মানবিক সমস্যার সমাধানে সংবাদপত্র
বিজ্ঞানীরা বলেন, চল্লিশ লাখ বছর আগে সচল প্রাণীরূপে প্রথম দেখা দেয় মাছ। আর ক্রমবিবর্তনে বা ক্রমোন্নয়নে মানুষ অবয়ব পায় দশ লাখ বছর পূর্বে। বিজ্ঞানীর বিবর্তনবাদে ও উদ্বর্তন তত্ত্বে আস্থা রেখে বলা চলে, মানুষের আরো কয়েক লক্ষ বছর কেটে গেছে দেহে-মনে উৎকর্ষ লাভের অবচেতন প্রচেষ্টায়। কিছুটা আভাসে, কিছুটা অনুমানে এবং কিছুটা নিদর্শনে আমরা মানুষের ইতিকথা পাচ্ছি মাত্র আট-দশ হাজার বছরের।
মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন ও বিশিষ্ট করেছে তার দৈহিক উৎকর্ষ ও আঙ্গিক সামর্থ্য। তার দুটো হাতের উপযোগই তাকে দিয়েছে প্রাণিজগতে শ্রেষ্ঠত্ব,–দিয়েছে জৈব-সম্পদে ও মানস-ঐশ্বর্যে অধিকার।
আত্মসচেতন প্রাণী হিসাবে মানুষের মননের প্রথম লক্ষণীয় প্রকাশ ঘটে সর্বপ্রাণবাদ (Animism) তত্ত্বচিন্তায়। তারপরে তার আরো এগিয়ে আসার স্বাক্ষর মেলে তার যাদুতত্ত্বের (Magic Power)উদ্ভাবনায়। তার আরো অগ্রগতির সাক্ষ্য রয়েছে টোটেম-টেবু ভিত্তিক জীবন চেতনায় ও সমাজ বিন্যাসে।
Pagan জীবন-চেতনায় ও ধর্মীয় জীবনে মৌলিক কোনো পার্থক্য দুর্লক্ষ্য। বাহ্য পার্থক্য হচ্ছে একটি অবচেতন অভিব্যক্তি, অপরটি সচেতন জীবন ধারণা। একটিতে রয়েছে অবিন্যস্ত অস্পষ্টতা, অপরটিতে আছে যুক্তির শৃঙ্খলা ও তাত্ত্বিক তাৎপর্য। মূলত ভয়-ভরসা, বিস্ময়-বিশ্বাস ও কল্পনা সংস্কারই উভয়বিধ জীবন-তত্ত্বের ভিত্তি। আর জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ও প্রসারই লক্ষ্য। এ জন্যে যুক্তি, বিশ্বাস ও তত্ত্ব সমন্বিত হলেও ধর্ম Animism, Magic, Totem, Taboo তত্ত্বেরই বিকশিত শোভন রূপ। আচারে-অনুষ্ঠানে আজো তার শাস সর্বত্র দৃশ্যমান। কেবল লক্ষ্যে মহত্তাব ও উদ্দেশ্য আরোপিত হয়েছে মাত্র। কেননা, মানুষের কোনো বিশ্বাস-সংস্কারেরই মৃত্যু নেই। পরিবর্তিত পরিবেশে তার রূপান্তরই হয় শুধু।
জীবনের বিকাশ কিংবা বিলয় জীবন-জীবিকার পরিবেশ নির্ভর। তাই মানুষে মানুষে পরিবেষ্টনী-গত পার্থক্যও দেখা দিয়েছে গোড়া থেকেই। সে পার্থক্য বর্ণে, জীবিকায় ও জীবনদৃষ্টিতে সুপ্রকট। পরিবেষ্টনীগত প্রয়োজন স্বীকার না করে উপায় ছিল না বলেই বিচিত্র ধারায় গড়ে উঠেছে মানুষের জীবন ও মনন। এভাবে প্রতিবেশের আনুকূল্যে মানুষের অগ্রগতি কোথাও হয়েছে অবাধ, আবার এর প্রতিকূলতায় কোথাও হয়েছে ব্যাহত।
পরিবেশ ও প্রয়োজনের অনুগত মনুষ্য জীবনে এজন্যেই বিকাশ সর্বত্র সমান হতে পারেনি। তাই আজো স্থিতিশীল আরণ্য গোত্র যেমন রয়েছে, তেমনি দেখা যায় পাঁচ-সাত হাজার বছরের পুরোনো সভ্য জাতিও।
সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ-মানসে তথা জীবন-জীবিকায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বিধান লক্ষ্যে উন্নততর সমাজে ধর্মের উদ্ভব। ধর্মও তাই স্বীকার করেছে পরিবেষ্টনীগত জীবন-জীবিকার প্রভাব ও প্রয়োজন। এ জন্যেই কোনো ধর্মই দেশকাল নিরপেক্ষ সর্বমানবিক হতে পারেনি। প্রতিবেশের কারণেই কোনো ধর্মে প্রাধান্য পেয়েছে পাপ, কোনো ধর্মে ক্ষমা, কোনো ধর্মে কর্ম, কোনো ধর্মে আচার, কোনো ধর্মে বৈরাগ্য, কোনো ধর্মে জরামৃত্যুভীতি, কোনো ধর্মে নৈতিক জীবন, কোনো ধর্মে জ্ঞান, কোনো ধর্মে ভক্তি এবং কোনো ধর্মে মুখ্য হয়েছে সংগ্রাম।
দেশকালের চাহিদা পূরণের জন্যে এভাবে কত ধর্মের জন্ম-মৃত্যু হয়েছে, আবার একই ধর্মের হয়েছে কত কত শাখা উপশাখা। তবু নিত্য পরিবর্তনশীল পরিবেশে চলমান মানুষের নব-উদ্ভূত প্রয়োজন মেটেনি। নিত্য নতুন সমস্যায় বিব্রত মানুষ উপায় খুঁজে খুঁজে এগিয়েছে একটার সমাধান পেল তো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অন্য সমস্যা। কোনো চলমান জীবনেই প্রয়োজন ও উপকরণ অপরিবর্তিত ও স্থিতিশীল থাকে না। তাই মানুষ কোনদিন নিশ্চিত জীবনের আশ্বাস পায়নি।
ফলে, ধর্ম অভাব মিটিয়ে ভরে তুলতে পারেনি বলে, ধরেও রাখতে পারেনি। দিশেহারা মানুষ ধর্মের নামে কেবল খুনোখুনিই করেছে–কিন্তু শ্রেয়সের সন্ধান পায়নি। এ অভিজ্ঞতা থেকে উন্নততর সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ জীবনচেতনা তথা সমাজ-চেতনা দেখা দেয়। তারই ফলে জীবন, সমাজ ও জীবিকা-তত্ত্বে হয়েছে নানা মতের ও পথের উদ্ভব। এ সব মতবাদই এখন সভ্যজগতে জীবন নিয়ন্ত্রণের ও চালনার ভার নিয়েছে।
ধর্মে ছিল অপৌরুষের অঙ্গীকার। তার ভিত্তি ছিল ভয়-ভরসা ও বিশ্বাস-সংস্কার। এজন্যে ধর্মে আনুগত্য ছিল প্রায় অবিচল।
মতবাদ হচ্ছে যুক্তি ও ফল নির্ভর। মতবাদ গ্রহণে-বর্জনে মানুষ অকুতোভয় এবং স্বাধীন। এ জন্যে সমাজে ও রাষ্ট্রে আরো জটিল হয়েছে সমস্যা।
ধর্মে আনুগত্য ভয়-বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠে বলে সে-আনুগত্য হয় অন্ধ ও অবিচল। তাই ধার্মিক মাত্রেই গোঁড়া ও কর্তব্যনিষ্ঠ। আনুগত্য, সংযম ও নিষ্ঠাই ধার্মিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ভয় ভরসা ও বিশ্বাসের অঙ্গীকারে সংযত ও বিধাননিষ্ঠ ধার্মিক তাই পোষমানা প্রাণী। তার মধ্যে প্রশ্ন নেই, দ্রোহ নেই, নেই কোনো উদ্বেগ। নিয়ম ও নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত তার জীবনের সুখে-দুঃখে, সাফল্যে-ব্যর্থতায়, রোগে-শোকে কিংবা আনন্দে-বেদনায় সে সহজেই প্রবোধ ও স্বস্তি পায়। অপৌরুষের বিধি-নিষেধের আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত থাকে তার ইহলোকে-পরলোকে প্রসারিত জীবনের ঐহিক ও পারত্রিক অভীষ্ট। এজন্যেই ধার্মিক মানুষে খাঁটি মানবতা সুদুর্লভ। মনুষ্যত্বের সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশ তাতে অসম্ভব। তার হচ্ছে যান্ত্রিক জীবন। যেমন দুটোই সৎকর্ম হওয়া সত্ত্বেও ধার্মিক মুসলমান মন্দির নির্মাণে এবং ধার্মিক অমুসলমান মসজিদ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে না। এবং বিধর্মী ভিক্ষুক দিয়ে কাঙ্গাল ভোজনের কিংবা ফিত্রা দানের পুণ্য মেলে না। তার ধর্মপ্রেরণা-প্রসূত দয়া যেমন অশেষ তার ঘৃণাও তেমনি তীব্র ও মারাত্মক। এজন্যে তার মনুষ্যত্ব, তার মানবতা ও তার উদারতা তার ধর্মবুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারে না কখনো। তাই ধার্মিক মানুষের সংযম ও নীতিনিষ্ঠা সমাজ-শৃঙ্খলার সহায়ক হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষের অগ্রগতির অবলম্বন হয় নি। আর মতবাদ যেহেতু যুক্তি ভিত্তিক ও কল্যাণমুখী সেজন্যেই মতবাদই মতধারীর মনুষ্যত্ব ও মানবতার পরিমাপক। এটি তার বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে অর্জিত বলেই এখানে সে স্বয়ম্ভ।
সেকালের ধর্মমত আর একালের মতবাদ দুটোই মূলত সামান্য অর্থে ধর্ম,–জীবনযাত্রীর নিয়ামক। একটা ঐশ্বরিক, অপরটা নিরীশ্বর তথা মানবিক–পার্থক্য এটুকুই। কিন্তু কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মানবিক সমস্যার সমাধানে কোনোটাই নয় পুরো সমর্থ। তবু গণহিতৈষণা-কামীর গণবাদ শ্রেয় এবং গণতন্ত্র উন্নততর ব্যবস্থা।
সেকালে ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন, প্রচারক ছিলেন, ছিল ধর্মগ্রন্থ। একালেও মতবাদের প্রবর্তক আছেন, সংবাদপত্রই এর গ্রন্থ এবং সাংবাদিকরাই এর প্রচারক। এজন্যে আজ সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরাই মানব ভাগ্যের নিয়ামক।
সেকালে পৃথিবী ছিল খণ্ডে বিভক্ত, আর সে-কারণে সমাজগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন। একালে পৃথিবী হয়েছে অখণ্ড ও সংহত। মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যা হয়েছে একই সূত্রে গ্রথিত। যৌথ প্রয়াস ছাড়া কোনো প্রয়োজনই মেটে না; সহযোগিতা ছাড়া মেলে না কোনো সমস্যার সমাধানও। এমনি। অবস্থায় ধর্মীয় ও জাতীয় স্বাতন্ত্র-প্রবণতা কেবল অকল্যাণই আনবে। স্বাতন্ত্র ও সৌজন্য; স্বার্থ ও সহযোগিতা; ধর্মবোধ ও মানবতা এবং জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধনেই কেবল আজকের মানবিক সমস্যার সমাধান হতে পারে।
আগের যুগের মানবতাবোধ ছিল ব্যক্তি-মানসের উৎকর্ষের ফল। এ যুগে মানবতাবোধ সমাজ-মানসে সংক্রমিত না হলে মানুষের নিস্তার নেই। সংবাদপত্র হচ্ছে গণসংযোগের মাধ্যম। কাজেই মানবতা-প্রচারকের ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে সাংবাদিককেই। স্বার্থ বজায় রেখেও সৌজন্য দেখানো সম্ভব অথবা সৌজন্য বজায় রেখেও স্বার্থসচেতন থাকা যায়–লি মুক্ত স্বার্থে ও সৌজন্যে যে বিরোধ নেই–এ কথা আজ মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ব্যষ্টি নিয়েই সমষ্টি। ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র্য যেমন প্রয়োজন, সামষ্টিক দায়িত্ব এবং কর্তব্যবুদ্ধিও তেমনি আবশ্যিক। আগের মতো ক্ষণিকের উত্তেজনায় কিংবা লিল্লায় আপাত স্বার্থে ধর্ম, জাতি ও রাষ্ট্রের নামে বিরোধের ব্যবধান সৃষ্টি না করে মিলনের মহাময়দান তৈরির ব্রত গ্রহণ করতে হবে সাংবাদিককে। দেশ-ধর্ম বর্ণ নিরপেক্ষ নির্ভেজাল মানবতার বিকাশের সাধনার আজ বড়ো প্রয়োজন। ধর্মীয়, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থচেকে করতে হবে বিশ্বমৈত্রী ও করুণার অনুগত এবং এগুলো রক্ষার ও বৃদ্ধির অনুকূল। আজ সহ-অবস্থান ও সহযোগিতার নীতিই মানবিক সমস্যা সমাধানের দৃষ্টিগ্রাহ্য একমাত্র উপায়।
এ নীতি প্রচারের গুরুদায়িত্ব, এ কঠিন কর্তব্য ও নেতৃত্বের এ অধিকার আজ সংবাদপত্রের। সংবাদপত্রের কাছে বিশ্বের কল্যাণকামী মানুষ মাত্রেরই তাই আজ অনেক প্রত্যাশা।