাকার সেই বন্ধুটির সাক্ষাৎ আর পাই না। পেলে একটা আর্জি ছিল। কারণ সহনীয় নয়, এমন কিছু কাজ গোবিন্দ আমাকে দিয়ে করাতে চায়। আইন অমান্য করি বলে তার সহ্য হয় না। না পেরে ছুতোয়-নাতায় কিল ঘুষি। ভাবি পালাই, কিন্তু বাবার বংশের মুখ রক্ষা না হয় ভেবে পড়ে থাকি। কিন্তু জীবন মানবে কেন, সে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ থেকেই আমার প্রথম নিরুদ্দেশ যাত্রা। 

সেটা কৃষ্ণপক্ষের রাত-টাত ছিল। শহরের রাস্তায় আলো ছিল না। আমাকে স্টেশনে যেতে হলে মাঠ ভাঙতে হবে। সাহেবদের কবরখানা পার হয়ে যেতে হবে। ভূতের ভয় বড় প্রবল। অনেকটা পথ ঘুরে, ফলে স্টেশনে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল। ভেতরে প্রচন্ড অভিমান সবার উপর। বাবা, মা, মানুকাকা সবাই যেন সংসারে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। সব তছনছ করে দিয়ে পালাচ্ছি। রেলগুমটি দেখা যাচ্ছে। সিগনালের নীল বাতি। গাড়ি আসছে। গাড়িতে উঠে পড়লেই মনে হল, আমার নতুন জীবন শুরু। সম্বল বলতে এখন আমি একজন উদ্বাস্তু বাবার সন্তান। তবে সাত খুন মাপ। গাড়িতে টিকিট লাগে না। চেকার হলে শুধু বাবার পুরনো স্বভাবটা ঝালিয়ে নেওয়া। আমাদের বেড়ালছানার মত নিয়ে যখন তিনি ট্রেনে এখানে সেখানে আশ্রয় খুঁজছিলেন, তখন বাবার স্বাভাবিক বুদ্ধি আমাদের কত অপমান থেকে যে রক্ষা করেছে। বাবা দিলখোলা মানুষ। আমি একেবারে বিপরীত। মুখচোরা স্বভাবের বলে ঠিক কথার পৃষ্ঠে ভাল কথাও যোগাতে পারি না। 

ট্রেন ছেড়ে দিতেই হু-হু করে কান্না উঠে এল বুক থেকে। আমি আমার প্রিয় গাছপালা, হেমন্তের কুকুর পিলু মায়াকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কবে ফিরব জানি না। ফিরলেও মানুষ হয়ে ফেরা দরকার। বাবার যেন বংশের মান রক্ষা হয়। এমন কিছু করব কি করে, তাও জানি না। কেন জানি সব সময় মনে হয়, আমার দুরবস্থা দেখে কেউ আমায় ঠিক আশ্রয় দেবে। আর কিছু না পাই, বাবার আকৃতি পেয়েছি। বাবা আমার বড় সুপুরুষ মানুষ। দীর্ঘদেহী, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ এবং বড় পুষ্ট গোঁফ আর মজবুত শরীরের খানিকটা আমার মধ্যে ইতিমধ্যে এসে গেছে। চোখ বড় বড়। যে চোখ দেখলে মানুষের মায়া হবার কথা। 

রাতের ট্রেন ছুটছে। রাতের ট্রেন বলে যাত্রী কম। শুয়ে বসে থাকা যায়। এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছি। অপরিচিত মানুষজনের মধ্যে আছি, কেউ একবার জিজ্ঞেসও করছে না খোকা কোথায় যাবে? এ সময় কেউ দুটো কথা বললেও যেন সাহস পেতাম। সব যাত্রীদের দিকেই চোখ বুলিয়ে নিলাম। আমার সমবয়সী মেয়েটি মাত্র দুবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, গায়ে আমার কোন ভদ্রলোকের বাচ্চার ছাপ নেই। হাফ প্যান্ট, কালিঝুলি মাখা, মুখটা কেমন দেখাচ্ছে তাও জানি না। পা খালি। এই সম্বল করে আমি আপাতত কলকাতা যাচ্ছি। শুনেছি শহরটাতে মাটি নেই। যেখানে মাটি নেই, সেখানে মানুষের পাপপুণ্য বোধও কম। কলকাতার নামে বাবা সব সময়ই ক্ষেপে থাকতেন। সেই শহরে আমি গেছি জানলেই বাবা ভারি মনোকষ্টে ভুগবেন। কিন্তু যাঁর সঙ্গে আমার আপাতত দেখা হওয়া দরকার, তাঁকে পেতে হলে শহরটা না মাড়িয়ে যাবার উপায় নেই। তিনি দিল্লীতে থাকেন। মানুষের জন্য তাঁর ভারি কষ্ট। কাগজে পড়েছি, তিনি যে কোন মানুষকে ইচ্ছে করলে অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা দিতে পারেন। আমার এতটা দরকার নেই, একটু আশ্রয় আর খাদ্য আর নীল মলাটের বই। সঙ্গে ভদ্রগোছের কাজ। বাবার জন্য মাসে মাসে কিছু টাকা, ফেরার সময় পিলু-মায়ার জন্য জামাপ্যান্ট। ছুটিছাটায় বাড়ি ফিরব যখন, মার জন্য জামদানি একখানা শাড়ি। 

গ্যারেজে তাঁর ছবি কাগজে দেখেছি, আর মনে মনে কথা বলেছি। তাঁর কোটে লাল গোলাপ ফুল। শিশুদের তিনি গলা জড়িয়ে ধরে আদর করছেন। এই দেশবাড়ির কাকা জ্যাঠার মতো—তিনি আমায়ও বুকে জড়িয়ে যেন কথা বলছেন, বিলু তোমার খুব কষ্ট। বলব, হ্যাঁ, এই দেখুন না, গোবিন্দ আমাকে শুধু শুধু মারে। আমার খুব পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয়। আমি কি ইচ্ছে করে অঙ্কে ফেল করেছিলাম? বাবা বলতেন, বাড়িঘর না হলে মানুষের পড়াশোনারও দরকার হয় না। যাও বাড়িঘর হল, বই নেই। পরীক্ষার আগে একটা কাটাছেঁড়া অঙ্কের বই—ও পড়ে কেউ পাস করতে পারে? ১৬-র উপপাদ্যটা পর্যন্ত উপড়ে নিয়েছে। আঃ, যদি ওটা থাকত, ফেল করতাম না অঙ্কে। কিন্তু আমার বাবা যখন জানলেন, দশটা বিষয়ের মধ্যে ন’টা বিষয়ে পাস করেছি, তখন কি খুশি। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে বললেন, বিলু, জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাস করেছে রে? মন খারাপ করছিস কেন? দেশের যে অত বড় মানুষ আপনি, আপনার নাকি ন’টা বিষয়ে পাস। বাবার কাছে সব বিষয়ে আপনি পাস করতে পারেন নি কেন? দেশ ভাগে আপনার মদত না থাকলে বাবা বোধ হয় আপনাকে সব বিষয়েই পাস মার্ক দিয়ে দিতেন। আমি কিন্তু বাবার কাছে জীবনে সব বিষয়ে পাস করা ছেলে। আমার কিছু একটা হিল্লে করে দিতেই হবে। 

এসব কথাগুলিই ঘুরে-ফিরে আমার মাথায় আসছে। মাঝে মাঝে দরজায় শব্দ হলেই তাকাচ্ছি। চোর-বাটপাড়ের মতো বসে থাকা। চেকারবাবু কোন দরজা দিয়ে ঢুকবে কে জানে? মাঝে মাঝে জানলায় উঁকি মেরে দেখছি। গোটা দুই-চার স্টেশন পার হয়ে গেলে বড় একটা স্টেশনে গাড়ি এল। এখানে এত বিলম্ব কেন বুঝতে পারছিলাম না। তবে কি দেশের সব পুলিস আর চেকারবাবুরা দেখে ফেলেছে, ট্রেনে একজন বিনা টিকিটের যাত্রী আছে? বুকটা গুরগুর করছে। উপরে বাঙ্ক। পা ঝুলিয়ে বেশ নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে কেউ। টিকিট কেটে যেদিন আমি ট্রেনে চড়ব, ঠিক এভাবে একটা ঘুম। অনেক আকাঙক্ষার মধ্যে আরও একটা আকাঙ্ক্ষা জীবন আমার এ মুহূর্তে পকেটে পুরে ফেলল। ট্রেনে যেতে যেতে কত সুন্দর সব গাছপালা শস্যক্ষেত্র শহর গঞ্জ চোখে পড়ে—কিছুই তারিয়ে তারিয়ে দেখতে পারছি না। সাত খুন মাপ ঠিক, কিন্তু আমি যে উদ্বাস্তু তার প্রমাণ? কথা বলি বাঙাল ভাষায়, ওটা একটা বড় রকমের সার্টিফিকেট-আর যদি নাই শোনে, বলে দেব বাবার আমি জীবনে সব বিষয়ে পাস করা কৃতী ছেলে—কাজের খোঁজে বের হয়েছি। আমার মা-বাবা বড় গরিব। আমি কলেজে পড়ব, ভাইবোনেদের কত আশা। যখন বড় হব, আমার টাকা হবে, মান যশ হবে, কড়া ক্রান্তি মিটিয়ে দেব। 

মনে মনে নানা ভাবে সাহস সঞ্চয় করে যাচ্ছি। আর সারাক্ষণ নেংটি ইঁদুরের মতো এ দরজায় ও দরজায় পালাচ্ছি। কখনও উঁকি মারছি, কখনও রড ধরে এ কামরা ও কামরা করছি। যতক্ষণ সম্মানের সঙ্গে ট্রেনযাত্রা শেষ করা যায়। ও মা, কখন আমি এ সব করতে করতে বাঙ্কের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিই না। সকালবেলায় ঝাড়ুদার এসে পা টানতেই জেগে গেলাম। ও বাবা, মরা মানুষ নাকি! 

খুব কাঁচুমাচু মুখে তাকালাম। কথা বললাম না। টেনে বের করে দিয়েছিল কতকটা আর কিছুটা বের করে দিলে কামরার বাইরে। সেটা দয়া করে করে নি। করলে রক্ষা পাওয়া যেত। ট্রেনে যে এসেছি, তার কোন চিহ্ন থাকত না। ফলে কামরাটা পার হতে হল নিজেকে। আর নেমেই দেখি, কি পরিচ্ছন্ন আকাশ, শরতের মিষ্টি রোদ। রেলের অজস্র লাইন বাড়িঘর পেছনে ফেলে কত দূরদূরান্তে ছুটেছে। আর তখনই দেখলাম পায়ের কাছে একটা ডাইরি কার পড়ে আছে। কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস নিতে নেই। বাবার শিক্ষা। কিন্তু আমার ইতিমধ্যে নানাভাবে নিয়মভঙ্গ হয়েছে। কাজেই ডাইরিটা পকেটে পুরে ফেললাম। কেউ না আবার দেখে ফেলে। একা মানুষ, সব কিছুই এখন জীবনে বড় দরকারী বস্তু হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে বিস্ময়, কত গাড়ি, কত ইঞ্জিন, এটা যে কোন স্টেশন নয়, বুঝতে অসুবিধা হল না। শান্টিং করছে গাড়ি। ঝমঝম শব্দ। খুব সন্তর্পণে লাইনগুলি পার হয়ে ছোট্ট একটা নিমের ছায়ায় বসা গেল। এবং মনে হল ডাইরিতে সব লিখে রাখা দরকার। কারণ সব আবার ভুলে না যাই। বিশেষ করে ধার-দেনা যার কাছে যা জমছে। প্রথমেই লিখলাম গোবিন্দ-বিশ টাকা। পরে লিখলাম, রেলগাড়ি—তিন টাকা দশ আনা। গোবিন্দের কৌটায় রাখা কুড়িটা টাকা না বলে নিয়ে এসেছি। একটা চিরকুটে লিখে এসেছি, গোবিন্দদা, তুমি আমাকে মার কেন? আমি তোমার কুড়ি টাকা নিলাম। যখন বড় হব, মান যশ হবে, তখন টাকা ফেরত দেব। বাবার নামে চিরকুট — বাবা, আমি আপনার কাছে ন’ বিষয়ে পাস করা লোকটার সঙ্গে দেখা করব বলে বের হয়ে পড়েছি। আমার জন্য ভাববেন না। আর যাই মানাক, আপনার সব বিষয়ে পাস করা ছেলেটির কিন্তু গ্যারেজে লাথি- ঝাঁটা খাওয়া মানায় না। গোবিন্দদা আমাকে অনর্থক মারধোর করতো। আমরা গরিব বলেই ও এতটা সাহস পায়। 

তা হলে মোটামুটি ধার-দেনার হিসাব লেখা হয়ে গেল। এখন কিছু খাওয়া দরকার। দিল্লীর গাড়িটা কোথা থেকে ছাড়ে খোঁজখবর নিতে হবে। 

একটা লোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সামনে কিছুটা হেঁটে গেলেই শিয়ালদা স্টেশন। স্টেশনেই গাড়ি ছিল। শেষ মাল খালাস করার জন্য আবার বুঝি নিয়ে এসেছিল এখানটায়। সেটা খালাস পেয়ে যাওয়ায় গাড়ি হালকা হয়ে গেছে। চলেও গেছে। এখন খালাস মালের বিড়ম্বনা। সে কি করে? 

খালাস মালটি আসলে খুবই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কি সব বড় বড় বাড়ি, যেদিকে চোখ যায় গিজগিজ করছে টিনের চাল, অজস্র রাস্তা। দালান কোঠার মেলা বসে গেছে। খালাস মালটির পেটে খিদের উদ্রেক হয়েছে। চোখে-মুখে জল দিয়ে কিছু খাওয়া দরকার। 

খালাস মালের খিদেটা একটু বেশি। যাকে বলে খিদে সম্পর্কে নাড়ি তার টনটনে। কিন্তু এখানে সবই গোলকধাঁধা। লোহার রেলিং দু’ধারে। সুতরাং কাউকে অনুসরণ করা ভাল। শেষ পর্যন্ত যেখানটায় আসা গেল, ওটার নাম তার জানা নেই। পিছনের দিকে তাকাতেই বুঝল জায়গামতই এসে গেছে। বড় বড় হরফে লেখা স্টেশনের নাম। চা-বিস্কুটের দোকান। ডিম ভাজা, মাছ ভাজা, মানুষজন, মলমূত্র গাদাগাদি। ভারি দুর্গন্ধ। স্টেশন চত্বরে শুয়ে বসে কালিমাখা সব মুখ। হোগলা চাটাই পাতা, মুড়ি চিড়া ভাত যে যা পারছে খাচ্ছে। 

বুঝতে কষ্ট হল না, এরাও আমার মত খালাস মাল। বুকে সাহস এসে গেল। এক আনার চিনাবাদাম কিনে খাচ্ছি, আর ভাবছি, গাড়িটার খবর কে দেবে? কাকে বলি, দিল্লীর গাড়ি ক’টায় ছাড়ে? বেশি কথাও বলা যায় না, যদি ধরে ফেলে পালাচ্ছে। পুলিস তো না পারে, হেন কাজ নেই। পালাচ্ছে যখন, নির্ঘাত চুরি-চামারি করেছে। তা করেছে, কিন্তু গোবিন্দদার কাছে সে তো চিঠিতে জানিয়ে এসেছে, অর্থ ফেরত যোগ্য। তাছাড়া যদি পুলিস ধরেও ফেলে, ডাইরি খুলে দেখাবে, এই দেখুন কে কি পাবে, সব লিখে রেখেছি। টাকা মান যশ হলে সব ফেরত। টাকা মান যশ হলে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠব। একটা লম্বা ঘুম দেব। কেউ বিরক্ত করলে ধমক দেব। ওঃ, কি মজা! ট্রেনটা যাচ্ছে আর যাচ্ছে। 

তখনই খ্যাঁক করে উঠল একটা মুখ, এই উল্লুককা বাচ্চে। আমাকে ঠেলা দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। গাড়ি চাপা পড়ি নি, ভাগ্য। এত দিকে নজর রাখি কী করে? কলকাতা শহর—বাবা ঠিকই বলেছেন, এখানে মানুষ থাকে! এখনই বাবার কৃতী ছেলেটা যেত। আসলে বুঝতে পারছিলাম, এই শহরে আসতে হলে আগে থেকে ট্রেনিং দরকার। কিছুতেই রাস্তা পার হতে পারছিলাম না। এত গাড়ি যে কোথায় থাকে! তারপর চোখ বুজে লম্বা দৌড়। যা হয় হবে। তারপর চোখ খুলে দেখি না সত্যি পার হয়ে এসেছি। যাক্। আর পায় কে? ফিসফিস করে রাস্তাটাকে বললাম, এই বাচ্চে, আটকে রাখতে পারলি? সামনে দেখলাম লেখা, এনকোয়ারি। এই তো সেই জায়গা। ভিড় ঠেলে মুখ বার করে বললাম, দিল্লীর গাড়ি ক’টায় ছাড়বে? লোকটা কি ভাবল, কে জানে? হঠাৎ তেড়ে এল, এই ধর ধর। ধর তো ওটাকে। চ্যাংড়ামো করার জায়গা পায় না। ধরতে বললেই কি আর ধরা যায়? নিজের ভাবনা- চিন্তা না করে দৌড়। একটু আড়ালে এসে দাড়াতেই হুঁশ হল, আমি কি অন্যায় বলেছি, লোকটা আমাকে ধরতে বলল? সামান্য ঘাড় তেড়া করে এগিয়ে গেলাম—আমার কি দোষ? আমায় এত অবজ্ঞা করছেন কেন? দিল্লীর গাড়িতে আমি উঠতে পারি না? শেষে মনে হল, যাক গে, বয়স্ক মানুষ! যা ভিড়, মাথা খারাপ হতেই পারে। আর আমার তো এক জামা প্যান্ট সম্বল। পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই। যার এমন হতশ্রী অবস্থা তার বোধ হয় দিল্লীর গাড়িতে ওঠার নিয়ম নেই। মানুষজন পঙ্গপালের মত উড়ছে। কাকে বলা যায়? আমারই বয়সী একটা ছেলে লজেন্স বিক্রি করছে। সমবয়সী ভেবে টান ধরে গেল। আপাতত ত্রাণকর্তা ভেবে বললাম, এই যে শুনছ। 

—লজেন্স? কটা দেব? 

—না। দিল্লীর গাড়ি ক’টায় ছাড়ে? 

—এটা তো এখানে ছাড়ে না। হাওড়া যেতে হবে। 

—কোন্ দিকে? 

—সামনের মোড়ে বাস পাবে। 

সামনেটা কোথায়? কারণ যেদিকে তাকাই, মানুষের মিছিল। যাচ্ছে আসছে। গাড়ির মিছিল। যাচ্ছে আসছে। এত সব পার হয়ে সেই সামনেটাকে খোঁজা কত যে দুরূহ এবং মনে হল চড়চাপড় খেয়ে জায়গার মাল জায়গাতেই পড়ে থাকা ভাল ছিল। কি যে দুর্মতি হল। বেলা বাড়ছে। পেটে কামড় বসাচ্ছে। সামান্য ভাত মাছ, আমার একান্ত প্রিয় খাদ্য। সুস্বাদু খাবার বলতে এই বুঝি। নিচে নেমে ট্রাম লাইনও পাওয়া গেল। আর কোথা থেকে আসছে ইলিশ মাছ ভাজার ঘ্রাণ। সব গুবলেট করে দিল। দিল্লীর ট্রেন, হাওড়া, টাকা মান যশ, সব মাথা থেকে ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু এক টুকরো ইলিশ মাছ ভাজা—আপাতত মাছ ভাজা ভাত হলে মন্দ হয় না। সূর্য মাথার উপর কখন উঠে গেছে— এত কি ভাবনা গেল মাথার মধ্যে দিয়ে যে বেলা যায় টের করতে পারি না। ও মা, এই সেই বেরন হোটেল। গোবিন্দদা বলেছিল, কলকাতায় গেলে বেরন হোটেলে খাস। তখন কলকাতার স্বপ্ন বড় শহরে গেলেই নাকি মানুষের হিল্লে হয়ে যায়। এখন আর কিছু খোঁজাখুঁজি না। চটপট ঢুকে বললাম, ভাত দিন। 

কাউন্টারের লোকটা তাকাল। আমি যে ভাত মাছ খেতে পারি, আমার যে রেস্ত আছে, লোকটার বোধ হয় বিশ্বাস হল না। তাকিয়ে হঠাৎ বলল, যা ভাগ! বেটা কোথাকার ভিখারী- 

খুব রাগ হয়ে গেল। আচ্ছা দেখা যাবে। টাকা মান যশ হোক। দেখা যাবে। তবে এখন কোন গন্ডগোল করা ঠিক হবে না। সময়টা আমার ভাল যাচ্ছে না। বললাম, টাকা দেব। এই দেখুন আমার কাছে টাকা আছে। বলে টাকা বের করে দেখাতেই লোকটার মায়া পড়ে গেল। 

বলল, বস। কি খাবি? 

—ভাত খাব। মাছ খাব। ওদিকের টেবিলে একটা লোক মাছের মুড়ো তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে। লোভে পড়ে বলে ফেললাম, মাছের মুড়ো খাব। 

সামনের বেসিনে হাত ধোওয়া গেল। মুখে চুরি করে সামান্য সাবান মেখে ফেললাম। আড়চোখে দেখছি, কারণ হাতমুখ ধোবার এমন সুযোগ আর কখন পাব জানি না। মুখটা ধুতেই বাবার মুখশ্রী ভেসে উঠল। আমায় এখন দেখলে লোকটা নিশ্চয়ই আর ভিখিরীর বাচ্চা ভাববে না। জামার আস্তিনে মুখ মুছে যখন খেতে বসলাম, তখন আমার প্রায় জ্ঞানগম্যি লোপ পেল। ঝোল, ভাত, ভাজা, মুগের ডাল, মাছের মুড়ো সব চেয়ে খেতে লাগলাম। চারপাশের টেবিলের লোকগুলি হাঁ করে দেখছে, তাও খেয়াল নেই। ওরা তো জানে না, কাল দুপুর থেকে পেটে কোন দানা পড়ে নি। খিদে পেলে মানুষ বোধ হয় কিছুটা আহাম্মক হয়ে যায়। খাবার শেষে বিল দেখে টের পাওয়া গেল, পুরো দু’ টাকা পাঁচ আনা বিল। এত টাকা একসঙ্গে খেয়ে মনটা ভারি দমে গেল। হিসাব করে বুঝলাম রেস্ত বলতে এখন সম্বল সতের টাকা এগার আনা। এটা যে কত বড় সম্বল, এই বড় আগাপাশতলাবিহীন শহরে না এলে বোঝা যেত না। কারণ শহরটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না। সব বড় বড় রাস্তা, এত বড় রাস্তা আমার বাপের জন্মে কে কবে দেখেছে? এক সঙ্গে দু’তিনটে গাড়ি রাস্তা ধরে যায় আসে। বড় বড় ট্রাম গাড়িগুলি গলে যায়। আর ভেপোঁ বাজে, ক্রিং ক্রিং শব্দ। যেন পাগলা ঘন্টি— হুঁশিয়ার! সামনে পড়লেই ভোগে লেগে যাবে। 

আর যাই হোক, ভোগে লাগছি না। কারো হাত ধরে রাস্তা পার হওয়া যায় না? হাত না হোক, জামার আস্তিন। তাও যখন সাহসে কুলাল না, লোকের পিছু পিছু যাওয়াই ভাল। একজন মুটের পেছনে যেতে গিয়ে রাস্তা পার হবার জ্ঞানগম্যি মিলে গেল। একার ভয় অনেক। অনেকের পেছনে থাকলে গাড়িও ভয় পাবে। মোড়ে শরবতের দোকান। কাপড়ের দোকান। মিষ্টির দোকান। পান সিগারেটের দোকান। মানুষের শুধু অগুনতি মাথা। এত লোক কলকাতায় থাকে? এতটুকু নির্জন জায়গা নেই যে এমন সুস্বাদু খাবার খেয়ে টেনে ঘুম দেওয়া যেতে পারে! তার পরই মনে হল, পকেটে টাকাটা থাকতে থাকতে দিল্লীর গাড়ি ধরা দরকার। কোনদিকে গেলে হাওড়া স্টেশন পাওয়া যাবে? শহরের উত্তরে না দক্ষিণে? মুশকিল শহরের উত্তর দক্ষিণও টের পাচ্ছি না। সূর্য আকাশছোঁয়া সব বাড়ির ‘পেছনে লুকিয়ে আছে। 

মানুষের সঙ্গে কথা বলা কী যে নিদারুণ বিপত্তিকর, রাস্তায় ট্রেনে সর্বত্র টের পাচ্ছি। সবার যেন টাকার থলে হারিয়ে গেছে। হন্যে হয়ে খুঁজছে। কেউ দু’দণ্ড দাঁড়াচ্ছে না। দাঁড়ালেই অন্য কেউ থলেটা বুঝি গস্ত করবে! মনে অবশ্য অনেক প্রশ্নটশ্ন কখন থেকে থিকথিক করছে। হাওড়া কোন্ দিকে? হাওড়ার বাস কোথায় পাওয়া যায়? কখন ছাড়ে? এতগুলি প্রশ্ন শুনে যদি বিরক্ত হয়। পালিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, সদাশয় মানুষের বড় অভাব পৃথিবীতে। সবারই টাকার থলে হারিয়ে গেলে যা হয়। শরবতওয়ালাকে বললে কেমন হয়? সে তো নিশ্চিন্তে শুধু ঢালাঢালি করছে। আর লাল নীল রঙের বাহারী শরবত এগিয়ে দিচ্ছে। টুক করে মুখ বাড়িয়ে বললাম, হাওড়ার বাস কটায় ছাড়ে? কে বলছে, লোকটির যেন লক্ষ্য করার কথা না। কী বলছে, তার জবাব দেওয়াই সারকথা। গ্লাসে ঢালাঢালি করতে গেলেও গভীর মনোযোগের যে দরকার হয়, অর্থাৎ সারা মাস কাল বছর যুগ যুগ ধরে অনন্ত এই ঢালাঢালি করতে করতেই জীবন যায়, এমন মনে হবার সময় শুনলাম—ঐ তো যায়। 

ঐ তো যায় কাকে বলা। তাই তো, বাসটা আমারই সামনে দিয়ে চলে গেল। এটা হাওড়ার বাস! কী যে দুর্গতি এখন! মনে মনে বললাম, শরবতওয়ালা, বাস আবার কখন আসবে? জোরে বলতে পারছি না। যদি মনোযোগ ভঙ্গের দরুন খ্যাক করে ওঠে। আসলে এদেশে আসার পরই বাবার পায়ের তলাকার মাটি সরে যায়। ক্রমে আমরা বাবার সঙ্গে কেমন যেন ভীরু স্বভাবের হয়ে যাই। কেবল পিলুটা অন্য রকমের। ও সঙ্গে থাকলে কখন হাওড়া পৌঁছে যেতে পারতাম। 

পিলুর জন্য, বাড়ির জন্য আবার মনে টান ধরে গেল। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি। সকালের মধ্যেই বাড়িতে খবর পৌঁছে যাবার কথা। মা হয়ত হাউ হাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। বাবার স্বভাব অন্য রকমের। তিনি শুধু একটা কথাই বলবেন, ভবিতব্য। পিলুটা গুম মেরে থাকবে। তার দাদাটা হারিয়ে গেছে। বনে-জঙ্গলে তার ঘোরাঘুরিটা হয়ত একটু বেড়ে যাবে। মায়ার যা স্বভাব- সে রোজই আশা করবে, মাঠ পার হয়ে দাদা ফিরে আসছে। ফাঁক পেলেই সে বড় রাস্তায় চলে যাবে। 

হাওড়ার বাসের জন্য খুব আর একটা ভাবছি না। আবার ক’টায় হাওড়ার বাস আসবে জিজ্ঞেস করলেই হয়ে যাবে। এখন হাতে কিছুটা সময় যখন আছে, এদিক ওদিক দেখে এলে হয়। এই যেমন চিড়িয়াখানা, জাদুঘর—এই কলকাতাতেই এগুলি আছে। বেশি দূরে যেতে হবে না। তারপরই মনে হল, ফিরে এসে যদি বাস ফেল করি, এই সব ভয়ে জায়গা থেকে কেন জানি নড়তে সাহস হল না। 

শরবতওয়ালার নজর আছে বলতে হবে। আমি যে দাঁড়িয়ে আছি—কেন দাঁড়িয়ে আছি, রাস্তায় ‘কেউ কলকাতায় দাঁড়িয়ে থাকে না, দাঁড়িয়ে থাকলে কিছু একটা অপকর্মের ধান্ধা আছে—তার কাঁচা পয়সা কেড়ে নিতে কতক্ষণ? সে বেশ সতর্ক গলায় বলল, এই সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সরে দাঁড়া। 

কথা যখন বলেছে, সাহস আমারও কম না। কিছুটা সরে গিয়ে বললাম, হাওড়ার বাস আবার ক’টায় আসবে? 

লোকটা হয়ত আমাকে ত্যাঁদড় ভাবল। আমি যে সদ্য কাঁচামাল, এই কলকাতায়, সে বিশ্বাস করল না। আপদটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নেই, এটাই তার বোধহয় এখন বড় ভরসা। সে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিতেই কলকাতার শেষ চেনা লোকটা আমার আবার কেমন অচেনা হয়ে গেল। 

আবার সামনে একের পর এক বাস চলে যাচ্ছে। বাপস্! বাসের কপালেও যে লেখা আছে কী সব? এতক্ষণ এটা খেয়ালই করি নি। সারাক্ষণ মানুষজন, বাস-ট্রাম আর গাড়িঘোড়া কেবল দেখে যাচ্ছি। স্টেশনের ও পাশটায় সারি সারি ঘোড়ার গাড়ি, একটা ভাড়া করলে সে নিশ্চয়ই হাওড়ায় পৌঁছে দিত। কিন্তু কত দূর কে জানে? হাওড়ার ব্রীজ জানা আছে, তাই বলে রাস্তাটা কত লম্বা, কি করে জানব? শহরে এসে কত কিছু ইচ্ছে হচ্ছে। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ, ইডেন গার্ডেন—সব নাম শুনেছি, অথচ বাবার সেই ন’ বিষয়ে পাস করা লোকটার সঙ্গে আমার বড় জরুরী কাজ। কখন কোথায় আবার চলে যায়? এবারে স্বাদ আহ্লাদ না মিটুক, পরের বারে হবে। টাকা মান যশ হলে সবাইকে কলকাতা দেখিয়ে নিয়ে যাব। সবাইকে নিয়ে ট্রামে চড়ব। পিলু প্রথম ভড়কে গিয়ে এত ভাল ছেলে হয়ে যাবে যে রাস্তাই পার হতে পারবে না। আমার তখন হাসি পাবে।

বাবা, রানাঘাটের বড় পাবদা মাছ খাবার গল্প করলে, পিলুর বড় বাসনা হয়েছিল রানাঘাট দেখার। সেটা কত দূর, সে বাবাকে বার বার প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিল। পিলু জানেই না তার দাদা রানাঘাট পার হয়ে আরও কত দূর চলে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে বাসের কপালে নাম পড়ে যাচ্ছে—এই নামগুলিই গন্তব্যস্থল বাসের, এই অনুমান নির্ভরের উপর ভরসা করে শেষ পর্যন্ত হাওড়াগামী বাসে ওঠা গেল। কিন্তু সংশয় প্রবল। কোথাকার মাল কোথায় নিয়ে আবার খালাস করে দেবে কে জানে? বললাম, বাস হাওড়া যাবে? লোকটা ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে বলল, যাবে। ভিতরে ঢুকে মনে হল, স্টেশনের কথা বলা হয় নি। আবার মুখ বাড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে প্রশ্ন, হাওড়া স্টেশন যাবে? 

—যাবে। 

সে তো যাবে। স্টেশনটা আমি চিনব কী করে? ন’ বিষয়ে পাস করা লোকটার সঙ্গে দেখা করার এত ফ্যাসাদ আগে জানলে, মাথা গরম করতে সাহস পেতাম না। এমন একটা ব্যস্ত শহরে একই লোককে পর পর দুটো প্রশ্ন করেছি এবং জবাব পেয়েছি—ভাবাই যায় না। গাদাগাদি বাসে দাঁড়িয়ে। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ঘণ্টা বাজিয়ে লোকটা কি সব হাঁকছে। এই হাঁকগুলি কিসের সংকেত? কারণ পিলুটা যা, সে তো হাঁ করে দাদার অভিযানের প্রতিটি পথ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনবে। কি ভাবে হাওড়া পৌঁছলাম, তাকে কোন বর্ণনাই দিতে পারব না। আসলে মনে হচ্ছিল, টানেলের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। মানুষজন চারপাশে এত ঘন হয়ে দাঁড়ালে পৃথিবীটা গোলকধাঁধা হওয়া স্বাভাবিক। একবার অতি কৌতূহলে মাথা গুঁজে দেখার চেষ্টা করলে কনুইয়ে গুঁতো মেরে জায়গারটা জায়গায় ফিরিয়ে দিল। কোনরকমে টাল সামলে কনুইওয়ালাকে বললাম, দাদা, হাওড়া স্টেশন এলে বলবেন। 

লোকটা এবারে খুব ভালমানুষ হয়ে গেল। বলল, বাসটা স্টেশনেই যাবে। 

কিছুটা স্বস্তি। লোকটার কনুই সোজা হয়ে আছে, ওটা আরও স্বস্তি। নাকে লেগেছে। টনটন করছে। একবার হাত বুলিয়ে দেখলাম, হাতে রক্ত-টক্ত লাগে কিনা? না, এখন পর্যন্ত হাত-পা-মুখ সবই অক্ষত রাখতে পেরেছি। বাবা-মার আর্শী বাদেই সব। বাবা-মার আশীর্বাদে স্টেশনেও ঠিক পৌঁছে যাব। কিন্তু লোকটা ভুলে যায় নি তো? আমার কথা মনে রাখার তার কোন দায় নাও থাকতে পারে। এত ভিড় ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতির মধ্যে বাবার নাম ভুলে গেলেও দুঃখ করার নেই। সুতরাং ফের প্রশ্ন— স্টেশন আর কত দূর? 

লোকটা বলল, অনেক দূর। বাসটা যাচ্ছে না, সেই থেকে হর্ন বাজাচ্ছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল, এত কি রাস্তায় পড়ে আছে যে, বাসটাকে এগুতে দিচ্ছে না? এটা কেমন আজব শহর, যেখানে গাড়িঘোড়া চলে গোযানের মত। বাবার কথাই ঠিক, শহরটায় মাটি নেই, মাটি না থাকলে মানুষের ধর্ম থাকে না। শান পাথর শুধু, গরমে ভ্যাপসা হয়ে যায়। শহর তো নয়, যেন অতিকায় এক উত্তপ্ত তাওয়া। মানুষজন ঘরবাড়ি তার উপর ভাজাভুজি হচ্ছে। 

এখন আমি বাসে নিরালম্ব মানুষ। কোন ভয় নেই। ভেসে আছি মতো। আঠার মধ্যে লেপটে আছি, উড়ে যাবার ভয় নেই। তারপরই বাসটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে কোথাও উঠে গেল। মৃদুমন্দ হাওয়া আসছে। পাশের লোকটা তখনও আমার কথা মনে রাখতে পেরেছে। আমার তৃতীয় বার প্রশ্ন করার সাহস কম। সে নিজ থেকেই যখন বলল, এসে গেছি, তখন তার কাছে আমার ঋণের শেষ থাকল না। 

.

বাস খালি করে সব নেমে গেল। সামনে অতিকায় লাল রঙের বাড়ি। পিঁপড়ের সারি যেন মানুষজনের . মিছিল। এর মধ্যে আমার পা গুটিগুটি চলছে। বড় বড় সাইনবোর্ড, খেজুর, আপেল, আঙুরের দোকান, বইয়ের দোকান। মানুষজন দৌড়াচ্ছে কেন? কোথাও আগুন লাগে নি তো? ভিতরে ঢুকে রহস্যটা ধরা গেল। গাড়িগুলি উগরে দিচ্ছে মানুষজন। আবার উদর ভর্তি করে চলে যাচ্ছে। কি সব এলাহি কাণ্ডকারখানা! একটা বড় ঘড়ি, কত সব ফাঁক ফোঁকরে মেমসাবের মুখ। আর অজস্র ভিখারী। সবাইকে একটা করে পয়সা যদি দিই, তালেও কুলাবে না। মানুষের আর্ত চিৎকার শুনলে নিজের মধ্যে কেউ যেন আমার কথা বলে ওঠে, বিলু, তুমি পথ হারিয়ে ফেলেছ। এদের মধ্যে মিশে গেলে, তোমার মা-বাবা আর তোমাকে চিনতে পারবে না। 

সহসা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কেউ যেন আমায় ডাকছে। সে কে, বুঝতে পারছি না। চারপাশে গভীর অন্ধকার। কোন আলো জ্বলছে না। কোথায় আমি আছি, ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না। ঘুমের জড়তায় মাথাটা বড় নির্বোধ। ভ্যাবলার মতো বসে থাকা ছাড়া যেন আর কোন উপায় নেই। জড়বুদ্ধি, স্থির চোখ, ভেতরে চাপা অসহায়তা। মাথার উপরে আকাশ, নক্ষত্র, গাছপালা আরও দূরে কোন জংশন স্টেশন কিংবা কোন লোকালয়ে আছি বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাথার মধ্যে একটা রেলগাড়ি সহসা ঝমঝম করে চলে গেল। মনে পড়ে গেল, ট্রেনে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলাম— এই পর্যন্ত। না, তারপর মনে কিছু আসছে না। 

অন্ধকারে টের পেলাম, কেমন আবছা মতো একটা মানুষ যেন এগিয়ে এসে আমাকে দেখছে। আবছা ছায়ামূর্তিটাকে জায়গা করে দেবার জন্য সরে বসলাম। এটা একটা বাড়ির গেট, বসার রোয়াক দু’পাশে। একটা ধাপের সিঁড়িতে এতক্ষণ এক পলাতক শুয়েছিল তবে। নীচে কাঁচা নর্দমা—গুনগুন করছে মশার পঙ্গপাল। আবছা মূর্তিটা এবারে টর্চ জ্বেলে আমার কি দেখল কে জানে? জায়গা বেদখল দেখে লোকটা রাগ করতে পারে। কেউ রাগ করলে আমার বড় খারাপ লাগে। অন্ধকারে সরে পড়াই শ্রেয়—হাঁটা দিলাম। মাথাটা ঘুরছে। তিন-চার দিন অনাহারে থাকলে মাথার কি দোষ! যতটা পারা যায় ঠিক থাকার চেষ্টা করছি। 

—এই কোথায় যাচ্ছ? 

তাহলে এই লোকটাই আমাকে ডাকছিল। আমাকে ঘুমের নেশায় পেয়ে গেছে। কাল থেকে, যেখানে পারছি শুয়ে পড়ছি। পৃথিবীতে আমার ঘরবাড়ি আছে, মা-বোন আছে, পিলু আছে, কিছুই মনে আসছিল না। আমার পলাতক জীবনে কেউ আজ পর্যন্ত এমন প্রশ্ন করে নি। আমি কোথায় যাচ্ছি, এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা ছিল না। থমকে দাঁড়ালাম। অনেকদিন পর কেউ আমায় ডাকল। 

লোকটা নেমে এল। কাছে এসে দাঁড়াল। কেমন টলছে। আপাদমস্তক টর্চ মেরে কি দেখে বলল, রাগ দ্যাখ ছোকরার। আমি খুব খারাপ মানুষ! তুমিও। মশারা যে ষড়যন্ত্র করছে, টের পাও নি। যা ঝাঁক বেঁধে বসেছিল, উড়িয়ে নিত। আমার সামনে হাপিস করে দেবে-না, সে হবে না। হতে দেব না। তার পরই লোকটা ওক দিল। মাথার ওপরে হাত তুলে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো মুখের ওপর দুলতে থাকল। 

লোকটা টেনে টেনে কথা বলছিল। সব কথা স্পষ্ট নয়। জড়তা রয়েছে কথায়। লোকটা মাতাল টের পেলাম। কেমন ভয় ধরে গেল। দৌড়ে পালাব ভাবছি। কিন্তু হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না। খেতে না পেলে যা হয়। মাথা ঠিক থাকে না। হলে কি হবে, জ্ঞানের নাড়ি টনটনে। মর্যাদার বড় দন্ত মনে। 

সে বলল, রোয়াকে শুয়ে ছিলে কেন? বাড়িঘর নেই? আমার আছে। চিনতে পারছি না। ওক। আবার কথা, কিন্তু শেষ করতে পারল না। তার আগেই পড়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ধরে ফেললাম। পড়লে কাঁচা নর্দমায় ডুবে যাবে। মানুষের এত কষ্ট আমার সহ্য হয় না। বললাম, হাত ধরুন, দিয়ে আসি। 

–সেই ভাল। একটা হেঁচকি দিল। তারপর টর্চটা আমার হাতে দিয়ে বলল, খুঁজে দেখ জুঁই ফুলের গাছ।

—জুঁই ফুলের গাছ এত রাতে কোথায় খুঁজব? 

লোকটা আমাকে অবলম্বন করে হাঁটছে। টর্চ মেরে মানুষটির অবয়ব দেখার চেষ্টা করতেই, কেমন আর্ত চিৎকার—না না। আলো না। মানুষটিকে বড় সম্ভ্রান্ত মনে হল। পাজামা পাঞ্জাবী গায়। 

–কী — পেলে? 

–না। 

—দুটো পাম গাছ? 

—না। 

—তবে কোথায় নিয়ে এলে? 

—জানি না। 

—আলবত জানতে হবে। তোমার বাপকে জানতে হবে। 

—বাপ তুলে কথা বলবেন না। রাগ করব। 

লোকটা কেমন চুকচুক করে বলল, আমার মনু- 

তারপরই পাম গাছ, রোয়াক পার হতেই এটা টের পাওয়া গেল। একটা পেয়ারা গাছ, উঠোন, জুঁই ফুলের গাছ। রঙিন ফুলের ঝাড়। সুঘ্রাণ ফুলের। কি ফুলের এমন ঘ্রাণ হয়! সামনে সিঁড়ি। সিঁড়িতে উঠেই লোকটা কি হাতড়াতে থাকল এবং পেয়েও গেল যেন। ভিতরে সহসা আলো, লণ্ডভণ্ড এক ঘরের ছবি। 

লোকটা আমার হাতে চাবি দিয়ে সংকেত করল কিছুর। তারপর ধপাস করে সিঁড়িতে বসে পড়ল। দরজা লক করা, চাবি ঘুরিয়ে দিতেই দরজা খুলে গেল। বললাম, উঠুন। কোন সাড়া শব্দ নেই। উঠুন। 

লোকটা হুঁম শব্দ করল। 

—আপনার ঘরবাড়ি? 

ঘরবাড়ির কথা মনে পড়তেই লোকটা হামাগুড়ি দিতে থাকল। এবং ঘরে ঢুকে খাটের ওপরও উঠে গেল হামাগুড়ি দিয়ে। শুধু বলল, বড় সমুদ্র পার হওয়া যায় না? 

এমন প্রশ্নের কি জবাব হবে জানি না। এখানে সমুদ্রই বা কোথা থেকে এল? তবে খাটটা বড়ই প্রশস্ত। সাদা চাদর জ্যোৎস্নার মতো ফুটফুটে। বালিশ ঠিকঠাক করে দিলে পরিপাটি বিছানা। বিছানাতে উঠেই লোকটা লম্বা হয়ে গেল। মরার মতো পড়ে থাকল। 

এ আবার কোন্ ফ্যাসাদ। কথা বললে আর জবাব দেয় না। কেবল হুঁম করে ওঠে। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া দরকার। আর কি কেউ নেই। ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-পরিজন- মানুষটার ভূগোল জানতে ইচ্ছে করছে। তবে ক্ষুধার্ত মানুষের যা হয়। অবসাদ — অবসাদ ক্রমেই আমাকে আরও বেশি জড়বুদ্ধি করে তুলছে। খাটের একপাশে আমিও কেমন লম্বা হয়ে গেলাম। রাত অনেক। চোখ আমার আবার জড়িয়ে আসছে। 

সকালে ঘুম ভাঙলে দেখলাম, লোকটা নেই। দরজা ভেজানো। আর বসে থাকা ঠিক না। রাতের কাণ্ডজ্ঞান বর্জিত লোকটার ভূগোলে বুঝতে পারছিলাম বড় বেশি পাহাড় জঙ্গল। যে কোন সময় বাঘ লাফিয়ে পড়তে পারে। আর তখনই লোকটা হাজির। ব্যাগে কি সব ভর্তি করে নিয়ে এসেছে। কাঁধে ফ্লাস্ক। হাসি-খুশি মেজাজী মানুষ! কি, ঘুম হল? 

–কথা বলতে পারলাম না। 

—কাল খুব জ্বালিয়েছি। 

মুখে রা সরছে না। অজ্ঞাতকুলশীল এক লোককে এত বড় বান্ধব কি করে মানুষটা ভাবে? তারপরই হাসতে হাসতে বলল, তুমি একটা পাগল আছ। দেশ কোথায়? ঠিক আছে, এখন ওসব থাক। আগে চান করে এস। সামনে গুরুদুয়ারা আছে, কল আছে—এই নাও সাবান। ভাল করে চান করবে। ঘুরে ঘুরে গায়ে বোটকা গন্ধ লাগিয়েছ। 

বসে আছি। এতটুকু জোর পাচ্ছি না। চোখ জ্বলছে। সারা গায়ে এক অপার্থিব যন্ত্রণা। টাকা, মান, যশ—না, আর ভাবতে পারছি না। সব বড় সুদূরের হয়ে যাচ্ছে। কেবল লোকটা সদাশয় হয়ে ওঠায় কোথায় যেন মাথায় এক কী-লক গেঁথে দিল কেউ। তাতে পা রেখে ওপরে ওঠা যেতে পারে। মনের মধ্যে অদ্ভুত ঘোলা জল, বেনো জল, নদীর জল, জলপ্রপাতের জল ঢুকে যাচ্ছে। সব কেমন গুলিয়ে উঠছে। 

লোকটা ফের বলল, কী হল। বসে থাকলে কেন? যাও। আমার কত কাজ। সামনে গুরুদোয়ারা আছে। রাস্তা পার হলেই পাবে। এই সাবান। জামা-প্যান্ট কাচবে। 

তবু বসে থাকলাম। হাই উঠছে। 

সদাশয় মানুষটি লুঙ্গি দিল পরতে। ঢোলা ফতুয়া। হাতে তুলে দিয়ে বলল, শীগগির যাও। আমায় আবার বের হতে হবে। 

এত সকালে মানুষটি স্নান-টান করে ফিটফাট। কে বলবে, অনেক রাতে মানুষটা তার আবাসে – নেশা করে ফিরেছিল। আর যাই হোক, মানুষটিকে ভয় পাবার কিছু নেই। মানুষের আচরণ কত সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যায় কখনো। স্নান সেরে এসে দেখি, চারপিস পাউরুটি, ডিম ভাজা আর ডালমুট সাজিয়ে বসে আছে। আহার শব্দটি এদেশে আসার পরই একটু বেশি মনোরম। আহার শব্দটি মনে এলে মাথা আমার এমনিতেই ঠিক থাকে না। দেরি করলে কোন অদৃশ্য আত্মা কেড়েকুড়ে খাবে, ভয়ে প্রায় হামলে পড়লাম। নিমেষে শেষ করে ফেলতেই মানুষটি হাত মুছতে বলল, কত দিন হল? 

মুখে পাউরুটির শেষটুকু। কোঁত করে গিলে বোকার মতো তাকালাম। 

—কত দিন পর খাওয়া হল তোর? 

আমার চোখে জল এসে গেল। মাথা নীচু করে ফেললাম। মানুষটি বোধহয় চোখের জল দেখতে পারে না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে—মনু শোন, বের হচ্ছি। পায়ে জুতো গলিয়ে বলল, তোমার কি নাম? 

নাম বললে মানুষটা কেমন আঁতকে উঠে বলল, এই রে, তোর তো ভাই জাত গেল। ছিঃ ছিঃ আগে বলতে হয়- 

জাত বিষয়টা আমার বাবার পরম গৌরবের বিষয়। কুলীন ব্রাহ্মণ তিনি। তাঁর কাছে ঘরবাড়ি আশ্রয় সব যেতে পারে—কিন্তু জাত যেতে পারে না। সগৌরবে তাকে টিকিয়ে রাখতে হয়। জন্ম মৃত্যু সব অর্থহীন, জাত ঠিকঠাক না থাকলে। আমার স্বভাবটা অন্যরকমের। বাবার কাছে এজন্য মাঝে- সাজে কুলাঙ্গার। যে মানুষটি আমাকে খাদ্য এবং আশ্রয় দিয়েছে, তার সংস্পর্শে জাত যায় কি করে ভেবে পেলাম না। আমার বাবা তো জাত যাবে বলে দেশ ছেড়ে চলেই এলেন। 

মানুষটির পরনে দামী প্যান্ট শার্ট। শৌখিন। যা কিছু অগোছালো ছিল, সব গোছগাছ করে বের হচ্ছে। একটাই ঘর। পাশে পাঁচিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালে পাঁচিল সংলগ্ন সুন্দর ছিমছাম বাড়িটা দেখা যায়। সামনে বড় পাকা রাস্তা—কোথায় কত দূর চলে গেছে! স্নান সেরে আসার সময় কিছু শিউলি ফুল মাড়িয়ে এসেছি। তখনই মনে হয়েছিল একবার — দুর্গাপূজার সময়-শরৎকালে কাশ ফুল ফোটে শিউলি ফুল ফোটে। 

আমি কিছু না বলায় মানুষটিকে গম্ভীর দেখাল। তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছিল। আবার সামনে এসে দাঁড়াল। এখন দেখলে মনে হয় না আর কোন তাড়া আছে। রাস্তায় একটা গাড়ি হর্ন দিচ্ছিল। কি যেন ভাবছে। 

মানুষটি এবার কি ভেবে বলল, এ হারামের নাম সামসুর রহমান। 

আমি বললাম, এখানে কোন কাজটাজ পাওয়া যাবে না? 

—কি কাজ করবে? 

—এই যে কোন কাজ। 

দুজনই কিছুটা এবারে স্বাভাবিক হয়ে আসছি। 

—তোর বাবা-মা আছেন? 

—আছেন। 

—পড়াশোনা কতটুকু? 

—আমি চুপ। 

—তোর তো পড়াশোনার বয়স। কাজ করবি কি? 

—না, আমাকে একটা কাজ দিন। যে কোন কাজ। বলতে সাহস হল না, ন’ বিষয়ে পাস করা লোকটার সঙ্গে দেখা করার জন্য বের হয়েছিলাম। কত বড় আহাম্মক হলে এটা হয়, এখন বুঝতে পারছি। মনের মধ্যে একটা বিড়াল এতদিন বাঘের মতো হালুম ডাকছিল – ঘুরেফিরে মনে হয়েছে বেড়াল বেশি হলে ইঁদুর মেরে খেতে পারে। হরিণের মাংস সে পাবে কোত্থেকে! আসলে এই প্রথম আমার বোধোদয় ঘটল। মানুষই মানুষকে ভালবাসে। মানুষই মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে। আবার আশ্রয় দেয়, খাদ্য দেয়। মানুষ স্বার্থপর, কুটিল, হিংস্র, নিরাভরণ, যখন যা দরকার তার সবই ঘটে। 

—যে কোন কাজ তুই পারবি কেন? চোখ মুখ তো সে কথা বলে না। 

আমাকে আবার চুপ করে থাকতে দেখে মানুষটি বলল, ঠিক আছে। এখনকার মতো দশ আনা রেখে দাও। আমার ফিরতে রাত হবে। পাঁড়েজীর দোকানে দুপুরে খেয়ে নেবে। ভাত, মাছ, ডাল। ফ্লাস্কে চা আছে—ও আর খেতে হবে না। খেতে ইচ্ছে হলে দোকানে চলে যাবে। বলেই মুখ বার করে দোকানটা দেখিয়ে দিল। 

—চা তো খাই না। 

—চা খাও না! অসুখ আছে? 

—না। চা খাই না। আসলে আমাদের পরিবারের ভূগোলটাই ছিল আলাদা। বাবা চা, ধুমপান, মদ্যপান—একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণ মিলে দুই সমকোণ ধরে নিয়েছিলেন। চা না খাওয়াটাই ভাল মানুষের লক্ষণ। আমার পক্ষে বাড়তি বিপজ্জনক কিছু করা এ সময় আর ঠিক হবে না। ফের বললাম, সত্যি বিশ্বাস করুন, চা খাই না। 

মানুষটি এবার উঠে বের হয়ে গেল। যাবার সময় শুধু বলে গেল, পাড়েজী দশ আনা — দশ আনায় মিল দেবে পেট ভরে খাবে। 

দুটো খাঁজকাটা চৌ-আনি, একটা দো-আনি, মোট দশ আনি! দশ আনায় পেট ভরে ভাত। দশ আনা কত বড় ব্যাপার, এ সময় আমার চোখমুখ না দেখলে বোঝা যাবে না। বাইরে রোদ উঠেছে। তারে জামাপ্যান্ট মেলা দরকার। কালো রঙের চেক-কাটা লুঙ্গিটা সাইজে বড়। কালো রঙের ফতুয়াটা ঢোলা। বামুনের ছেলের পক্ষে বড় বেশি বেমানান। ওটা পরে বের হতে লজ্জা করছিল। কিন্তু আয়নায় যখন দেখলাম, বামুনের ছেলেকে লুঙ্গি পরে খারাপ দেখাচ্ছে না, তখন নিশ্চিন্তে বের হওয়া যাক। পয়সা ক’টা হাতছাড়া করছি না। সেই ট্রেনে চলে যাব, টিকিট কেটে যাব, লাটসাহেবের মত বাঙ্কে পড়ে ঘুমোব এবং চেকার এলে ইঁদুরছানা ভয়ে মরে করতে হবে না—আসলে পয়সা থাকলে কত না কাব্য হয়—আর কাব্য করতে গিয়ে কাল—টিকিট কেটে যাও বা ছিল, এটা ওটা খেয়ে শেষ। বামুন হলে যা হয়। অভাবী হলে যা হয়। পয়সা হাতে থাকলেই খাই খাই—সব খাই, কমলালেবু খাই, লজেন্স খাই, ঝালমুড়ি খাই—খেতে খেতে কখন ট্রেনে ভিড়ের চাপে উড়ন্ত চাকির মত প্ল্যাটফরমে ভেসে পড়েছিলাম মনে করতে পারছি না। পেট ভরে খেলে বোধহয় বাকিটা মনে পড়বে। পয়সা কটা মুঠো করা। বাইরে বের হতেই ছিমছাম বাড়িটা থেকে পাখির মতো এক বালিকা উড়ে এল সাইকেলে। একেবারে সামনে। 

তাড়াতাড়ি এবাউট টার্ন। আবার ভিতরে। খেতে পাব ভেবে লজ্জা-সরম যা এতদিন উবে গিয়েছিল তা আবার ফিরে এসেছে। এতদিন মনেই হয় নি কেউ আমায় দেখে। হাতে দশ আনা পয়সা আসতেই নিজের অস্তিত্ব ফের টের পাচ্ছি। পয়সার এত বড় মাহাত্ম্য। চুপি দিয়ে দেখছি মেয়েটা আবার ভিতরে কখন ঢুকে যায়। আর যাই করা যাক, একটা লুঙ্গি আর ফতুয়া গায়ে দিয়ে একজন কিশোরের পক্ষে কোন কিশোরীর সামনে যাওয়া যায় না। মেয়েটা টুক করে ভিতরে ঢুকে গেলে আমিও টুক করে তারে জামাপ্যান্ট ফেলে আবার ঘরে। একের পর এক ধাক্কা খেয়ে সকালবেলায়ও চারপাশটা ভাল করে দেখা হয় নি। ছিমছাম সাদা রঙের বাড়ি— বাংলো গোছের—এই পর্যন্ত। বাড়িটার লাগোয়া বেশ বড় একটি ফুল-ফলের বাগান, পুকুর আছে। ঘরের উত্তরের জানলাটা খুলতেই তা দেখা গেল। 

মেয়েটা ভেতরে কোথায় যায়, কোন্ রহস্যময় জগৎ থেকে বা ভেসে এল—দেখা দিয়ে আবার উধাও —পালিয়ে চুপি চুপি দেখছি। আশ্চর্য মায়াময় ছায়ায় ঘেরা এক পৃথিবী। সেখানে মেয়েটা গাছে সাইকেল হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে ডাকছে। সাইকেল পেলে আমিও অনেক দূর চলে যেতে পারি। আমি কেমন মুগ্ধ বিস্ময়ে ফ্রকপরা বালিকাটিকে দেখছিলাম। গাছের মতো ঋজু এক বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু বাদেই আমি পেট ভরে খেতে পাব। আয়নায় মুখ দেখা যাচ্ছে। লুঙ্গি পরে যাই কি করে? তারপরই দেখলাম, সাদা ফ্রকপরা মেয়েটা কোথায় অদৃশ্য! চিঠি দিলে পিলুকে লিখতে হবে, জানিস পিলু, সার্কাসের একটা মেয়ে এখানে থাকে। সাইকেল চালাতে জানে। স্বচক্ষে দেখেছি, বিশ্বাস না হয় তুই আসিস, তোকে দেখাব। 

মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে যেতেই কেমন জায়গাটা ফাঁকা এবং অর্থহীন হয়ে গেল। বসে থেকে লাভ নেই। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ পাড়েজীর দোকান খুঁজে বের করা। স্টেশন রোডে গেলে পাওয়া যাবে। সেটা কত দূর জানা নেই। যা দিনকাল, সব মানুষ রাক্ষুসে হয়ে আছে, আগে থেকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই ভাল। কিন্তু মুশকিল, লুঙ্গি আর ফতুয়া। মেয়েটিকে দেখার পর আমি মুশকিলাসান হয়ে গেছি। হাতে সেঁজবাতি আর গলায় পাথরের মালা ব্যস। ষোল আনা কাজ শেষ। কালো অন্ধকারে কিম্ভূতাকার সেই মানুষের মতো এখন লাগছে নিজেকে। তবে ক্ষুধার তাড়নার কাছে মান- সম্মান বালাই ষাট। লুঙ্গি তুলে খিঁচে এক দৌড় মারব। রাস্তায় পড়লে কে আর কার চেনা! যত অসুবিধা, আম গাছ, জুঁই গাছ, রঙ্গন ফুলের গাছের মাঝখানে। বাংলোবাড়িটা উঠোনে বের হলেই দেখা যায়। ব্যালকনিতে যদি সে দাঁড়িয়ে থাকে। গলা বাড়ালাম। নেই। চুপি চুপি বের হলাম। লুঙ্গি খিঁচে দৌড়। আ-হা-হা আবার সাইকেল। পাক খাচ্ছে। দৌড় দৌড়। সোজা ঘরে। দেখার আগেই দরজার আড়ালে। এ আবার কী বিড়ম্বনা শুরু হল। খেতে যেতে পর্যন্ত দেবে না। 

উঁকি দিলাম। সামনের উঠোনটা ফাঁকা। পেয়ারা গাছটা একা দাঁড়িয়ে। নীচে খাটিয়া পাতা, রাস্তায় মানুষজন, গাড়ি, রিকশা এবং প্রসন্ন রোদ। গুরুদোয়ারাতে ভজন হচ্ছে। লুঙ্গিটা তুলে নিলাম। লুঙ্গিটা তুলে না নিলে তাড়াতাড়ি ছোটা যাবে না। জড়িয়ে গিয়ে রাস্তাঘাটে চৌপাট হলে আবার দশ রকমের প্রশ্ন—কোন্ বাড়ির ছেলে—আহা লাগল না তো? ওঠো ওঠো, গাড়ি আসছে, এত সবের পর ভাত খেতে লেট হয়ে যেতে পারে। পেট পুরে খাওয়া ভাবা যায় না। এ কদিন বেশ ছিলাম, অনাহার সয়ে গেলে যা হয়। কেমন বোধগম্যিহীন এক কিশোর—রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। চোখে ঘোলা ঘোলা দেখা—পৃথিবীতে তখন অন্যরকমের মজা দেখা যায়। সকালে পেটে কিছু পড়তেই পুরনো রোগটার উদ্রেক হয়েছে। পেটে ক্ষুধার জ্বালা। মেয়েটা বুঝতে পারে না কেন এ-সময় সাইকেলে পাক খেলে ক্ষুধার্ত ছেলেটির পথ আগলে থাকা হয়। 

ফাঁকা দেখে বের হওয়া মাত্র সহসা পাঁচিল থেকে মুখ বাড়িয়ে ঘেউ করে উঠল একটা কুকুর। ঐই রে—আমাকে ধরার জন্য পাঁচিল খামচাচ্ছে। নতুন লোকের গন্ধ পেয়ে ক্ষেপে গেছে। বুঝতে পেরেছে কাছেই চোর-বাটপাড়ের আস্তানা। মনে মনে আওড়ালাম, সব লিখে রেখেছি। টাকা মান যশ হলে কড়া-ক্রান্তি মিটিয়ে দেব। তুমি একখানা বিলিতি কুকুর। তোমার মান-সম্মানই আলাদা। আমায় ছেড়ে দাও বাছা। 

মুশকিল হচ্ছে, এখনও ঘরে আছি। বিলাইতি পাঁচিল টপকালে দরজা বন্ধ করে দেব। বোঝাই যাচ্ছে, বাংলোবাড়ির শখের কুকুর। উঠোনে নেমে গেলে, বিলাইতি পাঁচিল টপকাতে না পারুক, সদর দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে। সুতরাং এ বেলার মতো আমার আর খাওয়া হল না বোধ হয়। রহমানদা না ফিরলে কিছু হচ্ছে না। 

ঘরে পায়চারি করছি। একটা টেবিলক্লক দেয়াল-আলমারিতে। টিকটিক করছে। দশটা, দশটা এক মিনিট, দু’ মিনিট— মিনিটের কাঁটাও এত লম্বা হয়। ভারি অস্বস্তি বোধ করছি। আমােেক নিয়ে তোমরা মজা পেয়ে গেছ! দেখাচ্ছি—দরজা খুলে তাড়াতাড়ি ফের চাবি দিয়ে সোজা চোখ বুজে দৌড়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। রোয়াক পর্যন্ত দৌড়ে এসেই টের পেলাম, পেছনে আমার লুঙ্গি কে খিঁচে ধরেছে। পালাতে হলে লুঙ্গি খুলে পালাতে হয়। এমন অব্যবস্থার ভেতর আমি জীবনেও পড়ি নি। পেছনে চোখ খুলতেই অবাক। বিলাইতি আমার লুঙ্গিটা চামড়া ছেঁড়ার মতো টেনে পালাতে চাইছে। বিকট কুকুরের এই অসম্ভ্রান্ত আচরণে মর্মাহত তরুণ ফের চোখ বুজে ফেলল ভয়ে। বাবার ঈশ্বর কত করুণাঘন, টের পেল সে। আর তখনই সাইকেলওয়ালী কোথা থেকে উদয়। খিলখিল করে হাসছে। মা-মা, দেখ টাইগারের কাণ্ড। 

দোতলায় ব্যালকনি থেকে কারো গম্ভীর গলা, এ কি অসভ্যতা হচ্ছে টাইগার। রুমকি, তুমিই বা কেমন, দাঁড়িয়ে হা-হা করে হাসছ। লোকটা কে রে? 

বলতে পারতাম মা জননী, আমি রিফুজি। বাবার সুপুত্র, জীবনের সব বিষয়ে পাস কৃতী ছেলে। কিন্তু যা অবস্থা, গলা শুকিয়ে কাঠ। দু’হাতে লুঙ্গি চেপে ধরে আছি কোমরে। কথা বের হচ্ছে না। আসলে তোতলাচ্ছি ভয়ে। 

—এই, ছেড়ে দে—ছেড়ে দে বলছি। বুঝতে পারছিলাম, আমার মত হতভাগার লুঙ্গি কামড়ে ধরায় বিলাইতির ইজ্জত গেছে। সাইকেলওয়ালী ধমকাচ্ছে কুকুরটাকে। 

—কে রে লোকটা? ব্যালকনি থেকে ফের হাঁক। 

—এই, ছাড়, কে জানি না তো! ছাড় বলছি। টাইগার, ভাল হবে না। 

—কোন রকমে বললাম, রহমানদা দশ আনা পয়সা দিয়েছে। সত্যি বলছি, চুরি করি নি। হাতের মুঠোয় পয়সা ক’টা খুলে দেখালাম। 

—রহমান কে হয়? 

চোখ বুজেই বলছি, কে হয়—কুকুরটাকে বলুন না ছেড়ে দিতে। খুব ভাল কুকুর। ভাবি ভদ্র। কে হয় মনে করতে পারছি না। 

—ছেড়ে দেবে? তুমি এখানে কেন? সময় হলেই দেবে। 

—কুকুরটা কি দামী না। কত ভাল। আপনার কুকুর বুঝি। কুকুরের শিক্ষাদীক্ষা আছে। 

রুমকির শাসনের গলা, জানালা খুলে বাগানে কি দেখছিলে? কুকুরের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। 

অপরাধ টের পেয়ে গেছে। স্বীকারোক্তি চায়—আর খুলব না। 

—রহমান তোমার কে হয়? 

–দাদা হয়। 

—কেমন দাদা? 

—কেমন দাদা। তাই তো—কেমন দাদা হয় জিজ্ঞেস করা হয় নি। বললাম, অরে কন ছাইড়া দিতে। বুঝতে পারছিলাম, সম্বিত হারাবার আগের অবস্থা। না হলে আমার মাতৃভাষা মুখ থেকে খসে যাবে কেন! 

—মা, ছেলেটা বাঙ্গাল। মিছে কথা বলছে। 

সত্যি কই, বিশ্বাস করেন, আমি বাঙ্গাল না। রহমানদা আমার সত্যিকারের দাদা হয়। আর তখনই মনে হল, গেল, সব গেল। করছি কি। নিজের মাতৃভাষাটিকে কিছুতেই সামলাতে পারছি না। হড় হড় করে যে বমি ওঠার মতো উঠে আসছে। যা এখানে আসার পর চেপেচুপে রেখেছি, বিলাইতির ডরে ফাঁস। আসলে মাথা ঠিক নেই। ববকাটা সুন্দর মতো মেয়েটা যে এত প্রশ্ন করতে জানে, ভাবতেই পারি নি। দাদা বলেছি, বিশ্বাস হয় নি। চাচা বলব। আমার কাছে এখন দাদা চাচা সমান। ছাড়া পেতে চাইছি। 

—বাঙ্গাল তো এখানে কেন? 

সেই তো। বাঙ্গাল, বাঙ্গালদের দেশে থাকবে। এখানে কেন? হক কথা। 

—যেখানে সেখানে বাঙ্গাল দেখা যাচ্ছে। দেশটার যে কী হবে। 

তাই মা দেশটার বড়ই অধোগতি। আপাতত ছেড়ে দিতে বলুন। এত সব ভেবেই যাচ্ছি। কিন্তু বলতে পারছি না কিছু। একবার ফস করে মুখ থেকে মাতৃভাষা বের হয়ে যাওয়ায় বড়ই করুণ অবস্থা। যাও সহৃদয়তা পাওয়া যাবে ভেবেছিলাম, বাঙ্গাল বলে সেটাও গেল বুঝি! 

রুমকি এবার কুকুরটার বকলস ধরে ফেলল। এক হাতে সাইকেল, আর এক হাতে বিলাইতি। হুকুম হল, যাও। জানালা খুলবে না। জানালা খুললে মা রাগ করে। 

ছাড়া পেয়ে ছুটতে ইচ্ছে হল। ছুটতে গিয়ে মনে হল কাপুরুষতার লক্ষণ। রুমকি হা-হা করে আবার হাসবে। রুমকি হাসলে আমার খারাপ লাগবে। বেশ একজন সবল মানুষের মতো হাঁটার চেষ্টা করছি। ফতুয়া ঝেড়ে লুঙ্গি ঝেড়ে এই ধুলোবালি লাগার মতো আর কি, কিন্তু ঝাড়তে গিয়েই টের পেলাম, লুঙ্গির পেছনটা খাবলাখানেক বিলাইতি হজম করে দিয়েছে। একজন মানুষের পেছনে খাবলাখানেক নেই ভাবা যায় না। হাঁটছি আর ভাবছি, কি করা যায়—ঘুরিয়ে লুঙ্গিটা সামনে নিয়ে এসেও খাবলাখানেককে হজম করা গেল না। কেবল হাঁটুর উপর লুঙ্গিটা কোঁচার মতো ধরে রাখলে কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু হাঁটুর উপর বেশি তুলতে গেলে কি হবে কে জানে? অনভ্যাসের ফোটা কপালে চড়চড় করে। ফলে খুবই সন্তর্পণে অঙ্গ ঢাকাঢাকি চলছে। অনেকটা দূরে চলে এসেছি। পাম গাছগুলি দেখা যায়। স্টেশন রোড বিজ্ঞাপনের গায়ে লেখা। পাঁড়েজীর দোকান একেবারে সামনে। মাছ ভাজার গন্ধ। নিমেষে সব দুঃখ হাওয়া। খাওয়া বাদে মানুষের আর কোন অস্তিত্ব আছে, এ মুহূর্তে বিশ্বাস করতে ভাল লাগল না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিস্ময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি—তার নাম খাওয়া। চোখ বড় বড় হয়ে গেল। 

খড়ের ছাউনির নীচে পাকা মেঝে। একপাশে ভুঁড়িয়ালা একজন মানুষ ক্যাশবাক্স আগলে বসে আছে। উপরে টিনের পাতে লেখা, ‘রামভরসা হোটেল’। নীচে স্বাক্ষর পাড়েজীর। এবং এক কোণায় ঝুড়ির মধ্যে ভাজা মাছ—হাঁড়িতে ডাল সেদ্ধ হচ্ছে। খদ্দের এখনও লাগে নি। আমি বোধ হয় প্রথম খদ্দের। ঢুকতেই বলল, হোয়া নেহি। 

কি হয় নি, বোঝা গেল না। আমাকে চিনতে পেরেছে যেন। রোজকার খদ্দের যেমনটা হয় আর কি। দাঁড়িয়ে আছি দেখে কিছুটা অস্বস্তি। তালপাতার পাখায় হাওয়া খাচ্ছে। মাছি ভনভন করে উড়ছে। কারণ পাশেই কাঁচা নর্দমা। মাঝে মাঝে ভাজাভুজির গন্ধ বেমালুম হাপিস করে দিচ্ছে পচা নর্দমার দুর্গন্ধ। তবে ক্ষুধার্তের নাকু কান চোখ বোধহয় বেশি খোলা থাকে। অনেক দূর থেকেই টের পাচ্ছিলাম সেদ্ধ ভাতের ঘ্রাণ। এখন বুঝতে পারছি, আসলে ছলনা। সব কিছুর মতো নিজের বিবেককেও ছলনা করছে। সব সময় খাব বলে বুঁদ হয়ে থাকলে বিবেকেরই বা আর দোষ কি। পাড়েজী তখন বলল, ঘুমকে আও। রহমান সাব বোলে গেছে। 

যে সাব রাতে এত কাণ্ডজ্ঞানশূন্য থাকে, সকালে তার চারপাশে এত সতর্ক নজর! যাবার আগে বলে গেছে। কোথায় যায়, কী করে মানুষটা! মানুষটা সম্পর্কে কেমন ধন্দের মধ্যে পড়ে আছি। ঘুমকে আও যখন বলেছে, তখন পেয়ারা গাছটার কথা মনে পড়ল। নিচে খাটিয়া পাতা। সেখানে ফিরে লম্বা হয়ে থাকতে পারি। তাছাড়া ঘুমকে আও কতটা সময়ের মধ্যে— পাঁড়েজী আবার বলল, ঘুমকে আও। ভাত ডাল মাছ সব্জি-দেখলাম বাবার মতো লোকটার কাছেও একটা লম্বা লাল মলাটের খেরো খাতা আছে। তাতে কিছু লেখা। এই খেরো খাতাটা না থাকলে বুঝি জীবন সম্পূর্ণ হয় না। 

লোকটা এবার বিরক্ত হয়ে বলল, বুলছি না ঘুমকে আও। আর দেরি করা গেল না। মানুষ আমাকে দেখলে বিরক্ত হয় কেন? পাছে রাগ করে, বের হয়ে পড়লাম। বলতে সাহস হল না, কখন? কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার ফিরে আসতেই পাঁড়েজীর পাখার হাওয়া খুব বেড়ে গেল। হাঁটু নাচাচ্ছে। এখনও তবে ঘুমকে আও। রোদ মাথার উপর—খটিয়া বেশ মন্দ না, কিন্তু যেই না ব্যালকনিটা মাঠ থেকে চোখে ভেসে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে এবাউট টার্ন। ওখানে জানালা খুললে কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয়। 

পালাবার সময় মনে হয়েছিল, পৃথিবীর সবাই আত্মীয়। শুধু মা-বাবাই আমার সঙ্গে শত্রুতা করে গেল। এখন বুঝতে পারছি, পৃথিবীতে আত্মীয়ের বড় আকাল। সবাই স্টেশনে তল্পিতল্পা নিয়ে বসে আছে। গাড়ি এলেই উঠে যাবে। আমার মতো মানুষ সামনে ঘোরাফেরা করলে কখন কি না জানি খোয়া যায়। যেভাবে বাসে ট্রেনে সর্বত্র লেখা, পকেটমার হইতে সাবধান—মানুষের আর দোষ কি। শুধু বাড়ি ফিরে গেলেই আবার বাবার সুপুত্র হয়ে যেতে পারি—কিন্তু চিরকুটে যে লেখা আছে, আমি ফিরছি না। মানুষ না হয়ে ফিরছি না। সাত-আট দিন পর ফিরে গেলে মনুষ্যত্বের অবমাননা। হেরে যাবার লজ্জা! পিলু পর্যন্ত বলবে, তুই না দাদা, একটা কি! বাড়িঘর ছেড়ে কেউ পালায়। মা- বাবার মতো নিজের মানুষ আর কে আছে রে? 

সবই বুঝি রে পিলু। জাঁতাকলে পড়ে গেলে বুঝতিস। রহমানদাকে বলেছি, একটা কাজের কথা এটা একটা জংশন স্টেশন। সব ঘুরে দেখা হয় নি। ফাঁকা ফাঁকা ঘরবাড়ি। দূরে পাহাড় দেখা যায়। তুই এলে একদিন আমরা পাহাড়টায় ঘুরে আসব। 

আবার পাঁড়েজীর দোকান। পা দুটোও বলি, ঘুরে-ফিরে আর কোনদিকে যেতে জানে না। যেন গণ্ডি এঁকে দিয়ে গেছে কেউ। এবারে নিজেই বললাম, হোক না। দাঁড়িয়ে আছি। হলেই বসে পড়ব। কেউ কেউ খাচ্ছে। আমায় দিচ্ছে না কেন! অবশ্য প্রশ্নকর্তার আর বেশি কথার হক নেই। কারণ পাঁড়েজী বড়ই সদয় এবার—সবজি হোয়ারে? 

—থোড়া বাকি হ্যায়। 

–থোড়া বাকি হ্যায় তো কিয়া হ্যায়? হামকো বৈঠনে দিজিয়ে না। আসলে মেহমান আমি, সবজি না দিলে আপ্যায়নে ত্রুটি থেকে যাবে। 

—না বেটা, রহমান সাব বহুত গোঁসা করবে। বহুত মেজাজী আদমী আছে। তিন কিসিম নেই দেনে সে হুজ্জোতি করবে। 

তাহলে রহমানদাকে পাঁড়েজী ভয় পায়। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছিল! অহংকারী হয়ে গেলাম। বেশ গম্ভীর গলায় বললাম, পাত লাগাইয়ে, ভাত-ডাল পয়লা দিজিয়ে তো। বলে আর অপেক্ষা করা গেল না। একটা চাটাই পেতে সোজা নিজের গরজেই পদ্মাসন। 

পাঁড়েজীর লোক শালপাতা দিল। সেটার গন্ধ শুঁকে নিচে বিছিয়ে রাখলাম। খুরিতে জল। জল ছিটিয়ে যতটা পারা যায় সাফসোফ করে ভাতের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। আসছে। আমার পাশের লোকটি ওম ব্রহ্মানেভ্য নমঃ করে গণ্ডয় করছে। ভাত মাখছে ডাল দিয়ে। রসনা বড় বেশি সিক্ত। তাড়াতাড়ি জল খেলাম। এভাবে ক্ষুধার দুর্বলতাকে কিছুটা পরিহার করা। আসলে আমার তর সইছিল না। শালপাতায় ভাত পড়লে ডাল দেবার ফুরসত দিলাম না। শেষ। লোকটা ডালের হাতা নিয়ে সামনে থ। নিজেকে সামলে নিলাম। ক্ষুধায় এতটা বুঁদ হয়ে থাকা ঠিক না। স্বাভাবিক মানুষের আচরণ ভুলে যাচ্ছি। এবারে ডাল দিলে, একটু চেটে দেখলাম। ভাত আসছে। ভাতের সঙ্গে ডাল, তারপর গোগ্রাসে হাত চালাচালি – শেষ। হঠাৎ খটাস শব্দ। পাড়েজীর পাখা হাত থেকে পড়ে গেছে। আমি বোকার মতো বললাম, না এই খাচ্ছি, খাওয়া তো। অনেক দিন পর খাওয়া তো, আর বলা হল না। রহমানদার সম্মানে লাগতে পারে। বললাম, বেশ রান্না। সবজি এসে গেল। ভাত নেই। পাঁড়েজী কি রাগ করছে! এক বেলায় আর কতটা রাগ বাড়তে পারে। সুসময় তো মানুষের সব সময় আসে না। যখন এসেছে, তার সদ্ব্যবহার করাই ভাল। বাবা বলেছেন, হাতের পাঁচ ছাড়তে নেই। যখন সুযোগ এসে গেছে, তাকে অবহেলা করা ঠিক না। ভাতের অপেক্ষায় সোজা হয়ে বসলাম। 

পাঁড়েজী এবং ঠাকুরের মধ্যে ইশারায় কিছু কথা হল। চোখ তুলতেই সেটা লক্ষ্য করলাম। ভাত দিতে এত দেরি হয় কেন! দুটো না হয় বেশিই খাচ্ছি। খেতে দিয়ে বসিয়ে রাখলে নিন্দা হবে। হোটেলের বদনাম হবে। বললাম, ঠাকুর, ভাত। ভাত মাছ এল। মেখে মনে হল, ভাত আর একটু লাগবে। হাতায় ঠাকুরের ভাত উঠতে চাইছে না। আবার ভাত চাইলাম। পাঁড়েজীর হাঁটু নড়া বেড়ে যাচ্ছে। আমার কী দোষ, রহমানদা বলে দিয়েছে, পেট ভরে খেতে। পেট না ভরলে আমি কী করব। আমি তো আর শত্রুতা করে বেশি খাচ্ছি না। কারো অনিষ্ট হয়, এটা আমি কখনও চাইও না। খেতে বসে কম খেয়ে উঠি কী করে? 

ভাত মাখতে গিয়ে মনে হল, একটু ঝোল হলে বেশ হয়। ঠাকুর, তোমার ঝোল একটু বেশি হবে? 

পাঁড়েজী বলল, ঝোল মাংতারে? 

ঠাকুর আমার কথা শুনতে পায় নি। দোষ নেই। এক হাতে সব খদ্দের সামলাচ্ছে। আমার দিকে নজর দেবার ফুরসত কম হতেই পারে। আপাতত খেয়ে নেয়া যাক। ঝোল দিলে ফের ভাত চেয়ে নেব। না দিয়ে পারবে না। ঝোল আছে, ভাত নেই, খদ্দের বলতে কথা। কী হল! শেষ, তবু ঠাকুর তাকাচ্ছে না। কড়াইয়ে খুন্তি চালাচ্ছে তার তাবৎ শক্তি প্রয়োগ করে। খুব জোর দেখাচ্ছে ঠাকুর। পেট ভরে খেলে সবই হয়। আমারও হবে। 

খালি পাতে গ্যাঁট হয়ে বসে আছি দেখে পাঁড়েজীর বোধ হয় ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে! উঠে দাঁড়াল। ভাবলাম, বাড়াবাড়ি ভাল না। বিদেশ-বিভুঁয়ে মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা দরকার। সম্পর্ক নষ্ট করে লাভ নেই। এক বেলা একটু কম খেলে মরে যাব না। পাঁড়েজীর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই উঠে দাঁড়ানো গেল। দেখে মনে হল, পাঁড়েজীর যেন ধড়ে প্রাণ এসেছে। সান্ত্বনা দেওয়া দরকার ছিল। রোজ এমন হবে না। অনেকদিন পর তো। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে এভাবে আর মরা মাছের মতো আমার দিকে তাকাতে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঘুরে গেল। পয়সা দশ আনা ঠিক আছে তো। এরপর যদি পয়সায় খামতি হয়, যেভাবে রুমকি আর বিলাইতির হেনস্থা, কখন কোথায় কি ছিটকে পড়েছে কে জানে? ফতয়ার পকেটে হাত দিলাম—আছে। বের করে গুনে দেখলাম, আছে। ঠিক আছে। কোথাও কিছু ছিটকে পড়ে নি। দশ আনা পয়সা দেবার সময় তিন বার গুনে তারপর হাতে দিয়ে বললাম, দো চৌ-আনি। এই দু-আনি। মোট দশ আনা। মনে মনে বললাম, পাঁড়েজী, কথা ঠিক রেখেছি। তুমি রাখলে না। আরও দুটো খেলে ঠিক হত। 

বাইরে বের হয়ে আসতেই খর রোদ মাথার উপর। দূরে ট্রেন যাচ্ছে। টং-লিং টং-লিং শব্দ। মগজের মধ্যে ঘুমপাড়ানির গান কেউ গেয়ে যায়। সুস্বাদু আহারের পর কোন গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। সেই গাছটার নিচে খাটিয়া। দেওড়ি শুধু পার হয়ে যাওয়া। রাজপুত্র কোটালপুত্রের গল্প মনে আসে। পদ্মমানিক হাতে। কোথাও রাজকন্যা শুয়ে পায়ে রূপোর কাঠি, মাথায় সোনার কাঠি। ঘুমে অচেতন। রাক্ষস-খোক্কসেরা গেছে যুদ্ধ করতে। বন্দিনী রাজকন্যার জন্য রাজপুত্রের হাহাকার। কখনও মনে হয়, তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে যাচ্ছে একটা সবল লাল রঙের ঘোড়া—রাস্তা আর ফুরোয় না, ঘোড়াটা কদম দিচ্ছে—রাত হয়, আকাশে নক্ষত্র ওঠে। গভীর বনভূমিতে রাজপুত্র পথ হারায়। কোথায় যে সেই রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব, মাঠটা পার হয়ে খুঁজছি! দেখি রাজকন্যাও নেই, রাজত্বও নেই। ব্যালকনিতে আম গাছের ফাঁকে শুধু কুকুরের বকলস ধরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এই রে! সেই কুকুরটা। দেখার সঙ্গে সঙ্গে এক মহাপ্লাবনের ছবি। টুক করে পেয়ারা গাছ আর খাটিয়াটা চোখের ওপর থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। জায়গাটায় আর কিছু নেই—শুধু প্লাবনের জল থিকথিক করছে। জলে নাক জাগিয়ে রেখেছে শয়তান কুকুরটা। কাছে পেলেই খক করে কামড়ে ধরবে। 

আর যাই! বরং স্টেশনের দিকে গেলে হয়। সেখানে একটা শোবার জায়গা মিলে যাবে। আমাকে আবার দেখছে না তো। টুক করে মাথাটা শেডের পাশে আড়াল করে দিলাম। এই সেই ছোকরা যে জানালা খুলে গোপনে কিছু দেখার চেষ্টা করছিল। রহমানদাকে নালিশও দিতে পারে। পাঁড়েজীও বলতে পারে, কি লড়কা আদমি ভেজিয়েছিলে সাব, পাতে ভাত পড়ে থাকে না, ডালও পড়ে থাকে না। কেবল কব্জি ডুবিয়ে রাক্ষসের মতো খায়। তা খেয়েছি। তাই বলে, রাক্ষস নই। অভাবী মানুষের এটা হয়। আবার কবে খাবার জুটবে, ভয়ে ভয়ে বেশি খেয়ে ফেলে। খুব দোষের না। 

আসলে একা হয়ে গেলে মানুষ নিজের সঙ্গেই বেশি কথা বলে। এই সাত-আট দিনে টের পেয়েছি, কত শত কোটি কথা মনের মধ্যে বুড়াবুড়ি দিয়েছে। নিজের সঙ্গেই বোধ হয় মানুষ প্রিয় কথা বলতে ভালবাসে। রুমকিটা কি! আমাকে মানুষের মধ্যে গ্রাহ্য করল না। পেটে দানা পড়ার পর অপমানটা খুব গুড়গুড় করছে! তখনও দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। ফিরলেই আবার কুকুরটাকে লেলিয়ে দেবে। এত নিষ্ঠুর হয় মানুষ। নিজের দিকে তাকিয়ে অবশ্য খুব জোর থাকল না। রাস্তায় মেলা লোকজন, আমাকে কেউ দেখছেই না। এত বড় পৃথিবীতে একেবারে উহা হয়ে আছি—অথবা একেই বুঝি বলে ছায়াবিহীন মানুষ। পেছন ফিরে দেখলাম, ছায়াটা ঠিক আছে তো! নেই। এই রে! ওঃ, এটা তো একটা শেডের তলা। বাইরে গিয়ে দাঁড়াতেই নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। আমার ছায়াটা এখনও সঙ্গে আছে। প্রতারণা করে নি। তাহলে আমি মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো এখন যে কোন জায়গায় এ বেলাটা ঘুমিয়ে নিতে পারি। রাতে ঘুম হয় না। ভয়। একা অন্ধকারে মনে হয় সব সময় ভূত দানোদের উপদ্রব। লোক যেখানে গিজগিজ করছে, সেখানেই ওম পাবার মতো জায়গা খুঁজি। কিন্তু কেউ ভালবাসে না। কেবল দেখলে দূর ছাই করে। 

হাঁটতে হাঁটতে ফাঁকা জায়গায় হাজির। ধান সিঁড়ি ক্ষেত, পরে শালবন। মাঠ চিরে রেল-লাইন চলে গেছে কত দূর। ঘাস, মাঠ এবং বুনো ফুল। নিরিবিলি বেশ। এখানটায় শুয়ে থাকলে কেউ টের পাবে না, কুকুরের ভয়ে এত দূর কেউ চলে আসতে পারে ভাবা যায় না। 

কিছু পাখির ডাকে এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। বেলা পড়ে গেছে। শরতের বিশাল সবুজ মাঠ সামনে। ধানের ক্ষেত। মাঝে মাঝে উঁচুনীচু পাহাড়া টিলা। জায়গাটা ভারি সুন্দর। কোন সুন্দর জায়গা দেখলেই মনে হয় পিলুকে নিয়ে আসতে হবে। সে বিশাল মাঠ এবং অরণ্য দেখলে খুশি হয়। পাহাড়ী টিলা, বনজ ফুলের গন্ধ পেলে পাগলা হয়ে যাবে। কিছু দূরেই বোধহয় কোন পাহাড়ী নদী বয়ে গেছে। একটা সাঁকোয় সূর্যাস্তে মানুষের পারাপারের ছবি। এ সব দেখে মনটা কেমন নরম হয়ে যাচ্ছে। বাবাকে কবে যে লিখতে পারব, একটা কাজ পেয়েছি। দুপুরে কাজ। সকালে মর্নিং কলেজ। না হলে প্রাইভেটে পড়াশোনা চালিয়ে যাব। একটা কাজ হলে সব হয়ে যাবে। হাই উঠছিল। কত বড় আকাশ, কত বিশাল এই পৃথিবী, বের হয়ে টের পেয়েছি। শেষ নেই। গাড়ি যায়—আর যায়। গ্রাম মাঠ তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে যায়। কত রকম ভাষা মানুষের। কত বিচিত্র পোশাক। যেন এ ক’দিনে পৃথিবীর অনেক গূঢ় গোপন খবর আমি পেয়ে গেছি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আবছা অন্ধকার। দুটো একটা নক্ষত্র এবার উঠবে। ঘাসের মধ্যে কিছু কীটপতঙ্গ লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। আমাকে এবারে উঠতে হয়— বাড়িটায় না ফিরে আর কোথায় যাওয়া যায়। একটা কুকুর আর একটা মেয়ে জীবনে এত ত্রাসের সৃষ্টি করতে পারে, অনুমানই করতে পারি নি। 

স্টেশনে সব সময় মানুষজন থাকে। রাত্রিবাসের পক্ষে ভাল জায়গা। রোয়াকে বসে থাকতে থাকতে কখন কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, রহমানদা আবিষ্কার না করলে ফের স্টেশনেই চলে যেতাম। রহমানদা কখন ফিরে আসবে কে জানে। কিছু বলেও যায় নি। ফিরে এলেও, ভয় কমছে না। একা থাকলেই কুকুরটা আর মেয়েটা পেছনে লাগবে। মানুষ বলে যে ইজ্জত দেয় না, তার পক্ষে সব সম্ভব। টাকা মান যশ হোক তখন দেখব—সব লিখে রাখছি। রহমানদা টের পাবার আগেই এখান থেকে ভেগে পড়া দরকার কি না, এই নিয়ে কুট তর্ক। যা হোক তবু তো একটা আশ্রয়। মানুষটা ভাল। 

দুত্তোরি ভাল। কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেবে যখন? 

ও হয় না। কুকুর দিয়ে মানুষ খাওয়ানো যায় না।

যা নিরিবিলি বাড়ি, সব সম্ভব। 

আফটার অল মেয়ে তো? 

সাইকেলওয়ালী বলুন। সারকাসের জাদুকর একবার আস্ত একটা মুরগী গিলে ফেলেছিল। জাদুকর পারে না, এমন কাজ নেই। 

ভিতর থেকে আমায় সে বলল, তাড়াতাড়ি যা করার কর। তোমার যা অন্ধকারের ভয়!

তাহলে কি করব? য পলায়তি স জীবতি। 

খুব যে সংস্কৃত ও গরাচ্ছ? 

আর কি করা! বাবা যে ওটাই কেবল সার জেনেছেন। 

তখনই দুরে ঘেউঘেউ করে একটা কুকুর ডাকছে। আর সঙ্গে আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে, বিলু, বিলু তুই কোথায়? আমরা তোকে খুঁজছি? 

এই রে! আবার! রহমানদা আর সেই মেয়েটা। কুকুরটা এদিকেই ছুটে আসতে আসতে গন্ধ শুঁকছে। দৌড়—দৌড়। রহমানদা চিৎকার করছে, বিলু, যাস না। ফিরে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ। কোথায় ঘুরছিলি? পাঁড়েজী বলল, কখন তো খেয়ে চলে গেছে। 

কে শোনে কার কথা? কিচ্ছু কানে আসছে না। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখছি, রহমানদা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। মেয়েটাও রহমানদার মতো কেমন স্তম্ভিত হয়ে গেছে আমার ছোটা দেখে। আর থাকি। নির্ঘাত কোন ষড়যন্ত্র। হলে কি হবে, বিধির বিধান। লাঞ্ছনা কপালে লেখা থাকলে কে খণ্ডায়? সেই বদমেজাজী শয়তানটা গোটা কয়েক লাফ দিয়ে এসেই পেছন থেকে লুঙ্গি জাপটে ধরল। এ শিক্ষাটা যে কার কাছে পেল। না কি কুড়ি টাকা চুরি করার খেসারত। গন্ধটা গায়ে এখনও লেগে আছে। লুঙ্গি খুলে একমাত্র পালাতে পারি। জলজ্যান্ত মেয়েটা না থাকলে কি করতাম জানি না। আর লুঙ্গি খুলে ফেলতে সাহস হল না। থাক ব্যাটা তোর লুঙ্গি নিয়ে, আমি আমার পথ দেখছি বলতে কিঞ্চিত সম্ভ্রমে বাধল। 

মরেছি যখন মেরে মরব। যতটা জোরে পারলাম, নিজেকে মুক্ত করার জন্যে লাথি মারতে থাকলাম।

রহমানদা চিৎকার করছে, ছোড়দি কুকুরটাকে সামলাও। বিলুটা ক্ষেপে গেছে। কুকুরটাও ক্ষেপে গেছে। 

রুমকিকে রহমানদা ছোড়দি বলে। ছোড়দির তবে এত সব কাণ্ড। ছোড়দি গম্ভীর গলায় বলল, ওকে মের না। টাইগার—টাইগার। 

সঙ্গে সঙ্গে টাইগার কি এক জাদুমন্ত্রে আমাকে ছেড়ে দিয়ে কুঁইকুঁই করতে থাকল। ছোড়দির এত প্রভাব। 

পালাবার পথ নেই। পেছন থেকে আসছে রুমকি আর রহমানদা। সামনে টাইগার। সত্যি ছোটখাট জ্যাস্ত বাঘ। কুকুরটা কত বিশাল, টের করতে পেরে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

রহমানদা বলল, তুই কী রে? তুই মানে, তোর কি ভালমন্দ জ্ঞানগম্যি নেই? 

কথা বলছি না। 

—বিশ্বাস করে চাবিটাবি সব—তুই কি না—রহমানদা রাগে সব কথা শেষ করতে পারছে না।

—ফিরে দেখি, দরজা বন্ধ। তুই নেই। কোথায় ঘুরছিলি? 

কিছু বলতে হয়—এখানে শুয়েছিলাম। 

—বন্য স্বভাবের কেন রে তুই? 

রুমকি বলল, তুই না রহমান মরবি। আর একবার সেই ছেদি না কি নাম, তোর সব নিয়ে পালাল। বিশ্বাস করে থাকতে দিলি, খেতে দিলি, রাতে একদিন হাওয়া। 

রাগ দুঃখ ক্ষোভ— এই সেই পুচকে মেয়েটা—যার দাপটে পরিত্রাহি জীবন আমার চোখে জ্বালা, রহমানদা পর্যন্ত পুচকিটাকে ছোড়দি বলে। লুঙ্গির খানিকটা কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে, বাকিটাও আমার খাইয়ে দিত— পাজিটা কেমন বলছে, রহমান তুই মরবি। বেশ মরবে, তোমার কি। তারপরই কি হল কে জানে, বোধহয় ক্ষোভে মাথা ঠিক ছিল না—এই তো সেই, যে আমাকে এত দূর পর্যন্ত পালিয়ে আসতে উসকে দিয়েছে, কোন দূরবর্তী নক্ষত্র যাকে ভেবেছি—তার এই আচরণ। হঠাৎ বলে ফেললাম, আমি যাব না। 

—যাবি না, থাকবি কোথায়? খাবি কোথায়? 

আবার কথা নেই। আসলে আমি যে বাবা-মার ছেলে, ঘরবাড়ি আছে, পিলু আছে, নবমী আমাকে দা-ঠাকুর বলে, এত সব অহংকার থাকলে যা হয়—অথবা কিছুটা অভিমান, কার উপর জানি না, এ বয়সে এটা বোধহয় খুব বেশি থাকে, না হলে, পালাব কেন? 

—এই, দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? হাঁট। রুমকি শাসাচ্ছে। বাবা আসুক, তোকে পুলিসে দেব। রহমানের চাবি নিয়ে হাওয়া। ভাগ্যিস টাইগার ছিল। 

পুলিসকে আমি ভয় করি, আমার বাবা ভয় করে- সেই পুলিস আবার? জল ঘোলা দেখছি। মুখ শুকিয়ে গেছে। দিতেই পারে। না বলে কয়ে উত্তরের জানালা খুলেছি, না বলে কয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছি, কুড়ি টাকা চুরি করেছি—এর জন্য কত বছর জেল হয়, জেল না ফাঁসি, নিয়মকানুন পুলিসের একেবারেই জানি না, খুব ভীতু বালকের মতো আর কথা না বলে হাঁটা দিলাম। কিন্তু মনে অস্বস্তি, রুমকির বাবা এলে কি সত্যি আমাকে পুলিসে দেওয়া হবে। তার চেয়ে বরং কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিক না। পুলিসে দাগী আসামীদের ধরে নিয়ে যায়। বাবার সব বিষয়ে পাস করা ছেলেটা শেষ পর্যন্ত দাগী আসামী হয়ে যাবে! 

রহমানদা খুব মুখ গম্ভীর করে হাঁটছে। আগে আমি। কুকুরটাকে বকলশে শেকল পরিয়ে রুমকি পেছনে আসছে। যেন পালাতে না পারি। আর পারছিলাম না—এরা আমাকে যদি পুলিসে দেয়, আর বাবা যদি জানতে পারে আমি হাজতে আটকে আছি, বাবার এ-দেশে এসে বাড়িঘর করার গৌরব সব এক সেকেণ্ডে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। বাবা আমার না অপমানে আবার তাঁর ঘরবাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে যান। 

পায়ে জোর পাচ্ছি না। একটা টিলার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দূরের পাকা সড়কে ট্রাকের শব্দ। গরুর গাড়ির শব্দ। মাঠ থেকে চাষীরা ফিরছে ঘরে। শহরের আলো কেমন মায়াবী পৃথিবীর কথা বলছে। কান পাতলে শস্যক্ষেতের কীটপতঙ্গের আওয়াজ পাওয়া যায়। আর এ সময় কি না একটা কুকুর, একটা মানুষ আর একজন নারী আমাকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিসে দেবে বলে। ভেতরে যখন ভয় এভাবে দাপাদাপি করছে তখন আর পারলাম না—রহমানদার সামনে গিয়ে সহসা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। মাথা নিচু করে বললাম, আমাকে আপনারা পুলিসে দেবেন রহমানদা? খুব কাতর চোখে-মুখে তাকিয়ে থাকলাম। 

জাঁহাবাজ মেয়েটা লাফিয়ে এসে পড়ল মুখের উপর বলল, না দিলে ধরে নিয়ে যাচ্ছি কেন? আমি রহমানদার দিকে তাকালাম— আমার চোখে কি ভয়ে অভিমানে জল এসে গেছে। রহমানদা কিছু টের পেয়ে বলল, দূর পাগলা, আয় তো! 

.

ফেরার সময় সারাটা রাস্তা ভারি বিমর্ষ থাকলাম। রুমকিকে বিশ্বাস নেই। যা জাঁহাবাজ মেয়ে, সব করতে পারে। ওর বাবা মানুষটিকে আমি দেখি নি। খুবই জাঁদরেল হবে। রুমকি যাঁর মেয়ে আর যাঁদের ঘরবাড়ি সাহেব-সুবোদের মতো, তাঁরা জাঁদরেল না হয়ে যায় না। রহমানদা খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছিল। আমরা টিলা পার হয়ে শহরে ঢোকার পথ ধরে হাঁটছি। রাস্তার দু’পাশে সব বড় বড় গাছ। ইতস্তত লাইট-পোস্ট। আলো জ্বলছে। চারপাশে তাকালে শহরটা যে এখনও ভারি ব্যস্ত, বোঝা যায়। রাস্তায় বড় বড় ট্রাক বোঝাই মাল চলে যাচ্ছে। আর পাশ দিয়েই গেছে রেলের লাইন। আমরা একটা গুমটি ঘর পার হলাম। কুকুরটা মাঝে মাঝে আমার পাশে এসে গা ঘষটাতে চাইছে। মনে মনে বিরক্ত হচ্ছি। ভয়ও হচ্ছে। কিছু বলতেও পারছি না। কুকুরটা আমার অসহায়তা ধরতে পেরে যখন তখন ইয়ার্কি করছে। বিদ্রুপ করছে। কখনও ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে উঠছে। কখনও পায়ের কাছে হুমকি দিচ্ছে। রুমকি হাসছে। যত কুকুরটা রাস্তায় আমাকে বিব্রত করছে, তত রুমকি মজা পাচ্ছে। কিছু বলাও যাচ্ছে না। কারও মজার বিষয় যে কারও প্রাণ নিয়ে খেলা এটা প্রথম রুমকির কুকুর আমাকে বুঝিয়ে দিল। কুকুরটাকে যখন তখন পেছন থেকে লেলিয়ে দিলে আমি আর কি করতে পারি? রহমানদা দেখেও দেখছে না। রহমানদা অন্তত আশা করেছিলাম আমার হয়ে কিছু বলবে। আমার তো বলা শোভা পায় না। যাকে পুলিসে দেবার কথা হচ্ছে, সে কি করে কুকুরটাকে কষে লাথি মারে। এ সময়ে মানুষের কাছ থেকে কুকুরটার প্রাপ্য বলতে ধমাস করে মুখে সজোরে লাথি। যা আমার থেকেও নেই। 

গুরুদোয়ারার সামনে আসতেই রহমানদা বলল, চাবিটা আছে তো? 

—আছে। 

—না থাকলে দুজনকেই বাইরে। চাবিটা দে। 

চাবি দিলে রহমানদা দরজা খুলে বলল, তুই পালিয়েছিলি কেন বল তো! 

সব বলতে পারি। কিন্তু টাইগার আর রুমকি থাকলে বলা সহজ নয় খুব। কতক্ষণে যাবে সেই আশায় আছি। 

সুইচ খুঁজতে গিয়ে রহমানদা বলল, কথা বলছিস না কেন? তুই কি কালা আছিস? 

আলো জ্বলে উঠলে বললাম, রহমানদা, কুকুরে কামড়ায়। 

—টাইগার তোকে কামড়েছে? 

—না, মানে—দেখি, রুমকি টাইগারের বকলস ধরে আমার দিকে ত্যারছা চোখে তাকিয়ে আছে।

–টাইগার তো খুব ভাল। একটা কাকপক্ষী বাড়িতে এলাউ করে না। কামড়ায় না তো! ভাল ছেলের মতো হাসতে হাসতে বললাম! 

লুঙ্গিটা উল্টে পরেছিলাম। ফলে বস্ত্রখানি অটুট দেখাচ্ছে। খুলে দেখাতেও পারছিলাম না। কি জানি, রেগে গিয়ে সত্যি যদি পুলিসে দিয়ে দেয়। তার চেয়ে বলা ভাল, কুকুরে কামড়ায় না।  

রহমানদা রুমকিকে বলল, ছোড়দি, তোমায় বোধহয় ডাকছেন মা। 

—ডাকুক গে। 

—মা-বাবার কথা শুনতে হয়, না রহমানদা? এর চেয়ে বেশি বলার সাহস হল না। আসলে বলতে চেয়েছিলাম, ভাগ এখান থেকে। হতচ্ছাড়া মেয়ে। মায়া হলে কান মলে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। 

—রহমান—রহমান— 

—আজ্ঞে যাই। 

রহমানদা বাইরে বের হয়ে দ্বিতীয় সদরটায় গিয়ে দাঁড়ালো। 

—রুমকি কি করছে! ওকে পাঠিয়ে দাও। খাবে না! সেই কখন তোমার সঙ্গে লাফিয়ে বের হয়ে গেল! লোকটাকে খুঁজে পেলে! 

—পেয়েছি। লোক না মা। ছেলেমানুষ 

—ছেলেমানুষ তো এখানে কেন? 

—বাড়ি থেকে বোধ হয় পালিয়েছে? 

—পালিয়েছে! 

আমার মাথাটা ঘুরছিল। 

রহমানদা বলল, ঠিক পালায় নি। কাজের ধান্ধায় বের হয়েছে। 

—ছেলেমানুষের আবার কাজের ধান্ধা কেন? ছেলেমানুষ তো পড়াশোনা করবে।

গাছপালার অভ্যন্তর থেকে অথবা অন্য গ্রহ থেকে কেউ যেন কথা বলছিল; আমরা নিচের গ্রহে দাঁড়িয়ে শুনছি। অমোঘ বাণীর মতো রহমানদা সেই দেবলোকের কথাবার্তা অবধান করছে। 

হঠাৎ গ্রহ থেকে আবার অমোঘ কথাবার্তা ভেসে এল, ছেলেটা বাঙ্গাল নাকি! 

আমি উৎকর্ণ হয়ে আছি। তক্তপোশে বসে আছি, তবু পা হাঁটু কাঁপছে। একজন মানুষের এত অপরাধ থাকলে তাকে রহমানদা রাখবে কী করে! 

—তা তো জানি না মা। 

—জিজ্ঞেস করে দেখ। না জেনে-শুনে লোককে জায়গা দিতে নেই। তোমার ক্ষেপামিতে শেষে না আমাদের সব যায়। 

ওদের সব যাবে কেন! বাঙ্গাল আমি ঠিক। ইস, কী যে রাগ হচ্ছিল নিজের উপর। এত করেও দমন করা গেল না। 

আবার গ্রহলোকে কথাবার্তা— পীলখানার মাঠে সব ছেয়ে গেছে শুনেছ! 

—আজ্ঞে শুনেছি! 

—তরফদাররা থাকতে দিয়েছিল। এখন সব দখল করে নিয়েছে। কত বড় সম্পত্তি। বেহাত হয়ে যাবে। উনি তো বললেন, আইন-আদালতেও কিছু হবে না। বাঙ্গালরা নাকি ভগবান। বসলে উঠতে চায় না। ঠাকুর দেবতার মতো। আমাদের গ্রহ থেকে সংযোজনকারীর আক্ষেপ- সেই মা—কী যে হবে। হুড়হুড় করে সব ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসছে। ফাঁকা জায়গা পতিত জায়গা আর থাকছে না। 

—দেখ না, যা অবস্থা, দেশটা বাঙ্গালদের হয়ে যাবে। সেই কবে একবার কলকাতায় বাবা আমাদের বাঙ্গাল দেখিয়েছিলেন। জজ মানুষ— বললেন, আজ দেখবি একজন বাঙ্গাল আসবে। বাবার সঙ্গে কাজ করতেন। তিনিও জজ। খুব ডাকসাইটে জজ। অথচ বুঝলে, এসেই ডাকাডাকি— অ নিবারণবাবু, বাড়ি আছেন নাকি? বাবা বললেন, এসেছেন? —আরে আইছি। দরজা বন্ধ কইরা বইসা আছেন। বাঙ্গালরে ডরান দ্যাখতাছি খুব। না না, বাবা বিগলিত। বুঝলে রহমান, সেই আমাদের বাঙ্গাল দেখা। লোকটা কি চেঁচিয়ে কথা বলত! যেন আমরা সব কানে কম শুনি। 

রুমকি কুকুরটার বকলস ধরে দরজায় পাহারা দিচ্ছে। কুকুরটার লম্বা জিভ হা-হা করছে। হাঁ করলে আমার পুরো মুখটা মুখে ঢুকে যাবে। দু’পা সরে বসলাম। 

রহমানদা ফিরে এসে বলল, তুই বাঙ্গাল? 

মাথা গোঁজ করে বসে থাকলাম। 

মা তো বলল, তোরা নাকি এখন ঠাকুর দেবতা। বসলে আর উঠতে চাস না। বলেই হেসে দিল ছোড়দি, তুমি যাও। এখন আমরা খাব। বাবুসাব এলে রাগ করবেন। 

বাবুসাবের কথায় রুমকির মনে হল, আমাকে নিয়ে বোধ হয় বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।

রুমকি চলে গেলে রহমানদা বলল, ছোড়দি খুব ভাল মেয়ে। তুই ওকে ছোড়দি ডাকবি। এতক্ষণ যাও সহ্য হচ্ছিল, আর পারা গেল না। আমি ওকে ছোড়দি ডাকব বলছেন, পুচকে মেয়েটাকে আমি, না আমি পারব না। আমায় কী করেছে আজ? কুকুরটাকে লেলিয়ে দিয়েছে। 

সঙ্গে সঙ্গে হাজির সেই মহীয়সী — মিছে কথা বলছিস? 

আমার সব বলা এক দণ্ডে উবে গেল। স্থির হয়ে বললাম, হ্যাঁ, মিছে কথা। 

—তবে। 

রুমকি যে চলে যায় নি, এ বোধটা থাকা উচিত ছিল। উঁকি দিয়ে দেখে নিলে আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হত না। বললাম, না, সব ঠিক আছে। আমি তোমাকে ছোড়দিই ডাকব। এই কথা বলার পর ছোড়দি কেমন ভালমানুষ হয়ে গেল। বলল, পালাবার চেষ্টা করবি না। টাইগার দিনরাত ওত পেতে থাকে। সব টের পায়। 

তা যে পায়, তার ঠ্যালা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ছোড়দি কিছু আর বলল না। কুকুরটাকে নিয়ে এক দৌড়ে ভেতরে গাছপালার মধ্যে হারিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে রহমানদা বলল, এ বাড়িতে ছোড়দির দাপট খুব। ওকে খুশী রাখতে পারলে আর কথা নেই। তোর সাতখুন মাপ। নে আর দেরি করিস না, কখন তো খেয়েছিস। তারে জামাপ্যান্ট রয়েছে, নিয়ে আয়। হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে নে। খাবার দিতে বলে এয়েছি। 

খাবার এলে রহমানদা বলল, তোদের তো আবার জাতের মাথামুণ্ডু নেই। কি করতে কোটা কাটা যাবে—তার চেয়ে বরং তুই খেয়ে নে। পরে আমি খাচ্ছি বলে উঠে দাঁড়াল। ভিতরের দিকে আর একটা দরজা আছে, ওটা খুললে টের পেলাম, রহমানদার সব কিছু ঐ ছোট্ট কুঠরির মধ্যে। আসলে তবে দুটো ঘর। ঐ ঘরটায় রহমানদার যাবতীয় মহার্ঘ জিনিস, বাক্স পেটরা লকার সব কিছু। ওখান থেকে কি বের করতে ঘরে ঢুকল। বাইরের ঘরটা এ জন্য খুবই নিরাভরণ। 

শুধু একটা টেবিল ক্লথ বাদে বলতে গেলে আর কিছুই নেই। খাট এবং বিছানা টেবিল আর গোটা তিনেক চেয়ার। এই সম্বল করে সে সব কিছু অসংকোচে আমার মতো একজন পলাতকের কাছে গচ্ছিত রেখে চলে যেতে পেরেছে। মানুষকে বিশ্বাস নেই, এ বোধটা রহমানদাকে বোধহয় ছোড়দি বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। 

মানুষের স্বভাব এ-রকমেরই। তবু মানুষ অধিকাংশ এক একজন স্বার্থপর দৈত্য। ট্রেনে এটা খুব মালুম হয়েছে। তা না হলে যে দাড়িওলা লোকটিকে ভিড়ের ট্রেনে একটু জায়গা করে বসতে দিয়েছিলাম, তারই চাপ কেন ব্লাডারের মতো আমাকে উদ্বাস্তু করে ছাড়বে। চাপে প্রায় ছিটকে গেলাম। ভিন রাজ্যের মানুষটি আমার জায়গা সম্পূর্ণ বেদখল করে নিয়েছে বলে এতটুকু অনুকম্পা নেই। স্টেশন যত পার হয়ে যাচ্ছি, তত কোন এক অদৃশ্য শক্তি দরজার কাছে আমাকে ঠেলে নিয়ে চলে এসেছে। যে যেখান থেকে পারছে উঠছে। বাক্সপেটরা যে যার মতো জানালায় দরজায় গলিয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হয়েছিল, ট্রেনে জায়গা না পেলে মহাপ্লাবনে সব তাদের ভাসিয়ে নেবে। 

—কি রে, বসে আছিস কেন? ওঠ, খাবি না? 

হাত-মুখ ধুয়ে জামাপ্যান্ট পরার পর আগেকার বিলু হয়ে গেলাম। উঁকি দিয়ে দেখলাম, কেউ আবার দেখছে কিনা। না, নেই। কেবল গাছগাছালির ফাঁকে একটা আলোর ডুম জ্বলছে। এবং বাড়িটাকে এত রহস্যময় করে রেখেছিল যে রহমানদাকে লুঙ্গিটা দেখানো দরকার আছে, ভুলে গেছিলাম। 

রহমানদা লুঙ্গি পরে একটা হাফ হাতা গেঞ্জি গায়ে আবার হাজির। চোখে মুখে বুঝি আশঙ্কার ছাপ টের পেয়েছে। বলল, তুই কি খুন-টুন করে পালিয়েছিস? সব সময় কেমন সিঁটিয়ে আছিস? 

কি করে বোঝাব খুনেরই শামিল। গোবিন্দদার কৌটা থেকে কুড়ি টাকা চুরি আর খুনে আমার কাছে তফাত এক গাছি সুতোর। বাবার কাছে সব সমান! খুনেও পাপ, চুরিতেও পাপ। দুটোতেই ঈশ্বর তাঁর রাগ করেন। এ হেন মানুষের সন্তানের পক্ষে স্বাভাবিক থাকা খুবই কঠিন। সামান্য হাসার চেষ্টা করে বললাম, না না, খুন করব কেন? আমি গুণ্ডা না ডাকাত? তা ছাড়া ভাবলাম, আমাকে পুলিসে দেবার কথা হচ্ছে। মাথা ঠিক থাকে কি করে? 

—সে তো চেহারা দেখেই মালুম পাওয়া যাচ্ছে। 

খেতে বসে দেখলাম, বড় টিফিন ক্যারিয়ারে মাংস ভাত রুটি আলাদা করা। 

রহমানদা বললে, যা লাগে নে 

সবটাই খেতে পারি। খিদে তখন ঘোড়ার পিঠে জিন লাগিয়ে বসে আছে। যা পায় তাই নিয়ে দৌড়াতে চায়। কি নেব, কতটা নেব আন্দাজ করতে পারছিলাম না। 

—ভাত খাস রাতে? 

ঘাড় কাত করে দিলাম। 

—ভাতই খা। আমার আবার রাতে ভাত সহ্য হয় না। 

রহমানদা বললে, দুপুরে পেট ভরে খেয়েছিলি তো? 

না, বলতে সংকোচ হচ্ছে। আসলে কতটা খেলে পেট ভরে তার আন্দাজ আমার গেছে। হয় তো যতটা খেয়েছি, তারই নাম পেট ভরতি খাওয়া। পাঁড়েজী দীর্ঘদীন এ লাইনে আছে। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। সে জানে কতটা খাওয়ার নিয়ম। বেশি খেলে সইবে কেন? পেট ভরেছে, গলা অবধি হয় নি। পাইস হোটেলে আকণ্ঠ কে খেতে দেয়? যে দেয়, সে লাটে ওঠে। 

—বললাম, খুব খেয়েছি। 

—খাবি। লজ্জা করবি না। এত যার বিবেক তার আবার বাড়ি থেকে পালানো কেন! কাজের ধান্ধা দেশে থেকে করলেই হত। 

এ সব কথা কানে যাচ্ছিল না। একবার ভাবি বলি, আচ্ছা রহমানদা, ছোড়দি কি সত্যিই থানা পুলিসের কথা ভাবছে। কিন্তু রহমানদা তখনও কথা বলে যাচ্ছে, আমার কথা শোনার সময়ই নেই। 

—তোর মতো আমিও বের হয়েছিলাম। সে বেশ একটা জীবন গেছে। এখন মুঠো মুঠো পয়সা। না, তা বলে ভাবিস না, তোর মতো অনেক লেখাপড়া জানা ছেলে। লেখাপড়া জানলে দুনিয়া উল্টে দিতে পারতাম। 

মানুষটা কী করে জানি না। বাংলো বাড়িটার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক তাও জানি না। নেমপ্লেটে আছে, ডাঃ এস. কে. দত্ত। এই সহরটা খুব বড় নয়—জংশন স্টেশন, আর মহকুমা শহর মিলে যা ঘরবাড়ি থাকার কথা তাই আছে। বাড়িটা শহরের একপাশে, অনেকখানি জমিজমা নিয়ে বাগান নিয়ে বাড়ি। যেন মানুষটা নিজের একটা আলাদা পৃথিবী বানাবার তালে আছে। আসলে সবাই নিজের জন্য একটা আলাদা পৃথিবী তৈরী করতে চায়। আমারও সেই বাসনা। 

খাওয়া হলে রহমানদা বলল, শুয়ে পড়। এখন আমি একটু বসব। 

তা বসুন, আপনার জায়গায় আপনি বসবেন শোবেন—তা আবার বলা কেন। কিন্তু বসা যে মানুষের এ রকমের হয়, জানতাম না। বোতল গ্লাস, পরিপাটি করে চানা ভাজা এবং ভক করে ঝাঁজটা নাকে লাগলে এক কোণায় সরে গেলাম। 

—তোর অসুবিধা হচ্ছে। তবে পেয়ারাতলায় খাটিয়াতে শুয়ে থাক। পরে ডেকে আনব। 

সেই ভাল। আপনি খান। একটা বালিশ নিয়ে সামনের পেয়ারাতলায় চিৎপাত হওয়া গেল। রাস্তার আলো আসছে। পাতার জাফরিকাটা ছায়া ছড়িয়ে আছে খাটিয়াটার ওপর। শুয়ে মনে হল, ভয় করবে। বাড়িতে হলে কিছুতেই পারতাম না। মানুষের বসবাসের জায়গায় কিছু অদৃশ্য আত্মা সঙ্গী হয়ে যায়। আবাস নয়, এবং অপরিচিত জায়গা বলে কোন প্রেতাত্মা বোধ হয় সঙ্গী হতে চাইছে না। জংশন স্টেশনে মাঝে মাঝে হুইসিল দিয়ে গাড়ি যায়, রাস্তায় ট্রাক-বাস রিক্‌শর শব্দ এবং আলোর মধ্যে প্রেতাত্মার কোন অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল না। বরং প্রেতাত্মা বলতে এখন রুমকি। সে আমাকে পুলিসের ভয় দেখিয়ে রেখেছে। 

ঘুম আসছিল না। এপাশ ওপাশ করছিলাম। মাঝে মাঝে টাইগার গলা ফাটিয়ে ওপাশে চিৎকার করছে। জেগে আছে জানান দিচ্ছে। সকালে ছোড়দিকে বোধহয় সব খুলে বলাই ভাল হবে। কুড়ি টাকা চুরি করেছি ঠিক তবে ডাইরিতে লিখে রেখেছি। কে কি পাবে, সব লিখে রেখেছি। টাকা মান যশ হলে ফেরত। আজ যে দশ আনা পয়সা দিয়েছে রহমানদা, তাও লিখে রাখব। আশ্রয় দিয়েছে, তাও। কাজ দিলে তাও লেখা থাকবে, কারো কাছে কোন ঋণ রাখব না। বাবা বলেছেন, অঋণী অপ্রবাসী থাকতে। তবে দেশ ছেড়ে আসার পর তাঁর মুখে অপ্রবাসী কথাটা আর বের হত না। শরণার্থীদের জন্য সরকার লোন দিচ্ছে, বাবা সেদিকটাতে যানই নি। কে কার ঋণ শোধ করবে! যা সব সন্তান- সন্ততি, তাদের আর ঋণের মধ্যে রেখে পিতৃদায় বাড়াতে চান না। শিষ্যদের মানি অর্ডার এলে শুধু জবাবে লিখতেন, ঠাকুরসেবার জন্য প্রেরিত তোমার প্রণামী যথাসময়ে পেয়েছি। প্রণামী কখনও ঋণের পর্যায়ে পড়ত না। যে যার মঙ্গলের জন্য পাঠায়। তিনি শুধু উৎসর্গকারী, বাবার এসব ধারণা মনে হওয়ায় গোপনে হেসে ফেললাম। মানুষ বোধহয় নিয়মকানুন এভাবেই নিজের মতো করে তৈরি করে নেয়। নেশা করা, মাতলামি করা পাপ কাজের মধ্যে পড়ে রহমানদার খেরো খাতায় বোধ হয় লেখা নেই। থাকলে বলতে পারত না, তুই শুয়ে পড়। আমি একটু বসব। 

রহমানদা কী করে মুঠো মুঠো টাকা রোজগার করে জানি না। একদিনে জানা সম্ভবও নয়। শহরটায় এসে বুঝেছি, সব মানুষই রোজগারের ধান্ধায় ঘুরছে। যার যেমন ক্ষমতা। আমার ক্ষমতার মধ্যে আছে ইতিহাস ভূগোল অঙ্ক ইংরেজি। বাংলা ভাষাটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। ওটা রহমানদাও জানে। একজন ভিখিরীও জানে। হিসাবপত্র রাখতে পারি, সরকারী অফিসের কাজে লাগতে পারি—কোন একটা বাবু-কাজ আমার চাই। রুমকির বাবা যদি পুলিসে দেয়, তবে সব যাবে। দাগী আসামী জানলে কুকুর পর্যন্ত পেছনে লাগে। ওদের ঘ্রাণশক্তি প্রবল। আসলে কি টাইগার টের পেয়ে গেছে, পাঁচিলের পাশে একটা খুদে চোর শুয়ে আছে? 

না, ঘুম আসছে না। ইচ্ছে হচ্ছে পাঁচিল টপকে কুকুরটার গলা টিপে ধরি। সত্যিকারের একটা খুন-টুন না করলে চলছে না। কুকুর তুমি মরবে। ফাঁক পেলেই দড়ির ফাঁস পরিয়ে ঝুলিয়ে দেব। বেশি হুজ্জোতি আমি সহ্য করব না। প্রাণীদের প্রতি বাবার সব সময়ই একটু বেশি আবেগ। মনাকে পিলু কোন কারণে লাথি-ফাথি মারলে বাবা বলতেন, দেব নাকি এক ঘা। মনার বুঝি লাগে না। বাবার কাছে মানুষ এবং জীবজন্তু তেনারই সৃষ্টি। তুমি শাসন করার কে হে? 

কিন্তু এমন পেছনে লাগলে রাগ হয় না! আচ্ছা, ঠিক আছে—কিছু করব না। খুনের কথায় বাবার মুখটা ভেসে উঠল! 

তুমি শেষ পর্যন্ত নিরীহ একটা অবলা জীবের প্রাণ হরণ করলে। পারবে তুমি কারো প্রাণ দিতে? যা পার না, তা তুমি মারতেও পার না। হতাশায় কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেলাম। আমাকে দিয়ে আসলে কিছুই সম্ভব নয়। উচ্চাশা বাদে আমার আর কোন সম্বল নেই—এত সব ভাবনার মধ্যেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম—সকালে দেখি গাছতলাতেই শুয়ে আছি। রহমানদা ডেকে ডেকে সারা—রহমানদার স্নান সারা। 

—এবারে ওঠ। আর কত ঘুমাবি। হাত-মুখ ধুয়ে এলে সেই ডিম ভাজা, পাঁউরুটির পিস। এখন দেখছি খাবার সামনে থাকলে মাথায় আর কোন দুশ্চিন্তা থাকে না। রুমকি যে কুকুরটা নিয়ে যে কোন মুহূর্তে হাজির হতে পারে, তাও মনে নেই। 

দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পাবার মোক্ষম একটা উপায় খুঁজে বার করা গেল। সারাদিন খাদ্যসামগ্রী সামনে নিয়ে বসে থাকলে হয়। কিন্তু পাব কোথায়। দিতেই সব যার সারা হয়ে যায়, তাকে কোন সরবরাহকারী আছে যে, এটার পর এটা খান, তারপর এটা, তারপর মিহিদানা, খান না আর দুটো রসগোল্লা —সুতরাং মোক্ষম উপায়টা কাজে লাগতে পারত একমাত্র কোন যদি সদাশয় সরবরাহকারী বিনা শর্তে রাজী থাকতেন। 

রহমানদা বলল, অসীমকে বলেছি, ওর মোটর পার্টসের দোকান আছে। তার যদি কোন কাজে লাগে— 

তাহলে রহমানদা কাজে লেগে গেছে। 

—কাজ পাওয়া বড় কঠিন বিলু। তার চেয়ে ব্যবসায় নেমে পড় 

—কি ব্যবসা? 

–আমার সঙ্গে থেকে থেকে শিখবি। বিচারবুদ্ধি একটু থাকলেই হয়ে যায়। কি করবি?

–কোন অফিসে-টফিসে– 

—তুই ক্ষেপেছিস। সরকারী অফিসে চাকরি, সে হয় না। আমি পারব না। সব চোর, বুঝলি। পকেটমার, ছিনতাইবাজদের আমি ক্ষমা করে দিই। দেবে না, কেড়ে খাবে। কিন্তু ব্যাটারা সাধু সেজে বসে থাকে। এক দু’টাকার কাঙ্গাল। বেটারা সব লেঙ্গু। 

লেঙ্গু শব্দটি নতুন। লুঙ্গির অপভ্রংশ কি না ঠিক জানি না, কিংবা লেজুড়ের। যাই হোক, রহমানদা আপাতত খেয়ে ওঠার পর বলল, দশ আনা থাকল। আজ আবার পালাস না। ফিরতে দেরি হলে রোয়াকে বসে থাকিস। গাড়িটাড়ি গেলে লক্ষ্য রাখবি। কেউ এলে বলবি, রহমানদা নেই। তুই যে এখানে এসে উঠেছিস, স্যাঙাতরা সব জেনে ফেলেছে। কোথায় ঘুরছি ফিরছি জানতে চাইবে। 

—তুমি কী কর রহমানদা? 

এই প্রথম ওকে ‘তুমি’ বললাম। এবং কিছুটা চমকে গেলাম। মানুষ কত সহজে একজনকে নিজের করে নিতে পারে। 

—থাকলে টের পাবি। বলতে হবে না। তোকেও লাইনে ভিড়িয়ে দেব। হিসাব ঠিক থাকলে পাঁচ সাত বছরেই গাড়ি-বাড়ি। তুই লেখাপড়া জানা ছেলে, তোর সহজেই হবে। 

রহমানদা প্রচণ্ড জোরে একটা হাই তুললে। মুখে তুড়ি দিলে। শেষে বললে — স্বাধীন দেশ তো। লোকজন সব স্বাধীন। আগে পরাধীন ছিলাম। শৃঙ্খলিত বলে দেশনেতারা। হাত-পা বাঁধা থাকলে কাজে অসুবিধা। না থাকলে কত সুবিধা। বল। যাই করবি, তাতেই ফসল। কেবল কোন্ গাছে কি কি সার লাগে জানতে হয়। 

একটা টিকটিকি সে সময় ধপাস করে আমার মাথায়—ভয়ে উঠে দাঁড়ালে বললে –তুই খুব পয়া আছিস। কাল ভাল রোজগার হয়েছে। আরও হত, লেখাপড়া জানি না। অক্ষরজ্ঞান নেই, ছোড়দিদের গাড়ি চালিয়ে পেট ভরত। আর এখন সময়ে ছোড়দির বাবাই বলে—হবে নাকি? 

—কি হবে নাকি? 

— টাকা। 

—টাকা চায়? 

—চায় মানে? নেশা। জমিজমার নেশা। শহরের ফাঁকা জায়গা পেলেই কিনে ফেলে। নেশা না থাকলে হয় না। যেমন নেশা না থাকলে কার দায় বল এত সকালে দুটো মুখে দিয়ে ছোটার? বড় হ’, বুঝবি। 

রহমানদার এত কথা বলার দায় আমার সঙ্গে নেই। বরং গম্ভীর থাকলেই মানাত। যার আশ্রয়ে যে থাকে, সেই তার মনিব। সব সময় গোবিন্দদার মত রহমানদাও আমার মনিব—মনিবের এমন দিলখোলা কথাবার্তায় আরও বেশি মজে গেলাম। রহমানদা চলে গেলেই সারাদিন একা। পেয়ারা গাছ এবং পাঁচিল, রাস্তার লোকজন দেখা আর পাশের বাংলোবাড়িটায় রুমকি, টাইগার ভয় দেখাবে। সদর দরজায় পুলিস। 

দুম করে বলে ফেললাম, না বলে কিছু নিলে চুরি করা হয় না রহমানদা? 

—চুরি! 

—না, এই আর কি, কেউ যদি নেয়, নেবার পর যদি চিরকুটে লিখে রাখে, নিয়েছি। তবে কি চুরি হয়? 

—মরণ হয়। 

—তার মানে? 

—কিছু লিখে রাখতে নেই রে। শতং বদ মা লিখতি’ কি না বলে যেন। কোনদিন এমন কাজ করবি না। লেখাপড়া শিখে তোর এই বুদ্ধি হল। কেউ নিয়ে আবার লিখে রাখে নাকি? 

—লেখে না? 

—লিখলেই তো ধরা পড়তে হয়। 

গ্যাছে। সব গেল। নিজের হাতে মরণ ফাঁদ পেতে এসেছি। কি করি? মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পৃথিবীতে কত বড় নির্বোধ হলে এমন হয়। নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। চুপ করে থাকলে বললে, যাকে যা দিই মুখে মুখে হিসাব। লেখা থাকলে হিসাবে গন্ডগোল হয়। লোকও সব তক্কে তক্কে আছে, পেলেই খপ করে ধরে ফেলে। 

তারপর রহমানদা কখন চলে গেল, টের পাই নি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি—রাস্তাই একমাত্র মুক্তির পথ—ফেরার হওয়া ছাড়া আর ভাগ্যে কিছু লেখা নেই। টেবিলে দশ আনা পয়সা। বাইরে দরকার পড়লে তালা দেবার চাবি। আর কিছু নেই। একটা তোয়ালে স্নানের জন্য, আর কিছু নেই। টেবিল ঘড়িটা টিকটিক করে বাজছে, না মস্করা করছে, ঝুঝতে পারছি না। রাস্তার হাতছানি তখনই ঘেউ—এই রে, যাব কোথায়? সে তো জেগে আছে। দিনরাত কেউ জেগে থাকলে, আমি করি কি? অগত্যা ছোড়দিই আমার সব। হাতজোড় করে অপরাধ স্বীকার করলে, পুলিসে দেবার কথা ভাবতে নাও পারে। বাইরে পেয়ারাতলায় বসে আছি, ছোড়দির সঙ্গে দেখা করব বলে। আর সেই সময় একটা সাদা রঙের গাড়ি। গাড়িতে নীল ফ্রক গায়ে ছোড়দি। গাড়িটা হুস করে বের হয়ে যাবার সময় হাত নেড়ে বলল, তাহলে পালাস নি, এখনও আছিস? 

দৌড়ে গেলাম, ছোড়দিকে কিছু বলব বলে। ছোড়দির গাড়িটা চলে যাচ্ছে। কী সুন্দর দেখতে ছোড়দি। পায়ে সাদা মোজা, কালো পাম্পশু। ফাঁপানো ববকাটা চুল। কপালের অর্ধেকটা ঢেকে আছে। একটা সাদা রঙের গাড়ি যেন আশ্চর্য এক পৃথিবীর খবর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। দূরবর্তী নক্ষত্র বুঝি মানুষের শৈশবে, এভাবেই আকাশে আলো দেয়। কেন জানি বিশ্বাস হল, ছোড়দি আর যাই করুক পুলিসে দেবে না। টের পেলাম, ছোড়দির দুষ্টু চোখে বড় বেশি সুষমা। অন্য গ্রহ থেকে তখন কেউ যেন সংকেত পাঠায়—আমি আছি, আমি বড় হচ্ছি। মনের সব গ্লানি নিমেষে কেউ হরণ করে নেয়। প্রসন্ন মনে ভাবি, আমার বড় হওয়া তারই হাত ধরে। বাবা-মা ভাই বোনের মতো সেও জীবনে অংশীদার হয়ে যাচ্ছে। ভারি গোপনে পা টিপে টিপে সে আসছে। 

এখন আমি স্বাধীনও বলা যায়, পরাধীনও বলা যায়। স্বাধীন এ জন্যে, আমার মনিব রহমানদা নেই। দরজায় তালা মেরে শহরটা ঘুরে দেখে আসতে পারি। মানুষজন দেখলে, জীবন সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ে। বাবার কথা। বনের মধ্যে বাড়িটা করার পর, বাবা বোধহয় এটা টের পেয়েছিলেন। ভিটেমাটি ছেড়ে বনের মধ্যে বাড়িঘর করতে কেউ এলেই, বাবার অহংকার বেড়ে যেত। মাটি মানুষ এবং গাছপালা সম্পর্কে নানা রকমের কৌতূহলোদ্দীপক কথাবার্তা বলতেন। মানুষ নিজের ঘরবাড়ি চায়। প্রতিবেশী চায়। গাছপালা চায়। প্রতিবেশী না থাকলে, তোমার অহংকার কার কাছে? প্রতিবেশী আছে তাই মানুষ এত উদ্যোগী, জীবন সম্পর্কে মানুষের এত আগ্রহ। বাবা গভীর বনটার প্রথম ইজারাদার। নিজের মতো একখানা গ্রাম তাঁর আবার দরকার। তিনি ঘুরে ঘুরে খবর দিয়েছেন, চলে যাও, বহরমপুর স্টেশনে নেমে রেল-লাইন বরাবর। সামনে পাবে বাদশাহী সড়ক। পাশে পুলিস ট্রেনিং সেন্টার। পরে মাঠ। আরও পরে রাজরাজড়াদের আম-কাঁঠালের বাগান। জঙ্গল গড়িয়ে এখন সুমার বন। জঙ্গল সাফ করে ঘর বানাও। কত কাল আবাদ নেই—বীজ বুনলেই গাছ। খাবার থাকবার ভাবনা নেই। 

বাবাকে তখন আমার কিছুটা মোজেসের মতো মনে হত। অথবা বাবা যেন সেই মহাপ্লাবনের সময়কার মানুষ—নৌকায় তিনি সব জোড়ায় জোড়ায় পাখি, জীবজন্তু এবং মানুষের প্রজাতি তুলে নিচ্ছেন। নোয়ার নৌকা এখন বাবার গ্রামের আবাসটি। সেই বাবার ছেলে এইমাত্র নিজেকে স্বাধীনও মনে করছে—আবার পরাধীনও ভাবছে। 

পরাধীন এই জন্য যে একটা কুকুর নোয়ার বংশধরকে আটকে রেখেছে—বাবা এটা ভাবতেই পারতেন না। কুকুর গৃহপালিত জীব। তার এত আসকারা হবে কেন! মানুষের কাছে সে তো মাথা হেঁট করে রাখবে। সেই কুকুরের ভয়ে নোয়ার বংশধর খাটিয়ায় শুয়ে আছে। মাথার ওপর নিষ্ফলা পেয়ারা গাছ। শরতের বাতাসে, দুটো একটা পাতা ঝরে পড়ছে মাথায় পায়ে। রাস্তায় রিক্‌শর প্যাক প্যাক শব্দ। জংশন স্টেশনে গাড়ি—নীল আকাশ গুরুদোয়ারার গম্বুজ পার হয়ে একটা কলের চিমনির কাছে আটকে গেছে। নোয়ার বংশধর ভারি বিপাকে। পা নাড়লেও মনে হচ্ছে পাঁচিলের ওপাশে টাইগার গরগর করছে। এ হেন অবস্থায় বাবার বিচারবুদ্ধি সাফ। ট্রেনে দেখেছি, বিনা টিকিটে বাবা আমাদের তুলে দিয়ে এ-কামরা ও কামরায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চেকার দেখলেই পরিপাটি হাসি এবং সখ্যতা। সখ্যতার মতো বড় শত্রুতা অপহরণকারী আর কিছু নাকি নেই। সুতরাং টাইগারের বেলায় বাবার স্বতঃসিদ্ধ ধারণা প্রয়োগ করে দেখবার একটা বাসনা গজাল। একটা কুকুরের হেপাজতে থাকতে মানুষের কতক্ষণ ভাল লাগে? কুকুরটাকে হাত করতে পারলেই খোলামেলা স্বাধীন জীবন। ভাবা যায় না। 

ডাকলাম, কুঁ। 

কুঁ ডাকলে, কুকুর আসে। পায়ে লুটায়। ঘাউ ঘাউ করে উঠল কিন্তু কুকুর এল না।

আবার–কুঁ! 

রাস্তা থেকে দুটো নেড়ি কুকুর ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল। এল না। তাহলে কুঁয়ে হবে না। রাস্তার কুকুরও আমায় চিনে ফেলেছে। দেবার মুরদ নেই, ডাকে। হন্যে হয়ে ঘুরছি, শুঁকছি সব কিছু, কোথাও কিছু নেই—কুঁ দিলেই হল। আর টাইগারের ইজ্জত কত! ছোড়দির নফর, সে কুঁ দিলে ঘাউ ঘাউ করবে শুধু। আপাতত তবে উঁকি দেওয়া যাক। পাঁচিলে উঁকি দিতেই মনটা ভারি প্রসন্ন হয়ে গেল। টাইগার জাফরিকাটা বারান্দায় বন্দী হয়ে আছে। 

শত হলেও স্বভাবে কুকুর—খেতে দিলে সব হয়— ছোড়দি সেই ভয়ে বোধহয় আটকে রেখে গেছে। লাফিয়ে পাঁচিল টপকে নোয়ার বাচ্চার সঙ্গে ভাব জমালেই গেছে। সব প্রভুত্ব ছোড়দির তবে যাবে। তারপরই মনে হল, বাড়ি থেকে বের হওয়া তক আমি কেবল মানুষের খারাপ দিকটাই দেখছি। এও তো হতে পারে, পাঁচিল টপকে আমাকে কামড়াতে পারে ভেবে আটকে রেখে গেছে। ছোড়দি নেই, স্কুলে গেছে, গাড়িটা ফিরে এলে, সাহেব-সুবো মানুষ বের হয়ে গেল গেট দিয়ে। খাটিয়ায় শুয়ে থাকলে খারাপ দেখাতে পারে ভেবে গাছের নিচে খুব অবলা জীবের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। ছোড়দির যখন এত প্রতাপ, তার বাবা কিনা জানি একজন। আমাকে দেখে তিনি যখন কিছু বললেন না, তখন কেন জানি মনে হল ফাঁড়া কেটে গেল। এখন ছোড়দি ফিরে এলে শুধু বলে রাখা, আমি মাত্র কুড়িটা টাকা চুরি করেছি। টাকাপয়সা হলে ফেরত দেব। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। কান মলছি, আর কখনও এ কাজ করব না। আমাকে আর যাই কর, পুলিসে দিও না। পিলু জানতে পারলে ক্ষেপে যাবে। 

এই সব সাত পাঁচ ভাবনা—যার খাচ্ছি, তার তো কিছু কাজ করা দরকার। ঘরটা খুলে ঝাঁট দিলাম, কুঁজোতে জল রাখলাম—রহমানদা এসে সব দেখে যেন খুশি হয়—আর একটা বড় কাজ করে যাচ্ছি ফাঁকে ফাঁকে—সেটা ঘড়িতে সময় দেখা—লুঙ্গি, গামছা নিয়ে চানও করে আসা গেল। দশটায় পাড়েজী গেলে আবার রাগ করতে পারে পা বাড়িয়েই রেখেছ! তার চেয়ে আর একটু পায়চারি করলে সময়ও কাবার হবে, ক্ষুধারও ষোল আনা বেগ আসবে। পায়চারি করার পক্ষে উঠোনটা প্রশস্ত। পুবে-পশ্চিমে পা ফেলে দেখলাম ছাব্বিশ বার, উত্তরে-দক্ষিণে আঠারোবার। আরও দশ দফে উত্তর- দক্ষিণ, পুব-পশ্চিম আপাতত করা যাক। করা শেষ হলে দৌড়ে গিয়ে ঘড়িটা দেখলাম—মাত্র চার মিনিট। মিনিটে এতটা হাঁটা যায়, এর আগে কখনও জানতাম না। বুঝতে পারছি, ক্ষুধার বেগের তালে হাঁটার বেগ জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে বরং এই ধরনের বেগ নিয়ে পৃথিবী পরিক্রমা করতে কত সময় লাগতে পারে, তার গণিত সেরে রাখা ভাল। পৃথিবীর পরিধি জানা, তাকে গুণ, ভাগ করলে সময়টা পাওয়া যাবে। এতে সময়ও পার করা যাবে অনেকটা। অর্থাৎ এগারোটায় গেলে পাঁড়েজী খুব একটা বেশি রাগ করবে না। বসে বসে অঙ্কটা সেরে ফেলাই যুক্তিযুক্ত। উঠোনের মাটিতে একটা কাঠি দিয়ে অঙ্কটা করতে গিয়ে দেখা গেল, সারা উঠোন যোগ-ভাগে ভরে যাচ্ছে— কিন্তু অঙ্কটা মিলছে না। এই সমস্যাটা তৈরি হওয়ায় বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া গেছে, টেরই পাই নি। যখন পিছুতে পিছুতে পিঠ পাঁচিলে ঠেকেছে তখন হুঁশ ফিরে এলকার জন্য এত বড় অঙ্ক, মনে পড়ে গেল দুটো আহারের জন্য। আর সঙ্গে সঙ্গে সব অর্থহীন। রাস্তায় এসে মনে হল, নেশার ঘোরে তালা দিতে ভুলে যাই নি তো। ফিরে এসে দু’লাফে দেখে যাওয়া গেল—তারপর কতটা দ্রুতবেগে মাঠ পার হয়ে পাড়েজীর দোকানে হেঁটে গেছলাম, টের পাই নি। শালপাতা জল দিয়ে ধুয়ে মুছে ঠিক করে বসে আছি। পাঁড়েজীর কত আপনজন আমি দেখুক। 

কিন্তু– 

কিন্তু কি? 

ভাত আসছে না কেন? 

আমায় সে বলল, জল খাও। 

পাঁড়েজী আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। 

এনামেলের গ্লাসে জল। ঢকঢক করে জল খেলাম। 

পাঁড়েজী আমাকে দেখে প্রথমে কিছুটা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল বোধহয়—অথবা চিনতে পারছিল না—কোথাকার কে হে, বলা নেই, কওয়া নেই, পাত পেতে বসে যাওয়া। তারপর চিনতে পেরে ‘ওফ’ শব্দ শুধু। 

আমি দেখেছি, বাবা শিষ্যবাড়ি গেলে কিংবা ঠাকুরের ভোগ হলে সব সময় অন্ন বলতেন। ভাত বলতেন না। গাম্ভীর্য রক্ষা করার প্রয়াসে বলতেন, অন্ন। কাজেই গাম্ভীর্য রক্ষার্থে বোধহয় অন্ন বলারই নিয়ম। আপাতত পাঁড়েজীর গাম্ভীর্য দেখে মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, ঠাকুর অন্ন। 

—কিয়া বলতা? কি বলছ? 

—অন্ন। 

–দশ আনায় অন্ন হয় না। 

—ঠিক আছে, দশ আনায় ভাতই হোক। 

—ভাতও হবে না। 

কেন হবে না বলার জোর আমার নেই। পাঁড়েজীর পাইস হোটেলে দশ আনার মিল তবে উঠে গেল! বসে থেকে বোধহয় লাভ নেই। আমার দিকে আর ফিরেই তাকালো না। এত আহ্লাদ করে ক্ষুধার বেগ বাড়িয়ে এই ফল। কোন রকমে, বললাম, দিন আজকের মতো। 

–পোষাবে না। 

এ বেলায় বেশ বাংলা বলে। পোষাবে না। মাথায় বজ্রাঘাত কাকে বলে এই প্রথম টের পেলাম। না খেয়ে আছি, থাকছি এক কথা—সয়ে যায়, কিন্তু আশা করে থাকা খাব, সময় হলেই ডাল, ভাত, মাছ, তরকারি সেই স্বপ্নের মধ্যে, যেন কত কাল ধরে শখ করে খাব কথাটা পুষে রেখেছি মনে- খাব অন্ন খাব—আর পাঁড়েজী বলে কিনা পোষাবে না। কত হলে পোষাবে আর বলার সাহস হল না। বেশি চাইলে দেব কোত্থেকে? দশ আনা বরাদ্দ মিলের জন্য। বেশি চেয়ে রহমানদাকে বিগড়ে দিলে অভিমানের জাত রক্ষা করার আশ্রয়টুকু পর্যন্ত যাবে। মানে মানে উঠে পড়াই ভাল। চারপাশে হালুম হুলুম শব্দ। পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে—কি যেন একটা লাইন বার বার মনে আসছে। খুব খিদে পেলে মানুষের বোধহয় চোখে জল আসে। বের হয়ে আসার সময় কেমন সব ঝাপসা দেখছিলাম— সামনের মাঠটা সহসা কেন যে এত কুয়াশায় ছেয়ে গেল। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাম। মাঠটা বেশ বড়। দুটো ন্যাড়া বেলগাছ পার হয়ে রাস্তা। রাস্তা পার হলে কাঁচা নর্দমা, খুপরি ঘর, লরি- টেমপোর গ্যারেজ। সারি সারি ট্রাক। তারপরই গুরুদোয়ারা এবং বাংলোবাড়ির সদর। দু’দিনেই জায়গাটার মধ্যে একটা নিজস্ব ভাব এসে গেছে। খাটিয়ায় লম্বা হয়ে পড়ে থাকার বড় সুসময় এটা আমার। কিন্তু পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা, সে কেন মানবে? গুরুদোয়ারার কলে জল, সেখানে হাঁটু গেড়ে বসলাম। অনেকক্ষণ ধরে জলপান করতে হবে। আঁজলা পেতে আকণ্ঠ জল খেলাম। হা-অন্ন পেট এতটা জল সইবে কেন? কিছুটা বমি হয়ে সে তার নিজের সমতা রক্ষা করতেই ভাবলাম, ঠিক হয়েছে। ঢেকুর। জল খাবে, তাতেও রাক্ষুসেপনা। দশ আনায় মিল তোমার মিলবে কেন? এখন খাটিয়ায় শুয়ে পড়তে পারলে কথা নেই। নির্ভেজাল ঘুম। ঘুম মানুষের কত বড় সম্বল, এ সব সময়ে টের পাওয়া যায়। ঘুমিয়ে পড়লে মরা। কাকপক্ষীতে ভয় পায় না। আমার চারপাশটায় বিচিত্র সব পাখিরা এ সময়টা ওড়াউড়ি করবে জানি। ডাক খোঁজ করবে। —হ্যাঁরে ওঠ, খাবি না? কেউ যেন দূর থেকে তখন ডাকে। কে ডাকে। ঘুমটা লেগে আসছিল—কার মুখ। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ডাকছেন, ওঠ। খাবি না? কত বেলা হল রে! 

আমি যে না খেয়ে আছি, পলাতক জীবন, আমার কিছুই মনে আসছিল না। বাড়িঘর, উঠোন, ঠাকুরঘর যেন ডাকলেই পিলু দৌড়ে বের হয়ে আসবে, বলবে যাবি না দাদা, মাছ ধরতে যাবি না, কিংবা আরও দূরের খবর সে দেবার জন্য মুখ বার করে রেখেছে। চোখ কচলে যখন তাকালাম, দেখি সাদা রঙের গাড়িটা ঢুকছে। ছোড়দি ফিরল। ছোড়দি আমার দিকে তাকালও না। আমি যে আছি, কাল থেকে, ছোড়দি যেন ভুলে গেছে। গাড়িটা থামলে বলতাম, জান ছোড়দি, মানুষের স্বপ্ন কত সুন্দর হয়। পিলুটা দরজায় মুখ বাড়িয়ে আছে। কিছু একটা হলেই পিলুকে নিয়ে আসব। ও পাহাড় দেখে নি। তোমাকে নিয়ে আমরা দু’ ভাই একদিন কাছের পাহাড়টায় ঘুরে আসব। 

ছোড়দি কথা বলুক চাই না বলুক- আমার কিছু আসে যায় না। ছোড়দি এসে গেছে— বাড়িটার মধ্যে ছোড়দি আছে—ঠিক যেন কি থেকে যায় ছোড়দি থাকলে ঠিক কাউকে বোঝাতে পারছি না— অসীম হাহাকার সমুদ্রে একটা ছোট্ট দ্বীপের মতো ছোড়দি। ছোড়দিকে কখন যে কথাটা বলব। উঠে দু’বার পাঁচিলে উঁকি দিলাম। জানালা খুললে ছোড়দিকে বাগানের মধ্যে দেখা যেতে পারে—কিন্তু বারণ। সুতরাং একবার রোয়াকটায় উঠে আসা গেল—দেখলাম রোয়াকে উঠে বসলে বাড়ির ভেতরের অনেকটা দেখা যায়—কিন্তু ছোড়দিটা কোথায়? গাড়ি গ্যারেজে ঢোকাচ্ছে লোকটা—দেখা যায়, অথচ ছোড়দি কেমন অদৃশ্য। 

ছোড়দি আমার শত্রুপক্ষ, পুলিসের ভয় দেখিয়ে রেখেছে—সবই ভুলে যাই—কারণ এই প্রথম টের পেয়েছি, এবাড়িতে আমার জন্য কেউ জেগে থাকে— যাতে পালাতে না পারি, টাইগারকে সতর্ক করে দিয়ে যায়। সম্পর্ক মধুর নয়, তবু কোথায় যেন একটা টান বোধ করতে পারছি। সদ্য গাঁ থেকে আসা নোয়ার বংশধরের পক্ষে এই আশা কুহকিনী কত দূর নিয়ে যাবে, সে অবশ্য তা অনুমান করতে পারে না। তবু সখ্যতা, এবং নক্ষত্রের সংকেত-বার্তা মিলে ছোড়দি আমার এক ভয়ঙ্কর অরণ্য। সে কাছে এলে ভয় লাগে, দূরে চলে গেলে কষ্ট পাই। 

শরতের আকাশ এমনিতেই একটু বেশি নীল থাকে, আজ একটু বেশি গভীর নীল মনে হল। এগুলো কি মানুষের বড় হওয়ার লক্ষণ? এক অপরিচিতা বালিকার সঙ্গে দুটো কথাবার্তা তাও কত ভয়ের কথাবার্তা অথচ কেন যে সম্পর্কের গভীরে নিয়ত এক টান থেকে যায় এবং কখনও কিছুটা ঝড়ো হাওয়ার মতো কেউ যেন উঁকি দেয় পাঁচিলে। ছোড়দি টাইগারকে নিয়ে বের হয়ে পড়েছে রাউন্ড দিতে। এদিকেই ছুটে আসছে। হাওয়ায় ছোড়দির চুল উড়ছিল, ফ্রক উড়ছিল। কোথা থেকে এই প্রবল হাওয়া আসছে টের পাচ্ছি না। আমার কাছে এসে ঠিক উল্টো রোয়াকে বসে পড়ল। টাইগার পায়ের কাছে। সোজাসুজি বলল, গাছে উঠতে পারিস? 

পিলু পারে। আমি গাছে চড়তে ভাল পারি না। তবু বললাম, হ্যাঁ, গাছে চড়তে জানি। 

—লাফাতে পারবি? 

—হ্যাঁ পারব। 

—আয় তো। দেখি, কেমন লাফাস? 

ছোড়দি আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়। এখনই বলে দিলে হয়। ছোড়দির কুকুরটা টের পেয়েছে, আমি একটা চোর। চুরি করা পাপ না ছোড়দি? বাবা তো চুরি করাকে মহাপাপ মনে করে। চুরি করি নি ঠিক— 

—এদিকটায়। ওদিকে না। 

দু’ লাফে ছোড়দির বাগানের মধ্যে চুপি চুপি ঢোকা গেল। 

—ঐ দ্যাখ অকালের গোলাপজাম। পেড়ে আন। 

তাকিয়ে দেখলাম, অনেক উপরে গাছের মগডালে চাঁপা ফুলের মতো ক’টা গোলাপজাম ঝুলে আছে। বললাম, কী সুন্দর! 

গাছের মগডালে এক গুচ্ছ পাকা গোলাপজাম। মানুষের সাধ্য নয়—কিন্তু আমার অসাধ্য কাজ বলতে কিছু নেই। প্রাণ দিয়েও ছোড়দির কাছে ভালো মানুষ প্রমাণের দরকার। গাছটা সরু লম্বা, যেন আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যত উঠছি, তার চেয়ে বেশি নেমে আসছি। এত পিছল যার কান্ড সে কেন আমাকে সহজে রেয়াত দেবে। তবু রবার্ট ব্রুসের কথা মনে পড়ল। আমাদের পড়াশোনার সময় অমনোযোগী হলে বাবার দুটো আপ্তবাক্য সার ছিল। পারিব না কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার। তারপরই রবার্ট ব্রুসের গল্প। পড়াশোনার বিষয়ে দ্বিতীয় আপ্তবাক্যটি বিদ্যাসাগরমশাই। বই নেই –বিদ্যাসাগর, খাতা-পেনসিল নেই—বিদ্যাসাগর, আলো নেই—বিদ্যাসাগর। 

বড়ই রাগ হত, ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কেন যে একজন ঈশ্বরচন্দ্র রেখে গিয়েছিলেন বাবাদের জন্য। পড়ার কথা উঠলে রাস্তার গ্যাসের আলো থেকে দামোদর নদ পার হওয়া পর্যন্ত বাবা আমাদের সবটা না বলে নিস্তার দিতেন না। এতে করে বাবার প্রশান্তি বাড়ত। সব সদগুণই ছেলেরা পাবে এবং তুলনায় বাবা যে একজন ঠাকুরদাসের সর্বশেষ সংস্করণ, হাবে ভাবে তা প্রকাশ করতে চাইতেন। 

গাছ থেকে নেমে দেখলাম, জামা-প্যান্টের খানিকটা গাছে এবং ডালে। সঙ্গে শরীরের কিছু ছাল- চামড়া। গোলাপজাম পেড়ে হাতে দিলে ছোড়দি বলল, শীগগির পালা, মা আসছে। 

গাছ এবং আগাছার জঙ্গলে পুকুরের এদিকটায় ভর্তি। মাথা নুয়ে দৌড়। পকেটে দুটো গোলাপজাম। ছোড়দির অলক্ষ্যে রেখে দিয়েছি। গাছে থাকতেই নিরন্ন পেট এবং নীতিবোধের ঠোকাঠুকি হচ্ছিল— কখন হাতসাফাই হয়ে গেছে টের পাই নি। ছোড়দি যদি পকেট সার্চ করত— ভয়ে কেমন কাঁটা হয়ে গেলাম। তারপর দৌড়। কারণ চারপাশে মানুষজন, চুরি করে গোলাপজাম খাচ্ছি—কে কোথা থেকে টের পাবে—একটু নিরিবিলি জায়গা হলে ভাল হয়। বারবার পেছনে তাকাচ্ছি। বাড়িটা, মায় তার গাছপালা যতক্ষণ না অদৃশ্য হল, ততক্ষণ পর্যন্ত থিতু হতে পারলাম না। শেষে মনে হল, নিরাপদ দুরত্বে এসে গেছি, এবং শরীরও আর দিচ্ছে না। সন্তর্পণে খেলে কেউ টের পাবে না। একসঙ্গে দুটোই মুখে পুরে প্রায় গিলে ফেলার মতো—তারপর মুখ মুছে ভারি নিরীহ ছোকরা হেঁটে যাচ্ছে, মুখে চোখে এমন অভিনয় ফুটিয়ে হাঁটা দিতেই টের পাওয়া গেল, ছাল-চামড়া ওঠা জায়গাগুলো জ্বলছে। আর চকিতে দশ আনা পয়সার যে মালিক আমি, পকেটে আছে তো, দেখতেই সব ফাঁকা। দৌড়ঝাঁপে কোথায় ছিটকে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ইস্ শব্দ বের হয়ে এল মুখ থেকে। কি বোকা আমি, দশ আনায় মিল না হোক, পাঁউরুটি জিলিপী, মিষ্টি, মিহিদানা কত কিছু খেতে পারতাম। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, ভাতখেকো বাঙ্গালের মিল না খেয়ে মাথাটা গোলমাল হয়ে গেছে। 

দশ আনা পয়সা এখন সারাটা রাস্তায় খোঁজা। কিন্তু যদি পয়সা ক’টা ছোড়দির বাগানে পড়ে গিয়ে থাকে। সেখানে তো একা যাবার নিয়ম নেই। তবু যে পথে আসা গিয়েছিল, ঠিক ঠিক পথটা অনুসরণ করে আসা গেল। রাংতা এবং নাট-বল্টু যাই দেখি উবু হয়ে তুলে নিই। না, সবই আশা কুহকিনী। বাবার ঠাকুরদাস হওয়ার মতো। এমন একজন পিতৃদেব কি করে যে আমাকে মোটর ড্রাইভার করার কথা শেষ পর্যন্ত ভেবেছিলেন। কারণ ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে একজন ড্রাইভারের তুলনামূলক সম্পর্কের কথা ভাবলে নির্বুদ্ধিতা বৃদ্ধি পেতে পারে—সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। ঐ তো কি চকচক করছে। টী-ষ্টলের পাশটায় না, সোডার বোতলের ছিপি। একটা আস্ত সিকি যেন—আসলে পয়সা ক’টা কত দুর্লভ বস্তু, আমার চোখ না দেখলে তখন কেউ টের পেত না। একটা আবর্জনার ঢিবিতে লাফিয়ে গেছি, সেখানে বসে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করা গেল। তবু নিরাশ হতে শিখি নি না পারিলে দেখ শতবার। এই শতবার করতে গিয়ে কখন যে বেলা পড়ে গেছে, কখন ডুবন্ত জাহাজের হতাশ নাবিকের মতো খাটিয়ায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছি, টের পাই নি। আকাশে চাঁদ উঠেছে, বাংলোবাড়িটায় মিউজিক বাজছে—কোথাও হাউই গুড়ছে—পৃথিবীতে মানুষের অনন্ত সুখ, শুধু আমার কাছেই সে মুখ ফিরিয়ে আছে। কবে যে সদয় হবে— 

রহমানদা ফিরে আমাকে দেখল শুয়ে আছি। পালাই নি, এতেই তার মুখ উজ্জ্বল। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ঘরের সব কিছু ছিমছাম দেখে খুব খুশি। তারপর আমার মুখের দিকে তাকাতেই কেমন বিস্ময়—হ্যাঁরে, তোর চোখ-মুখ কোথায় গেছে? কি হয়েছে তোর? মুখ এত শুকনো কেন? 

সারাটা দিন যা গেছে, সব বললে বিশ্বাসই করবে না। মানুষের এত হুজ্জোতি হয়, তার ধারণায় হয়ত নেই। খাই নি বলতে গিয়ে গলাটা কেমন বুজে এল। অভিমান এত যে আমার কোথা থেকে আসছে! বুঝি, সব মানুষের উপর অভিমান। মা-বাবা, পাঁড়েজী এমন কি পিলুটা পর্যন্ত আজ আমার শত্রু। পিলু যদি এক-আধ দিন শহরের সেই গ্যারেজে দেখা করতে যেত, তবে হয়তো পালাতাম না। পিলুরও যে অভিমান হতে পারে, তার দিগ্‌বিজয়ী দাদাটা শেষ পর্যন্ত মোটর গ্যারেজে ঝুল- কালি মেখে একটা ক্লিনারের কাজ করছে—সহ্য হবে কেন? পিলু তো কত দিন বলেছে, তুই দাদা যখন বড় হবি, কলেজে পড়ে এইয়া বড় মানুষ হবি, তখন আমাদের কোন দুঃখ থাকবে না। সেই মস্ত বড় দাদাটা কিনা গ্যারেজে কাজ করতে রাজী হয়ে গেল! 

—কী হয়েছে বলবি তো? রহমানদা জুতো মোজা খুলে, হাতঘড়ি খুলে ভেতরের ঘরটায় রেখে এল।

—পাঁড়েজী খেতে দেয় নি। 

—ঝগড়া করেছিস? 

—না-না। বলল, দশ আনায় মিল হবে না। 

—মগের মুল্লুক। সহসা একটা ধনুকের ছিলা কেটে গেলে যেমন হয়, রহমানদা সেরকম সোজা হয়ে বলল, চল তো, শালার থুতনি নেড়ে দেব। 

—ওর দোষ নেই দাদা তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। 

এমন কথায় রহমানদা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল—তবে কার দোষ? 

—আমারই। 

—তোর মানে তুই কি কিছু…. 

—না, না। আমি কিছু চুরি করি নি। মানে… 

—চুরি। চুরি করবি কেন? চুরির কথা আসে কি করে? এতটুকুন একটা ছেলেকে পারল, না খাইয়ে রাখতে? 

—না পোষালে কি করবে? 

—তোর কোন কথা বুঝতে পারছি না। বলে ফের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। দশ আনা পয়সা সোজা! দশ আনায় সব জায়গায় মিল দেয়, ও দেবে না মানে? তুই ব্যাটা জরু-গরু বৌ ক্ষেত সব করবি আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে আর মিল দেবার বেলায় জুচ্চুরি। পাষন্ড কোথাকার। হারামির সব ক’টা দাঁত যদি তুলে না দিই। ইস, সেই থেকে না খেয়ে আছিস? 

প্রায় আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। আমার কোন কথাই কানে তুলছে না।

দোকানের সামনে গিয়ে রহমানদা হাঁক পাড়ল, পাঁড়েজী— 

—আজ্ঞে যাই জনাব। 

কী ভাল মানুষ! 

—তুমি ওকে খেতে দাও নি? 

বুঝতে পারছি, রহমানদা ক্ষেপে গিয়ে হয়ত এখন তুই তুকারি করবে। এতটা আমার ভাল লাগছিল না। ভিতরে আবার মজাও পাচ্ছিলাম। একটা কুকুর থাকলে, আরও ভাল দেখানো যেত। লুঙ্গি খুলে দিতে পারত। 

—দিচ্ছি। 

—ও পেট ভরে খাবে। কত লাগবে তোমার? 

—যা খায়, চোদ্দ আনা লাগে জনাব 

লোকটা একেবারে বাঙালী হয়ে গেছে দেখছি। 

—তাই দাও। মাছের মুড়ো আছে? 

—আছে। 

—টক? 

—আছে? 

—দুটো মিষ্টি? 

—দেব। 

—সব মিলে কত? 

—এক টাকা। 

—ব্যস তো এই কথা। দেখবে নড়েচড়ে বসেছ তো আগুন ধরিয়ে দেব চালায়। পাঁড়েজী একটা “হাতল ভাঙা চেয়ার টেনে এনেছে। খুব বিনয়, বলছে, বসুন রহমান সাব। কি খায় দেখুন! তারপর রাগ করতে হয় করবেন। 

—তাই দেখব। এই বিলু, পেট ভরে খাবি। তুই এমন কি খাস যাতে ওর পোষায় না। আর যদি দেখি লজ্জা করছিস খেতে, লাথি মেরে তাড়িয়ে দেব। 

এমন উভয় সংকটে জীবনে কমই পড়া গেছে। বিশ্বস্ততা রক্ষা করা আগে দরকার। পেট ভরে খাব। সেটা আকন্ঠ হবে। এবং আর যাই করি, কোন কারণে রহমানদার সঙ্গে অবিশ্বাসের কাজ করতে পারি না। বড় আসনে আসন পিঁড়ি হয়ে বসা গেল। অনেক দিন পর ভোজের খাওয়া। গন্ডুষও করা গেল। অর্থাৎ খাবার আগে দেবতারা তুষ্ট হোন, পেল্লাই জবরদস্ত ভোজ—যত দেয় তত খেয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখছি পাড়েজীর চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠছে। এদিক থেকে রহমানদা বলছে, ওর ভাত লাগবে। এই ঠাকুর তোমার কি বাতে ধরেছে, হাতায় ভাত ওঠে না কেন? বিলু চালিয়ে যা। 

যত বলছি আর লাগবে না, তত রহমানদা বলছে, লাগবে। তুই খা তো। ব্যাটা পেট ভরে খেতে পর্যন্ত দেবে না। কুনজুস। পাপ হবে না। মানুষকে কখনও আধপেটা খাইয়ে রাখতে হয়? না খাইয়ে ফিরিয়ে দিতে হয়? চিল্লাচিল্লিতে আরও দশটা লোক জমে গেছে। রহমানদা দুপুরের ঘটনা সবিস্তারে বলছে। বলুন, বেটা তুই কোন মুলক থেকে এয়েছিস পয়সা কামাতে, পয়সা কামা, বারণ করেছে কে? তাই বলে এমন নিষ্পাপ ছেলেটাকে না খাইয়ে রাখা। আপনারা বলুন, দশ আনায় মিল হয় কি না? সবার যদি হয়, ওর হবে না কেন! 

সঙ্গে সঙ্গে ওরাও সায় দিচ্ছে— রহমান সাব, এক পয়সা বেশি দেবেন না। যেমন দেশের গরমেন্ট, সব শালা লুটেপুটে খেতে এসেছে। এক পয়সা বেশি দেবেন না। 

রহমানদা বেশিই দিল। পুরো এক টাকা। এতটা খেয়েছি যে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। রহমানদা বলল, বোস। আমি আসছি। বোধহয় রহমানদা তার রাতের সিগারেট আনতে গেল—কিংবা ওদিকটায় যে সার্বজনীন হোটেল আছে সেখানে খেতে চলে গেল। আমি বসে থাকলাম। 

রহমানদা ফেরার সময় দুটো পান নিয়ে এসেছে। খা, খেলে হজম হবে। পাঁড়েজী অন্য খদ্দের সামলাচ্ছে। ভয়ে রহমান কিংবা আমার দিকে তাকাচ্ছে না। একা পেলে লোকটা কি করবে কে জানে? রাস্তায় বললাম, কাল খেতে দেবে তো? 

—ওর বাপ দেবে। আরে তুই কি! না খেয়ে থাকলি। পয়সা তো ছিল, অন্য কোথাও কিছু খেয়ে নিতে পারলি না? 

দৌড়ঝাঁপে পয়সা হারিয়েছে, ছোড়দির বাগানেই পড়েছে পয়সা ক’টা, কাল খুঁজলে পেয়ে যাব। পয়সা হারিয়েছি বলতে সাহস হল না। 

রহমানদা রোয়াক পার হবার সময় বলল, কেউ এসেছিল? 

—না। 

—জামাপ্যান্ট ছিঁড়লি কি করে? 

—ছোড়দির গোলাপজাম পাড়তে গিয়ে। তারপর রহমানদা যদি প্রশ্ন করে, গাছে উঠলি কখন? পয়সা ক’টা দে। রেখে দি। বলে ফেলাই ভাল—রহমানদা!

ঘরে ঢুকে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল—কিছু বলবি? 

—গাছে উঠতে গিয়ে পয়সা ক’টা কোথায় পড়ে গেছে।

–তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। খুঁজেছিলি? 

—হ্যাঁ। পাই নি। বাগানে আছে মনে হয়। 

—কাল খুঁজে দেখিস। 

—ঢুকতে দেবে? 

—ছোড়দিকে বলে দিয়ে যাব। পয়সা হল গে মানুষের ইজ্জত। যেখানে সেখানে তাকে হারাতে নেই। ঠিক এই সময়ই কড়া নাড়ার শব্দ। 

এই খুলিস না। কেমন ফ্যাকাসে মুখ রহমানদার। বলল, কে? 

—আমি 

—আমিটা কে? 

—পাঁড়ে রহমান-সাব। 

—অঃ। আসুন। 

ভিতরে এলে বলল, বসুন। 

—বৈঠেগা নেহি। আপনি মেহেরবান আদমি। 

—তা বুঝছি। টাকা পয়সা এখন নেই। 

—ও বাত নেহি। 

—তবে কি বাত আছে? 

পাঁড়েজী আমার দিকে চশমার উপর দিয়ে তাকাল। চোখ দুটো পিটপিট করছে। গোবদা মুখ, ঝাঁটা গোঁফ। গলায় ঢোলের মতো তাবিজ। তাগা কনুইতে বাঁধা। চেহারাতে রাম নাম সত্ হ্যায় হয়ে আছে। 

—আজ্ঞে, রহমান সাব বলছিলাম… 

—বলে ফেলুন না। 

—দশ আনা আচ্ছা থা সাব। 

—মানে 

— চোদ্দ আনা মিল দিলে পোষাবে না সাব। বহুত খা লিয়া। 

—কতয় পোষাবে? 

—না বলছিলাম, আপনার না যায়, হামার ভি না যায়। খাস বাত এক—দশ আনাই। দশ আনা দিলেই হবে। 

—এত সুমতি! 

—সুমতি না সাব, বাত এই হ্যায় ও ভি দশ আনা খাবে। হাম ভি দশ আনা মিল দেবে। চুক্তি বাতিল হলে আবার কোথায় গিয়ে পড়ব কে জানে? যা দশা চলছে। বললাম, রহমানদা, ঐ কথাই থাক। 

—মানে? 

—দশ আনা মিল। 

—পেট ভরবে? 

–খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে যাবে? ক্ষুধার সঙ্গে কিছুটা চোখের খিদে আছে, ওটা আর বিশদ করে বোঝালাম না। আমার কথা পেয়ে পাড়েজীর হাতে স্বর্গ মিলে গেল। 

—খোকাবাবু বহুত ইমানদার আদমি আছে সাব। হাম চলে। রাম রাম। 

চোদ্দ আনায় আমার আকণ্ঠ খাবার স্বাধীনতা রহমানদা দিয়েছিল। পাঁড়েজীর এত বড় স্বাধীনতা পছন্দ নয়। সে আমার সেটুকু হরণ করে দিব্যি রাম নাম বলতে বলতে চলে গেল। 

সকালে আজ ঘুম থেকে রহমানদার আগেই উঠেছি। রহমানদা সকালে উঠে ঘরের কাজকর্ম কিছু সেরে রাখে। কুঁজোতে জল রাখা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, কিছু কাচাকাচি থাকলে তাও। জানি না, কেন মানুষটাকে অত্যন্ত কাছের মনে হচ্ছে দিন দিন। বিশ্বস্ত থাকার চেয়ে বড় কাজ কিছু নেই। কী পরিবারে, কী বাইরে। বাবার কথা। রামায়ণ থেকে মহাভারত থেকে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ। যিনি অন্ন দেন, তিনি ঈশ্বর। জমিদারী সেরেস্তায় বাবা কাজ করতেন—জমিদার মানুষটি তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ। 

কাজেই এখানে যিনি অন্ন দিচ্ছেন, তাঁর কাছে আমার কিছু ঋণ থেকে যাচ্ছে। গৃহকর্ম করে আপাততঃ সে ঋণ থেকে আংশিক মুক্তিলাভের উপায় খুঁজছি। ঘুম থেকে উঠে রহমানদা আমাকে এ সব করতে দেখে ভারি ক্ষেপে গেল বের হয়ে যা। এক্ষুনি বের হ বলছি। তোকে বলেছি কাচাকাচি করতে? নিকালো হিয়া সে। 

খুব কাতর গলায় বললাম, সরাদিন বসে থাকতে ভাল লাগছে না। 

রহমানদা এ দু’দিনে আমার মোটামুটি পরিচয় জেনে নিয়েছে। তমাকে যে নবমী দা-ঠাকুর বলে তাও। বাবার কিছু কথাবার্তা তাকে আমার সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বোধহয় শিখিয়েছে। অবস্থা বিপাকে আমরা গরিব হয়ে গেছি, এবং এ সব কারণেই বোধহয় বাড়াবাড়ি করতে সাহস পেল না। বলল, ঠিক আছে, কাল থেকেই কাজে লেগে যা। নিমতা যাবি। গড়ি আসবে। গাড়িতে যাবি। 

—কখন যাব? 

—বিকেলের দিকে তুলে নেবে। তোর জামাপ্যান্ট জুতোর দরকার। ভাল হয়ে থাকতে শেখ। দুপুরের দিকে রহমানদা আমাকে নিয়ে কিছু সওদাপাতি করল। তখনই কথায় কথায় বলল, আমি এক রকমের, তুই আর এক রকমের। তুই দেখছি তোর বাবার স্বভাব পেয়েছিস। আরও জানলাম, ওর দু’রকমের ব্যবসা আপাতত আছে। কোলিয়ারি থেকে কয়লা আনা আর পারমিটের পেট্রল ব্ল্যাক করা। বাবুদের পয়সা দিলেই পারমিট। পারমিট বেচলে পাঁচ-সাতশো টাকা হয়ে যায়। পুলিস, সরকারী বাবু, সবাই অংশীদার। রহমানদার পয়সার অভাব নেই। লেখাপড়া শিখে যদি মানুষ অধর্ম করে, চুরি-চামারি করে, তবে লেখাপড়া না-শেখা মানুষের আর ধর্ম থাকে কোত্থেকে। কাজেই এ-সব কাজে তার কোন পাপবোধ নেই। 

এটা যে খুব একটা অধার্মিক কাজ, আমারও তেমন মনে হল না। কারণ বিষয়টা প্রথমে ভারি গোলমেলে। যুদ্ধের সময়কার কথা। ব্ল্যাক-মার্কেট শব্দটি তখন আমাদের শোনা। বয়সে খুব বাচ্চা, ব্ল্যাক-মার্কেট করে টাকা কামাচ্ছে কথাটা চুরি-চামারির পর্যায়ে পড়ত না। বরং যুদ্ধের কালোবাজারী একজন মানুষের পিতৃশ্রাদ্ধে যে এলাহি ভক্তির প্লাবন দেখেছিলাম, তাতে তার ধর্মবোধে এখনও বিস্মিত হই। ফলে রহমানদার ধর্মাধর্মে কিছুটা খামতি আছে, আদৌ বিষয়টা আমাকে স্পর্শ করল না। মানুষটা সোজাসুজি কথায়—বরং অনুরাগ আরও বেড়ে গেল। বললে জীবন দিতে পারি এমন অবস্থা। 

সেদিন বিকেলের দিকটায় সেজেগুজে বসে আছি। এ সময়টাতে প্রায়ই আমার চোখ বাংলোবাড়িটায় গিয়ে পড়ছে। সকাল থেকে আজ ছোড়দি-কে দেখি নি। ইস্ত্রি করা জামাপ্যান্ট পরে কেমন দেখাচ্ছে, যদি ছোড়দি দেখত। দেখলে বোধহয় আর আগের মতো কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেবার সাহস পাবে না। দেখা হলে, বাগানে যেতে পারতাম। কবে থেকে বাগানে পড়ে আছে দশ আনা পয়সা। কেউ নেই দেখছি। এমন কি, মালীটা যে ওদিকে কি টুকটাক কাজ করে, সেও নেই। কুকুরটার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচিল টপকে পালিয়ে দেখে এলে হয়। যেই টপকেছি, আর কোত্থেকে সেই বিশাল কুকুরটা এসে হামলে পড়েছে। ভয়ে কাঁটা। হাত তুলে দাঁড়িয়েছি। দৌড়ে আসছে কেউ। তাকে চিনি না। বাড়িতে কে কোথায় থাকে টের পাওয়া ভার। এসেই খপ করে হাত ধরে ফেলল, ক্যারে তুই?

যত বলি আমি বিলু, ছোড়দি আমাকে চেনে, তত লোকটা ক্ষেপে যায়। টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। যত বলছি, গোলাপজাম পাড়তে গিয়ে আমার পয়সা হারিয়েছে, তত লোকটা রেগে যায়। এত রাগ থাকলে মানুষ যায় কোথা? 

সিঁড়ি ধরে উঠতেই বিশাল বারান্দা, একদিকে চিক ফেলা। নানারকম পাথরের কাজ করা মেঝে। আমার কেন জানি বিশ্বাস- ছোড়দি আমাকে আর তাড়া করবে না। ভাল জামাকাপড় পরলে মানুষের অন্য রকম চেহারা হয়ে যায়। ভিতর থেকে কেউ ছুটে আসছে—কে ঢুকে ছিল রে বাগানে? 

—এই ছোঁড়াটা মা। 

ছোড়দির মা! এত সুন্দর। কেমন বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। দূর থেকে দেখেছি। ছবির মতো দেখতে পৃথিবীতে মানুষ জন্মায়, ছোড়দির মাকে দেখে প্রথম সেটা বিশ্বাস হল। আর কি জানি, জানি না, আমার পোশাক-আশাক দেখে ছোড়দির মা যেন কিছুটা বিড়ম্বনার মধ্যেই পড়ে গেছে—তুমি খোকা বাগানে? 

—পয়সা পড়েছে।

–পয়সা! 

—ছোড়দি জানে। 

—ওর তো জ্বর। দাঁড়াও দেখছি। কিসের পয়সা? বলে ফের ঘুরে দাঁড়ালেন। কুকুরটা বারান্দায় এখন লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। লোকটা আমাকে ছোড়দির মার হেপাজতে রেখে কোথায় হাওয়া। ছোড়দির মা বুঝতেই পারছে না আমিই সেই বাঙ্গাল। 

কী বলি! কারণ গোলাপজাম পাড়তে গিয়ে পয়সা ক’টা বাগানে পড়তে পারে বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। আসলে একটাই ইচ্ছে আমার—যা হয় হোক, ছোড়দি আমাকে দেখুক। ভাল জামাপ্যান্ট পরলে আমিও যে কম যাই না, এবং এতক্ষণে মনে হল, পয়সা খোঁজার অজুহাতে এ বাড়িটার মধ্যে আমি ঢুকতে চাইছি। কিন্তু ছোড়দির জুর—কেন জ্বর হল, বড় চঞ্চল ছোড়দি- তার যদি জ্বর হয় কি হবে? ছোড়দির মা আমাকে চুপচাপ দেখে হঠাৎ বললেন—কে আছিস রে? রুমকিকে পাঠিয়ে দে তো। 

ছোড়দি পুরু হাতা জামা, লম্বা পাজামা পরে অনেক দূর থেকে যেন হেঁটে আসছে। গায়ে নরম উলের চাদর। আর আশ্চর্য উষ্ণ এক ঘ্রাণ সঙ্গে বয়ে আনছে। কাছে আসতেই কেমন চমকে উঠল ছোড়দি—আমাকে দেখে! বিশ্বাস হল না, সেই বাঙ্গালটা। কাছে এসে বলল—তুই? বলে বেশ নরম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। 

—ছোড়দি? 

ছোড়দি কেমন চকিত চোখে ফের তাকাল। 

—পয়সা হারিয়েছি। 

—কোথায়? 

—তোমার বাগানে! 

—কখন? 

—সেই যে গোলাপজাম পাড়তে গিয়ে। খুঁজে দেখব? 

ছোড়দির মা ভিতরে ঢুকে গেছেন। ছোড়দি কি খুঁজল যেন, তারপর বলল—আয়। ভিতরে আয় না।

আমার ভারি সংকোচ হচ্ছিল। বাবার জমিদারের প্রাসাদ আমি দেখেছি, কিন্তু এত ছিমছাম নয়। সব কিছু সাজানো, এতটুকু ধুলোবালি কোথাও নেই। মেঝেতে আমার প্রতিবিম্ব ভাসছে। হলুদ নীল রঙের দেয়াল, লতাপাতা আঁকা পর্দা হাওয়ায় উড়ছে। একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল – বোস, আসছি। তারপর মা মা করে ডাকতে থাকল। 

মা এলে বলল—এই সেই বাঙ্গাল মা, রহমানের কাছে থাকে। 

ছোড়দির মা কি ভেবে বললেন—বাঙ্গাল বলে কী মানুষ না? আমার দিদিমা তো শুনেছি বাঙ্গাল ছিল। জানিস, বাঙ্গালরা দেখতে খুব সুন্দর হয়। দিদিমার মায়ের কি রঙ ছিল। আমি আর তার কী পেয়েছি? 

ছোড়দির সান্নিধ্য আমাকে ভারি আপ্লুত করছিল। ছোড়দি আমাকে তার ঘরে নিয়ে বসিয়েছে। কত সব জিনিস। একটা বাক্সে কি ঢাকা দেওয়া—কিছুই চিনি না। টেবিল চেয়ার বই আলমারি, সব কিছুতেই আমার কৌতূহল—এটা কি ছোড়দি? 

ছোড়দি বলল—রেকর্ড প্লেয়ার। 

—কি হয় 

—গান। শুনবি? 

—দেখব। 

–দ্যাখ না। 

–কত বই, না ছোড়দি? এত বই তুমি পড়েছ। 

–এগুলো তো সব গল্পের বই রে। 

—কখন পড়তে হয়? স্কুলে পড়লে এ সব পড়া বারণ নয়? 

—বারণ হবে কেন? 

ছোড়দি ছোট্ট সবুজ সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়ল। 

এত বই ছোড়দিকে তার বাবা কিনে দিয়েছে। বললাম—এ ঘরের সব কিছু তোমার? 

–সব। 

পৃথিবীতে ছোড়দি এত সব শৌখিন জিনিস নিয়ে বড় হচ্ছে। ছোড়দির বর কি রকম হলে মানায়, আমার ধারণায় আসছিল না। বললাম—ছোড়দি, যাবে? 

—কোথায়? 

—পয়সা ক’টা খুঁজে দেখব। পয়সা নাকি হারাতে নেই! 

—কি হয় হারালে? তুই কি বোকা রে। তোর কথাবার্তা শুনলে হাসি পায়। কবে পয়সা পড়েছে, এতদিনে মনে পড়ল। 

—পয়সা হারালে নাকি মানুষের ইজ্জত যায়। 

—ধুস। আমার তো কিছু ঠিক থাকে না। মা কত বকে। 

তখনই মনে হল, ছোড়দির সঙ্গে এক ঘরে বসে এতক্ষণ কথা বলা উচিত হচ্ছে কি না। লাই দিলে ঘাড়ে চড়ে—এমনও তো ভাবতে পারে। বিচারবুদ্ধি সজাগ রাখা ভাল। বললাম- ছোড়দি, আমি বরং উঠি। তোমার জ্বর- 

—বোস না। বিকেলের জলখাবার হচ্ছে। 

বিকেলের জলখাবার বিষয়টি আমার মাথায় ঠিক আসছে না। লোকে সকালে জলখাবার খায়। দুপুরে পেট ভরে, রাতে পেট ভরে খেতে হয়। আমরা ভাই-বোনেরা দেশের বাড়িতে থাকতে তিন- বেলাই পেট ভরে ভাত খেতাম। জলখাবার খেত বড়রা। তাও সকালে। 

বললাম, বিকেল কে আবার জলখাবার খায়? যেন বড়ই অনাসৃষ্টি কারবার। বড়ই নিয়ম-বহির্ভূত কাজ। 

আর তখনই দেখি গরম লুচি ভাজা দু’প্লেট, বেগুন ভাজা, এক গ্লাস করে জল। মীনা করা গ্লাসগুলি সাজিয়ে রাখা হল। ছোড়দির সঙ্গে আর কেউ খাবে। এ সময় আমার থাকা ঠিক না। হ্যাংলা ভাবতে পারে। ছোড়দি জলখাবার খেয়ে হয়ত বাগানে যাবে। এজন্য বসতে বলেছে। কাজেই খুব সঙ্কোচের সঙ্গে বললাম, ছোড়দি, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। তুমি খেয়ে এস। 

—তোরটা কে খাবে? 

এতটা আমার সাহস নেই, অথবা ভাবতে পারি, কেউ আমার জন্য গরম লুচি ভেজে বসে থাকতে পারে? প্রথমে ভুল শুনতে পারি, এমন মনে হল। আমার এখন কিছুতে বিশ্বাস নেই। আশা করেছিলাম ছোড়দি পোশাক দেখে বলবে, ভারি মানিয়েছে তোকে। কিছুই বলে নি। যেন আমার পক্ষে যা স্বাভাবিক, আজ তাই পরে এসেছি। এতদিন শুধু আমার নাটক গেছে। 

লুচির প্লেটটা থেকে ভারি সুঘ্রাণ আসছে। পাশে দুটো মিষ্টি। কোনরকমে সামলে বললাম, আমাকে খেতে বলছ? 

—তবে কাকে? 

—না। মানে ভুল হচ্ছে না তো? 

ছোড়দি এবারও ভাবল, ঠাট্টা করছি। উঠে এসে বলল—মারব এক থাপ্পড়। খা তো। 

এ সব বিষয়ে প্রথমে নানা সংশয় দেখা দেয়। প্রথম কথা, আমি কে? আমাদের বাড়িতে ছোড়দির মত বয়েস হলে বিয়ের কথা ওঠে। আমার এবং ছোড়দির বয়সটা বোঝাবুঝির মাঝখানটায়। কিছুটা এগিয়ে এসেছি। সবটা হয় নি। কি এক রহস্য, ঠিক বুঝতে পারি না, তবু টানে। প্রকৃতি আমাদের সামনে জাদুকরের গালিচা পেতে রেখেছে। শুধু আজীবন তা হেঁটে পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা। ছোড়দি-কে বললাম, তুমি সাইকেল চড় কেন? যেন এই যে খাওয়া, এখনই যথার্থ সময় সব ঝাল মিটিয়ে নেবার। 

—ছোড়দি বলল, তুই মেট্রিক পাস করেছিস? 

—সব বিষয়ে পাস করেছি। শুধু পাস নয়, সব বিষয়ে পাস। 

–তবে এত বোকা বোকা কথা বলিস কেন? 

–ছোড়দি ভয়ে। ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম সব বিষয়ে পাস না করা একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে। বাপস, এত ঝামেলা কে জানে? 

সব শুনে ছোড়দি হা হা করে হেসে উঠল। যত বলি হাসছ কেন, হাসার কি হল, তত ছোড়দি হাসতে হাসতে সোফায় লুটিয়ে পড়ছে। যত বলছি, আমার কি দোষ বল, আমাকে তো তিনিই একটা পছন্দমত কাজ দিতে পারেন। পড়তেও পারি, বাবা মাকেও খাওয়াতে পারি, কে না চায়? 

ছোড়দির হাসি থামছে না। আর মাঝে মাঝে ডাকছে—মা, শীগগির এস। বিলু কী কাণ্ড করেছে শোন। মা-মা- 

তিনি এলে, ছোড়দি আবার হাসতে থাকল—মা বিলুটা না, বিলুটা কোথায় গিয়েছিল জান? মা, ও না প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করবে বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। হাসছে আর বলে যাচ্ছে। শুনে দেখি তিনিও হাসছেন—তুই কী রে? তুই দেখছি সত্যি বাঙ্গাল। এবং আমার এমন পরিচয় পেয়ে তাঁরা কিছুটা বোধহয় আমার মধ্যে একজন সরল সহজ মানুষকে খুঁজে পেয়ে গেল। এই নিয়ে রহমানদা থেকে জজ মানুষটিও বেশ আমাকে নিয়ে মজা করল। এতে কি মজা আছে, আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। মানুষই তো মানুষের কাছে যায়। আর সে মানুষ যদি বড় হয়, তবে তার কাছে তো অনেকে যাবেই। দেশটা যে চালায়, মানুষগুলির ভাবনাও তো তার। এটা এমন কি হাসির কাজ হল ভেবে পাচ্ছি না। কেমন বোকার মত ওদের দিকে তাকিয়েছিলাম শুধু। 

ছোড়দি বললনে, খা। খেতে খেতে পাঁড়েজীর কথা উঠল। দশ আনা মিল ঠিক হয়েছে শেষ পর্যন্ত। শর্তের কথাগুলোও ছোড়দিকে বললাম। তা ছাড়া দুপুরে মিল পর্যন্ত দেয় নি লোকটা কি কুনজুস। ছোড়দি বোধহয় হেসে ফেলবে। না, আর বলা ঠিক না। সারাদিন না খেয়ে ছিলাম শুনলে আরও মজা পাবে। হঠাৎ দেখি তখন ছোড়দি ভারি গম্ভীর হয়ে গেছে। বলল, তুই না খেয়েছিলি? 

—তুমি আবার হেসে ফেলবে না তো? 

—যা বলছি, উত্তর দে। 

পুলিসের ভয়টা একবার উঁকি দিয়ে গেল। কুকুরটা কোথায় দেখছি। 

—কি, না খেয়েছিলি? 

—হ্যাঁ ছোড়দি। 

—খাস নি, বলিস নি কেন? 

—তুমি যে বললে পুলিসে দেবে? 

—কবে বললাম? 

—বা রে। মনে নেই? আমাকে ধরে নিয়ে আসার সময়। 

ছোড়দি আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল। ভয় লাগছে। এত সুন্দর ব্যবহার ছোড়দির মার, ফুলকো লুচি, বেগুন ভাজা, সন্দেশ, সব তবে যাবে। বললাম- খেয়েছি। দুটো গোলাপজাম খেয়েছি। তোমাকে সত্যি কথা বলাই ভাল। গোবিন্দদার কাছ থেকে পালাবার সময় কুড়িটা টাকা নিয়েছি। বলে নিই নি। বাবা তো বলেন, না বলে কিছু নিলে অপহরণ করা হয়। আমি সেজন্য লিখে রেখে এসেছি। টাকা মান যশ হলে সব ফেরত। ছোড়দি, আর যাই কর, পুলিসে দিও না। পিলু বাবা জানতে পারলে দুঃখ পাবেন। 

ছোড়দি কিছু বলছে না। তাকিয়েই আছে। চোখ দুটো ছোড়দির চকচক করছে কেন? কেমন জলে ভার। ছোড়দির এটা কি হচ্ছে? ছোড়দির চোখে জল—এই ছোড়দি, ছোড়দি, ঠিক আছে, আর বলব না। 

ছোড়দি কোন কথা না বলে উঠে চলে গেল। সমবয়সী যদি কেউ এভাবে চোখের জল ফেলে, আমার বড় খারাপ লাগে। ধুস, না বললেই হত। কেন যে বলতে গেলাম? ছোড়দি ফিরে এল কেমন অন্য এক ছোড়দি হয়ে। বলল — বিলু চল, তোমার পয়সা ক’টা খুঁজে পাই কিনা দেখি। ছোড়দি তার কুকুরের চেনটা এবার আমার হাতে দিয়ে বলল—শক্ত করে ধরে রাখ। তুমি যা মানুষ, যে কেউ তোমার হাত থেকে পালাতে পারে। 

সেই থেকে ছোড়দি কেমন অন্য মানুষ হয়ে গেল। সারাটা বিকেল গাছের নিচে, ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে শুকনো ডাল পাতার ভেতর পয়সা ক’টা খুঁজল। আমার কাছে পয়সা ক’টা কত দামী, ছোড়দির খোঁজা না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। কিছুই পাওয়া গেল না। 

বাড়ি থেকে এক সময় ছোড়দির মাও হাজির। বললেন—পেলি? 

ছোড়দি কিছু বলল না। 

যেন বড় একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে ছোড়দি। পয়সা ক’টা খুঁজে পেতেই হবে। আমি বললাম—যাক গে। রহমানদাকে বলব, খুঁজে পাই নি। 

ছোড়দির মা বললেন—আমার সঙ্গে এস। দশ আনা দিয়ে দিচ্ছি। রহমানকে দিয়ে দিও।

আমি বললাম— সেই ভাল। 

ছোড়দি কিন্তু আমার সঙ্গে গেল না। ছোড়দির মা পয়সা ক’টা দিয়ে চলে গেলে, ছোড়দি সামনে এসে দাঁড়াল। কেমন অপমানে থমথম করছে চোখ। ছোড়দিকে নিয়ে সত্যি পারা গেল না। জ্বর নিয়ে খোঁজাখুঁজি, তার চেয়ে এই ভাল-রহমানদাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে—তা না, কেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁসছে। বলছে, কেন নিলে বিলু? 

—কী হয়েছে? উনি তো ভালবেসে দিয়েছেন। 

–দাও, পয়সা ক’টা দাও। 

—তুমি নিয়ে নেবে? 

—হ্যাঁ। আমাদের পয়সা ভিক্ষা নেবে কেন? লজ্জা করে না! বলে প্রায় কেড়েই পয়সা ক’টা হাত থেকে নিয়ে নিল। যাবার সময় ক্ষোভে দুঃখে বলে গেল, দ্যাখনা আজই রহমানকে বলে দেব, তোমার বাবাকে যেন চিঠি লিখে দেয়। তিনি যেন তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। তারপর ছোড়দি যেমন গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, আজও তেমনি হারিয়ে গেল। 

খাটিয়ায় ফিরে কেমন হতাশায় ভেঙে পড়লাম। ছোড়দিকে কিছুতেই খুশি করা যাচ্ছে না। এই রোদ, এই বৃষ্টি। এমন দুরন্ত পৃথিবী নিয়ে কে আর কত দূর যেতে পারে? কী যে অপরাধ আমার বুঝি না! 

কিছু ভাল লাগছিল না। ক্রমে রাত বাড়ছে। চারপাশে আলো। গুরুদোয়ারাতে ভজন হচ্ছে। তেমনি নীল আকাশ, নক্ষত্র সব ফুটে আছে। সেই নক্ষত্র থেকে বার বার সংকেত ভেসে আসছে। বিলু, আমি তোমার জন্য বড় হচ্ছি। গ্রাম মাঠ শস্যক্ষেত্র আমার দু’হাতের মুদ্রায় নাচানাচি করে। ফুল ফোটে। শস্য জন্মায়। নদীর পাড়ে আমরা হেঁটে যাই। কোন দূরবর্তী উপত্যকায় আমি ছুটি। তুমি আছ বলেই আমি আছি। আমি ছুটি, আমি বাঁচি। 

ছোড়দিকে একদিন বলেই ফেললাম, আমার টাকা না হলে চলছে না, কিছু টাকা জমলেই চলে যাব। কলেজে ভর্তি হব। প্লিজ বাবাকে তোমরা চিঠি লিখতে যেও না। 

ছোড়দির চোখে জল। ছোড়দি বাবাকে আসতে লিখতে পারে, নাও লিখতে পারে—কিন্তু আমার যে সংকেত আসছে দূরবর্তী নক্ষত্র থেকে বড় হও, বড় হও। আমি কাকে নিয়ে বড় হব? সে আমার কে? কি সংকেত তার আমার জন্য? কেন চোখে জল? কে যেন আশ্চর্য ইশারায় বলে গেল, বিলু, তোমার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর ভালবাসা দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। তার টানে তুমি ভেসে পড়েছ। সে তোমাকে ঠিক কোথাও পৌঁছে দেবে। কোন গভীর অরণ্যে অথবা ফুলের উপত্যকায় 

এভাবে অনাবৃত আকাশের নীচে আমি আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। স্বপ্ন দেখছি, ছোড়দি আমার শিয়রে চুপচাপ বসে আছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *