প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ১৪

চোদ্দ 

যথারীতি বাবা তাঁর কথামত রাতে ফিরে এলেন না। মানুষটা আসবে ভেবে মা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসেছিল। আমি রাত জেগে অঙ্ক কষছিলাম। বাকি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মা দরজায় হেলান দিয়ে—কেমন নিরুপায় রমণীর মতো মুখ তাঁর। মাঝে মাঝে উঠোনের দিকে চোখ সরে যাচ্ছে। কোনো শব্দে মা সতর্ক হয়ে উঠছে। এবং সারা মাঠঘাট জ্যোৎস্নায় ডুবে। উঠোনে জ্যোৎস্না। গাছের মাথায় বনভূমিতে জ্যোৎস্না। যেন জ্যোৎস্না নিরিবিলি আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। শুধু বাবা ফিরে আসেনি বলে সবই কেমন অর্থহীন মায়ের কাছে। 

একসময় বললাম, তুমি খেয়ে শুয়ে পড় মা। 

মা বলল, দেখি আর একটু। 

সুতরাং আবার দুটো ঐকিক নিয়মের অঙ্ক করে বর্গমূলে চলে এলাম। মা একসময় কেমন ছোট্ট বালিকার মতো উবু হয়ে বসল। আমার বইগুলির পাতা উল্টে গেল অযথা। বইয়ের ছবি দেখল। এক একটা ছবির নিচে কি লেখা আছে পড়ল। যেহেতু বইয়ের তাকটা সামনে, বইগুলি নামিয়ে আবার সুন্দর করে ভাঁজ করে তাকে সাজিয়ে রাখার সময় কেমন ছোট্ট বালিকা হয়ে গেল। মা’র পাশে বসে থাকতে এখনও আমার ভাল লাগে। মায়ের শরীরে এক আশ্চর্য ঘ্রাণ। অঙ্ক কষতে খুবই ভাল লাগছিল। বুঝতে পারি মা আমাকে মাঝে মাঝে সহসা চুরি করে দেখছে। মুখে সামান্য গোঁফের রেখা, আমি বাবার মতো বড় হয়ে যাচ্ছি, বোধহয় মা’র কোথাও ভেতরে সন্তান বড় হলে যে সুখ অথবা বাবার মতো একজন পুরুষমানুষ আমার মধ্যে জেগে উঠছে ভেবে কেমন মুহ্যমান। জননী গো বলতে ইচ্ছে হল একবার। আর তখনই মা’র দু ঠোঁট ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি মা’র দু চোখ কি এক বেদনায় ভার হয়ে গেছে। বললাম, বাবা ঠিক আসবে। 

মা উঠে পড়ল। উঠোনে নেমে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকল। এমনটা তো আমার মা ছিল না। বাবা ফিরে না এলে কখনও এমন বিচলিত বোধ করেনি। উঠোনে নেমে বললাম, বাবা তো প্রায়ই দেরি করে আসে। তবে এত ভয় পাচ্ছ কেন? 

মা বলল, তোরা বড় হয়ে যাচ্ছিস। 

বড় হয়ে যাচ্ছি বলে মা’র ভয়টা কোথায় বুঝতে পারলাম না। আমরা বড় হব না কাজ করব না, বাবার দুঃখ ঘোচাব না—তবে মানুষের ঘরবাড়ি দিয়ে কি হবে। 

মা লালপেড়ে শাড়ি পরেছে। মাথায় ঘোমটা। আকাশ নীল এবং কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডাকছিল। বাবার গাছপালা মা’র চারপাশে কেমন প্রহরীর মতো সজাগ। তখন মা বলল, বড় হলে তোরাও তো তোদের বাবার মতো হবি। যাবি আর ফিরতে চাইবি না। 

তখন বাড়িঘরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি কেউ আমায় দূরে ডাকে। সংগোপনে শহরের সেই ব্যালকনিটা মগজের মধ্যে ভরা থাকে। পায়ের কাছে গোলাপের টব। ইজিচেয়ারে বালিকা ফ্রক গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকে। শীতের পাখিরা আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। এক একটা পালক নেমে আসে এবং জীবনের অর্থ পাল্টে যায়। বালিকার জন্য বুকে আমার কোথায় যেন টান ধরে গেছে। নিশীথে লণ্ঠনের আলোতে মা আমার মুখ দেখে ধরে ফেলেছে সেটা। বড় হয়ে যাচ্ছি ভেবে দুঃখটা কোথায় মা’র টের পেয়ে বললাম, মা তুমি ভেব না, আমরা এই বাড়িঘরেই থাকব। 

মা’র মুখে অদ্ভুত কূট হাসি ফুটে উঠল। জ্যোৎস্নায় সেই হাসিটুকু আমাকে সত্যি কষ্টের মধ্যে ফেলে দিল। একটা কথাও আর মাকে বলতে পারলাম না। চুপচাপ ঘরে ঢুকে মাথা গুঁজে থাকলাম। যেন আমি সত্যি এখন আগের মতো এই বাড়িঘরের জন্য টান অনুভব করি না। কেউ নদীর পাড়ে, অথবা গাছপালার অভ্যন্তরে এখন আমাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে চায়। মা সেটা টের পেয়ে ভারি নিঃসঙ্গ বোধ করছে। 

তারপর মাও আর আমার সঙ্গে কোনো কথা বলল না। খেয়ে নিল। দরজা বন্ধ করে দিল। মশারির ভেতর ঢুকে যাবার সময় শুধু বলল, শুয়ে পড়ার সময় আলোটা কমিয়ে রাখিস। নিভিয়ে দিস না। মা’র আশা যে কোনো মধ্যরাতে বাবা ফিরে আসতে পারে। আলোটা সে জন্য কমিয়ে রাখতে বলল। 

শুয়ে পড়ার সময় মনে হল, খুবই নিস্তব্ধ ধরণী। এমন কি কোনো কীটপতঙ্গের আওয়াজ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। মা ঘুমিয়ে পড়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। মা যে ঘুমোয়নি টের পেলাম, কারণ শুয়ে পড়ার সময় মা বলল, দরজায় খিল দিয়েছিস তো। 

বললাম, হ্যাঁ মা দিয়েছি। খুব সকালে ডেকে দিও। 

—সে দেব। তুমি এখন ঘুমোও। 

রাত থাকতে উঠে আবার অঙ্ক নিয়ে বসব ভেবেছি। আসলে এখন বুঝতে পারছি, অঙ্কটা আমার আদৌ করা হয়নি। পরীক্ষার দেরি নেই। দু-একদিনের মধ্যেই ঠিক খবর আসবে কোথায় কবে পরীক্ষা। হপ্তা দুই হয়ত সময় পাব আর। যে করেই হোক দশটা বিষয়েই পাস করতে হবে। নটা বিষয়ে পাস বাবার আমলে চলতে পারে, এই আমলে দশটা বিষয়ে পাস খুবই জরুরী। 

পরদিনও বাবা এলেন না। সকাল সকাল বহরমপুরে কাকার কাছে গেলাম। পরীক্ষা কবে, কোথায় জানা হয়ে গেল। পরীক্ষার সিট পড়েছে কলকাতায়, দ্বারভাঙা হলে। কলকাতা খুবই বড় শহর, মানুকাকা এমন বলেছে। সেখানে কোথায় উঠব, কার কাছে উঠব এই নিয়ে কাকা কিছুক্ষণ সমস্যা বোধ করলেন। তারপর কি ভেবে বললেন, নীলমণির দাদা তো কলকাতায় থাকে। শেষ পর্যন্ত বোধহয় ওখানেই তোমাকে উঠতে হবে। 

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা হয়ে গেল। পিলুর সোজা পথটায় না এসে ঘুরে এলাম। ও-পথটায় সেই ব্যালকনি—টবে গোলাপের গাছ, সামনে ছোট্ট বাগান এবং জানালায় বালিকার মুখ। ওদিক দিয়ে গেলে শুধু একবার সেই বালিকাকে দেখতে পাব ভেবে ঘুরে এসেছি। সে নেই। তাকে দেখতে না পেয়ে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। মানুষের বড় হতে হতে কি যে সব হয়। সারা রাস্তাটা বড়ই দীর্ঘ মনে হয়েছিল। মা বাবা ভাই বোন বাদে কোথায় যেন আরও একটা ছোট্ট পৃথিবী বাবার মতো আমি এখন কেবল খুঁজে বেড়াচ্ছি। 

বাড়ি এসে দেখলাম, মা বেশ উগ্রচন্ডা। মা ভীষণ গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছে। পিলুকে সকালে বেদম প্রহার করেছে। মায়া ভয়ে ভয়ে মা’র কাছে ঘেঁষছে না। ছোট ভাইটা পড়ে গিয়ে রক্তপাত ঘটিয়েছে। সকালে যারা দিনক্ষণ তিথি-নক্ষত্রের খবর জানতে বাবার কাছে আসে তাদের সবাইকে বলে দিয়েছে, বাড়ি নেই। কবে ফিরবে বললে জানিয়েছে, সে তেনার মর্জি। অন্যদিন সকালে বাবার এসব কাজ আমিই করে থাকি। তিথি নক্ষত্র শুভদিন পঞ্জিকায় লেখা থাকে। কেউ ফিরে যায় না। 

ফিরতেই মা বলল, তোর মানুকাকা কিছু বলল? 

—কলকাতায় সিট পড়েছে। 

—তোর বাবার কথা কিছু? 

বুঝতে পারলাম, মা এখন বাবার খবরের জন্য খুব উদ্বিগ্ন। আমার পরীক্ষা নিয়ে মা’র কোনো মাথাব্যথা নেই। কি বলি! 

একটু ঘুরিয়ে বললাম, কালুবাবু খুব সদাশয় লোক। বাবার মতো মানুষকে পেয়ে ছাড়তে চাননি। দু-একদিন হয়ত ঘুরে ফিরে কালুবাবুর ঘরবাড়ি, চাষবাস দেখছেন। 

—মানুকাকা তোমায় কি বলল? 

—এই তো বলল। 

—বেশ। তাহলে তোমরাও এবার সদাশয় কালুবাবুর বাড়ি গিয়ে ওঠ। সংসারে আমার আর কারো দরকার নেই। 

বাবার ওপর এই প্রথম কেন জানি আমারও ভীষণ রাগ হল। সত্যি তো, আগে একরকমের দিন ছিল, কোথায় কে থাকছে, খুব একটা ভাববার ছিল না। বরং বাবা কোথাও গেলেই কিছু তখন হয়ে যেত। এখন কেন জানি মা’র এবং আমাদেরও সময় মতো বাবা না ফিরলে চিন্তা হয়। বাবা সেটা কেন যে বোঝেন না। মানুষের বাড়িঘরও হবে, বাউন্ডুলে স্বভাবও থাকবে সে হয় না। দুটো একসঙ্গে মানায় না। মা বোধহয় সেজন্যই বাবার ওপর এবার হাড়ে হাড়ে ক্ষেপে গেছে। 

মা বলল, তুমি বেলডাঙা স্টেশনে নেমে যেতে পারবে? 

—কোথায় যাব?

—সদাশয় কালুবাবুর বাড়ি। 

–কত দু…র। সাত ক্রোশ রাস্তা, সোজা কথা!

–স্টেশন থেকে সাত ক্রোশ দূর হয়ে গেল! 

অগত্যা আর কি করা! বললাম যাব। 

—কালই সকালে রওনা হয়ে যাবে। 

এ সময় কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পিলুটা মার খেয়ে বাড়িঘরের কাছে পিঠে নেই। মায়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ভাইটা মায়ার কোলে। সবাইকে মা সকালে বাড়িছাড়া করেছে। কেবল আমি বাকি। এ সময় কিছু বুঝিয়ে বলাও নিরর্থক। সব কিছুরই মা এখন অন্যরকম অর্থ দাঁড় করাবে। বললাম, ঠিক আছে, যাব। 

তারপরই বাবাকে উপলক্ষ করে সেই গজগজ করা, ছেলেরা মানবে কেন! ছেলেরা ভাল হবে কোত্থেকে। সব একরকমের। আমি না হয় কেউ না। ছেলেদের কাছে পর্যন্ত কথা রাখলে না। 

মা’র আঘাতটা কোথায় এতক্ষণে ধরা গেল। আর তখনই দেখি দূরে পিলু চিৎকার করছে, মা বাবা আসছেন। মা বাবা একটা গরু নিয়ে আসছেন। 

মা রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। আমিও। পিলু মাঠ পার হয়ে জোরে ছুটে আসছে। আর চিৎকার— বাবা গরু নিয়ে আসছেন। 

বাবা অথবা গরু কিছুই রাস্তা থেকে দেখা গেল না। পিলু খবরটা দিয়েই ফের উল্টো মুখে ছুটতে থাকল। মুহূর্তের মধ্যে পিলু মাঠঘাট পার হয়ে বাদশাহী সড়কে উঠে গেল। আশ্চর্য দ্রুতগামী পিলু। তাকে দৌড়ে নাগাল পাওয়া খুবই অসম্ভব। মুহূর্তের মধ্যে সে অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে, আবার দেখা দিতে পারে। আর এত বড় একটা খবর, একটা সত্যি সত্যি আস্ত গরু বাবা নিয়ে আসছেন, সে স্থির থাকে কি করে! ডাকলাম, পিলু দাঁড়া। 

আমার ডাকে সে সহসা ঝোপঝাড়ের ফাঁক থেকে উঁকি দিল। বলল, আয়। তারপরেই ডুব। রাস্তার দিকে না গিয়ে সে লেংড়ি বিবির হাতার দিকে ছুটছে। আবার ডাকলাম, দাঁড়া পিলু। 

মা সেই বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। মায়া কিছুটা মাঠের মধ্যে আমি কালীর পুকুর পার হয়ে গেছি— পিলু আরও আগে। সে কোথায় বাবাকে দেখেছে, কতদূরে বোঝা যাচ্ছে না। না কি পিলুর সংশয় আছে, বাবা এই ফাঁকে না আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। বাবা যা একখানা মানুষ। বাবার জন্য সকালে মায়ের জ্বালায় সে বাড়িছাড়া, সেই বাবাকে যখন কোথাও একটা আস্ত গরুর সঙ্গে আবিষ্কার করা গেছে তখন আর কিছুতেই ছাড়ছে না। সেই জন্যেই মনে হয় পিলু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। গরুটাকে নিয়ে সে তার বাবাসহ মায়ের কাছে ফিরবে। 

—ওরে পিলু দাঁড়া। 

আর দাঁড়া। সে একবার মুখ ফিরিয়ে বলল, আয় না। ছুটতে পারছিস না! সত্যি আমি আর ছুটতে পারছিলাম না। সড়কে এসে ভীষণ হাঁপিয়ে গেছি। দেখি, মায়া আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, বাবা কোথায় রে দাদা? 

—দেখছি না তো। 

—গরুটা কোথায়? 

—কিছুই দেখছি না। 

—ছোড়দা কোন দিকে গেল? 

—লেংড়ি বিবির হাতায় ঢুকে গেল। 

আর তারপরই মূর্তিমান তিনজন, বাবা আগে, পিছনে গরুটা তার পিছনে মায়ার ছোড়দা। পাটক্ষেতের ভেতর থেকে বাবা একবার ভেসে উঠছে, গরুটা একবার ভেসে উঠছে। মায়ার ছোড়দা একবার ভেসে উঠছে, মেস্তা পাটের জমি, উঁচু নিচু বলে তিনজনেই আবার মেস্তা পাটের জমিতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা খুবই অধীর। কতক্ষণে বাবা এবং গরুটা দূরে আবার ভেসে উঠবে। ভেসে উঠেই আবার ডুবে গেল। এবং এভাবে আমার বাবা মায়ার ছোড়দা আর বাবার গরুটা পাটের জমির ওপর দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকল। পেছনে দিগন্ত, তার মধ্যে একটা প্রাণীর দুদিকে দুজন, এবং আমরা সড়কে ভাই বোন, অনেক পেছনে, বাড়ির রাস্তায় মা, আর ভাই–বোঝাই যাচ্ছিল, বাড়িঘরে এটা কত বড় সুখবর। আমি যে আমি, যে একটু সব তাতেই ইয়ে ইয়ে ভাব সেও, শেষ পর্যন্ত খুশীতে মেস্তা ক্ষেতের মধ্যে ছুটে ঢুকে গেল। আর গরুটা নিয়ে যখন সে উঠে এল, তখন অবাক 

গরুটা কালো রঙের। শিং ভীষণ লম্বা। শিরদাঁড়া হাড়গোড় বের করা, এ পর্যন্ত সহ্য করা যায়। গরুটা খোঁড়া। চারটে পায়ের মধ্যে একটা নড়বড়ে। পাটা মাটিতে পড়ে না। ঘুরে ঘুরে নড়ে চড়ে বেড়ায়। কিন্তু রাস্তায় বাবাকে ঘাবড়ে দিতে মন চাইল না। কেবল পিলু একবার কি ভেবে বলল, বাবা গরুটার একটা পা ঠিক নেই, না বাবা? 

পিলু খোঁড়া শব্দটি উচ্চারণ করল না। যাতে বাবা মনে আঘাত না পান, সেজন্য সে পা ঠিক নেই বলল। বাবার যা চেহারা, হাঁটু অবধি কাদা উঠে গেছে, সারা রাস্তা হেঁটে এসে বাবা আমাদের দেখে খুবই গম্ভীর—বাবা এমনটা কখনও থাকেন না, বোঝাই যাচ্ছিল সারা রাস্তায় বাবা গরুটাকে নিয়ে বেশ ধকল সয়ে তবে পুত্র কন্যাদের জন্য দুধের বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। 

পিলু শুধু বলল, বাবা আমাকে দড়িটা দাও। 

বাবা বললেন, না পারবি না। 

—পালাতে পারবে না, দাও না। 

বাবা বললেন, তুই ধরলেই শুয়ে পড়বে। ওঠানো যাবে না। 

আমরা লক্ষ্য করলাম, বাবা গরুটার গলার কাছে বেশ রশির টান রেখেছেন। গরুটাকে বাবা টেনে টেনে নিয়ে আসছেন, আর কি যেন ভয়ে ভয়ে আছেন। বাড়ির কাছে এসে নেতিয়ে পড়লে, শুয়ে পড়লে কেলেঙ্কারির এক শেষ। এভাবে টেনে টেনে বাবা কতক্ষণে নিয়ে যাবেন, পিলুর তর সইল না। মা কতক্ষণ ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, ভাইটা—সে লেজটা মুচড়ে দিল একটু তাড়াতাড়ি হাঁটবে বলে। সেই যেমন কে তেমন, পাটা ঘুরে ফিরে পড়ছে, এক পা এগুলে দু পা পিছিয়ে যায় মনে হচ্ছে। ততক্ষণে পিলু বুঝতে পারল, এমন একটা গরু নিয়ে তাদের বাবার পক্ষেই সম্ভব এতটা পথ হেঁটে আসা। কিন্তু এখন পিলু এবং আমাকে যে ভয়টা সব চেয়ে বেশি কাবু করছিল, সেটা আমাদের মা। আজ বাবার না জানি কি হবে। বাবা আমাদের সাহস দেবার মতো করে বললেন, অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে তো, একটু নেতিয়ে পড়েছে। লেজ মুচড়ে কিছু হবে না। 

বাবা এবং গরুর দুরবস্থা দেখে পিলু খুবই সংকটে পড়ে গেল। বলল, জল আনব বাবা, গরুটার জলতেষ্টা পেয়েছে। বলেই সে ছুট লাগালে বাবা বিষম খেলেন। ডাকলেন আর তো দূর নেই। জলটল বাড়ি গিয়ে দেখানো যাবে। টানাটানিতে গরুর ছাল চামড়া উঠে আসতে পারে ভেবে বাবা আমাকে বললেন, ধর তো। দড়িটা টান করে ধর। যতটা সম্ভব টেনে ধরতে গেলে বললেন, আহা লাগবে। ফাঁস লেগে যাবে। অত জোরে নয়। বলে পেছন থেকে বাবা যতটা জোরে পারলেন ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসতে থাকলেন। 

সুতরাং বাবা পেছনে আমি আগে। পিলু কি করবে বুঝতে পারছে না। সে একবার ছুটে বাড়িতে চলে গেল, এক বালতি জল নিয়ে আসতে দেখে বাবা কেমন ক্ষেপে গেলেন। বললেন জলটা গরুকে না দেখিয়ে আমাকে খাওয়াও, কাজে লাগবে। পিলুর এই আচরণ বাবার পছন্দ না বোঝা গেল। সে বলল, কোথা থেকে আনলে বাবা? 

বাবার তখন কাছার কাপড় সব খুলে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে বললেন, গরুর মতো গরু কত দুধ দেবে দেখ। 

পিলু বলল, ল্যাংড়া গরু বেশি দুধ দেয় বুঝি বাবা? 

বাবা কপালে দুর্গতি আছে ভেবে বললেন, তা দেয়। তোমাদের জননী কি বলে? 

—কিছু বলেনি। 

—খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করেছে তো? 

—তুমি কাল ফিরে আসবে বলে গেলে, কৈ এলে না তো। 

—কপালে এমন একটা গরু জুটবে কে জানত। বাবা কথা বলছিলেন আর গরুটাকে হেঁইয় মার টান বলে ঠেলছিলেন। পিলু মাঝে মাঝে বাবাকে সাহায্য করছে। সেও শীর্ণকায় গরুটাকে যতটা সম্ভব বাবার সঙ্গে ঠেলতে ঠেলতে মা’র এজলাসে হাজির করতে চাইল। 

গরুটাকে নিয়ে বাড়ির রাস্তায় উঠতেই মা সহসা হাউমাউ করে উঠল, ওমা, একি গো, হাড়মাস বের করা গরু, একটা ল্যাংড়া গরু। 

বাবা এসব সময় খুবই রাশভারি হয়ে যান। মা’র কাছে এসে বাবা আরও গম্ভীর। এতটা হেঁটে জ্যান্ত একটা গরু নিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছানো গেল সেজন্য এদের যদি এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ থাকে। বাবা ভীষণ ঘর্মাক্ত কলেবরে গরুটাকে উঠোনে দাঁড় করিয়ে বারান্দায় সোজা বসে পড়লেন। তারপর ক্লিষ্ট গলায় বললেন, জল। 

বাবার কাছে যেতে কেউ আমরা সাহস পাচ্ছিলাম না। বাবা কখনও বিষয়ী মানুষ হয়ে গেলে ভয় পেতাম। যেন আঙুল উঁচিয়ে বলা, বসে নেই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এত করছি তবু সুখ নেই। তিনি সে সবের কিছু বললেন না। মাও বুঝতে পারছিল না, সেবাশুশ্রূষা কার আগে দরকার। বাবার না গরুটার। মায়া ইতিমধ্যে ছুটে এক গ্লাস জল এনে দিলে সবটা বাবা এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেললেন। মা তাড়াতাড়ি তালপাতার পাখা এনে বাবাকে বাতাস করতে লাগল। আমরা উঠোনে গরুটার সঙ্গে ঠায় দাঁড়িয়ে। পিলু ফাঁক বুঝে গরুটার তেজ দেখার জন্য বাঁটে হাত দিলে বাবা তেড়ে উঠলেন, লাথি-ফাতি খেয়ে মরবে দেখছি সব। 

গরু পা তোলা তো দূরে থাক, এতটুকু নড়ল না পর্যন্ত। পিলু বলল, ভারি ঠান্ডা গরু বাবা।

আমার মনে হল ঠান্ডা গরু না বলে সভ্রান্ত গরু বলা ভাল। বাবা হয়ত এখন তাই বলতেন। কিন্তু মা কেমন বিমূঢ়ের মতো বলল, হ্যাঁগো দেখছ গরুটা তো নড়ছে-টড়ছে না। 

—নড়বে নড়বে। অত তপ্ত খোলা হলে হয়। কতটা পথ হেঁটে এসেছে। 

—তাই বলে গরুর লেজ নাড়া বন্ধ থাকে কখনও। 

—সবই নড়বে। সময় দিতে হয়। এই বিলু, বাবা গরুটাকে একটু জল দেখা তো। 

এতটা পথ হেঁটে এসে সত্যি গরুটা জীবিত না মৃত বাবারও বোধহয় সংশয় দেখা দিল। বাজপড়া প্রাণীর মতো উঠোনে দাঁড়িয়ে। মা’র ভয়ে কিছুতেই বুঝি সত্যি কথাটা বলতে পারছেন না। জল দিলে বোঝা যাবে। এক বালতি জলও গরুটার সামনে রাখা গেল। তবু সে দাঁড়িয়ে আছে। পিলু ছুটে গিয়ে আহ্লাদে এক আঁটি ঘাসও তুলে এনেছে। তাও দৃকপাত নেই। 

মা বলল, ওমা কি গরু গো, ঘাস খায় না, জল খায় না। নড়ে না চড়ে না।

বাবা প্রায় উঠে বসলেন এবার। –আরে খাবে খাবে। ঠান্ডা হয়ে নিক খাবে। 

—আর খেয়েছে। মা বোধহয় দু হাত ছুঁড়েটুড়ে বাবার কান্ড দেখে কাঁদতে বসে যাবে এবার।

বাবা তেমনি আমাদের সবাইকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন। –ভাল গরু। জাত ভাল। দুধ দেবে। গেরস্থ বাড়িতে গরু না থাকলে মা লক্ষ্মী থাকেন না। কতটা পথ হেঁটে এসেছে। গরু বলে কি আরাম বিরাম থাকতে নেই! 

মানুষটাও অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। সঙ্গে গরুটা। হাঁটু অবধি কাদা। চোখমুখ কোথায় ঢুকে গেছে। সারারাত গরুটাকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটির চিহ্ন। দু দিন আগে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরছেন আজ। চন্ডীপাঠের নাম করে শেষপর্যন্ত সোজা একটা ভাগাড়ের গরু নিয়ে হাজির। কার এত কৃপা হল মানুষটার ওপর। মা বাবাকে দেখতে দেখতে বোধহয় এসবই ভাবছিলেন। রাগে দুঃখে চোখ ফেটে বোধহয় এবারে জল বের হয়ে আসবে মা’র। 

মা’র চেহারা দেখা বাবা ঘাবড়ে গিয়ে পায়ের ওপর পা রেখে নাচাতে থাকলেন। খুবই তেজী অহংকারী মানুষ। ভেঙে পড়লেই গেছে। সংসারে আগুন জ্বলে উঠবে। বলছিলেন, হবে হবে সব ঠিক হয়ে যাবে। গরুটা দুধ দিতে থাকলেই তোমার আর দুঃখ থাকবে না ধনবৌ। 

এবং এবারে দেখা গেল গরুটা সত্যি লেজ নাড়াচ্ছে। বাবা লাফিয়ে উঠলেন। ওগো দ্যাখো লেজ নাড়াচ্ছে। বাবার বুকে যেন দুগুণ বল এসে গেল। –বললাম গরু লেজ নাড়াবে না সে হয়। দে ব্রে জল দে। 

জলের বালতিটা মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। গরুটা নাক টানল দুবার। মুখ খানিকটা জলে ডুবিয়ে ফের তুলে নিল। খেল না। 

বাবা বললেন, ফ্যান আছে ধনবৌ, থাকলে দাও না। একটু নুন মিশিয়ে দাও। মা ফ্যান এনে নুন মিশিয়ে দিল। না, খাচ্ছে না। শত হলেও গরু একটু অদর যত্ন চায়। মা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে বুঝল, কঙ্কাল বাদে গরুটার আর কোনো সম্বল নেই। মা অগত্যা বলল, খাবে কি? শরীরে কিছু আছে! 

—বাঁধা খাওয়া সইবে কেন? ছেড়ে খাওয়ালে দেখবে দু দিনে ঠিক হয়ে যাবে। 

মা এতক্ষণ যা বলতে চেয়েছিল, এবারে তা বলে ফেলল, কে দিল গরুটা? বের হলে তো চন্ডীপাঠের নাম করে। আর নিয়ে এলে একটা মরা গরু। কার এমন কৃপা হল কর্তার ওপর। আর লোক পেল না! ভয়ে বাবা মা’র দিকে না তাকিয়েই বললেন, কালুবাবুই দিল। সবৎসা গাভীর কথা পাড়তেই ওনার দয়া হল। বলল, গোয়াল থেকে রাইমণিকে নিয়ে যান। ভাল জাতের গরু। বয়স হয়েছে। তবে কার বয়স না হয় বলুন! 

বাবা দেখছি আসলে গরু নিয়ে আসেনি, নিয়ে এসেছে রাইমণিকে। 

মা কেমন স্বগতোক্তি করল—কি যে তার এত দায় ছিল, এমন অবলা জীবকে এমন একজন অবলা মানুষের জিম্মায় তুলে দেওয়া। 

আমরা যে ঝড়ের আশঙ্কা করেছিলাম, দেখলাম সেটা কেটে গেছে। মা গরুটার জন্য দুব্বো তুলতেও বলল মায়াকে। বুড়ো হোক, গায়ে কিছু না থাক, সাক্ষাৎ ভগবতী। রাইমণির জন্য বাবা আমাদের নিয়ে একটা নতুন দড়িও পাকালেন। খালের জলে ঘষে ঘষে স্নান করানো হল সাক্ষাৎ ভগবতীকে। বেশি জোরে ঘষা গেল না, ঘষতে গেলেই রাইমণির ছাল চামড়া উঠে যাচ্ছে। স্নান-টান সেরে রাইমণি ঘাস এবং জল দুই খেয়ে ফেলল। 

রাইমণিকে বাবা আমি এবং পিলু মিলে যখন ঠেলাঠেলি করে জল থেকে তুলে আনছিলাম, শেষবারের মতো মা বলেছিল, গরুটাকে দিয়ে কালুবাবু ভাল করেনি। ভোগাবে। বাবা তখন কেমন শোকসন্তপ্ত গলায় বললেন, দানের গরু আর কত ভাল হবে ধনবৌ? সংসারে এত করেও কিছু করা গেল না। তোমাকে সুখী করতে পারলাম না। খুব ভালমানুষের মতো বাবা রাইমণিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে ভারি দুঃখী মানুষ কিছুতেই কাউকে টের পেতে দিচ্ছেন না। তখন বাবার জন্য আমার কেন জানি চোখে জল আসছিল। বললাম, রাইমণি কি সুন্দর দেখতে, না? 

বাবা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি বলছিস? 

—হ্যাঁ বাবা। রাইমণি সত্যি ভাল। নিরীহ। 

বাবা বললেন, এখন কত কাজ। দাঁড়িয়ে থাকিস না। রাইমণির একটা ঘর করতে হবে। দুলেকে ডেকে আনতে হবে। দুলে এলে সবাই মিলে সাঁজ লাগতে না লাগতেই রাইমণির পাতার ঘর বানিয়ে ফেললাম। বাঁশের বন থেকে বাঁশ এল। কাশের বন থেকে কাশ। পাটের দড়িতে বাতা বেঁধে দিলাম। বাবলা গাছের খুঁটিতে রাইমণিকে বেঁধে বাবা বাড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কি দেখছেন! সাঁজ লেগে গেছে। সারাটা দিন বাবা একদন্ড বসে নেই। এখনও এই সন্ধ্যার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এত কি দেখছেন! 

ডাকলাম, বাবা। 

অন্ধকারে সংবিৎ ফিরে পাবার মতো বললেন, বিলু। 

—হ্যাঁ বাবা। 

—এদিকে আয়। 

কাছে গেলাম বাবার। 

—দ্যাখ তো! 

ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম, কি দেখব বাবা? 

—বাড়িটা দ্যাখ। ঠিক এতদিনে এটা মানুষের ঘরবাড়ি মনে হচ্ছে না? থাকার ঘর, খাবার ঘর, ঠাকুরঘর, গোয়ালঘর—সব মিলে মানুষের ঘরবাড়ি। 

আমি বললাম, হ্যাঁ, সত্যি মানুষের ঘরবাড়ি। 

–তোর মা বোঝে না। রাইমণিকে এনে ভাল করিনি? 

—খুব ভাল হয়েছে। 

—রাইমণি না থাকলে বাড়িটা ঠিক বাড়ি মনে হত না। দুধ না দেয় গোবরটা তো পাওয়া যাবে। ব্রাহ্মনের বাড়ি গোবর ছাড়া চলে। 

—দুধও দেবে বাবা। 

বাবাকে আর কি বলে সুখী করব বুঝতে পারলাম না। অন্ধকারে পিতাপুত্র আমাদের এতদিনের গড়ে ওঠা আবাস দেখছিলাম। সত্যি ধীরে ধীরে রাইমণির প্রতি ঠিক অন্য সবের মতো আমারও মায়া পড়ে যাচ্ছে। রাইমণি অন্ধকারে ঘাস চিবুচ্ছিল—তার শব্দ, এবং দূরে ব্যারেক বাড়িতে বিউগিল বাজছে। গাছপালার ভেতর মানুষের ছোট্ট একটা ঘরবাড়ি ক্রমে গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। জোনাকির আলোতে বাবার মুখে অস্পষ্ট সুখের আভাস। গাছপালা ঘরবাড়িটাতে সতর্ক প্রহরীর মতো বড় হয়ে উঠেছে। 

বাবা বাড়ির দিকে একসময় যেতে যেতে শুধু বললেন, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের আর কি লাগে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *