মানভঞ্জন পালা
নারী প্রগতির এই সাংঘাতিক স্তরে, আধুনিকাদের মনে ফসিলের মতো প্রাচীন কিছু পদার্থ জমে আছে; তার মধ্যে একটি হল রাগ। কারণে অকারণে, ফায়ার হয়ে যাওয়া। কথায়-কথায় রাগ। মেয়েলি রাগের গোটাকতক বিশেষ ধরনের বহি:প্রকাশ আছে। যেমন, বেগে প্রস্থান। এই প্রস্থানকে গ্রাম্য ভাষায় বলা হয় ফড়কে চলে যাওয়া। একটি ঘটনা সহযোগে দৃশ্যটি তৈরি করা যাক। অফিস থেকে অশোক বাড়ি ঢুকছে। ক্লান্ত, শ্রান্ত, ধুলো ও ধোঁয়ায় মেরোব্বা। বগলে খুব ভালোভাবে প্যাক-করা একটা কাগজের বান্ডিল। দরকারি এক গাদা কাগজ। প্যাকেটটা এমনভাবে করা হয়েছে, যেন শাড়ির প্যাকেট। অশোকের স্ত্রী অশোকা প্যাকেটটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খোলার চেষ্টা করতে লাগল। অশোক তার অকারণ শ্রম বাঁচাবার জন্যে ভালো মনেই বললে, ‘হেঁ হেঁ, ওতে কিন্তু শাড়ি নেই।’
ওই হেঁ হেঁ-টাই কাল হল। অশোকা অমনি প্যাকেটটা দুম করে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। এই যে প্রস্থান, এর একটা বিশিষ্ট ধরন আছে। তখন আর পায়ের চাপ আঙুলের ওপর আলতো থাকে না। গোড়ালির খেলা চলতে থাকে। যারা তবলা বাজান, তারা জানেন, হাতের চেটোর গোড়ার দিকটা ব্যবহার করে বাঁয়াতে সময়-সময় একটা কাজ করা হয়, যাকে বলে গুপো। তখন মেয়েদের চলনে ওই গোড়ালির গুপোর কাজ। দোতলার ফ্ল্যাটে হাঁটলে একতলার বুড়ো কর্তা খাটে শুয়ে বুঝতে পারেন, একটা কিছু হয়েছে। মা আমার বজ্রগামিনী। এই-যে ফেলে দেওয়া, এই ফেলার সময় কোনও হিসেব, কোনও ভবিষ্যৎ চিন্তা থাকে না। ছুঁড়ে ফেলে, হঠাৎ হাত থেকে ছেড়ে দেওয়া, মেয়েদের বিশেষত্ব। কত ছেলে যে এইভাবে মেয়েদের প্রেমের হাত খসে পড়ে গেছে।
রমা একবার তাজমহল ভেঙে ফেলেছিল। আগ্রা থেকে অসিত একটা সুন্দর তাজমহলের মডেল কিনে এনেছিল। সেই তাজমহলটি উপহার দিতে এসেছিল রমাকে। রমার স্বামী রমেন দোষের মধ্যে বলেছিল, ‘খুব সাবধান। তোমার আবার হাত ভীষণ আলগা।’ ব্যস, ওই এক কথাতেই তাজমহল র মেটিরিয়ালের পর্যায়ে চলে গেল। হয়ে গেল, হায় সাজাহান। এই রইল তোমার তাজমহল। বারমহল থেকে রমার সবেগে অন্দরমহলে প্রস্থান। সেই তাজমহল একটা বেতের ঝুড়িতে পড়ে আছে শতটুকরো হয়ে। রমেন রিটায়ার করে আধুনিক আঠা দিয়ে জুড়ে, যাওয়ার আগে স্ত্রীকে প্রেজেন্ট করে যাবে। এইরকম একটা বাসনা আছে। যদি না ছানি পড়ে মডেল সাজাহানের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়।
সবেগে প্রস্থান হল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বজ্রবিদ্যুৎসহ দু-এক পশলা হবেই হবে। রান্নাঘরে জিনিসপত্রের দুমদাম পতন। ধারালো বাক্য-বিনিময়। এর মধ্যে একটি কথা অতি প্রাচীন—প্রায় প্রবাদের মতো, ‘হাঁড়ি ঠেলার জন্যে এসেছি, ঠেলে ঠেলেই ঘাটে যাব। পিঞ্জরের পক্ষী। না আছে কোথাও একটা যাওয়া, সেই আইবুড়ো বেলার একবার জব্বলপুর গিয়েছিলুম। সেই সময় বুদ্ধি করে একটুকরো মার্বেল পাথর খুলে আনলে একটা মেমোরিয়াল হত।’
ওই মুহূর্তে মেয়ে হয় তো জিগ্যেস করলে, ‘রাতে কী রান্না হবে, মা?’
‘আমার পিন্ডি।’
এরপর অবধারিত যা হবে, খাওয়া বন্ধ। মহাত্মাজি অনশন করতেন দেশের জন্যে। রাগের কারণে অনশনে মেয়েদের রেকর্ড কে ম্লান করবে। এক সপ্তাহের হিসেবে দেখা যাবে অবধারিত অনশন থেকে ফিরে এলেন অন্তত তিন দিন। সকলের সব খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল, তিনি কোঁত কোঁত করে এক গেলাস জল খেলেন। এই জল খাওয়ার শব্দ শুনে অভিজ্ঞ স্বামী বুঝতে পারেন, এটা নর্মাল খাওয়া নয়। গোলমেলে খাওয়া। এই জল, নাকের জল চোখের জল করে ছাড়বে। মেয়ে জিগ্যেস করলে, ‘মা তুমি খাবে না?’
‘আমার খাওয়া হয়ে গেছে।’
‘কী খেলে?’
‘এ বাড়িতে যা খেতে আসা—ঝ্যাঁটা।’
খাদ্যত্যাগের সঙ্গে-সঙ্গে আর একটি জিনিস ত্যাগের সম্ভাবনাও প্রবল, সেটি হল শয্যাত্যাগ। বিছানা রইল খাটে, মেঝেতে ঝপাস করে যা হয় একটা কিছু বিছানো হল, তারপর বিনা বালিশে কাটা কলাগাছের মতো ধড়াস। এইবার যার ম্যাও, সেই হুলো সামলাক। ছেলেদের রাগে ঘুম চটে যায়, মেয়েদের রাগে ঘুমে একেবারে কাদা। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। একজনের চোখে ঘুম নেই। তিনি অবশেষে রাত দেড় ঘটিকার সময় খাট থেকে নেমে এলেন, ‘কী হচ্ছে, কি? চলো ওঠো’।
যাকে বলা, তিনি এপাশ থেকে ওপাশে উলটে গেলেন, গঙ্গার ভরা ভাদরের ঢেউয়ের মতো। যার ম্যাও তার ভয় মেঝের ঠান্ডা একবার বুকে বসে গেলে হয়ে গেল। ডাক্তারে চকোলেট খেয়ে যাবেন। দিলীপকুমার যেমন সায়রাবানুকে দুহাতে পাছমোড়া করে তুলে, তিন রাউন্ড নেচেছিলেন, সেইভাবে তুলে খাটের দিকে নেচে নেচে এগিয়ে যাওয়ার সাহস হয় না। সেই শক্তি কোথায়? কোমর মটকে গেলে কে দেখবে? তখন দুহাত ধরে তোলার চেষ্টা। বোনলেস প্ল্যাস্টিক বডি যেন। একটু উঠেই ল্যাদ করে ধেসকে পড়ে। তখন মনে হয়, কী প্যাঁচেই পড়া গেল।
ভাগ্য ভালো, আজকাল পরিবারে পরিবারে ঘরের সংখ্যা কম। যে সব পরিবারে ঘর বেশি, কী ছাদের ঘর আছে, সেইখানে হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে একবার যদি খিল দিয়েছেন, তো নিজের খিল খুলে যাওয়ার জোগাড়। মহা দুশ্চিন্তা। পাখার ব্লেডে ঝুলে পড়লে, সাত পাকের বদলে সাত বছর সশ্রম ডোরাকাটা জামা। বেশি জোরে ধাক্কা মারাও যায় না। পাড়া জানাজানি হয়ে যাবে। দরজায় আঁচড়া আঁচড়ি। করুণ প্রার্থনা, ‘দেবি। সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে, ত্রিভুবনতারিণী, তরল’ হয়ে বেরিয়ে এসো দেবী।
শ্রীকৃষ্ণের ডায়েরিটা যে হারিয়ে গেল; তা না হলে দেখা যেত লেখা আছে, এক রাধাতে আমার বারোটা বাজালে। সারাটা জীবন মানভঞ্জনেই কেটে গেল। বাঁশি ফুঁকে ফুঁকে লাংসে ছেঁদা হয়ে গেল। পায়ে যত তেল মর্দন করেছি, সেই তেলে কলকাতার তৈল-সমস্যা এক বছরের মতো সমাধান করে বামফ্রন্ট সরকারের হাত শক্ত করা যেত। রাধার জন্যে নিজের সংসারের দিকে নজর দেওয়া হল না। ডিসগাস্টেড হয়ে যুদ্ধে গেলুম। যদুবংশ বখে গেল। শেষে অপঘাতে মৃত্যু। অনেক আগেই গাছের ডাল ভেঙে যমুনার জলে পড়ার কথা। বস্ত্রহরণ করেছিলুম গলায় বেঁধে ঝুলব বলে। যাক, আমার জীবন যায় যাক। মানভঞ্জন পালা লিখে আর গেয়ে মানুষ টু-পাইস কামাচ্ছে।