মানিকচাঁদের কীর্তি

মানিকচাঁদের কীর্তি

অবশেষে চোর ধরা পড়ল৷ ক’দিন ধরে পাড়ায় তর্ক চলছিল, চোর না ভূত? ভূত না চোর? ভূত হলে তো ধরাই যেত না৷

এমন এমন চুরির ঘটনা শোনা যাচ্ছিল, যা চোরের কাণ্ড বলে বিশ্বাস করাই শক্ত হচ্ছিল৷

বুলামাসি স্নান করতে ঢুকে সোনার দুল দুটো খুলে রেখেছেন বাথরুমে৷ বেরুবার সময় ভুলে গেলেও মনে পড়ল সাত মিনিট বাদেই৷ এর মধ্যে আর কেউ বাথরুমে যায়নি৷ একদম শিওর৷

দরজা খুলে বুলামাসি দেখলেন, জানলার পাশে যেখানে দুল দুটো রেখেছিলেন, সেখানে নেই৷ তা হলে কি সাবানদানিতে রেখেছেন? নাঃ! তা হলে অন্য কোথাও?

সারা বাথরুম তন্নতন্ন করে খোঁজা হল৷ কোথাও সে দুল নেই৷ কোথায় গেল?

সাততলার ওপর ফ্ল্যাট৷ কোনো চোরের পক্ষেই বাথরুমের জানলা দিয়ে উঁকি মারা সম্ভব নয়৷ এদেশে স্পাইডারম্যান আসে না৷ আর স্পাইডারম্যান কিছু চুরিও করে না৷ তা হলে নিশ্চয়ই ভূতের কাণ্ড৷

মিত্তিরদের বাড়ির ছাদে অনেক জামা-কাপড় মেলা ছিল৷ ছাদের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ৷ সন্ধেবেলা ও বাড়ির কাজের লোক রঘু জামা-কাপড় তুলতে এসে দেখল, সব জামা-কাপড় মেঝেতে ছড়ানো৷ ঝড়-টড় কিছু হয়নি, তবু জামা-কাপড়গুলো মেঝেতে পড়ল কী করে? সব তুলতে গিয়ে রঘু দেখল টুবলুর দুটো হাফ প্যান্ট নেই৷ অথচ ক্লিপ দিয়ে তারে আটকানো ছিল৷

কোথায় গেল টুবলুর প্যান্ট?

ভূতুড়ে কাণ্ড ছাড়া এ আর কী হতে পারে?

কেউ কেউ অবশ্য ভাবে, ভূতেরা সোনার দুল, বাচ্চা ছেলের প্যান্ট, কারুর হাতঘড়ি, কোনো বাড়ির থালাবাটি এসব নিয়ে কী করবে? হাফ প্যান্ট পরা ভূত, সোনার দুল পরা পেতনি কেউ কখনো দেখেছে কী?

প্রতিদিনই কিছু না কিছু চুরি হচ্ছে বলে অতিষ্ঠ হয়ে পাড়ার লোক একদিন সদলবলে নালিশ জানাতে এল থানায়৷

থানার বড়বাবুর নাম ভূতনাথ দাঁ৷ তিনি সবার কথা শুনে বললেন, ভূত না চোর, তা আপনারা আগে ঠিক করুন৷ চোর হলে ঠিক ধরে ফেলব৷ কিন্তু ভূত ধরার সাধ্য আমার নেই৷

একজন জিজ্ঞেস করল, তবে আপনার নাম ভূতনাথ কেন?

দারোগা বললেন, বাবা-মা নাম রেখেছেন, তা আমি কী করব! ভূতনাথ মানে কিন্তু মহাদেব৷

একজন লোক চেঁচিয়ে বলল, ভূতই হোক আর চোরই হোক, আমাদের জিনিসপত্র আমরা ফেরত চাই৷

দারোগা বললেন, সে ব্যাপারে কথা দিতে পারছি না৷ আপনারা ভালো করে নজর রাখুন৷ যদি ভূত দেখতে পান, তক্ষুনি আমাদের জানাবেন৷ আমরা সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলব৷ ভূতের সঙ্গে পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই৷ আর যদি ছিঁচকে চোর হয়, সেটাই মনে হচ্ছে, তাকে ধরে ফেলব তিন দিনের মধ্যে৷

কিন্তু তিন দিনেও ধরা পড়ল না চোর কিংবা ভূত৷ এর মধ্যে হাপিস হয়ে গেল একটা দামি শাড়ি, এক বাড়ির টিফিন কেরিয়ার, আরও কত কী৷

সন্ধের পরই চুরিগুলো হয়, তাই পুলিশ টহল দিল রাস্তায় রাস্তায়৷ চুরি তবু থামে না৷

শেষ পর্যন্ত একদিন ভূতনাথ দাঁ নিজেই দেখতে পেলেন চোরটাকে৷

যে বাড়িতে থানা, সেই বাড়িরই তিনতলায় বড়বাবুর নিজের কোয়ার্টার৷ তাঁর বউ-ছেলে-মেয়ে নেই, তিনি একলাই থাকেন৷

সারাদিনই তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়, অনেক রাত্তির পর্যন্তও কাজ থাকে৷ তাই তিনি সন্ধেবেলা ওপরে উঠে এসে নিরিবিলিতে চা খান, একটুক্ষণ বিশ্রাম নেন৷

পাশেই একটা খোলা ছাদ৷ সেখানে তাঁর অনেক জিনিসপত্র ছড়ানো থাকে৷ দু’দিন ধরে তিনি লক্ষ করেছেন, কিছু কিছু জিনিস যেন কমে যাচ্ছে৷ কে নিচ্ছে? থানার বড়বাবুর কাছ থেকে কিছু চুরি করার সাহস তো কারুর হবে না৷

তবে কি ভূতের উপদ্রব?

বড়বাবু বসে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, ছোট ছাদটার পাঁচিলের ওদিক থেকে দুটো হাত উঠে এল৷ মনে হল, বাচ্চা ছেলের হাত৷ এই তাহলে চোর, আর সে একটা বাচ্চা ছেলে৷ দেওয়াল বেয়ে ওঠে কী করে?

ভূতনাথ নিঃশব্দে বসে রইলেন৷

এবারে উঠে এল একটা মুখ৷

আবছা অন্ধকারে সেই মুখখানাকে মনে হল কোনো বুড়ো মানুষের মতন৷ বাচ্চা তো নয়৷

সে মুখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই চেয়ারে বসা ভূতনাথকে দেখতে পেয়ে গেল৷ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল স্থিরভাবে৷

ভূতনাথ বলে উঠলেন, ওরে ব্যাটা তোর এই কীর্তি?

সঙ্গে সঙ্গে চোরটা হুপ শব্দ করে লাফ মারল পাশের দিকে৷ একটা জলের পাইপ ধরে নামতে লাগল সরসরিয়ে৷

ভূতনাথ পাঁচিলের কাছে এসে উঁকি মেরে দেখলেন বাঁদরটাকে৷

আগেই তাঁর একটু একটু সন্দেহ হয়েছিল৷ একটা বাঁদরের পক্ষেই দরজা বন্ধ থাকলেও ছাদে উঠে আসা সম্ভব৷ সাততলার ফ্ল্যাটের বাথরুমের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সোনার দুলও সে তুলে নিতে পারে৷

কিন্তু এখানে বাঁদর এল কোথা থেকে? কাছাকাছি তো জঙ্গল নেই৷

দমদমে একসময় অনেক গাছপালা ছিল, সে সব কেটেকুটে প্রচুর বাড়ি বানানো হয়েছে৷ গাছ-কাটা যখন নিষেধ হল, তার আগেই কাটা হয়ে গেছে গাছ৷ শুধু একটা খালের ধারে কয়েকটা গাছ আছে৷ তাও বেশি বড় নয়৷ সে গাছে তো বাঁদর থাকে না৷ কখনো বাঁদর দেখা গেলেও পাড়ার ছেলেরা ঢিল মেরে তাড়াবে৷

তা ছাড়া, চোরাই জিনিসগুলো বাঁদরটা লুকিয়ে রাখবে কোথায়? শাড়ি, জামা-কাপড়, বাসনপত্র এসব তো কোনো গাছের ওপর রাখা যায় না৷

তাহলে বাঁদরটা নিশ্চয়ই কারুর পোষা৷ সেই লোকটাই বাঁদরটাকে দিয়ে চুরি করাচ্ছে৷ সেই লোকটাই আসল চোর৷

বড়বাবু তখনই অন্য পুলিশদের হুকুম দিলেন, এ তল্লাটে কে বাঁদর পুষেছে কিংবা কোন বাড়িতে বাঁদর আছে তা খুঁজে বার করতে হবে৷

তিন-চার দিনের মধ্যেও কোথাও বাঁদরের খোঁজ পাওয়া গেল না৷ কে আর শখ করে বাঁদর পুষবে?

একসময় রাস্তায় রাস্তায় বাঁদরের খেলা দেখানো হত৷ এখন আর তাদের দেখা যায় না৷ এখন সার্কাসেও বাঘ-সিংহর খেলা দেখানো বন্ধ, সেই সব বাঘ-সিংহগুলো কোথায় গেল কে জানে!

এর মধ্যে আবার দুটো বাড়িতে চুরি হয়ে গেল৷ বাঁদরটাই যে চোর তা বড়বাবু নিজের চোখে দেখেছেন৷ সুতরাং এই চোরকে ধরতেই হবে৷

বড়বাবু খবর দিলেন সরকারি বন দফতরকে৷ তারা কি বাঁদর ধরায় সাহায্য করতে পারে?

বিকেল বেলাতেই বন দফতর থেকে এক অফিসার এলেন৷ ভদ্রলোক দক্ষিণ ভারতীয়৷ নাম শিবরামকৃষ্ণণ৷ একই নামের মধ্যে তিনটি ঠাকুর-দেবতার নাম৷

ভদ্রলোকের ছোটখাটো চেহারা, বাংলা বলেন ঝরঝর করে৷

তিনি সব শুনে-টুনে বললেন, আপনারা কী চান? বাঁদরটা আমরা ধরে নিয়ে যাবো, না আপনারা রাখবেন?

বড়বাবু বললেন, ও তো একটা চোর৷ তাই পুলিশই ওকে ধরে রাখবে, তারপর ওর বিচার হবে!

শিবরামকৃষ্ণণ বললেন, বেশ৷ বাঁদরটা যখন এদিকে আসে, তখন একবার না একবার সে কোনো গাছে বসে৷ ওরা বিশেষ একটা গাছকেই পছন্দ করে৷

তিনি এদিক-ওদিক ঘুরে খালধারে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে এসে বললেন, এই গাছটা!

বড়বাবু সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বুঝলেন কী করে?

শিবরামকৃষ্ণণ বললেন, এইখানে বাঁদরের গন্ধ পাচ্ছি যে!

বড়বাবু অবাক হয়ে বললেন, আপনি বাঁদরের গন্ধ পাচ্ছেন? কই, আমি তো পাচ্ছি না৷

শিবরামকৃষ্ণণ বললেন, আপনি পাবেন কী করে? আমি তো বাঁদরের গন্ধের এক্সপার্ট৷ তাই আমাকে পাঠানো হয়েছে৷ আমাদের অফিসে একজন আছে শেয়ালের গন্ধের এক্সপার্ট৷ একজন সাপের গন্ধের এক্সপার্ট৷

বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, আর বাঘের গন্ধের এক্সপার্ট নেই!

শিবরামকৃষ্ণণ বললেন, নাঃ! বাঘের গন্ধের এক্সপার্ট লাগে না, সে গন্ধ সবাই পায়৷

কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে তিনি এক ছড়া কলা বার করলেন৷ তারপর গুনে গুনে ঠিক চারটে কলা নিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে দিলেন সেই গাছের খুব নীচু একটা ডালে৷

তারপর বললেন, ব্যাস৷ কাল সকালেই আপনারা আসামিকে পেয়ে যাবেন! আর চিন্তা করবেন না৷

সত্যিই তাই৷ পরদিন সকালেই বাঁদরটাকে কোলে করে নিয়ে এল থানায়৷ প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল, মরেই গেছে বুঝি! পরে বোঝা গেল অঘোরে ঘুমোচ্ছে, আর পিচ পিচ করে নাকও ডাকছে৷

একটা দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হল৷ বোঝাই যাচ্ছে, কলাগুলোর মধ্যে খুব কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল৷

তার ঘুম ভাঙল বিকেলের দিকে৷ তখনই সে লাফালাফি চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল৷ কোমরে দড়ি বাঁধা, বেশি লাফাতেও পারছে না!

তখন তাকে দেওয়া হল ছোলা সেদ্ধ, পেয়ারা আর দুটো জিলিপি৷

জিলিপি দুটোই সে খেয়ে নিল আগে৷

এবার বাঁদরটাকে নিয়ে দেখা দিল নতুন সমস্যা৷ পুলিশের হাতে চোর ধরা পড়লে তাকে পাঠাতে হয় কোর্টে৷ সেখানে তার বিচার হয়৷

অধিকাংশ কোর্টেই বিচার হয় বড়দের৷ যাদের বয়েস ষোলো বছরের বেশি৷ আর কমবয়েসি অপরাধীদের জন্য আছে জুভেনাইল কোর্ট বা শিশু আদালত৷

বাঁদরের বয়েস কী করে বোঝা যাবে? এক এক জনের এক এক মত৷

বড়বাবুর এক বন্ধু, অঙ্কের অধ্যাপক, তিনি বললেন, কুকুর বারো-চোদ্দ বছরের বেশি বাঁচে না, বাঁদরের আয়ু ওই রকমই হবে৷ শিশু আদালতেই পাঠাও৷

শিশু আদালত এখন বন্ধ, খুলবে একুশ দিন পর৷ ততদিন এই চোর বাঁদরকে কোথায় রাখা হবে?

শিশু অপরাধীদের জন্য আলাদা হোম আছে৷ সেখানে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বললেন, ওখানে বাঁদর রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ তা ছাড়া যে-সব ছেলে এখন রয়েছে, তারাই এত বাঁদর যে আর বেশি হলে টেঁকা যাবে না৷

সুতরাং বাঁদরটা থানাতেই থেকে গেল৷

দলে দলে লোক ভিড় করে তাকে দেখতে আসে৷ যাদের জিনিস চুরি গেছে, তারাও আসে৷ কেউ যাতে বাঁদরটাকে খোঁচাখুঁচি না করে, সেই জন্য একজন পুলিশ পাহারায় থাকে৷ তবে অনেকেই তাকে খাবার দেয়৷ নানারকম খাবার৷ তার মধ্যে জিলিপিই সবচেয়ে তার প্রিয়৷

ভালো খাবার পেলে সে লাফিয়ে, ডিগবাজি খেয়ে মজাও দেখায় মানুষদের৷

কে যেন এর মধ্যে তার নাম দিয়ে দিল মানিকচাঁদ৷ সেই নামটাই চালু হয়ে গেল লোকের মুখে মুখে৷ সবাই তাকে ওই নামে ডাকে৷ কয়েকদিনের মধ্যেই মানিকচাঁদ বলে ডাকলে সে মুখ ঘুরিয়ে তাকায়৷

কিন্তু আসল সসম্যা তো রয়েই গেল৷ চোরাই জিনিসপত্রও কিছু পাওয়া গেল না, আসল চোরও ধরা পড়ল না৷ এই বাঁদরকে কত দিন থানায় রাখা হবে? প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে, তাতে কাজেরও অসুবিধে হয়৷

এর মধ্যে একদিন একটা কাণ্ড ঘটল৷

দড়িটা কী করে যেন আলগা হয়ে গিয়েছিল, নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মানিকচাঁদ৷

মুক্তির আনন্দে প্রথমে হুপ হুপ করে লাফাল কয়েকবার৷ তারপর তাকাল এদিক-ওদিক৷

যে-পুলিশটি পাহারা দিচ্ছিল, সে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ হঠাৎ চোখ মেলে দেখল, মানিকচাঁদ বারান্দার রেলিং-এ উঠে বসেছে৷

পুলিশটি তাকে ধরতে যেতেই সে এক লাফে জলের পাইপ ধরে তরতর করে উঠে গেল তিনতলায়৷ একেবারে বড়বাবুর কোয়ার্টারে৷

ছাদের দরজা খোলা৷ বড়বাবু বিশ্রাম নেবার জন্য শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছেন৷ রিভলভার সমেত তাঁর বেল্টটা রাখা আছে একটা চেয়ারে৷

তিনি কিছু বোঝবার আগেই মানিকচাঁদ সে ঘরে একবার উঁকি দিল৷ তারপর রিভলভারের বেল্টটা তুলে নিয়েই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷

বড়বাবু এই এই বলে তাড়া করলেন তাকে৷ মানিকচাঁদ প্রথমে গিয়ে বসল ওপরের ছাদে৷ তারপর একটা প্রচণ্ড লাফ দিয়ে চলে এল পাশের নিম গাছটার ডগায়৷

বাঁদরের হাতে রিভলভার দেখে কাছাকাছি সব লোক দৌড়ে পালাল ভয়ে৷ অন্য পুলিশরাও ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে৷

বড়বাবু তরতর করে নেমে এসে নিম গাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে হুকুম করলেন, এই মানিকচাঁদ, নেমে আয়৷ শিগগির নাম!

বড়বাবুর হুকুম গ্রাহ্যই করল না মানিকচাঁদ৷ সে হাতের বেল্টটা দোলাতে লাগল৷

বড়বাবু বললেন, আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? আমি ভয় পাই? কাছাকাছি আর গাছ নেই, এই গাছ থেকে তুই কিছুতেই পালাতে পারবি না৷

থানার ভেতরের জানলা দিয়ে ফিসফিস করে মেজবাবু অমৃতলাল বললেন, স্যার, বাঁদরের হাতে রিভলভার, ভেরি ডেঞ্জারাস৷ আমরা ভেতর থেকে রাইফেল দিয়ে ওকে গুলি করব?

বড়বাবু বললেন, মোটেই সে সব কিছু করবে না৷ বরং পাশের দোকান থেকে গোটাকতক জিলিপি এনে দাও৷

জিলিপির ঠোঙাটা গাছের তলায় রেখে বড়বাবু আবার ধমক দিয়ে বললেন, মানিকচাঁদ, নেমে আয়!

এবারে আর মানিকচাঁদ লোভ সামলাতে পারল না৷ সরসর নেমে এসে জিলিপি খেতে লাগল৷

রিভলভার আর বেল্টটা সে পাশে রেখেছে, বড়বাবু তা সরিয়ে নিলেন৷ তারপর মানিকচাঁদের একটা কান ধরে এক থাপ্পড় মেরে বললেন, জিলিপি খাওয়া হচ্ছে! বদমাইশ, পাজি, হনুমান কোথাকার! তুই আমার চাকরি খেতে বসেছিলি?

এবার পুলিশরা সবাই বাইরে বেরিয়ে এল৷ বড়বাবু একজনকে বললেন, ভালো করে বাঁধো ওকে, আর যেন পালাতে না পারে৷

মেজবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, স্যার, বাঁদরটার হাতে রিভলভার, তবু আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রইলেন! আপনার এত সাহস!

বড়বাবু বললেন, সাহসের কী আছে? ও কি আমায় গুলি করত নাকি?

মেজবাবু বললেন, কেন, গুলি করতে পারত না?

বড়বাবু বললেন, বাঁদরে গুলি চালালে সেটা হত বিশ্ব রেকর্ড৷ বন্দুক-রিভলভার চালাতে গেলে বুড়ো আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরতে হয়৷ মানুষ ছাড়া আর কোনো জন্তু-জানোয়ার বুড়ো আঙুল ব্যবহার করতে পারে না৷ বাঁদর যেদিন রিভলভার চালাতে শিখবে, সেদিনই সে মানুষ হয়ে যাবে৷

মেজবাবু বললেন, ও তাই বুঝি! স্যার, আপনি যে ওকে হনুমান বলে গালাগালি দিলেন, হনুমান কি বাঁদরের চেয়েও খারাপ?

বড়বাবু বললেন, কেউ খুব বেশি দুষ্টুমি করলে তাকে আমরা বলি, বাঁদর কোথাকার! বাঁদরকে কী বলব বলো তো?

তারপরই তিনি গলার স্বর গম্ভীর করে বললেন, এ ব্যাটাকে এবার চরম শাস্তি দিতে হবে! আমি ওকে ফাঁসি দেব! সবাইকে বলে দিন, আগামী রবিবার থানার সামনে মানিকচাঁদকে ফাঁসি দেওয়া হবে!

খবরটা আগুনের মতন ছড়িয়ে গেল৷ মানিকচাঁদের ফাঁসি হবে৷ কয়েকটা খবরের কাগজেও ছাপা হল একথা৷

লালবাজার থেকে পুলিশের এক বড়কর্তা ফোন করে বললেন, ওহে ভূতনাথ, তুমি নাকি একটা বাঁদরের ফাঁসি দেবে ঠিক করেছ? খবর্দার, ও কাজ করো না৷ ওটা বে-আইনি৷ তা ছাড়া, অনেক লোক বাঁদরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে৷ তারা আপত্তি করবে৷

বড়বাবু বললেন, স্যার, সত্যি সত্যি কি ফাঁসি দেব! আমি ভয় দেখাতে চাই৷

বড়কর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ভয় দেখাবে? কাকে? ওই বাঁদরটাকে?

বড়বাবু হেসে ফেলে বললেন, হ্যাঁ, দেখা যাক ও ভয়ে সব স্বীকার করে কি না!

রবিবার সকালে থানার সামনের জায়গাটায় দু’একটা চৌকি পেতে মঞ্চ সাজানো হল৷ ঝুলতে লাগল ফাঁসির দড়ি৷

চতুর্দিক ভিড়ে ভিড়াক্কার৷ কয়েক হাজার লোক এসেছে দেখতে৷ এসেছে টিভি ক্যামেরা৷

মানিকচাঁদ মঞ্চের একপাশে বাঁধা৷ সে কিছু বুঝতে পারছে কি না কে জানে!

একদল লোক এসেছে প্রতিবাদ জানাতে৷ পুলিশ আটকে দিয়েছে তাদের৷

ঠিক দশটার সময় বড়বাবু ভূতনাথ দাঁ উঠে এলেন মঞ্চে৷

সকলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এই বাঁদরটা পাড়ায় অনেক বাড়ি থেকে চুরি করেছে৷ কোর্টে ওর বিচার হবে না৷ তাই আমি নিজেই ওকে শাস্তি দিচ্ছি!

তিনি ফাঁসির দড়িটা হাতে নিতেই ভিড়ের মধ্যে থেকে ঠেলেঠুলে একজন রোগা মতন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা লোক কাঁদতে কাঁদতে বড়বাবুর পায়ে এসে পড়ল৷

সে বলতে লাগল, বড়বাবু, দয়া করুন৷ ওকে মারবেন না৷ ও আমার ছেলের মতন৷ যা শাস্তি দিতে হয় আমাকে দিন৷

বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, চোরাই জিনিসপত্রগুলো কোথায়?

লোকটি বলল, দু’একটা বিক্রি করে দিয়েছি৷ বাকি আমার কাছে৷ আছে আমার নাম ষষ্ঠীচরণ৷ বাবু, আগে আমি বাঁদরের খেলা দেখাতাম৷ সরকার এখন নিষেধ করে দিয়েছে৷ আমি আর কোনো কাজ জানি না৷ খাবো কী করে? ওর নাম সত্যিই মানিকচাঁদ৷ ও-ই আমার জন্য রোজগার করে আনে৷

বড়বাবু বললেন, চুরি করা আর রোজগার করা এক নয়৷ সব চোরাই মাল যদি ফেরত দিয়ে যাও, তাহলে তোমায় ক্ষমা করতে পারি৷

ষষ্ঠীচরণ বলল, সব কালই দিয়ে যাব৷ মানিকচাঁদকে আমার কাছে দিয়ে দেবেন তো?

বড়বাবু বললেন, না৷ ওর বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে৷ ওকে আমি সুন্দরবনে ছেড়ে দিয়ে আসব৷ জঙ্গলের প্রাণী জঙ্গলেই থাকুক৷

ষষ্ঠীচরণ বলল, তা হলে আমিও সুন্দরবনে যাব৷ ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না৷

এরপর মানিকচাঁদকে সত্যিই ছেড়ে দিয়ে আসা হল সুন্দরবনে৷ যেতে কী আর চায়! মুক্তি পাবার পর সে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিল৷ জোর করেই তাকে নামিয়ে দিয়ে আসা হয় ঘন জঙ্গলের ধারে৷

ষষ্ঠীচরণ সেখান থেকে তাকে খুঁজে পেয়েছে কিনা কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *