দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

মাদ্রাজে পার্টি গঠন

মাদ্রাজে পার্টি গঠন

মাদ্রাজে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কথা বলতে হলে সব কিছুর আগে উল্লেখ করতে হবে মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্রিয়ারের নাম। ১৯২২ সালে তাঁর বয়স ৪৭ বছরের মতো ছিল, অন্তত পুলিসের লোকেরা তাই মনে করতেন। আমার মনে হয় পুলিসের অনুমান সত্য নয়। তাঁর বয়স তখন আরও বেশি ছিল। তিনি মাদ্রাজ হাইকোর্টের উকিল ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি ওকালতি ছেড়ে দেন। ১৯২২ সালে তিনি মজুর আন্দোলন করতেন। পুলিসের ভাষায় তিনি মজুর আন্দোলনের একজন ‘কুখ্যাত’ ‘এজিটেটর’ ছিলেন। তার মানে তাঁর আন্দোলন কিছু শক্তি সঞ্চয় করেছিল। ১৯২২ সালে অসযোগ আন্দোলন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, সিঙ্গারাভেলু আর হাইকোর্টে ফিরে গেলেন না, ট্রেড ইউনিয়নের কাজ তো তিনি করছিলেনই, কাজেই অক্টোবর বিপ্লব যে মশাল জ্বালিয়েছিল তার দ্বারা তাঁর আকৃষ্ট হওয়া ছিল একান্ত স্বাভাবিক। বিদেশে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপিত হয়েছিল। ইতোমধ্যে মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখিত ‘পরিবর্তনের মুখে ভারত’ (India in Transition) নামক বইখানাও তিনি পড়ে ফেলেছিলেন। এই পুস্তকও তাঁর মনে দাগ কেটেছিল। এ সম্বন্ধে এম. এন. রায় আমাকে এক পত্রে লিখেছিলেন যে দক্ষিণ ভারতে একজন নেতা (সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার) পুস্তকখানি পড়ে তাঁকে জানিয়েছেন যে তিনি (সিঙ্গারাভেলু) তামিল ভাষায় তার তর্জমা করবেন। কিন্তু শুধু বলাই সার হয়েছিল। তামিল ভাষায় তর্জমা কখনও হয়নি।

গয়া কংগ্রেসে যোগ দিয়ে তিনি বিদেশ হতে আসা আমাদের প্রোগ্রামের সমর্থনে বক্তৃতা করেছিলেন,-বলেছিলেন তিনিও একজন কমিউনিস্ট। কিন্তু হাজার হোক, তিনি উকিল মানুষ ছিলেন। তাই নিরুপদ্রব সংগ্রামের কথাই তিনি বলেছিলেন। এই কথাটা খুঁচিয়ে তুলে গান্ধী ভারতের ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে অহেতুক সচেতন করে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভ্যরূপেই তিনি গয়া কংগ্রেসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার বুদ্ধিজীবী লোককে তেমন সঙ্গে টানতে পারেননি। বেলায়ুধন নামীয় একজন উকিল তার সঙ্গে এসেছিলেন। তাঁর নামে মোকদ্দমা করার কথাও উঠেছিল। কিন্তু পরে তাঁকে আমরা আর দেখিনি। পুলিস রিপোর্টে আছে যে বেলায়ুধনের সঙ্গে পুলিসের যোগাযোগ ছিল। তামিল দেশের একটি বিশিষ্ট পরিবারের একজন যুবক তাঁর সঙ্গে এসে জুটেছিলেন। কিছু দিনের ভিতরেই যুবকটির চালচলনে তাঁর মনে সন্দেহ জাগে। এই যুবকটি তামিল দেশের বাইরের কমিউনিস্টদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। কিন্তু তার অসাধুতা প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে পার্টি হতে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার সম্বন্ধে আরও অনেক কথা আমি পরে বলব।

আবদুল হালীমের যোগদান

১৯২২ সালের শেষার্ধ সম্বন্ধে আরও অনেক কথা বলা দরকার। এই সময়ে কমরেড আবদুল হালিমের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। শেষার্ধ হলেও জুলাই মাসের পরে নয়। এই পরিচয়ের ভিতর দিয়েই সে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে পথিকৃৎ হয়। সেই যে পার্টি গড়ার কাজে সে যোগ দিল তার পরে সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর কাল, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে ২৯ শে এপ্রিল তারিখে তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তাকে কেউ তার কাজ হতে বিচ্যুত হতে দেখেনি। গ্লাডস্টন ওয়েলী কোম্পানীর হাতে সিটি লাইটের জাহাজগুলির কলকাতার এজেন্সী ছিল। হালীম এই কোম্পানীর হাতে সিটি লাইনের জাহাজগুলির কলকাতার এজেন্সী ছিল। হালীম এই কোম্পানীর দ্বারা নিযুক্ত হয়ে কলকাতার পোর্টে আসার পরে এই সকল জাহাজে টালি ক্লার্কের কাজ করত। ১৯২১ সালে যুক্ত খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন যখন প্রবল আকার ধারণ করল তখন হালীম চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে পিকেটিং করতে গিয়ে সে গিরেফতার হয়ে জেলে গেল। ১০ই ডিসেম্বর (১৯২১) তারিখে অনেক স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে সে গিরেফতার হয়েছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ বড় বড় নেতারাও গিরেফতার হয়েছিলেন সেই দিনই। আদালতের বিচারে আবদুল হালীম ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। তার বয়স তখন বিশ বছর মাত্র। সে তার দণ্ডকাল কলকাতা প্রেসিডেন্সী জেলে ও খিদিরপুর ডক জেলে কাটিয়েছিল। গান্ধীজী দেশবাসীর নিকটে ওয়াদা করেছিলেন যে ১৯২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তারিখ তিনি ‘স্বরাজ’ পাইয়ে দিবেন। এমন ‘ভালো’ মানুষও সেদিন কিছু কিছু দেশে ছিলেন, যাঁরা সত্যই বিশ্বাস করেছিলেন যে ৩১শে ডিসেম্বর তারিখে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই তাঁরা স্বরাজ পেয়ে যাবেন। অধিকাংশ লোক অবশ্য গান্ধীজীর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করেননি। হালীমেরা (সমস্ত ভারতবর্ষে সংখ্যায় তাঁরা হাজার হাজার ছিলেন) জেলে বসে ৩১শে ডিসেম্বর তারিখে স্বরাজ তো পেলই না, প্রস্তাবিত গণ-আইন অমান্য আন্দোলনও ১২ই ফেব্রুয়ারী (১৯২২) তারিখে গান্ধীজী বারাদোলিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ডেকে স্থগিত রাখলেন। কারণ, ৫ই ফেব্রুয়ারী (১৯২২) তারিখে কংগ্রেসের একটি বড় মিছিল (কৃষকদের মিছিল) পুলিসের ২১ জন কনস্টেবল ও একজন সাব ইনস্পেক্টরকে জোর তাড়া করলে তারা থানার ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে। বাইরে থেকে সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে ২২ জন পুলিশের লোকই পুড়ে মরে যায়। যে দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা ঘটেছিল সে দেশে চৌরি-চৌরাও ঘটতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের একনায়কের (গান্ধীর) কোমল হৃদয় তা সইতে পারল না। তিনি আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন।

১৯২২ সালের বসন্ত কালে হালীমেরা যখন বাইরে এলেন তখন সব কিছু জুড়িয়ে গেছে। দেশে কোনো আন্দোলন নেই, এখানে ওখানে সামান্য মজুর আন্দোলন ছাড়া। যে সকল ভলান্টিয়ার জেলে গিয়েছিলেন দেশে কোনো আন্দোলন না থাকার কারণে তাঁদের একটা অংশ বাড়ী ফিরে গেলেন, আর একটি অংশ স্কুল কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করতে লাগলেন। তৃতীয় অংশ না পারলেন ঘরে ফিরতে, না পারলেন স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে। তাঁরা হাতকাটা জামা (তখন তাই রেওয়াজ ছিল) পরে কলকাতার পথে পথে ঘুরতে লাগলেন। তাঁরা স্বাধীনতার ব্রত নিয়ে ঘরের বা’র হয়েছিলেন। আবদুল হালীম এই শেষোক্ত দলে ছিল। তবে, তার স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়ার কোনো কথাই ছিল না। সে নিজে নিজে পড়াশুনা করে বাঙলা ও ইংরেজি লিখতে শিখেছিল। মোটের উপরে ভালোই লিখত সে। আসলে মেট্রিকুলেশন পাস করা তো দূরের কথা, মেট্রিকুলেশন ক্লাসেও সে কোনোদিন ওঠেনি।

হালীমের এই ঘুরে বেড়ানো অবস্থায় তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রিডিং রুমে ৩২, কলেজ স্ট্রীটে। সেখানে সে মাসিক পত্রিকা পড়তে আসত। বাঙলা ও ইংরেজি বহু মাসিক পত্রিকা আসত সেখানে। অসহযোগ আন্দোলনে সে জেল খেটে এসেছে। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের কথা সে জানে, কিন্তু কখনও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য সে হয়নি, হওয়ার পথে বাধাও ছিল। আমাদের পথ ছিল সম্পূর্ণ নূতন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিষয়ে আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। আমি নিজেও তখন খুব বেশি কিছু জানতাম না। যা বুঝেছি তাই নিয়ে কাজে এগোব, সঙ্গে সঙ্গে পড়াশুনা করে আরও বেশি বুঝব, হালীমের সঙ্গে এই হলো আমার কথা। এটা বুঝেছিলেম যে কমিউনিস্টদের জীবনভোর ছাত্র থাকতে হয়। এই সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একদিন আবদুর রাজ্জাক খানের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল, তখন ওই পথ দিয়ে হালীম যাচ্ছিল। খান সাহেব আমায় বলেন, এই ছেলেটি খিদিরপুর ডক জেলে আমার সঙ্গে ছিল, বড় ভালো ছেলে। আপনি তার সঙ্গে কথাবার্তা বলুন। আমি খান সাহেবকে জানালাম যে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রিডিং রুমে হালীমের সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং কথাও হয়।

দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন সৃষ্টি করব ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলব এই অসাধ্য সাধনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা মর্মে অনুভব করছি। তবুও ভাবছি পথে যখন বা’র হয়ে পড়েছি তখন ফেরার পথ আর নেই। নলিনী গুপ্ত চলে যাওয়ার পূর্বক্ষণে ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সঙ্গে যে তাঁর দেখা হয়েছিল সেকথা পূর্বে বলেছি। তিনি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির লোক। অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কাজ-কর্ম বন্ধ থাকলেও ভূপেন্দ্রকুমারের পেছনে তখনও যুবকেরা রয়েছেন। তিনি যখন আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন এবং আমাদের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলবেন, এমনকি কাজও করবেন বলে ওয়াদা করলেন তখন আমি সত্যিই বড় খুশি হয়েছিলেম। নিজের মনে অনেকটা বলও পেয়েছিলেম।

এখানে আমি বলে রাখতে চাই যে কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেমে আমার প্রথম সংযোগ হয়েছিল ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সঙ্গে। অবশ্য, পরে তিনি তাঁর পুরনো পথে ফিরে গিয়েছিলেন।

আব্দুর রাজ্জাক খানের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। কিন্তু যে উপলক্ষ্যে তাঁর সঙ্গে আমার মার্কস-লেনিনবাদী চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করে কাজ করার ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার জন্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল সে কথা আমি আগেই বলেছি। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের পরেই তাঁর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। তার সঙ্গে আমার সংযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল, একসঙ্গে চলাফেরা ও উঠাবসা।

আবদুল হালীমকে আমি আমার রাজনীতিক কর্মক্ষেত্রে তৃতীয় সাথীরূপে পেয়েছিলেম এক সঙ্গে পঁয়তাল্লিশ বছর আমরা কাজ করেছি। তার পরে হালীমের আকস্মিক মৃত্যু আমাদের একত্রে চলার পথে ছেদ টেনে দিয়েছে।

১৯২২ সালের প্রথমার্ধে এবং তার লাগালাগি সময়ে আমার এই ক’টি বিশেষ রাজনীতিক সংযোগ হয়েছিল। অল্প কিছু দিনের ভিতরে এই যোগাযোগগুলি হলেও তার ক্রমটা আমি এখানে লিখে রাখলাম। কোনো দিন কারুর রেফারেন্সের জন্য এই হয়তো কাজে লেগে যেতে পারে।

শিশিরকুমার ঘোষ ও আবদুল রজ্জাক খান

আবদুর রাজ্জাক খান শিশিরকুমার ঘোষকে আমার ১০/১, ব্রাইট স্ট্রীটের আস্তানায় একদিন রাত্রে নিয়ে গিয়েছিলেন সে কথা আমি আগে বলেছি। খান সাহেব সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের যে ছোট দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তারই একজন নেতারূপে তিনি শিশিরের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর দিক হতে আন্তরিকতায় ভরা ছিল সেই পরিচয়। শিশিরের ভিতরে কোনো দুর্বলতা ছিল কিনা এবং খান সাহেব তার কথা কিছু জানতেন কিনা, আমায় আভাসে-ইঙ্গিতেও তিনি কিছু জানাননি। আমি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে শিশিরের সঙ্গে মেলামেশা করে যাচ্ছিলেম। ক্রমে আমি দেখতে পেলাম যে শিশিরের সঙ্গে আমারই পরিচয় খান সাহেব শুধু করিয়ে দেননি, তাঁর বয়সে বড় আপন মামাত ভাই আবদুস্ সত্তার খানের সঙ্গেও দেখলাম শিশিরের খুব দহরম-মহরম। এই আবদুস্ সত্তার খান বিপ্লবী রাজনীতি ভালোবাসতেন। আবদুর রাজ্জাক খান যে বিপ্লবীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন সেটা তিনি খুব ভালো চোখে দেখতেন। শিশির তাঁর কাছে যেতেন এই ভেবে যে হয়তো তিনি কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে দিতে পারবেন। নানান ধরনের লোকের সঙ্গে আবদুর সত্তার খানের বিস্তৃত পরিচয় ছিল।

আবদুর রজ্জাক খান বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বলেই আমি অন্য কোন সূত্র হতে আলাদাভাবে শিশিরকুমার ঘোষের পরিচয় নেওয়ার চেষ্টা কখনও করিনি। তিনি আমায় বলেছিলেন যে তাঁদের ছোট টেরোরিস্ট পার্টির প্রোগ্রাম বদলে যাবে, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রোগ্রাম মেনে নিয়েই তাঁরা কাজে এগিয়ে যাবেন। শিশির ঘোষও আমায় এই একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু শিশিরকুমার ঘোষের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় এবং খান সাহেবের সঙ্গেও, তাঁদের মধ্য হতে কেউ কেউ, যেমন ধীরেন বাগচী, বলেছিলেন জনগণ আবার কে? তারা তো গড্‌ডালিকা। তারা আমাদের অনুসরণ করবে।

নলিনী গুপ্ত বার্লিনে ফিরে গিয়ে দেখতে পেল যে সেখানে আমাদের প্রবাসী পার্টির কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। একজনে আমেরিকান লেখক, ডক্টর ডেভিড এন ডুহে লিখেছেন যে নলিনী গুপ্তের পরামর্শে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়াটার্স বার্লিনে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এটা সঠিক তথ্য নয়। গুপ্ত তখন ভারতবর্ষে ছিল। ১৫ই মে (১৯২২) হতে ইংরেজি ভাষায় পার্টির মুখপত্র “দি ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স” (The Vanguard of the Indian Independence) প্রকাশিত হয়েছে। এম. এন. রায়ের ইংরেজি পুস্তক ‘পরিবর্তনের মুখে ভারত’ও (India in Transition) বা’র হয়ে গেছে। শিশিরকুমার ঘোষকেও আমি সব কাগজ-পত্র পড়তে দিচ্ছি।

২৫, মির্জাপুর স্ট্রীটে (এখনকার সূর্য সেন স্ট্রীটে) শিশির ঘোষের ‘স্বদেশী এজেন্সী’ নামে একটি খদ্দরের দোকান ছিল। এই দোকানে অনেক যুবকের আনাগোনা ছিল। এই সময়ে একদিন আমি কলেজ স্কোয়ারের পুকুরের ধারে পায়চারি করছিলেম। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সঙ্গে। রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক সব কথা আমি বলেছিলেম। তখন শিশির ঘোষের দোকান হতে একজন লোক এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, “শিশিরদাকে দেখেছিলেন এদিকে কোথাও? তাঁর মামা এসেছেন।” আমি “দেখিনি” বলার পর লোকটি চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই ভূপেন দত্ত আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, “এই লোকটি কোন্ শিশির ঘোষের কথা জিজ্ঞাসা ক’রে গেল? মির্জাপুর স্ট্রীটে যার খদ্দরের দোকান আছে তার কথা কি?” আমি বললাম “হাঁ”। ভূপেন দত্ত বললেন, “শিশির ঘোষ ভালো লোক নয়। তার সঙ্গে পরিচয় করে আপনি ভুল করেছেন।” তারপর তিনি শিশির ঘোষের দীর্ঘ পরিচয় আমায় দিলেন। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও পরে আমার নিজের সংগ্রহ করা বিবরণ হলো এই যে শিশিরকুমার ঘোষ অনুশীলন সমিতির সভ্য ছিল। পুলিশের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হত্যায় লিপ্ত ছিল সন্দেহে ধরা পড়ে সে পুলিসের নিকটে দীর্ঘ স্বীকৃতি দেয়। তখন সমিতির অনেক তথ্য পুলিশ তার নিকট হতে পেয়ে যায়। তাছাড়া, সমিতির আণ্ডা-বাচ্চা যে যেখানে ধরা পড়তে বাকী ছিল তাদের সকলের নাম শিশির পুলিশকে বলে দেওয়ায় তারা ধরা পড়ে গেল। বিপ্লবী শিশিরকুমার ঘোষ হয়ে পড়ল গোয়েন্দা পুলিসের এজেন্ট।

বসন্তকুমার চট্টেপাধ্যায়কে হত্যার অপরাধে শিশির ঘোষের বিরুদ্ধে কোনো মোকদ্দমা হয়নি। (এই হত্যার অপরাধে মোকদ্দমা আসলে কারুর বিরুদ্ধে হয়নি।) কিন্তু শিশিরকুমার ঘোষকে বাঁচাবার দায়িত্ব পড়ল পুলিসের ঘাড়ে। কারণ, অনুশীলন সমিতির লোকেরা তাকে পেলে মেরে ফেলতে পারেন। এই কারণে আসামে সদিয়া সীমান্তে জঙ্গল বিভাগে শিশিরকে একটা চাকরী দেওয়ার ব্যবস্থা পুলিসই করেছিল। সেখানে সবার অলক্ষ্যে সে চাকরী করে যাচ্ছিল। পুরনো ঘটনার কথা লোকেরা ধীরে ধীরে ভুলে গিয়ে থাকেন। পাঞ্জাবের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, খিলাফৎ ও অসহযোগ আন্দোলন, এই তিনেতেই মিলে দেশে একটা প্রচণ্ড ঝড় তুলেছিল। এ ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে পুলিস শিশিরকে সদিয়া হতে ফিরিয়ে এনে কলকাতায় ছেড়ে দেয়। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবলাম এসবের কিছুই কি আবদুর রজ্জাক খান জানতেন না? আর, এসব কথা তাঁর জানাই যদি থাকবে তবে তিনি কি করে শিশিরকুমার ঘোষের সহিত আমার পরিচয় করিয়ে দিতে পারলেন?

সারারাত আমার ছটফট করে কাটল। পরের দিন আবদুর রজ্জাক খানের সহিত আমার দেখা হওয়া মাত্রই আমি ভূপেন্দ্ৰকুমার দত্তের কথাগুলি সবই একে একে তাঁকে জানালাম। অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এসব কথার কিছুই কি আপনি জানতেন না?” আমি আশা করেছিলেম, খান সাহেব বলবেন যে তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু তিনি তা করলেন না। বললেন, সব কথা না শুনলেও এর কিছু কিছু কথা তিনি শুনেছিলেন। ক্ষোভ ভরা মন নিয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, “এই রকমই যখন ব্যাপার ছিল তখন আপনিই বা কেন শিশিরের সঙ্গে এত বেশী মিশতে গেলেন, আর আমার সঙ্গেই বা কেন তাকে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন?” কোনো উত্তর দিলেন না তিনি। খান সাহেবের কোনো বড় ভুল ধরা পড়ার পরে এমনই চুপ করে থাকা তাঁর অভ্যাস। এর পরে শিশিরের সঙ্গে আমি সকল প্রকার সংস্রব ত্যাগ করলাম। খান সাহেবও আমায় জানিয়েছিলেন যে তিনিও শিশিরের সঙ্গে আর মেলামেশা করেন না।

শিশির সংক্রান্ত ব্যাপারে পেছনে একটা ইতিহাস আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে সারা ভারতে ব্যয়-সঙ্কোচের সুপারিশ করার জন্যে একটি কমিটি নিযুক্ত করা হয়েছিল। লর্ড ইঞ্চকেপ ছিলেন এই কমিটির সভাপতি। এই জন্যে কমিটিকে বলা হতো ইঞ্চকেপ কমিটি। বাঙলা দেশের প্রাদেশিক গবর্নমেন্টও শুধু বাঙলার জন্যেই এই রকমই একটি ব্যয়-সঙ্কোচ কমিটি নিযুক্ত করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই কমিটিকে মল্লিক কমিটি তাই বলা হতো।

মল্লিক কমিটি দেখতে পেলেন, কলকাতায় রাজনীতিক গোয়েন্দা পুলিসের দুটি বড় দর রয়েছে। তাদের নাম যথাক্রমে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিস (বেঙ্গল পুলিস) ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিস (কলকাতা পুলিস)। বেঙ্গল পুলিসের মাথা ছিলেন ইনস্পেক্টর জেনেরেল অফ পুলিস এবং কমিশনার অফ পুলিস ছিলেন কলকাতা পুলিসের মাথা। তাঁদের কেউ কারুর অধীন ছিলেন না, কিন্তু দু’জনাই ছিলেন বেঙ্গল গবর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারির অধীনে। এই অবস্থায় রাজনীতিক পুলিসের দুটি বড় বড় অফিস কলকাতায় রাখার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসটি সমস্ত বাঙলা দেশের জন্য কলকাতাতে রাখতেই হচ্ছে। কলকাতার রাজনীতিক গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারে কলকাতা পুলিস অনায়াসেই বেঙ্গল পুলিসের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সহযোগে কাজ চালাতে পারে। মল্লিক কমিটি সুপারিশ করলেন যে, ব্যয় সঙ্কোচের জন্যে কলকাতার স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসটি তুলে দেওয়া হোক। কমিটি আরও যুক্তি দিলেন যে, অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে রাজনীতিক গুপ্তহত্যা ও ডাকাতি ইত্যাদি যখন দেশে নেই তখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসটি অনায়াসে তুলে দেওয়া যায়। কিন্তু মল্লিক কমিটি সুপারিশ করলেও কলকাতা পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চ কিছুতেই নিজেদের বিলোপ করতে রাজী ছিলেন না। তাঁরা তাই উস্কানীদাতাদের নিযুক্ত করেছিলেন। যাঁরা শিশিরকুমার ঘোষকে জানতেন তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে উস্কানীদাতারূপেই শিশিরের পুনরাগমন ঘটেছে। এবং তা সত্যও ছিল।

অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে কলকাতা ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পুবপাশে ‘ফরবেস ম্যানশনস্’ নামক বিরাট বাড়ীটি ছিল কংগ্রেস অফিস। ‘গৌড়ীয় সর্ব- বিদ্যায়তন’ নামক ন্যাশনাল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল এই বাড়ীটিতে। ছাত্র ও ভলান্টিয়ারদের আনাগোনায় বাড়ীটি সরগরম হয়ে থাকত। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন তখন স্থগিত ছিল। কিন্তু তার কোনো কোনো নেতা ভাবলেন ঘর ছেয়ে নেওয়ার, অর্থাৎ দলে নূতন নূতন ছেলে রিক্রুট করা এটাই প্রকৃষ্ট সময়। তাদের মধ্যে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী ছিলেন অগ্রণী। তিনি তাঁর দলে ছেলেদের রিক্রুট করতে লাগলেন। সন্তোষকুমার মিত্র ইউনিভারসিটিতে ইকনমিক্‌স্- এম. এ. পড়তেন। তিনি পড়া ছেড়ে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলেন। ফরবেস ম্যানশনে বিপিন গাঙ্গুলী তাকেও দলে টানলেন। কয়েকদিন যেতে না যেতে সন্তোষকুমার মিত্র নিজেও একটি দল গড়তে লাগলেন। পরে কেউ কেউ এ দলটিকে সন্তোষ মিত্রের দল বলেছেন। আবদুর রজ্জাক খান এই বিপ্লবী দলে ছিলেন। শিশিরকুমার ঘোষকেও সন্তোষ মিত্র তাঁর দলে নিলেন। সন্ত্ৰাসবাদী নেতারা সন্তোষ মিত্রের এই কাজটি একেবারেই সমর্থন করলেন না। কিন্তু সন্তোষ মিত্র হুগলী গিয়ে অসুস্থ বিপ্লবী নেতা অধ্যাপক জ্যোতিশচন্দ্র ঘোষের বিশেষ আশীর্বাদ লাভ করে ফিরে এলেন।

হাঁ, যখন শিশির ঘোষের কথা আবদুর রেজ্জাক খানের নিকটে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলেম তখন তিনি একটি কথা আমায় বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কংগ্রেস অফিস হতে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তাঁরা যখন প্রচারে বার হচ্ছিলেন তখন শিশির ঘোষকে কোনো দলই সঙ্গে নিতে চাইছিলেন না, তা দেখে খান সাহেবরাই তাকে সঙ্গে নিলেন।

শিশিরকুমার ঘোষের মির্জাপুর স্ট্রীটের দোকানের ওপর কেউ বোমা মেরেছিলেন। তাতে শিশিরের দোকানের শরীফ মারা যান, কিন্তু শিশির বেঁচে গিয়েছিল। কোনো কোনো স্মৃতিকথাতে পড়েছি যে শিশির ঘোষের সমপর্যায়ের অন্য একজন উস্কানীদাতা রেষারেষির কারণে শিশির ঘোষকেই পৃথিবী হতে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। মির্জাপুরের বোমার ঘটনার পরে পুলিস শিশির ঘোষকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। তার পরে শিশির ঘোষের আর কোনো পাত্তা কেউ পাননি।

কলকাতা পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চওয়ালাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। ১৯২৩ সালের মে মাসে কলকাতায় কয়েকটি ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে উল্টাডাঙ্গা ও শাঁখারীটোলা পোস্ট অফিস আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। আক্রমণকারীরা উল্টাডাঙ্গা পোস্ট আফিস হতে সামান্য টাকা লুট করতে পেরেছিলেন। শাঁখারীটোলা পোস্ট আফিসে তাঁরা কিছুই লুট করতে পারেননি। তবে, পোস্ট মাস্টারকে তাঁরা গুলি করে মেরে ফেলেছিলেন। সেই সময়ে কোথাও একটি বধূর কানের মাকড়ি তাঁরা খুলে নিয়েছিলেন। এই ঘটনাকে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পলিটিক্যাল মুরগি চুরি’ বলে প্রচার করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *