মাননীয় দ্বারকানাথ মিত্র, ভবানীপুর
হুগলী জেলার আগুসি গ্রামে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে মাননীয় দ্বারকানাথ মিত্র জন্মগ্রহণ করেন। জাতিতে তিনি ছিলেন কায়স্থ। “তাঁর পিতা ছিলেন হুগলী কোর্টের মোক্তার; অবস্থা তাঁর বিশেষ ভাল না হলেও, পুত্রকে তিনি উদারনৈতিক ও ভালভাবে শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেন। দ্বারকানাথ শিক্ষালাভ করেন হুগলী কলেজে থেকেই এখানে তাঁর বিশিষ্টতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সহপাঠীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য। পরবর্তীকালে তাঁকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করা হয়। এই সময়কার শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, পাঠাভ্যাস ও রচনা সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি ইংরেজি ভাষায় তাঁর বিশেষ অধিকারের পরিচয় দিয়েছিলেন। লর্ড বেকনের ওপর প্রতিযোগিতামূলক রচনা লিখে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন; মনে হয়, ১৮৫২তে এই প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রচনাটি এডুকেশন রিপোর্টে ছাপানো হয়েছিল। বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক ডি এল আর সহ অন্যান্য বহু সাহিত্য সমালোচক রচনাটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৮৫৫তে তিনি কলকাতা পুলিস কোর্টের জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট বাবু কিশোরীচাঁদ মিত্রের দোভাষীর চাকরি গ্রহণ করেন। অল্পকালের মধ্যে প্লিডারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সদর কোর্টের উকিল হন। এখানে প্রবীণ উকিলদের কাছে তিনি কোন সহানুভূতি না পেলেও তাঁকে সাদরে কাছে টেনে নেন তদানীন্তন জুনিয়র সরকারি উকিল বাবু শম্ভুনাথ পন্ডিত। পরবর্তীকালে জজ হিসাবে তিনি এঁরই স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। উচ্চ গুণের অধিকারী দ্বারকানাথকে উপেক্ষা অবহেলার যন্ত্রণা বেশি দিন সহ্য করতে হয় নি। হাইকোর্ট স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সৌভাগ্যসূর্যও উদিত হতে থাকে। এখানে তিনি তাঁর বিদ্যাবত্তা ও গুণের মর্যাদা দিতে পারেন এমন সব ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য লাভ করেন। স্যার বার্নেসই সর্বপ্রথম তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতার স্বীকৃতি দেন। মিত্রের আইন ও আইনের মূলনীতির ওপর দখল ভারতীয় আইনকানুন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, এবং আইন ব্যবসায়ী হিসাবে তাঁর দক্ষতার পরিচয় পেয়ে প্রভাবশালী বার্নেস এতই চমৎকৃত হন যে, তিনি প্রথমাবধিই মিত্রকে তাঁর সমর্থন জানান; অল্পকালের মধ্যে অন্যান্য জজ, ব্যারিস্টার উকিলগণ ও আদালতের কর্মচারীবর্গ তাঁর গুরুত্ব ও চারিত্রিক দৃঢ়তা উপলব্ধি করেন। আইনজ্ঞ হিসাবে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত, কিন্তু খ্যাতিলাভ করেছিলেন তিনি মূলত তাঁর সততা ও অনমনীয় স্বাধীনচিত্ততার জন্য। অনৈতিক ব্যবসায়ের সঙ্গে সমার্থক ভেবে এতদিন শিক্ষিত এদেশবাসী আইন ব্যবসাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে চাইতেন না। পুরাতন আইন ব্যবসায়ীদের মধ্যে বহু সম্মানীয় ব্যক্তি যে ছিলেন না তা নয়, তাঁদের অনেকে দেশের গৌরবও, কিন্তু তবুও সাধারণভাবে জনগণ আইন ব্যবসায় ও আইন ব্যবসায়ীদের খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন না; সে অবশ্য অধিকাংশ ব্যবহারজীবীর আচার আচরণের জন্যই। সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুরাতন সদর কোর্টের নিম্নমানের পরিবেশের জন্য, না– ইংরেজি শিক্ষা না থাকায় পেশাগত মর্যাদাবোধ ও আত্মসম্মানবোধের অভাবের জন্য জনগণের মনে এমন একটা ধারণার উদ্ভব হয়েছিল, তা নিরূপণ করতে যাওয়া বৃথা। একথা বললেই যথেষ্ট হবে যে, উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এই পেশা গ্রহণ করতে থাকায়, এবং এঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন বাবু দ্বারকানাথ মিত্র, দেশীয় আইনজীবীদের সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে, নব্য শিক্ষিতদের মধ্যে এখন স্বাধীন বৃত্তি হিসাবে আইন ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের নৈতিক প্রভাব আবার বহু বিস্তৃত হয়েছে। দেশে এখন এমন জেলা প্রায় নেই বললেই চলে যেখানকার আদালতে অন্তত পক্ষে জনা ছয় শিক্ষিত ব্যবহারজীবী না আছেন। এই পরিবর্তনটি সাধিত হয়েছে বাবু দ্বারকানাথ মিত্র এবং সমগোত্রীয় ব্যক্তিদের দ্বারা। ব্যবহারজীবী হিসাবে তিনি বহু সদ্গুণের অধিকারী ছিলেন। ধৈয্যশীল এই মানুষটি কোন মামলা হাতে নেবার আগে তার সব দিক খুঁটিয়ে বুঝে নিতেন। তীক্ষ্ণধী ছিলেন বলে, অতি দ্রুত তিনি তাঁর মামলার গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলি বুঝে নিতে পারতেন; মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর ভাষণ হত বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিচ্ছন্ন, তাই প্রায়ই দেখা যেত আদালত তাঁর অভিমত গ্রাহ্য করছেন! স্বাভাবিক বাগ্মিতা থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি বিচারকদের মনের ওপর কার্যকরী আবেদন রাখতে সক্ষম হতেন। প্রতিপক্ষ যত দক্ষতার সঙ্গেই তাঁদের বক্তব্য পেশ করুন না, নির্ভীক দ্বারকানাথ আপন কর্তব্য থেকে কখনও বিচ্যুত না হয়ে তাঁর মামলার বিষয়গুলি পরিচ্ছন্নভাবে পেশ করে যেতেন; প্রখ্যাত ব্যারিস্টারদের বিরুদ্ধেও তিনি পরম স্বচ্ছন্দে সওয়াল করে যেতেন। এজন্য তাঁরা তাঁকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখতেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন পুরোপুরি সৎ এবং স্বাধীনচিত্ত; কোন অবস্থাতেই তিনি প্রতিপক্ষের ভুল ত্রুটি বা দুর্বলতার সুযোগ যেমন নিতেন না, তেমনি স্বীয় মক্কেলের মামলার বিষয়বস্তু সুপরিস্ফুট করবার জন্য, জজদের পক্ষে যত বিরক্তিকরই হোক তিনি নিজের বক্তব্য নিখুঁতভাবে, নির্ভীকভাবে এবং স্বাধীনচিত্ততার সঙ্গে পেশ করে যেতেন। চাইলে, তিনি তাঁর ব্যবহারজীবী জীবনের বহু গৌরবজনক অধ্যায়ের কাহিনী বলতে পারতেন। তবে, ১৮৬৫-র রাজস্ব মামলায় তিনি একটানা সাত দিন ধরে হাইকোর্টের সকল জজের সামনে যে ভাবে সওয়াল করেছিলেন– এবং সে সওয়ালে যে-ভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি, ল্যান্ডলর্ড ও টেন্যান্ট সম্পর্কীয় ইংলিশ ল’, ভারতীয় রাজস্ব বিধি এবং দেশীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান একের পর এক বিবৃত করতে থাকেন, তাতে তাঁর কৃতিত্ব বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়। সে মামলায় তিনি সওয়াল শুরু করতেন বেলা এগারটায় আর শেষ করতেন সন্ধ্যা ছ’টায়– শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও, বিষয়বস্তু ও যুক্তি উত্থাপনে তাঁর ক্লান্তি ছিল না। আদালতের প্রবীণ আইনজ্ঞগণ এ বিষয়ে তাঁর মতের বিরোধী ছিলেন, তাছাড়া খোদ প্রধান বিচারকের মুহূর্মুহূ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে, কিন্তু যে কৌশল ও দক্ষতার সঙ্গে সকল বিরোধিতা ও প্রশ্নের তিনি সম্মুখীন হয়েছিলেন, সে হয়ে উঠেছিল পরম আনন্দদায়ক। অল্পকালের জন্য তিনি অস্থায়ী জুনিয়র গর্ভনমেন্ট প্লিডারের স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। এরপর তাঁর বন্ধু ও সহ ব্যবহারজীবী, হাইকোর্ট বার ও বেঞ্চের অলঙ্কারতুল্য, মাননীয় শম্ভুনাথ পন্ডিত মহাশয়ের পরলোকগমনে, দ্বারকানাথ (হাইকোর্টের জজরূপে) ১৮৬৭-র জুন মাসে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং উচ্চ ও সম্মানজনক পদে সাত বছর অধিষ্ঠিত থাকেন। এই নিয়োগের ফলে আর্থিক দিক থেকে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন, কারণ, ব্যবহারজীবী হিসাবে তখন তাঁর উপার্জন ছিল, শোনা যায়, বার্ষিক ৫০,০০০ টাকা। কিন্তু তিনি দ্বিতীয়বার জজপদে নিযুক্ত হওয়ায়, উচ্চতম পদসমূহে এদেশীয়দের নিযুক্ত হবার দাবী ও যোগ্যতা প্রমাণিত হয়। মাননীয় শম্ভুনাত পন্ডিতের দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে হাইকোর্টের অন্যান্য বিচারকবর্গ, সরকার ও জনগণ সর্বৈবভাবে সহমত ছিলেন; এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, পার্লামেন্ট এদেশবাসীদের দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারকের পদে নিয়োগের অনুমতি দিয়ে বাস্তব উপলব্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন, আর মাননীয় দ্বারকানাথ মিত্র তাঁর দক্ষতা দ্বারা ভারতীয়দের চারিত্রিক পরিচয়কে উজ্জ্বলতর করেন। ব্যবহারজীবী থেকে বিচারক পদে উন্নীত হবার পর, তাঁর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়, কিন্তু দায়িত্ব যতই বাড়ুক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর সুবিবেচনা, সম্পূর্ণতা ও একান্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করেন। ধীর, স্থির, বিজ্ঞ এবং দৃঢ়চেতা দ্বারকানাথ হয়েছিলেন আদর্শ বিচারক; আদালতের অন্যান্য বিচারক ও ব্যবহারজীবীগণ তাঁকে সমভাবে সম্মান করতেন। স্যার বারনেস্ তো তাঁর প্রতি প্রায় অপত্য স্নেহ পোষণ করতেন। তখনও তিনি প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পৌঁছননি, বয়স মাত্র ৪০ বছর- কিন্তু যুবাবৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন; তার কারণ, তাঁর দক্ষতা ও স্বাধীনচিত্ততা। ‘উইকলি রিপোর্টার’ গত সাত বৎসরে তাঁর প্রদত্ত বহুমূল্যবান ও স্মরণীয় রায় সংগৃহীত হয়ে আছে; বহু ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সহবিচারকদের থেকে আলাদা মত পোষণ করতেন; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর দেওয়া রায়-ই প্রিভি কাউনসিল অনুমোদন করতেন। ‘দি গ্রেট আনচেটিটি কেসের’ ফুল বেঞ্চ বিচারে বিচারপতি দ্বারকানাথ প্রায় সম্পূর্ণতই তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি ব্যাপৃত ছিলেন– এই মামলায় তাঁর প্রদত্ত রায় সারা দেশকে বিস্ময়ে অভিভূতও করেছিল, দেশবাসী তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল। দেশের উচ্চতম শ্রেণির পদের অধিকারী হলেও, তিনি অহঙ্কার ও গর্বের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন– তাঁর স্বভাব ছিল শিশুসুলভ সরলতায় পূর্ণ। মানুষ ছিলেন একান্তই সাদাসিধে। জনগণের কোন আন্দোলনে তিনি অংশ নিতে পারেননি, এটা দুঃখের, অবশ্য শেষ জীবনে তিনি যে উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তার জন্য তাঁর কোন আন্দোলনে অংশ গ্রহণ সম্ভবও ছিল না, তবে প্রতিটি আন্দোলনের প্রতি তিনি সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন, এ-সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাও করতেন। কোঁতের দর্শনে তিনি আস্থাবান ছিলেন; স্যার পীকক্ বার্ণেসের বাড়িতে একদিন তিনি মানবধর্ম সম্বন্ধে ভোজনান্তিক চমৎকার একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। ফরাসী ভাষা জানা থাকায় ফরাসী সাহিত্য মূলভাষায় পাঠ করে তিনি যথেষ্ট আনন্দ পেতেন। ফ্রান্স ও প্রাসিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে আগ্রহান্বিত ছিলেন, তাঁর সহানুভূতি ছিল বীর ও কল্পনাপ্রবণ ফরাসী জাতির প্রতি। যে-কোন প্রকারের নির্যাতন নিপীড়নকে তিনি ঘৃণা করতেন, বিচারক হিসাবে তাঁর সহানুভূতি থাকত দুর্বল ও দরিদ্রদের প্রতি। আইন ও শৃঙ্খলার প্রবক্তা রূপে শক্তিমদমত্তদের বদখেয়াল ও দুর্নীতির মুখোশ তিনি নির্ভয়ে খুলে দিতেন। কুখ্যাত ‘মালদহ কেস’-এ ব্যক্তিগত সরকার (Personal government)-এর কুকীর্তিসমূহ তিনিই সর্বপ্রথম অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ফাঁস করে দেন, তাঁর দৃষ্টান্ত সমান সাহস নিয়ে অনুসরণ করেন বিচারপতি কেম্প ও বিচারপতি ফিয়ার (Phear); ফলে দ্বারকানাথের নিকট প্রেরিত গভর্নর জেনারেলের গোপনীয় পত্র মারফৎ বেলভেডিয়ারের ‘বজ্র’ তাঁর ওপর নেমে আসে; পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সকলের ধারণা হয়, তেমন সুযোগ পেলে স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল আর কোন ভারতীয়কে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবেন না। সে কাহিনী থাক। এমনিতে গভীর অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ দ্বারকানাথ ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনার সময় কড়া ভাষায় ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশে দ্বিধা করতেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন জনগণের মানুষ, তিনি তাদের প্রতি অনুষ্ঠিত অন্যায়, অত্যাচারের সুবিচার করতেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তাদের আন্দোলনের সামনে আসতে পারেন নি। ব্যাপকভাবে তিনি অধ্যয়ন করতেন, কিন্তু লেখার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। একমাত্র বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতির ওপর তিনি মুখার্জির ম্যাগাজিনে কয়েকটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের ভক্ত, সময় তাঁর কমই ছিল, কিন্তু সেই সময়টুকুরও অনেকখানি তিনি ব্যয় করতেন বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তকাদি পাঠ করে। কিছুদিন তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ফাদার লা-ফর বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতা নিয়মিত শুনতে যেতেন। ডাঃ সরকারের সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের উন্নতিকল্পে চার হাজার টাকা দান করে তিনি তাঁর বিজ্ঞান প্রীতির পরিচয় দিয়েছিলেন। দানশীলতা ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ; প্রকৃত অভাবী কোন মানুষ তাঁর সাহায্যপ্রার্থী হয়ে বিমুখ প্রায় কখনও হতেন না। অত উচ্চপদে আসীন হলেও, বিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সঙ্গে তিনি সেই পূর্বের সারল্য নিয়েই মেলামেশা করতেন। তিনি ছিলেন খোলামেলা মনের মানুষ, লোক-দেখানো কোন কিছুর তিনি ধার ধারতেন না; অবশ্য অপরিচিত ব্যক্তিদের নিকট তিনি ছিলেন গম্ভীর ও স্বল্পভাষী; তবুও তাঁর পরিচিত মহলে তিনি ছিলেন সর্বজনপ্রিয়।” (দি হিন্দু পেট্রিয়ট, ২ মার্চ, ১৮৭৪)
গলার ক্যান্সারে দ্বারকানাথ বেশ কয়েকমাস ভুগেছিলেন; এই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ভাইসরয়ের পক্ষ থেকে তাঁর দেহরক্ষী, হাইকোর্টের বিচারকগণ, অসংখ্য বন্ধুবান্ধব ও গুণমুগ্ধ ব্যক্তি। অসুস্থ অবস্থায় তাঁর স্বগ্রাম দেখবার বাসনা হয়; স্থান পরিবর্তনে স্বাস্থ্যর উন্নতি হতে পারে ভেবে, চিকিৎসকগণও এতে সম্মতি জানান। কিন্তু রোগের আর উপশম হল না, জন্মস্থানেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ১৮৭৪-এর ২ মার্চ। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান বৃদ্ধা মাতা, তরুণী স্ত্রী ও তিনটি নাবালক সন্তান। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র জাতির ওপর শোকের ছায়া নেমে আসে। [প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, দ্বারকানাথ ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। দ্বারকানাথের প্রথমা ও দ্বিতীয়া স্ত্রীর অকালে মৃত্যু হওয়ায় তৃতীয়বারে তিনি বিবাহ করেন বর্ধমান জেলার বেনাপুরের জমিদার প্রাণগোবিন্দ রায় চৌধুরীর জ্যেষ্ঠা কন্যাকে]। তাঁর মৃত্যুতে হাইকোর্টের বিচারকগণ এক সভায় মিলিত হয়ে পরলোকগত সহকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে পরোলকগত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার জন্য সেদিনকার মতো হাইকোর্টের ছুটি ঘোষণা করেন। উক্ত শোক-সভায় বিচারপতি লুই জ্যাসান্ আবেগপূর্ণ দীর্ঘ ভাষণে দ্বারকানাথের অসাধারণ গুণাবলী ও অমূল্য সেবার উল্লেখ করেন। অ্যাডভোকেট জেনারেল অনুপস্থিত থাকায়, স্ট্যান্ডিং কাউনসেল মিঃ কেনেডি ইংরেজ ব্যবহারজীবীদের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন :
“মিঃ জাসটিস মিত্রকে ব্যবহারজীবীমহল, সাধারণভাবে, যে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন, তাঁর খ্যাতি সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও কম নয়–তার থেকে বলতে পারি, তাঁর পরলোকগমনে বার ও বেঞ্চের যে ক্ষতি হল, সে ক্ষতি, আমার ধারণা, কখনও পূরণ হবার নয়। লার্নেড় জজ তাঁর ভাষণে যে কথাগুলি বললেন সে সবই ব্যবহারজীবী মহলের প্রত্যেকের মনের কথার প্রতিধ্বনি। তাঁর প্রজ্ঞার জন্য যে- ভাবে অনুপ্রাণিত বোধ করতাম, তেমন অনুপ্রেরণা অন্য কোন বিচারকের কাছ থেকে আমরা পাইনি, তাঁর মতো অন্য কোন বিচারপতি আমাদের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হন নি; এমন বিচারপতি খুবই কম, যিনি তাঁর মতো সঠিক ও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গিযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলার নিষ্পত্তি করতে পারেন। অবশ্য, এই সূত্রে একটা বিষয় স্বীকার করতে হবে যে, তিনি এই উপমহাদেশবাসীদের ভাষা জানতেন, তাঁদের রীতিনীতির সঙ্গে চিরপরিচিত ছিলেন, এই সুবিধা অপরাপর বিচারপতির ছিল না। এ ক্ষতি শুধু বার, বা মামলাকারীরাই অনুভব করবেন না, অনুভব করবে সমগ্র জাতি–এ ক্ষতি অপূরণীয়।”
সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার এতই শোকাভিভূত হয়ে পড়েন যে, তাঁর পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হয় নি; তাঁর পক্ষ থেকে বলেন অ্যাপলেট কোর্ট বারের নেস্টর মি: আর টি অ্যানেল। তিনি তাঁর দীর্ঘ ভাষণে দ্বারকানাথের দুর্লভ গুণাবলী ও বিদ্যাবত্তার উল্লেখের পর এই বলে উপসংহার টানেন :
“সামান্য যে-কটি কথা আমি বললাম তার সমাপ্তি টানতে এ কথা বলা একান্ত প্রয়োজন, এবং আমার ধারণা, তিনি স্বয়ং তাঁর জীবনের প্রকৃত পরিচয় হিসাবে একথা মেনে নিতেন : স্বভাবতই তিনি দয়াপ্রবণ, স্নেহপরায়ণ ও সমভাবে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের প্রতি বন্ধুবৎসল ছিলেন কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য যে, তাঁর স্বদেশবাসীর প্রতিই তাঁর ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়তর। তাঁর স্মৃতিস্তম্ভে এই উক্তি খোদিত করা যায় (সম্ভবত তিনি স্বয়ং এটি অনুমোদন করতেন) :
আমার দেশের মনে এই কথা লেখা থাক,
ইনি সেবা করেছিলেন স্বদেশের
এবং ভালবেসেছিলেন স্বদেশবাসীকে।”
দ্বারকারনাথের মৃত্যুতে বড়লাট বাহাদুরও গভীর শোক-জ্ঞাপক এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিলেন।
দ্বারকানাথ হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ডের অন্যতম অছি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন। বস্তুত তিনি ছিলেন শিক্ষা বিস্তারে পরমোৎসাহী। ভবানীপুরের বাড়ীতে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে রেখে তাদের খাদ্য বস্ত্র পাঠ্যপুস্তক ও বিদ্যালয়ের বেতন দিতেন। স্বগ্রামে তিনি প্রতি বছর দূর্গাপূজার অনুষ্ঠান করতেন। সে সময় তিনি বেশ কিছু সংখ্যক দরিদ্রনারায়ণের সেবাও করতেন।
তাঁর সন্তানগণ এখন ভবানীপুরের বাড়িতে বাস করছেন।