মানবতন্ত্র
জাতীয় আদর্শের ধারণা সকলের এক নয়। সাহিত্যিকের কাছে সত্যই বড় কথা। সত্যের সঙ্গে যদি জাতীয় আদর্শ, ধর্ম বা শাস্ত্রের বিরোধ ঘটে নিঃসন্দেহে বিনা দ্বিধায় সাহিত্যিক সত্যের পক্ষাবলম্বন করবে। সাহিত্যিকের যদি কোনো আল্লাহকে মানতে হয় তা হলে সে আল্লাহ হচ্ছেন–‘আল হককুন’ অর্থাৎ যিনি হক বা সত্য। প্রচলিত অর্থে আল্লাহর গুণাবলি নিরানব্বই হোক কি তেত্রিশ কোটি হোক তাতে কিছু এসে যায় না–তা যে হক বা সত্যের রকমফের, এ উপলব্ধি যার নেই তার পক্ষে মুখে আল্লাহর নাম নেওয়া শয়তানের ধর্ম গ্রন্থ আবৃত্তিরই সমতুল্য। সত্যের এ বোধটুকু না থাকলে সাহিত্যিক যেমন হওয়া যায় না তেমনি হওয়া যায় না সাহিত্যের বিচারক বা সমজদার। প্রসঙ্গত বলতেই হচ্ছে আমার রাঙ্গা প্রভাত নামক উপন্যাস পড়ে জনৈক অধ্যাপক অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে জাতীয় আদর্শবিরোধী, পাকিস্তানবিরোধী, ইসলামবিরোধী ইত্যাকার বহু সাংঘাতিক অভিযোগে বইটাকে সংবাদপত্রের পাতায় অভিযুক্ত করেও ক্ষান্ত হতে পারেন নি। শুনেছি, এ বিষয়ে তিনি প্রদেশের স্বরাষ্ট্র বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করবারও চেষ্টা করেছেন। জাতীয় আদর্শ খুব একটা মস্ত বড় বস্তু যদি হয়, তা হলেও জিজ্ঞাসা করা যায় তা রক্ষা ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব কি স্বরাষ্ট্র বিভাগের? ওই বিভাগের কর্মচারীদের ওই সম্পর্কে জ্ঞানের বা মূল্যায়নের দৌড়ই বা কতটুকু? সাহিত্য বিচারের ভার শেষ পর্যন্ত যদি স্বরাষ্ট্র বিভাগের ওপরই ন্যস্ত হয় তা হলে সাহিত্য ও সাহিত্যিকের ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত হওয়ার কারণ ঘটে না কি? আশ্চর্য, সাহিত্য-শিল্পের ওপর স্বরাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয় বলে, এরাই আবার সোভিয়েট রাশিয়ার নিন্দায় পঞ্চমুখ। এদের মতে, বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের যে ধর্ম মানবতার চেয়ে তা বড়। এ মত আমি বিশ্বাস করি না, মানিও না। কথাটা হয়তো রাঙ্গা প্রভাত-এ কিছুটা সোচ্চার হয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি জায়গায় যে অমানুষিক কাণ্ড ঘটে গেলো তাতে আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে। এ সবে যারা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ধার্মিকের অভাব ছিল না–এদের অনেকে হাতের ধারালো ছোরাটা উদ্যত করেছে ঈশ্বর ও আল্লাহর নাম নিয়েই। ঈশ্বর ও আল্লাহর পরিবর্তে এদের দিলে যদি কণামাত্রও মানবতার ছোঁয়া লাগতো তা হলে এমন কাজ তাদের দ্বারা কখনো সম্ভব হতো না। এদের সম্বন্ধেই বানার্ড শ’র বিখ্যাত উক্তি Beware of that man whose God is in heaven একটু বদলিয়ে বললে কথাটা আরো প্রত্যক্ষ হয়; যাদের আল্লাহ শুধু ঠোঁটে আর তসবিতে তাদের থেকে সাবধান।
ধর্ম আর সেকুলারিজম আজ স্রেফ মুখের বুলিতে পর্যবসিত। ধার্মিক না হয়েও ধর্মের নামে গদগদ হওয়া আর মনে সেকুলার না হয়েও সেকুলারিজমের নামে মুক্তকচ্ছ হওয়া তেমন কোনো বিরল দৃশ্য নয়। আজকের দিনে যদিও সেকুলারিজমের অর্থ করা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’–আসলে ওটাও একটা পোশাকি ধর্ম–-সাম্প্রদায়িকতার আর একটি নতুন নাম। এও এক রকম ‘মিটিংকা কাপড়া’। রাজনৈতিক বদলের বেশি এর কোনো মূল্য নেই। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ কি খুলনায় যারা অশান্তি ঘটিয়েছে তারাও তো ইসলাম ধর্মাবলম্বী, যে ইসলামের অর্থ শান্তি। ধর্মকে এ স্ববিরোধিতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে মানুষের দৃষ্টি ধর্মের দিক থেকে মনুষ্যত্বের দিকে ফেরাতে হবে। কোনো রকম ধর্মতন্ত্র নয়, মানবতন্ত্রকেই করতে হবে আজ সব দেশের ও সব রাষ্ট্রের আদর্শ। ব্যক্তি বা সমাজজীবনেও এর থেকে বড় আদর্শ আমার মনের দিগন্তে আমি খুঁজে পাই না।
খাঁটি অর্থে কোনো ধর্মের পক্ষেই আজ তার নিষ্কলুষ আদি স্বরূপ রক্ষা করা সম্ভব নয়–সম্ভব নয় সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে রেহাই পাওয়া–বিশেষ করে পাকিস্তান হিন্দুস্থানে। না পাওয়ার একটা বড় কারণ রাজনীতি আর ধর্ম আমাদের দুই দেশে আজ এক। রাজনীতিবিদের মুখে এখন ধর্মের যত বুলি শোনা যায় স্বয়ং ধর্ম প্রবর্তকদের মুখেও কোনো দিন তত ধর্ম বুলি শোনা যায় নি। কারণ, তারা বুলির চেয়ে ধর্ম পালনে ছিলেন অধিকতর বিশ্বাসী। এখন অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিজ্ঞানের অগ্রগতিও হয়তো অন্যতম কারণ। ধর্মের অনেক বিশ্বাস, যার সঙ্গে নৈতিক বোধ ও সামাজিক ন্যায়-চেতনা জড়িত তা আজ এক রকম ধূলিসাৎ। যা সাক্ষাৎ ও প্রত্যক্ষ নয়, তা আর মানুষকে প্রভাবিত করতে পারছে না। তাই সব রকম ধর্মীয় নীতিবোধ আজ শিথিল–ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন থেকে বিযুক্ত। ফলে যে কোনো শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোক এখন দোজখের জল্লাদ থেকে তাঁর এলাকার থানার দারোগাকে অনেক বেশি ভয় করে থাকেন।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটা খুব ভালোভাবেই দেখা গেছে যে, ধর্ম বা সেকুলারিজম কোনোটাই মানুষকে বাঁচাতে পারে না, পারে নি। কাজেই ধর্ম নয়, সেকুলারিজমও নয়, একমাত্র মানবতার ওপরই দিতে হবে জোর। ধর্মের কথা বললেই অনিবার্যভাবে অন্য ধর্মের কথা এসে পড়ে। সেকুলারিজমের সঙ্গেও বৈপরীত্যের কল্পনা অবিচ্ছিন্ন। যারা সেকুলার নয় তাদের শত্রু ভাবতে সেকুলারিজম বিশ্বাসীর মোটেও বাধে না। বামপন্থীদের কণ্ঠস্বরও আজ কিছুমাত্র আশাপ্রদ নয়। সম্প্রতি ভারতীয় লোকসভা ও পশ্চিমবঙ্গ আইনসভায় যে বিতর্ক দেখা গেল তা রীতিমত আতঙ্কজনক।
কাজেই মানুষকে অমানুষিকতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে মানবতাকেই করতে হবে একমাত্র অবলম্বন। কথা আছে, বাঘ বাঘের মাংস খায় না–কথাটা সত্য। বাঘও বাঘের বেলায় নিজেদের সাধারণ ব্যাঘ্রত্ব সম্বন্ধে সচেতন। ব্যাঘত্বে পরস্পর অভিন্ন। অতএব অবধ্য। মানুষকেও সচেতন করে তুলতে হবে সাধারণ মানতা সম্বন্ধে। এখন ধর্ম আর সেকুলারিজমের ওপর জোর দিতে গিয়ে আমরা সাধারণ মানবতাকে শুধু খাটো নয়, প্রায় মুছে ফেলেছি আমাদের জীবন থেকে। আমরা নির্ভেজাল মুসলমান বা নির্ভেজাল হিন্দু কি না এ দাবিই আজ সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। পাশাপাশি দুই দেশের দুই বৃহত্তর সমাজে আজ এ দাবিই সবচেয়ে উদগ্র। নির্ভেজাল মানুষ হোক–এ স্বাভাবিক দাবি কোথাও শোনা যায় না–পরিবারে, সমাজে রাষ্ট্র সর্বত্র এ দাবি অনুপস্থিতিতেই বিশিষ্ট।
অন্য মানুষটাও আমার মতই মানুষ–এ বোধ ও চেতনাকে ব্যাপক ও ব্যবহারিক করে তুলতে না পারলে মানুষের রক্ষা নেই। ধর্ম বা সেকুলারিজম মানবতার স্থান নিতে পারে না। প্রাণপণে দুই বিপরীত ধর্ম পালন করে কোথাও মিল হয়েছে–এমন নজির আমার জানা নেই। দুই ধর্মের দুই ধার্মিকের সত্যকার সখ্য বা আন্তরিকতাও বিরল ঘটনা আত্মীয়তা তো অবিশ্বাস্য। হিন্দু মহাসভা আর জমাআতে ইসলাম একই মঞ্চে মিলিত হয়ে একই কর্মসূচিতে হাত মেলাবে এ কল্পনার বাইরে। শুভ বুদ্ধিওয়ালা কেউ কেউ যে বলে থাকেন, মুসলমান খাঁটি মুসলমান আর হিন্দু খাঁটি হিন্দু হলেই মিলন সহজ হবে–একথা আমার কাছে সোনার পাথরবাটি; বরং মানুষ যখন এবং যেখানে প্রচলিত মুসলমানিত্ব ও হিন্দুয়ানিকে ছাড়িয়ে গেছে সেখানে মিলন সহজ ও অবাধ হয়েছে। হিন্দু মুসলমানে যে কয়টা বৈবাহিক সম্পর্ক হয়েছে তাও এ দৃষ্টিভঙ্গির ফুল। এটা মানবতার দিকেই ইঙ্গিত। এ মনোভাব বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রসারিত হলে মিলন ও সহযোগিতার দিগন্ত বেড়ে যাবে। সযত্নে নিজের মুসলমানিত্ব কি হিন্দুয়ানিও রক্ষা করবো এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হিসেবেও বড় ও মহৎ হবো–এ হয় না, যেমন হয় না নিজ নিজ পুকুরে গোসল করে সমুদ্র স্নানের স্বাদ পাওয়া। সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক ধর্মে আনুষ্ঠানিকতার বহর অনেক বেশি। ধর্মে ধর্মে বিরোধও সবচেয়ে বেশি এ আনুষ্ঠানিকতায়। অথচ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া ধর্মের স্বরূপ জনসাধারণের কাছে অবোধ্য। নিরাকার ঈশ্বরের মতো ধর্মের বৃহত্তর আদর্শ বা আবেদনও থেকে যায় ওদের কাছে তাই অনুপলব্ধ। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাই কে হিন্দু আর কে মুসলমান এ বোধটাকে খুব বড় করে তোলে। এর ফলে দুইটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও হিন্দু-মুসলমান সমস্যার মৃত্যু ঘটে নি এবং সব রকম আনুকূল্য সত্ত্বেও কোনো রাষ্ট্রেই একটা সুসংহত জাতীয়তা গড়ে ওঠে নি। বলা বাহুল্য সাধারণ মানুষের কাছে অনুষ্ঠানই ধর্ম। ফলে যে-কোনো অজুহাতে এরা যখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে বা এদের উত্তেজিত করে তোলা হয় তখন ধর্মের নামে মানুষ হত্যায়ও এরা মনের দিক থেকে আর কোনো বাধা পায় না।
একবার এক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন : ধার্মিক আর সাহিত্যিকের পার্থক্যটা কোথায়?
উত্তরে বলেছিলাম, ধর্মগ্রন্থে যদি নির্দেশ দেওয়া থাকে যে, বিধর্মীকে কতল করলে তোমার জন্য বেহেস্তে সর্বোত্তম কামরাটি খাস রাখা হবে আর দেওয়া হবে তোমাকে সত্তর হাজার হুর (সংখ্যাটা কাল্পনিক নয়, এক ওয়াজের মজলিসে শুনেছিলাম), তাহলে ধার্মিকজন সুযোগ পেলে এ নির্দেশ পালন করতে কিছুমাত্র ইতস্তত করবে না। ইতস্তত করার বা পালন না করতে পারার একমাত্র অন্তরায় পার্থিব আইন–অধিকতর ও প্রত্যক্ষ পুলিশ। কিন্তু সাহিত্যিক এমন নির্দেশ শুধু যে পালন করবেন না তা নয়, বরং অবিশ্বাস্য বলে এমন নির্দেশকে তিনি তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দেবেন। মানুষ মেরে বেহেস্তে যাওয়ার কল্পনাই তার চিন্তার বাইরে। স্বয়ং ঈশ্বর নেমে এসেও যদি তাকে এমন নির্দেশ দেন, সাহিত্যিক তেমন ঈশ্বরকেও নিজের লেখন কক্ষ থেকে বের করে দিতে দ্বিধা করবেন না। ঈশ্বর নামধেয় কারো পক্ষে এমন নির্দেশ দেওয়া সম্ভব–এ কথাটাই সাহিত্যিকের কাছে অবিশ্বাস্য। কিন্তু ধার্মিক তো সম্ভব-অসম্ভবের বিচার করে না। কারণ, ধর্ম আর শাস্ত্রীয় ব্যাপার নিয়ে বিচার করাটাই তার কাছে অধর্ম। তার একমাত্র অবলম্বন অন্ধ বিশ্বাস আর অন্ধ অনুসরণ। একজনের জন্য সত্তর হাজার হুর সম্ভব কি অসম্ভব, সম্ভব হলেও একত্রে অতগুলি হুর দিয়ে সে কী করবে এ সব অতি স্বাভাবিক ও সঙ্গত প্রশ্নও তার মনে উদয় হয় না–হলেও উত্তর সন্ধানে সে নিস্পৃহ অথবা শঙ্কিত। সে উত্তর যতই লজিক্যাল বা যুক্তিসঙ্গত হোক না কেন, তার কাল্পনিক পরিণাম ভেবে সে আরো বেশি ভীত। যে মানুষ লজিক বা যুক্তির সম্মুখীন হতে ভয় পায়, তার কাছে মননশীলতা বা মুক্তবুদ্ধির চর্চা এক নিষিদ্ধ ব্যাপার। এমন মানুষকে সত্তর হাজারের পরিবর্তে সত্তর লক্ষ বললেও সে বিশ্বাস করতে এতটুকু দ্বিধা করবে না। হয়তো। ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে আরো বেশি উৎফুল্ল, আরো বেশি বেপরোয়া ধার্মিক হয়ে উঠবে। যে মানুষ জীবনে একটা হুর সামলাতেই গলদঘর্ম, মৃত্যুর পর সে সত্তর হাজার সামলাবার অলৌকিক শক্তির অধিকারী হবে–এমনতর অদ্ভুত বিশ্বাসই সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ ও সম্মোহিত করে রাখে।
বলা বাহুল্য, সংসারে বা সমাজে অর্থাৎ জীবিতলোকে অলৌকিকতার বিন্দু-বিসর্গ মূল্যও নেই–এখানে যা কিছু মূল্য তা বাস্তব আর প্রত্যক্ষের। তাই যে অলৌকিকতার ওপর ধর্ম আর তার আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানগুলি দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে মানুষের মন ফিরিয়ে তাকে মানবতার দিকে–যে মানবতা বাস্তব, প্রত্যক্ষ, সামাজিক, ব্যবহারিক ও যুক্তিনির্ভর সে দিকে ফেরাতে হবে। মানবজাতির শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করছে এ সাধনা আর এর সাফল্যের ওপর। ব্যক্তি জীবনে মানুষ ইচ্ছা মতো নিজ নিজ ধর্মানুষ্ঠান পালন করুক তাতে কারো লাভ-লোকসান ঘটে না। কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাকে বড় করে তুললেই ঘটে মুশকিল, তখন এমন সব সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে যার সমাধান এক কথায় বন্যহংস’। আজ পাকিস্তান আর হিন্দুস্থান-এ ‘বন্যহংস’ধরার প্রতিযোগিতাই চলেছে। স্বাধীনতার পর এ দুই দেশে ধর্মানুষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি মশার বংশবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ এ দুই দেশে নৈতিক মান সব রকম পূর্বতন রেকর্ড ভঙ্গ করে অধঃপতনের পাতালপুরীর দিকেই আজ দ্রুতগতিতে ধাবমান। জীবনবিচ্ছিন্ন ধর্মচর্চার এ এক শোচনীয় পরিণতি। আমার বিশ্বাস ধর্ম সম্বদ্ধে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। ধর্ম আজ অনেকের জীবনে অন্য পাঁচটা বৈষয়িক বস্তুর সামিল–পার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার। অথচ এরা বাস্তব ও পার্থিব যুক্তি বিচারের কষ্টিপাথরে ধর্মকে যাচাই করতে নারাজ। ধর্ম আর ঈশ্বর সম্বন্ধীয় শব্দ ও নানা উক্তি বহু ব্যবহারে আজ এমন একটা নির্জীব অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, তা মনে আর কোনো আবেদন বা উপলব্ধিরই চমক লাগায় না। চরিত্র ও নীতিবোধের পরিবর্তে তসবির জনপ্রিয়তা, মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি বা হরি সংকীর্তনে কণ্ঠস্বরের প্রতিযোগিতা মোটেও সামাজিক অগ্রগতির দিদর্শন নয়। বরং এ যুগে ওটাও এক রকম Playing to the gallery. ওতে খেলায় জেতা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন, মন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য মননে সাহায্য করা। আজ মন্ত্র পাঠ বা তসবিহ তেলাওয়াত মননশীলতার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক জড় ব্যাপারে পরিণত। মুখে আরবি বা সংস্কৃতি বুলি যতই উচ্চারিত হোক তার অর্থ কী, জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটুকু (জীবন মানে শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে যে জীবন) এ সব জিজ্ঞাসা যদি মনে কোনো ভাবনার সৃষ্টি না করে, ভেতরটা যদি কোনো নতুন তরঙ্গে সাড়া না দেয় তাহলে অমন উচ্চারণ অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও নির্ভুল হলেও নিষ্ফল শ্রম ছাড়া কিছুই না।
পৃথিবীর এখন বয়স হয়েছে, সভ্যতা সংস্কৃতিরও বয়স কম নয়, লিপিবদ্ধ ধর্মের আয়ুও কয়েক হাজার বছর। প্রাথমিক স্তরে জীবনধারণ বা সভ্যতার জন্য যেসব উপকরণ অত্যাবশ্যক বিবেচিত হতো, আজ তার অনেক কিছু অকেজো বলে পরিত্যক্ত। সভ্য জীবন যাপনের জন্য তা আর অপরিহার্য মনে করা হয় না। তেমনি ধর্মেরও প্রাথমিক স্তরের অনেক কিছুই আজ জীবনের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। ধর্ম জীবনও যে সামাজিক জীবন, সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতেই তার যা কিছু মূল্য–এ বোধ না থাকলে ধর্ম জীবনবিমুখ হয়ে পড়তে বাধ্য। যেমন এখন হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষ মৃত্যুর পর স্বর্গে গেল কি নরকে গেল তা মানবজাতির কিছুমাত্র দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে লোকটা সৎ ও সামাজিক ছিল কিনা তা সব মানুষেরই ভাবনায় বিষয়। কারণ,তার এ জীবনের সঙ্গে বহু মানুষের সুখ-দুঃখ জড়িত–জড়িত সামাজিক স্বাস্থ্য, শান্তি, নিরাপত্তা ও ভারসাম্য। স্বর্গের বা নরকের জীবন ব্যক্তিগত ও একক–ওই দুজায়গায় কোনো সামাজিক জীবন আছে বা থাকবে তেমন কথা কোনো ধর্মগ্রন্থেই উল্লেখিত হয় নি। কিন্তু এখানকার যে জীবন তা পুরোপুরি সামাজিক ও সমষ্টিগত। এ সামাজিক বা সমষ্টিগত জীবনের সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই তেমন অশরীরী ব্যাপারকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিলে, আদর্শ ও লক্ষ্য করে তুললে বিভ্রান্তি ঘটাই স্বাভাবিক। জীবনে যারা জীবনকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে মৃত্যু অর্থাৎ মৃত্যুর পরের জীবনকে, বলা বাহুল্য, এ হুর-পরীবর্জিত, দুধের নদ-নদীশূন্য পৃথিবী তাদের জন্য খুব উপযুক্ত বাসস্থান নয়। এ জন্যেই বলছি–যা পরকালের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ ধর্ম, তার ওপর জোর না দিয়ে যা এ জীবনের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ মানবতার ওপর জোর দেওয়া উচিত। মানুষের কল্যাণ এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে জড়িত।
ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সামাজিকভাবে ধার্মিক হওয়ার যে আমি বিরুদ্ধে তা নয়। ধর্ম যদি মনুষ্যত্বের পরিপূরক বা নামান্তর না হয় তাহলে ধর্মে আর মনুষ্যত্বে পদে। পদে সংঘর্ষ অনিবার্য। আমার বিশ্বাস, খাঁটি অর্থে যারা ধার্মিক তারা কখনো নিজের কি অপরের মনুষ্যত্বকে আঘাত হানতে পারে না–পারে না মানবতাকে কিছুমাত্র খাটো করতে। আমার বক্তব্য, নিছক আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণের দ্বারা কেউ ধার্মিক হতে পারে না। যেমন, হতে পারে খাঁটি সাহিত্যিক স্রেফ পেশাদারি অধ্যাপনা করে। জীবনের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই আলাদা হওয়া চাই–আর তা হওয়া চাই ব্যক্তির সমস্ত সত্তার সঙ্গে জড়িত। ভেতরে ধর্মবোধ না থাকলে আর বহু সাধনায় তাকে অন্তরঙ্গ করে তুলতে না পারলে সত্যিকার ধার্মিক হওয়া অসম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। ধর্মজীবনের ব্যাপ্তি সামাজিক জীবনে ছড়িয়ে না পড়লে তার মূল্যই বা কতটুকু? ব্যক্তিগতভাবে কোনো মানুষের কাছে যদি কোটি টাকাও থাকে তাতে সমাজের কী। এসে যায়, যদি তার এক ভগ্নাংশও সমাজদেহে স্বাস্থ্য সঞ্চারে সহায়তা না করে? সমাজের দিক থেকে এর চেয়ে স্তূপীকৃত মৃত্তিকাখণ্ডের মূল্য অনেক বেশি। ঘরে বসে কোটিবার তসবিহ জপা আর কোটি টাকা সিন্দুকে বন্ধ করে রাখা ব্যবহারিক দিক থেকে একই ব্যাপার–এ দুয়ের কিছুমাত্র সামাজিক মূল্য নেই। কোটি টাকা বা কোটি পুণ্যও তাই–সামাজিক মূল্যই এ দুয়ের মূল্য। আগেই একবার বলেছি, ব্যক্তিবিশেষ স্বর্গে যাবে কি নরকে যাবে তার আগাম দুশ্চিন্তায় কারো পক্ষে ব্লাড প্রেসার বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।
মন্দিরে মসজিদে গির্জায় কে কী রকম আচরণ করে, সেজদায় গিয়ে কে দীর্ঘতর সময় কাটায় তা মোটেও বড় কথা নয়। কোনো মানুষ বত্রিশ আনা হিন্দু বা চৌষট্টি আনা মুসলমান কি খ্রিস্টান হলেও পৃথিবীর কোনো লাভ-লোকসান ঘটে না। কিন্তু বাইরে, অর্থাৎ সমাজে এবং পরিবারেরও যদি আট আনা মানুষও হয় তাহলেই পৃথিবী বেঁচে যায়। আজ পৃথিবী এমন মানুষের প্রতীক্ষায়–যে মানুষের একমাত্র অভীপ্সা মানুষ হওয়ার–মানুষের মতো আচরণ করার।
ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর তাবত পৃথিবীর মালিক। এসব কথা সামাজিক দিক থেকে স্রেফ হাওয়ায় বেলুন ওড়ানো। এর কোনো সামাজিক মূল্যই নেই। এতে কোনো সামাজিক তথা মানবীয় সমস্যারই সমাধান হয় না। এসব ব্যক্তিবিশেষের বিশ্বাসের অঙ্গ হতে পারে। কিন্তু কোনো বিশ্বাসই সামাজিক শান্তি বা শৃঙ্খলা আনতে সক্ষম নয়। তার এক বড় প্রমাণ, কোথাও শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দিলে লোকে পুলিশ ডাকে, আল্লাহ বা ভগবান ডাকে না।
ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে আইনের শাসনে শৃঙ্খলাবদ্ধ না করলে তা সহজে পরস্পাপহরণের অজুহাত হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
একটা গল্প শুনেছিলাম।
এক ব্যক্তি প্রায়ই মসজিদ থেকে কোরান শরিফ চুরি করতো আর চুরি করার সময়। এভাবে সাফাই দিতো আল্লাহর কাছে: আল্ আবৃদু আবদুল্লাহ, আল্ বায়তু বায়তুল্লাহ্ আল্ কালামু কালামুল্লাহ অর্থাৎ এ বান্দাও আল্লার বান্দা, এ ঘরও আল্লার ঘর, এ কোরানও আল্লার কালাম। অতএব (তার মতে) এতে কোনো অন্যায় বা পাপ নেই। অধিকতর সেয়ানা আর এক ব্যক্তি এটা টের পেয়ে একদিন লাঠি হাতে আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখে শুনে ম্পাজদ্যরবো জরোল্লাহ্ অর্থাৎ মারটাও আল্লার মার বলে চোরটাকে বেদম লাঠি পেটা করে ছাড়লো।
মনে হচ্ছে, এ চোর এবং দণ্ডদাতা উভয়ে আল্লার সার্বভৌমত্বেই বিশ্বাসী। একই বিশ্বাসের লজিক বা যুক্তি দুজন মানুষকে কেমন পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপে অনুপ্রাণিত করেছে তা দেখে রীতিমতো অবাক হতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লার সার্বভৌমত্বের এমন ধারা ধারণা যদি সামাজিক ও নাগরিক জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রসার লাভ করে, তাহলে অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? জগৎ সংসারের ওপর আল্লার সার্বভৌমত্বে যদি ভাবলোকে অর্থাৎ থিওরেটিকেলি স্বীকার করা হয় আর ব্যবহারিক জীবনে করা হয় সম্পূর্ণ অস্বীকার, তাহলে পদে পদে আত্মপ্রবঞ্চনা করাই হবে মানুষের নিয়তি। ব্যবহারিক জীবনে স্বীকার করা হলে কী দশা ঘটে তার নজির ওপরে উল্লেখিত চোর ও তার দণ্ডদাতা। মসজিদ বা কোরাণের সংকীর্ণগণ্ডি ছাড়িয়ে অথবা একটা চোর ও একজন দণ্ডদাতার সীমা অতিক্রম করে বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে এ ধারণা ও বিশ্বাসকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করলে আমার বিশ্বাস, সামাজিক জীবন আর জঙ্গলজীবনে কোনো পার্থক্যই থাকবে না। গৃহস্থ ও চোর উভয়েই যদি অন্তরের সঙ্গে পার্থিব ব্যাপারেও আল্লার সার্বভৌমত্ব মেনে নেয় আর তা প্রাত্যহিক জীবনে পরীক্ষা করতে শুরু করে, তাহলে অবস্থাটা যা দাঁড়াবে তা কল্পনা করতেও হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। তখন আইন বলে যদি কিছু থাকে তা একই সঙ্গে গৃহস্থ এবং চোর উভয়ে নিজ নিজ স্বার্থানুসারে নিজ নিজ হাতে তুলে নিতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করবে না। যেমন ওপরে বর্ণিত চোর ও দণ্ডদাতা করে নি। পার্থিব ব্যাপারে আল্লাহ ও ধর্মকে টেনে আনলে তা এমনি দুধারী করাত হয়ে উঠবে।
আমার বক্তব্য : যা অপার্থিব তাকে অপার্থিব থাকতে দিন–যা পার্থিব তাকে সর্বতোভাবে পার্থিবের এলাকাতেই সীমাবদ্ধ রাখুন। অপার্থিবের তথা আধ্যাত্মিকের প্রেরণা ও তৃষ্ণা মানুষ যে একেবারে অনুভব করে না বা তার কোনো প্রয়োজন নেই তা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি বলতে চাচ্ছি, তা ব্যক্তিগত সাধনা ও উপলব্ধির ব্যাপার। তাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে টেনে আনায় আমার আপত্তি, টেনে আনলে শুধু সামাজিক জীবন নয়, আধ্যাত্মিক জীবনও নাজেহাল হয়। সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ পার্থিব ব্যাপার–যে মানুষ নিয়ে সমাজ সে মানুষও আগাগোড়া পার্থিব। কাজেই অপার্থিবের দোহাই দিয়ে এমন সমাজকে শাসন পরিচালনা করতে গেলে তা ব্যর্থ হবেই। এ ব্যর্থতার নজির আজ সর্বত্র। কেতাবের ইসলাম আর জীবনের ইসলামের মাঝখানে আজ বিরাজ করছে এক প্রশান্ত মহাসাগর। সব ধর্মের বেলায় এ কথা সত্য।
মানুষের মধ্যে একটা সনাতন মেষ-বৃত্তি আছে। জিজ্ঞাসা ও মননশীলতার অভাব ঘটলে মনের সে মেষ-প্রবৃত্তিটাই একক হয়ে ওঠে। তখন গতানুগতিকতা আর অন্ধ অনুসরণই চরম মোক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস নিঃসন্দেহ রূপে প্রমাণ করেছে, ধর্ম মানুষকে মানুষের হাত থেকে বাঁচাতে পারে নি। ধর্মযুদ্ধ কথাটাই একটা স্ববিরোধী উক্তি। ধর্মকে মানবতার ওপর স্থান দিতে গিয়েই মানুষ এ ধরনের বহু স্ববিরোধিতার শিকার হয়েছে। যার ফলে যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে অপরিমেয়। ধ্বংস নেমে এসেছে। আর এ ধ্বংসের পেছনে এক বড় ভূমিকা নিয়েছে পরকাল–সে পরকাল অদৃশ্য, অপ্রামাণ্য ও সম্পূর্ণ অপার্থিবকে পার্থিবের এলাকায় টেনে আনলে বিভ্রান্তি অনিবার্য। আল্লার সার্বভৌমতুকে জাগতিক ব্যাপারে টেনে আনলে যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয় তাতে প্রবেশের পথ পাওয়া গেলেও বের হওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিজ্ঞান বা বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করে বিশ্ব ও মানবসৃষ্টি সম্বন্ধে যদি ধর্মীয় মতবাদও মেনে নেওয়া যায়, তাহলেও জাগতিক ব্যাপারে আল্লার সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার বিপদ অনেক, যেমন অনেক বিপদ সন্তানের ওপর পিতা-মাতার সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার। তাই কোনো ইসলামি রাষ্ট্রেও শেষোক্ত সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি পায় নি। স্বয়ং ইসলামের নবীও ওই ধরনের সার্বভৌমতু নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন তার নবী জীবনের শুরুতে। অথচ আল্লার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের চেয়ে পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অধিকতর প্রত্যক্ষ ও অধিকতর বাস্তব।
যে ধর্ম ইহকালে মানুষ রক্ষা করতে পারে নি, পারছে না–সে ধর্ম পরকালে মানুষকে রক্ষা করবে এমন অলৌকিক বিশ্বাসে কেউ যদি স্বস্তিবোধ করেন তাতে আপত্তি করার কোনো কারণ নেই; কিন্তু আমার আপত্তি হচ্ছে অলৌকিককে লৌকিক ব্যাপারে টেনে আনায়। বলা বাহুল্য, দেশ,সমাজ, রাষ্ট্র–এ সবই লৌকিক ব্যাপার।
আর পরলোকে যদি কোনো ‘প্রবেশিকা’ পরীক্ষা হয় তা হলে মানুষের জন্য মনুষ্যত্বের পরীক্ষা না হয়ে ধর্মের তথা ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের পরীক্ষা হবে, তেমন বিশ্বাস মানববুদ্ধির অপমান। ঈশ্বরের অপমান আরো বেশি–কারণ তখন তাকে খাটো করে টেনে এনে বসানো হয় সুপরিচিত গুরুমশায়ের আসনে।
পাকিস্তান-হিন্দুস্থানের আয় দায় অর্থাৎ assets and liabilities ভাগ-বাটোয়ারার সময় আল্লাহ নাকি পাকিস্তানের ভাগেই পড়েছেন। তবে তখন তা আয় না দায় ভালো করে বোঝা যায় নি। এখন বুঝতে পারা যাচ্ছে, পাকিস্তানের এ এক মস্ত বড় দায়। দোহাই–কথাটি আমার নয়, আমি মরহুম জাস্টিস কায়ানীর ভাষণ থেকেই চুরি করেছি। প্রমাণ হিসাবে এ প্রসঙ্গে তার শেষ মন্তব্যটাও উদ্ধৃত করছি :
‘Undoubtedly the Lord God is an asset when the nation is going to run, but in the name of the Lord God, the Beneficent,the Merciful,some of us are apt to develop a narrow pseudo-reli-gious outlook as though the Lord God belonged to us only, and were not the Lord of the Universe, which is the true meaning of Rabbul Alamin. And that is how He is made a liability’
(Vide : Not the Whole Truth: Page-186)
বলা বাহুল্য, এ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন স্বয়ং পাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। শুধু ভূমিকা নয়–কায়ানীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি। এ liability বা দায় আমাদের শাসনতন্ত্রে শুধু নয়, সমাজের প্রতিস্তরেও অনুপ্রবেশ। করে কী রকম আত্মপ্রবঞ্চনা ও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে,আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তার একটিমাত্র দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি : মাত্র কয়েক বছর আগেকার ঘটনা। পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটির বার্ষিক সভা। ওই প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সভাপতি চট্টগ্রামের প্রাক্তন কমিশানার মি. এন. এম. খান আই. সি.এস। কী কারণে সেবার তিনি উপস্থিত থাকতে পারেন নি। সভাপতিত্ব করছেন সহ-সভাপতি পূর্ব পাকিস্তানের জনৈক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সভার কাজ যথারীতি শুরু হয়েছে–কিছুদূর এগিয়েও গেছে। হঠাৎ একজন মুসল্লি মোত্তকি সদস্য বলে উঠলেন : স্যার, কোরান তেলাওয়াত হয় নি, কোরান তেলাওয়াতের পর সভার কাজ শুরু হওয়া উচিত।
সভাপতি বেকায়দায় পড়ে ইতস্তত করতে লাগলেন। সভার কাজ শুরু হয়ে গেছে, এখন হাঁ করা মানে কেঁচে গণ্ডুষ করা, না করা তো এক রকম অসম্ভব। কায়ানী সাহেব যে দায়ের কথা বলেছেন সে দায় রক্ষা না করে উপায় নেই। অগত্যা সভাপতি আমতা আমতা করে বললেন : আচ্ছা তেলাওয়াত করুন, আপনিই করুন। কয়েক মিনিটের জন্য কর্মসুচি মূলতবি রেখে তাই করা হলো।
পরের বৎসর আবার সে একই প্রতিষ্ঠানের একই বার্ষিক সভা–একই স্থানে উপস্থিত সদস্য শ্রোতারাও, একই মুসল্লি মোত্তকি সদস্যরাও সদলবলে হাজির। কিন্তু ঘটনাচক্রে এবার স্থায়ী সভাপতি স্বয়ং এন. এম. খান উপস্থিত–তিনিই সভাপতিত্ব করছেন। এন. এম. খান দুর্দান্ত অফিসার–এ খবর সবারই জানা। পরিচিতদের সঙ্গে কুশল জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে তিনি সভার কাজ শুরু করে দিলেন বিনা তেলাওয়াতে, বিনা ভূমিকায়। কেউ টু শব্দটিও করলেন না। সে মুসল্লি মোত্তকি সদস্যটিও কোরান তেলাওয়াতের কথা এবার ভুলে রইলেন বেমালুম। নাচ গানে ভরপুর বিচিত্রানুষ্ঠানও কোরান তেলাওয়াত করে শুরু হতে দেখেছি। অকারণে ধর্মকে কোথায় টেনে আনা হচ্ছে এসব তারই দৃষ্টান্ত।
পাকিস্তানের অন্যতম চিন্তাবিদ মি. এ. কে. ব্রোহী তার Religion and Freedom’ প্রবন্ধটি শেষ করেছেন রবীন্দ্রনাথের এ বিখ্যাত উক্তি দিয়ে : ‘I love God,because he has given me freedom to deny him’ যে ঈশ্বর বা আল্লাহ গুরুমশায়ের প্রতীক সে ঈশ্বর থেকে এ ঈশ্বরের ধারণা ও উপলব্ধি কি অনেক বড় ও মহত্তর নয়? আল্লাহর এ মহত্ত্বের সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত ক্যুনিস্ট দেশগুলি। ওরা তো ঈশ্বর, আল্লাহ, গড় কিছুই মানে
। তবুও আল্লাহ তাদের ক্রমোন্নতি আর সুখ সমৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন অথবা ওই সব দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেশ থেকে বেশি তেমন কথা এ যাবত শোনা যায় নি। যদি বলেন ওরা মজাটা টের পাবে পরকালে গিয়ে তাহলে অবশ্যই নিরুত্তর থাকতে হয়।
সব রকম অলৌকিকতার অস্তিত্ব মানুষের ধারণা ও উপলব্ধির ওপর নির্ভরশীল–ঈশ্বর এবং পরকালও। যা কিছু মানুষের ধারণা ও উপলব্ধির বাইরে তা শুধু অস্তিত্বহীন তা নয়, মানুষের জীবনে তার কোনো দামও নেই। যে ঈশ্বর তাকে শুদ্ধ না মানবার স্বাধীনতা মানুষ দিয়েছেন, সে ঈশ্বরের conception বা উপলব্ধি মানুষের প্রত্যয় ও আত্মমর্যাদার দিগন্তরেখা যে শুধু অবারিত করে দেয় তা নয়, মানুষকে নবতর চেতনা আর জিজ্ঞাসায়ও করে তোলে উদ্বুদ্ধ। এভাবে নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরে এলেই মানুষের পক্ষে মনুষ্যত্বের শাসন তথা মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে সহজ। ধর্মের ওপর জোর দিতে গেলেই ঈশ্বরের আবির্ভাব অনিবার্য। আর ঈশ্বর মানে সাম্প্রদায়িক ঈশ্বর–পশ্চিমের বেলায় জাতীয় ঈশ্বর। লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য এক হলেও আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের মতো আল্লাহ, ঈশ্বর এবং গড নিয়েও কারো সঙ্গে কারো মিল নেই, মিল হবেও না। মুসলমানের আল্লাহ আর হিন্দুর ঈশ্বর এক নয়, তেমনি হিন্দুর ঈশ্বর আর খ্রিস্টানের গডও এক নয়–বুদ্ধ মানুষ হয়েও কোটি কোটি মানুষের আরাধ্য। এভাবে যেখানে মূলের পার্থক্য, সেখানে ব্যাখ্যা আর উপলব্ধিতে তারতম্য ঘটবেই। ফলে আচার-অনুষ্ঠানেও শুধু তারতম্য নয়–বিরোধও অনিবার্য। আর দেখা গেছে, অতি সহজে এ বিরোধ হয়ে ওঠে বারুদ। নীতিহীন, মনুষ্যত্বহীন রাজনীতি এ বারুদে অগ্নিসংযোগ করতে এক মুহূর্তও ইতস্তত করে না। ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের এটাই তো পটভূমি। কিন্তু মনুষ্যত্বের ব্যাপারে এ বিরোধ ও উপলব্ধির দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্য নেই বলে সহজে ওটাকে মানুষের স্থির মিলন-কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ করে তোলার দায়িত্ব আমাদের দু দেশের শুধু নয়–পৃথিবীর তাবৎ বুদ্ধিজীবীদের বলেই আমার বিশ্বাস।
[‘মানবতন্ত্র’ প্রথম প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৭১ সংখ্যায়। এটি প্রথম সংকলিত হয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে। ১৯৭২-এ এটি মানবতত্র নামে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।]