০৫.
ঘটনাটা ঘটল আরও মাসখানেক পরে। দীঘায় বেড়াতে গিয়েছিল শরদিন্দু রীণাকে নিয়ে–দিন চারেক পরে ফিরে এল একা।
সুকুমার তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, হঠাৎ শরদিন্দুর দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। উসকো-খুসকো মাথার চুল, ছোট ছোট দাড়ি। দুচোখে কেমন যেন বিভ্রান্ত দৃষ্টি। নিঃসন্দেহে। চমকে উঠেছিল সুকুমার।–কি হয়েছে শরদিন্দুদা!
রীণা নেই।
নেই? কি বলছ তুমি?
বোধ হয় সমুদ্রের জলে ড়ুবে মারা গেছে।
সমুদ্রের জলে ড়ুবে?
হ্যাঁ, স্নান করতে নেমেছিল-সন্ধ্যার ঘোর নামছে তখন, কত বারণ করলাম শুনল না আমার কথা। জল থেকে আর উঠল না। পরের দিন কত খুঁজলাম—জেলেরা কত চেষ্টা করল
পুলিসে খবর দিয়েছিলে? সুকুমার শুধাল।
হ্যাঁ, তারা এখন ডেড বডিটার অনুসন্ধানে আছে।
সুকুমার কি বলবে বুঝে পায় না, কোন সান্ত্বনার বাণী তার মুখ থেকে বের হয় না।
আরও দিন পনেরো কেটে গেল। রীণার মৃতদেহের সন্ধান করতে পারেনি পুলিস, যেমন পারেনি পুরীতে মানসীর মৃতদেহের কোন সন্ধান।
মানসীর মৃত্যুর ব্যাপারটাও নিয়ে পরবর্তীকালে যেমন শরদিন্দু আর মাথা ঘামায়নি, তেমনি রীণার মৃত্যুর ব্যাপারটাও বোধ করি অনিবার্য একটা দুর্ঘটনা বলে শরদিন্দু মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু মানসীর ঐ আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটা ভুলতে পারেননি একজন, তিনি মানসীর বাবা পরেশ নন্দী। একটা সন্দেহের কুয়াশা যেন ক্রমশ তার মনের মধ্যে জমাট বেঁধে উঠতে থাকে। মানসী ছিল ভাল সাঁতারু। কলেজ জীবনে সে তার সাঁতারের কৃতিত্ব স্বরূপ অনেক কাপ মেডেল পেয়েছিল। সেই মানসী পুরীর সমুদ্রে স্নান করতে নেমে তলিয়ে যাবে—কথাটা যেন মন থেকে কিছুতেই পরেশ নন্দী মেনে নিতে পারছিলেন না।
কেমন যেন ব্যাপারটা রীতিমত অবিশ্বাস্য মনে হত তার কাছে। মনে হত মানসীর মৃত্যুর মধ্যে কোথাও একটা কোন রহস্য আছে নিশ্চয়ই।
এমনি যখন মনের অবস্থা পরেশ নন্দীর, হঠাৎ একজনের কথা তার মনে পড়ল। মানুষটি সম্পর্কে অনেক কিছু তিনি শুনেছিলেন কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। অবশেষে অনেক ভেবে সাহসে ভর করে একদিন তিনি গড়িয়াহাটায় তার গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
কিরীটী রায়।
কিরীটী বাড়িতেই ছিল। প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে সবে ফিরেছে কিরীটী। বসবার ঘরে বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রের পাতাটা ওলটাচ্ছিল কিরীটী, জংলী এসে বললে, একজন বুড়ো বাবু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
বুড়ো বাবু? কিরীটী বলল, তুই বললি না কেন কারও সঙ্গে আমি দেখা করি না?
বলেছি, কিন্তু শুনছে না
যা এই ঘরে নিয়ে আয়।
একটু পরে জংলীর সঙ্গে পরেশ নন্দী এসে ঘরে ঢুকলেন, পরনে একটা ময়লা ধুতি আর পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, পায়ে চপ্পল।
রায়মশাই, আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে হল বলে আমি বিশেষ দুঃখিত, কিন্তু আপনি ছাড়া কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না ভেবেই
বসুন। কোথা থেকে আসছেন?
পরেশ নন্দী তার নাম-ধাম বললেন।
আমার কাছে কি দরকার বলুন তো পরেশবাবু? কিরীটী শুধাল।
আমার যা বলবার যদি একটু ধৈর্য ধরে শোনেন রায়মশাই অনুগ্রহ করে—
বেশ বলুন!
পরেশ নন্দী, তখন মানুসীর কাহিনী আদ্যোপান্ত বলে গেলেন ধীরে ধীরে।
আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না নিশ্চয়ই নন্দীমশাই যে আপনার মেয়েটি জলে ড়ুবে মরতে পারে! কিরীটী বলল সবকিছু শুনে।
না। আমার মনে হয় তার যদি মৃত্যুই হয়ে থাকে জলে ড়ুবে, তাহলে সে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
সমুদ্রে কখনও আপনার মেয়ে সাঁতার কেটেছে?
না।
তাহলে ব্যাপারটা তো আকস্মিক দুর্ঘটনাও হতে পারে নন্দীমশাই।
পরেশ নন্দী বললেন, হতে যে পারে না তা নয়। কিন্তু তবুও মনকে প্রবোধ দিতে পারছি। তাছাড়া একটা কথা ভেবে দেখুন রায়মশাই-শরদিন্দু আবার বিবাহ করল দেড় বৎসরের মধ্যে এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাগ্যেও অনুরূপ ব্যাপার ঘটল। আবার সেই সমুদ্র–
আচ্ছা নন্দীমশাই, শরদিন্দুবাবু দ্বিতীয়বার যাকে বিবাহ করলেন—সেই রীণা না কি নাম মেয়েটির—তার পরিচয় কিছু জানেন? কার মেয়ে—কোথায় বিয়ে করলেন তাকে উনি?
না, সেসব কিছুই আমার জানা নেই হয়তো সুকুমার জানে।
সুকুমার মানে শরদিন্দুবাবুর জ্ঞাতিভাই, যিনি এই বাড়িতেই থাকেন?
হ্যাঁ। একটা কথা রায়মশাই কথাটা আমি বলিনি এখনও, কিন্তু বোধ হয় আপনার জানা দরকার, আমার মেয়ে মানসীর সঙ্গে ঐ ছেলেটির একটু যেন হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল একসময়
ভালোবাসা?
বলতে পারেন।
আপনার মেয়ের বিবাহের পূর্বে না পরে?
পূর্বে।
তবু আপনি শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়েছিলেন কেন?
সে কথা তো পূর্বেই আপনাকে বলেছি শরদিন্দু এক সময় আমার মালিক ছিল—তারপর হঠাৎ অকালে শরদিন্দু আমাকে রিটায়ার করাবার জন্য জেদ প্রকাশ করল-মানসী সেকথা জেনে প্রতিবাদ জানাতে যায় শরদিন্দুর কাছে শরদিন্দু ওকে দেখে মুগ্ধ হয়—বিবাহের প্রস্তাব দেয় আমার কাছে, সেই সঙ্গে একটা লোভনীয় পেনসনের লোভ দেখায়। চাকরি গেলে আমার আর্থিক অবস্থার কি হবে ভেবে আমি মানসীকে অনুরোধ জানাই বিবাহে সম্মত হতে। মানসী আমায় অত্যন্ত ভালোবাসত—সে সব কথা শুনে প্রথমটার গুম হয়ে রইল—তারপর একটু পরে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে বাবা।
কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে কিরীটী বললে, আচ্ছা বিবাহের পর শরদিন্দু কি ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল—মানে তার স্ত্রীর পূর্বরাগের কথা?
বোধ হয় জেনেছিল।
আপনি জানলেন কি করে?
মানুর ডাইরি থেকে—
ডাইরি?
হ্যাঁ, মানুর একটা ডাইরি ছিল—মধ্যে মধ্যে যে ডাইরি লিখত। সেই ডাইরিটা এখনও আমার কাছে আছে।
আপনি পেলেন কি করে সেই ডাইরি?
ও যেবারে পুরী যায়, তার দুদিন আগে আমার কাছে এসেছিল—বোধ হয় সেই সময়ই ডাইরিটা তার পড়ার টেবিলে বইয়ের মধ্যে রেখে যায়—তার মৃত্যুর পর একদিন তার পড়ার টেবিলের বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ ডাইরিটা পাই—ওর পুরী যাওয়ার তিন দিন আগে রাত্রে ডাইরির শেষ পাতা লেখা।
আপনি আমাকে একবার ডাইরিটা পড়াতে পারেন নন্দীমশাই?
কাল এনে দেব।
তাই দেবেন, আগে আমি ডাইরিটা পড়ে দেখি, ডাইরির মধ্যে যদি এমন কিছু পাইযাতে করে আপনার সংশয়টা যুক্তিযুক্ত মনে হয়
পরেশ নন্দী বললেন, বেশ, তাই পড়ে দেখুন কালই আমি দিয়ে যাব। ডাইরিটা—পরেশ নন্দী কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে পরেশ নন্দী এসে মানসীর ডাইরিটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ সনের একটা পুরাতন ডাইরি। সেই ডাইরির পাতার মধ্যে মধ্যে মানসী ডাইরি লিখেছে। রাত্রে বসবার ঘরের সোফাটায় বসে কিরীটী ডাইরির পাতাগুলি ওলটাচ্ছিল।
প্রথম তারিখ ১৯৬৩ সনের ৬ই জুলাই। প্রথমে বেশ অনেকগুলো খালি পাতার পর বোধ হয় ঐ ডাইরি লেখা শুরু। মানসী লিখছে, মাত্র কয়েকটি লাইন—আজ আমার জন্মদিন, রথযাত্রার দিনই নাকি আমি জন্মেছিলাম—ঠিক সন্ধ্যা সোয়া সাতটায়, হিসাব করে দেখলে আজ আমার বয়স উনিশ পূর্ণ হল, কুড়ি বছরে পা দিলাম!
পরের ডাইরি লেখা হয়েছে—এক মাস পরে—৭ই আগস্ট। বুধবার।
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। কাল সারারাত বৃষ্টি পড়েছে। বৃষ্টি আমার খুব ভাল লাগে, বৃষ্টির যেন একটা আলাদা সুর আছে রিম ঝিম রিম ঝিম।
তারপরের যে তারিখটায় ডাইরি লেখা শুরু হয়েছে লাল কালি দিয়ে সে তারিখটা লেখা। তারিখটা ইংরেজী তারিখ নয়, বাংলা তারিখ। ২১শে ফায়ূন, রাত্রি দশটা।
আজ স্নানের পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রথম আবিষ্কার করলাম যেন। বাড়িতে কেউ ছিল না। আমি একাই ছিলাম। সত্যি আমি দেখতে এত সুন্দুর? দেহের কানায় কানায় যৌবন। আমি নিজেই যেন চমকে উঠেছিলাম নিজের সেই ভরা যৌবনের দিকে তাকিয়ে
ঐ পর্যন্তই, তারপর আর কিছু লেখা নেই।
লেখা শুরু আবার সাত মাস পরে।
এবারে পুজো আশ্বিনের মাঝামাঝি। আকাশে এখনও মধ্যে মধ্যে মেঘ জমে ওঠে। দু-এক পশলা বৃষ্টিও হয়। আচ্ছা সুকুমারকে কি সত্যিই আমি ভালোবাসি? কি জানি, জানি না। তবে এটা জানি, সুকুমার আমাকে ভালোবাসে।
বুঝতে পারি দেখা হলে সুকুমার কি রকম মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর দুচোখের দৃষ্টি যেন আমাকে বন্দনা করে। সুকুমার কিন্তু বড় চাপা। আচ্ছা, মুখ খুলতে ওর এত ভয় কেন, কিসেরই বা ভয়?
আবার দু মাস পরে লেখা ডাইরি।
লেকে আজ বেড়াতে গিয়েছিলাম দুজনে। আমি আর সুকুমার দুজনে একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসেছিলাম, ও আমার একটা হাত দুহাতের মধ্যে নিয়ে খেলা করছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, কারও মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। বললাম আমিই, কিছু বলবে সুকুমার?
সুকুমার বললে, কি বলব?
কিছু বলার নেই?
তুমি বল মানসী। সুকুমার বলল।
কেন, তুমি বলতে পার না সুকুমার?
যা বলবার আগেই তো সব বলেছি। কেন, তুমি জান না! শুনতে পাওনি?
কই না তো!
তবে আর শুনে কাজ নেই।
বাবুর অমনি রাগ হয়ে গেল, বেশ, গো বেশ আমি হার মানছি, হল তো?
সুকুমার হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল।
আঃ, কি হচ্ছে ছাড়—কেউ দেখে ফেলবে, বললাম।
আরও মাস দুই পরে আবার ডাইরি লেখা। কোন তারিখ নেই। তবে লেখা :
দুমাস কোন ডাইরি লিখিনি।
আশ্চর্য, সত্যি আজও যেন সুকুমারকে বুঝতে পারলাম না। ও আমাকে চায়, বুঝতে পারি, কিন্তু বলে না স্পষ্ট করে—এ এক দুঃসহ যন্ত্রণা-ভোগ। এক যন্ত্রণার সাগর উত্তীর্ণ হওয়া। তবে ওর ভালোবাসাটা ও প্রকাশ করতে পারে না। কেন পারে না ও—আমি তো পারি, ও ছাড়া জীবনে আমার অন্য কোন পুরুষ আসতে পারে না।
আবার মাস দুই পরে ডাইরি লেখা হয়েছে :
বুঝতে পেরেছি সুকুমারের মধ্যে একটা কমপ্লেক্স আছে। হীনমন্যতার কমপ্লেক্স। কেবলই ও নিজেকে বলে, পরাশ্রয়ী। শরদিন্দুবাবু না থাকলে নাকি ওর বাঁচাটাই দুষ্কর হত।
আমার কেন যেন মনে হয় শরদিন্দুর কাছে আশ্রয় পাওয়াটাই হয়েছে ওর জীবনের সব চাইতে বড় অভিশাপ। শরদিন্দু যদি ওকে আশ্রয় না দিত, ও বোধহয় অন্য মানুষ হতে পারত। ও মরে গিয়েছে। বিয়ের পর ওকে আমি ঐ শরদিন্দুর কাছ থেকে দূরে—অনেক দূরে নিয়ে যাব।
এবারে মাস আষ্টেক বাদে ডাইরি লেখা হয়েছে। ওপরের তারিখটা ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫।
ও কোন দিনই বলবে না। ভাবছি এবারে আমিই ওকে বলব—আচ্ছা সুকুমার, এবার আমরা বিয়ে করলে কেমন হয়? এস, বিয়ে কর আমায়। দূর, তাই কখনও বলা যায় নাকি! ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। কিন্তু ওকে যতটুকু চিনেছি, ও কোন দিন হয়তো মুখ ফুটে বলবে না, আমাদের বিয়ের কথা। আমাকে হয়তো ঐ কথাটা শুনবার আশায় এমনি করেই চেয়ে থাকতে হবে।
তারপর আবার—৩১শে অক্টোবর ১৯৬৫।
হঠাৎ কাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বাবা বললেন, ওঁর কারখানার মালিক নাকি ওঁকে রিটায়ার। করতে বলেছেন।
কথাটা শুনে আমার প্রচণ্ড রাগ হল, এ কি অদ্ভুত খেয়াল মানুষটার! মালিক বলে যা খুশি তাই করবে নাকি! আর আমাদের সেটা সহ্য করতে হবে? না, এ হতে পারে না। আমি কাল দেখা করব মানুষটার সঙ্গে, বলব, আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন না। একটা সংসারকে আপনি আপনার খেয়ালে নষ্ট করতে পারেন না।
১লা নভেম্বর ১৯৬৫।
গিয়েছিলাম ভদ্রলোকের অফিসে। মানুষটার চোখের দৃষ্টি কি বিশ্রী। সর্বক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকেছেন, আমার এমন বিশ্রী লাগছিল। কিন্তু তবু মনে হয়, মানুষটাকে বোধ হয় যতটা খারাপ ভেবেছি ততটা খারাপ নয়।
দিন দুই পরে আবার লিখছে মানসী–
বাবার মুখে প্রথমে কথাটা শুনে সত্যিই আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল, স্পর্ধা তো কম নয়—আমাকে বিয়ে করতে চায়! বেচারীর বোধ হয় আমাকে দেখে এতকালের কৌমার্যের আসনটা টলে গিয়েছে!
যত ভাবছি কথাটা, ততই রাগ হচ্ছে বটে কিন্তু হাসিও পাচ্ছে। বেচারী শরদিন্দু! কিন্তু যা-ই বলি না কেন, ভদ্রলোকের চেহারাটা কিন্তু পুরুষালী এবং রীতিমত হ্যাণ্ডসাম।
বাবা আজ সকালেই আমাকে ডেকে বললেন সব কথা, তারপর বললেন আমি এখন কি
করি বল্ তো মা? আমি হঠাৎ বললাম কি করে বললাম তা জানি না, বললাম, তুমি যা ভাল বুঝবে তাই করবে। আমার মতামতের জন্য অত ভাবছ কেন?
তুমি আমায় বাঁচালি মা। বেঁচে থাক, শরদিন্দু সত্যি ভদ্রলোক। তুই সুখী হবি আমি বলছি, বাবার সমস্ত মুখ জুড়ে সে এক তৃপ্তির আনন্দ!
দীর্ঘ দেড় মাস পরে আবার ডাইরি শুরু
গত প্রায় মাস দেড়েক সুকুমারের সঙ্গে দেখা হয় নি হয়তো বেশিও হতে পারে। বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে প্রথমে যে বিস্ময়ের সম্মুখীন হলাম, সে সুকুমার।
সুকুমারকে দেখলাম। সে এসে আমাদের যে ঘরে ফুলশয্যা রচিত হয়েছিল সেই ঘরে প্রবেশ করল। ভেবেছিলাম জীবনে আর হয়তো সুকুমারের সম্মুখীন হতে হবে না, কিন্তু আমার ভাগ্যবিধাতা বোধ হয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। সুকুমার এই বাড়িতেই থাকে, ও শরদিন্দুর ভাই।
ঐ পর্যন্ত লিখে ডাইরি যেন শেষ হয়েছে। অনেকগুলো শূন্য পৃষ্ঠা। কিছু লেখা নেই। কিন্তু ডাইরি যে ওখানেই শেষ হয়নি, কিরীটী বুঝতে পারল, ডাইরির শেষের দিকে এসে অনেকগুলো শূন্য পাতার পর আবার ডাইরির শুরু। মানসী লিখেছে।– মানুষের বুকের মধ্যে যে এমন একটা আক্রোশ, এমন জমাটবাঁধা ঘৃণা থাকতে পারেসত্যি যেন আমার ধারণাও অতীত ছিল।
কাল রাত্রে শরদিন্দুর অন্য রূপ দেখলাম। শরদিন্দু নেই, কি একটা ব্যবসার কাজে দিল্লী গিয়েছে, কাল ফিরবে। যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম, তার কামনার উগ্র তাপ থেকে। আমার দেহটা যেন সুতীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। ক্লান্ত—বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যেন। সত্যি, আর যেন সহ্য করতে পারছি না।
একদিকে শরদিন্দুর ঐ অত্যাচার, অন্যদিকে সুকুমারের দুচোখের ঘৃণাভরা দৃষ্টি। চুপচাপ অন্ধকার ঘরের মধ্যে অন্ধকার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ কানে এল বেহালার করুণ সুর, কে যেন এই বাড়ির মধ্যেই কোথায় বাজাচ্ছে। কে বেহালা বাজায় এ বাড়িতে? পায়ে পায়ে একসময় ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। বেহালা কাঁদছে। বেহালার সুর অনুসরণ করে করে তিনতলায় চলে গেলাম। সুকুমার তার ঘরে বেহালা বাজাচ্ছিল।
হঠাৎ কানে এল গাড়ির শব্দ। শরদিন্দুর আগে-আগেই ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। শরদিন্দু আমার পশ্চাতে ঘরে ঢুকল, ঘরের দরজার অর্গল তুলে দিল। ঘরে ঢুকেই আমি আলোটা সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। মনে হল, তার দু চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা হত্যা করবার লিপ্সা, শিকারের পূর্ব মুহূর্তে বাঘ যেমন তার শিকারের দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি করে যেন শরদিন্দু তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এখুনি বুঝি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বুকটার মধ্যে হঠাৎ যেন কেঁপে উঠল আমার।–কি হয়েছে, অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? ভয়ে ভয়ে বললাম।
মানসী, আমার অবর্তমানে তাহলে তুমি সুকুমারের ঘরে রাত কাটাও? কেন, কেন বলনি তুমি আমাকে বিয়ের আগে কথাটা? কেন জানতে দাওনি সত্য কথাটা?
তুমি তো জানতে চাওনি, আমি বললাম। মাথার মধ্যে তখন আমারও যেন আগুন জ্বলছে, আমিও যেন সহ্যের শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছি।
আমি জানতে চাই, বিয়ের আগে কতদূর পর্যন্ত তোমরা এগিয়েছিলে, শরদিন্দুর গলার স্বর যেন কাপছিল।
সে কথা তোমায় বলে কোন লাভ নেই বললাম আমি। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত।
স্বৈরিণী–বেশ্যা!
ভদ্রভাবে কথা বলহারামজাদী, ভদ্রভাবে কথা বলব তোর সঙ্গে! কথাগুলো বলেই হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমার গলাটা দশ আঙুল দিয়ে চেপে ধরল শরদিন্দু খুন—আজ তোকে খুনই করে ফেলব—চাপা গলায় হিসহিস করে বললে শরদিন্দু।
হঠাৎ ঐসময় গোকুল দরজায় ধাক্কা দিল, দাদাবাবু—দাদাবাবু!
শরদিন্দুর দশ আঙুলের চাপ শিথিল হয়ে গেল। ও আমায় ছেড়ে দিয়ে দরজাটা খুলে দিল। আশ্চর্য! শরদিন্দু তখন একেবারে শান্ত, একেবারে স্বাভাবিক, তার চোখে মুখে ও কণ্ঠস্বরে ক্ষণপূর্বে যে কুটিল হিংসা তাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল তার কিছুই যেন নেই। বললে, কিরে গোকুল?
খাবে তো চল, খাবার তৈরী হয়েছে।
পরে সেই রাত্রেই হঠাৎ শরদিন্দু আমার দুহাত ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললে, আর বলতে লাগল, ক্ষমা কর মণি আমাকে ক্ষমা কর, পশুরও অধম ব্যবহার করেছি আজ তোমার সঙ্গে আমি, বল—আমায় ক্ষমা করেছ বল!
ঘৃণায় লজ্জায় আমি যেন তখন একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছি।
মণি বল—আমি পশু—আমি একটা পশু।
আমি বললাম, আজ বোধ হয় ড্রিঙ্ক করনি–
না।
আমি তখন বোতল থেকে গ্লাসে ড্রিংক ঢেলে দিলাম।
আমি বুঝতে পারছি ঐ শরদিন্দুর হাতেই আমার মৃত্যু আছে।
এর পর আর ডাইরি লেখা হয়নি। বোঝাই যায়, মানসী আর ডাইরি লেখবার সুযোগ পায়নি। অতল জলধির মৃত্যু তাকে গ্রাস করেছে। ঐ ঘটনার পরেই তো সে পুরী গেল স্বামীর সঙ্গে, ডাইরিটা সঙ্গে নিয়ে যায়নি। নিজেদের বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। মানসী কি তাহলে বুঝতে পেরেছিল, আর সে ডাইরি লেখার সুযোগ পাবে না? তাই—তাই কি সে ডাইরিটা সঙ্গে নেয়নি, বাপের বাড়িতে রেখে গিয়েছিল?
কিরীটীর মনে হয়, কলকাতায় নিজের বাপের বাড়িতে তার পড়ার টেবিলে ডাইরিটা রেখে যাওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে—প্রথমত সে সুনিশ্চিত ভাবে বুঝতে পেরেছিল, পুরী থেকে : সে আর ফিরে আসবে না এবং দ্বিতীয়ত, যদি তার মৃত্যু সেখানে হয়ই, তাহলে একদিন না একদিন ঐ ডাইরিই তার মৃত্যুর কারণটা প্রকাশ করে দেবে।