প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ১৩

তেরো 

এইভাবে আমাদের দিন যায়। বাবা কালুবাবুর মা’র কাজে চণ্ডীপাঠের জন্য সকালে রওনা হয়ে গেলেন। বেলডাঙ্গা থেকে বাবাকে সাত ক্রোশের মতো পথ হেঁটে যেতে হবে। সকালের ট্রেনে স্টেশনে নামলে, রাতে রাতে পৌঁছে যাবেন। পরদিন কাজ। বাবা নামাবলী গায়ে বগলে পুঁথি, হাতে ব্যাগ। আমরা বাবাকে বাদশাহী সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়েছি। বাবা যেতে যেতে পিলুকে অমৃতবাণী শোনাচ্ছিলেন। পিলু এক কান দিয়ে শুনছে, অন্য কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। 

বাবা বললেন, তোমরা ভাল হয়ে থেকো। 

পিলু বলল, থাকব বাবা। 

—মা’র কথা শুনবে। 

পিলু বলল, তুমি কবে ফিরবে বাবা? 

খুবই বিস্মিত গলায় বাবা বললেন, কাজ হলেই ফিরে আসব। 

কবে কাজ শেষ হবে বাবা? 

—কালই হবে। 

—কতদিন লাগবে ফিরতে? 

মনে হল বাবা হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেলেন। বললেন, কালই ফিরে আসতে পারব বোধহয়।

আমি বললাম, বোধহয় কেন বাবা? 

আসলে এত সব প্রশ্ন করার সাহস আমার কিংবা পিলুর কারো নেই। বাবা আমার দিকে তাকালেন। পিলুটা না হয় বেয়াদপ হয়ে গেছে, মায়ের আসকারাতে জাহান্নমে যেতে বসেছে, তাই বলে তুমিও। বাবা আমার দিকে তাকিয়েই কিছু আঁচ করতে পারলেন। বললেন, তোমার মাকে বল, কাল রাতেই ফিরব। 

সকাল থেকেই মা’র সঙ্গে বাবার বাক্যালাপ বন্ধ ছিল। কেন বাক্যালাপ বন্ধ থাকে আমরা দু ভাই আজকাল কিছুটা বুঝি। আজকাল মা মাঝে মাঝে কেন যে যা দেবী সর্বভূতেষু হয়ে যায়! কেবল গজগজ করে। কথা দিয়ে বাবা কথা রাখে না, একটা মানুষ বাইরে বাইরে ঘুরলে, খবর না পাওয়া গেলে কত চিন্তা হয়, মানুষটার যদি সেই আক্কেল থাকে। ছেলেরা বড় হয়ে গেল, এই ধরনের অজস্র কথা, আর যত অভাব তখন মা’র বেড়ে যায়। মা খুব সামান্য উপকরণ সম্বল করে বাবার সঙ্গে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতে পারে তখন। 

বাবাকে বাদশাহী সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম আমরা। বাবা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। আমাদের দিকে হাত তুলে বললেন, বাড়ি যা। রাস্তায় অন্য সব অনেক কাজের কথাও বলেছেন। তার মধ্যে আমার বড় কাজ মানুকাকার কাছে যাওয়া। বাবার জন্য কার কি হয় জানি না, আমার ভারি কষ্ট হয়। গতকাল বাবা সারাদিন চণ্ডীপাঠ করে ঝালিয়ে নিয়েছেন। সংসারে কি হল না হল, একবারও মুখ বার করে দেখেননি। পিলু কখন ফিরে এল, কখন কে খেল, ভাইটা এখন হাঁটতে পারে, দৌড়তে পারে, সেই ভাইটা দুবার ঠাকুরঘরে মুখ বাড়িয়ে ডেকেছে, বাবা, বাবা, কোনো উত্তর দেননি। চণ্ডীপাঠের মধ্যে এতই নিমগ্ন ছিলেন যে মা না পেরে আমাকে বলল, দেখ তো তোর বাবার বাহ্যজ্ঞান আছে কি না? আমি মা’র কথায় কোনো গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু মা না খেয়ে বসে আছে। বাবা বাড়ি থাকলে যতই বেলা হোক মা খায় না। বাবার খাওয়া হলে মা পাতেই বসে যায়। বেলা পড়ে গেছে কখন, গাছের ছায়া লম্বা হতে শুরু করেছে এবং যখন সাঁজ নেমে আসার দেরি নেই, তখনই মা না পেরে কথাটা আমাকে বলেছিল। মা’র কথায় গুরুত্ব না দেওয়ায়, পিলু দেখলাম দায়িত্বটা সহজে নিয়ে নিল। সে সোজা ঠাকুরঘরে গলা বাড়িয়ে ডাকল, বাবা। 

বাবা চোখ উন্মীলন করে সামান্য তাকালেন। তারপর ফের চোখ বুজে চণ্ডীপাঠে লিপ্ত হতে গেলে, সে বলল, বাবা। 

বাবা সোজা হয়ে বসলেন। 

পিলু বলল, মা জানতে চেয়েছে…. 

বাবা তাকিয়েই আছেন। বোধহয় সামান্য বাকি আছে। সেটুকু শেষ করে কথা বলবেন।

পিলু শেষ করল কথাটা, মা জানতে চেয়েছে, তোমার বাহ্যজ্ঞান আছে তো! 

বাবা চণ্ডীপাঠ অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়লেন। শুধু বাইরে এসে বলেছিলেন, চণ্ডীপাঠে ঘরবাড়ির সব অকল্যাণ দূর হয়। জীবনে খাওয়াটাই সব নয়। 

মা খোঁচা হজম করে গেল। তখনকার মত কিছু বলল না, পরে বাবাকে খেতে দিয়ে নিজে আর খেল না। খাওয়া নিয়ে খোঁটা শেষ পর্যন্ত। বাবা তারপর সাধ্য সাধনা করলেন অনেক। মা’র দিক থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। এবং আজ সকালেও অভিমানবশে মা জলগ্রহণ করেনি। বাবার অনেকদূর পর্যন্ত যেতে হবে বলে জলগ্রহণ না করলে চলে না। বাবার জন্য মা সবই রান্নাবান্না করেছে। বরং অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই করেছে, নিজে খায়নি। বাবা বলেছেন কপাল। দুর্ভাগ্য বলতে পার। আমাকে বলেছে, তোমার মা’র সবই ভাল, তবে বড্ড জেদ। যাই হোক, আমি তো কাজে যাচ্ছি, খেতে বল। না খেয়ে যেন থাকে না। গৃহলক্ষ্মী অভুক্ত থাকলে ঘরবাড়ির অকল্যাণ হয়। 

বাড়ি ফিরতেই মা বলল, কবে ফিরবে কিছু বলে গেল? 

পিলু বলল, কালই। 

—আর কাল! মা কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল। 

আমি বললাম, বাবা বলেছে তোমাকে খেয়ে নিতে। না খেয়ে থাকলে নাকি অকল্যাণ হয়। 

বাবা বাড়ি নেই বলে মা’র কাজে কর্মে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। প্রথম দাওয়ায় বসে রাস্তায় বাবার সঙ্গে আমাদের কি কি কথা হল সব শুনল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হরেন মল্লিক এসেছিল। মঙ্গলচণ্ডী পূজা। 

বাবা বাড়ি না থাকলে সাধারণ পূজা-আর্চার কাজ এখন আমাকেই করতে হয়। 

পালা-পার্বণে বাবা আজকাল একা পেরে ওঠেন না বলে, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজার সময় বাড়ি বাড়ি আমিও যাই। প্রথম প্রথম খুবই ভুল হত। বাচ্চা ঠাকুর বলে যজমানরা ক্ষমাও করে দিত।- ও কর্তা সংকল্প করলেন না। ও কর্তা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন না। মূর্তি পূজা থাকলে প্রায়ই ভুল হত চক্ষুদানের সময়। কাজল যেমনকার তেমন পড়ে থাকত। একটুও আঁচড় পড়ত না। মাঝে মাঝে মন্ত্রপাঠ গুলিয়ে ফেলতাম—মনে থাকত না, বাবার কথামত তখনই গায়িত্রী জপ করে সংকট থেকে ত্রাণ পেতাম। বাবার মতে গায়িত্রী পাঠের মতো মহামন্ত্র আর কিছু নেই। বামুন ঠাকুরের ওটা ব্রহ্মাস্ত্র বলতে পার। সুতরাং পূজায় অসুবিধায় পড়লেই বাবার ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রয়োগ করতাম। ফলে পূজা-আর্চায় ভয় ভীতির চেয়ে, খেয়ে না থাকার কষ্টটাই বেশি। যেমন এই এখন, আমাকে স্নানটান সেরে সড়কের ও-পাশে যে নতুন কলোনি হয়েছে, যেখানে হরেন মল্লিকরা থাকে সেখানে ছুটতে হবে। তারপর বাড়ি ফেরা বাড়ির বিগ্রহে ফুল জল দেওয়া এবং এত সবের পর খাওয়া। দুপুর গড়িয়ে যাবে। মেজাজটা খুবই বিগড়ে গেল। বললাম, পিলুকে বলো করতে। আমি পারব না। 

পিলু এক পেট খেয়ে এক পায়ে খাড়া। কারণ দ্বিতীয়বারের সময় হতে হতে সে দুটো পূজাই শেষ করে ফেলতে পারবে। পূজা করার সময় সে বিধি বিধান গ্রাহ্য করে না। মোটামুটি গণেশের পূজা আর পঞ্চদেবতার পূজা জানা আছে। বাকিটা তো এষ গন্ধ পুষ্প, অথবা দীপায় নম, নৈবেদ্যায় নম—আর বামুন ঠাকুর যা বলবে—সবই ঈশ্বর দু হাত পেতে করজোড়ে গ্রহণ করবে—সুতরাং তার ভয় ভাবনা এত কম যে, মঙ্গলচণ্ডীর ধ্যানের সময় সে অত্যন্ত তদগতচিত্তে গণেশের ধ্যান জপ করে যাবে। বিন্দুমাত্র সংশয় থাকবে না কারো যে সে এক দেবতার পূজা করতে এসে অন্য দেবতার পূজা সেরে উঠে যাচ্ছে। 

চুল বড় চোখ বড় পিলুর। চোখ দুটোতে ওর আশ্চর্য এক ভালবাসা। সব কিছুতেই সে পা বাড়িয়ে থাকে। পেট ভরা থাকলে, সব কাজই সে কত সহজে করে আসতে পারে। চারপাশে তাকালে বোঝা যায় পিলু সব সময় এই বাড়ি-ঘরের জন্য ঠিক বাবার মতো অহংকারী। 

আমি বললাম, তুই তো ঠিক মন্ত্র পড়িস না! 

—কে বলেছে! 

—তুই লক্ষ্মীর ধ্যান জানিস? 

—হ্যাঁ। 

—বল তো। 

—ওম পাশাক্ষ মালিকান্তুজ…এইটুকু বলেই বলল, তারপর কিরে দাদা? 

—ঐ তো! 

—কেন বাবা তো বলেছে না পারলে, গায়িত্রী পাঠ করতে। 

—তাও তুই করিস না। 

—দক্ষিণা কম দিলে কি করব? 

—দক্ষিণার সঙ্গে পূজার কি সম্পর্ক রে! 

—বারে সব জিনিসের দামদর থাকে, খাঁটি জিনিসের এক দাম, ভেজাল জিনিসের এক দাম, দক্ষিণা কম দিলে কম মন্ত্র, বেশি দিলে বেশি মন্ত্র। 

আমি মা’র দিকে তাকিয়ে বললাম, শুনছ মা, পিলু কি বলছে! 

মা বলল, ঠিকই তো বলছে। তোমার বাবার মতো হলে সংসার চলে না। 

সুতরাং ঠিক হল, পিলুই যাবে হরেন মল্লিকের পূজা সারতে। আমি যাচ্ছি না। সে কিছুক্ষণ ঘাসপাতা সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকল। ছাগলের বাচ্চাটা এই পরিবারের আর একজন হয়ে গেছে। তার নামকরণ পর্যন্ত করে ফেলেছে পিলু। অনেক ভেবেচিন্তে নাম রেখেছে রত্না। গতকাল থেকেই সংসারে পিলু, মায়ার মতো, মনার মতো বাচ্চাটা আমাদের এক পরিবারভুক্ত জীব। পিলুকে যদি কেউ বলে সংসারে তোমরা ক’জন প্রাণী, সে গর্বের সঙ্গে বলবে আটজন। দেশ থেকে আসার পর আরও দুজন বেড়েছে। 

এবং পিলু বাচ্চাটাকে ঘরবার করে থাকে। একটা বস্তা বিছিয়ে দেয়। হেগে মুতে বস্তাটা নোংরা করে ফেলে বলে, সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল পিলু রত্নাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। রত্নাকে বলছে, তোমার বড়ই স্বভাব খারাপ। মুতে নাও বলছি। রত্না যত ঘরের দিকে ছুটতে চাইছে, তত শক্ত হাতে দড়ি ধরে রেখেছে। বলছি না মুতে নিতে। মুতে নিলে রান্নাঘর নোংরা হয় না। 

দু’দশবার বলার পর সত্যি রত্না শিরদাঁড়া লম্বা করে দিল। এবং মুতে দিল। পিলুর অদ্ভূত আত্মতৃপ্তির হাসি। এই সংসারে মনার মতো রত্নাও তার কথাবার্তার মানসম্মান রাখছে। সে ঘরে নিয়ে রত্নাকে শুধু বেঁধেই রাখল না, রাতে খিদে পেলে যাতে খেতে পায়, সেজন্য কিছু ঘাসপাতা দড়িতে বেঁধে মুখের সামনে ঝুলিয়ে রাখল। ঘুম ভাঙলে চেঁচেমেচি করার সুযোগ পাবে না। সামনে দেখতে পাবে কচি ঘাসপাতা। শুধু একটাই ভয় পিলুর, শিয়ালে না নিয়ে যায়। এ জন্য সে মনাকে কয়েকবার শাসিয়েছে। পাহারা দেবার জন্য রান্নাঘরের ঠিক দরজার সামনে শুয়ে থাকতে বলেছে। এবং রাতে যখন পড়াশোনা সেরে খেতে বসেছি, দেখি, ঠিক রান্নাঘরের দরজার এক পাশে মনা মুখ তুলে বসে আছে। পিলু কিছুটা খেয়ে বাকিটা তুলে নিয়ে গেল। মনাকে খাইয়ে বলল, কোথাও যাবে না। তোমারও দেখছি বাউন্ডুলে স্বভাবে পেয়েছে। যখন খুশি যেদিকে চলে যাও। ঘরবাড়িতে ফেরার কথা মনে থাকে না। 

মা বলল, তোমরা সবাই একরকমের। শুধু মনাকে দোষ দিয়ে কি হবে। 

তারপর আমাদের এই বাড়িঘরে রাত ক্রমে গভীর হতে থাকে। টের পাই রত্না চোখ বুজে জাবর কাটছে, মনা ঘরের দাওয়ায় মুখ গুঁজে শুয়ে আছে, একটা পাতা পড়ার শব্দে সতর্ক, কান খাড়া হয়ে উঠছে। বাড়িঘরের গাছগুলি বর্ষার জল পেয়ে সতেজ — বনভূমিটা পায়ে পায়ে সরে যাচ্ছে। আর ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে টোপরের মতো বাড়িটা তুলে নিতে পারছে না। মা শুয়ে শুয়ে কেবল সারাক্ষণ আমাদের সুসময়ের গল্প বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। গল্পে সারাক্ষণ বাবার কথায় ঘুরে ফিরে আসছিল। বুঝতে পারি মা বাবার কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। মা হয়ত ঘুমিয়েও বাবার স্বপ্নই দেখছে। স্বপ্নে বোধহয় এই ঘরবাড়ির মাথার ওপর রয়েছে তেমনি আকাশ, দূরবর্তী নীহারিকাপুঞ্জ। বাবা নীলবাতি হাতে মাঠ পার হয়ে ক্রমে বাড়িঘরের দিকে এগিয়ে আসছেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *