মানসাঙ্ক
কলকাতার ভেতরেই। অথচ ঠিক কলকাতার ভেতরে নয়। ট্রাম থেকে নেমে বাস, অটো, মিনিবাস। যেটা ইচ্ছে ধরে আদিগঙ্গা পেরােও। তারপরই সুধীর পার্ক, চট্টরাজ গার্ডেন্স, ওয়াজেদ আলি পল্লি, বােসনগর, দাসপাড়া—এই সব নাম দিয়ে গেরস্থপাড়া। আর তাদের মাঝে মাঝে ফুলকপির খেত। লঙ্কার চাষ। বেগুনের ঝুড়ি মাথায় মেয়ে ব্যাপারী কলকাতা চলেছে। মুলাে বােঝাই সাইকেল ভ্যান। ইলেকট্রিকের খুঁটির পাশেই টেলিফোনের পােল। উল্টোদিক থেকে লরি এলে রিকশ থেমে যায়। চট্টরাজ গার্ডেন্সে বাড়িভাড়া নেবার পর কিছুদিন রিকশ চড়ে বাস রাস্তায় গিয়ে হিসেব কষে দেখি–ওরে বাবা! রিকশ। তারপর অটো। শেষে পাতাল রেল। তারপরেও আরও বাস, ট্রাম চড়তে হয়। রােজ গাড়িভাড়াই তাে দিচ্ছি কমসে কম পঁচিশ-তিরিশ টাকা। তারপর আবার একটু রাত হলে কিংবা বৃষ্টি পড়লে রিকশ উধাও। পঁচিশ-তিরিশ টাকায় সকালের বাজারটা নমঃ নমঃ করে হয়ে যায়। সেই টাকা রােজ অফিস যাতায়াতে বেরিয়ে যাবে? মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। চট্টরাজ গার্ডেন্সে এই দশ-বারাে বছর হল ধানখেত, কপি খেতে ঘরবাড়ি উঠেছে। এখনও দু-চারটে ফাঁকা জায়গায় বেগুন, ধনেপাতার চাষ। মনকে বােঝাই কলকাতার ভেতরে থেকেও আমরা কলকাতায় নেই ঠিকই। কিন্তু এখানে বাতাসে কোনও পলিউশন নেই। ধুলাে নেই। সবজিটা টাটকা। বাজারে মাছ আশপাশের পুকুর থেকে আসে। জ্যান্ত। পাল্লায় উঠেও লাফায়। ঘাসখাের লােকাল পাঁঠার মাংস। দিব্যি মিষ্টি। এ তাে আর ভবানীপুর বা শ্যামপুকুরে পাওয়া যাবে না। এও তাে কম নয়।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে টিভি-তে কলকাতার খবর পাই। মুক্ত বায়ুর জন্যে গণদৌড়। সম্প্রীতির জন্যে মানবশৃঙ্খল। আমাদের এখানে দুপুরবেলাতেই গভীর রাতের মতােই সব কিছু নিস্তরঙ্গ। কলকাতার ছবি টিভি-র পর্দায় খুব কঁপে। আবছা। লাে ভােল্টেজ। বুঝে নিতে হয় এটা গণদৌড়। ওটা মানবশৃঙ্খল। তার ভেতর বেশি রাতে শেয়ালের ডাক। বসতি এগিয়ে আসায় ওরা পিছিয়ে গেছে। টাটকা সবজির মতােই খুব অরিজিনাল সেই কলধ্বনি। সিনেমার মতাে মায়াদর্পণে নয়।
বাড়িওয়ালা বলল, এটুকু রাস্তা রিকশয় চড়েন কেন? হাঁটলেই পারেন। বললাম, তারপরেও তাে—অটো আছে—
অটোয় উঠবেন কেন? একটু পিছিয়ে গিয়ে মিনিবাসের টার্মিনাস। একদম কার্জন পার্কে গিয়ে নামবেন। পাতাল রেলের গলাকাটা ভাড়াও বাঁচাতে পারবেন।
মন্দ বলেননি। কেডস কিনে পায়ে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম—সময় যায়। ঠা-ঠা রােদুরে ঘেমে একশা। সট করে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কিনে ফেললাম। চড়ে দেখি—উঃ! কী আনন্দ। গায়ের দুপাশ দিয়ে বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে। সে বাতাস চোখে দেখা যায় না। কিন্তু গায়ে লাগে। বহু বছর পরে সাইকেল চালাচ্ছি। ব্যালান্সে ভর করে। বাস রাস্তায় গিয়ে জমা রেখে প্রাইভেট বাসের দরজায় ঝুলি। নয়তাে মিনিবাসে লাদাই হয়ে দিব্যি কার্জন পার্কের গায়ে গিয়ে পৌছলে কন্ডাক্টর খালাস করে দেয়।
এইভাবেই জীবন চলে যাচ্ছিল। পাতাল রেল, অটো, রিকশ মিলিয়ে দুপিঠে মােট আঠারাে টাকার জায়গায় যাতায়াতে ছ-টাকাও লাগছে না। গাদাগাদি, ঝুলােঝুলিতে শরীরের খানিকটা ব্যায়ামও হয়ে যাচ্ছে। এর ভেতর একশাে পয়সা কখনও একটাকা কুড়ি পয়সা হচ্ছে—আবার আশি পয়সায় নেমেও আসছে। এরই নাম বােধহয় জীবনের লবণ।
এই লবণ দিয়ে—যাতে কিনা খানিকটা পয়সা বাঁচানাে, দরাদরি, যাচাই মিশে থাকে—তাই দিয়ে জীবন করে যাচ্ছি। গরম লাগলে পাখা চালাই। ঠান্ডা লাগলে চাদর নামাই। আকাশে মেঘ দেখলে ছাতা বের করি। দোকান থেকে দেখে-শুনে ভালাে ফ্লেবারের চা কিনি। আর বাড়ির সামনে আখেচড়া একটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি। ঢােলকলমির বুনাে ঝাড় দিয়ে বাড়িটার বাউন্ডারি এবড়াে-খেবড়াে ভাবে জানান দিচ্ছে। রাস্তা থেকে রান্নাঘর দেখা যায়। সে জানলায় একটি বউ হাতা-খুন্তি নাড়ে। একটি বাচ্চা মেয়ে টিউবয়েলে জল ঘাঁটে। চট্টরাজ গার্ডেন্সে এসেছি মাস কয়েক। বেশ লাগে নতুন জায়গাটা।। সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেলটা আমায় অনেক জায়গায় নিয়ে যায়। চারশাে পঁচিশ টাকায় কী অবাধ স্বাধীনতা। আর বছর দুই বাদে রিটায়ার করলে এখানেই জায়গা কিনে থিতু হব ভাবছি।
এর ভেতরে সামনের সেই বাড়িটা থেকে একদিন একটা বুড়ােটে ছেলে বেরিয়ে এসে বলল, সরলদা, আপনার সাইকেলটা দিন তাে। গড়ে থেকে চালটা নিয়ে আসি।
অবাক হলাম। আপনি আমায় চেনেন? আমায় আপনি বলছেন কেন? আমি তাে চিত্ত। সুইস পার্কের চিত্ত নিত্য দুই ভাইকে মনে নেই আপনার? আমি সেই চিত্ত।
প্রায় তিরিশ বছর আগে পুরনাে যেসব পাড়ায় থেকেছি সেখানে হাতড়াতে হাতড়াতে চিত্তকে পেয়ে গেলাম। কালাে মতাে দুই ভাই—আমাদের চেয়ে বছর দশেকের জুনিয়র-ক্যারাম খেলে, রেশন আনে, কলেজে পড়ে—সবই মনে পড়ে গেল।
তুমি সেই চিত্ত? হা। এই তাে আমার বাড়ি। এই বাড়িটা। হ্যা। আমি তাে রােজ তাকিয়ে থাকি। ওই তাে টিউবয়েলে আমার বউ মেয়েকে চান করাচ্ছে। এখানে বাড়ি করেছ কতদিন? তা সাত বছর হয়ে গেল। একদম কর্নার প্লট পেয়েছ।
হা। ছ-কাঠা। এগারশাে টাকা করে কাঠা কিনেছিলাম—বছর দশেক আগে। এখন তাে প্রায় লাখ টাকা কাঠা।
শস্তায় পেয়ে গেছ।
বলছি আর ভাবছি–চিত্ত তাে না হােক পঞ্চাশ হয়েছে।
পাজামার ওপর পাঞ্জাবি। মাথার চুল পাকছে। চোখে চশমা। পায়ে স্যান্ডেল। বেশ ছিপছিপে চিত্ত বলল, চট্টরাজমশাই নিজে জমিটা কিনিয়ে দিয়েছিল। আরও দিতে চেয়েছিল চার কাঠা। নিইনি। নিয়ে রাখলে খুব কাজের হত।
তা তাে হতই। দশকাঠা মানে দশ লাখ টাকা। প্রমােটাররা আবার সাধে সরলদা। জায়গাটা দিন। থাকার জন্যে দুটি ফ্ল্যাট ফ্রি। দিলে পার। দাও না কেন? দিলে ফ্ল্যাটে বন্দি হয়ে যাব। কোনও স্বাধীনতা থাকবে না। চট্টরাজ তােমার ভালাে চাইতেন। সবাইকে তিনি চিনিয়ে দিতেন সরলদা— তাঁর নামেই চট্টরাজ গার্ডেন্স। মানী লােক ছিলেন নিশ্চয়—
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেই চিত্ত বলল, না না সরলদা। চট্টরাজ তাে জমির দালাল ছিল। সবাই যা তা বলত তাকে পেছন ফিরলেই
জমির দালাল? দালালের নামে গার্ডেন্স ?
হ্যা, জমি কেনাবেচার ব্যবসা করত লােকটা। খুব মিষ্টি কথা বলত। একশাে-দুশাে টাকায় কাঠা কিনে হাজার বারােশােতে বেচে দিত।
একশাে-দুশাে ? হা। তখন তাে এদিকে কেউ আসত না। দিন। সাইকেলটা দিন।
সাইকেল নিয়ে চলে গেল চিত্ত। ঘন্টা দেড়েক পরে একবস্তা চাল চাপিয়ে সাইকেল নিয়ে ফিরল। ফিরে বলল, চালটা কিনে রাখি একবারে। কিলােতে তিরিশ-চল্লিশ পয়সা শস্তা পড়ে।
বস্তা বয়ে আনার ধকলে আমাকে সাইকেলে টাল–মাডগার্ড সারাতে হল আড়াই টাকা দিয়ে।
চিত্তর বউ চিন্তা। সে ডালের বড়া ভাজলে আমায় দেয়। সজনে ফুলের চচ্চড়ি রাঁধলে আমায় বাটি ভরে পাঠায়। আমি কখনও তাকে তুমি বলি।
কখনও তুই বলি।
চিত্ত আমায় বলে, দাদা।
ওকে আপনি একবার বলুন তাে বাড়িতে একটা গেট লাগানাে দরকার। আমি চিত্তকে বলি, লােহার গেট লাগাও চিত্ত। চ্যাটাইয়ের ঝাপ চোরে কাটবে। ছাদের টালি সরিয়ে করগেট দাও অন্তত।
চিত্ত বলে, এই দেব সরলদা। আগের বউ সবে ক্যান্সারে মারা গেল। মােটে পাঁচ বছর হল। সব খরচের ধাক্কা সামলে উঠতে—
চিন্তা তােমার দ্বিতীয় বউ? | হা, ওর দিদির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তার তাে পেটেই বাচ্চা মরে গেল। আছাড় খেয়ে। মরে গিয়ে ভেতরে ছিল অনেকদিন। ভাগ্যিস বের করা গেল। কিন্তু ততদিনে ইউটেরাসে ক্যান্সার।
মাঝখানে শীত চলে গেল ভাব দিয়ে শীত আবার ফিরে এল। এ ফেরা একেবারে জাঁক দিয়ে ফেরা। হি হি কঁপুনি। তার ভেতরে খালি গায়ে বিধবা বুড়িরা থােড়, মােচা, শাক পাতা নিয়ে বেচতে বসে। চার আনায় এক আঁটি মেথি শাক। পঞ্চাশ পয়সায় এক আঁটি কচি নিমপাতা। ভাবি—এমন কচিপাতা তাে ডালের একদম ডগায় থাকে। বুড়িরা পাড়ে কী করে? | চিন্তাদের বাড়ি গেছি। গিয়ে জানতে চাইলাম, ডালে সম্বরা দিয়েছ। বড়াে ভালাে গন্ধ বেরােচ্ছে—
খাবেন একটু দাদা? দেবড়াে ভালাে ডাল।
হ্যা, ডালটা ভালাে। চিত্তদা ইনকাম ট্যাক্সের কো-অপারেটিভ থেকে ডাল, মশলা নিয়ে আসে।
ওখানে কাজ করে?
তাে। চিত্তদার তাে অন্য অফিস। বিবাদি বাগে। আর এ ডাল, মশলা সব আনে শ্যামবাজারে আয়কর সমবায় থেকে—কার একখানা সমবায় কার্ড পায়—তাই দেখিয়ে সারা মাসের সওদা বয়ে বয়ে আনে। মনে মনে ভাবি–কোথায় বিবাদি বাগ—কোথায় শ্যামবাজার। মুখে বলি, তুই স্বামীকে চিত্তদা ডাকিস কেন?
অভ্যেস যাবে কোথায়! আগে যখন জামাইবাবু ছিল তখন যে চিত্তদা ডেকে এসেছি। সেই অভ্যেসে। ও এমনিতে পরিশ্রমী আছে। এই দেখুন না—সাবান, সর্ষের তেল, আটা—সব আনে খিদিরপুর থেকে।
খিদিরপুর থেকে?
হা। সব জাহাজি মাল। খুব সেরা জিনিস। কিন্তু ঘটে বুদ্ধি নেই। কেন? কেন? রােজ রাতে অফিসের পর আলাে জ্বালিয়ে খাতা লেখে। তাতে দুটি পয়সা হয়।
এত খাটে কেন? কার জন্যে খাটে?
আমিও বুঝি না। ভালাে অফিসে ভালাে মাইনে পায়। নিজেদের বাড়ি। বাড়ি ভাড়ার বালাই নেই। খেটেখুটে কোথায় মানুষ একটু সুখ করে। তা নয়। অফিসের পর খাতা লেখে। অ্যাকাউন্টসের খাতা ঠিক করে দেয় নানান কোম্পানির। তাতে মােটা টাকা পায় ফুরনে। অথচ দিদির ক্যান্সারের চিকিৎসা করল কবিরাজি বড়ি দিয়ে—
কবিরাজি বড়ি দিয়ে ? হা। স্রেফ বড়ি আর সেঁকতাপ অত টাকা কী করে? জায়গা কেনে। অন্তত চার-পাঁচটা প্লট কিনে রেখেছে। তার ভেতর একটা তাে বেদখল হয়ে গেল।
এত জমি দিয়ে কী করবে চিত্ত? দাম বাড়লে বেচে দেবে।
তার আগে যে বেদখল হয়ে যাবে। তারপর শহর সম্পত্তি আইনে তাে অত জায়গা একজন শহরের ভেতর রাখতে পারে না। সরকার নিয়ে নেবে।
অতসব বুঝি না দাদা। তবে নানান নামে রাখছে। আপনার কথা শােনে। একবার একটা টেবল ল্যাম্প কিনতে বলুন না। রাতে বড়াে আলাে জ্বালিয়ে খাতা লেখে। ঘুমােতে পারি না চড়া আলােয়।
তাের না আবার বাচ্চা হবে? হ্যা।
তাের তাে ঘুমের দরকার।
তা কী বােঝাে চিত্তদা! এই যে মেয়েটার তিন বছর হল। তাকে একটু কোলে নেয় ? একখানা বিস্কুট কিনে হাতে দেয় ? কখনও না। ভুলেও দেয়—
সেদিন রিকশর পয়সা বাঁচিয়ে অতটুকু মেয়েকে গড়ে থেকে হাঁটিয়ে এনেছে। শেষে কচি কচি পা ফুলে ঢােল। কোথায় জায়গা শস্তা। কোথায় ডাল শস্তা। লুঙ্গি শস্তা। তাই কিনতে ছুটছে চিত্তদা। শ্যামবাজার, খিদিরপুর, ডানলপ। হয় আপনার—না হয় অন্য কারও সাইকেল নিয়ে। গাড়িভাড়া যতটা পারে বাঁচায়। ঘটে বুদ্ধি থাকলে তাে!
বুদ্ধি আছে। তবে অন্য দিকে। হা দাদা। অন্য দিকে। কীসে দুটি পয়সা সাশ্রয় হয়। কীসে আয় দেয়। চিন্তার মুখে তাকালাম। মুখখানি শুকনাে। চোখ কোটরে। পেটটা ফুলে উঠেছে। কাঠি কাঠি হাত। মুখে বললাম, আচ্ছা বলব—বলে মনে হল, চিন্তার বুদ্ধিটা একদম বােকার বুদ্ধি।
চিত্তকে ধরা কঠিন। তা ছাড়া এত বছর পরে দেখা। ও একজন আলাদা মানুষ। আমিই বা কীভাবে ওর ব্যাপারে নাক গলাই। আবার অগােছালাে বাড়িটার সামনে সন্ধের সময় চিন্তাকে একা পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনও খারাপ হয়। আহা! এর জন্যে কিছু একটা করা দরকার। বাঁ-হাতে মেয়েটাকে ধরে চিন্তা দাঁড়িয়ে। বাড়ির সামনের উঠোনে বসানাে মানকচুর বিরাট পাতার সামনে রঙিন কাচপােকা শব্দ করে উড়ছে। চিন্তার পেটটা ফোলা ফোলা। হাত দুখানি কাঠি কাঠি। এই সময় বিশ্রাম—ভালাে খাবার দরকার। আর চিত্ত দুহাতে আয় করে জমি জায়গা কিনে চলেছে। একটার পর একটা।
ফাল্গুন পড়তেই বঙ্গোপসাগর থেকে এক আহামরি বাতাস ক-দিন ধরেই কলকাতার ওপর এসে ঝাপিয়ে পড়তে লাগল। কী মূর্তি বাতাসটার। লাখ লাখ গেরস্থবাড়ির দরজা জানলা দরাম দরাম করে ধাক্কা মেরে খুলে দিচ্ছে। রাস্তা থেকে ধুলাে উড়িয়ে নিয়ে যখন তখন ঘূর্ণী তুলছে। এর ভেতর দেখি চিত্ত মাথার চুল সামলাতে সামলাতে বাড়ি ফিরছে। আমায় দেখে বলল, সরলদা। কালীতলার ওপর দিয়ে শুনেছিলাম একটা বড়াে রাস্তা যাবে বাইপাসের দিকে। আদৌ যাবে কিনা আপনি একটু জেনে দেবেন? অনেককে তাে চেনেন আপনি।
কালীতলা কাছেই। রােজ সেদিকে ইটের লরি যায়। অনেক বাড়ি হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই বললাম, না হয় রাস্তা গেলই। তাতে তােমার কী ?
প্রােপােজড রাস্তার গায়ে আমার তিন কাঠা কেনা আছে। চিত্ত। ক-জায়গায় তুমি থাকবে?
আমার কথা বলছি না। আরেকটা বাচ্চা তাে আসছে। সে বড়াে হলেওখানে যদি একটা বাড়ি করা থাকে তাে–সেখানে থাকতে পারবে।
এই বাড়িটার কী হবে? আমার আর চিন্তার অবর্তমানে মেয়েই পাবে। আমি কোনও কথা না বলে চিত্তর মুখে চেয়ে রইলাম।
তারপর অনেকদিন চিত্তর সঙ্গে দেখা হয় না। কাজকর্মে চিত্তর কথা ভুলেই বসে আছি। বাসস্টপে চির সঙ্গে দেখা। আমায় দেখে বলল, চলুন প্রাইভেট বাসে যাই। ওরা টাইমলি পৌঁছে দেয়।
ইচ্ছে ছিল না—ভেবেছিলাম মিনিবাসের টার্মিনাসে গিয়ে বসে যাব। চিত্তর সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট বাসেই ভিড় ঠেলে উঠলাম। চিত্ত আমায় নিয়ে বাসের ঠিক মাঝখানটায় এসে মাথার ওপর হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়াল। দুই দরজায় দুই কন্ডাক্টর। তাদের কেউই ভিড় ঠেলে আমাদের নাগাল পাচ্ছে না। যেদিককার কন্ডাক্টরই আমাদের দিকে হাত বাড়ায় চিত্ত ঠিক তার উল্টোদিকে তাকিয়ে—
আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়।
ভবানীপুরের কাছাকাছি এসে বাসে লােক কমতে লাগল। কন্ডাক্টর দুজন দুদিক থেকে আমাদের ছুঁয়ে ফেলে প্রায়। চিত্তর রকমসকম দেখে আমি তাে কাটা হয়ে আছি। ওরই ভেতর এক ট্রাফিকে বাস দাঁড়িয়ে পড়তেই চিত্ত আমাকে একরকম টানতে টানতেই নেমে পড়ল। আর অমনি ট্রাফিক ক্লিয়ার পেয়ে দরজার কন্ডাক্টর আফশােসের ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে।
এটা কী হল চিত্ত? এরকমই তাে করতেই হয় দাদা বিরক্ত হয়ে বললাম, তুমি যা কর-কর। আমাকে আর কোনওদিন এভাবে জড়িয়াে না।
রাগ করছেন সরলদা? বলে ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে পড়ল চিত্ত। হিসেব মিলিয়েই আমায় চলতে হয়। কাল দু-বার মিনিবাসে উঠে বাসের চেয়ে দু-টাকা বেশি লেগেছে টিকিট কাটতে। তার একটা টাকা আজকের এই বাসে টিকিট কাটলে লেগে যেত। ফেরার পথে আরেকবার বাসে উঠে টিকিট কাটতে না হলেই বাকি টাকাটাও উসুল হয়ে যাবে বুঝব।
আপত্তি করে উঠি, কী বলছ চিত্ত? কাটতে না হলে কোথায় ? তুমি তাে কাটছ না।
ওই একই হল সরলা।
তাই কী ? তাহলে যেদিন বাস-মিনিবাসে উঠতে না পেরে ট্যাক্সি নিতে খুব দরকারে বাধ্য হও—সেদিন? | সময়ে সময়ে ট্যাক্সি নিতে তাে হয়ই। তখন চার-পাঁচদিন ধরে একটানা এভাবেই যাবার জায়গাগুলােয় বাসে উঠি-ফেরার জায়গাগুলােয় এভাবেই বাস ধরে পৌছে যাই।
তার মানে টিকিট কাটতে না হলেই ট্যাক্সি ভাড়ার টাকাটা খেপে খেপে উশুল হয়ে যায়।
ভিড়ের রাস্তায় হাে হাে করে মহাখুশিতে হেসে উঠল চিত্ত। বলল, আপনি তাে সরলা আমার ভাষায় কথা বলছেন! আপনার বলা উচিত—যে টাকাটা ট্যাক্সি ভাড়ায় গেছে টিকিট না কেটে সেটা বাঁচিয়ে তােল চিত্ত।
আমি কথা বলতে পারছি না। সারা রাস্তা জুড়ে মানুষের ভিড়। সবাই যে যার নিজের নিজের ধান্দায় বুদ হয়ে আছে। যে যার অঙ্কে অঙ্ক মিলিয়ে যাচ্ছে।
চিত্তর যে কত অঙ্ক। সে নিজেই বলল, ধরুন, বাঁশদ্রোণী থেকে ট্যাক্সিতে দেশপ্রিয় পার্ক গেলাম। বাধ্য হয়েই গেলাম। ভাড়া দিতে হল বাইশ টাকা। দিলাম। আবার তখনই দেশপ্রিয় পার্ক থেকে ঢাকুরিয়ার মিনিতে কার্জন পার্ক গেলাম। ভাড়া দিলাম না। তখন কিন্তু ভাবব, ট্যাক্সিতে দেশপ্রিয় থেকে কার্জনে গেছি। তার মানে তিরিশ টাকার মতাে ট্যাক্সি ভাড়া বাঁচল। তাহলে তিরিশ থেকে বাইশ বাদ দিয়ে হাতে থাকল আট টাকা। সেই আট টাকা কিন্তু আমার কাছে রিয়াল। আমি তখন স্বচ্ছন্দে বাসের ভাড়ার মতাে খরচ করতে পারি। তখন আমি বাসে খেপে খেপে মােট আট টাকা সত্যিই ভাড়া দেব।
আমি তাকিয়ে আছি চিত্তর মুখে।