০১-০৫. মানব-চিত্তের তৃপ্তি

মানব জীবন – ডা. লুৎফর রহমান

০১. মানবচিত্তের তৃপ্তি

মানব-চিত্তের তৃপ্তি অর্থ, প্রাধান্য; ক্ষমতা এবং রাজ্যলাভে নাই। আলেকজাণ্ডার সমস্ত জগৎ জয় করেও শান্তি লাভ করেন নাই। মানুষ অর্থের পেছনে ছুটছে–অপরিমিত অর্থ দাও তাকে, সে আরও চাবে। তার মনে হয় আরও পেলে সুখী হবে। সমস্ত জগৎ তাকে দাও : তবুও সে সুখী হবে না। জাগতিকভাবে যারা অন্ধ, তারাই জীবনে সুখ এইভাবে খোঁজে। দরিদ্র যে, সে আমার জীবন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে ঈর্ষা করছে, সে আমার অবস্থার দিকে কত উৎসুকনেত্রে তাকিয়ে থাকে কিন্তু আমি নিজে কত অসুখী। পরম সত্যের সন্ধান যারা পায় নাই, মানব-হৃদয়ের ধর্ম কি, তা যারা বুঝতে পারে নাই–তারাই এইভাবে জ্বলে-পুড়ে মরে, এমন কি এই শ্রেণীর লোক যতই মৃত্যুর পথে অগ্রসর হতে থাকে, ততই এদের জীবনের জ্বালা বাড়ে। প্রতিহিংসা-বৃত্তি, বিবাদ, অর্থ-লোভ আরও তীব্রভাবে তাদেরকে মত্ত ও মুগ্ধ করে। তখনও তারা যথার্থ কল্যাণের পথ কী, তা অনুভব করতে পারে না। জীবন ভরে যেমন করে সুখের সন্ধানে এরা ছুটেছে, মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও তেমনি তারা সুখের সন্ধান করে–পায় না, এই পথে মানুষ সুখ পাবে না। ক্রোধে তারা চিৎকার করে মানুষকে তারা দংশন করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের দুখী, আহত-ব্যথিত মন নিজের দেহ এবং পরের অন্তরকে বিষাক্ত করে। বলতে কী, মানুষ জাগতিক কোনো সাধনায় সুখ, আনন্দ এবং তৃপ্তি পাবে না। এই পথ থেকে মানুষকে ফিরতে বলি; সমস্ত মহাপুরুষই এই কথা বলেছেন। মানুষ তার জীবনকে অনুভব করতে পারে নাই; শয়তান মানুষ–চিত্তকে ধর্মের নামে ভ্ৰমান্ধ করেছে।

সত্যের সাধনাই মানব হৃদয়ের চরম ও পরম সাধনা। পরম সত্যকে দিনে দিনে জীবনের প্রতি কাজের ভিতর দিয়ে অনুভব করাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সাধনা। কত বিচিত্রভাবে তাকে অনুভব করতে হবে তার ইয়ত্তা নাই। যিনি যতটুকু এই পরম সত্যকে অনুভব করতে পেরেছেন তিনি তত বড় সাধক, সন্ন্যাসী এবং ফকির। জগতে যা কিছু কর, যত কাজেই যোগ দাও, পরিবার প্রতিপালন কর, শিশুর মুখে চুম্বন দাও–মানব-চিত্তের এই একমাত্র গুরুতর সাধনা ও আকাক্ষা এর মধ্যেই প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সত্যময় আল্লাহতায়ালাকে হৃদয়ে ধারণ করা, তাতে মিশে যাওয়া, আল্লাহময় হয়ে যাওয়া–সর্বপ্রকারের সত্য, সুন্দর, মধুর ও পূর্ণ হয়ে ওঠা–এই-ই চরম এবাদত।

আত্মার এই সিদ্ধির জন্যই ধর্মের যাবতীয় বিধি-বন্ধনে মত্ত থাকলে এবং তাকেই চরম মনে করলে মানবাত্মা বিনষ্ট হবেই!’হাজার নিয়ম পালন ও রোজা উপাসনায় তাকে উন্নত ও উজ্জ্বল করতে পারবে না। জীবনকে আল্লাহর রঙে রঙিন করে তুলতে হবে, সমস্ত চিন্তা, কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে সেই সত্য সুন্দর ও সুমহানের গুণকে প্রকাশ করতে হবে।

.

০২. আল্লাহ্

বহুদিন আগে এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম–’আল্লাহ্ কী? তিনি বললেন, আল্লাহ অনন্ত–তাঁকে কেউ জানে না।’

‘আল্লাহ’র এই ব্যাখ্যা মানুষের পক্ষে বিন্দুমাত্র আশার কথা নহে। ‘আল্লাহ্ অনন্ত’ শুনে আমাদের মন বিন্দুমাত্র বিচলিত ও চঞ্চল হয় না। এই ব্যাখ্যা ব্যাখ্যাই নয়। বস্তুত আরও অনেকে আল্লাহর ব্যাখ্যা অনেক কথায় দিয়ে থাকেন, তাতে আল্লাহর পরিচয় মানুষ একটুও। পায় না-মানুষ বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে ওঠে।

এই জগৎ, এই অনন্ত সৃষ্টি, অনন্ত জীবনের উৎস যিনি আছেন এবং থাকবেন–যিনি চিরসত্য, যিনি সর্বব্যাপী, যিনি আমাতে আছেন, যিনি আমাকে ভালবাসেন, প্রেম করেন, আমার সঙ্গে খেলা করেন, পথে পথে ঘুরে বেড়ান, আকাশে যার বাঁশি বাজে, হাম্বারবে যার অফুরন্ত প্রেম উছলে উঠে, যিনি মাতৃহারা শিশুর আর্তকণ্ঠে বিশ্বকে মা বলে ডাকেন–আমি। তাঁকে দেখতে চাই, পেতে চাই, হৃদয়ে ধারণ করতে চাই।–ঝড়ের দোলায় তার ভীষণ হাস্য বাজে, বজ্রনিনাদে তার শঙ্কা ধ্বনিত হয়।অনন্ত সৃষ্টি তিনি বুকে ধারণ করে আছেন, তিনি নর-নারীর অঙ্গশ্রীতে লীলায়িত হন, গানের সুরে তিনি ক্রন্দন করেন–সেই অশ্রুর দেবতাকে আমি দেখতে চাই–অনন্ত আকাশে, নিথর রাতে তার ক্রন্দন শুনেছি, মুগ্ধ নির্জন প্রান্তরে তাঁর শোক বাতাসে বয়ে এনেছে, তাকে পাবার জন্যে মানব-চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ছুটছে। আমি তাকে পেতে চাই, তাঁকে চুম্বন করতে চাই। মানব-চিত্তের চির-প্রেয়সীর অঞ্চল ধরে অনন্ত সোহাগে আমি বাসরের আনন্দ অনুভব করতে চাই।

‘আল্লাহ’ কী? তাঁর কোনো সিংহাসন নাই, কোনো আসন নাই, রূপ নাই–অন্তরের সঙ্গে তিনি মিশে আছেন। সুন্দর, কল্যাণ এবং সত্যে তিনি আছেন। তোষামোদে তাঁকে পাওয়া যাবে না। তিনি আছেন ত্যাগে, সহিষ্ণুতায় এবং প্রেমে! তিনি রূপমুক্ত প্রেম, কল্যাণ এবং জীবন্ত সত্য। মনুষ্য যখন অন্যায়ভাবে আঘাত পেয়ে আঘাতকারীকে আশীর্বাদ করেছে, তখনই আমি তার রূপ দেখেছি। অসত্য ও অন্যায় দেখে মনুষ্য যখন লজ্জিত ও মর্মাহত হয়েছে, তখনই আমি তার রূপ দেখেছি। মনুষ্য যখন মনুষ্যের জন্য আঁখিজল ফেলেছে, তখনই আমি তাকে দেখেছি। জননী যখন শিশুকে বুকে ধরেছেন, তখনই আমি তাকে দেখেছি। বন্য পশু যখন সন্তানের স্নেহে ব্যাকুল অস্থির হয়ে গর্জে ছুটেছে, তখনই সেই রূপহীনকে আমি চোখের জলে দেখেছি। হে রূপহীন! তুমি ধন্য!–তোমার এত রূপ, কে বলে তোমার রূপ নাই? এতভাবে মনুষ্যকে তুমি ধরা দিচ্ছ–তবুও দেখলাম, তোমার রূপ সমস্ত গগন-পবনে ছড়িয়ে আছে, সমস্ত অবুঝ মনুষ্য বলে–তোমাকে দেখি নাই। প্রাতঃকালে যখন উঠলাম, তখন প্রকৃতিতে তোমার পায়ের নির্মল সুরভি লেগে আছে, সমস্ত দিন ভরে নিজেকে প্রকাশ করলে তবু বলি তোমার রূপহীন।

.

০৩. শয়তান

প্রভু! বীভৎস ঘৃণিত কুৎসিত মুখ আমি দেখতে চাই। আমার হাত তুমি ধর, আমি শয়তানের মুখ দেখবো–খুব ভালো করে তাকে দেখবো। শয়তান কেমন করে আমাকে মুগ্ধ করে, আমার শিরায় শিরায় প্রবেশ করে, আমাকে উদভ্রান্ত করে, আমাকে তোমার স্নেহ-মধুর পূত-নির্মল সহবাস হতে ইঙ্গিতে বিভ্রান্ত করে।

সমস্ত অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করতে চাই। তাকে দেখি নাই বললে চলবে না। তার ঘৃণিত, পৈশাচিক মুখ আমায় দেখাও, আমার দেহের অনুপরমাণু ঘৃণায় বিদ্রোহী হয়ে উঠুক, সমস্ত অন্তর দিয়ে আমি শয়তানকে ঘৃণা করতে চাই।

আমি অনেক সাধনা করেছি, অনেক রাত্রি তোমার ধ্যানে কাটিয়েছি আমার সমস্ত শরীর তোমার পরশ-পুলকে অবশ হয়ে উঠেছে; আমাতে আমি নাই–আমার নয়ন দিয়ে তোমার প্রেমের অশ্রু ঝরছে। পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা মুক্ত হয়ে তোমার প্রেমে ধন্য হয়েছি; অকস্মাৎ চোখের নিমিষে শয়তান এসে আমার সর্বনাশ করে গেল,–আমাকে এক মুহূর্তে, পাতালের গভীরতম কূপে ফেলে গেল, ক্ষণিকের লোভে মানুষের মাথায় বজ্রাঘাত করলাম, অন্ধকার নিশীথে পশুর নেশায় বারবণিতার সৌন্দর্যশ্রীতে ডুবে মরলাম, গোপনে লোকচক্ষুর অগোচরে কুকার্যে আসক্ত হলাম, মানুষের বৃদ্ধি-অনুভূতির অন্তরালে প্রতারণায় আত্মনিয়োগ করলাম। প্রভু, কে আমায় রক্ষা করবে? মানুষ আমার পাপ দেখে নাই, আমি একাকী দেখেছি, আমাকে শয়তান আমার সর্বনাশ করেছে। প্রভু,মানুষের অগোচরে আমায় দুর্জয় কর; শয়তানের কুৎসিত মুখশ্রী আমায় দেখাও।

পৃথিবীর যত পাপ–পৃথিবীর যত প্রতারণা, নীচাশয়তা, হীনতা, কাপুরুষতা তাই তো শয়তানের মুখ। সাধু সঙ্গ ত্যাগ করে শয়তানের মুখ ভালো করে দেখবার জন্য, পৃথিবীর সমস্ত কাপুরুষতা, সমস্ত মূঢ়তা, গোপন পাপ, নারী ব্যভিচার আজ আমি ভালো করে দেখতে চাই।

একটা দরিদ্র লোক জীবনভর কিছু টাকা উপায় করেছিল। একদিন এক নামাজিকে তার বাড়িতে গিয়ে গভীর রাত্রে পঞ্চাশটি টাকা হাওলাত করে আনতে দেখেছিলাম। নামাজি বিয়ে করতে যাচ্ছিল, খুব বিপদে পড়েই তাকে সেখানে টাকার জন্য যেতে হয়েছিল। পঞ্চাশটি টাকা সে চাওয়া মাত্র পেয়েছিল–কোনো সাক্ষী ছিল না, কোনো লেখা-পড়া দলিলপত্র হয় নাই। এই ঘটনা দেখেছিলেন শুধু আল্লাহ্ আর নামাজির অন্তর মানুষ। তারপর দশ বৎসর অতীত হয়ে গেছে। লোকটি মারা গেছে। তার বিধবা পত্নী নামাজির বাড়িতে হেঁটে হেঁটে হয়রান হয়ে এখন আর হাঁটে না। এই ব্যক্তিকে লোকে মুসলমান বলে, মানুষ তাকে ঘৃণা করে। তাকে অমানুষ বলে ধরবার কোনো পথ নাই। সে পাঁচটি ফরজই আদায় করেছে। কে তাকে কাফের বলবে? কিন্তু আমি দেখেছি তার মুখে শয়তানের বিশ্রী মুখ।

একজন কেরানি তার পত্নীকে খুব ভালোবাসতো। সারাদিন সে পোস্ট অফিসে গাধার খাটুনি খাটতো, আর তার মাঝে তার পত্নীর মুখোনি বুকে জেগে উঠতো। মাতাল যেমন মদ খেয়ে দুর্বল দেহটিকে সবল করে নেয়, সেও তার দুর্বল দেহটাকে পত্নীর মুখোনির কথা মনে করে সবল শক্ত করে নিত। পোস্ট অফিসের ভারী ব্যাগগুলি ধাক্কা মেরে সে দশ হাত দূরে ফেলে দিত।

সে যখন বাসায় ফিরতো বাজার থেকে এক গোছা গলদা চিংড়ি মাছ কিনে শিস দিতে দিতে বাড়ি আসত, পত্নীর হাতে সেগুলি দিয়ে প্রেমে তার মুখের পানে চেয়ে থাকত।

এক ছোঁকরা ঐ বাড়িতে আসত। কেরানি তাকে পুত্রের মতো স্নেহ করতো। তার বয়স আঠার বৎসর হবে। একদিন ছোঁকরার সঙ্গে ঘরখানি খালি করে পত্নীটি চলে এসেছিল–সে এখন পতিতা। রাস্তার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে হাসে। একদিন ঝগড়া করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখলাম–সেই পতিতার উজ্জ্বল দীপ্ত লোহিত মুখ। সেই মুখে দেখেছিলাম শয়তানের কুৎসিত মুখ-বীভৎস দৃষ্টি। হৃদপিণ্ডে আগুন জ্বলে উঠেছিল, আন্তরিক ঘৃণায় সেই স্থান ত্যাগ করলাম। আমার পাপচিত্ত ক্রুদ্ধ ঘৃণায় জ্বলে উঠেছিল। মহাপাপের মুখ দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম।

শয়তান! আমি তোমার মুখ আরও ভালো করে দেখতে চাই–প্রভুকে যেমন করে দেখছি, তোমাকেও তেমন করে দেখতে চাই–অনন্তভাবে আমি তোমার ঘৃণিত কুৎসিত নগ্ন ছবি দেখতে চাই। আমি সমস্ত প্রাণ দিয়ে তোমাকে ঘৃণা করতে চাই। ভালো করে তোমার মুখ আমায় দেখাও, আমি দুই হাত দিয়ে ভালো করে স্পর্শ করে তোমায় দেখতে চাই।

শমসের এবং হাসান দুই ব্যক্তি কথা বলছিলেন। শমসের বললেন–আপনি মহামানুষ, দেশসেবক, আপনার কাছে আমি চিরঋণী।, হাসান–জনাব, জীবন অনিত্য, কোনো সময় যাই, তার ঠিক নাই, আমার কাছে কৃতজ্ঞ হবার দরকার নাই।

শমসের বললেন–আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ, আপনি মহামানুষ।

অতঃপর হাসান সে স্থান থেকে চলে গেলেন। তার স্থান ত্যাগ করা মাত্র শমসের বললেন–এই ব্যক্তিকে আমি চিনিভারি শয়তান’। শমসেরের মুখে দেখলাম, কাপুরুষ নিন্দাকারী শয়তানের বীভৎস ছবি। শয়তানের হাত থেকে রক্ষা চাই। আমাদের এই সুপবিত্র মুখশ্রীতে শয়তানের মুখ ফুটে না উঠুক।

একটি বন্ধু আর একটি বন্ধুকে ভালোবাসতো। প্রথম বন্ধুটির গৃহে দ্বিতীয় বন্ধুটি প্রায়ই যেত। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো। একদিন দেখলাম দ্বিতীয় বন্ধু প্রথম বন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রথম বন্ধুর পত্নীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমালাপে মত্ত। শয়তানের মুখ দেখতে বাকি রইল না। শয়তানকে ভালো করেই চোখের সামনে দেখলুম।

একটি যুবক, সে বক্তৃতা করতো, এক সংবাদ-পত্রিকার সম্পাদক সে। এক বুড়ির বাড়িতে সে যেত। বুড়ি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত–স্নেহ করতো; এতটুকু অবিশ্বাস করতো না। বুড়ি উচ্চ-হৃদয় যুবককে গৃহে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো। বুড়ির একটি মাত্র অবলম্বন ছিল তার বার বৎসরের প্রিয় সন্তানটি, দেখতে বেহেশতের পরীবালকের মতো। এই যুবক বালকটিকে ভালোবাসতো; বুড়ি প্রাণ ভরে দেখতো তার পিতৃহীন সন্তানকে যুবক ভালোবাসে, স্নেহ করে। প্রাণভরে সে যুবককে আশীর্বাদ করতো। একদিন যুবক এই শিশুর পবিত্র মুখে গোপনে চুম্বন করলো। সুকুমার স্বর্গের শিশুটি যুবকের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে শিশুকে যুবক পাপের পথে আকর্ষণ করলো। তার সোনার হৃদয়-কুসুমে পাপের হলাহল ঢেলে দিল। বুড়ির নয়ন-পুত্তলির সর্বনাশ হয়ে গেল। বুড়ি তা জানতে পারলে না। তার সাজান বাগানে যুবক আগুন ধরিয়ে দিল। এখন দেখি বুড়ি অন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় সে ভিক্ষা করে। তার সোনার যাদুটি মারা গেছে। শিশুটি ধীরে ধীরে পাপের পথে অগ্রসর হতে থাকে, তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, বিবিধ রোগে সে ভেঙ্গে পড়ে, সে মদ, গাঁজা, ভাঙ্গ খায়, পরে সে জেলে যায়, সেখানেই মরে। সেই সম্পাদক যুবককে কেউ জানে না, তাকে মানুষ নমস্কার করে। নিকটে এলে আসন এগিয়ে দেয়। অনেক টাকা তার। আমি তার মুখ দেখলে ভয় পাই। সম্মুখে সাক্ষাৎ শয়তান দেখে শিউরে উঠি।

এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির গৃহে তার সেয়ানা মেয়েটি থাকতো। মেয়েটির স্বামী বিদেশে থাকে। ভদ্রলোকের বাড়িতে তার এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয়ও থাকত। দেখলাম, একদিন সেই আদরের মেয়েটি সেই যুবকটির সঙ্গে গোপনে গোপনে আলাপ করছে। মেয়েটির মা বোনেরা তা জানে, জাতি যাবার ভয়ে কথা বলে না। নির্জন কক্ষে এই দুটি বিশ্বাসঘাতক নর-নারী কথা বলে, এক সঙ্গে খায়।

যুবকটি ভয় করে, অনিচ্ছা প্রকাশ করে; বিবাহিতা অবিশ্বাসিনী যুবতীটি তাকে বলে–কোনো ভয় নাই।

দুই বৎসর পরে দেখলাম, এক জায়গায় এক বাবুর গৃহিণীরূপে এই বালিকাটিকে। বাবু পরম বিশ্বাসে পত্নীর সঙ্গে প্রেমালাপ করছেন, পত্নীও স্বামীর সঙ্গে আনন্দে কথা বলছে।

এই দৃশ্য দেখে শোকে আমার চোখ জলে ভরে উঠলো। শয়তানের এই অভূতপূর্ব কীর্তির ছবি চোখ দিয়ে দেখলাম। অসহ্য দুঃখে ভাবলাম, মানুষের অত্যাচার এবং মূর্খতা-অবিচার আর শয়তানের প্রাণঘাতী কীর্তি!

এক মহাজন এক ব্যক্তিকে বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। লোকটি একদিন মহাজনের সর্বনাশ করার জন্যে চালাকি করে ঘরে সিঁদ কেটে দুপুর রাতে কাঁদতে আরম্ভ করলো। লোকজন যখন জমা হল, সে কেঁদে বলল, তার সর্বনাশ হয়েছে–চোর তাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে, কী করে সে মহাজনকে মুখ দেখাবে?’ প্রাতঃকালে সে মহাজনকে টেলিগ্রাম করল। থানার কর্মচারীর সঙ্গে রাত্রে গোপনে সে দেখা করল। চুরি যে ঠিক হয়েছে এবং সে যে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তা প্রমাণ হয়ে গেল। তার মিছে সর্বনাশের কেউ প্রতিবাদ করলো না। করতে কেউ সাহস পেল না।

এই নিমকহারাম বিশ্বাসঘাতক লোকটি সেই টাকা নিয়ে এসে বাটীতে মসজিদ-ঘর তুলো। সেই ঘরে বসে সে বন্দেগী করে। মানুষের মুখে তার প্রশংসা ধরে না; কত মানুষ তার গৌরব করে, কত মৌলবীর মুরুব্বি সে, কত ভদ্রলোকের বন্ধু সে। আমি তার মুখ দেখলেই ভয় পাই, তার মুখে কার বীভৎস মুখ দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠি। ঘৃণায় সে স্থান ত্যাগ করি।

চল্লিশ বৎসর পূর্বে এক ব্যক্তি রেঙ্গুনে গিয়েছিল; সেখানে গিয়ে সে একটি বালিকাকে বিবাহ করেছিল। সেই বালিকাটি এখন যুবতী। যৌবনের রূপ-ঐশ্বর্য দেখে তাকে ভোগ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে, সে প্রতারণা করে তাকে বিয়ে করেছিল। যখন তার পিপাসা মিটে গেল। তখন একদিন আসি’ বলে ঐ যে পালিয়ে এল, আর কোনোদিন সেখানে গেল না। সেই বালিকা যে কত বৎসর ধরে পথের পানে তার প্রিয়তমের আশায় চেয়েছিল, তা কে জানে? এই যুবক একজন ধার্মিক ভদ্রলোক। সমস্ত ধর্ম সাধনাই তার ব্যর্থ হয়েছে। প্রভু আর আমি জেনেছি সে কে!

এক ব্যক্তি মরে গেছে। সে যে বিপুল সম্পত্তি রেখে গেছে তার জন্য তার বংশের মর্যাদা দেশ জোড়া। সে ছিল এক জমিদারের নায়েব। জমিদার বিশ্বাস করে তার সম্পত্তি নায়েবের হাতে দিয়ে আনন্দ করে বেড়াতো। ধীরে ধীরে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে বিশ্বাসঘাতক নায়েব নিজেই জমিদার হল। তার এখন কত সম্মান, মানুষ তার নামে দোহাই দেয়, কত ইট পাথর তার বাড়িতে। কত বড় বড় প্রতিমা তার ঘরে উঠে। আমি তার বাড়ির সামনে গেলেই হাসি-শয়তানের ভণ্ডামি দেখে জ্বলে উঠি, শয়তান মানুষকে কত রকমেই না প্রতারণা করে। কে তার মুখ মানুষের মুখে দেখতে সাহস পায়?

সৌরভ, সমস্ত পরিচ্ছদ, সমস্ত সৌন্দর্যের সাধ্য নাই শয়তানের কুৎসিত মুখচ্ছবি ঢাকে। যে তা দেখেছে, সেই ভয় পেয়েছে।

.

০৪. দৈনন্দিন জীবন

জীবনের প্রতিদিন আমরা কত মিথ্যাই না করি, সেজন্যে আমাদের অন্তর মানুষ লজ্জিত হয় না। আল্লাহর কালাম পাঠ করি, কিন্তু সে কালাম আমাদের প্রতারণা, মিথ্যা ও অন্যায় হতে রক্ষা করে না।

পুটার্ক (Plutarch) বলেছেন, যে বড় যুদ্ধে জয় লাভ করে, তার মনুষ্যত্ব সূচিত হয় না। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি-রহস্য একটুখানি সহৃদয়তা, একটা স্নেহের বাক্যে মানুষের মনুষ্যত্ব সূচিত হয়। যে মানুষ জীবনে এক একটা দিন নিষ্ঠুর বাক্য, মানুষের সঙ্গে মিথ্যা ব্যবহার এবং প্রতারণা থেকে মুক্ত করে রাখতে পারবে জীবন শেষে সে দেখতে পারবে, সে তার জীবনকে সার্থক করেছে। প্রতিদিনকার জীবন যার নিষ্ঠুরতা, মিথ্যা ও প্রতারণায় ভরা-তার সমস্ত জীবনটাই একটা ভাঙ্গা ঘরের মতো অন্তঃসারশূন্য। প্রাতঃকালে উঠেই প্রতিজ্ঞা কর, “আজিকার দিনটা সফল ও সার্থক করবো! আমার আজিকার এই দিনের কার্যে যেন মানব সমাজ উপকৃত হয়। যার সঙ্গে কথা বলি, তাকেই যেন আনন্দ দিতে পারি, যেন কোনো কার্যে কাপুরুষ না হই। যেন এর প্রতিমুহূর্ত আমার জীবনে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়।”

কত পাপ, কত অন্যায়, কত প্রকার হীনতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অপবিত্র করে, আমাদের আত্মাকে কতখানি মলিন করে। দিনের মধ্যে কতবার আমরা মিথ্যা পক্ষ সমর্থন করি। দিনের প্রভাতে উঠে আমরা দেখতে পাই উদার, নীল গগন শী–কী সুন্দর! কী শোভাময়! তারপর পূর্বাকাশের নির্মল প্রভাত ছবি–গাছে গাছে স্বর্গের কী মোহন মাধুরী! বিশ্বময় নির্মলের দেবতাকে একবার প্রণাম কর-তারপর মানুষের মুখের দিকে চেয়ে দেখ।

যত প্রকার পাপ আছে, মানুষের চিত্তে ব্যথা দেওয়াই তার মাঝে বড় পাপ। এ মহাপাপ কেউ করো না! ক্ষমতা এবং বাহুর গর্বে, জনবলের গর্বে মানুষের মুখের দিকে চেয়ে কঠিন কথা বলো না। সরে এস, ভীত হও।

এমন সুন্দর আলো-বাতাস প্রবাহে, এমন সুন্দর বিধাতার আশীর্বাদ ঐশ্বর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হে মানুষ–সর্ব পাপমুক্ত হবার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা কর। বিধাতার জড়সৃষ্টির মত তুমি নির্মল হও।

প্রভাতে উঠেই কী ভাবছ?–হিংসা প্রতিশোধের বিষ তোমার নির্মল আত্মাকে বিষাক্ত, অপবিত্র করে দিচ্ছে? সতর্ক হও, কী চিন্তা করছ? কার ক্ষতির চিন্তা মনে জেগেছে? কার পানে মন তোমার নিষ্ঠুর বিরূপতায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে? ক্ষান্ত হও! মানুষকে প্রেম করতে শেখ।

ঘর হতে বের হয়ে যাও। পথে পথে মানুষের সুন্দর, শুভ মুখ দেখে জীবন সার্থক কর–মনুষ্যকে আলিঙ্গন কর।

মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করো না-এই মহাপাপ হতে সরে এস, মানুষের সঙ্গে শঠতা করো না, মনুষ্যকে গালি দিও না। সর্ব প্রকারেই জীবনকে সফল ও সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা কর। মানুষকে চিনি না এ কথা কাউকে বলো না।

তোমার আত্মসর্বস্ব জীবনের কথা ভেবে তুমি লজ্জিত হও। মানুষ নিজের জন্য বেঁচে নেই। অনেক টাকা-কড়ি উপায় করছ, আরও টাকার জন্য ব্যস্ত হয়েছ? এই টাকা-কড়ি আহরণ করার অন্তরালে কী উদ্দেশ্য তোমার আছে! তোমার সমস্ত জীবন-স্পন্দনের মাঝে দাঁড়িয়ে যে সমস্ত মহাপুরুষ অদৃশ্যভাবে তোমার জীবনকে পরিচালিত করেছেন, তাঁরা মানবজীবন সম্বন্ধে কী বলেছেন? মানুষ কি বেঁচে আছে নিজের জন্যে?–মানুষের নিজের অভাব কতটুকু? আর জগতে রাজা হয়েই বা কী লাভ?–অপরিসীম প্রতিপত্তি লাভ করেই বা কী এমন লাভ আছে, যদি না দুর্বলের পার্শ্বে যেয়ে দাঁড়াও? যদি না মানব-দুঃখ তোমাকে ব্যথিত করে?–মানব সেবার জন্যে যদি না তুমি তোমার সমস্ত ধন-সম্পদ, সমস্ত জ্ঞান ও শক্তি নিয়ে অগ্রসর হও? কী লাভ হবে বড়লোক হয়ে?–কতদিন মানুষ তোমার নাম করবে? তোমার চাইতে অনেক শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী মানুষ মাটির ধূলার সঙ্গে মিশে গেছে। তুমি কোন ছার!

মন যার পাষাণ, মানুষকে শুধু উপদেশ দিয়েই যে কর্তব্য শেষ করে, প্রেমে অগ্রসর হয় না, দুর্বল, অপরাধীকে ক্ষমা করে না, সে মানুষ নহে।

এ শিক্ষা মনুষ্য কোনো পুস্তক, কোনো বক্তৃতা হতে পায় নাই, এ শিক্ষা, এ প্রেমের শিক্ষা মানুষ আপনা আত্মা হতেই পেয়েছে। সমস্ত ধন-সম্পদ দিয়ে তোমার আত্মার প্রেমকে সার্থক করতে হবে। পশুর মত আপন বিবরে প্রবেশ করো না–মানুষের কথা ভাব–মানুষের প্রতি তোমার কর্তব্য আছে। এই কর্তব্য উদযাপনের নাম এবাদত, তা শুধু প্রাণহীন আবৃত্তি নয়।

দুঃখের সামনে, ব্যথার সামনে, নিষ্ঠুর পাষাণের মতো স্থির হয়ে থেকো না। মানব দুঃখের সম্মুখে আপন পত্নীর প্রেমে পূর্ণ থেকো না। অবিচারের সম্মুখে আপন পুত্রের মুখে চুম্বন দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করো না।

ধর্মগ্রন্থ তোমায় কী দীক্ষা দিয়েছে? ইঞ্জিল, জব্দুর, তৌরাত, কোরান এবং পবিত্র হাদীস সমষ্টি কী শিক্ষা তোমায় দিয়েছে? তোমাকে স্নেহশীল, প্রেমিক হতে বলে নি? কতবার কতভাবে তোমাকে বলেছে, হে মানুষ, প্রেমিক হও, পাষাণ হয়ো না।

আত্মার প্রেমকে সার্থক করবার জন্যে,–মনুষ্য জীবনের দানকে সার্থক করবার জন্যেই রত্ন সংগ্রহে দিকে দিকে ছুট। মনুষ্যকে পূর্ণ করবার জন্যে নিজের পরিবারের সুখের জন্যে, মানুষের ধনরত্ন কেড়ে এনে বাক্সজাত করো না। মনুষ্য যে তোমার ভাই, এ কথা কি তুমি জান না? এ কথা তো যুগে যুগে আল্লাহর বাণীরূপে তোমরা পেয়েছ, তবুও তা বিশ্বাস করো না? মনুষ্য সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কি আনন্দ-রসে পূর্ণ হয়ে উঠতে পার না? তাকে কি কাছে বসাতে জান না? মনুষ্য হয়েও কেন মনুষ্যকে এত বিষ নয়নে দেখ? এই তোমার ধর্ম?–যাও, ফিরে যাও। ভালো করে চিন্তা কর, তোমার ধর্ম কী? মিথ্যা করে তাড়াতাড়ি চিন্তা করে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করো না।

মনুষ্যকে প্রেম করাই আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এ ছাড়া মনুষ্যের জন্যে দ্বিতীয় কোনো ধর্ম নাই। মনুষ্যকে প্রেম কর–মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার কর। মনের হৃদয়ে ব্যথা অনুভব কর। পৃথিবীর দুঃখ তোমরা সকল ভাই সমান ভাগ করে নাও। মানব সমাজের জন্য জগৎ স্বর্গে পরিণত হোক–ধর্মের নামে মিথ্যাচরণ করো না।

দরিদ্র সন্তানের সম্মুখে নিজের সন্তানকে সজ্জাভূষিত করো না–এ নিষ্ঠুর কাজ। আবার বলি, মনুষ্যকে আত্মীয়ের চোখে, প্রেমের চোখে দেখ। পরিচিত বেগানার মতো মানুষের দিকে চেয়ে দেখ না। কীসের তোমরা গর্ব কর?–বংশ মর্যাদার? অর্থের? বেশ ভূষার? অট্টালিকার? জমিদারির? তোমরা জান না-মানুষ কীসের গর্ব করতে পারে! তোমরা যে কত নত হয়েছ, সেই গর্ব কর, প্রেমের গর্ব কর, মনুষ্যত্বে পরস্পরের প্রতিযোগিতা কর। সেবার এবং ত্যাগের প্রতিযোগিতা কর। সত্য বলছি, যে নত হতে পেরেছে, সেই তত শ্রেষ্ঠ হতে পেরেছে। মানুষের চোখে সে তত বড় আসন লাভ করেছে।

হে ভণ্ডেরা, মোহাম্মদ (সঃ) তোমার কাছে দরুদ চান নাই। আবার বলছি, তোমরা অযথা দরুদ পাঠ করো না। মোহাম্মদ (সঃ) দেখতে চেয়েছেন যারা তাকে প্রেম করে, তারা মানব-প্রেমিক কিনা, তারা সর্বপ্রকার অহঙ্কার বর্জন করেছে কিনা, দিকে দিকে আল্লাহর বাক্য তারা বহন করেছে কিনা। হাত-পায়ে সাবান লাগাবার মসলা (ব্যবস্থা) তোমরা প্রচার করো না, এতে তিনি সত্যিই লজ্জিত হন। ইসলাম মানে এ নয়।

সত্য বলতে কী, সমস্ত মানব জাতির জন্য মাত্র একটি ধর্ম আছে, সমস্ত মানুষই মুসলমান হবার জন্য, পরম শান্তির জন্যে লালায়িত। মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনো বিরোধ নেই, বিরোধ আছে শুধু শয়তানের এবং আল্লাহর। আমরা সবাই আল্লাহকে চাই,পরম শান্তি চাই, ইহাই ইসলাম, পরম শান্তি। সব ধর্মেরই সমস্ত মানব-চিত্তের ইহা অপেক্ষা পরম লাভ আর কি আছে? শুধু শয়তানের সঙ্গে বিরোধ কর। সকল জাতির মানুষ সমস্ত হানাহানি ত্যাগ কর, সর্ববিধ পাপ বর্জন কর। আত্মার পক্ষে যাহা কিছু অসম্মানজনক, তাহা ত্যাগ কর। এটাই পরম শান্তির পথ। মনুষ্যকে এই পরম শান্তির পথে আকর্ষণ কর, মানুষকে বিনষ্ট হতে দিও না। জীবনের সমস্ত সাধনা, শক্তি, ধন-সম্পদ এরই জন্যে, জীবনের আর কোনো সার্থকতা নাই।

.

০৫. সংস্কার মানুষের অন্তরে

অভাবে মানুষের দুঃখ হয় না, রোগ-শোকের যাতনা মানুষ ভুলতে পারে, কিন্তু মানুষের নীচতা দেখে যে দুঃখ হয়, তার তুলনা নাই।

মানুষের প্রবৃত্তি যদি পশুর মতোই হবে, যদি তার হীনতায় সে লজ্জিত না হয়, তবে কেন সে পশুর আকার ধারণ করে নাই? কেন সে আপন দেহ পোশাকে ও লজ্জায় ভূষিত করে? যদি রাজ্য হারিয়ে থাক, দুঃখ করো না, যদি তোমার পরম আত্মীয়েরা ত্যাগ করে গিয়ে থাকে তবুও দুঃখ করো না, যদি তোমার প্রবৃত্তি নীচ হয়, যদি ইতর পশুর আত্মার স্বভাবে তোমার আত্মার অবনতি ঘটে থাকে, তাহলেই লজ্জিত হও। তোমার চশমা, তোমার ঢেউ-তোলা চুল, সুবাসিত গন্ধ তেল, তোমার শার্ট, কোচান ধুতি তোমার গৌরব বর্ধন করবে না।

কোনো দুঃস্বভাবে লজ্জিত হও না?–অপরের দোষ দেখে আঘাত কর, নিজের দোষের পানে একটু তাকাও না? একটু লজ্জিত হও না? মানুষের দোষ-ক্রটি অম্লান বদনে সমালোচনা কর, নিজের দোষ-ত্রুটির বিষয় একটুও ভাবো না! পরের চোখে একটা কাল দাগ দেখে লাফিয়ে উঠেছ, নিজের চোখে সরষে ঢুকছে, তা দেখ না? কেন আপন স্বভাবকে সমর্থন করার জন্যে মানুষের সঙ্গে তর্ক কর? অন্ধকারে নিজের মনের দিকে চেয়ে দেখ–কত কালি, কত মিথ্যা, কত প্রতারণা, কত শঠতা সেখানে রয়েছে। নিজের অপরাধের কথা ভেবে লজ্জা লাগে না? কেবলই পরের কথা ভাব? মানুষ তোমাকে চুরি করতে দেখে নি, তা বলে তুমি চোর নও? অন্তরের পাপ মুখোনি একবার ভালো করে দেখে নাও! তুমি কি অন্যায় করে কারো মনে আঘাত দিয়েছ? তাহলে গোপনে ক্রন্দন কর। তার কাছে ক্ষমা চাইবার আগে মসজিদ ঘরে যেয়ো না। তোমার ভাই বা পিতাকে ফাঁকি দেবার জন্যে কোনো মিথ্যা কথা বলেছ কী? তাহলে লোক চক্ষুর আগে চেয়ে আপন মনে লজ্জিত হও। কাউকে বঞ্চনা করেছ কি? তুমি কি অকৃতজ্ঞ? তুমি কি মিথ্যাবাদী? তাহলে লজ্জিত হও। মনুষ্য সমাজে বের হয়ো না।

হাইরোক্লিস বলেছেন, সংস্কার নিজের অন্তর থেকেই হবে। আপন আত্মার দিকে প্রথমেই ফিরে তাকাও। তারপর পরের কথা ভেবো। নিজেকেই প্রথমে প্রেম করো। নিজের জাহাজ ভেঙ্গেছে, সেই কথা আজ ভাব, নিজেকে বাদ দিয়ে মানুষকে সত্যপ্রিয় হতে বলো। নিজের নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করে, অপর মানুষকে মধুর কথা বলতে অনুরোধ করো। নিজের কথাই আগে ভাবতে হবে। নিজের কর্তব্য আগে পালন কর, তারপর অন্যকে উপদেশ দিও, অপরকে তার কর্তব্য পালন করতে অনুরোধ করো।

যে নিজে নীচাশয়, সে অন্যকে কেন নীচ বলে গালি দেয়? যে নিজে ভুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, সে কেন অন্যের ভুল ধরে? জীবনের কোনো কিছুতেই আনন্দবোধ করো না–যদি না নিজেকে পশুর স্তর থেকে মানুষের আসনে উন্নীত করতে পার। তুমি কি ধনশালী হয়েছ? ব্যাংকে কি লক্ষ টাকা জমাতে পেরেছ? তাহলে এমন কি আনন্দের বিষয় আছে–সমুদ্রগর্ভে কি অপরিমিত মণিরহ থাকে না? পর্বতের অন্ধকার গুহায় কি বহুমূল্য প্রস্তর নাই?

তোমার পোশাকের গর্ব কর। ক্ষেতের পুষ্প কি তোমাদের চাইতে অধিক সুন্দর নয়। মনুষ্য তোমাদের অর্থ এবং মূল্যবান পরিচ্ছদকে নমস্কার করে না–তোমাদের দংশনকে, তোমাদের আঘাতকে তারা ভয় করে; তাই তোমাদের শক্তি, অর্থ ও গর্বের সম্মুখে মাথা নত করে। বস্তুত অর্থের গৌরবে মনুষ্যের শ্রদ্ধালাভ করতে যেয়ো না–জমিদারির শক্তিতে মনুষ্যকে ঘৃণা করো না। এ দাবি কোনো দাবিই নয়।

তুমি কি মনুষ্যকে প্রেম কর? তুমি কি সহৃদয়? মনুষ্য তোমাকে দেখে কি আনন্দিত হয়? তুমি মানব-মঙ্গল চাও? তোমার জীবনে কি পৃথিবীর এবং মানব সমাজের কোনো কল্যাণ হচ্ছে? তুমি কি মনুষ্যকে আল্লাহর পথে আকর্ষণ করে থাক? তুমি কি মনুষ্যকে সত্যময় হতে উপদেশ দিয়ে থাকো? তাহলে মনুষ্যের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার দাবি তুমি করতে পার।

মন পরিবর্তন কর। মনের গোপন পাপ ধুয়ে ফেল। যতই কেন ধার্মিকের বেশ ধারণ কর না, অন্তরের গ্লানি ধুয়ে না ফেললে তোমাকে যথার্থ ধার্মিক বলা হবে না। মানুষ শরীরের গৌরবে বড় নয়। আত্মার গৌরবে যে বড় হতে চায় না, সে মানুষের জন্য নয়। সে পশু জাতীয়।

মানুষকে পশুর সঙ্গে তুলনা করে কেন? মানুষের প্রবৃত্তি কী, পশুর প্রবৃত্তিই বা কী? পশুরা আপন পত্নীকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু খাবার বেলায় দেখতে পাই, সে পত্নীকে ফাঁকি দিয়ে নিজেই খায়, পশু পিতা সন্তান পালন করে না, বরং বাচ্চাগুলো নিকটে এলে পশু পিতা অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়, নিকটে এলে তাড়িয়ে দেয়। সে নিজের ভালো, নিজের লাভই বেশি বোঝে, সে কখনও পরের চিন্তা করে না, সে দুর্বলকে আঘাত করে এবং অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীর কাছে সভয়ে মাথা নত করে। তার আপন-পর জ্ঞান নাই, সুযোগ পেলেই পরের জিনিস চুরি করে। নিজের কোনো অন্যায় দেখলে আপত্তি করে না। কেউ বিপদে পড়লে তার উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হয় না। কোনো কোনো সময় দেখতে পাওয়া যায়, আপন জাতির কাউকে বিষণ্ণ দেখলে তাকে আরও আঘাত করে, তার লজ্জা নাই, তার কোনো সম্মান-জ্ঞান নাই। আপন আপন স্বামী এবং পরীর কাছে সে বিশ্বস্ত থাকে না। সে শোক করে না–আত্মীয় বিরহে তার কোনো বেদনা বোধ নাই। তার কোনো ধর্ম নাই, সে

অতিশয় ভীরু। যেখানে স্বার্থ দেখে সেখানেই উপস্থিত হয়। . মানুষের স্বভাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে মানুষকে পশুর মতো দেখি সেখানে আমরা তাকে পশু বলে ঘৃণা করি। সেখানে মানুষ পশু অপেক্ষা নিকৃষ্ট স্বভাবের পরিচয় দেয়, সেখানে তাকে ঘৃণায় পশ্বাধম বলে গালি দেই।

মানুষে আর পশুতে পার্থক্য আকাশ-পাতাল, মানুষ স্বর্গের দেবতা, তারার মতো সুন্দর,–পশু মর্তের নিকৃষ্ট জীব, রাত্রির মতো মসিমলিন।

মানুষ ভালোবেসে, যা-কিছু আছে সবই দান করে। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সে সব দিয়ে দেয়, রিক্ত হস্তে দাঁড়িয়ে ধন্য হয়। সে যাকে ভালোবাসে, তাকে সর্বপ্রকার সুখী করতে চায়, নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়াতে চায়। মানুষের প্রেমের এটাই স্বভাব। ইহাতেই তার আনন্দ। মানুষ সন্তানকে হৃদয়ের টুকরা মনে করে, স্ত্রী-পুত্রের জন্যে সে বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপদকে সে বিপদ মনে করে না, পরের জন্য দুঃখভোগ করতেই তার আনন্দ। এক একটা পশ্চিমা দারোয়ান বিদেশে ৭/৮ টাকা বেতনে, ছাতু খেয়ে মাটির উপর শুয়ে বৎসরের পর বৎসর কাটিয়ে দেয়; মাসটি গেলে কত আনন্দে সে পত্নীর কাছে টাকা পাঠায়। কীসের জন্যে। সে এত কষ্ট সয়?–না, তার স্ত্রী-পুত্র খাবে। পশ্চিমা ছেলেগুলি মাস অন্তে কত আনন্দে মায়ের কাছে দুই তিনটি টাকা পাঠায়। মানুষ নিজে খেয়েই শুধু সুখী হয় না, আত্ম-সুখের জন্যে সে শুধু দুঃখের সাগর পাড়ি দেয় না। হাজী মোহাম্মদ মহসিন, ডাক্তার পালিত ঘোষ, করটিয়ার –চাঁদমিয়া সর্বস্ব দান করে রিক্ত হস্তে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। এই-ই মনুষ্য দেবতার স্বভাব। পশুর মত চীৎকার করে, সকলকে দংশন করে, নিজের উদর ভর্তি করাকে সে ঘৃণা করে। মানুষ মানুষের দুঃখ-ব্যথার কথা চিন্তা করে, লোকচক্ষুর অগোচরে নানা বেদনায় ফুলে ফুলে কাঁদে। কী প্রেম তার চিত্তে! মানুষ দুর্বলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, পশুর মতো পীড়িতকে দুঃখে ফেলে সে ত্যাগ করে না। লাঞ্ছিত-অত্যাচারিতকে সে সকলের নিষ্ঠুর আঘাত থেকে রক্ষা করে। সে নিঃসহায়া নারীকে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে রক্ষা করে, কারণ সে যে মনুষ্য দেবতা। প্রেম দিয়ে তার চিত্ত গড়া। প্রেম করা, আঁখি জলে কাদা, মানুষের দুঃখে বিগলিত হওয়াই তার স্বভাব। মানুষ যখন পশুর মতো হীন হয়ে আপন সত্য স্বভাবের পরিচয় দেয় না, তখন মানুষের আকৃতি ধারণ করলেও সে সত্যিকার মানুষ থাকে না–সে পশুর স্তরে নেমে যায়। মর্যাদা রক্ষার জন্য মনুষ্য প্রাণ দেয়, তবুও অন্যায় ও মিথ্যার কাছে সে মাথা নত করে না। কারবালা প্রান্তরে পিপাসিত, ক্ষুধার্ত মানব দেবতা চরম দুঃখে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেছেন, তবুও দুর্মতির কাছে মাথা নত করেন নাই, তার অনুগ্রহ স্বীকার করেন নাই। ইহাই মানুষের মহত্ত্ব। অন্ধকারে কেহ যেখানে তাকে দেখে নাই, সেইখানে সে নিজের পাপ নিজে দেখেছে এবং শঙ্কিত হয়ে নিজেকে শাসন করেছে–নিজ পাপে সে নিজেই লজ্জিত হয়েছে। মনুষ্য নিজের জাতির জন্য বর্তমান ও অতীতে কত দুঃখই না সয়েছে, ইতিহাস তার প্রমাণ। নিজের রক্ত দিয়ে ধুলার সঙ্গে মিশে যে জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণের পথ প্রস্তুত করেছে, কেউ তাদের সংবাদ রাখে নি। এই-ই মনুষ্য দেবতার স্বভাব। নিজের দেশের মানুষ দেখলে মানুষের প্রাণ আনন্দে নৃত্য করে উঠে, প্রেমে তার কণ্ঠবেষ্টন করে সে যে কত বড় তারই পরিচয় দিয়েছে।

মানুষের জন্যে রাজ-সিংহাসন ত্যাগ করে পথের ভিখারি হয়েছে, ঐশ্বর্য বিলাস অস্বীকার করে সে পথের ফকির হয়েছে।

বেহেস্তের কন্যা নারী আপন সতীত্ব রক্ষার জন্যে দস্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, সে জীবন দিয়েছে, তবু স্বামী ত্যাগ করে পরের অঙ্গশায়িনী হয় নি। যেখানে নারী ব্যভিচারিণী, সেখানে নারী আর নারী নয়–সে পশু।

মানুষের জন্যে মানুষ কী কঠিন শোকই না করেছে। মানুষের জন্যে মানুষের কী অপরিসীম বেদনা! কী অতুলনীয় প্রেমের অনুভূতি তার। সে আপন সন্তানের জন্য, আপন প্রণয়ী ও প্রণয়িনীর জন্য পথে কেঁদে মরেছে। পৃথিবীর কোনো আকর্ষণ তাকে আনন্দ দেয় নাই। চিরজীবন সে হাসে নাই। পথে পথে বনে বনে ঘুরে, পাহাড় ভেঙ্গে, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে তার মহাপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে। সে ধন্য।

মানুষ দেবতা বলেই সে মানুষের জন্য শোক করে। আত্মা তার স্নেহ-মমতার আধার বলেই বিরহ-বেদনায় কাতর হয়; সমস্ত প্রকৃতির মাঝে আপন চিত্তের শোকধ্বনি শুনতে পায়। পশুর কোনো শোক নাই, তার বিরহ-বেদনা নাই।

মানুষের কী অপরিসীম সাহস! কী তার হৃদয়ের বল! জগতের কোনো ব্যথা, কোনো ভয় তার গতিকে রোধ করতে পারে নি। বজ্র অপেক্ষা সে ভীষণ, বিদ্যুৎ অপেক্ষা সে দীপ্তিশালী। সে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করেছে, কামানের সম্মুখে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় ভেঙ্গে ছিন্ন বিচ্ছিন্নরেছে, সমুদ্রকে সে অঞ্জলি আবদ্ধ জলবিন্দু মনে করেছে।

যে মানুষ এত বড়, তার কি কাপুরুষতা, ভীরুতা সাজে! প্রাণভয়ে মৃত্যুর আগেই মরা কি তার শোভা পায়?

মনুষ্য কি নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সংবাদ নিয়েছে? নিঃস্ব পীড়িত আর্ত তার করুণ নয়নের দৃষ্টিলাভ করেছে? সে পশুর মতো পাশ কাটিয়ে স্বার্থ ও লাভের গন্ধে ছুটে নাই। বিশ্বের যেখানে ব্যথা, যেখানে হাহাকার, সেখানে সে তার সর্বস্ব নিয়ে আকুল হয়ে ছুটেছে। এই-ই মানুষের স্বভাব। সে দুঃখী সংসারের সম্মুখে আপন মুখে অন্ন তুলে দিতে পারে নাই, প্রাণ তার প্রেমের বেদনায় কেঁদে উঠেছে। ধন্য মানুষ! তোমায় নমস্কার করি। মনুষ্য যেখানে প্রেমের নামে জাতি-বিচার করে, দুঃখীকে অবিশ্বাসী কুকুর বলে গালি দেয়, তখন তা মানুষের কথার মতো শোনা যায় না।

মানুষে যখন মানুষের উপর অত্যাচার করে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে, মানুষকে চূর্ণ করে আনন্দলাভ করে, মানুষকে ব্যথা দেয়, মানুষ যখন অপ্রেমিক, নিষ্ঠুর, কাপুরুষ, মিথ্যাবাদী, নীচ, আত্মমর্যাদাজ্ঞানহীন, নিন্দুক এবং বিশ্বাসঘাতক হয়, যখন সে মোনাফেক শয়তান এবং ক্রুর হয়, সে যতই উচ্চাসন লাভ করুক, সে পশু। সে আর তখন মানুষ থাকে না।

মানুষ কি নিজের গৌরব ও মর্যাদা রক্ষা করতে চেষ্টা করবে না? আত্মার গৌরবে কি সে তার জন্ম সার্থক করবে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *