মানবী-না-দেবী?

মানবী-না-দেবী? 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

রামগোবিন্দ ভট্টাচার্য্যের বাড়ীতে আজ মহাধূম পড়িয়া গিয়াছে। পল্লিগ্রামে ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের বাড়ী হইলেও, উহা নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে, সদর এবং অন্দর উভয় মহলই বেশ পরিসর ও অনেক জায়গার উপর স্থাপিত। সদর মহলের সম্মুখে পূজার দালান ও দুই পার্শ্বে দুইটি বৃহৎ বসিবার ঘর বা বৈঠকখানা সমস্তই নূতন প্রস্তুত। যেস্থানে এখন ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয়ের পাকা বসত বাটী, সেই স্থানে পূর্ব্বে তাঁহার কয়েকখানি খড়ের ঘর ছিল, ওই সকল ঘর ভাঙ্গিয়া এখন তাঁহার পুত্র রাজীবলোচন এই প্রকাণ্ড সৌধ নির্ম্মাণ করিয়াছেন। যে কয় বৎসর এই বাড়ী প্রস্তুত করিয়া ভট্টাচার্য্য মহাশয় ইহাতে বাস করিতেছেন, সেই কয় বৎসর হইতে এই বাড়ীতে নিয়মিতরূপ ক্রিয়াকর্ম্ম হইতে আরম্ভ হইয়াছে। দুর্গোৎসব বা অপরাপর পূজার সময় ওই বৃহৎ পূজার দালান কখনই খালি থাকে না। 

পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের বাড়ীতে মহাধূম পড়িয়া গিয়াছে। গ্রামের ও নিকটবর্তী পল্লিসমূহের ব্রাহ্মণমণ্ডলী আজ মধ্যাহ্নের সময় দলে দলে ওই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া সেই বৈঠকখানা ঘরে উপবেশন করিতেছেন। “পা ধোবার জল দে,”“তামাক নিয়ে আয়,” প্রভৃতি নানারূপ শব্দে সেই বাড়ী প্রতিধ্বনিত হইতেছে, ভৃত্যগণ চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া সকলের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতেছে। মধ্যাহ্নকালে বাড়ীতে অনেক ব্রাহ্মণের সমাগম হইয়াছে। সকলেই নিমন্ত্রিত হইয়া মধ্যাহ্নের কার্য্য সমাপন করিতে সেই স্থানে আগমন করিয়াছেন, কিন্তু সেই বৃহৎ পূজার দালান ত খালি পড়িয়া রহিয়াছে, উহাতে ত কোন দেবমূর্ত্তি দৃষ্টি গোচর হইতেছে না। এইতো গেল সদর বাড়ীর অবস্থা, অন্দর বাড়ীতে এখন কি হইতেছে একবার দেখা যাউক। বিস্তৃত রন্ধনশালায় সারি সারি বসিয়া প্রবীণা স্ত্রীলোকগণ রন্ধন করিতেছেন, কেহ বা তাহাদিগকে নানারূপে সাহায্য করিতেছেন, উহার মধ্যে বাড়ীর স্ত্রীলোকগণও আছেন, অপর বাড়ীর স্ত্রীলোকগণও আছেন। আজকাল কোন কাজকৰ্ম্ম উপলক্ষে যেমন পাচক ব্রাহ্মণের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে হয়, পূর্ব্বে আমাদিগের দেশে তাহা ছিল না, রন্ধনাদি করিবার ভাবনা কাহাকেও ভাবিতে হইত না, কাহারও বাড়ীতে কোন কাজকৰ্ম্ম উপস্থিত হইলে, পাড়ার স্ত্রীলোকগণ আপনা হইতেই নিঃস্বার্থ ভাবে গমন করিয়া সেই কাৰ্য্য শেষ করিয়া আসিতেন।” 

অন্দর মহলের একটি বিস্তৃত দালানে আরও মহাধূম পড়িয়া গিয়াছে। অল্পবয়স্কা স্ত্রীলোকদিগের দ্বারা ওই স্থান পরিপূর্ণ, ওই স্থানের একপার্শ্বে বসিয়া পুরোহিত মহাশয় পুঁথি খুলিয়া মন্ত্রপাঠ করিতেছেন, মধ্যস্থলে চারুবালা বসিয়া সুগন্ধি পুষ্প ও চন্দন দ্বারা রাজীবলোচনের পদযুগল পূজা করিতেছেন। চারুবালা রাজীবলোচনের গুণবতী ভাৰ্য্যা, আজ তিনি সাবিত্রীব্রত করিয়া মনের সুখে স্বামীর পদপূজা করিতেছেন, তাই এই বাড়ীতে আজ মহাধূম পড়িয়া গিয়াছে। 

পূজা সমাপন হইল, সেই বৎসরের ওই ব্রত উপলক্ষে যাহা যাহা কৰ্ত্তব্য তাহার সমস্তই শেষ হইল। রন্ধনশালার কাৰ্য্যও শেষ হইয়া আসিল। রাজীবলোচন হাসিতে হাসিতে সদর বাড়ীতে আগমন করিয়া নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণমণ্ডলীকে সাদরসম্ভাষণ, অভিবাদন ও কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিয়া সকলের আহারের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। বৈঠকখানা, পূজার দালান ও পূজার দালানের সম্মুখবর্তী প্রাঙ্গণে উপবেশন করিয়া সকলে পরিতোষের সহিত আহার করিলেন, ও সময়োপযোগী কিছু কিছু নগদ দক্ষিণা গ্রহণ করিয়া, ক্রমে সকলে সেই স্থান পরিত্যাগ করিলেন। 

ব্রাহ্মণমণ্ডলীর আহারাদি সমাপন হইলে, রাজীবলোচন আহার করিলেন। রামগোবিন্দের আহার করিতে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল। বাড়ীর চাকর চাকরাণী ও অপরাপর লোকগুলি যাহারা নানারূপ কার্য্যে নিযুক্ত ছিল, তাহাদিগের আহার না হইলে রামগোবিন্দ আহার করিবেন না বলিয়াই তাঁহার আহার করিতে এত বিলম্ব হইল, ইহা রামগোবিন্দের পূৰ্ব্বাবধি অভ্যাস ছিল, বাড়ীর প্রায় সমস্ত কাজকর্ম উপলক্ষেই তাঁহার ওইরূপ অবস্থা ঘটিত। 

রামগোবিন্দের আহার করিবার পর, আহার করিতে বসিলেন তাঁহার পত্নী ও চারুবালা। যে সময় তাঁহাদিগের আহার সমাপন হইল তখন রাত্রি প্রায় ৮টা, সেই সময় আহার করিতে আর কেহই বাকী ছিল না। সমস্ত দিবস যদিও তাঁহারা অনাহারে অতিবাহিত করিয়াছিলেন কিন্তু তাহাতে তাঁহাদিগের কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই, মনের আনন্দে কাজকর্ম করিতে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইয়া গিয়াছিল। 

নবীনা স্ত্রীলোকগণ রামগোবিন্দের পত্নী ও চারুবালার কথা শুনিয়া মনে মনে হাসিবেন ও কহিবেন, যে সকল কার্য্য পাচকপাচিকাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হয়, কৰ্ম্মকাৰ্য্য উপলক্ষে যে সকলকার্য্য চাকর চাকরাণীর দ্বারা অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারে, সমস্ত দিবস উপবাস করিয়া সেই সকল কার্য্য লইয়া ব্যস্ত থাকা মূর্খের কার্য্য ব্যতীত আর কি বলা যাইতে পারে? বাড়ীতে কোনরূপে লোক সমাগম হইলে বা কোনরূপ কাজকর্ম্ম উপস্থিত হইলে, দক্ষিণ হস্তের ব্যাপার যিনি যত শীঘ্র শেষ করিয়া লইতে পারেন, তাঁহাকে ততই চতুর বলা যাইতে পারে। আর যিনি উপবাসে সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিয়া, সকলের আহার অন্তে আহার করিতে বসেন, তাঁহার মত গণ্ডমূর্খ আর কেহ আছে কি না সন্দেহ। 

নবীনা স্ত্রীলোকগণ আজকাল প্রায় ওইরূপই করিয়া থাকেন, তাঁহারা লেখাপড়া শিখিয়াছেন, গৃহকর্ম্মের ও সন্তান প্রতিপালনের ভার পরিচারিকার হস্তে অর্পণ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের নিত্যকর্ম্মের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে পুস্তক—বিশেষ উপন্যাস পাঠ, সদা সৰ্ব্বদা বেশ ভূষা করিয়া ফিটফাট থাকা, সকলের আহার করিবার পূর্ব্বে আহার করা ও কখন কখন স্বামীর সহিত একত্রে আহার করিতে বসিয়া দুইএকটি মিষ্টি কথায় ভালবাসা প্রকাশ করা। 

রামগোবিন্দের স্ত্রী বা চারুবালার শিক্ষা সেরূপ ছিল না, সুতরাং নবীনা স্ত্রীলোকের সহিত তাঁহাদিগের মনের ভাব কোনরূপেই মিলিত না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

রামগোবিন্দ ভট্টাচার্য্য দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন, সামান্য বৃত্তি—ব্রহ্মোত্তর হইতে তিনি কোন গতিকে দিনযাপন করিতেন। রাজীবলোচন ভট্টাচার্য্য তাঁহার একমাত্র সন্তান, গ্রামের পাঠশালায় ও পরিশেষে সেই গ্রামের স্কুলে রাজীবলোচন তাঁহার বাল্যশিক্ষা সমাপন করেন। রামগোবিন্দ অনেক কষ্টে স্কুলের বেতন প্রভৃতি প্রদান করিয়া তাঁহার শিক্ষার নিমিত্ত সাহায্য করিয়াছিলেন, সেই স্কুলের শেষ পরীক্ষায় রাজীবলোচন বিশেষ সম্মানের সহিত উত্তীর্ণ হন ও বৃত্তি প্রাপ্ত হন, সেই বৃত্তি অবলম্বনে তিনি কলিকাতায় আগমন করিয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া লেখাপড়া শিখিতে আরম্ভ করেন ও পর পর ক্রমশঃ বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া ক্রমে তিনি উচ্চশিক্ষা শেষ করেন, ও উকীল হইয়া বিদ্যালয় পরিত্যাগ করেন। 

উকীল হইয়া প্রথমতঃ তিনি কলিকাতার নিকটবর্তী জেলা আদালতে ওকালতি আরম্ভ করেন ও কিছু কিছু পাইতেও থাকেন। এতদিবস তিনি পিতামাতাকে কোনরূপে সাহায্য করিতে পারিতেন না, উকীল হইয়াও এক বৎসরকাল তাঁহাদিগকে সাহায্য করিতে সমর্থ হন নাই, কোন গতিকে নিজের খরচ চালাইতে থাকেন। এক বৎসর পরে ক্রমে তাঁহার আয় বৃদ্ধি হইতে আরম্ভ হইল, নিজের খরচপত্র বাদে পিতামাতাকে কিছু কিছু সাহায্য করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে জেলা আদালতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত করিয়া তিনি হাইকোর্টে আসিয়া ওকালতি আরম্ভ করিলেন। ক্রমে তিনি তাঁহার পসারের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর অর্থ উপার্জ্জন করিতে আরম্ভ করিলেন ও পিতামাতাকেও যথেষ্ট অর্থ দিয়া সাহায্য করিতে লাগিলেন। নিজগ্রামে বৃহৎ বাড়ী প্রস্তুত করাইলেন। পুত্রের উপার্জিত অর্থে বৃদ্ধ রামগোবিন্দ মনের সুখে ক্রিয়াকৰ্ম্ম, পুজাপার্ব্বণ, ব্রত-নিয়ম, অতিথি-অভ্যাগতদিগের সেবা করিয়া দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। এই সকল কার্য্যে তাঁহার প্রধান সাহায্যকারিণী হইলেন তাঁহার বৃদ্ধা স্ত্রী ও যুবতী পুত্রবধূ চারুবালা। 

চারুবালা বিশেষ ভদ্রবংশসম্ভূতা গরিবের কন্যা। যে সময় রামগোবিন্দ রাজীবলোচনের বিবাহ দেন, সেই সময় তাহার দরিদ্র অবস্থা দূর হইয়াছে, সেই সময় মনে করিলে রামগোবিন্দ কোন বড় লোকের কন্যাকে পুত্রবধূরূপে আপন গৃহে আনিতে পারিতেন, ও সেই সঙ্গে অনেক ধন ও অলঙ্কার তাঁহার গৃহে আসিত। কিন্তু রামগোবিন্দ সেদিকে কিছুমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়া দরিদ্র গৃহজাত লক্ষ্মীকে আনিয়া আপন ঘরে স্থাপিত করিলেন। চারুবালা রামগোবিন্দের গৃহে পদার্পণ করিতে না করিতেই রাজীবলোচনের মান, সম্ভ্রম, পসার, খ্যাতি, প্রতিপত্তি ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। রাশি রাশি অর্থ আসিয়া তাঁহার হাতে পড়িতে লাগিল। 

রাজীবলোচন কলিকাতায় তাঁহার একখানি বাসোপযোগী বাড়ী প্রস্তুত করিয়াছিলেন, চারুবালা সময় সময় সেই বাটীতে আসিয়া বাস করিতেন, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই গ্রামে বাস করিয়া বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ীর সেবায় নিযুক্তা থাকিতেন। ক্রিয়াকৰ্ম্ম প্রভৃতি কিছুই কখনও কলিকাতার বাড়ীতে হইত না, সে সমস্তই দেশে হইত, তবে কলিকাতায় বন্ধু বান্ধবগণকে কোন সময়ে নিমন্ত্রণ করিতে হইলে, তাহার আয়োজন প্রভৃতি কলিকাতার বাড়ীতেই হইত। 

সাবিত্রীব্রত উপলক্ষে রাজীবলোচন দেশে আগমন করিয়াছিলেন। কলিকাতায় সেই সময় তাঁহার মামলা মোকদ্দমাদির এতদূর ঝঞ্ঝাট ছিল যে, সেই সময় তাঁহার কিছুতেই কলিকাতা ছাড়িয়া যাইবার উপায় ছিল না, কিন্তু কি করেন, চারুবালার ব্রত উপলক্ষে তাঁহার বাড়ী না যাইলেও নহে, সুতরাং দুই তিন দিবসের নিমিত্ত তাঁহাকে দেশে আসিতে হইয়াছিল। 

রাজীবলোচন যে সময় চারুবালাকে বিবাহ করেন, সেই সময় চারুবালার একখানিও অলঙ্কার ছিল না, কিন্তু রাজীবলোচন ক্রমে দুই-একখানি করিয়া তাহাকে অনেকগুলি মূল্যবান অলঙ্কার প্রদান করিয়াছিলেন। ওই সকল অলঙ্কারের মধ্যে তিনি একছড়া মুক্তার মালাও প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলেন। সদা সর্ব্বদা যেরূপ ভাবে মুক্তার মালা গ্রথিত হইয়া থাকে, ইহা সে প্রকারে গ্রথিত ছিল না। ছোট ছোট মটরের ন্যায় কতকগুলি মুক্তা তিনি বাছিয়া বাছিয়া সংগ্রহ করেন, ও ওই মুক্তাতে একছড়া সাতনর হার গ্রথিত করাইয়াছিলেন। যেরূপ ভাবে মুক্তার সাতনর গ্রথিত হয়, ইহা সে প্রকারে গ্রথিত হয় না। ওই সাতনর হার সোনার পাটরির ন্যায় গায় গায় চওড়া করিয়া সাজান হয়। ও উহা যাহাতে ঠিক সেইরূপ ভাবে আটকাইয়া রাখিতে পারা যায়, এরূপ কয়েকখানি খামি প্রস্তুত করিয়া ওই হারের মধ্যে মধ্যে স্থাপিত করিয়া উহারই সহিত ওই হার গাঁথিয়া দেওয়া হয়। মধ্যে মধ্যে পাঁচ সাতখানি খামির সহিত ওই মুক্তা হার সমান ভাবে গ্রথিত থাকায়, উহার কোন নর কোনরূপেই স্থানচ্যুত হইতে পারে না। গলায় ও বক্ষস্থলে সমানভাবে একটি চওড়া হারের ন্যায় থাকে। ওই খামিগুলি সুবর্ণ নির্ম্মিত হইলেও উহাতে ভাল কয়েকখানি করিয়া হিরা, চুনি ও পান্না বসান ছিল। কয়েক বৎসর ব্যবহার করিতে করিতে উহার কয়েকখানি প্রস্তর খুলিয়া গিয়াছিল, কিন্তু একখানিও হারাইয়া যায় নাই। চারুবালা বিশেষ যত্ন করিয়া উহা তুলিয়া রাখিয়াছিলেন। 

ব্রত উপলক্ষে চারুবালা তাঁহার সমস্ত অলঙ্কার পরিধান করিয়া রাজীবলোচনের পদ পূজা করিয়াছিলেন। 

যে সময়ে চারুবালা অবগুণ্ঠনে নিজের মস্তক আবৃত করিয়া প্রতিবেশিনীগণের সম্মুখে স্বামীপদ পূজা করিতেছিলেন, সেই সময় তাহার কণ্ঠস্থিত সেই মুক্তা হার তাহার স্থানচ্যুত হইয়া কাপড়ের বাহিরে আসিয়া পড়ে, সেই সময় রাজীবলোচনের দৃষ্টি সেই হারের উপর পতিত হয়, তিনি দেখিতে পান, উহার কয়েকখানি খামি হইতে কয়েকখানি প্রস্তর খসিয়া পড়িয়া গিয়াছে। সেই সময়ে রাজীবলোচন ও সম্বন্ধে কোন কথা বলেন না। 

রাত্রিকালে যখন তিনি আপন ঘরে গিয়া শয়ন করেন সেই সময় কথায় কথায় রাজীবলোচন চারুবালাকে কহেন, “আজ আমি দেখিলাম, তোমার মুক্তাহারের খামি হইতে কয়েক খামি প্রস্তর পড়িয়া গিয়াছে, এ কথা আমাকে এতদিন বল নাই কেন? আমি উহা কলিকাতায় লইয়া গিয়া যে স্থান হইতে যেরূপ প্রস্তর হারাইয়া গিয়াছে, সেই সকল স্থানে ঠিক সেইরূপ প্রস্তর বসাইয়া দিতাম। কাল কলিকাতায় যাইবার সময় ওই হারছড়াটি আমার সঙ্গে দিও, আমি যত শীঘ্র পারি উহা ঠিক করিয়া পাঠাইয়া দিব।” 

রাজীবলোচনের কথা শুনিয়া চারুবালা কহিলেন, “কয়েকখানি প্রস্তর একে একে খুলিয়া গিয়াছে, কিন্তু একখানিও হারায় নাই আমি সমস্তগুলিই তুলিয়া রাখিয়াছি। উহা পুনরায় মেরামত করিয়া দিবার জন্য তোমাকে আমি অনুরোধ করি নাই, কারণ আমি জানি, তুমি সদা সর্ব্বদা পরের ঝঞ্ঝাটে যেরূপ ব্যতিব্যস্ত থাক, তাহাতে এই সকল সামান্য বিষয়ে মনোযোগ করিবার তোমার সময় থাকে না। বিশেষ আমার এ কথা মনেই ছিল না, কারণ ওই সকল অলঙ্কার বিশেষ কোন কাজকর্ম্মের উপলক্ষ ব্যতীত আমি পরিধান করি না।”

চারুবালার কথা শুনিয়া রাজীবলোচন কহিলেন “সে যাহা হউক, ওই মালা-ছড়াটি এখনই আমাকে দাও আমি আমার ব্যাগের মধ্যে রাখিয়া দিই, কারণ কলা আমি যখন গমন করিব, সেই সময় পাছে তুমি ভুলিয়া যাও।” 

রাজীবলোচনের কথা শুনিয়া চারুবালা আর কোন উত্তর করিলেন না, ধীরে ধীরে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া নিজের বাক্সটি খুলিলেন, ও সেই মুক্তার মালা ছড়াটি ও স্থানভ্রষ্ট প্রস্তর কয়েকখানি তাহা হইতে বাহির করিয়া রাজীবলোচনের হস্তে প্রদান করিলেন, তিনি সেইগুলি একবার উত্তমরূপে দেখিয়া আপনার ব্যাগের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলেন। ক্রমে রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল, পরদিবস প্রত্যূষে রাজীবলোচন সকলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া, ও বৃদ্ধ পিতামাতার পদবন্দনা করিয়া কলিকাতায় অভিমুখে যাত্রা করিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

রাজীবলোচন কলিকাতায় আসিয়া তাঁহার ব্যাগটি তাঁহার আফিস ঘরে রাখিয়া দিবার নিমিত্ত ভৃত্যকে আদেশ প্রদান করিলেন। ভৃত্য আদেশ প্রতিপালন করিল, ব্যাগটি তাঁহার আফিস ঘরের একখানি টেবিলের উপর রাখিয়া দিল। রাজীবলোচন কলিকাতায় আসিয়া মামলা মোকদ্দমাদির ঝঞ্ঝাটে এরূপ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, যে সে দিবস তিনি সেই হারছড়াটি মেরামত করিতে দিবার নিমিত্ত কারিকরকে ডাকাইয়া আনিবার কথা একেবারেই ভুলিয়া গেলেন। 

রাত্রিকালে যে সময় হারের কথা তাঁহার মনে পড়িল, সেই সময়ে কারিকরকে ডাকিবার আর সময় ছিল না। পর দিবস প্রত্যূষে তিনি শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই যে ব্যক্তি ওই হার প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিল, তাহাকে ডাকাইয়া আনিবার নিমিত্ত তাঁহার সরকারকে আদেশ প্রদান করিলেন। সরকারও সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিল। দিবা আটটা বাজিতে না বাজিতে সেই হারপ্রস্তুত কারীকে আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলে, রাজীবলোচন তাহাকে বসিতে বলিলেন, ও কহিলেন “আজ কয়েক বৎসর অতীত হইল, তুমি একছড়া মুক্তার হার প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলে, এ কথা তোমার মনে আছে কি?” 

কারি। আছে। 

রাজী। উহার কয়েকখানি খামি হইতে কয়েকখানি প্রস্তর খসিয়া গিয়াছে, কিন্তু উহার একখানিও হারায় নাই, ওই প্রস্তরগুলি পুনরায় সেই স্থানে বসাইয়া দিতে হইবে, ও আরও যদি কোন প্রস্তর ওইরূপে খুলিয়া যাইবার উপক্রম হইয়া থাকে তাহাও দেখিয়া ঠিক করিয়া দিতে হইবে। আমি কিন্তু উহা শীঘ্র চাই দুই এক দিনের মধ্যেই আমাকে উহা মেরামত করিয়া দিতে হইবে। 

কারি। হার ছড়াটি ও প্রস্তর কয়েকখানি কোথায়? 

রাজী। এই স্থানেই আছে, আমি বাড়ী হইতে উহা এখানে আনিয়াছি। 

এই বলিয়া রাজীবলোচন তাঁহার সরকারকে সেই ব্যাগটি তাঁহার নিকট আনিতে আদেশ করিলেন। যে ঘরে বসিয়া সেই কারিকরের সহিত রাজীবলোচন কথা কহিতেছিলেন সেই ব্যাগটিও সেই ঘরের ভিতর ছিল। 

রাজীবলোচনের কথা শুনিয়া সরকার তখনই সেই ব্যাগটি আনিয়া রাজীবলোচনের সম্মুখে স্থাপন করিল। ওই ব্যাগের চাবি রাজীবলোচনের নিকটেই ছিল তিনি ওই ব্যাগটি খুলিলেন ও নিতান্ত বিস্ময়ের সহিত দেখিলেন যে, উহার ভিতর যাহা যাহা ছিল সমস্তই ঠিক আছে, কেবল সেই হার-ছড়াটি নাই। হার হইতে যে কয়েকখানি প্রস্তর খসিয়া পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা একখানি ছোট নেকড়ায় বাঁধা ছিল, তাহা তিনি যেস্থানে রাখিয়াছিলেন, সেই স্থানেই পাইলেন। ওই ব্যাগের ভিতর হারছড়াটী না পাইয়া তিনি অতিশয় বিস্মিত হইলেন, ওই ব্যাগের ভিতর পুনঃপুনঃ অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু সেই হার প্রাপ্ত হইলেন না। ওই ব্যাগের ভিতর যাহা যাহা ছিল সমস্তই বাহির করিয়া ফেলিলেন। উহার ভিতর যে সকল কাপড় পিরাণ প্রভৃতি ছিল তাহা এক একখানি করিয়া খুলিয়া ও ঝাড়িয়া দেখিলেন, কিন্তু ওই হার প্রাপ্ত হইলেন না। যাহা উহার ভিতর নাই, উহা হইতে যাহা অপহৃত হইয়াছে তাহা আর উহার ভিতর কিরূপে প্রাপ্ত হইবেন? 

একবার তাঁহার মনে হইল, তবে কি ওই হার ভুলক্রমে তিনি বাড়িতেই ফেলিয়া আসিয়াছেন? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল তাহা কখনই হইতে পারে না; তিনি নিজহস্তে যাহা ব্যাগের মধ্যে রাখিয়াছেন তাহা হইলে প্রস্তরের ক্ষুদ্র পোঁটলাটীও সেই সঙ্গে ফেলিয়া আসিতেন; তাঁহার কোন প্রকারেই ভুল হয় নাই, ওই হার নিশ্চয়ই ওই ব্যাগ হইতে অপহৃত হইয়াছে। তিনি এক বার মনে করিলেন চারুবালাকে পত্র লিখিবার সময় তাঁহাকে ওই হারের কথা লিখিলে হয় না? যদি ভুলক্রমেই ওই হার তাঁহার ঘরে ফেলিয়া আসিয়া থাকেন তাহা হইলে নিশ্চয়ই তিনি তাহা প্রাপ্ত হইয়াছেন। আবার ভাবিলেন যদি চারুবালা উহা পাইয়াই থাকেন তাহা হইলে নিশ্চয় তিনি তাঁহাকে লিখিবেন। আর তিনি পাইবেনই বা কোথা হইতে? যখন তিনি নিজ হস্তে করিয়া উহা তাঁহার ব্যাগের ভিতর রাখিয়া দিয়াছেন, তখন উহা চারুবালার পাইবার কোন রূপ সম্ভাবনা নাই। এখন কথা হইতেছে উহা চুরি হইল কোথা হইতে? ব্যাগের চাবি তাঁহার নিকট। বাড়ী হইতে কলিকাতায় আসা পর্যন্ত ওই ব্যাগ বরাবরই তাঁহার নিকট ছিল। সুতরাং রাস্তায় উহা কোনরূপেই অপহৃত হইতে পারে না। যদি রাস্তা হইতে উহা অপহৃত হইত তাহা হইলে ব্যাগের ভিতর হইতে কেবল মাত্র হার কখনই যাইত না, ব্যাগ সমেত অপহৃত হইত। এ হার নিশ্চয়ই তাহার আফিস ঘর হইতে অপহৃত হইয়াছে। সমস্ত রাত্রি ওই ব্যাগ আফিস ঘরে ছিল, সুতরাং ব্যাগ হইতে হার বাহির করিয়া লইবার সুযোগও যথেষ্ট ঘটিয়াছিল কিন্তু যে ব্যক্তি ওই ব্যাগ হইতে ওই হার অপহরণ করিয়াছে, সে ব্যাগের চাবি পাইল কোথা হইতে? তবে বাড়ীর ভৃত্যদিগের কাহার দ্বারা যদি ওই হার অপহৃত হইয়া থাকে তাহা হইলে তাহার চাবি তাহারা একেবারে যে না পাইতে পারে এরূপ নহে। এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা তাঁহার মনে আসিয়া উদয় হইল। 

তিনি সেই কারিকরকে সেই সময় বিদায় দিয়া, এরূপ অবস্থায় এখন কি কৰ্ত্তব্য তাহাতেই চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে সাব্যস্ত হইল যে যখন অধিক টাকা মূল্যের হারছড়াটি অপহৃত হইয়াছে, তখন স্থির ভাবে বসিয়া থাকা কৰ্ত্তব্য নহে, পুলিসে সংবাদ দেওয়া হউক, তাঁহারা আসিয়া যাহা কর্তব্য তাহা করুন। 

আরও সাব্যস্ত করিলেন চারুবালাকে এ সংবাদ দেওয়া হইবে না, পুলিস অনুসন্ধান করিয়া যদি ওই হার বাহির করিতে পারেন ভালই নতুবা ওই প্রকারের আর একছড়া হার প্রস্তুত করিয়া চারুবালাকে প্রদান করা যাইবে। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া রাজীবলোচন দুইখানি পত্র লিখিলেন। একখানি লিখলেন স্থানীয় পুলিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে, তাহাতে কেবল এই মাত্র লিখিত হইল যে, আমার অফিস ঘরের মধ্যস্থিত একটি ব্যাগের ভিতর হইতে এক ছড়া মূল্যবান মুক্তার মালাখানি অপহৃত হইয়াছে। আপনি আসিয়া ইহার আবশ্যকীয় অনুসন্ধান করিবেন আপনি এখানে আসিলে ইহার সমস্ত ঘটনা আমি আপনাকে বলিব । 

দারোগার দপ্তর ॥ তৃতীয় খণ্ড 

॥ ৬২৭ 

অপর পত্রখানি লিখিলেন চারুবালাকে। তাহাকে যেরূপ সংক্ষেপে পত্র লিখিলেন ওরূপ সংক্ষিপ্ত পত্ৰ তিনি চারুবালাকে ইতিপূর্ব্বে আর কখনও লেখেন নাই। তিনি লিখিলেন : 

প্রিয় চারুবালা- 

আমি কলিকাতায় আসিয়া পৌঁছিয়াছি, তুমি কেমন থাক মধ্যে মধ্যে আমাকে লিখিবে। 

তোমার রাজীবলোচন 

প্রথম পত্রখানি একজন লোক দিয়া থানায় পাঠাইয়া দিলেন, দ্বিতীয় পত্রখানি ডাকযোগে প্রেরণ করিলেন। নিজে তাঁহার আফিস ঘরে বসিয়া যে পুলিস কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিতে আসিবেন তাঁহার অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। 

রাজীবলোচনের পত্র পাইবামাত্র থানায় একজন কর্ম্মচারী সেই হার চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত রাজীবলোচনের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যেরূপ অবস্থায় ওই হার অপহৃত হইয়াছে তাহার সমস্ত অবস্থা রাজীবলোচন সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে উত্তম রূপে বুঝাইয়া দিলেন। কর্ম্মচারী সমস্ত অবস্থা শুনিয়া ও ঘটনাস্থলের অবস্থা দেখিয়া বিশেষ কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না, একবার মনে করিলেন যে, হার অপহৃত হয় নাই। ভুলক্রমে তিনি উহা বাড়ীতে ফেলিয়া আসিয়াছেন। কখনও বা ভাবিলেন বাড়ী হইতে কলিকাতায় আসিবার কালীন সুযোগমত ওই হার কেহ তাঁহার ব্যাগ হইতে বাহির করিয়া লইয়াছে। পরিশেষে ইহাও ভাবিলেন যে রাজীবলোচনের আফিস ঘর হইতে ওই হার অপহৃত হইবার খুব সম্ভাবনা ও তাঁহার শেষ অনুমানই যদি প্রকৃত হয় তাহা হইলে বাড়ীর কোন পরিচারক ভিন্ন এই কার্য্য আর কাহার দ্বারা হয় নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া বাড়ীর সমস্ত পরিচারকদিগকে দেখিলেন ও উপস্থিত মত জিজ্ঞাসাবাদও করিলেন, কিন্তু কাহারও নিকট হইতে কোন কথা অবগত হইতে পারিলেন না। 

এইরূপে সেই বাড়ীর ভিতর সেই সময় যে সকল অনুসন্ধান করিবার আবশ্যকতা তিনি বিবেচনা করিলেন, তাহা শেষ করিয়া তিনি রাজীবলোচনের বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন এই হার যেই অপহরণ করুক না কেন তাহাকে উহা বিক্রয় করিতেই হইবে, বাজারে ওই হার বাহির হইলে যাহাতে তাহার সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায়, এখন তাহারই চেষ্টা দেখা কৰ্ত্তব্য। 

কর্মচারীর কথায় রাজীবলোচন কোন কথা কহিলেন না। কর্ম্মচারী বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

চারুবালা রাজীবলোচনের পত্র পাইয়া যে কতদূর নিশ্চিত হইলেন, তাহা অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে। এরূপ দুই ছত্রের পত্র ইতি পূর্ব্বে চারুবালা রাজীবলোচনের নিকট হইতে আর কখনও প্রাপ্ত হন নাই। ওই পত্র পাঠ করিয়া চারুবালার অন্তরে প্রথমতঃ একটু রাগের সঞ্চার হইল কিন্তু পরক্ষণেই তিনি তাহা সংবরণ করিয়া ফেলিলেন, রাগের পরিবর্তে দুঃখ আসিয়া তাঁহার হৃদয় পূর্ণ করিল, কিন্তু তাঁহার মনে হইল বাড়ী আসিবার নিমিত্ত তাঁহার আফিসের দুই তিন দিন কার্য্যের বিশেষ ক্ষতি হওয়ায়, তিনি সেই স্থানে গমন করিয়া পরের কার্য্যের ঝঞ্ঝাটে অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন বলিয়াই, তাঁহার নিকট হইতে যেরূপ পত্রের প্রত্যাশা করা যাইতে পারে, সেরূপ পত্র তিনি লিখিয়া উঠিতে পারেন নাই বলিয়াই, ওইরূপ অতি সংক্ষিপ্ত পত্র লিখিয়াছেন। দুই এক দিবস গত হইলেই, যখন তিনি সময় পাইবেন তখন তিনি আমাকে নিশ্চয়ই পত্র লিখিবেন। তিনি যেরূপ ভাবে আমাকে পত্র লিখিয়াছেন, আমিও ঠিক সেইরূপ ভাবে তাহার উত্তর প্রদান করিব, দেখি ইহাতেই বা তিনি কি ভাবেন? এই বলিয়া তিনি নিম্নলিখিত রূপ একখানি পত্ৰ তাঁহাকে লিখিলেন। 

স্বামিন! 

আপনার দুই ছত্রের এক পত্র পাইয়াছি। এখানে নতুন আর কোন সংবাদ নাই। আমার শ্বশুর শাশুড়ি ভাল আছেন। 

চিরাসুগৃহীতা দাসী 

চারুবালা 

এইরূপ পত্র লিখিবার পর রাজীবলোচন তাঁহাকে কিরূপ পত্রাদি লিখেন তাহা দেখিবার নিমিত্ত চারুবালা আশা পথে চাহিয়া, ক্ৰমে দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। ক্রমে দিনের পর দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল, সপ্তাহের পর সপ্তাহও চলিয়া গেল, কিন্তু চারুবালা রাজীবলোচনের কোন পত্রাদি পাইলেন না। ফলে তিনি অস্থির হইয়া পড়িতে লাগিলেন, ভাবিলেন হয় ত আমার পত্র পাইয়া তিনি রাগ করিয়াছেন, তাই আমাকে আর কোন পত্র লিখিলেন না। আবার ভাবিলেন, কলিকাতায় গিয়ে হয়তো তিনি অতিশয় অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন, তাই পত্র লিখিতে পারেন নাই, নতুবা আজ কুড়ি দিবস হইল একখানি পত্র লিখিতে যে তিনি সময় পান নাই, ইহা কখনই সম্ভবপর নহে। চারুবালা এতদিবস মনের কষ্ট মনে রাখিয়া কোনরূপে দিন যাপন করিতেছিলেন, কিন্তু আর তিনি মনকে কোনরূপেই স্থির রাখিতে পারিলেন না। একদিবস সময় মত তিনি তাঁহার শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কলিকাতা হইতে কোন পত্ৰাদি আসিয়াছে কি?” উত্তরে রাজীবলোচনের মাতা কহিলেন চিঠি আসিয়াছে বৈ কি। রাজীব এখান হইতে যাওয়ার পর তোমার শ্বশুরকে দুই-তিনখানি পত্র লিখিয়াছেন। কালও একখানি পত্র পাওয়া গিয়াছে, তিনি ভাল আছেন, কেন মা, তোমাকে কি রাজীব কোন পত্রাদি লিখে নাই?” 

উত্তরে চারুবালা কহিলেন “এই স্থান হইতে কলিকাতায় গমন করিবার পরই একখানি পত্র পাইয়াছিলাম, তাহার পর আমি আর কোন পত্র পাই নাই।” 

রাজীবলোচনের মাতার কথা শুনিয়া চারুবালা আর কোন কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন না। একটি কার্য্যের অছিলা করিয়া তিনি সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলেন ও নিজের শয়ন-ঘরে প্রবেশ করিয়া পালঙ্কের উপর স্থির ভাবে শয়ন করিলেন। 

সেই সময় চারুবালার হৃদয়ের মধ্যে যে কিরূপ ভয়ানক তরঙ্গ উঠিয়াছিল তাহার বর্ণন করা লেখকের সাধ্য নহে, কোন পাঠক সেই প্রবল তরঙ্গের বিষয় কিছুমাত্র সহজে অনুমান করিতে পারিবেন না, কিন্তু পাঠিকাগণের মধ্যে যদি কাহার অদৃষ্টে কখনও সেইরূপ ঘটনা ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে তিনি তাহার কিয়ৎ পরিমাণ উপলব্ধি করিতে পারিবেন। 

চারুবালা শুইয়া শুইয়া কত কি ভাবিলেন, ও পরিশেষে মনে করিলেন উকীলগণের মধ্যে অনেকে অনেক অর্থ যেমন উপার্জ্জন করিয়া থাকেন, কলিকাতায় তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকে সেই অর্থ নানারূপে অপব্যয়ও করিয়া থাকেন। এ কথা আমি অনেক সময় শুনিয়াছি। অনেকে কেবল অর্থ নষ্ট করিয়াই নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারেন না, নিজের স্বাস্থ্যকেও সেই সঙ্গে বিসর্জ্জন দিয়া থাকেন। অনেকে কুহকিনীগণের মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, আপন পিতা-মাতা ও স্ত্রীকে পৰ্য্যন্ত ভুলিয়া, তাহাদিগকে লইয়াই উন্মত্ত হইয়া পড়েন ও উপার্জিত সমস্ত অর্থ তাহাদিগকে প্রদান করিয়া নিজের পরিণামের বিশেষ অনিষ্ট সাধন করিয়া থাকেন। 

চারুবালা মনে করিলেন, বাড়ী হইতে গমন করিবার পর এবার কি তিনি সেইরূপ প্রকৃতির কোন উকীলের সহিত মিলিত হইয়া কোন নিন্দনীয় স্থানে গমন করিতে আরম্ভ করিয়াছেন ও কোন কুহকিনীর প্রণয়ে পতিত হইয়া তাঁহাকে ভুলিয়া গিয়া নিজের ইহকাল ও পরকাল নষ্ট করিতে বসিয়াছেন? নতুবা এরূপ ভাবে একেবারে তাঁহাকে বিস্মিত হইবার ত কথা নহে। 

চারুবালার হৃদয়ে এইরূপ যত কথা উদয় হইতে লাগিল ততই তাঁহার চক্ষু দিয়া জলধারা পতিত হইয়া, তাঁহার উপাধান পৰ্য্যন্ত ভিজিয়া যাইতে লাগিল। আবার পরক্ষণেই তিনি আপনাকেই বলিতে লাগিলেন “আমি কি মহাপাতকী, আপন দেবোপম স্বামীর প্রতি আমি অবিশ্বাস করিতেছি। অনেক তপস্যা করিলেও যেরূপ স্বামী প্রাপ্ত হওয়া যায় না, বিনা তপস্যায় আমি সেইরূপ স্বামীর ভালবাসা পাইয়াছি কিন্তু এখন আমি তাঁহার দেব দুর্লভচরিত্রের উপর নানারূপ সন্দেহ করিয়া যে মহাপাপের সঞ্চয় করিতেছি তাহার প্রায়শ্চিত্ত এ জগতে কিছুতেই হইতে পারে না। 

চারুবালা যখন এইরূপ নানা চিন্তায় নিমগ্না ছিলেন সেই সময় একটি পরিচারিকা একখানি পত্র হস্তে তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিল। 

পরিচারিকার হস্তে একখানি পত্র দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন উহা কাহার চিঠি?। 

উত্তরে পরিচারিকা কহিল “ইহা আপনার পত্র, একজন ডাকওয়ালা ইহা এখনই দিয়া গেল।” 

চারুবালা পত্রখানি আপন হস্তে গ্রহণ করিলেন ও দেখিলেন উহা রাজীবলোচনের হস্ত লিখিত, তাঁহারই পত্র বিশেষ আগ্রহের সহিত তিনি উহা খুলিলেন, ও পাঠ করিলেন ইহাও একখানি নিতান্ত সংক্ষিপ্ত পত্র, দুই চারি ছত্র ভিন্ন ইহাতে অধিক কিছু লেখা নাই। পত্রখানি পাঠ করিয়া চারুবালা আরও মর্মাহত হইলেন, উহাতে কেবল এই মাত্র লেখা আছে। 

প্রিয় চারুবালা! 

বিশেষ কাজের ঝঞ্ঝাটে আমি তোমাকে অনেক দিবস পত্র লিখিতে পারি নাই, ও সময়মত তোমার পত্রেরও কোন উত্তর দিতে পারি নাই, অপরাধ মাপ করিও। একটু সাবকাশ পাইলেই তোমাকে বিস্তারিত পত্রে সমস্ত লিখিব এখানে আমি ভাল আছি। 

তোমার শ্রী রাজীবলোচন 

চারুবালা রাজীবলোচনের চরিত্রের উপর যেরূপ সন্দেহ করিতেছিলেন, অথচ যে সন্দেহকে তাঁহার মনে স্থান দিতে পারিতেছিলেন না সেই সন্দেহ পুনরায় তাঁহার হৃদয়ে আসিয়া উপস্থিত হইল, সেই সন্দেহকে তিনি হৃদয় হইতে বিতাড়িত করিবার অনেক চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে সমর্থ হইলেন না। সেই সময় একবার তাঁহার মনে হইল, এবার তিনি আমার মুক্তার হার-ছড়াটি লইয়া যাইবার নিমিত্ত এত ব্যস্ত হইলেন কেন? তিনি আমাকে দুইখানি পত্র লিখিয়াছেন কিন্তু ওই হার সম্বন্ধে ত কোন কথা লিখেন নাই। উহা ত তিনি কাহাকেও প্রদান করেন নাই? কাহাকে প্রদান করিবার নিমিত্ত ওই হার তিনি আমার নিকট হইতে মেরামতের ভান করিয়া লইয়া যান নাই ত? না, তাহা কখনই হইতে পারে না। আমার হৃদয় পাপে ভরা, তাই আমি তাঁহার উপর এরূপ সন্দেহ করিতেছি। যে স্বামীর চরিত্রের উপর সন্দেহ করে, বা অবিশ্বাস করে সে স্ত্রীর ইহকালও নাই পরকালও নাই। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

তারাবাই সোণাগাছির একজন প্রসিদ্ধ নর্ত্তকী ও গায়িকা। আজ তাহার ঘরে গানবাজনার মহাধূম পড়িয়া গিয়াছে। মহাধূমধামের সহিত নৃত্যগীত হইলেও, কোন নূতন ধনবান লোকের সেই স্থানে সমাগম হয় নাই। কোন বড়লোকের ছেলে হঠাৎ কাপ্তেন হইয়া এই সকল স্থানে যেরূপে অর্থাদি নষ্ট করিয়া থাকে সেইরূপ কাহাকেও আজ ওই স্থানে দৃষ্ট গোচর হইতেছে না। থাকিবার মধ্যে কেবল বলাইচন্দ্র তারাবাইর সম্মুখে একটি তাকিয়ায় ঠেস দিয়া বসিয়া তাহার নৃত্য দর্শন ও তাহার গীত এক মনে শ্রবণ করিতেছে। 

যে সময় বলাইচন্দ্ৰ সেই স্থানে বসিয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতেছিল, সেই সময় রাত্রি একটা বাজিয়া গিয়াছিল। ও স্থানের অবস্থা দেখিয়া অনুমান হয়, সন্ধ্যার পর হইতে ওই স্থানে ওইরূপ আমোদ-প্রমোদ চলিতেছিল; যাহাদিগের জন্য এই আমোদ-প্রমোদের অবতারণা তাঁহারা রাত্রি বারটার পরই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন বলাইচন্দ্ৰ আসিয়া তাঁহাদিগকে দেখিতে পায় নাই, এখন বলাইচন্দ্র একাই সেই স্থানে বসিয়া, সেই নৃত্যগীতে যোগ দিয়াছে। এইরূপে কিয়ৎক্ষণ নৃত্যগীতে বলাইচন্দ্রকে সন্তুষ্ট করিয়া, তারাবাই নৃত্যগীত বন্ধ করিয়া, বলাইচন্দ্রের সহিত হাসি ঠাট্টা ও বাক্যালাপ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

বলাইচন্দ্র যে কে, তাহার একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই স্থানে পাঠকগণকে প্রদান করা কর্তব্য। 

বলাইচন্দ্র রাজীবলোচনের একজন প্রিয় খানসামা। কাপড় কোঁচাইতে, তেল মাখাইতে, গা হাত পা টিপিতে বলাইচন্দ্র একরূপ সিদ্ধ হস্ত তাহার উপর রাজীবলোচন তাহাকে যখন যে কাৰ্য্য বলিয়া থাকেন তখনই সে তাহা সম্পন্ন করিয়া থাকে। কেবল এই কার্য্য করিয়াই, বলাইচন্দ্র দিন অতিবাহিত করেন। তাঁহার যে সকল মক্কেল বাড়ীতে আসে, বলাইচন্দ্র তাহাদিগকেও বিশেষরূপে যত্ন করিয়া থাকে। তদ্ব্যতীত বলাইচন্দ্র রাজীবলোচনের সহিত হাইকোর্টেও গমন করে, সেই স্থানে তাঁহার উপস্থিত মত কার্য্য করিয়া পুনরায় তাঁহার সহিত ফিরিয়া আসে। যে পর্য্যন্ত রাজীবলোচন শয়ন না করেন সে পর্যন্ত বলাইচন্দ্র তাঁহার সম্মুখ ছাড়া হয় না। 

বলাইকে রাজীবলোচন ভালবাসেন বলিয়া সে বেশ দু পয়সা রোজগার করে। নিয়মিত বেতন ও বক্‌শিস প্রভৃতি ব্যতীত রাজীবলোচনের মক্কেলগণের নিকট হইতেও সে দশ টাকা পাইয়া থাকে, এইরূপে বলাই যে সকল অর্থ উপার্জ্জন করিয়া থাকে, তাহার সমস্তই সে ব্যয় করে তারাবাইর গৃহে। রাজীবলোচন শয়ন করিবার পর তাঁহারই কাপড় প্রভৃতি পরিয়া বলাইচন্দ্র বাহির হইয়া যায়, সমস্ত রাত্রি আমোদ-আহ্লাদ করিয়া, রাজীবলোচন শয্যাত্যাগ করিবার পূর্ব্বেই সে ফিরিয়া আসে। 

বলাইচন্দ্র যতই কেন উপার্জ্জন করুক না সোণাগাছির একটি বাইজির খরচ চালান তাহার পক্ষে বিশেষ কষ্টকর। যে সকল স্থানে ধনবান লোক তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব খরচ করিয়াও দীর্ঘকাল স্থান পায় না, যে স্থানে রাজা, মহারাজাগণও সময়ে তাড়িত হইয়া থাকেন, সেই স্থানে বলাই তাহার সমস্ত উপার্জিত অর্থ প্রদান করিয়া কয়দিবস তাহাদিগের মন রক্ষা করিতে পারে! বলাই যখন দেখিল যে তাহার উপার্জিত অর্থে আর তারাকে সন্তুষ্ট করিতে পারে না তখন কাজেই তাহাকে অপর উপায় দেখিতে হইল। সুযোগমতো মনিবের অর্থ চুরি করিতে আরম্ভ করিল। যে সকল দ্রব্য চুরি করিলে রাজীবলোচন সহজে জানিতে না পারেন, প্রথম প্রথম তাহারই উপর বলাইয়ের হাত পড়িল। পরিশেষে যতই টাকার আবশ্যক হইতে লাগিল, বলাইয়ের চুরি করিবার মতিগতি ততই বাড়িতে লাগিল। 

যে ব্যাগ হইতে মুক্তাহার অপহৃত হইয়াছিল, সেই ব্যাগটি রাজীবলোচন সৰ্ব্বদাই হাইকোর্টে লইয়া যাইতেন, সেই স্থানের উপার্জিত অর্থাদি উহার ভিতর রাখিতেন ও বাসায় আসিয়া উহা হইতে সেই সমস্ত অর্থ বাহির করিয়া লইতেন। ওই ব্যাগ হইতে দুই-চারি টাকা বাহির করিয়া লইলে রাজীবলোচন তাহা জানিতে পারিতেন না। বলাই ওই ব্যাগের একটি চাবি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিল। সময় সময় সুযোগমত ওই ব্যাগ খুলিয়া সে অর্থাদি বাহির করিয়া লইত। 

রাজীবলোচনের বাড়ী হইতে আসিবার পর যে রাত্রিতে ওই ব্যাগ তাঁহার আফিস ঘরে রাখা ছিল সেই রাত্রিতে বলাই ওই ব্যাগ খুলিয়া সেই মুক্তাহার বাহির করিয়া লয়, ও পুনরায় বাক্সটিতে পূর্ব্বের ন্যায় চাবি বন্ধ করিয়া রাখে, সুতরাং পরদিবস রাজীবলোচন যখন ওই হারের অনুসন্ধান করেন সেই সময় উহা আর পাওয়া যায় না। 

যে রাত্রিতে তারাবাইর গৃহে আমোদ-প্রমোদে বলাই উন্মত্ত ছিল সেই রাত্রিতে, বলাই ওই হার- ছড়াটি লইয়া তারাবাইর গৃহে গমন করে তখন সে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হয়, তখন অপরাপর ব্যক্তিগণ, যাহারা সেই স্থানে আমোদ-আহ্লাদ করিতে গমন করিয়াছিল তাহারা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছিল, তারাবাইও তাহার মজলিস ভাঙ্গিবার উৎযোগ করিতেছিলেন। বলাই সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া তাহার আনীত সেই মুক্তাহার তাহাকে অর্পণ করিল দেখিয়া তারা বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন ও সেই হার নিজের গলায় পরিয়া পুনরায় নৃত্যগীত আরম্ভ করিয়া বলাইয়ের মনস্তুষ্টি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

কিয়ৎক্ষণ পরে নৃত্যগীত বন্ধ হইল, অন্য রাত্রে যেরূপ ভাবে বলাই সেই স্থানে অতিবাহিত করিত আজ সে তাহা অপেক্ষা অধিক মনের সুখে রাত্রি অতিবাহিত করিল। তারা সমস্ত রাত্রি বিশেষ যত্নের সহিত তাহার মনস্তুষ্টি করিল। তারার নিকট সেই দিন হইতে বলাইয়ের খাতির বাড়িল। তারা বুঝিতে পারিল বলাইয়ের দ্বারা তাহার অনেক কার্য্য সাধিত হইবে। সুতরাং পূর্ব্বের অপেক্ষা সে বিশেষরূপে বলাইকে যত্ন করিতে লাগিল। এইরূপ ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যে গ্রামে রাজীবলোচনের বাসস্থান, তাহার নিকটবর্ত্তী একখানি গ্রামে চারুবালার মাতুল আশ্রম, তাঁহার মাতামহের অবস্থা পূর্ব্বে ভাল ছিল না কিন্তু তাঁহার মাতুলগণ কলিকাতায় কারবার করিয়া তাহাদিগের অবস্থার পরিবর্তন করিয়াছেন, ভালরূপ বাড়ী ঘর প্রস্তুত করিয়াছেন ও ক্রিয়াকর্ম্ম উপলক্ষে খরচপত্র আরম্ভ করিয়াছেন। 

চারুবালার বড়মামার জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহ উপলক্ষে তাঁহাদিগের বাড়ীতে খুব ধুমধাম পড়িয়া গিয়াছে, নৃত্যগীত গান বাজনার বিশেষরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছে বলিয়া চারুবালার বড়মামা নিজে চারুবালাকে তাঁহাদিগের বাড়ীতে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন। 

রাজীবলোচন বাড়ীতে না থাকায় রামগোবিন্দের মত লইয়া চারুবালার মাতুল তিন দিবসের নিমিত্ত চারুবালাকে তাঁহাদিগের বাড়ীতে লইয়া গেলেন। চারুবালার মনে বিশেষরূপ কষ্ট থাকিলেও নিজের মনের ভাব গোপন করিয়া লোকলজ্জার ভয়ে সাজিয়া গুছিয়া একজন পরিচারিকাকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার মাতুলের সহিত মাতুলালয়ে গমন করিলেন। 

যে দিবস তিনি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন সেইদিবস নাচ গাওনা প্রভৃতি কিছুই হইল না কেবল লোকজন খাওয়ান ও আত্মীয় কুটুম্বগণকে সমবেত করিতেই সে দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। পরদিবস হইতে নৃত্যগীত আরম্ভ হইবার উৎযোগ হইতে লাগিল। কলিকাতা হইতে তিন দল ভাল নর্তকী আসিবে, তাহারা তিন দিবস ওই স্থানে অবস্থিতি করিয়া নৃত্যগীত করিবে। কোথায় তাহাদিগের বাসস্থান দেওয়া হইবে, কি রূপে তাহাদিগকে অভ্যর্থনা করা হইবে, তাহা লইয়া পাড়ায় যুবকগণ ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। 

পরদিবস এক এক করিয়া তিনজন নর্তকী দলবলের সহিত ক্রমে কলিকাতা হইতে ওই গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাদিগের তিনজনের মধ্যে পাঠকগণের পূর্ব্ব পরিচিতা তারাবাইও একজন। 

সন্ধ্যার পর হইতেই নর্তকীগণ আসরে নামিলেন। পর্য্যানুক্রমে একে একে তিনজনেই নৃত্যগীত আরম্ভ করিলেন। অর্থাৎ প্রথমেই একজন উঠিয়া তাঁহার সাধ্যানুসারে শ্রোতৃবর্গকে সন্তুষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন, এইরূপে কিছুক্ষণ নৃত্যগীত করিয়া যখন তিনি ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন তখন সেই স্থানে উপবেশন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। অপর আর একজন নর্ত্তকী গাত্রোত্থান করিয়া দর্শকবৃন্দের মনস্তুষ্টি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এইরূপে তিনি যখন ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন তখন তৃতীয় নর্তকী গাত্রোত্থান করিলেন। তাহার পর পুনরায় প্রথম নর্তকী উঠিলেন, এইরূপে ক্রমে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। 

যেস্থানে নৰ্ত্তকীগণ নৃত্য করিতেছিলেন তাহার সন্নিকটে এক স্থানে চিক দিয়া ঘিরিয়া স্ত্রীলোকগণের বসিবার স্থান প্রস্তুত হইয়াছিল। বাড়ীর ও যত নিমন্ত্রিত গৃহস্থ স্ত্রীলোকগণ সেই স্থানে বসিয়া নৃত্যগীত দর্শন ও শ্রবণ করিতেছিলেন। বলা বাহুল্য যে চারুবালাও সেই স্থানের একটু স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। 

পাঠকগণ বিশেষরূপে অবগত আছেন যে কলিকাতায় নর্তকী ও গায়িকাগণ, নিজের কার্য্যে যতদূর পটু হউন বা না হউন, সাজসজ্জার দিকে তাঁহারা বিশেষরূপে দৃষ্টি রাখিয়া থাকেন। ভাল ভাল কাপড়, ভাল ভাল পোষাক নহিলে কোনরূপেই চলে না, তাহার উপর অলঙ্কারে সর্ব্ব শরীর ভূষিত করা চাই। যাঁহার সুবর্ণ অলঙ্কার নাই, গিল্টির গহনায় তাঁহারা তাঁহাদিগের শরীর ভূষিতা করিয়া থাকেন। সুতরাং যে সকল নর্তকীগণ সেই স্থানে নৃত্যগীত করিতে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই পরিচ্ছদ ও অলঙ্কারে উত্তমরূপে সুসজ্জিত হইয়া গিয়াছিলেন। তারাবাইর কয়েকখানি সোণার অলঙ্কার ছিল, অবশিষ্ট গিল্টি করা অলঙ্কার দ্বারা সে তাহার শরীর ভূষিতা করিয়াছিল। বলাইচন্দ্র তাঁহাকে যে মুক্তার মালাছড়াটি প্রদান করিয়াছিল, তাহাও পরিধান করিয়া তিনি সেই আসরে আসিয়া অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। ওরূপ মুক্তার মালা অপর নর্তকীদ্বয়ের ছিল না, সুতরাং সেই দিকে তাঁহাদিগের দৃষ্টি আকর্ষিত হইয়াছিল। যে সকল স্ত্রীলোক সেই স্থানে নর্তকীদিগের নিকটবর্ত্তী চিকের অন্তরালে বসিয়া নৃত্য দর্শন করিতেছিলেন তাঁহাদিগের দৃষ্টি ও ক্রমে তারাবাইর সেই মুক্ত-মালার উপর পতিত হইল। 

চারুবালার দৃষ্টি উহার উপর পতিত হইলে তিনি দেখিলেন ওই মুক্তার হার তাঁহারই মুক্তা-হারের ন্যায়, তাঁহার যে হার রাজীবলোচন মেরামত করিয়া দিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছিলেন, সেই হার ও তারাবাইর গলায় যে হার দুলিতেছিল, তাহা ঠিক এক প্রকারের; ইহা দেখিয়া চারুবালা ওই মুক্তাহার বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিলেন। যতই তিনি উহা দেখিতে লাগিলেন ততই তাঁহার মনে কেমন এক সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। তাঁহার নৃত্যগীতের দিকে আর লক্ষ্য রহিল না, তাঁহার কেবল লক্ষ্য রহিল সেই হারের দিকে। বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিতে দেখিতে তিনি দেখিতে পাইলেন তাঁহার হারের খামির যে যে স্থান হইতে প্রস্তর সকল খুলিয়া গিয়াছিল এ হারের খামিরও সেই সেই স্থানের প্রস্তর নাই। 

এবার কলিকাতায় যাইবার পর রাজীবলোচন চারুবালার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন তাহাতে সময় সময় তাঁহার মনে রাজীবলোচনের চরিত্র সম্বন্ধে অনেক কথা উদয় হইয়াছিল। কিন্তু সহজে তিনি সেই সকল কথা তাঁহার মনে স্থান দিতে পারিতেছিলেন না। আজ তারাবাইর গলায় ওই মুক্তাহার দেখিয়া তাঁহার মনে স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিল ওই মুক্তাহার তাঁহার, সুতরাং সে বিষয়ে তাঁহার কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না। আরও তাঁহার মনে হইল, তিনি সময় সময় যেরূপ অনুমান করিতেছিলেন তাহার কিছুমাত্র মিথ্যা নহে। রাজীবলোচনের পরকাল এই তারার ঘরে নষ্ট হইয়াছে। ইহারই জন্য রাজীবলোচন মেরামতের ভাণ করিয়া তাঁহার হার লইয়া গিয়াছেন ও ইহাকে প্ৰদান করিয়াছেন; এই জন্যই হার সম্বন্ধে তিনি কোন কথা লিখেন নাই। 

চারুবালা আরও মনে করিলেন, তাঁহার স্বামী কুপথাবলম্বী হইয়াছেন – হউন, অপরকে ভালবাসিয়াছেন – বাসুন, সৎপ্রবৃত্তির পরিবর্তে হৃদয়ে কুপ্রবৃত্তি ধারণ করিয়াছেন – করুন, কিন্তু যে হার চারুবালার গলায় এক দিবসের জন্যও ঝুলিয়াছে, তাহা একজন সামান্য বারবনিতার গলায় পরাইয়া দেওয়া তাঁহার কর্ত্তব্য হয় নাই। তাঁহার অর্থের অভাব নাই। যদি এইরূপ একছড়া মুক্তাহার তাঁহার নব প্রণয়িনীর গলায় দেখিয়া সুখানুভব করেন, তাহা হইলে তাহাকে আর এক ছড়া ওইরূপ মুক্তাহার প্রস্তুত করিয়া দিলেই পারিতেন। যে হার একবার পতিপ্রাণা কুলবধূর গলায় উঠিয়াছে, সেই হার কোন বিবেচনায় তিনি একজন বারবনিতার গলায় পরালেন? সেই হারের মর্য্যাদা রক্ষা না করিয়া কেন তাহাকে পাপ পঙ্কে নিমগ্ন করিলেন। 

চারুবালার নৃত্যগীত আর ভাল লাগিল না। তিনি সেই নর্তকীগণের দিকে, বিশেষ তারাবাইর দিকে আর চাহিতে পারিলেন না। উহাদিগের উপর তাঁহার কেমন একরূপ রাগের সঞ্চার হইল। ভাবিলেন দেশের যত অনিষ্ট হইয়া থাকে, ভাল লোকের যত সর্ব্বনাশ হইয়া থাকে, ইহারা তাহারই মূল। ইহারাই পতিপ্রাণা স্ত্রীর স্বামী বর্তমানেও তাঁহাকে বিধবা করিয়া তোলে। ইহারাই বৃদ্ধ পিতামাতার স্নেহ, যুবকগণের মন হইতে অন্তর্হিত করিয়া দেয়। ইহারাই ধনবানের সন্তানদিগকে পথের ভিখারি করিয়া তোলে। ধনবানের ধন ক্ষয় করিতে, জমিদারের জমীদারী নষ্ট করিতে, বিদ্বানের বুদ্ধি বিসর্জ্জন ঘটাইতে ইহারা যেরূপ পারদর্শী এক আদালত ছাড়া সে রূপ আর কেহ আছে কি না সন্দেহ? 

সেই সময় চারুবালার মনের ভাব যেরূপ পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল তাহাতে নৃত্যগীত আর তাঁহার ভাল লাগিল না। তিনি সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া একটি প্রকোষ্ঠে গিয়া শয়ন করিলেন। ওরূপ সময়ে তাঁহার শয়নের কারণ কেহ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, তাঁহাকে তিনি কহিলেন, হঠাৎ তাঁহার শরীর অসুস্থ বোধ হওয়ায় তিনি শয়ন করিয়াছেন, একটু সুস্থ হইলেই পুনরায় তিনি নৃত্যগীতের স্থানে গমন করিবেন। 

এইরূপ নিৰ্জ্জন গৃহে তিনি কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত করিলেন সত্য, কিন্তু তাঁহার হৃদয়ে যে অগ্নি জ্বলিতেছিল, তাহা কিছুতেই নিৰ্ব্বাপিত হইল না, তিনি পুনরায় সেই নৃত্যগীতের স্থানে গমন করিলেন, পুনরায় ফিরিয়া আসিলেন। এইরূপে বৃশ্চিক দংশনের ন্যায় যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, তিনি কোনরূপে সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

প্রায় ২০/২৫ দিন হইল মুক্তাহার অপহৃত হইয়াছে, পুলিস অনুসন্ধান করিয়া এপর্য্যন্ত তাহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারেন নাই, এরূপ অবস্থায় রাজীবলোচন চারুবালাকে আর কতদিবস তিমিরাচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারেন। তিনি মনে করিলেন যখন সেই হার আর পাওয়া গেল না তখন সেই রূপের আর এক ছড়া হার প্রস্তুত করিয়া চারুবালাকে দেওয়াই কৰ্ত্তব্য। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি পূৰ্ব্বকথিত সেই কারিকরকে পুনরায় ডাকাইলেন। তিনি আসিলে তাহাকে তাঁহার মনের ভাব ব্যক্ত করিলেন, ও তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেইরূপ মুক্তা প্রস্তরাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত বড়বাজারে গমন করিলেন। সেই স্থানে যে সকল ব্যক্তি মুক্তা বিক্রয় করিয়া থাকে, তাহাদিগের প্রত্যেকের নিকট গমন করিয়া বাছিয়া বাছিয়া নানা স্থান হইতে তাঁহার আবশ্যক মত সেই প্রকারের মুক্তা ও প্রস্তর সংগ্রহ করিলেন। এই কার্য্য করিতে তাঁহাকে সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিতে হইল। 

কারিকর তিন দিবসের মধ্যে সেইরূপ খামি প্রভৃতি প্রস্তুত করিয়া ও ওই সকল মুক্তাদ্বারা হার গাঁথিয়া প্রস্তুত করিল। চতুর্থ দিবসে ওই মুক্তাহার আনিয়া রাজীবলোচনের হস্তে প্রদান করিল। 

নূতন হার ছড়াটি হস্তগত হইলে রাজীবলোচন চারুবালাকে এক পত্র লিখিলেন। ইহা দুই ছত্রের পত্র নহে, তিনি পূর্ব্বে চারুবালাকে যে রূপ ভাবে পত্র লিখিতেন ইহা সেই প্রকারের পত্র। ওই পত্রে অনেক কথা লেখার পর পরিশেষে লিখিলেন, ৮/১০ দিবসের মধ্যে আমার বাড়ী যাইবার নিতান্ত ইচ্ছা আছে; সেই সময় তোমার হার আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। 

চারুবালা যখন এই পত্র প্রাপ্ত হইলেন, তখন তাঁহার মাতুলালয়ের কাৰ্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে, নর্তকীগণ আপনাপন স্থানে চলিয়া গিয়াছে। চারুবালাও তাঁহার শ্বশুরালয়ে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। 

এ পর্যন্ত চারুবালা নিতান্ত মনের কষ্টে কাল অতিবাহিত করিতেছিলেন। রাজীবলোচনের এই পত্রখানি পাইয়া তিনি কিয়ৎ পরিমাণে সুস্থা হইলেন, কিন্তু তাঁহার হারের কথা তিনি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না; একবার ভাবিলেন, যে হার রাজীবলোচন একবার তারাকে অর্পণ করিয়াছেন, সেই হার আবার তাঁহার নিকট আসিল কি প্রকারে? তবে কি সেই হার তিনি তাহাকে একেবারে প্রদান করেন নাই? কেবল ব্যবহার করিতে দিয়াছিলেন, ও তাহার নিকট হইতে উহা পুনরায় ফিরাইয়া লইয়াছেন? ইহা কখন সম্ভবপর নহে, বেশ্যারা যে অলঙ্কার একবার প্রাপ্ত হয় সেই অলঙ্কার তাহারা কখনই প্রত্যর্পণ করে না। তবে যে হার তিনি তারার গলায় দেখিয়াছিলেন সেই হার কি তাঁহার নহে? সেই প্রকারের আর এক ছড়া হার পরিয়া কি তারা তাঁহার মাতুলালয়ে আগমন করিয়াছিল? না, ইহা কখনই হইতে পারে না। ওই হার যে চারুবালার সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। স্ত্রীলোকগণ তাহাদিগের নিজের গহনা যেমন চিনিতে পারে তেমন আর কেহই পারে না। 

‘রাজীবলোচনের পত্র পাইবার পর চারুবালার মনের ভাব অনেক পরিবর্ত্তিত হইল, পরিশেষে মনে করিলেন, “আমি না বুঝিয়া আমার স্বামীর উপর নানারূপে সন্দেহ করিয়া কি মহাপাপ সঞ্চয় করিয়াছি; এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহা কখনই হইতে পারে না, যাঁহার চরিত্রের সহিত অপর লোকের চরিত্রের তুলনা হয় না, তাঁহার চরিত্র এত অল্প সময়ের মধ্যে কখনই পরিবর্তিত হইতে পারে না। এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি, যাহাকে তিনি আমার মুক্তাহার মেরামত করিতে দিয়াছিলেন তারাবাইর সহিত তাহারই বোধ হয় কোনরূপ সংশ্রব আছে, তাহারই নিকট হইতে তারাবাই ওই হার কোনরূপে গ্রহণ করিয়া আপনার গলদেশ সুসজ্জিত পূর্ব্বক এখানে আসিয়াছিল। সেই সময় ওই হারের কিছুমাত্র মেরামত হয় নাই, এখান হইতে প্রত্যাগমন করিবার পর বোধ হইতেছে সেই হার মেরামত হইয়াছে, বা হইতেছে, ওই হার প্রাপ্ত হইলেই তিনি উহা লইয়া বাড়ীতে আসিবেন বলিয়া বোধ হইতেছে। যদি আমার এই শেষ অনুমানই সত্য হয় তাহা হইলে যে হার একবার বারবনিতার কণ্ঠে উঠিয়াছে, সেই হার আমি নিজ কণ্ঠে কখনই ধারণ করিতে পারি না। সে যাহা হউক তিনি প্রত্যাগমন না করিলে, বা তাঁহার নিকট হইতে ইহার সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে না পারিলে আমি ইহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তিনি শীঘ্রই বাড়ী আসিবেন লিখিয়াছেন, তিনি আসিলেই তাঁহার সংক্ষিপ্ত পত্র লিখিবার কারণ অবগত হইতে পারিব; তখন আমার পাপ মনের সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া যাইবে। স্বামীর চরিত্রের উপর মিথ্যা সন্দেহ করিলে যে মহাপাপ হয় তাহার কোনরূপ প্রায়শ্চিত্ত আছে কি না এখন তাহাই দেখা যাউক। 

চারুবালার মনে পরিশেষে এইরূপ চিন্তা আসিয়া উদয় হইল তাঁহার মনের যে যন্ত্রণায় তিনি অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাহার কিয়ৎ পরিমাণে উপশম হইল, তিনি রাজীবলোচনের প্রত্যাগমনের প্রত্যাশার আশা পথ চাহিয়া দিন যাপন করিতে লাগিলেন। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

রাজীবলোচনের বাড়ী হইতে তাঁহার এক ছড়া মূল্যবান মুক্তাহার অপহৃত হইয়াছে, এ কথা জনৈক ডিটেকটিভ কর্ম্মচারী জানিতে পারিয়াছিলেন। স্থানীয় পুলিস-কর্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়া যখন ইহার কোনরূপে সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন না, সেই সময় এই হার চুরির গুপ্ত অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত জনৈক ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সুতরাং তিনি উহার সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিয়াছিলেন। জনৈক ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী যে ভিতর ভিতর ওই হার চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেছিলেন তাহা রাজীবলোচনও অবগত ছিলেন না। 

ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী কিরূপে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করেন, বা কিরূপ উপায় অবলম্বনে তিনি ওই হারের সংবাদ প্রাপ্ত হন, তাহা বর্ণন করিতে হইলে পাঠকগণের ধৈর্য্যচ্যুতি হইবার সম্ভাবনা সুতরাং তাহা পরিত্যাগ করিয়া কিরূপে তিনি অপহৃত হার পুনরুদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন কেবল তাহাই এই স্থানে বিবৃত হইল। 

কয়েক দিবস অনুসন্ধানের পর ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী সংবাদ পাইয়াছিলেন যে রাজীবলোচনের গৃহ হইতে যেরূপ মুক্তাহার অপহৃত হইয়াছে সেইরূপ এক ছড়া মুক্তাহার তারাবাই আজ কয়েক দিবস হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন। এই সংবাদ পাইয়া কৰ্ম্মচারী তারাবাইর সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে তাহার বাড়ীতে গমন করেন, ও সেই স্থানে জানিতে পারেন যে তারাবাই বাড়ীতে নাই, নৃত্যগীত করিবার নিমিত্ত তিনি কোন পল্লিগ্রামে গমন করিয়াছেন কিন্তু কোন জিলার বা কোন গ্রামে গিয়াছেন তাহা বাড়ীর কেহ অবগত নহে বা বাড়ীর কোন লোক ইচ্ছা করিয়া তাহা বলিতেছে না, সুতরাং কর্ম্মচারী সেই সময় তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হন না। কোন্ দিবস বা কোন্ সময় তিনি প্রত্যাগমন করিবেন তাহারই উপর তিনি বিশেষরূপে লক্ষ্য রাখিয়া দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। 

সময়মত তারাবাই তাহার দলবলের সহিত প্রত্যাগমন করিয়া তাহার বাড়ীতে আসিয়া যেমন উপস্থিত হইলেন কর্ম্মচারীও অমনি সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও তারাকে কহিলেন, “আমি বিশেষ কোন কার্য্যের নিমিত্ত আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি।” 

তারা। আমি আজ কয়েক দিবস হইতে বাহিরে ছিলাম, সবে এইমাত্র ফিরিয়া আসিতেছি, আপনি অন্য সময় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। 

কৰ্ম্ম। আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত আপনার নিকট আগমন করিয়াছি অপর সময় আসিলে আমার সেই কাৰ্য্য সিদ্ধ হইতে অনেক বিঘ্ন ঘটিতে পারে, যাহা আমি জানিতে আসিয়াছি তাহা এখনই আমার জানিবার প্রয়োজন। 

এই বলিয়া কৰ্ম্মচারী তারার নিকট আপন পরিচয় প্রদান করিলেন। 

কর্মচারীর পরিচয় পাইয়া তারা যেন একটু ভীত হইলেন, কিন্তু মনের ভাব গোপন করিয়া কহিলেন “আপনি যে ডিটেক্‌টিভ পুলিস-কর্মচারী তাহা আমি আপনার কথায় কিরূপে বিশ্বাস করিতে পারি?” 

কৰ্ম্ম। আমার কথার উপর নির্ভর করিয়া আপনি অনায়াসেই বিশ্বাস করিতে পারেন। আর যদি নিতান্তই বিশ্বাস না করেন তাহা হইলে যাহাতে আমার কথায় আপনার বিশ্বাস হয় আমি তাহার উপায় করিতেছি। 

এই বলিয়া কৰ্ম্মচারী আপন পকেট হইতে একটি হুইসিল্ বা ছোট বাঁশি বাহির করিয়া একরূপ শব্দ করিলেন, দেখিতে দেখিতে একজন প্রহরী সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। যে সময় ডিটেকটিভ কর্ম্মচারী তাহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করেন সেই সময় হইতেই আদেশের প্রত্যাশায় সেই পুলিস প্রহরী তারার বাড়ীর বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল, বংশীধ্বনি শুনিয়া সে সেই কৰ্ম্মচারীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। 

সেই প্রহরী সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলে কর্ম্মচারী তাহাকে কহিলেন “আমার পরিচয় সম্বন্ধে যদি তোমার সন্দেহ না মিটিয়া থাকে তাহা হইলে তুমি ইহাকে জিজ্ঞাসা করিতে পার আমি কে?” 

তারা। আপনি কে তাহা জানিতে পারিয়াও যদি আমি এখন আপনার কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা না করি ও অপর সময় আপনাকে আসিতে বলি তাহা হইলে কি হইতে পারে? 

কৰ্ম্ম। কি হইতে পার তাহা আমি জানি না, যদি সেরূপ অবস্থা হয় তখন যেরূপ হইতে পারে তাহা দেখা যাইবে। আমি দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি মাত্র আমাকে তাহার উত্তর প্রদান করিলেই আমি এই স্থান হইতে চলিয়া যাইতে পারি, তুমিও অনায়াসে বিশ্রাম করিতে পার। 

তারা। আমাকে আপনি কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন? 

কৰ্ম্ম। আপনার নিকট এক ছড়া মুক্তার হার আছে? 

তারা। কাহার মুক্তার হার? 

কৰ্ম্ম। যাহারই হউক আপনার নিকট কোন মুক্তার হার আছে কি না? 

তারা। না। 

কৰ্ম্ম। আপনি বিশেষ বিবেচনা করিয়া আমার কথার উত্তর প্রদান করিবেন। আপনি মনে রাখিবেন আমি কেবল আপনার কথার উপর নির্ভর করিয়া এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব না। যদি আমি আপনার কথায় বিশ্বাস না করি বা যদি আমার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় তাহা হইলে জানিবেন যে এখনই আমি আপনার ঘর খানাতল্লাসি করিয়া দেখিব যে আপনার ঘরে কোন মুক্তার হার আছে কি না? আমি আপনাকে পুনরায় সতর্ক করিয়া দিতেছি যে আপনি আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করুন। 

তারা। আমার নিকট কোন মুক্তার হার নাই। 

কৰ্ম্ম। আমি প্রথমেই আপনার গহনার বাক্স দেখিব, যদি তাহার ভিতর কোন মুক্তার হার দেখিতে পাই তাহা হইলে আমি আপনাকে ধৃত করিয়া লইয়া যাইব আপনি বিশেষরূপ বিপদগ্রস্ত হইবেন, ইহা যেন আপনার মনে থাকে? 

তারা। আমার বাক্সে মুক্তার হার নাই তবে এক ছড়া মুক্তার মালা আছে। 

কৰ্ম্ম। মুক্তার হারই হউক বা মুক্তার মালাই হউক, যাহা আপনার নিকট আছে তাহা আনিয়া আমাকে দেখান। মুক্তার হার ও মুক্তার মালায় যে কি প্রভেদ তাহা ত আমি অবগত নহি। 

কর্মচারীর কথা শুনিয়া তারা তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল ও ক্ষুদ্র মোতির এক ছড়া একনর মালা বাহির করিয়া আনিয়া কৰ্ম্মচারীর হস্তে অর্পণ করিল। কর্ম্মচারী দেখিলেন তিনি যে হারের অনুসন্ধান করিতেছেন ও যে হারের সংবাদ ইতিপূর্ব্বে তিনি প্রাপ্ত হইয়াছেন ইহা সে হার নহে, অপর আর এক ছড়া মালা। কর্ম্মচারী মালাছড়াটি হাতে লইয়া তারার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন তারাও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। কর্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন এই মালাছড়াটি কোন বাক্সে ছিল। 

তারা একটি বাক্স দেখাইয়া দিয়া কহিল “মালা এই বাক্সের মধ্যে আমি রাখিয়া দিয়াছিলাম এখন ইহা হইতে বাহির করিয়া আপনাকে দিয়াছি।” 

কর্ম্মচারী ওই বাক্সটি খুলিলেন ও দেখিলেন ওই বাক্সের ভিতর অপর কোন দ্রব্যই নাই। ইহা দেখিয়া তিনি তারাকে জিজ্ঞাসা করিলেন আপনার অপর গহনাগুলি কোথায়? 

তারা। কোন্ গহনা? 

কৰ্ম্ম। তোমার নিজের গহনা। 

তারা। আমার বিশেষ গহনাপত্র নাই। 

কৰ্ম্ম। যাহা আছে তাহা কোথায়? যে সকল গহনা লইয়া তুমি বাহিরে গিয়াছিলে তাহা কোথায়? 

কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া তারা কোন উত্তর করিল না চুপ করিয়া কি ভাবিতে লাগিল? 

পোষাক পরিচ্ছদ প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি লইয়া তারা বাহিরে গিয়াছিল সেই সকল দ্রব্য ওই ঘরের এক প্রান্তে রাখা ছিল উহাদিগের যথাযথ স্থানে ওই সকল দ্রব্য রাখিবার সুযোগ সে পর্য্যন্ত ঘটিয়াছিল না। কর্মচারী সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলেন একটি ছোট ষ্টিলের বাক্স রহিয়াছে। উহা তাহাকে দেখাইয়া দিয়া কৰ্ম্মচারী কহিলেন “ইহার ভিতর কি আছে?” 

তারা। যে সকল গহনা সংগ্রহ করিয়া লইয়া আমি বাহিরে গিয়াছিলাম সেই সকল অলঙ্কার ইহার মধ্যে আছে। কর্ম্মচারী ওই বাক্সটি খুলিবার নিমিত্ত তারাকে কহিলেন, তারা তাহার বিশেষরূপ অনিচ্ছা সত্ত্বে ওই বাক্স খুলিলে কর্মচারী যে মুক্তামালার অনুসন্ধান করিতেছিলেন তাহা তাহার মধ্যে দেখিতে পাইলেন। 

ওই মালাছড়াটি হাতে লইয়া কৰ্ম্মচারী তাহাকে কহিলেন “তুমি যে বলিতেছিলে তোমার মুক্তাহার নাই। এই মুক্তাহার তোমার বাক্সের ভিতর কোথা হইতে আসিল?” 

কর্ম্মচারীর কথায় তারা কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া সেই স্থানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কর্মচারী দেখিলেন উহাকে এখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা অনাবশ্যক। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি তারাকে ধৃত করিয়া সেই মুক্তাহার সহিত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন ও যে থানা হইতে ওই মুক্তাহার চুরির অনুসন্ধান হইতেছিল সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী ওই মুক্তাহার দেখিয়াই বুঝিতে পারিলেন, ওই হার রাজীবলোচনের; তথাপি সন্দেহ দূর করিবার মানসে তিনি ওই হার লইয়া রাজীবলোচনের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই সময় রাজীবলোচন হাইকোর্টে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে ছিলেন। তিনি ওই মুক্তাহার দেখিয়াই চিনিতে পারিলেন ও কহিলেন এই হারই তাঁহার ব্যাগ হইতে অপহৃত হইয়াছিল। 

তারা থানায় আসিয়াই সমস্ত কথা স্বীকার করিয়াছিল ও কহিয়াছিল বলাইচন্দ্র তাহাকে ওই হার প্রদান করিয়াছে। যে সময় রাজীবলোচন তাঁহার হার দেখিতেছিলেন সেই সময় বলাইও সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, ওই হার দেখিয়াই বলাই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার উৎযোগ করিতেছিল। দারোগাবাবু প্রথম অনুসন্ধানের সময় হইতে তাহাকে চিনিতেন এবং থানায় তারার নিকট বলাইর নামও শুনিয়া ছিলেন, সুতরাং আর বলাইকে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতে হইল না, দারোগাবাবু কর্তৃক সে সেই স্থানেই ধৃত হইল। রাজীবলোচন তাঁহার সেই প্রিয় ভৃত্যের কথা শুনিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলেন। তখন জানিতে পারিলেন যাহাকে তিনি যথাসর্ব্বস্ব দিয়া বিশ্বাস করিতেন, যাহাকে তিনি অতিশয় ভালবাসিতেন, যাহাতে সে তাঁহার মক্কেলদিগের নিকট হইতে দুই টাকা উপার্জ্জন করিতে পারে তাহার দিকে সর্ব্বদা দৃষ্টি রাখিতেন, সেই বলাইর দ্বারা এই কাৰ্য্য হইয়াছে শুনিয়া তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন ও ভাবিলেন আজ-কাল সময়ের গতিক কি হইয়া দাঁড়াইল? যাহাকে বিশ্বাস করা যায় সেই অবিশ্বাসের কার্য্য করে! 

রাজীবলোচন বলাইর ব্যবহারে যেমন দুঃখিত হইলেন তাহার উপর সেইরূপ কুপিতও হইলেন ও দারোগাবাবুকে কহিলেন “ইহাকে কোনরূপেই অব্যাহতি দিবেন না যাহাতে এ দীর্ঘকাল কারাগারে বাস করে তাহার উত্তমরূপ ব্যবস্থা করিবেন। 

এই মোকদ্দমায় বলাইচন্দ্র বা তারাবাই প্রভৃতি কেহই নিষ্কৃতি পাইল না। বলাই চুরি করা অপরাধে এবং তারা চোরামাল জানিয়া ওই হার গ্রহণ করা অপরাধে অভিযুক্ত হইল। রাজীবলোচন প্রথমতঃ বলাইর উপর অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন কিন্তু মোকদ্দামার সময় যাহাতে সে অব্যাহতি পায় তাহার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিলেন। তারার বন্ধু বান্ধব অনেকগুলি ছিল, এবং তাহার কিছু অর্থও ছিল সুতরাং তারাকেও বাঁচাইবার জন্য অনেক চেষ্টা হইল, কিন্তু উভয়ের কেহই একেবারে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারিল না; তবে যে পরিমাণে উহাদিগের দণ্ড হওয়া উচিত ছিল তাহা অপেক্ষা অনেক কম দণ্ডে উহারা দণ্ডিত হইল। বলাইচন্দ্র ছয় মাসের জন্য এবং তারাবাই তিন মাসের জন্য কারাগারে গমন করিল। রাজীবলোচন আপনার হার প্রাপ্ত হইলেন ও দুই দিবসের মধ্যে সেই হার মেরামত করিয়া লইলেন। যে সকল প্রস্তর উহার খামির যে যে স্থান হইতে খসিয়া পড়িয়াছিল, সেই কারিকর সেই সকল প্রস্তর সেই সেই স্থানে বসাইয়া দিল ও আবশ্যক অনুযায়ী আরও যে সকল কার্য্য করিতে হইল তাহাও করিয়া ওই হার একরূপ নূতন করিয়া দিল। পূর্ব্বে যে হার রাজীবলোচন প্রস্তুত করাইয়াছিলেন তাহাও তাঁহার নিকট রহিল। 

নবম পরিচ্ছেদ 

মুক্তাহার মেরামত হইয়া আসিবার দুই দিবস পরে রাজীবলোচন তাঁহার দেশে গমন করিলেন। পূর্ব্বে তিনি মনে করিয়াছিলেন বাড়ী যাইবার সময় দুই ছড়া হারই তিনি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন ও দুই ছড়া হারই তিনি চারুবালাকে প্রদান করিবেন। কার্য্যে কিন্তু তাহা সেই সময় ঘটিয়া উঠিল না, কলিকাতা হইতে গমন করিবার কালীন নূতন প্রস্তুত হারছড়াটি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে রাজীবলোচন ভুলিয়া গেলেন। প্রস্তুত হইবার পর তিনি উহা যে বাক্সের ভিতর রাখিয়া দিয়াছিলেন, তাহার ভিতরই উহা রহিয়া গিয়াছিল। 

রাজীবলোচন যে সময় বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন সেই সময় রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছিল। তিনি বাড়ীতে আসিবেন এই সংবাদ রাধাগোবিন্দ পূর্ব্বেই প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার আহারীয় সমস্তই প্রস্তুত ছিল। তিনি গৃহে উপনীত হইয়া নিয়মিতরূপ পিতামাতার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, চারুবালাকেও একটু দূর হইতে দেখিতে পাইলেন, কিন্তু সে সময় তাঁহার পিতামাতা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন বলিয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে চারুবালার সহিত কোন কথা হইল না। আহারাদি সমাপন করিয়া তিনি আপন শয়ন-ঘরে গমন করিলেন। 

যে সময় রাজীবলোচন শয়ন করিতে গমন করিলেন সেই সময় চারুবালা সেই ঘরে উপস্থিত ছিলেন না। রাজীবলোচনের আহার করিবার পর তিনি আহার করিতে বসিয়াছিলেন, সুতরাং আহার করিয়া তাঁহার গমন করিতে একটু বিলম্ব হইল। 

রাজীবলোচন যে ব্যাগটি লইয়া বাড়ীতে গিয়াছিলেন, তাহা পূৰ্ব্বেই তিনি তাঁহার শয়ন ঘরে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, ওই ব্যাগের ভিতর চারুবালার সেই মেরামত করা মুক্তাহার রক্ষিত ছিল। সেই ঘরে গমন করিয়া রাজীবলোচন সেই মুক্তাহার ছড়াটি বাহির করিয়া আপনার বিছানার উপর রাখিয়া, চারুবালার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। 

প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে চারুবালা সেই ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চারুবালা তাঁহার বিছানার নিকট গমন করিবামাত্র রাজীবলোচন ওই মুক্তাহার ছড়াটি চারুবালার গলায় পরাইয়া দিলেন। যে সময় রাজীবলোচন ওই মুক্তাহার তাঁহার গলায় পরাইয়া দিয়াছিলেন সেই সময় চারুবালা একটু অন্যমনস্ক ছিলেন বলিয়া রাজীবলোচন ওই হার তাঁহার গলায় পরাইতে সমর্থ হইলেন। 

গলদেশে সেই মুক্তাহার লম্বিত হইবামাত্রই চারুবালার চমক ভাঙ্গিল। তিনি ক্ষিপ্রহস্তে ওই হার আপন গলা হইতে খুলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। সেই সময় একটি মার্জ্জার সেই ঘরের ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া যাইতেছিল, ওই প্রক্ষিপ্ত হার গিয়া সেই মার্জারের মস্তকের উপর পড়িল, মার্জ্জারও দ্রুতবেগে পলায়ন করিল। হার-ছড়াটি কিছুক্ষণ সেই মার্জারের মস্তকে ঝুলিয়া সেই ঘরের ভিতর দরজার নিকট পড়িয়া গেল। মার্জ্জারও ঘরের বাহির হইয়া গেল। চারুবালার এইরূপ ব্যবহারে রাজীবলোচন অতিশয় বিস্মিত হইলেন, কারণ তাঁহার সহিত এরূপ ব্যবহার করিতে তিনি ইতিপূর্ব্বে চারুবালাকে আর কখনও দেখেন নাই। মনে ভাবিলেন, হার মেরামত করিয়া আনিতে বিলম্ব হইয়াছে বলিয়া চারুবালার রাগ হইয়াছে; তাই তিনি রাগ ভরে ওই হার দূরে নিক্ষেপ করিলেন। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া রাজীবলোচন চারুবালাকে কহিলেন “তোমার হার মেরামত করিয়া আনিতে বিলম্ব হইয়াছে বলিয়া, তুমি রাগ করিয়াছ না কি?” 

চারু। রাগ ত হইয়াছেই, তুমি কোন্ বিবেচনায় ওই হার আমার গলায় পরাইয়া দিলে? 

রাজী। কেন! তোমার হার, তোমার গলায় পরাইয়া দিয়াছি, তাহাতে আমার বিবেচনার কি ত্রুটি হইল? 

চারু। ওই হার যখন আমার ছিল তখন ছিল, এখন উহা আমার নহে। 

রাজী। তবে কাহার? 

চারু। কাহার তাহা তুমি বেশ জান, আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন? 

রাজী। আমি তোমার কথা কিছুমাত্র বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

চারু। বেশ বুঝিতে পারিতেছ, আমার এই সামান্য কথা যদি তুমি বুঝিতে না পার তাহা হইলে আইনের কূট তর্ক কিরূপে বুঝিতে সমর্থ হও? 

রাজী। সে যাহা হউক ওই হার ছড়াটি একবার পরিধান কর, দেখি মেরামত হইয়া উহা এখন তোমার গলার কি রূপ শোভা বৰ্দ্ধন করে? 

চারু। তুমি কি আমাকে এতই নীচ প্রকৃতির স্ত্রীলোক মনে কর যে ওই হার আমি পুনরায় আমার গলায় পরিব! কোন্ সাহসে ওই হার আমার গলায় পরিতে তুমি আমাকে অনুরোধ করিতেছ? আমি গৃহস্থের কন্যা ও ধার্ম্মিকের কুলবধূ নহি কি? আমি কি নিৰ্ম্মল হৃদয়ে স্বামীসেবা করিতে কখনও কি ত্রুটি করিয়াছি যে তুমি আমাকে ওই হার পরিধান করিতে বল? তোমরা পুরুষ মানুষ, তোমরা যাহা কর তাহাই শোভা পায়। বিশেষ তুমি ধনবান, বুদ্ধিমান, ও পর-প্রতিপালক, তুমি একটি অন্যায় কার্য্য করিলেও তোমার মনে তাহা উদয় হয় না, সেই সময় তুমি বুঝিতে পারি না যে, তুমি কি অন্যায় কার্য্য করিতেছ? কোন্ বিবেচনার উপর নির্ভর করিয়া তুমি ওই হার আমার গলায় পরাইয়া দিলে? 

রাজী। কেন, ও হারের কি হইয়াছে তোমারই হার তোমারই গলায় পরাইয়া দিয়াছি ইহাতে আমার কি অপরাধ হইল? 

চারু। যখন এ হার আমার ছিল তখন কেবল আমারই গলায় উঠিত। 

রাজী। এখন এ হার কাহার? 

চারু। যাহার গলায় উঠিয়াছিল। 

রাজী। কাহার গলায় উঠিয়াছিল? 

চারু। বারবনিতার গলায় উঠিয়াছিল-বাইজীর গলায় উঠিয়াছিল-তারাবাইর গলায় উঠিয়াছিল।

রাজী। এ কথা তোমাকে কে বলিল! 

চারু। কে আর বলিবে, আমি নিজ চক্ষে দেখিয়াছি। তোমার শ্বশুরবাড়ীতে সে নাচিতে গাহিতে আসিয়াছিল, সেই স্থানে আমি উহা তাহার গলায় দেখিয়াছি। যাহা একবার বারবনিতার গলায় উঠিয়াছে, তাহা গতিপ্রাণা সাধ্বী স্ত্রীলোকের গলায় কিছুতেই স্থান পাইতে পারে না, যাহা একবার অপবিত্র হইয়াছে তাহা স্পর্শ করিলেও মহাপাপ। সে যাহা হউক তারা বাইর উপর তুমি কতদিবস হইতে সদয় হইয়াছ? যদি তাহার উপর তোমার এতই অনুগ্রহ হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহাকে ওইরূপ আর এক ছড়া মুক্তাহার প্রস্তুত করিয়া দিলেই পারিতে। 

চারুবালার কথা শুনিয়া রাজীবলোচন বুঝিতে পারিলেন যে, চারুবালা তাঁহার চরিত্রের উপর সন্দেহ করিয়াছেন, চারুবালা ভাবিয়াছেন যে তিনি তারাবাইর গৃহে যাতায়াত করিয়া থাকেন, ও তাঁহারই মুক্তাহার তিনি তারাবাইকে পরিধান করিতে দিয়াছিলেন। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি চারুবালাকে কহিলেন “তুমি আমার চরিত্রের উপর যে সন্দেহ করিয়াছ তাহা সম্পূর্ণ অমূলক। কিন্তু এই হার যে তারাবাই পরিয়াছে সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।” এই বলিয়া ওই হার যেরূপে তাঁহার ব্যাগ হইতে চুরি হইয়াছিল, যেরূপে ওই হার তারাবাইর নিকট পাওয়া যায়। যেরূপে তাঁহার ভৃত্য বলাই ওই হার অপহরণ করিয়া তারাকে দিয়াছিল তাহার সমস্ত একে একে তিনি চারুবালাকে কহিলেন, ও আরও কহিলেন “তোমার নিকট হইতে ওই হার মেরামত করিতে লইয়া যাইবার পর উহা চুরি হইয়া গেল তখন সেই সংবাদ তোমাকে প্রদান করিতে আমার ইচ্ছা হইল না, ভাবিলাম যদি ওই হার আর পাওয়া না যায় তাহা হইলে ওইরূপ আর এক ছড়া হার প্রস্তুত করিয়া অগ্রে তাহা তোমাকে প্রদান করিব ও পরিশেষে তোমার হার চুরির অবস্থা তোমাকে বলিব। এই নিমিত্ত তোমাকে ভাল করিয়া আমি পত্র পর্য্যন্ত লিখি নাই, কারণ বিস্তারিত পত্র লিখিতে হইলে, তাহাতে যদি তোমার হারের কোন কথা উল্লেখ না করি, তাহা হইলে তোমার মনে নানা কথা উদিত হইতে পারে। এই ভাবিয়া তোমাকে যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে পত্র লিখিতাম। যখন দেখিলাম তোমার হার আর কোনরূপেই পাওয়া গেল না, তখন আমি ওইরূপ মুক্তা ও প্রস্তর সংগ্রহ করিয়া ওইরূপ আর একছড়া হার প্রস্তুত করাইলাম। ওই নূতন হার প্রস্তুত হইলে তোমাকে পত্র লিখিলাম, ‘তোমার হার লইয়া আমি শীঘ্রই বাড়ী যাইতেছি।’ তাহার পর তোমার হার পাওয়া গেল, বলাই ও তারা ধৃত হইয়া কারারুদ্ধ হইল। আমি মনে করিয়াছিলাম বাড়ীতে আসিবার কালীন তোমার সেই নূতন হারও সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিব কিন্তু তাড়াতাড়ি আসিবার কালীন উহা ভুলিয়া আসিয়াছি বলিয়া তোমাকে দেখাইতে পারিলাম না।” 

রাজীবলোচনের নিকট সমস্ত অবস্থা শুনিয়া চারুবালার মনের সমস্ত গোলমাল মিটিয়া গেল। তিনি যে না বুঝিতে পারিয়া তাঁহার স্বামীর চরিত্রের উপর নানারূপ মিথ্যা সন্দেহ করিয়াছিলেন তাহার জন্য বিশেষরূপে অনুশোচনা করিলেন ও কি রূপ প্রায়শ্চিত্ত করিলে তিনি সেই মহাপাপ হইতে উদ্ধার হইতে পারেন ও কিরূপ উপায়ে বেশ্যা-ব্যবহৃত অলঙ্কার-স্পর্শনের পাপ হইতে মুক্তি লাভ করিতে সমর্থ হন তাহার ব্যবস্থা দেখিতে লাগিলেন। এ সম্বন্ধে ভট্টাচার্য্য পণ্ডিতদিগের মত সংগৃহীত হইল; কেহ কেহ কহিলেন একটি প্রায়শ্চিত্ত করিয়া পরিশেষে একটি হোম করা হউক, ওই হোমের অগ্নিতে মুক্তাগুলি পোড়াইয়া পরিশেষে মন্ত্রপূত গঙ্গাজলে শোধিত করিয়া লইলেই উহা পুনরায় ব্যবহৃত হইতে পারে। কেহ কহিলেন অগ্নিতে মুক্তা নিক্ষিপ্ত হইলে উহা পুড়িয়া যাইতে পারে বা উহাতে পোড়া দাগ হইয়া ওই মুক্তা নষ্ট হইয়া যাইতে পারে আমার বিবেচনায় একটি প্রায়শ্চিত্ত করিয়া পঞ্চগব্যে এই মুক্তাহার শতবার ধৌত করিয়া লইলেই বোধ হয় যথেষ্ট হইবে। 

কেহ কহিলেন ওই মুক্তাহার গঙ্গাদেবীকে প্রদান করা হউক। কেহ কহিলেন এ বৎসর যে রাত্রিতে সাবিত্রীর ব্রত করা হইয়াছিল সেই রাত্রিতে বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় তাহার পরদিবস ব্রাহ্মণাদি ভোজন করান হয়, আগামী বৎসর ব্রতের রাত্রিতেই ব্রাহ্মণ ভোজনের ব্যবস্থা করিয়া, তাঁহাদিগের দক্ষিণা স্বরূপ ওই সকল ভাগ করিয়া দান করিলেই সমস্ত পাপ বিমোচিত হইবে। কেহ কহিলেন এ সকল কার্য্যে অত বিলম্ব হওয়া কৰ্ত্তব্য নহে, শুভকাৰ্য্য যত শীঘ্র সম্পন্ন হয় ততই মঙ্গল। এখন শাস্ত্র অনুযায়ী একটি প্রায়শ্চিত্ত করা হউক এবং যে সকল ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হইবেন তাঁহাদিগের দক্ষিণা স্বরূপ ওই সকল মুক্তা প্রদান করা হউক। 

এই শেষোক্ত ব্যবস্থাই ব্রাহ্মণমণ্ডলী এক বাক্যে অনুমোদন করিলেন কিন্তু রাজীবলোচন কহিলেন “বেশ্যা অঙ্গে স্থান পাইয়াছে বলিয়া যখন চারুবালা উহা স্পর্শ করিতে অসম্মতা তখন ওই মুক্তা যাঁহারা প্রাপ্ত হইবেন তাঁহাদিগের ব্রাহ্মণীগণ উহা কিরূপে স্পর্শ করিবেন? 

উত্তরে জনৈক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কহিলেন “গঙ্গাজলে বিধৌত ও মন্ত্রপূত হইয়া ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হইবার পর আর উহাতে কোন দোষ থাকিবে না তখন উহা অনায়াসেই স্পর্শিত হইতে পারিবে; সুতরাং তখন কেহ উহা স্পর্শ করিলে তাহার কোনরূপ পাপ হইবার সম্ভাবনা নাই।” 

রাজীবলোচন এই কথায় সন্তুষ্ট হইলেন না। মনে মনে ভাবিলেন আজ-কাল ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণ অর্থ লোভে বা যেস্থানে কিছু অর্থ পাইবার সম্ভাবনা আছে সেই স্থানে তাঁহারা তাঁহাদিগের ইচ্ছামত অবস্থা দিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হন না। যাহা হউক যখন সকলেরই পরিশেষে এক মত হইল ও যখন চারুবালা ওই মুক্তাহার স্পর্শ করিতে অসম্মতা তখন ব্রাহ্মণমণ্ডলীকেই উহা দান করা কর্তব্য, ভাবিয়া তিনি আর কোন কথা কহিলেন না। 

পরিশেষে এই ব্যবস্থাই সাব্যস্ত হইল, যাগযজ্ঞ করিয়া মহাধমে প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হইল। দশ সহস্র মূল্যের মুক্তাহার ছিন্ন করিয়া উহাতে যতগুলি মুক্তা ছিল ততগুলি ব্রাহ্মণকে উহা ভোজন-দক্ষিণা রূপে প্রদত্ত হইল। ন্যূনকল্পে কেহই কুড়ি টাকার কম প্রাপ্ত হইলেন না। সকলে পরিতোষের সহিত আহার করিয়া ও মুক্তা দক্ষিণা লইয়া, রাজীবলোচন ও চারুবালাকে আশীর্ব্বাদ করিতে করিতে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় অনেকেই কহিলেন “চারুবালা তুমি মানবী-না-দেবী তাহা আমরা বুঝিতে পারিলাম না।” প্রায়শ্চিত্ত করিবার পূর্ব্বেই রাজীবলোচন তাঁহার নূতন প্রস্তুত হার আনাইয়া চারুবালার গলায় পরাইয়া দিয়াছিলেন। ওই হার পরিধান করিয়াই চারুবালা প্রায়শ্চিত্ত করিল। 

সমাপ্ত 

[ আষাঢ়, ১৩১৮ (?) ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *