০৪.
মানসীর সঙ্গে ঐ শেষ দেখা সুকুমারের। পরের দিনই পুরী এক্সপ্রেসে মানসীকে নিয়ে শরদিন্দু চলে যায়। শরদিন্দু ফিরে এল কিন্তু তার সঙ্গে মানসী ফিরে এল না।
যেদিন শরদিন্দু এসে মানসীর মৃত্যুসংবাদটা সুকুমারকে দিল, সুকুমার প্রথমটায় সত্যিই চমকে উঠেছিল। মানসী পুরীর সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছে।
মানসী যে কেবল ভাল সাঁতারই জানত তাই নয়—কলেজে পড়ার সময় সাঁতারে সে বিশেষ পারদর্শিনী ছিল। শরদিন্দুর সেকথা জানবার কথা নয়, কিন্তু সুকুমার জানত। তাই কথাটা শুনে কয়েকটা মুহূর্ত শরদিন্দুর মুখের দিকে কেমন যেন একপ্রকার বিস্ময়েই তাকিয়ে ছিল সুকুমার।
কিন্তু শরদিন্দুর তখনকার চেহারা ও চোখের অসহায় দৃষ্টি—যে দৃষ্টির মধ্যে ছিল সর্বস্ব হারানোর এক ব্যথা—সেটাও সে অবিশ্বাস করতে পারেনি।
কটা দিন শরদিন্দু কোথাও বেরুল না। সর্বক্ষণ বাড়িতেই থাকে।
শেষটায় সুকুমারই বলেছিল, যা হয়ে গিয়েছে তার তো আর কোন চারা নেই। শরদিন্দুদা—তুমি বরং দিনকতক কোথাও গিয়ে ঘুরে এস শরদিন্দুদা।
আচ্ছা সুকুমার, মানসীকে তুই অনেক দিন থেকেই চিনতিস, তাই না?
সুকুমার কথাটা শুনে চমকে ওঠে। কি বলতে চায় শরদিন্দু!
কি রে, আমার কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন? জানতিস ওকে অনেক দিন থেকেই, তাই না?
চিনতাম।
তা সেকথা আমাকে বলিসনি কেন? তাহলে তো এত বড় ভুলটা করতাম না আমি!
না, তুমি ভুল করছ। তুমি বিশ্বাস করতে পার আমরা পরস্পরকে বিবাহ করব এমন কোন কথা কখনও আমাদের মধ্যে হয়নি। এখন বুঝতে পারছি, একটা ভুলের মধ্যে পড়ে তুমি নিজেও। দুঃখ পেয়েছমানসীকেও দুঃখ দিয়েছ। তবে ভুল আমিও করেছি, তোমার ঐ ধারণার কথা জানা সত্ত্বেও এ বাড়ি ছেড়ে আমার না চলে যাওয়াটা—অনেক দিন আগেই আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ছিল—আমি কালই চলে যাব।
না না, সুকুমার, তুই চলে যাস না, মানসীকে হারানোর ব্যথাটা সহ্য হলেও তোকে হারানোর ব্যথাটা আমি সহ্য করতে পারব না। কিন্তু শরদিন্দুদা, তুমি বুঝছ না—
বুঝছি—ও চিন্তা মনেও স্থান দিস না, আমার আরও কেন দুঃখ হয়েছে জানিস, মানসী প্রেগনেন্ট ছিল!
শরদিন্দুদা?
হ্যাঁ, চার মাস অন্তঃসত্ত্বা ছিল মানসী, এই কথাটা কোনমতেই আমি ভুলতে পারছি না— সে-ই কেবল চলে যায়নি, সেই সঙ্গে আমার ভবিষ্যৎ বংশধরের সমস্ত সম্ভাবনাটুকুও সে শেষ করে দিয়ে গিয়েছে। মানসীর কথাটা হয়তো আমি ভুলে যাব একদিন, কিন্তু কখনও বোধ হয়। জীবনে ভুলতে পারব না আমার সেই অনাগত সন্তানের কথা।
সুকুমার নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে শরদিন্দুর মুখের দিকে। সত্যিই সে যেন কোন সান্ত্বনার ভাষাই খুঁজে পায় না।
সুকুমারের শেষ পর্যন্ত ঐ বাড়ি আর ছাড়া হল না। শরদিন্দুর কথাটা সে ফেলতে পারল। কিন্তু বাড়িটা যেন অতঃপর সত্যি সত্যিই একটা ভূতুড়ে বাড়ি হয়ে উঠল—কোন সাড়া নেই, শব্দ নেই, নিঃশব্দে সবাই চলাফেরা করে।
মানসী ঐ বাড়িতে এসে অবধি হাসিগানে যেন বাড়িটাকে ভরিয়ে রাখত সর্বদা, এখন যেন সমস্ত বাড়িটাতে শ্মশানের স্তব্ধতা।
কেবল মাঝে মাঝে অনেক রাত্রে শোনা যায় একটা বেদনার সুর। সুর তো নয় যেন কান্না। যেন গুমরে গুমরে কে কাঁদছে।
শরদিন্দু কদাচিৎ কখনও কারখানায় যায়, কিন্তু গেলেও বেশীক্ষণ থাকে না। শোনা যায় সে নাকি তার গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে বের হয়ে যায়। আর প্রায়ই ৮/১০ দিনের জন্য যেন কোথায় চলে যায়। সুকুমারকেই অগত্যা কারখানাটা দেখতে হয়।
এমনি করেই দিন কাটছিল। তারপরই বৎসরখানেক পরে শরদিন্দু যেমন হঠাৎ হঠাৎ চলে যায় তেমনিই চলে গিয়েছিল, প্রায় দেড় মাস বাদে এল ঐ টেলিগ্রামটা। শরদিন্দু তার নবপরিণীতা বধূকে নিয়ে কোন্ ট্রেনে কখন আসবে কিছুই জানে না সুকুমার, স্টেশনে তাই গাড়ি পাঠাতেও পারে না। তবে সুকুমার সেদিনটা আর বাড়ি থেকে বেরই হল না।
সন্ধ্যার ঘোর নেমেছে তখন চারিদিকে। শীতের সন্ধ্যা, কলকাতা শহরের সেই বিশ্রী ধোঁয়াটা জমাট বেঁধে উঠেছে চারিদিকে। শীতটাও কয়দিন থেকে বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। একটা ট্যাক্সি এসে থামল বাড়ির সামনে।
ট্যাক্সিটা থামার শব্দে গোকুলই গেটটায় ছুটে যায়। দরজা খুলতেই ওর চোখে পড়ল শরদিন্দু ট্যাক্সি থেকে নেমেছে—তার পশ্চাতে এক নারী। গেটের সামনের আলোটা জ্বেলে দিয়েছিল। গোকুল। সেই আলোতেই দেখল পরনে তার দামী শাড়ি, মাথায় ঘোমটা নেই। বব করা চুলগুচ্ছে গুচ্ছে কাঁধের ওপর ঝুলছে। সরু বগলকাটা ব্লাউজ হাতে একটা কালো রংয়ের দামী হ্যান্ডব্যাগ, পায়ে হিলতোলা জুতো। গোকুল কি করবে বুঝতে পারে না। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইতিমধ্যে সুকুমারও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেও দেখছিল নারী মূর্তিটিকে—চোখমুখ তীক্ষ্ণ, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম।
এই যে সুকুমার, আমার টেলি পাসনি? শরদিন্দু বলল।
পেয়েছি।
তোর নতুন বৌদি-তারপর স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, রীণা, এই আমার ভাই সুকুমার, যার কথা তোমায় বলেছি।
রীণা সুকুমারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
রীণা বললে, আমি কিন্তু তোমাকে সুকুমার বলেই ডাকব ভাই।
তাই বলবেন। সুকুমার বলল।
না, না—তুমি ওসব আপনি-টাপনি বলবে না সুকুমার। তুমি আমাকে তুমি করেই বলবে। শরদিন্দু এবারে বাধা দিয়ে বললে, তুমি যা বলবে রীণা, তাই হবে। চল ভিতরে চল।
অনেক রাত তখন। সুকুমার তার তিনতলার ঘরে বসে বেহালা বাজাচ্ছিল। হঠাৎ রীণা এসে ঢুকল সেই ঘরে। পাতলা সিল্কের নাইটি রীণার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে যেন লেপটে আছে। সুকুমার লজ্জায় চোখ নামায়।
কি হল সুকুমার, থামলে কেন? তোমার বাজনা শুনতেই তো এলাম। বলতে বলতে রীণা আরও এগিয়ে এল সুকুমারের কাছে। একটা দামী সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে তার দেহ থেকে।
দাদা—
আরে তোমার দাদা এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, পেথিডিনের অ্যাকশান–
পেথিডিন!
হ্যাঁ, তোমার দাদা তো রোজ রাত্রে ঘুমের জন্য পেথিডিন ইনজেকশন নেয়। পেথিডিন না। নিলে নাকি তোমার দাদার ঘুমই হয় না! তুমি জান না?
দাদা পেথিডিন নেয়। সুকুমারের কণ্ঠে বিস্ময়।
হ্যাঁ, এখন তো জানলে, এবার বাজাও।
এখন আমি ঘুমাব বৌদি, আপনি আসুন।
তুমি আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছ সুকুমার? রীণার গলায় অভিমান।
না, আমি কেবল বলেছি—এবারে আমি ঘুমাব।
বেশ তাহলে ঘুমাও। রীণা আর দাঁড়াল না। ঘরের মধ্যে বাতাসে মৃদু মিষ্টি সুবাসের ঢেউ তুলে বের হয়ে গেল। আর সুকুমার স্তব্ধ অনড় হয়ে বসে রইল যেমন বসেছিল। সে তখন ভাবছে শরদিন্দুদা এ কাকে বিয়ে করে নিয়ে এল!
পরের দিন সকালে সুকুমার তখনও নীচে নামেনি। স্নান সেরে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, গোকুল এসে ঘরে ঢুকল।
ছোটদাবাবু, আপনার চা কি এখানে নিয়ে আসব?
তাই দাও গোকুল। দাদা উঠেছেন?
তিনি তো এখনও ওঠেননি। বৌদি একা বসে টেবিলে ব্রেকফাস্ট করছেন।
শরদিন্দুদা এখনও ওঠেননি! বেলা তো প্রায় সাড়ে সাতটা! এত দেরি করে তো কখনও শরদিন্দুদা ওঠে না শয্যা থেকে? মাস দেড়েক ছিল না কলকাতায় শরদিন্দু—এই দেড় মাসের মধ্যে শরদিন্দুর এতখানি পরিবর্তন হয়েছে! মনে পড়ল গতকাল রীণা বলছিল, শরদিন্দু নাকি পেথিডিন নেয়! ওর নবপরিণীতা স্ত্রীর কথায় মনে হল শরদিন্দু পেথিডিন-অ্যাডিকটেড হয়েছে।
চা ও প্রাতঃরাশ গোকুল ওপরেই নিয়ে এল ট্রেতে করে, চা পান করতে করতে হঠাৎ কেন যেন আজ আবার মনে হল সুকুমারের, এ বাড়ি ছেড়ে বোধ হয় তার চলে যাওয়াই ভাল—আজ হোক কাল হোক শরদিন্দুকে কথাটা সে বলবে।
দুজনের আবার দেখা হল বেলা প্রায় পৌনে একটা নাগাদ কারখানায়। জার্মানী থেকে অনেক টাকার নুতন একটা প্ল্যান্ট আনা হয়েছে। সেটারই তদারক করছিল সুকুমার, শরদিন্দু এসে ঢুকল। সুকু!
সুকুমার শরদিন্দুর দিকে ফিরে তাকাল। বললে, এই প্ল্যান্টটা গত মাসে এসেছে শরদিন্দুদা—
শরদিন্দু কিন্তু সেদিকে ফিরেও তাকাল না। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ তুলল, লাঞ্চে যাবি না?
আমি তো লাঞ্চে বাড়িতে যাই না, এখানেই ক্যানটিনে লাঞ্চ করি।
শরদিন্দু বললে, নতুন একজন সায়েন্টিস্ট দেখলাম এখানে, অনিল গাঙ্গুলী—
হ্যাঁ, ওঁকে তো তুমিই মাস দুয়েক আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে গিয়েছিলে—
ও হ্যাঁ–তা তিনি কাজ কেমন করছেন?
মনে তো হয় ভালই।
আচ্ছা চলি—শরদিন্দু বের হয়ে গেল।
সুকুমার একবার ইচ্ছা হয়েছিল প্রশ্ন করে শরদিন্দুকে, সে নাকি আজকাল পেথিডিন নেয়, কিন্তু কেন জানি কথাটা তার মুখ দিয়ে বেরুল না।
তারপর আরও পনেরো দিন চলে গেল—কথাটা জিজ্ঞাসা করতে পারল না শরদিন্দুকে সুকুমার। চলে যাবার যে ইচ্ছাটা তার মনে জেগেছিল, সেটাও প্রকাশ করা হল না।