প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

মানুষের ঘরবাড়ি – ১০

দশ 

দেশ ছেড়ে আসার পর, দু-তিন বছর আমাদের কারো কেনো অসুখ হয়নি। এমন কি সামান্য সর্দি কাশিতেও কেউ ভুগিনি। মানুষের অসুখ বিসুখ থাকে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। গাছপালা আর মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকলে তাই বুঝি হয়। শীতের চাদর থাকত না, খালি গায়ে দিন দুপুরে ঘুরে বেড়ানো, গাছ পাতা বনআলু খেয়ে আমাদের আশ্চর্যভাবে জীবনীশক্তি বেড়ে গিয়েছিল। ঠাকুর প্রতিষ্ঠার পর আমাদের এখন প্রায় সুদিনই বলা চলে। শীতের চাদর পর্যন্ত বাবা কিনে দিয়েছেন। আর তখন থেকেই আমরা কেউ কেউ সর্দি কাশির শিকার হতে থাকলাম। সর্দি কাশিতে বাবা গা করতেন না। হয়েছে সেরে যাবে। মানুষের ঘরবাড়ি হবে অসুখ বিসুখ হবে না সে আবার কেমনতর কথা! আমার মা, বাবার হাবভাব কিছুদিন শুধু লক্ষ্য করেই গেল। পিলুর সর্দি-কাশি, মায়ার আমাশয়, আমারও ক’দিন জ্বর, মাও কিছুদিন অম্বলের রোগে ভুগে উঠল। সবই বিনা ওষুধে সেড়ে যাওয়ায় বাবা বললেন, নিজের মধ্যেই আছে, সঞ্জীবনী সুধা। তাকে ধনবৌ বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু বর্ষা পড়তেই একদিন পিলু খুব জলে ভিজে বাড়ি ফিরে এল। পুকুর ডোবা খাল বিল জলে ভেসে গেছে। পিলু ব্যারেকের পুকুরে উজানী মাছের খোঁজে গিয়েছিল। কটা কৈ, মাগুর, সিংগি মাছ সে জলে ভিজে ধরেছে। সারা আকাশ জুড়ে ছিল প্রচণ্ড কালো মেঘ। আর ঝড়ো বাতাস। গাছপালা জলে ভিজে চুপসে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে পিলু বৃষ্টি মাথায় করে মাছ নিয়ে যখন ফিরল, তখন মা ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বেলে দিচ্ছে। বাবা বাড়ি নেই। ঠাকুরের বৈকালির কাজ আমাকেই সারতে হবে। সে সময় পিলু গামছা খুলে বলল, দাদা দেখবি আয়। বারান্দায় বের হয়ে দেখলাম, সত্যি কত বড় সব সিঙ্গি, কৈ, মাগুর। সে বলল, কী মাছরে দাদা। আবার যাবি? এমন ঝড় বৃষ্টিতে আমার যেতে সাহস হল না। আর মাও দেখলাম বেশ চুপচাপ। পিলু আবার বলল, মাঠে মাছ উঠে আসছে। কত মাছ ফসকে গেল। মা কুপি জ্বেলে মাছ দেখতেই সহসা চিৎকার করে উঠল, ওরে পিলু, তোর প্যান্টে এত রক্ত কেন রে! 

পিলু হাসতে হাসতে বলল, সিঙ্গি মাছের কাণ্ড মা। হাত ফুঁড়ে দিয়েছে। কিন্তু পিলুর মুখ দেখে আমার ভাল লাগল না। কেমন সাদাটে আর নীল দেখাচ্ছে মুখটা। মা তাড়াতাড়ি কিছুটা হলুদ গরম করে আনতে গেল। পিলু এত সবের মধ্যেও মাছগুলি নিয়ে রাখল হাঁড়িতে। প্যান্ট ছেড়ে একটা খোট পরে নিল। বলল, খুব শীত করছে রে দাদা। বলে সে মার একটা শাড়ি দু ভাঁজ করে গায়ে দিয়ে কেমন ঝিম মেরে বসে থাকল। 

মায়া তখন কাছে গিয়ে বলল, এই ছোড়দা ঝিমুচ্ছিস কেন? 

—খুব শীত করছে। 

—শীতে কেউ ঝিমোয়? 

—মেলা কথা বলবি না। যা তো! 

ঝিমুনোর কথায় আমারও খুব একটা ভাল লাগছিল না। বললাম, সত্যি সিঙ্গি মাছে কুঁড়েছে না অন্য কিছু। 

—অন্য কিছু আবার হতে যাবে কেন! 

—তুই দেখেছিস? 

—জলে দেখা যায়। ঘাসের মধ্যে অন্ধকারে হাত দিতেই ফুঁড়ে দিল। লম্বা। ধরতে পারলাম না। কত বড় যে না! বলেই ওর চোখ বুজে আসছিল। 

আমার কেমন ভয় ধরে গেল। মাকে তাড়াতাড়ি ডেকে বললাম, পিলু কেমন করছে। মা দৌড়ে এল। বলল, কি হয়েছে? 

পিলু ঝিমোচ্ছে। 

মা তাড়াতাড়ি গরম হলুদ আঙুলে লাগিয়ে বলল, ব্যথা করছে? 

—না। 

—জ্বালা করছে? 

—না। 

—তোমার কিছুই করছে না। তবে ঝিমোচ্ছ কেন? 

—ঘুম পাচ্ছে। 

—পোকামাকড়ে কাটেনি তো? 

পিলু বলল, না। 

আমি বললাম, যখন ফুঁড়ে দিল, তখন ব্যথা করছিল? 

—টের পাইনি।—কত মাছ! মাছ ধরব, না ব্যথা টের পাব। 

মা কেমন হাউমাউ করে কাঁদতে বসে গেল। পিলু ঝিম পায় কেনরে! সিঙ্গি মাছে ফুঁড়ে দিলে ব্যথা করবে। তুই কী ধরতে কীসে হাত দিয়েছিস রে! 

মহা জ্বালা দেখছি। মা কাঁদতে কাঁদতে ওর হাতের কব্জিতে মশারির দড়ি বাঁধাতে গেলে, পিলু মহারোষে উঠে দাঁড়াল। বলল, বলছি তো পোকামাকড়ে কামড়ায়নি। এবং আমার সামনে তখন একটা মহাভুজঙ্গ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—দেখতে পাচ্ছি, পিলুর সর্বনাশ হয়ে গেছে। সংসারে মহা সর্বনাশ। বাবা কাল ফিরে এসে কি দেখতে পাবেন বুঝতে পারছি না। ভেবেচিন্তে কিছুই করতে পারছি না। আর মার এই হাউমাউ কান্না বনটার মধ্যে কেউ শুনতে পাবে না— মানুষের এটা কত বড় বিপদ এই প্রথম টের পেয়ে এক দৌড়ে নিবারণ দাসের বাড়ি যাব ভাবতেই মা বলল, অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছিস! শুধু সেই অন্ধকার এবং ঝড় বৃষ্টি থেকে চিৎকার করে বললাম, নিবারণ দাসের বাড়িতে যাচ্ছি মা। জ্যাঠাকে খবরটা আগে দিই। 

পাল্লা দিয়ে ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি। শাঁ শাঁ শব্দ। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পথের যখন যেখানে পা দিচ্ছি, মনে হচ্ছে কেবল সাপ। যেন হাঁটলেই পাটা সাপের মাথায় পড়বে। আর এ- সময়ে মনে পড়ল বাবার সেই মহাবাণী, উচ্চারণ করলাম, দোহাই আস্তিকমুনি। আমরা এই বনভূমি সাফ করার সময় কত বড় বড় গোখরো সাপ দেখেছি। বাবা একটাও মারতে দেননি। দেখলেই তিনি বলতেন, দোহাই আস্তিকমুনি। সাপেরা তখন মাথা নিচু করে ঝোপে জঙ্গলে ঢুকে যেত। এবং এসবে আমার এবং মার তাছাড়া পিলুর কোনই বিশ্বাস ছিল না। কেবল মনে হত বাবাকে ভালমানুষ পেয়ে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে সাপগুলো। অথচ এখন ঝড় বৃষ্টিতে অন্ধকারে হাতের কাছে এমন মহাসম্বল পেয়ে আরও বেগবান হয়ে গেলাম। মানুষের কি যে থাকে। আকাশ ফালা করে দিচ্ছে তখন বিদ্যুতের শেকড়বাকড়। 

একবিন্দু আর ভয় নেই। যেন সেই আস্তিকমুনির দোহাই শুনে সব আস্তিকেরা আমাকে দেখলেই পালাচ্ছে। এবং মহাভারতের পুণ্যশ্লোকের মতো আকাশ ধরণী নিমেষে বড় পবিত্র হয়ে গেল। বুঝলাম বাবার সব বিশ্বাসই বড় পবিত্র ইচ্ছের দ্বারা চালিত। বুঝতে পারলাম মানুষের ঘরবাড়ির সঙ্গে এমন সহায় সম্বল না থাকলে সে খুবই অসহায়। এবং কখন নিবারণ দাসের বাড়ি পৌঁছে গেছি খেয়ালই করিনি। এত বড় একটা দুর্যোগের মধ্যে এতটুকু ক্লেশ নেই শরীরে। রাস্তার দু-পাশে আকাশে বাতাসে কি ছিল টের পাইনি। সামনে নিবারণ দাসের বাড়ি আর মুখে দোহাই আস্তিকমুনি, এতক্ষণ এই ছিল আমার অস্তিত্ব। 

দাসের মা বলল, আড়ত থেকে তো ফেরেনি। এই ঝড় বাদলায় ভিজে। কি খবর কর্তা। কেবল কোনরকমে বললাম, পিলুকে কিসে কেটেছে। 

নিবারণ দাসের মা হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ওর ছোট মেয়ে বলল, ঠাকুর ছাতা নিয়ে যান। আমি আর কিছুই শুনতে পাইনি। কারণ শরীর তখনও ভারি বেগবান। একটা পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছি। দু-বার আছাড় খেয়েছি। সারা শরীর কাদায় লেপ্টে গেছিল, আবার যেতে যেতে কখন তা বৃষ্টিতে ধুয়েও গেছে। পেছনে একবার তাকাতেই মনে হল, বাড়িটা বৃষ্টির ঝাপটায় কুয়াশার মধ্যে যেন আবছা হয়ে গেছে। নিবারণ দাসের আড়ত সামনে। ঝড় বৃষ্টির জন্য পাল্লা ভেজানো! ফাঁক দিয়ে হ্যাজাকের আলো বাইরে এসে পড়ছে। সামনে দুটো গরুর গাড়ি। গাড়িগুলোর ওপর দিয়ে লাফ মেরে নেমে গেলাম। একটা গরুর পিঠে পা পড়ল, এবং পাল্লা ফাঁক করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, জ্যাঠা, বাবা বাড়ি নেই, পিলুকে কিসে কেটেছে। মা কাঁদছে। 

নিবারণ দাস বলল, কী বলছেন, কিসে কাটবে! 

—মাছ ধরতে গেছিল। শীতে শরীর কাঁপছে পিলুর। আর ঝিমুনি। কিছুতে যদি কেটে থাকে, কি করব? 

নিবারণ দাস সাহস দেবার জন্য বলল, কিচ্ছু হয়নি। দাঁড়ান। সব তো ভিজে গেছে! ছাতা আনেননি কেন? এই গোপাল, টাকাগুলো তুলে রাখ। চাবিটা দে। শিগরির কর। 

গরীব মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাস ছাড়া কিছু সম্বল থাকে না। বাবারও তাই সম্বল। অথচ আমরা, বিশেষ করে মা এবং পিলুর ঈশ্বর বিশ্বাসে ঘাটতি ছিল খুব। সারাটা রাস্তা ভারি দুর্গম। ঝড় জলে সাপখোপের উপদ্রব বাড়ে। এতটা পথ একা অন্ধকারে ঝড় জলের মধ্যে কী করে এলাম! নিবারণ দাসের কথায় যেন সংবিৎ ফিরে পেয়েছি। শীত করছে। জানি একা এতটা পথ আর অন্ধকারে যেতে পারব না। ভূতের ভয় এবং সাপখোপের ভয়। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। নিবারণ দাসের জন্য অপেক্ষা করব না আবার যেমন এসেছিলাম তেমনি ঝড় জলে বের হয়ে পড়ব। বাবা বাড়ি নেই। মা একা। বনভূমির মধ্যে মা’র অসহায় চোখ মুখ একদণ্ড স্থির থাকতে দিচ্ছে না। সম্বল বলতে আমার গলায় পৈতা আছে আর সাপখোপের জন্য আছেন, আস্তিকমুনি। এবং এই সম্বল করে আবার বের হয়ে ছুটব ভাবছি, খবরটা যখন দিয়েছি, নিবারণ দাস ঠিক যাবে, ওর দেরি হতে পারে, আমার দেরি হলে মা আরও ভেঙে পড়বে। বললাম, জ্যাঠা আপনি আসুন। আমি যাচ্ছি। 

নিবারণ দাস রে রে করে উঠল।—আরে না না। আমি যাচ্ছি সঙ্গে। গোপাল, বাবা তাড়াতাড়ি কর।

তাড়াতাড়ি বললেই তো আর হয় না। পাটের আড়ত। কত কাজ গোপালের। দুজন দেহাতী লোক পাটের গাঁট সব তুলে ভিতরে নিয়ে রাখছে। সব রাখতে দেরি হবারই কথা। তারপর দরজা বন্ধ করা, গোটা দশেক তালা ঝোলানো, এতসব কাজের জন্য দেরি হতেই পারে। আমার কাছে একদণ্ড কত অমূল্য সময় এই প্রথম টের পেলাম। 

রাস্তায় নিবারণ দাস ছাতা মাথায় বড় ঠুকে ঠুকে হাঁটছিল। টর্চ মেরে গোপাল আগে আগে যাচ্ছে। আমি আরও আগে। নিঝুম অন্ধকার, গাছপালার সাঁই সাঁই শব্দ আর কড়াৎ করে বাজ পড়ার মাঝে মাঝে বিকট আওয়াজ। সব কিছুই কত সহজে এক নিমেষে তুচ্ছ করতে শিখে গেলাম। কেবল আশঙ্কা ভেতরে, পিলু এখন না জানি কেমন আছে। পিলু তোর এত মাছ ধরার বাই কেনরে। পিলুর ওপর অভিমানে চোখ ফেটে জল আসছিল—কিছু যদি ওর হয়ে যায় দেখ তোমাকে আমি কি করি। তারপরই মনে হল বাবার যখন ভগবান আছে, তখন খুব একটা কিছু হবে না। শুধু দুর্ভোগ কিছুটা ওর। মনে মনে বললাম, ঠাকুর পিলুকে ভাল করে দাও। ও খুব দুষ্ট ছেলে। ওকে কষ্ট দিও না ঠাকুর। ও সংসারে না থাকলে আমাদের কিছুই থাকবে না। এবং যতভাবে দরকার ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে কখন যে বাড়ির রাস্তায় হাজির টেরই পাইনি। দু-লাফে একেবারে উঠোন ডিঙিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে বললাম, জ্যাঠা আসছে। পিলু, এই পিলু। কোন সাড়া দিচ্ছে না। এই পিলু জ্যাঠা আসছে রে। আর কোন ভয় নেই। 

পিলু খুব ক্ষীণ গলায় বলল, দাদা তুই খুব ভীতু। আমার কিছু হয়নি রে!

পিলুকে তো জানি। সে দশটা কথা বললে পাঁচটা মিছে কথা বলে। এখন দাদাকে ঘাবড়ে যেতে দেখেও মিছে কথা বলছে। 

নিবারণ দাস ঘরে ঢুকতেই মা উঠে দাঁড়াল। মা একটা কথা বলল না। এতক্ষণ পিলুকে জাগিয়ে রাখার জন্য জোরজার করে বসিয়ে রেখেছে। ঘুমিয়ে পড়লেই সব শেষ। দাস লাঠিটা বেড়ার পাশে রেখে পিলুর কপালে হাত দিল। বলল, ও কি তাত? খুব জ্বর হয়েছে দেখছি! জলে কাদায় ঘুরে বেড়ালে তো জ্বর হবেই কর্তামা। ওকে শুইয়ে দিন। 

মা ঘোমটা সামান্য আরও টেনে বলল, কিসে কেটেছে। ও দেখেনি। হাত বেঁধে দিয়েছি।

নিবারণ দাস হা হা করে হেসে দিল। বলল, কর্তামা পোকামাকড়ে কাটলে শরীরে তাপ ওঠে না। কৈ দেখি হাতটা মেজ ঠাকুর? বলে টর্চ জ্বেলে আঙুলের কানা দেখল। টিপে টিপে বলল, বেশ জাঁদরেল মাছ ছিল দেখছি। ধরতে পারলেন না! 

পিলু কেমন সাহস পেয়ে গেছে। সে বলল, খুব বড় ছিল। এই বড় জ্যাঠা। মাছটা না…..। নিবারণ দাস দড়ির গিঁটগুলি খুলে দিতে দিতে বলল, ও কি বেঁধেছেন, হাতে দাগ বসে গেছে! এতক্ষণ বোধহয় হাতটা পিলুর ভীষণ টনটন করছিল, বাঁধন খুলে দিতেই পিলু যেন প্রাণ পেয়ে গেল। বলল, জ্যাঠাকে দেখা না দাদা, কত বড় বড় সিঙ্গি মাগুর ধরেছি। যেন ওর কিছুই হয়নি। মারও মনে জোর এসে গেছে। মা তাড়াতাড়ি মাছগুলি টেনে নিয়ে এনে দেখাল, দেখুন কী কাণ্ড, কত বড় মাছ। নিবারণ দাস বলল, মেজ ঠাকুর আপনার কিছু হয়নি। জলে কাদায় ভিজে জ্বর হয়েছে, সেরে যাবে। এত বড় বড় মাছ ধরেছেন একটু জ্বর জ্বালা হবে না সে কি করে হয়। 

এই বলে নিবারণ দাস গোপালের সঙ্গে বের হয়ে গেল। মা বসতে বলল একটু। আমাকে তামাক সেজে দিতে বলল, নিবারণ দাস জানাল, বাবা এলে বসবেন। তামাক খাবেন। কেমন থাকে পিলু, সকালে একটা খবর দিতেও বলে গেল। মানুষের ঘরবাড়ির সঙ্গে একজন ভাল প্রতিবেশী কত দরকার এই প্রথম আমরা টের পেলাম। নিমেষে সব ভয় আতঙ্ক কত সহজে দূর হয়ে গেল। আমার মা দেখলাম আবার বীরাঙ্গনার মতো চলাফেরা করছে। বলছে, ওরে, ঠাকুর শোওয়ানো হয়নি। যা বাবা বৈকালিটা দিয়ে আয়। পিলু তুমি আর বসে থেক না। মায়া কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়িঘরে এমন একটা আতঙ্ক এসে ভর করেছিল সে টেরই পায়নি। 

কাপড় ছেড়ে ঠাকুরঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি প্রদীপটা ঝড়ো হাওয়ায় কখন নিভে গেছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সাঁ সাঁ শব্দ খড়ের বাড়িটার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। জোরে কথা না বললে, ও-ঘর থেকে কিছুই শোনা যায় না। ডাকলাম, মা দেশলাইটা দাও। প্রদীপ জ্বালাতে হবে। অন্ধকারেই দেখলাম দরজায় একটা লম্বা হাত। মা আলো জ্বালাবার জন্য দেশলাই বাড়িয়ে ধরেছেন। আলো জ্বালা হলে দেশলাইটা আবার নিয়ে যাবে। বললাম, তুমি আবার বাইরে দাঁড়িয়ে জলে ভিজছ কেন মা। তোমরা সবাই দেখছি একরকমের। মা হেসে বলল, আমার কিছু হবে না! তুই আলোটা ধরা তো। 

প্রদীপটা জ্বাললে দেখলাম, মা আমার প্রণিপাত করছেন। জল ঝড়ে কার উদ্দেশ্যে এই প্ৰণিপাত জানি। সামান্য দুটো পেতলের মূর্তি সাক্ষাৎ দেবতার মতো মিটি মিটি হাসছেন তখন। শালগ্রাম-শিলার মাথায় তুলসীপাতাটি চন্দনের গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাবার কথা মনে হল। দূর থেকে তিনি কি সব টের পান। তিনি বুঝতে পারেন, আমরা কেমন আছি। বাবা গলায় ঝুলিয়ে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে এসেছিলেন, এখন আমার তালুতে সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কত সহজে তাকে ধারণ করে আছি। পিলু তখন, চেঁচিয়ে বলছে, দাদা, বাতাসা সব তুই একা খেয়ে ফেলবি না। আমার জন্য রাখিস। বৈকালির গোনাগুনতি তিনটে বাতাসা। এবং আমার পূজার পালা থাকলে, পূজা শেষে চুরি করে সবটাই খেয়ে ফেলার স্বভাব আছে। প্রসাদ কণিকা মাত্র, এক কণিকা প্রসাদ দিলে পিলু চিৎকার করে বলত, দেখ মা দাদাটা কি রাক্ষস। সব একা একা খেয়ে আমাদের শুধু হাত ছোঁয়াচ্ছে। বৈকালি শেষে, দুর্লভ তিনটি বাতাসাই ঘরে ঢুকে পিলুর হাতে দিয়ে বললাম, পিলু ওঠ। প্রসাদ নে। বলে তিনটে বাতাসা ওর হাতে দিলে সে খুব অবাক হয়ে গেল। বলল, কিরে দাদা, সবই আমাকে দিলি। তুই নে মাকে দে। প্রসাদ সবাইকে খেতে হয়। বলে পিলু নিজের জন্য একটা রাখল, মাকে একটা দিল, আমাকে একটা। অন্যদিন আমি জানি, পিলু কিছুই পেত না, কণিকা ছাড়া, আজ পিলুর চেয়ে আমি সদাশয়। পিলুকে বললাম, আমারটা তুই খা পিলু। আসলে মানুষের ঘরবাড়ির মায়া এমনিতেই বাড়ে। পিলুর মতো আমার একটা ভাই আছে বলেই বাড়ে। কিছুক্ষণ আগে টের পেয়েছি, বাবার ঘরবাড়িতে পিলুর বেঁচে থাকা কত দরকার। সে না থাকলে অন্ধকার কি গভীর তাও জানি! সামান্য একটা বাতাসা দিয়ে তা কেনা যায় পিলুর আশ্চর্য অকৃত্রিম হাসিটুকু না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *