০৯.
এদিকে কিরীটী আর কৃষ্ণাও পুরীতে এসেছিল। দেড় বৎসর আগেকার ঘটনা—হয়তো কোন সূত্ৰই মিলবে না, তবু কিরীটী সরেজমিন তদন্ত করবার লোভ সম্বরণ করতে পারেনি।
কিরীটীও ঐ একই হোটেলে উঠেছিল, যে হোটেলে শরদিন্দু এসে উঠেছিল। শরদিন্দু ছিল সেই পূর্বেকার কুড়ি নম্বর ঘরে দোতলায়। পরে কিরীটী ও কৃষ্ণা ছিল ঐ দোতলাতেই চৌদ্দ নম্বর ঘরে।
পুরীতে পৌঁছেই পরের দিন বিকেলে কিরীটী গেল থানায়। সেখানে ঘনশ্যাম মোহান্তির সঙ্গে আলাপ হল। ঘনশ্যাম মোহান্তি প্রায় দুই বছর আছেন ঐ থানার ইনচার্জ-এ। বয়স বত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে বলে মনে হয়। বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, মাথায় সামান্য টাক, একজোড়া পুরু গোঁফ, একবারে চেন স্মোকার যাকে বলে।
মোহান্তি কিরীটীর পরিচয় পেয়ে যথেষ্ট সমাদর করলেন। তারপর কিরীটী যখন তার পুরীতে আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল তখন মোহান্তি বললেন, হ্যাঁ, জলে ড়ুবে যাবার একটা কেস ঘটেছিল বছর দুই আগে। এক ভদ্রমহিলা বিকালের দিকে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে ঢেউয়ের মধ্যে তলিয়ে যান।
কিরীটী বললে, তার মৃতদেহের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি?
না। চার-পাঁচ দিন ধরে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মৃতদেহটা শেষ পর্যন্ত ট্রেস করা যায়নি।
ফাইলটা আছে কি আপনার কাছে? কিরীটী বলল।
আছে। বসুন আপনি।
ভিতুরের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বাদে ফাইল নিয়ে এলেন মোহান্তি।
ভদ্রমহিলার বয়স ছিল তেইশ। স্বামীর নাম শরদিন্দু বোস। বিজনেসম্যান, কলিকাতা থেকে পুরীতে এসেছিলেন বেড়াতে। দিন পাঁচেক বাদে ঐ ঘটনা ঘটে, শরদিন্দুই থানায় ডাইরি করে।
হঠাৎ কিরীটীর নজর পড়ল, থানায় ডাইরি করা হয় ঐ ঘটনার পরের দিন বিকালে, অর্থাৎ প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে। দুর্ঘটনা ঘটেছে আগের দিন বেলা চারটের পর, পরের দিন বেলা চারটেয় ডাইরি করা হয়। পুলিস থেকে তারপর স্থানীয় জেলে ও নুলিয়াদের দিয়ে অনেক অনুসন্ধান চালানো হয় মৃতদেহের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। হয়তো মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে গিয়েছে, না-হয় হাঙ্গরে মৃতদেহ খেয়ে ফেলেছে।
মিঃ মোহান্তি কিরীটী বলল, তাহলে দুর্ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা পরে ডাইরি লেখানো হয়। ভদ্রলোক এত দেরি করে এলেন কেন বলেছিলেন কিছু?
না, তবে ঐদিনই সন্ধ্যায় কিন্তু আমরা রিপোর্টটা পেয়েছিলাম সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেই সী বিচে যাই–
শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে হোটেলে দেখা করেননি?
সংবাদ পেয়ে গিয়েছিলাম রাত্র আটটা নাগাদ, কিন্তু ভদ্রলোক ছিলেন না হোটেলে। তার পরের দিনও সকালে হোটেলে যাই কিন্তু তখনও দেখা হয়নি। হোটেলের মালিক মিসেস ভট্টাচার্য বললেন, ঘরে তার তালা দেওয়া—রাত্রে ফিরেছেন কিনা তাও বলতে পারব না। অগত্যা ফিরে এলাম থানায়। তারপর বিকেল চারটে নাগাদ ভদ্রলোক এলেন থানায় ডাইরি করতে। বললেন তিনি নাকি সমুদ্রের ধারে ধারে সারাটা রাত খুঁজে বেড়িয়েছেন তার স্ত্রীর দেহটা।
কি করে তার স্ত্রী জলে ড়ুবলেন সে সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি?
বলেছিলেন বিকেলে যখন তারা হোটেলে বসে গল্প করেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর সমুদ্রস্নানের ইচ্ছা হয়।
ঐ সময় কেউ সমুদ্রে স্নান করছিল?
না। লোকজন বড় একটা সে সময় সমুদ্রের আশেপাশে ছিল না। তবে কিছুদূরে এক প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত ভদ্রলোক—চোখে চশমা ও মাথায় শোলার টুপি হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছিলেন, একবার নাকি তিনি দেখেছেন। তারপর স্ত্রী সাঁতার দিতে দিতে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় খানিকটা এগিয়ে যান, ভদ্রলোক মানা করা সত্ত্বেও শোনে না। হঠাৎ একটা ঢেউ এসে তাকে দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। উনি সাঁতার জানতেন না বলে চেঁচামেচি শুরু করে দেন।
তারপর?
দুরে দুজন নুলিয়া ছিল—তারা ছুটে আসে কিন্তু ভদ্রমহিলাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিরীটী প্রশ্ন করলে, ঐ সময় সেই ভদ্রলোক, যিনি কিছুদূরে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি?
সে সব কথা ভদ্রলোক বলেননি।
আচ্ছা মিঃ মোহান্তি, সমুদ্রে যারা মাছ ধরে তাদের কাউকে আপনি চেনেন?
একজনকে জানি, সমুদ্রে একসময় সে মাছ ধরত—এখন বয়স হয়েছে। এককালে ভাল সাঁতারুও ছিল এবং তার কাঠের ভেলার মত নৌকাটা নিয়ে সমুদ্রের মধ্যে অনেক দূরে চলে যেত মাছ ধরতে—আড়িয়া লোকটার নাম—জাতে তেলেঙ্গা—এখন অবিশ্যি মাছ টাছ আর ধরে না—আপনি যে হোটেলে উঠেছেন তারই পাশের হোটেলে নুলিয়ার কাজ করে, যাত্রীদের স্নান করায় সমুদ্রে।
আচ্ছা আজ আমি উঠছি—কিরীটী বিদায় নিল থানা থেকে।
হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এল কিরীটী সমুদ্রের ধারে। সমুদ্রের পশ্চিম দিকটায় লাল আবির ঢেলে সূর্য তখন অস্তে চলেছে, বহু বায়ুসেবী সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় বড় ঢেউগুলো। বেলাভূমির ওপরে এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছে মুহুর্মুহুঁ। একটানা সমুদ্র গর্জন বাতাসে ভেসে আসছে।
কিরীটী সোজা মোহান্তির নির্দিষ্ট হোটেলটায় গেল। লোকটার বিশেষ খোঁজ করতে হল না। সহজেই দেখা মিলল। একটা কাল ঢ্যাঙামত প্রৌঢ় লোক। মাথার চুল সবই প্রায় পেকে গিয়েছে, শরীরের পেশীগুলো পাকান দড়ির মত। পরনে একটা লুঙ্গি—হোটেলের সামনে বারান্দায় সিঁড়ির ওপর বসে থাকতে দেখে তারই দিকে এগিয়ে যায় কিরীটী।
এই শোন!
লোকটি উঠে এল।
এখানে এই হোটেলে আড়িয়া বলে কেউ থাকে, জানিস?
সাব, আমারই নাম তো আড়িয়া আছে। তা তোর কি দরকার সাহেব আড়িয়াকে?
আছে দরকার, আয় না, ঐ সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি।
আড়িয়া সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটীর দিকে। কি চায় এই বাঙ্গালীবাবু!
আমার কাজের জন্যে তোকে ভাল বকশিস দেব। বলে কিরীটী পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে আড়িয়ার হাতে দিল।এই টাকাটা রাখ, কাজটা হয়ে গেলে আরও পঞ্চাশ টাকা দেব।
আড়িয়া খুশি হয়ে টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিল। বলল, বোল বাবু, কি করতে হবে আমাকে। আয় আমার সঙ্গে, বলছি–
দেখ আড়িয়া, হাঁটতে হাঁটতে কিরীটী বলল, আমি আমার একজন জানাশোনা মেয়ের সন্ধান করছি—এখানে সে বেড়াতে এসেছিল প্রায় বছর দুই আগে।
দুই বছর আগে?
হ্যাঁ রে। হঠাৎ একদিন সমুদ্রে স্নান করতে নেমে জলে ড়ুবে যায়। আমি যে হোটেলে উঠেছি সেই হোটলেই উঠেছিল মেয়েটি। ভাল সাঁতার জানত জলে ড়ুবে সে মরতে পারে না। আমার ধারণা সে এখানেই কোথাও আছে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে।
সন্দেহ জাগে আড়িয়ার মনে। সে বলল, মেয়েটা তোর কে হয় বাবু?
মেয়েটা–মেয়েটা আমার বোন। জেলেপাড়ায় আমি একবার খোঁজ করে দেখতে চাই। তোর তো জেলেপাড়ায় যাতায়াত আছে। অনেককে সেখানে চিনিসও। কাল সকালে তুই আমাকে জেলেপাড়ায় নিয়ে যেতে পারবি?
কেন পারব না বাবু, খুব পারব।
তাহলে কাল সকালে এখানে আসিস—তোর জন্যে আমি অপেক্ষা করব।
সকালে তো হবে না! হোটেলের বাবুদের আমি স্নান করাই তখন।
তবে কখন আসবি বল। আমি এখানে এসে অপেক্ষা করব।
দুপুরে।
বেশ, তাই আসিস।
আড়িয়াকে বিদায় দিয়ে কিরীটী হোটেলে ফিরে এল। নীচের তলায় অফিস ঘরে এসে সোজা ঢুকল কিরীটী। হোটেলের মালিক মিসেস ভট্টাচার্য অফিসঘরে বসে হিসাবপত্র দেখছিলেন। আর
তার অ্যাসিস্টেন্ট দুর্গাবাবু তার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
দুর্গাবাবুর সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল কিরীটীর। বয়স বছর ২৬-২৭ হবে, রোগা পাতলা চেহারা, গায়ের রঙ ফর্সা, পরনে ধুতি শার্ট। দু-চারটি কথা বলেই কিরীটী বুঝেছিল ছেলেটি সরল ও বোকা টাইপের। যাত্রীদের ধরে নিয়ে এসে হোটেলে তোলাই তার প্রধান কাজ।
মিসেস ভট্টাচার্যর বয়স হয়েছে তা প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। চোখেমুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ। পরনে দামী তাঁতের শাড়ি। এক হাতে একটা মোটা সোনার বালা, অন্য হাতে একটা জেন্টস রিস্টওয়াচ। ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফের মত আছে। বাহু দুটিও লোমশ। চোখে সোনার চশমা।
ভদ্রমহিলা সধবা, তার স্বামীও ঐ হোটেলেই থাকেন, নিবারণ ভট্টাচার্য। দুর্গাবাবুর মুখেই শুনেছিল কিরীটী, নিবারণ ভট্টাচার্য কোন কাজ করেন না। মিলিটারীতে কাজ করতেন। স্টোর ক্লার্ক ছিলেন। হাত সাফাইয়ের বদভ্যাস ছিল। অনেক দিন হল চাকরি গিয়েছে সেই কারণেই। এখন স্ত্রীর পোয্য।
মিসেস ভট্টাচার্য।
কিরীটীর ডাকে মুখ তুলে মিসেস ভট্টাচার্য বললেন, আসুন আসুন মিঃ রায়।
আপনি কি এখন একটু ফ্রি আছেন? আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।
হা হ্যাঁ, বসুন না। দুর্গা, গণেশকে বল দুকাপ চা এ ঘরে দিয়ে যাবার জন্য। কিরীটী চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। দুর্গা চায়ের কথা বলতে চলে গেল।
বলুন মিঃ রায়!
আমি নিছক বেড়াতে কিন্তু এখানে আসিনি মিসেস ভট্টাচার্য! তবে কেন এসেছি সে কথাটা জানাজানি হয় আমি চাই না।
মিসেস ভট্টাচার্য হাসলেন, বললেন, তা কি আর বুঝিনি। বুঝেছি। না, কেউ জানবে না। বলুন এবারে—
যদিও প্রায় দুবছর আগেকার ঘটনা, তাহলেও হয়তো আপনার মনে আছে এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। এসে আপনার এই হোটলের বিশ নম্বর ঘরে উঠেছিলেন? ভদ্রলোকের স্ত্রীটি সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে ড়ুবে যান!
মিসেস ভট্টাচার্য বললেন, হ্যাঁ, মনে আছে বৈকি। ব্যাপারটা খুবই স্যাড।
আমি সেই সম্পর্কেই সঠিক সংবাদ যোগাড় করতে এসেছি অর্থাৎ সত্যিই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল কিনা। ভদ্রলোক সারাটা রাত সমুদ্রের ধারে সন্ধান করেছিলেন মৃতদেহের, কিন্তু খোঁজ পাননি।
পরের দিন বিকেলে থানায় গিয়ে ডাইরি করেন। পুলিশ এল, অনেক খোঁজাখুঁজি হল, কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।
ঐ সময় ভৃত্য গণেশ এসে দুকাপ চা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে গেল।
নিন মিঃ রায়, চা খান।
কিরীটী চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল।
আচ্ছা, ভদ্রমহিলা জলে ড়ুবে যাওয়ায় ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুব মুষড়ে পড়েছিলেন? কিরীটী প্রশ্ন করল।
তা একটু বোধ হয় পড়েছিলেন, তবে খুব বেশী নয়—
কেন—ও কথা বলছেন কেন?
পরের দিনের একটা ঘটনা বললেই হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন মিঃ রায়। অবিশ্যি ব্যাপারটা আমার চোখে পড়েনি, আমার স্বামীর কাছেই শোনা।
কি বলুন তো?
আমার স্বামীর অভ্যাস আছে রাত্রে কিছুক্ষণ একা একা সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়ানো। কথাটা আপনাকে খুলেই বলি মিঃ রায়, ঐ সময়ে আমার স্বামী স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না।
স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন না?
না, সন্ধ্যা থেকে ড্রিঙ্ক করে করে বোধ হয় এক সময় নেশার ঘোরেই সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াতে বের হয়, তাই বলছিলাম তার কথাটা কাউন্ট করা খুব একটা বোধ হয় উচিত হবে না। মানে গুরুত্ব দেওয়া আর কি—
তিনি কি কিছু দেখেছিলেন?
হ্যাঁ। পরের দিন অনেক রাত্রে সমুদ্রের ধারে নাকি মিঃ বোস জ্যোৎস্নার আলোয় একা একা বসে গান গাইছিলেন—
গান গাইছিলেন মিঃ বোস!
তাহলেই বলুন মিঃ রায়, কথাটা যদি সত্য হয়, তাহলে যে ভদ্রলোকের আগের দিন মাত্র স্ত্রীর জলে ড়ুবে মৃত্যু হয়েছে তার পক্ষে ঐভাবে গান গাওয়াটা–
তা তিনি যে ঐ ভদ্রলোকই আপনার স্বামী বুঝলেন কি করে?
আমার স্বামী গান শুনে এগিয়ে গিয়ে ডাকেন, মিঃ বোস! উনি আমার স্বামীর ডাকে নাকি সাড়াও দিয়েছিলেন। স্বামীর মুখে পরের দিন সব কথা শুনে আমার যেন কেমন একটু আশ্চর্য বোধ হয়েছিল মিঃ, রায়।
আচ্ছা, আপনার স্বামীর সঙ্গে আর কোন কথা হয়েছিল মিঃ বোসের সেরাত্রে?
জানি না। বলতে পারব না। কারণ আমি কোন বিশেষ কৌতূহল প্রকাশ করিনি সেদিন স্বামীর কথায়, ভুলেও গিয়েছিলাম কথাটা। আজ আপনার কথা শুনে হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল।
আপনার স্বামীর সঙ্গে কি কথা বলতে পারি?
কেন পারবেন না, সে তো এখন হোটেলেরই একতলায় তার ঘরে বসে বসে ড্রিঙ্ক করছে, চলুন না, যাবেন তো–
চলুন। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
কিরীটীকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের একতলার একেবারে কোণের দিকের একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন মিসেস ভট্টাচর্য। দরজাটা ভেজানো ছিল। কোন সাড়াশব্দ না দিয়েই মিসেস ভট্টাচার্য ভেজানো দরজা ঠেলে কিরীটীকে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
কিরীটীর নজরে পড়ল ঘরের আলোয়—পরনে একটা মিলিটারীর রং জ্বলে যাওয়া বটলগ্রীন প্যান্ট ও গায়ে একটা গেঞ্জি, বছর ষাট-বাষট্টির একটা লোক চেয়ারে বসে গুনগুন করে একটা ইংরেজি গানের সুর ভাঁজছে! চ্যাপটা লম্বা চেহারা, অনেকটা ঝাকাসের মত শীর্ণ। গাল দুটো– ভাঙা, মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় ঝাকড়া ঝাঁকড়া বিশৃঙ্খল চুল। সামনের টেবিলে একটা অর্ধসমাপ্ত দিশী মদের বোতল আর অর্ধেক ভর্তি একটা কাঁচের গ্লাস। শকুনের মত নাক। চওড়া ঠোঁট, চোখ দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে।
কি চাই ডার্লিং? লোকটা বললে।
ইনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। মিসেস ভট্টাচার্য বললেন।
হু ইজ হি? কৌন্ হ্যায় ইয়ে আদমী?
মিসেস ভট্টাচার্যের চোখেমুখে একটা বিরক্তির ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বললেন, মিঃ রায়, বিখ্যাত সত্যসন্ধানী কিরীটী রায়
কিরীটী রায়—মানে দ্যাট ফেমাস ম্যান! ইয়েস–ইয়েস আই নো হিম।
আপনি আমাকে চেনেন? কিরীটী প্রশ্ন করল।
চিনি মানে নাম শুনেছি।
উনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। মিসেস ভট্টাচার্য বললেন।
বাট আই অ্যাম অ্যান অর্ডিনারী পার্সন!
কি যে দিবারাত্র ঐ বিষগুলো গেলো! মিসেস ভট্টাচার্য বিরক্তি-কণ্ঠে বললেন।
বাস, দাস ফার অ্যান্ড নো ফাদার! তুমি যেতে পার।
রোষকষায়িত লোচনে স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিসেস ভট্টাচার্য চলে গেলেন।
বসুন স্যার বসুন, বলতে বলতে একটা চেয়ার ঠেলে দিল নিবারণ ভট্টাচার্য।
কিরীটী উপবেশন করল। চলবে স্যার?
না, ধন্যবাদ।
কিন্তু স্যার, আমার মত স্ত্রীর কৃপাপ্রার্থী একটা মাতালের সঙ্গে আপনি কেন আলাপ করতে চান, বলুন তো?
আপনার হোটেলে এলাম অথচ আসল মালিকের সঙ্গে পরিচ্চ্য হবে না, তাই–
নো, নো স্যার, আসল মালিক হার একসেলেন্সি শ্রীমতী সুষমা ভট্টাচার্য। আমার কাজ অনেক দিনই ফুরিয়ে গিয়েছে, চাকরি যাবার পর টাকাটা এনে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, অ্যান্ড দেয়ার এন্ডস দি ম্যাটার!
তাহলে তো আপনার টাকাতেই এই হোটেল চালু হয়েছিল, মিঃ ভট্টাচার্য!
না না, আমার সে টাকা নাকি অতি সামান্য–খুদকুঁড়ো—যাক সে কথা! আমাকে একটা করে বোতল দিলেই আমি সন্তুষ্ট। আর আমার প্রয়োজনটাই বা কি! এবারে বলুন মিঃ রায়, আপনি হঠাৎ আমার সঙ্গে আলাপ করতে এলেন কেন?
কিরীটী তখন মানসীর মৃত্যুর ব্যাপারটা বর্ণনা করে বললে, সেই সম্পর্কেই আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই!
হ্যাঁ, মনে আছে আজও আমার সেই ভদ্রলোকের কথা কিন্তু সে তো অনেক দিন হয়ে গিয়েছে।
তা তো একটু হয়েছেই—
তবু বেটার লেট দ্যান নেভার!
হুঁ, তাহলে দেখছি আপনার মনেও ব্যাপারটা সন্দেহের উদ্রেক করেছে!
দেখুন মিঃ রায়, সেদিন মিসেস বোসের ঐভাবে জলে ড়ুবে মৃত্যুটা আমার কাছে কেমন যেন একটু গোলমেলেই মনে হয়েছিল—
কেন, গোলমেলে মনে হয়েছিল কেন আপনার?
কারণ মেয়েটি যেরকম সাঁতার জানত বলে শুনেছিলাম, তাতে তার ঐভাবে ড়ুবে যাওয়াটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক। আরও কথা আছে এর মধ্যে মিঃ রায়—আমার অভ্যাস আছে অনেক রাত্রে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে—একা একা সী বীচে গিয়ে হেঁটে বেড়ানো। ফলে হোটেলের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আমি ঘুমাই না। দু-তিন রাত-রাত তখন একটা-দেড়টা হবে—ওদের ঘর থেকে চেঁচামেচির শব্দ শুনেছিলাম আমি–
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একদিন তাই কৌতূহলে দোতলায় ওদের ঘরের দরজায় গিয়ে কান পাতি, কতকগুলো কথা সেরাত্রে আমার কানে এসেছিল। শুনলাম মেয়েটি বলছে, তোমার ধারণা ভুল। কারও প্রতিই আমি আকৃষ্ট নই।
ভদ্রলোক বললে, ইটস এ ড্যাম লাই! মিথ্যা, তোকে আমি বিশ্বাস করি না! কলকাতায় আমি ঘুমোলে প্রতি রাত্রে তুই সুকুমারের ঘরে যেতিস—
তুমি যেমন জঘন্য তেমনি নীচ!
তোকে আমি খুন করব—খুন করে ফাঁসি যাব।
সে কি আর আমি জানি না, তা-ই—শেষ পর্যন্ত আমার বরাতে তা-ই আছে।
তারপরই ভদ্রলোকের সে কি হাউমাউ করে কান্না স্যার!
কান্না? কিরীটীর প্রশ্ন।
হ্যাঁ। ভদ্রলোক তারপর বললে, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না মানসী, তুই কি চাস বল–সুকুমারকে তুই ছেড়ে দে।
মেয়েটি বললে, সুকুমারকে ও বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেই তো পার—
না, সে হবে না। ও চলে গেলে অন্যত্র প্রেম চালাবার খুব সুবিধা হবে, না? না, তোদের দুজনকেই আমার চোখের সামনে থাকতে হবে।
ভট্টাচার্য একটু থেমে বলতে লাগলেন, কেমন একটা নেশা ধরে গেল আমার। তারপর আরও দুরাত বন্ধ দরজায় কান পেতে ওদের কথা শুনেছি।
গ্লাসটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, নিবারণ ভট্টাচার্য আবার বোতল থেকে গ্লাসে ঢালতে গিয়ে দেখলেন, বোতলটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বললেন, যাঃ, এর মধ্যেই ফুরিয়ে গেল!
কিরীটী বললে, আমার কাছে আছে, তবে বিলেতী—
বিলেতী আঃ, কত দিন খাই না! কোথায় আছে স্যার?
আপনি বসুন, আমি আনছি।
কিরীটী তার ঘরে গিয়ে একটা VAT 69-এর বোতল নিয়ে এল।
বোতলটা হাতে করে নিবারণ ভট্টাচার্য বললেন, স্যার দেখছি একজন রসিক ব্যক্তি, এ সবও চলে।
কিরীটী মৃদু হাসল।
বোতল থেকে খানিকটা গ্লাসে ঢেলে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে ভট্টাচার্য বললেন, আঃ, একটা যুগ পরে তারপরই একটু থেমে বললে, কি জানেন মিঃ রায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং না থাকে সে দাম্পত্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই নিজেকে দিয়েই তো বুঝতে পারি, একান্ত অনাবশ্যক আজ আমি সুষমার জীবনে—আমি এতটুকু বিস্ময় বোধ করব না ও যদি একদিন বিষপ্রয়োগে আমায় হত্যা করে।
না না, এ কি বলছেন? কিরীটী বললে।
আমার কি মনে হয় জানেন মিঃ রায়, ঐভাবে মিসেস বসুর মৃত্যু হওয়ায় মিঃ বসু মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন—নতুবা পরের দিনই সমুদ্রের ধারে বসে কেউ গান গাইতে পারে? আর আমি কাল রাত্রে তাই বলছিলাম ওকে–
কাকে বলছিলেন?
কেন, মিঃ বসুকে, সেই মেয়েটির স্বামীকে!
সেই মেয়েটির স্বামীকে! গতকাল!
হ্যাঁ, তিনি তো এখন এই হোটলেই আছেন। আমার স্ত্রী তাকে চিনতে না পারলেও আমি কিন্তু তাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছি। আর কি আশ্চর্য জানেন, তিনি আগেরবারের মত সেই বিশ নম্বর ঘরেই এবারেও উঠেছেন। আপনি কোন্ ঘরে আছেন মিঃ রায়?
চোদ্দ নং ঘরে—
তাহলে তো মিসেসের দুখানা ঘরের পরেই—
কি রকম?
১৫, ১৬, ১৭ নম্বরের কোন ঘর নেই—আগে অবিশ্যি আলাদা আলাদা তিনটি ঘর ছিল, এখন ঐ তিনটে কামরায় পার্টিশন তুলে দিয়ে দুটো ঘর করে মিসেস থাকেন।
আর আপনি এইখানে থাকেন?
হ্যাঁ। প্রত্যেক রাত্রে যে ওর তরুণ বন্ধুরা ওকে সঙ্গদান করতে আসে, সব জানি স্যার সব জানি। সবাই জানে আমাকে মোদো মাতাল-কিন্তু সব বুঝি, সব টের পাই আমি। জানেন, সেবারে যখন উনি এসেছিলেন, ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পরও দুটো দিন এখানে এই হোটেলে ছিলেন উনি, সে সময় ওঁকেও এক রাত্রে মিসেসের ঘরে যেতে দেখেছি।
সে কি! কিরীটী যেন বিস্ময়ে হতবাক।
জানেন এককালে এই হোটেলে অনেকেই এসে উঠত, কেন জানেন—ঐ সুষমার জন্য। আজই না হয় মুটিয়ে গিয়েছে সুষমা, বয়স হয়েছে, কিন্তু দশ বছর আগে খুব সেক্সি ছিল দেখতে এবং আমার টাকার সাহায্য গোড়ার দিকে নিলেও সুষমা তার সেক্সকেই আসল মূলধন করেছিল এবং ক্রমশ আজ যা দেখছেন এই হোটেল—সেই রূপটি পরিগ্রহ করেছে, ফলাও ব্যবসা হয়ে উঠেছে।
কিরীটী বুঝতে পারছিল যে নেশার ঝোঁকে আজ এই মুহূর্তে মনের মধ্যে এতদিনকার চাপা দুঃখটা প্রকাশ করে চলেছেন নিবারণ ভট্টাচার্য। কিরীটী তাই কোন রকম বাধা দেয় না, নিঃশব্দে শুনে চলে। নিবারণ ভট্টাচার্যের গলাটা যেন ধরা ধরা। মনে হয় লোকটা যেন কাঁদছেন।
আমার কি দুঃখ জানেন মিঃ রায় একদিন ছিল যেটা তার প্রয়োজনের মূলধন, এখন প্রয়োজন মিটে যাবার পর হয়েছে একটা অভ্যাস। জানেন মিঃ রায়, আমি নিঃসঙ্গ একাকী সত্যিই, কিন্তু সুষমা আমার চাইতেও নিঃসঙ্গ একাকী। অনেক টাকা আজ ওর, কিন্তু মনের তৃপ্তি ওর নেই।
কথায় কথায় কখন যে রাত শেষ হয়ে এসেছিল। কিরীটী উঠে দাঁড়াল এবং ঘর থেকে বের হয়ে এল। নিবারণ ভট্টাচার্য তখন বোতলটা অর্ধেক করে এনেছেন। দোতলায় উঠে থমকে দাঁড়াল কিরীটী। মিসেস ভট্টাচার্যের ঘর থেকে একজন বের হয়ে এল।