প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ১২

বারো 

এই বনভূমিটা তার জঙ্গল গাছপালা নিয়ে আগে একরকমের ছিল, মানুষের বাড়িঘর হয়ে যাওয়ায় এখন অন্যরকমের। দূরে দূরে দরমার বেড়া দিয়ে মানুষজন ঘরবাড়ি কেবল তুলছেই। বনজঙ্গল ক্রমশ শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছিল। তবু বাবা তাঁর বাড়িঘরে নিয়ে আসছেন যাবতীয় ফুল ফলের গাছ। যেমন বাবা এর মধ্যে গোটা কয়েক আমের কলম পুঁতেছেন। নারকেল গাছ দুটো। একটা সফেদা ফলের গাছ, পেয়ারা তিনটে, লেবুর কলম কিছু রোপণ করেছেন বাড়িটাতে। আর পেঁপে গাছগুলি বুড়ো হয়ে যাওয়ায় নতুন কিছু পেঁপের চারা। করমচা লাগিয়েছেন টক ডাল খাবেন ভেবে। অর্থাৎ দেশ বাড়িতে বাবার যা কিছু ছিল, এই আবাসে প্রায় তার সবই তিনি এনে হাজির করার চেষ্টা করছেন। কিছুই বাদ দিচ্ছেন না। এক একদিন বাবা ফিরতেন এক এক রকমের গাছের সংবাদ নিয়ে। একবার মাঝে বাবা দশ ক্রোশ দূরে হেঁটে গেছিলেন, শুধু শহরে মানু কাকার এক বন্ধু বলেছিল, বাড়িতে তার একটা জামরুল গাছ আছে। গাছটার কলম বাঁধার জন্য একবার যেমন দশ ক্রোশ হেঁটে গেছিলেন, আবার কলমটি আনার জন্যও তাঁকে দশ ক্রোশ ভাঙতে হয়েছিল। 

জঙ্গল সাফ করে যত এগিয়েছি, তত গাছগুলো বাবা পুঁতে গেছেন। শুধু বিঘা দুই ভূঁই শাক- সব্জীর জন্য আলাদা রেখে দিয়েছেন। আর বাবার গাছপালা-অন্ত প্রাণ ছিল বলে, এক একটা গাছের পরিচর্যায় বড় সময় দিতেন। ঋতু বদলের সঙ্গে গাছের গোড়া কুপিয়ে সামান্য শেকড়-বাকড় আলগা করে বর্ষার জল খাওয়াতেন। কোন গাছে কি সার দরকার বাবার চেয়ে কেউ ভাল জানত না। ফলে এই বছর দুই যেতে না যেতেই জমির রুক্ষ ভাবটা কেটে গেছে। ছায়া শীতল এক সুষমা বাড়িটার চারপাশে গড়ে উঠেছে, আমরা ধীরে ধীরে টের পাচ্ছি। আর বাবার সঙ্গে এই গাছপালা, কুকুর, ছাগলছানা বাড়িঘর আমাদের নতুন এক সাম্রাজ্য। দূরে রাজবাড়ি। যেখানে পূজায় মেলা বসে, যাত্রাগান হয়। হাতী দেখা যায়। শহরে গেলে সুন্দর সুন্দর মেয়েদের দেখা যায় ফ্রক পরে স্কুলে যাচ্ছে। নিমতলায় গেলে আজকাল মানুষজনের অনেক মুখ দেখা যায়। আর রয়েছে মাঠ, বাদশাহী সড়ক, ল্যাংড়া বিবির হাতা, বিষ্ণুপুরের কালীবাড়ি। পৌষে মেলা বসে। এইসব মিলে আমাদের ঘরবাড়ির চারিদিকে বেঁচে থাকার এক আশ্চর্য রহস্যময়তা গড়ে উঠেছিল। বাবা কত সহজে আমাদের একটা নতুন পৃথিবী উপহার দিলেন। 

যারা বাড়িঘর করছে, অথবা নতুন বাড়িঘর করে চলে এসেছে, তারা অনেকেই সপরিবারে আজকাল আমাদের বাড়ি আসে। মা তাদের বসতে দেয়। বিকেলবেলায় মা মায়াকে নিয়ে কখনও নতুন নতুন বাড়িতে বেড়াতে যায়, গল্প করে এবং কখনও দেখা যায়, ওদের কেউ দিয়ে গেছে বড় একটা লাউ। পঞ্চানন চন্দ, কাঙ্গালী আইচ সকাল হলেই আসে। ঠাকুরঘরের দাওয়ায় মাথা ঠোকে। চরণামৃত নেয়। মুখে মাথায় মাখে। ওদের ছেলেরা মেয়েরা মাকে মাসিমা ডাকে। বাবাকে মেসোমশাই। কত দূর দেশে সবার বাড়িঘর ছিল। অথচ সব কিছু ফেলে আসার শোক ক’দিনেই মানুষের বুঝি উবে যায়। নতুন এক জীবন, মানুষেরা বেঁচে থাকার জন্য তৈরি করে নেয়। বাবা ট্রেনে এখন কোথাও গেলে টিকিট কাটেন। বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা আজকাল পছন্দ করেন না। 

এরই মধ্যে একদিন বাবা একটি খবরের কাগজ নিয়ে এলেন। এই কাগজ আমরা বাড়িতে বসে গোল হয়ে প্রথম পড়ি। বাবা কাগজটা সারাদিন পড়লেন। পরদিনও পড়লেন। বাবার কাছে খবরের কাগজ পড়াটা একটা সম্ভ্রমের ব্যাপার। বাবা কাগজের খবরগুলি নিয়ে নিবারণ দাসের আড়তে সন্ধ্যায় ঘুরে এলেন। এবং সব খবর দিয়ে ভাব দেখালেন বাবা খুব হেজিপেঁজি মানুষ আর নন। পূজার মাস আসছে, একটা দুর্গাপূজার বায়না পাওয়া যায় কিনা, সেই আশায় তিনি প্রায়ই বহরমপুরে গিয়ে মানুকাকার বাসায় আজকাল বসে থাকছেন। 

আর আসা যাওয়া করতে করতে একদিন বাবা খুব বড় একটা খবর নিয়ে এলেন। বললেন, বুঝলে ধনবৌ, কালুবাবুর মা’র কাজ। খুব দেবে থোবে মনে হয়। বেলডাঙা স্টেশনে নেমে যেতে হবে। খুবই ধনী ব্যক্তি কালুবাবু। একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের খোঁজে এসেছিল মানুর কাছে। তা কালই রওনা হয়ে যাব। মানুকে বলে রেখেছি, শহরেও তো অনেক সার্বজনীন পূজা হয়—একটু খোঁজখবর রাখিস। বিলুটা তো বড় হয়ে গেছে। ওকে তন্ত্রধার করে নেব। কিরে পারবি না? 

তন্ত্রধারের কাজ কি আমি জানি। ধুতি পরতে হবে। নামাবলী গায়ে দিতে হবে। দেবীর সামনে আসনে বসে পুরোহিতদর্পণ আওড়ে যাব। মন্ত্র শুনে শুনে বাবা দেবীর নামে মন্ত্রপাঠ করবেন। বাবাকে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। এতসব মানুষের মধ্যে আমি বাবার পুত্র, আমার খালি গা, জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ, দেবীর মুখে গর্জন, ধুপ ধুনোর গন্ধ, চন্দনের গন্ধ আর আমি বাবার পুত্র হয়ে বসে আছি ভাবতেই ভারি বিভ্রমে পড়ে গেলাম। বাবাকে ঠিক আগের মতো আর অত সহজে বলতে পারলাম না, হাঁ পারব বাবা। কি যেন একটা সংকোচ অথবা লজ্জা বলা যেতে পারে মনের মধ্যে তিরতির করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। 

বাবা ফের বললেন, অন্য তন্ত্রধার নিলে সে তো ভাগ নেবে। পুরোহিত বরণ পাবে। পাঁচ দশ টাকা দক্ষিণা পাবে। সেটা তুই গেলে ঘরেই আসবে। কোনো অসুবিধা হবে না। যেখানে ঠেকে যাব, সেখানে একটু ধরিয়ে দিবি। 

মা বলল, পূজার দেখা নেই। হবে কি হবে না এখন থেকেই…. 

–এই তো ধনবৌ, সবটাতেই আগ বাড়িয়ে বাধা। হবে না কে বলেছে! কী হয়নি। তারপর কালুবাবুর মতো ধনী ব্যক্তির বাড়িতে বাবার চণ্ডীপাঠে আমন্ত্রণ—কোথায় ওঠা গেছে, ধনবৌ বুঝেও কেন যে বোঝে না বাবার মুখ দেখে এমন মনে হল আমাদের। 

বাবা ফের বললেন, বিগ্রহের কৃপায় সবই হচ্ছে, বাকিটুকু হবে। একটা গরু হয়ে গেলে দেখবে, তোমার আকাঙ্ক্ষার কত নিবৃত্তি। 

আমরা বুঝতে পারলাম, বাবার মনে শুধু এখন একটাই দুঃখ, সন্তানদের পাতে সামান্য দুধ দিতে পারছেন না। দুঃখটা ঘোচাবার তালে আছেন সেটা ক’দিন থেকে বাবার কথাবার্তা থেকেই বুঝতে পারছি। এখন শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কতদূর গড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। 

পিলু পাশেই ছিল। ছাগলের বাচ্চাটার জন্য একটা খোঁয়াড় তৈরি করছে। সে বলল, দাদা না গেলে আমি যাব বাবা। আমি ঠিক পারব। 

আমি বললাম, তুই গেলেই হয়েছে। পরের বারে বাবা আর পূজাই পাবেন না। 

পিলু বলল, কেন পাবেন না? 

মা বলল, লোকে ভাববে ছানাপোনা দিয়ে কি কাজ হয়। আর তন্ত্রধার হেলাফেলার কাজ না! ঠাকুরমশাই-এর কি ভীমরতি হয়েছে! 

বাবা খুব গম্ভীর গলায় বললেন, পারলে পিলুই পারবে। তোকে পিলু আমি সব শিখিয়ে দেব। এবং কথা হল, একটা পুরোহিতদর্পণ বাবা যে করেই হোক সংগ্রহ করবেন। কোথায় যে পাওয়া যেতে পারে, পঞ্জিকাটা না হয় প্রতিবছর নিবারণ দাসই এনে দেয়, কিন্তু পুরোহিতদর্পণ! বাবার বোধহয় মনে হল, কালুবাবুর কাছে তাঁর এই বাসনা নিবেদন করলে তিনি দয়াপরবশে দিয়েও দিতে পারেন। মানুষই তো দেয়। তবে আর ভাবনা কেন 

অবশ্য বাবার কাছে একটা পুরনো পুরোহিতদর্পণ থাকার কথা। দেশ বাড়িতে দুর্গাপূজা বাঁধা ছিল। আসার সময় ওটা আনতে ভুলে গেছেন, না হারিয়ে গেছে বাবার কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল না। শুধু বললেন, কাল চণ্ডীপাঠ। বোধহয় বাবা এখন মনে মনে হেঁকে উঠবেন, কাল চণ্ডীপাঠ। কতবড় একটা ঘটনা এটা ছেলেরা যদি বুঝতো! বাবা সকাল সকাল স্নান করলেন। ঠাকুরঘরে আরও সকালে ঢুকে গেলেন। একটা নতুন গামছায় বাবার সব অমূল্য গ্রন্থাদি সযত্নে বাঁধা। ঠাকুরের সিংহাসনের ওপর ওটা রাখা থাকে। বাবার যা কিছু জরুরী কাগজপত্র, সবই ঐ গামছায়। এমন কি দলিল দস্তাবেজ। তাছাড়া বাবার ধারণা, ঠাকুরের মাথার ওপর থেকে হাত দিয়ে কেউ কিছু সরাবার তালে থাকলে, অপহরণকারী ধনে জনে মারা পড়বে। ফলে টাকা পয়সা ঐ একটা গামছায়। ঠাকুরঘরে যেহেতু আমার প্রবেশ করার অনুমতি আছে, সিংহাসনের সবটাই ঘেঁটেঘুঁটে দেখার সৌভাগ্য হয়। বাবার গামছার পুঁটলি খুলে যা যা দেখেছিলাম—একটা তালপাতার পুঁথি। কতকালের জানি না। স্বহস্তে লিখিত কার সেটা বাবা নিজেও জানেন না। বাবার বাবার, না তস্য বাবার, কোন বাবার জানা ছিল না বলে, আমার পিতৃদেব সেটি লাখ টাকার শামিল ভাবতেন। ওতেই পুরো চণ্ডীর বর্ণনা আছে। নিবারণ দাসের দেওয়া পঞ্জিকা, একটা রুদ্রাক্ষের মালা আর নানারকম গাছগাছালির গুণাগুণের একটি বই। দুটো তামার পয়সা। কাশীর কোন এক সাধু বাবাকে দিয়েছিল। এই পয়সার গুণে সংসারে কোনো অপমৃত্যু ঘটবে না। একটা আসন, ওটা কার দেওয়া বাবা আজ পর্যন্ত বলেননি। আসনটাতে বাবা বসেন না। সব সময় তোলা থাকে। আর কিছু লাল নীল পাথর। এগুলি দিয়ে কি হবে বললেও বাবা ভীষণ অহংকারী হয়ে যেতেন। রেখে দাও। তোমাদের কতদিন বলেছি, আমার জিনিসে হাত দেবে না। কিছু ভূর্জপত্র। সঙ্গে আমার আর পিলুর ঠিকুজী কুষ্ঠি। গামছার পুঁটলিটাতে যখন পুরোহিতদর্পণটা নেই, তখন সেটা খোয়া গেছে ধরে নেওয়া গেল। থাকলে ওটা পুঁটলিতেই থাকত। 

কোথাও পূজা-আর্চা থাকলে বাবা খুব সকাল সকাল ঠাকুর ঘরে ঢুকে যান। সূর্য উঠতে না উঠতে কোনো দিন পুজাও শেষ হয়ে যায়। সকালে প্রাতঃস্নান সেরে নেন তাড়াতাড়ি। জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ করেন। এবং গলায় পৈতার যে কী মাহাত্ম্য বাবাকে এই সময়টায় না দেখলে বোঝা যাবে না। একেবারে পরম নিষ্ঠাবান মানুষ। পৃথিবীতে হিংসা-দ্বেষ আছে, চুরি-চামারি, কোর্ট-কাছারি আছে, যুদ্ধ আছে, সিনেমা- বায়স্কোপ আছে, নাটক-নভেল আছে কিছুতেই বিশ্বাস করা যেত না। শুধু ঠাকুরঘর, আমরা ক’জন আর মা’র ব্যস্ততা বাবার ব্যস্ততা, ফুল জল, তিল, তুলসী, দূর্বা প্রভৃতির মধ্যে বাবা একসময় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে শাঁখে ফুঁ দিয়ে কাঁসি বাজিয়ে যখন বের হতেন, তখন হয়তো পিলু দুলে দুলে পড়ছে। বাবা বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বের হচ্ছে সুবাদে পিলুর পড়ায় এত উৎসাহ। যত খুশী থাকবেন, তত তাড়াতাড়ি হবে কাজকর্ম। বের হতে সময় লাগবে না। পিলু সুপুত্র হওয়ার তখন প্রাণপণ চেষ্টা  করত। 

আজ বাবার কোথাও যাবার কথা নেই। পূজা-আর্চা থাকলে, ঘটা করে আগের দিনই সবাইকে বাবা জরুরী খবরটা দিয়ে রাখেন। মায়া খুব সকালে উঠে ফুল দুর্বা তুলে রাখে। ভাইটা মা’র সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়বে ভেবে, আমার পাশে রেখে যায়। বাবাকে জলখাবার যা হোক কিছু, এই মুড়ি খৈ অথবা যবের ছাতু। বাবা যবের ছাতু জলে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে খেতে খুব ভালবাসেন। মাকে তার আগে ঘরদোর লেপে ফেলতে হয়। ঠাকুরঘরের বাসনপত্র মেজে রাখতে হয়। বাবার সঙ্গে মা’রও কাজের তখন অন্ত থাকে না। অথচ আজ এত সকালে কেন বাবা ঠাকুরঘরে প্রবেশ করলেন বোঝা গেল না। পিলু মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসে, দেখে বাবা ঠাকুরঘরে পদ্মাসনে বসে আছেন। সে ভেবে পেল না, সুপুত্র হবে, না ছাগলটাকে নিয়ে ঘাস খাওয়াবে এখন। বাবার তো যাবার কথা নেই কোথাও। সে তবু খুব ভাল ছেলের মতো বলল, বাবা, তুমি কোথাও যাচ্ছ? 

—কেন রে? 

—না এমনি, এত সকালে ঠাকুরঘরে তুমি…… 

বাবা বললেন, পড় পড়। লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। কেবল আমি কখন বের হব সেই তালে থাকে। 

পিলু ধরা পড়ে গিয়ে খুব লজ্জায় পড়ে গেল। সে পড়তে থাকল গলা ফাটিয়ে। 

ছাগলের বাচ্চাটা কি মরে গেছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে দু-পাতা পড়ে মাকে বলল, বাচ্চাটা রা করছে না কেন মা? 

বাবা ঠাকুরঘর থেকেই বললেন, বাচ্চাটা রা করছে না কেন তা তোমার মা কি করে বলবে?

—আমি একবার দেখে আসব? 

বাবা বুঝতে পারলেন বুঝি পুত্রটি বাচ্চাটা সম্পর্কে নাছোড়বান্দা। বললেন, দেখে আয়। না দেখলে তো শাস্তি হবে না। দেখে এস। তারপর একটু পড়ে আমার ঘরবাড়িকে উদ্ধার কর। 

বাচ্চাটা দেখে এসে পিলু বলল, খুব খিদে পেয়েছে বাবা। 

কার খিদে পেয়েছে, পিলুর না বাচ্চাটার ঠিক বোঝা গেল না। বাবা তখন পূজায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন। এখন পিলু পড়ল কি পড়ল না, সংসারে কোথায় কি হচ্ছে জানার কোনো উৎসাহ নেই। তিনি আচমন করার পর কোনো কথাই বলবেন না। তারপর গণেশের পূজা আরম্ভ হবে। বাবা জোরে জোরে বললেন, খর্বং স্থূলতং গজেন্দ্র বদনং লম্বোদর সুন্দর এবং আরও সব মন্ত্রপাঠ আরম্ভ হলে পিলু বইটই ভাঁজ করে প্রথম কুকুরটাকে ডাকল, মনা মনা। মনা তো ছুটে এসে পায়ে গড়াগড়ি। সে এবার বাচ্চাটাকে বগলে নিল। পিলুকে বের হয়ে যেতে দেখে মা আর চুপ করে থাকতে পারল না—পিলুরে তোর কি হল? সাত সকালে কিছু মুখে না দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিস। তোর বাবাকে ডাকবো! পড়াশুনা লাটে ওঠালি! 

পিলু জানে সব অহেতুক। বাবা আর কথা বলছেন না। যতই মা চেঁচামেচি করুক বাবা পূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন বাক্য নয়। কটু বাক্যও নয়। বরং মা’র চেঁচামেচি যত আরম্ভ হবে, বাবার মন্ত্রপাঠের স্বরগ্রাম তত উঁচুতে উঠবে। ততক্ষণে মাও আরম্ভ করে দিয়েছে যেমন বাপ, তেমন ছেলে। একটা কথা বলছে না! হ্যাঁগো শুনতে পাচ্ছ, পিলু দ্যাখো কোথায় বের হচ্ছে। 

—কোথায় বের হব আবার। বাচ্চাটার খিদে পায় না! একটু ঘাসপাতা ছিঁড়ে খাওয়াব তাও তোমার সহ্য হয় না মা। না খাইয়ে শেষ পর্যন্ত তোমরা সবাই বাচ্চাটাকে মারবে! 

অকাট্য কথা। বাচ্চাটা খেল কি খেল না সংসারে আর কারো দেখার অবসর নেই। সেই দেখে থাকে। বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে না খাইয়ে মেরে ফেলে সে তো পাপের ভাগী হতে পারে না। সুতরাং সে সোজাসুজি কিছু গ্রাহ্য না করে বের হয়ে গেল। বগলে ছাগলের বাচ্চা, পায়ে পায়ে কুকুরটা। পিলু এখন সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছে। ঘরবাড়ির প্রতি তার এখন এতটুকু আকর্ষণ নেই। বাবা যতই মন্ত্রপাঠ করুন, যতই রাগে দুঃখে স্বরগ্রাম একবার উঁচুতে একবার নিচুতে নামিয়ে আনুন, পিলুর কিছু আসে যায় না। আসলে সে বাবাকে বোবা বানিয়ে রেখে চলে যাচ্ছে। ফিরে আসার পর এই বাবা আর সেই বাবা থাকবেন না। এইটুকুই পিলুর ভরসা। সে এখন পরিত্যক্ত বনভূমিতে, নবমীর ইঁটের ভাটায়, ঝোপ জঙ্গলে রাজার মতো ঘুরে বেড়াবে। আমরা বুঝে নিয়েছি, বাবা বিদেশে, পিলু স্বদেশে দু’জনই সমান। দুজনে কোন ফারাক নেই। পিলু ফিরে এলে মা’র সামনে বাবার তখন কোন সাহসও নেই কিছু বলার। কারণ কোথাকার জল কতদূর গড়াবে কেউ বলতে পারে না। বোবার শত্রু নেই। এই মহামন্ত্র সম্বল করে বাবা তখনকার মতো সব সামলে নেবেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *