০৭.
সুকুমার জানত না, গতরাত্রে অনুরূপ একটা ঘটনা দিন দুই আগে ঘটে গিয়েছে শরদিন্দুকে কেন্দ্র করেও।
রাত্রে শরদিন্দুর বড় একটা ঘুম হয় না। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সে বসে বসে মদ্যপান করে, তারপর একসময় শয্যায় এলিয়ে দেয় দেহটা। তখনও চোখে ঘুম আসে না—একটা আচ্ছন্ন ভাব, নেশার ঘোর মাত্র—ঘুম নয়।
তখন বোধ হয় রাত্রি বারোটা হবে, কি কিছু বেশী—হঠাৎ ঘরের মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল।
আঃ, এই রাত্রে আবার কে ফোন করে? বিরক্তির সঙ্গে শরদিন্দু ফোনের রিসিভারটা তুলে নেয়।
হ্যালো! অপর প্রান্তে নারীকণ্ঠ।
কে? উঠে বসে শরদিন্দু।
গলা শুনে চিনতে পারছ না! আমি মানসী!
অকস্মাৎ যেন একটা শক খায় শরদিন্দু! তার মদের নেশা যেন ছুটে যায়। মানসী! তু-তুমি!
ভাবছ বোধ হয়, মরা মানুষ আবার ফোন করে কি করে, তাই না? বুঝতেই পারছ, আমি মরিনি সেদিন সমুদ্রের জলে ড়ুবে। কি হল, একেবারে যে চুপ করে গেলে বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি কথাটা?
শরদিন্দু ফোনের রিসিভারটা হাতে প্রস্তর-মূর্তির মত বসে তখন।
বিশ্বাস করতে পারছ না কথাটা, তাই না? কিন্তু সত্যিই আমি মরিনি। দুবছর আগে যাকে বিষ–
বিষ?
হ্যাঁ, বিষ। কিন্তু কেন বিষ দিয়েছিলে বলতে পার? আমাকে তুমি সন্দেহ করেছিলে, তাই না? তোমার সন্দেহ হয়েছিল সুকুমারের সঙ্গে–
না, মানসী–তুমি কোথায়–কোথা থেকে কথা বলছ? তুমি যেখানেই থাক চলে এস, আমি বুঝতে পেরেছি আমি ভুল করেছি–
কিন্তু এখন তো তা আমার পক্ষে সম্ভব নয় শরদিন্দু। দুবছর আগে যার মৃত্যু হয়েছে, আজযদি সে আবার ফিরে আসে—অনেক জটিলতা সৃষ্টি হবে। অনেক প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াবে তোমার শরদিন্দু।
তবু তুমি ফিরে এস মণি—
বললাম তো, তা আর সম্ভব নয়। কিন্তু বলতে পার শরদিন্দু কেন তুমি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে?
কি বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি, মনে করে দেখ, আমার লেমন স্কোয়াশের গ্লাসে সেদিন বিষ মেশানো ছিল–
না না, আর সত্যিই যদি লেমন স্কোয়াশের গ্লাসে বিষ মেশানো হয়ে থাকে—সে আমি মিশাইনি।
বিষাক্ত সেই লেমন স্কোয়াশ খাবার পরেই আমি যখন সমুদ্রে স্নানে যাচ্ছি তুমি বারণ করোনি–কিন্তু কি দুর্দৈব দেখ, আমি মরলাম না, সমুদ্রের তলায় তলিয়েও গেলাম না তুমি কেমন করে জানবে বল যে নিশ্চিত মৃত্যুর মধ্যে থেকেও আমি বেঁচে ফিরে আসতে পারি! তাই আবার বিয়ে করলে আর একজনকে–
মানসী শোন, সব তোমাকে আমি খুলে বলব—তুমি এস। নিজে না আস, তুমি কোথায় আছ বল—এখুনি আমি গাড়ি নিয়ে সেখানে যাব!
ধন্যবাদ, তার কোন প্রয়োজন নেই। তবে এও জেনো, কে আমাকে মারতে চেয়েছিল সেদিন, তা একদিন না একদিন আমি জানতে পারবই—আমি প্রতিশোধ নেব।
মানসী!
কিন্তু শরদিন্দুর সে ডাকের কোন সাড়া এল না। অন্য প্রান্ত তখন নীরব। এক সময় অপেক্ষা করে করে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল শরদিন্দু।
এইমাত্র যা সে শুনল, তা কি সত্যি? এও কি সম্ভব? শরদিন্দুর মনে হয়, সত্যিই কি মানসী আজও বেঁচে আছে? তাই—তাই হয়তো এত অনুসন্ধান করেও মানসীর মৃতদেহের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি!
ঐ মুহূর্তে একটা অদ্ভুত কথা মনে হয় শরদিন্দুর, তবে কি রীণাও দীঘার সমুদ্রে ড়ুবে মারা যায়নি? সেও আজও বেঁচে আছে মানসীর মতই? সেও কি একদিন এমনি কোন এক রাত্রে ফোন করে বলবে-শরদিন্দু, আমি মরিনি!
কথাটা যত ভাবে শরদিন্দু ততই যেন একটা অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অস্থির অশান্ত শরদিন্দু ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে।
তারপর অনেক ভেবেই শরদিন্দু স্থির করে, আবার সে পুরী যাবে—আবার সে নতুন করে মানসীর অনুসন্ধান করবে পুরীতে। যে হোটেলে সেবার সে গিয়ে উঠেছিল মানসীকে নিয়ে, এবারও সেই হোটেলেই উঠবে।
মানসী আজও বেঁচে আছে শরদিন্দুর কেমন যেন ধারণা হয়। কিন্তু মানসী তো মিথ্যা বলেনি—মনের মধ্যে তার একটা হত্যালিপ্সা সত্যিই জেগেছিল। বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকে কি সত্যিই মনে মনে সে হত্যা করতে চায়নি!
যেদিন সমুদ্রের জলে ড়ুবে যায়, তার আগের দিন রাত্রেই তো সামান্য কি একটা তুচ্ছ কথাকাটাকাটির পর সেই সকাল থেকেই শরদিন্দু কথা বন্ধ করেছিল মানসীর সঙ্গে।
বাইরে অন্ধকার রাত্রি তখন। খোলা জানালা পথে সাগরের হাওয়া আসছে, আর সেই সঙ্গে একটানা সমুদ্রের গুম গুম গর্জন। একটা হিংস্র দৈত্য যেন অন্ধকারে কেবলই ফুসছে। সামনে টেবিলের ওপরে ড্রিংসের গ্লাস—সেই সন্ধ্যা থেকে ড্রিংক করে চলেছে শরদিন্দু সামনে মুখখামুখি কিছুটা তফাতে একটা বেতের চেয়ারে বসে মানসী।
আর খেও না শরদিন্দু–মানসী বললে।
রক্তবর্ণ দুটো চোখ তুলে তাকাল শরদিন্দু—তার পরই যেন চাপা গলায় হিস হিস করে উঠল। শরদিন্দু, শাট আপ!
আমি তোমার মনের দ্বন্দ্ব জানি শরদিন্দু, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করতুমি যা ভেবে কষ্ট পাচ্ছ তা সত্য নয়!
সত্য নয়? বিয়ের আগে সুকুমারের সঙ্গে তোমার–
বলেছি তো, আমাদের পরিচয় ছিল ঘনিষ্ঠতাও ছিল, আর হয়তো তাকে ভালোও বেসেছিলাম আমি—কিন্তু–
চুপ, চুপ, একটা স্বৈরিণী, বেশ্যা—আবার উঁচু গলা করে সাফাই গাইছিস! তুই মর মর—মরে আমায় নিষ্কৃতি দে!
আমি কি বুঝতে পারছি না, বুঝতে পারছি—মানসী বললে, তোমার হাতেই একদিন আমায় মরতে হবে–
হ্যাঁ, তোকে—তোকে আমি—
হত্যা করবে তো, বেশ, তাই কর। এ যন্ত্রণার অবসান হোক।
মানসীর দুচোখের দৃষ্টিতে সেদিন কোন ভয়ই ছিল না। সে যেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। মানসী উঠে এসে শরদিন্দুর গলাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললে, পারবে—পারবে আমাকে মারতে? কই, মারমার না!
কি হল শরদিন্দুর, সে মানসীকে দুহাতে বুকের উপর টেনে নিয়েছিল।
তোমাকে বিশ্বাস করানো যাবে না শরদিন্দু, কিন্তু এটা তুমি কেন বোঝ না, সত্যিই যদি সুকুমারের প্রতি আমার ভালোবাসা তেমনিই থাকত, তাহলে তোমার সঙ্গে বিবাহে কি আমি মত দিতাম!
মানসী, তুমি কি জানতে না যে সুকুমার আমার ভাই—একই বাড়িতে থাকে সে?
না, বৌভাতের রাত্রে প্রথমে জানতে পারলাম।
সুকুমার তোমাকে কোনদিন কিছু বলে নি?
না, বাড়ির কথা সে কোন দিন আমায় কিছু বলেনি। আমায় কেবল বলেছে, সে পরাশ্রিত, অন্যের আশ্রয়ে জীবনযাপন করে। দেখ আমার কি মনে হয় জান, ওর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াই ভাল।
সুকুমারকে আমি ছাড়তে পারব না। কোন দিনই নানা না, তাকে আমি কোন দিনই ছাড়তে পারব না। হঠাৎ শরদিন্দু বললে, সে যত বড় অপরাধই করুক না কেন–
ছাড়তে পারলে বোধ হয় ভালই করতে শরদিন্দু, মানসী বললে।
সুকুমার পরেশ নন্দীর অনুরোধটা শেষ পর্যন্ত ঠেলতে পারেনি। তবে পরেশ নন্দীর গৃহে সে যায়নি। পরের দিনই সে এসেছিল কিরীটীর গৃহে। নিজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, বেলা তখন গোটা দশেক হবে।