১২.
একটা ট্যাক্সি যোগাড় করে কিরীটী আর সুব্রত বেলা দেড়টা নাগাদ ভুবনেশ্বরে এসে পৌঁছুল। ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাহায্যেই বাড়িটা খুঁজে বের করতে ওদের কোন অসুবিধা হল না, বাড়ির সামনে এসে ওরা ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল। ট্যাক্সিটা চলে গেল।
দোতলা বাড়ি। এবং বাড়িটা নতুন তৈরি হয়েছে মনে হয়। দরজা বন্ধ। কলিং বেল টিপতেই একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দিলেন। পরনে পায়জামা আর পাঞ্জাবি। মাথার চুল প্রায় সব সাদা। চোখে চশমা।
কাকে চাই? ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
আমরা একটা ফিল্ম কোম্পানি থেকে আসছি, কিরীটী বলল, লক্ষ্মী দেবী কি বাড়িতে আছেন?
না।
তিনি তো এখানেই থাকেন? কিরীটীর প্রশ্ন।
হ্যাঁ থাকতেন, তবে দিনপাঁচেক হল চলে গিয়েছেন। তাছাড়া আমি যত দূর শুনেছি আর কোন ছবিতে তিনি অভিনয় করবেন না।
কেন?
তা কেমন করে বলব বলুন!
তিনি কোথায় গিয়েছেন বলতে পারেন?
ভদ্রলোক বললেন একটু যেন ইতস্তত করেই, না, তা বলতে পারব না। মানে আমাকে সেসব কিছু বলে যাননি।
আচ্ছা এখানে তিনি কতদিন ছিলেন?
তা মাস আষ্টেক হবে।
আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
জগন্নাথ সাহু!
এটা বোধ হয় আপনারই বাড়ি? কিরীটীই বললে!
হ্যাঁ, কিন্তু এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বলুন তো! ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে এবার যেন বেশ একটু রুক্ষতাই প্রকাশ পায়।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, লক্ষ্মী দেবীর ঠিকানাটা পেলে বড় ভাল হত। সত্যিই আপনি জানেন
জগন্নাথবাবু?
না। রুক্ষকণ্ঠে কথাটা বলেই জগন্নাথ সাহু ওদের মুখের ওপরই দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
দুজনেই হতভম্ব কিছুটা। সুব্রত বললে, অতঃ কিম্?
কিরীটী সুব্রতর কথার কোন জবাব না দিয়ে ঘুরতে গিয়েই হঠাৎ একটা বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
কিরীটীর দৃষ্টি অনুসরণ করে সুব্রতও ঐদিকে তাকিয়েছিল—তার যেন মনে হল জানালার একটা কপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।
চল, সুব্রত!
কোথায়—স্টেশনে তো?
না, কোন একটা হোটেলে। ওড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বর—নিশ্চয়ই এখানে দু-একটা ভাল হোটেল আছে!
কিন্তু হোটেলে কেন? সুব্রত পালটা প্রশ্ন করে।
কিরীটী বললে, করুণ দুটি চোখের মিনতি—যেও না, যেও না বঁধু!
মানে?
চোখ থাকলে দেখতে পেতে। চল—আর এখানে নয়-পা চালাও।
দুজনে হাঁটতে শুরু করে। কিরীটী চিন্তিত।
কিরীটী। জানালায় কার চোখের মিনতি দেখলি?
লক্ষ্মী দেবী ভুবনেশ্বর ছেড়ে যাননি কোথাও! কিরীটী বললে।
কি করে বুঝলি?
নারীজাতির সহজাত কৌতূহল। বুঝলে সুব্রত—সেই কৌতূহলটুকু প্রকাশ করতে গিয়েই ধরা পড়ে গেলেন!
হোটেলে একটা ভাল ঘরই পাওয়া গেল। একপেট আহারের পর সুব্রত একটানা একটা ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে সুব্রত দেখল কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।
কি হে, সারাটাক্ষণ পায়চারি করেই কাটালে নাকি?
কিরীটীর দিক থেকে কোন সাড়া এল না। সে একমনে তখনও পাইপটা ঠোঁটে চেপে পায়চারিই করে বেড়াচ্ছে।
বাইরে ইতিমধ্যে অনেকক্ষণ দিনের আলো নিভে গিয়েছে। সুব্রত একটা হাই তুলে শয্যার ওপর উঠে বসল। তারপর বেয়ারাকে চায়ের অর্ডার দিয়ে সুব্রত বললে, রাতটা কি এখানেই কাটানো হবে?
একবার বেরুতে হবে—এখন সাতটা বাজে—এই পৌনে আটটা নাগাদ।
কোথায়?
লক্ষ্মীর ভবনে-সেখানে আর একবার যেতে হবে।
জগন্নাথ সাহুর ঐ কাঠ-কাঠ কথা বলবার পরও?
সে কাঠ থেকেই রস বার করতে হবে সুব্রত!
বাবা, আমি আর সেখানে যাচ্ছিনে।
কেন, গলাধাক্কার ভয়ে নাকি? কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
রসিকতা থাক। সত্যিই আবার সেখানে যাবে নাকি?
বাঃ, এতদূর এসে শ্রীমতী লক্ষ্মী দেবী—মানে আমাদের মানসী দেবীর সঙ্গে না দেখা করেই চলে যাব?
তা দেখাটা করবে কেমন করে?
ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়!