মানিকদার সমতুল্য অভিনেতা ভারতবর্ষে নেই
প্রথম নাট্য আন্দোলনের সময় অর্থাৎ ১৯৫২/৫৩ সালে একটা জোর আড্ডা বসত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে। আমরা আড্ডা দিতাম কমনসে, আর একটা আড্ডা ছিল লর্ডসে। এই লর্ডসেই মানিকদাকে প্রথম দেখি। তিনি তখন একজন প্রখ্যাত কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। একদিন শুনলাম সত্যজিৎ রায় একটা ছবি করছেন—’পথের পাঁচালী’। আমাদের সেক্রেটারি ৺রবি সেনগুপ্ত এবং তখনকার তাবড় বুদ্ধিজীবীরা সেই নিয়ে খুব আলোচনা করতেন। আমরা শুধুই শুনতাম। ‘পথের পাঁচালী’ একদা রিলিজ হল। তারপর কী কী ঘটল সেটা সকলেরই জানা।
তারপর দীর্ঘদিন চলে গেছে। মানিকদা ছবির পর ছবি করে চলেছেন। আমরাও চুটিয়ে নাটক করে চলেছি। সেই সময় আনন্দ ও নিরানন্দ পাশাপাশি থাকত। ১৯৬০ সালে একদিন শুনলাম সত্যজিৎ রায় ‘অঙ্গার’ দেখতে আসছেন। দেখলেন এবং খুব প্রশংসাও করে গেলেন। ১৯৬১ সালে আমার এলটিজি-র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকে গেল। প্রায় অসহায় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় ডাক এল তপন সিংহর ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’য় কাজ করার জন্য। কাজ করছি, বেশ লাগছে একটা নতুন মিডিয়াম। কাজ সেরে একদিন সেই কফি হাউসে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছি বাসে করে, সেই সময় দেখা ভানু ঘোষের সঙ্গে। ভানু তখন মানিকদার Asst. Production manager. এবং এককালে আমার স্কুলের সহপাঠী। ভানু বলল, ‘কীরে কোথায় থাকিস,—তোকে মানিকদা খুঁজছে।’ সোজা সেই সন্ধ্যায় ভানুর সঙ্গে মানিকদার লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে। এই প্রথম, জীবনে আমি মানিকদার সঙ্গে সামনাসামনি কথাবার্তা বললাম। এক মুহূর্তে মনে হল যেন মানিকদার সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়। বললেন, ‘তোমাকে একটা পার্ট করতে হবে। মোটর গাড়ির cleaner, করবে তো?’ আমার সেইদিনকার মনের ফিলিংস লিখবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। মেকআপ টেস্ট হল—ড্রেস-এর কাজকর্ম হল। এইবার প্রথম দিন শুটিং—টেকনিসিয়ানস স্টুডিয়োতে। প্রথমেই মুগ্ধ হলাম মানিকদার গলার আওয়াজ শুনে। সে গলায়—শাসন আছে—স্নেহ আছে—ভালোবাসা আছে আর আছে সুপ্রিম কমান্ড করার ক্ষমতা। প্রথম ছবি আমার ‘অভিযান’। শটটা বোঝাতে গিয়ে এত সহজ করে দিলেন যে অভিনয়ের স্ট্রেনটাই বুঝতে পারলাম না। আর অভিনয়—কী আর বলব, সেই ‘অভিযান’ থেকে শেষ ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত দেখলাম। আমার মনে হয় মানিকদার সমতুল্য অভিনেতা ভারতবর্ষে নেই। মানিকদা যখন অভিনয় করে দেখান তখন চরিত্রের ফিলজফি আর ইনটেলকট ঠিকরে বেরিয়ে আসে। আমরা অভিনেতারা তার ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ নিতে পারি। আমাকে মানিকদা সবসময় একটু ইমপ্রাোভাইস করার সুযোগ দেন (হয়তো আমি বাড়াবাড়িটা একটু কম করি বলে)। কিন্তু সেটা তখনই অ্যালাউ করেন যতক্ষণ তার ফ্রেমটা নষ্ট না হয়। মানিকদা কখনই রিজিড নয়, ভীষণ মেথডিক্যাল। যখন মানিকদা ফ্লোর-এ আসেন তখন তিনি সম্পূর্ণ তৈরি। অর্থাৎ হোম ওয়ার্ক মানিকদার অসাধারণ।
ইমপ্রাোভাইজেশন-এর একটা উদাহরণ দিই। ‘অভিযান’-এ একটা সিন-এ ওয়াহিদার সঙ্গে কথা বলে আমি হেঁটে চলে যাচ্ছি—এই ছিল দৃশ্য। আমার হাতে একটা খেলনা ছিল। আমার ওপর ডিরেকশন ছিল হেঁটে চলে যাওয়া। —ব্যাস আর কিছু নয়। কিন্তু শট-এর মধ্যে আমি দেখতে পেলাম একটা মোষ মাটিতে শুয়ে আছে। আমার কী খেয়াল হল—আমি লাফ দিয়ে মোষটাকে টপকে গেলাম। মোষটাও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠল। আমার প্রচণ্ড ভয় হল বোধহয় শটটা খারাপ করে দিলাম। কিন্তু দূর থেকে মানিকদার গলা শুনলাম—’ফাইন’ অর্থাৎ এই যে কাণ্ডটা আমি করলাম এতে সিনটার ক্ষতি হল না, বরং একটু মজা বাড়ল। মানিকদা শুটিং-এর সময় অসীম পরিশ্রম করতে পারেন। যে পরিশ্রম দেখলে শিল্পীরাও মাঝে মাঝে লজ্জা পাবেন। কিন্তু কোনওদিনই মানিকদাকে শিডিউল আওয়ার্স-এর বাইরে কাজ করতে হয়নি। ঠিক দশটা থেকে সাড়ে ছ’টা—ব্যাস। একটা ঘটনা মনে আছে—’গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর সময়। বীরভূমে শুটিং—সেই প্রথম গানটা। একটা লাইফ কন্ডিশানে পরপর তিন দিন শুটিং ফাস্ট টোয়াইলাইট-এ শট অর্থাৎ আমাকে আর তপেনকে উঠতে হত প্রায় ভোর তিনটে নাগাদ। একটু কষ্ট কষ্ট ভাব প্রকাশ করেছিলাম একদিন। মেকআপ করে বেরিয়ে দেখি—মানিকদা পায়চারি করছেন এবং আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তখন ঠিক ভোর চারটে। কী লজ্জা!
আর একটা ঘটনা নৃপতিদাকে নিয়ে। তিনি আসতে দেরি করছেন। আমরা সবাই রেডি। নৃপতিদার পাত্তা নেই। প্রায় বেলা বারোটা নাগাদ নৃপতিদা এলেন, পুরো তৈরি—দাঁড়াতে পারছেন না। মানিকদা ফ্লোরে চুপ করে বসে আছেন। খুব সন্তর্পণে মানিকদাকে গিয়ে বলা হল যে নৃপতিদা এসেছেন, কিন্তু দাঁড়াবার মতো অবস্থায় নেই। একটু চুপ করে থেকে মানিকদা বললেন, ‘বসে থাকতে পারবে তো—তাহলেই আমার শটটা হয়ে যাবে।’ নৃপতিদাকে ফ্লোর-এ মেকআপ করিয়ে ধরে আনা হল এবং একটা চেয়ার-এ বসানো হল। চতুর্দিক থমথম করছে। সবাই ভাবছে হয়তো মানিকদা প্রচণ্ডভাবে রাগ প্রকাশ করবেন। একটু দূরে মানিকদা বসে ব্যাপারটা ওয়াচ করছিলেন। নৃপতিদার কাছে এগিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একটু বসে থাকতে পারবেন তো?’ নৃপতিদা স্যালুট-এর ভঙ্গিতে বললেন, ‘ওয়ার্ক ইজ ওয়ার্ক’। মানিকদা ফিক করে হেসে ক্যামেরায় গিয়ে বসলেন।
দেশ ২৮ মার্চ ১৯৯২