রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

মাদার তেরেসা (১৯১০–১৯৯৭) – প্রেম, করুণা ও ধর্মের মূর্ত প্রতিমা

মাদার তেরেসা (১৯১০–১৯৯৭) – প্রেম, করুণা ও ধর্মের মূর্ত প্রতিমা

কী আশ্চর্য যোগাযোগ! যে বছর বিশ্বনন্দিত মানবসেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মৃত্যু,

ওই একই বছর জন্মগ্রহণ করেন ভবিষ্যতের আরেক বিশ্ব বিশ্রুত মানবসেবিকা মাদার তেরেসা।

১৯১০ সালে ২৬ আগস্ট দক্ষিণ যুগোস্লাভিয়ার স্কপিয়েত নামক শহরে তেরেসার জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন বহুভাষাবিদ নিকোলাস বোজাঝিও ও মায়ের নাম ড্রাফিল বার্নাই। মিশনারির এই সেবাব্রতের জীবন বেছে নেয়ার আগে তেরেসার নাম ছিল অ্যাগনেস গোনাস্কা বেজাকিসহিউ। তাঁরা ছিলেন এক ভাই, দুবোন।

সেসময় যুগোস্লাভিয়ার মিশনারিরা অনেকেই ধর্মপ্রচার ও সেবাধর্মের ব্রত নিয়ে ভারতে আসতেন। কেউ থাকতেন কলকাতায়, আবার কেউ-বা যেতেন দার্জিলিং-এর দিকে। এই মিশনের নাম ছিল বেঙ্গল মিশন ফিল্ড।

মাদার তেরেসার যখন ১৫ বছর বয়স, তখনই আর্থাৎ সেই ১৯২৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারিখে একজন জেসুইট বা মিশনারি নেতা বেঙ্গল মিশন ফিল্ড সম্পর্কে যুগোস্লাভিয়ায় একটি উৎসাহভরা পত্র প্রেরণ করেন ভারতের দার্জিলিং-এর কারসিয়াং থেকে।

এই পত্রটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়ে শোনানো হয়। বিশেষ করে স্কুলের যেসব ছাত্রছাত্রী ধর্মীয় ও সেবা সংগঠন সোভালিটির সদস্য, তাদেরকে বিশেষভাবে পত্রটি পড়ে ও ব্যাখ্যা করে বোঝানো হয়।

এর পরও মিশনারিদের যেসব পত্র স্কুলে আসত তার সবগুলো পড়ে শোনানো হতো সেভালিটির সদস্যদের। সেখানে লেখা থাকত কেমন করে খ্রিস্টান মিশনারিরা পৃথিবীর দারিদ্র্যপীড়িত বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুধার্ত ও অসুস্থ মানুষের সেবা করছেন। কীভাবে তারা হাসি ফোটাচ্ছেন দুখি মানুষের মুখে। আর্তমানবতার সেবায় মিশানারিরা কীভাবে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন, তারও বিবরণ থাকত এসব পত্রে।

অল্পবয়সী অ্যাগনেস ওরফে তেরেসা উৎসাহ ব্যঞ্জনাভরা পত্রগুলো নিয়মিত পড়ে পড়ে এতই অনুপ্রাণিত হন যে, তিনি বেঙ্গল মিশনের সদস্য হয়ে ভারতে আসার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর মনে হতে লাগল, তিনিও যদি এমন করে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে সঁপে দিতে পারতেন, তাহলে শান্তি পেত তাঁর আত্মা।

তারপর সত্যি সত্যি একদিন তাঁর স্বপ্ন সফল হলো।

১৯২৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় আসেন। তিনি প্রথমে শিক্ষকতা শুরু করেন এন্টালি সেন্ট মেরি স্কুলে। এই স্কুলে তিনি ছিলেন দীর্ঘ ১৮ বছর। পরে তিনি বদলি হয়ে আসেন লরেটো স্কুলে। এই স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়ই তাঁর জীবনে আসে এক বিরাট পরিবর্তন।

লরেটো স্কুলের পাশেই ছিল একটি বস্তি। মতিঝিল বস্তি নামে পরিচিত এই নোংরা এলাকায় ছিল কয়েক হাজার ক্ষুধার্ত ও ছিন্নমূল মানুষের বসবাস।

স্কুল ছুটির পর কিংবা টিফিনের সময় তিনি প্রায়ই এই বস্তিতে চলে আসতেন। তাঁর হাতে থাকত রুটি, কলা বা অন্যসব শস্তা খাবার৷ কখনও স্কুলের মেয়েদের টিফিনের বাড়তি খাবার। তিনি এসব খাবার এনে তুলে দিতেন বস্তির কঙ্কালসার ও উলঙ্গ ছেলেমেয়েদের হাতে। এই খাবার পেয়ে তারা কী যে খুশি হতো! তেরেসাকে দেখেই তারা এসে ঘিরে ধরত তাঁকে ‘মা-মা’ বলে।

উল্লেখ্য মতিঝিল বস্তির এই উলঙ্গ ও ক্ষুধার্ত শিশুগুলোই তেরেসাকে প্রথমে মা (মাদার) বলে ডাকতে শুরু করে। সেই থেকেই তিনি সকলের কাছে ‘মা’।

তিনি মতিঝিল বস্তির দুস্থ মানুষের সুখ-দুঃখ আর অভাব অভিযোগের কথা শুনতেন নিজের চোখে দেখতেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। তাদের নরকযন্ত্রণার ছবি গভীর মনোযোগ দিয়ে।

তারপর ক্লাসে ফিরে এসে মেয়েদের কাছে সেসব দুখি মানুষের কথা বলতেন। তাদের সাহায্য করার জন্য তিনি ছাত্রীদের কাছে আবেদন জানাতেন। ধনী ঘরের মেয়েরা তাদের টিফিন ও যাতায়াতের পয়সা থেকে বাঁচিয়ে তা তুলে দিতেন প্রিয় শিক্ষিকা অ্যাগনেসের হাতে। অ্যাগনেস সেই পয়সা দিয়ে আবার খাবার কিনে নিয়ে প্রবেশ করতেন মতিঝিল বস্তিতে।

এমনি করেই চলল অনেক দিন। ক্রমে এই দুস্থ মানুষজনকে সাহায্য করার কাজটি যেন তাঁর কাছে নেশার মতো হয়ে গেল। তাঁর মনে হতে লাগল এটাই বুঝি তাঁর জন্য শ্রেষ্ঠ কাজ, তা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। অন্য কাজ করতে মনও চায় না। আর্তমানবতার সেবা করার জন্যই যেন তাঁর জন্ম হয়েছে। এটাই তিনি করতে চান। তিনি নিজেকে তাদের সেবায় সম্পূর্ণ সঁপে দিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকেন।

এরপর সত্যি সত্যি তিনি সম্পূর্ণভাবে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার সংকল্পে নিজেকে নিয়োজিত করে সন্নাসিনীর ব্রত গ্রহণ করেন।

এরপর তাঁর জীবনে যে ঘটনা ঘটে, তা কোনোদিন তিনি ভুলে যাননি। ১৯৪৬ সালের ১০ ডিসেম্বর বড়দিনের আগে তিনি কোলকাতা থেকে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। তিনি ট্রেনের কামরায় বসে দুপাশের দ্রুত অপসৃয়মাণ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির দিকে তাকিয়ে ছিলেন আনমনে। তাঁর মন তখন ছিল ঈশ্বরে নিবেদিত। তিনি চলতে চলতেই একমনে যিশুর মহান মূর্তির ধ্যান করছিলেন। ঠিক তখনই যেন তিনি শুনতে পেলেন মহান যিশুর আহ্বান, যার কথা তিনি পরে বলেছেন এভাবে—”I heard the call to give up all and follow Him to the slums to serve Him amongst the poorest of the poor.”

অ্যাগনেস বুঝতে পারলেন অন্তর্যামীর নির্দেশ। মহান যিশুই যেন তাঁকে বলছেন, স্কুলের চাকরি ছেড়ে তুমি চলে এসো দীনদরিদ্র মানুষের পাশে। তাদের সেবাই ঈশ্বরের সেবা। আমিই তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে বলছি তোমাকে।

এরপর তা-ই হলো। এর ঠিক দুবছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে তিনি লরেটো স্কুলের চাকরি ছাড়ার অনুমোদন চেয়ে মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানালেন। তাঁর আবেদন মঞ্জুর হলো।

তিনি যখন লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসেন, তখন তাঁর হাতে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। এ-রকম নিঃস্ব অবস্থাতেই তিনি স্কুলের সাজানো ফুলের বাগান, স্নিগ্ধ পরিবেশ, সুখময় নিশ্চিন্ত জীবন ফেলে এসে আশ্রয় নিলেন শিয়ালদহ রেলস্টেশন লাগোয়া এক পুরনো ভাঙা বাড়িতে।

তিনি শুধু সুখময় জীবনই ফেলে এলেন না। নিজের পৈতৃক নামটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে এলেন। মিশনারি জীবন শুরু করার সময়ে মহামান্য পোপের অনুমতিক্রমে তিনি নতুন নাম গ্রহণ করলেন তেরেসা, পরে যা সকলের মুখে মুখে হয়েছে মাদার তেরেসা।

শিয়ালদহের এই ভাঙা বাড়িতেই তিনি কয়েকটি অনাথ শিশুকে নিয়ে শুরু করলেন তাঁর সেবাকার্য। থাকা-খাওয়াও এখানেই। এই নোংরা পরিবেশই এখন তাঁর সত্যিকার স্বর্গধাম।

পরে তিনি শিয়ালদহের পার্শ্ববর্তী বস্তিতে একটি স্কুল খুললেন। তাঁর স্কুলের সব ছেলেমেয়েই ছিল বস্তিবাসী। বস্তির অন্ধকারেই তিনি আলোর দীপ জ্বালাতে চান।

কিন্তু এখানে সত্যিকার স্কুল চালানোর মতো জায়গা না থাকায় তিনি সেটি স্থানান্তর করলেন মৌলালিতে। এটিও একটি পুরনো বাড়ি। বাড়ির মালিক মাইকেল গোমেস বাঙালি খ্রিস্টান।

তেরেসার ইচ্ছে ছিল মুমূর্ষুদের সেবা করার জন্য একটি সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু মাইকেলের বাড়িটি ছিল খুবই ছোট। এখানে স্কুলেরই জায়গা হয় না। এর পাশে সেবাশ্রম খুলবেন কোথায়? কিন্তু তিনি দমলেন না। আশ্রম খোলার জন্য জায়গার অনুসন্ধান করতে লাগলেন।

অবশেষে জায়গা পাওয়া গেল। কালীঘাটের মন্দিরের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে আছে একটি ধর্মশালা। এই পরিত্যক্ত ধর্মশালাতেই তেরেসা ১৯৫০ সালে স্থাপন করলেন তাঁর সেবাশ্রম। মুমূর্ষু নিরাশ্রয়দের আশ্রয়স্থলটির নাম দেয়া হল ‘নির্মল হৃদয়’।

পঙ্গু, পরিত্যক্ত, নিঃস্ব, অভুক্ত ও সহায়সম্বলহীন মৃত্যুপথযাত্রী শিশু, বালক, বালিকা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা নির্বিশেষে আশ্রয় পেল মায়ের আশ্রমে। তাঁরা পেতে লাগল সেবা আর সান্ত্বনা। মাদার তেরেসা ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করেন।

তেরেসা এর আগেই নার্সের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এবার সেই শিক্ষাই কাজে লাগালেন সেবাশ্রমে। এভাবেই শুরু হয় তাঁর ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-র কাজ, ১৯৫০ সালে।

উল্লেখ্য, দুবছর পর অর্থাৎ ১৯৫২ সালে কলকাতার পুরসভা এই পরিত্যক্ত ধর্মশালাটি মাদার তেরেসার মিশনকে দান করে দেয়।

মিশনের লক্ষ্য ছিল জাতিধর্ম নির্বিশেষে দীনদরিদ্র মানুষের সেবা করা, দরিদ্র মানুষদের ভালোবাসা। মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত যেসব অনাথ শিশু, দুরারোগ্য ব্যাধির জন্য পরিবার পরিজনদের স্নেহ থেকে বঞ্চিত, সহায়সম্বলহীন সেইসব আর্তমানুষ— তাদের সেবা করাই হলো মিশনের কাজ।

কালীঘাট থেকেই যাত্রা শুরু হলো তেরেসার। তারপর ক্রমেই কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেতে লাগল। কলকাতা শহরেই প্রতিষ্ঠিত হলো আরও বেশ কয়েকটি সেবাশ্রম।

জগদীশচন্দ্র বসু রোডে স্থাপিত হলো অনাথ শিশুদের জন্য সেবাশ্রম ‘নির্মলা শিশু ভবন’। আজও এর কার্যক্রম অব্যাহত। এখানে কেউ এলেই তাঁর মন আনন্দে ভরে উঠবে। চোখে পড়বে কচি কচি শিশুদের হাসিমুখ। কাউকে খাওয়ানো হচ্ছে, কারো গায়ে তেল মাখানো হচ্ছে, কেউ-বা স্নান করছে। কাজগুলো করছেন মিশনারির মহিলা-কর্মী অর্থাৎ সন্ন্যাসিনীরা।

চারদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে তকতকে। কলকাতার যে-কোনো আধুনিক নার্সিং হোমকে হার মানিয়ে দিতে পারে।

উল্লেখ্য কলকাতার এই জগদীশচন্দ্র বসু রোডেই অবস্থিত তেরেসার মিশনারি অব চ্যারিটির প্রধান কাৰ্যালয়।

মাদার তেরেসা শহরের পথে চলতে চলতে কুষ্ঠরোগীদের দেখেন। রাস্তায় কুষ্ঠরোগাক্রান্তদের ভিক্ষার পাত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে তিনি ব্যাকুল হন। তাদের জন্য কিছু একটা করার জন্য তাঁর মন আকুলিবিকুলি করে ওঠে। তিনি বস্তিতে কুষ্ঠরোগীদের কাছে যান, তাদের ক্ষতবিক্ষত শরীরে পরম স্নেহে হাত বোলান। মনে মনে ভাবেন, এদের জন্যও কিছু একটা করতে হবে। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর প্রতিষ্ঠিত হয় সোদপুরে গান্ধি কুষ্ঠ আশ্রম ‘প্রেম নিবাস’। অর্থের অভাবে প্রথমে খুব বড় ধরনের কিছু করা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৪ সালে পোপ ষষ্ঠ পল ভারত সফরের সময় মাদার তেরেসার কুষ্ঠ আশ্রম পরিদর্শন করেন। এ-সময় তিনি তাঁর নিজের দামি লিংকন গাড়িটি উপহার হিসেবে দিয়ে গিয়েছিলেন মাদার তেরেসাকে।

গাড়িটি দিয়েছিলেন মাদার তেরেসার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যই। কিন্তু গাড়িটি তিনি নিজে ব্যবহার না করে সেটিকে উপলক্ষ করে একটি লটারির ব্যবস্থা করলেন। এতে দারুণ সাড়া পাওয়া গেল। কয়েক লক্ষ টাকা সংগৃহীত হলো। এই সব টাকাই তিনি দান করলেন কুষ্ঠ আশ্রম-প্রেম নিবাসের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য।

এ ছাড়া তিনি ‘পোপ জন শান্তি পুরস্কার’ স্বরূপ পেয়েছিলে কয়েক লক্ষ টাকা। এই টাকা দিয়েও তিনি আসানসোলের কাছে গড়ে তোলেন কুষ্ঠরোগীদের জন্য একটি শহর—শান্তিনগর।

শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, মাদার তেরেসার সেবাকার্য ক্রমে ছড়িয়ে পড়তে লাগল আরও বৃহত্তর পরিসরে। ক্রমে তা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। আজ বিশ্বের সবকটি মহাদেশেই স্থাপিত হয়েছে মিশনারিজ অব চ্যারিটির শাখা। এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সর্বত্র মাদার তেরেসার কল্যাণহস্ত সম্প্রসারিত।

পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের আর্তমানুষের কান্না তেরেসার অন্তরকে ব্যাকুল করে, তিনি ছুটে যান তাদের কাছে। সাধ্যমতো সাহায্য করেন।

তেরেসার এই বিশাল ও মহৎ কর্মযজ্ঞে কোনো বাধাই কিন্তু তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। লরেটো স্কুল ছেড়ে আসার সময় তাঁর সম্বল ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। অথচ আজ মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রতিদিনই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সেবাকার্যের জন্য খরচ করে প্রায় ১২,০০,০০০ টাকা। অন্নছত্রগুলোতে (লঙ্গরখানা) প্রতিদিন গড়ে আহার করে প্রায় ৬০,০০০ নিরন্ন মানুষ। ৮১টি (১৯৯৬ সাল পর্যন্ত) আশ্রয় কেন্দ্রে এ পর্যন্ত আশ্রয় পেয়েছে প্রায় ১৪,০০০ ছিন্নমূল মানুষ। ৪,০০০ শিশুর জন্য রয়েছে ৭০টি অনাথ আশ্ৰম।

মিশনারিজ অব চ্যারিটির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে ১৫০টি বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে হাজার হাজার শিশু-কিশোর। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় ৭০০টি ভ্রাম্যামাণ চিকিৎসা কেন্দ্ৰ।

মাদার তেরেসার সেবাকর্মের অধিকাংশ অর্থ আসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও কল্যাণ সংস্থা কিংবা ধনাঢ্য ও হৃদয়বান ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে। অর্থ, ঔষধ, পরিধেয় ও খাদ্য দিয়ে তাঁরা সাহায্য করছেন এই কল্যাণময়ী মাকে।

মাদার তেরেসার বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত এই সেবকার্যের প্রধান সহকারিণী হলেন এক বাঙালি রমণী—নাম সুভাষিণী। তবে তাঁর বর্তমান নাম অ্যাগনেস। মাদার তেরেসার পরিত্যক্ত পৈতৃক নামে নিজের নামকরণ করেছেন সুভাষিণী।

এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য প্রধান প্রধান সহকারিণীর মধ্যে আছেন সিস্টার ক্লেয়ার (প্রকৃত নাম কিরণ দত্ত), সিস্টার বার্নার্ড, সিস্টার ডোরোথিসহ আরও অনেক। এঁরা সকলেই মাদার তেরেসার বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত সেবাকর্মযজ্ঞে আত্মোৎসর্গ করেছেন।

দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মাদার তেরেসা। তিনি ১৯৭৯ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়াও ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ভারতরত্ন ও দেশিকোত্তমসহ অনেকগুলো পুরস্কার।

আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় মিলে এ পর্যন্ত তিনি ৪৫টি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু কোনো পুরস্কারই এই মহীয়সী মহিলাকে আনন্দিত বা গর্বিত করে না। তিনি আপন মনে করে গেছেন তাঁর সেবাকর্ম। তিনি মনে করেন ঈশ্বরের ধ্যান আর আর্তসেবার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

এই মহীয়সী নারী বৃদ্ধ বয়সেও সেবাব্রতের কাজ নিয়ে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তিনি শিশু আর মুমূর্ষু মানুষকে মাতৃস্নেহে জড়িয়ে ধরতেন বুকে। মাতৃত্বের এ দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর নেই বললেই চলে।

মাদার তেরেসা বাংলাদেশেও তাঁর সেবাকাজে দুবার এসেছিলেন।

তিনি কলকাতায় ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *