মাদাম ইমবার্ট’স সেফ

মাদাম ইমবার্ট’স সেফ

অনুবাদ: ডিউক জন

ভোর তখন তিনটে। বুলেভার্দ বার্থিয়াইয়ের পাশে গড়ে ওঠা বাড়িগুলোর একটির সামনে আধ ডজন ক্যারিজ দাঁড়িয়ে আছে তখনও।

দরজা খোলা বাড়িটির। পুরুষ আর নারী অতিথিরা বেরিয়ে আসছে দরজা দিয়ে। ক্যারিজে উঠে সবাই যে যার গন্তব্যে রওনা হয়ে গেল। কেবল দু’জন ছাড়া। ক্রোসেল অভিমুখে হাঁটা ধরেছে এই দু’জন।

ক্রোসেলে পৌছে আলাদা হয়ে গেল দুই ব্যক্তি। ওই রাস্তাতেই দু’জনের একজনের বাড়ি। অন্যজন ঠিক করল, পোর্ট-ম্যালোর উদ্দেশে যদ্দূর সম্ভব, পা চালিয়ে এগোবে।

শীতের চমৎকার রাত। পরিচ্ছন্ন, শীতল আবহাওয়া। এমন রাতে হাঁটতে বেরোলে চনমনে হয়ে ওঠে মন।

কিন্তু মিনিট কয়েক পরই অস্বস্তি জাগল লোকটির মধ্যে। কেউ যেন অনুসরণ করছে ওকে! ঘুরে তাকাতেই গাছগাছালির আড়ালে লুকিয়ে পড়তে দেখল একজনকে।

ভিতু নয় পথচারী। তারপরও মনে হলো, চলার গতি বাড়ানো উচিত তার।

গতি বাড়াল অনুসরণকারীও।

রিভলভার বের করে মুখোমুখি হবে কি না পশ্চাদ্ধাবনকারীর, ভাবল লোকটি।

কিন্তু সময়ই পেল না অস্ত্রটা হাতে নেওয়ার। তার আগেই ছুটে এসে নিষ্ঠুরভাবে হামলা চালাল পেছনের জন।

মরিয়ার মতো একে অপরের সঙ্গে যুঝতে লাগল দু’জনে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তি টের পেল, শক্তি-সামর্থ্যে ওর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে আক্রমণকারী।

আক্রান্ত ব্যক্তি চিৎকার করল সাহায্যের আশায়। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো তাকে নুড়ির স্তূপে। কণ্ঠনালী আঁকড়ে ধরে রুমাল পুরে দেওয়া হলো মুখের মধ্যে।

চোখ বুজে এলো হতভাগার।

অকস্মাৎ উলটে গেল দাবার ছক। শিকারের ওপর চড়াও হওয়া লোকটা নিজেই এবার শিকার হলো অপ্রত্যাশিত আক্রমণের!

প্রতিরোধের চেষ্টা করল সে। বদলে ছড়ির বাড়ি আর বুটের লাথি খেয়ে চিৎকার ছাড়ল ব্যথায়। নিস্তেজ শরীরে শাপশাপান্ত করতে করতে পিঠটান দিলো কোনো মতে।

বদমাশটাকে ধাওয়া না করে পড়ে থাকা লোকটির ওপর ঝুঁকে পড়ল আগন্তুক। ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল, “আপনি ঠিক আছেন, মঁসিয়ে?”

না, আহত হয়নি লোকটি। তবে মাথা-টাথা ঘুরে ওঠায় পারছে না উঠে দাঁড়াতে।

উদ্ধারকারী ক্যারিজ ডাকল একটা, আক্রান্ত ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে অ্যাভিনিউ দে লা গ্রান্ড আরমি-তে লোকটির বাসা পর্যন্ত সঙ্গী হলো তার।

বাড়ি পৌছুতে পৌঁছুতেই পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে উঠল আক্রান্ত। বার বার ধন্যবাদ জানাতে লাগল ওর ত্রাণকর্তাকে।

“ঋণী হয়ে রইলাম আপনার কাছে, মঁসিয়ে। আপনার এই উপকার কখনোই ভুলব না। এত রাতে আর জানাতে চাইছি না আমার অর্ধাঙ্গিনীকে। তবে কাল কিন্তু নিজেই ও আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইবে। আসুন না একবার, সকালে নাশ্তা করবেন আমাদের সঙ্গে! অধমের নাম লুদোভিক ইমবার্ট। আপনি?”

জবাবে ‘আর্সেন লুপাঁ’ লেখা একটা কার্ড বাড়িয়ে দিলো লোকটি মঁসিয়ে ইমবার্টের দিকে।

.

সেসময় কাহর্ন-কাণ্ড, সাঁৎ কারাগার থেকে পলায়ন এবং পরবর্তী দুর্ধর্ষ সব কাণ্ডকীর্তির সুবাদে গায়ে লেগে যাওয়া কালিমাটুকু মোটেই উপভোগ করছিল না লুপাঁ। আর্সেন লুপাঁ নামটাও ব্যবহার করত না ওই সময়। ছদ্মনামটা আদতে-যেমনটা শোনা যায় আরকি-ইমবার্ট-অপারেশনের নামে বানানো হয়েছিল।

তখন থেকেই না-কি সবকিছু আবার নতুনভাবে শুরু করেছিল লুপাঁ। আস্তিনে অস্ত্রের অভাব ছিল না ওর, অ্যাকশনে নামার জন্যও পুরোপুরি প্রস্তুত; স্রেফ সঙ্গতি আর সঠিক যোগাযোগের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দিচ্ছিল না নাগালে। তখনকার সামান্য নবিশ আর্সেন লুপাঁ যদিও পরে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের লাইনের মাস্টার হয়ে ওঠে।

সেই রাতে পাওয়া নিমন্ত্রণের কথা মনে হলে আজও রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে ও। শেষ পর্যন্ত তা হলে পৌঁছুতে পেরেছে চূড়ান্ত লক্ষ্যে! মনের মতো কাজ পেয়েছে অবশেষে। কাজটা ওর শক্তি ও দক্ষতার সঙ্গে একদম খাপে খাপ। ইমবার্টদের সম্পত্তি! এর চেয়ে দারুণ ভোজ আর কী হতে পারে?

মিশনটার জন্য নিজেকে বিশেষভাবে তৈরি করেছিল লুপাঁ। বহু-ব্যবহৃত ফ্রক কোট, ব্যাগি ট্রাউজার, সুতো বেরিয়ে পড়া সিল্কের হ্যাটের সঙ্গে সুন্দর করে পরা কাফ আর কলার-সবই ঠিক আছে; তারপরও দারিদ্র্যের চিহ্ন নজর এড়াবে না কারও। গলবন্ধ হিসেবে পরেছিল নকল হীরা বসানো কালো রিবন।

এমনিভাবে সেজেগুজে পরদিন মনমাত্রায় নিজের অস্থায়ী বাসভবনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিল লুপাঁ, চতুর্থ তলায় এসে একটুও না থেমে ছড়ির মাথা দিয়ে টোকা দিলো বন্ধ এক দরজার গায়ে। এরপর পা চালাল বাইরের বুলেভার্দ অভিমুখে। চলন্ত একটা ট্রাম দেখতে পেয়ে উঠে পড়ল ওটায়।

তক্ষুনি ওর পিছু নেওয়া লোকটি এসে বসে পড়ল লুপাঁর পাশে। চতুর্থ তলার ভাড়াটে সে। এক মুহূর্ত পর লুপাঁর উদ্দেশে বলে উঠল: “তারপর, গভর্নর?”

“হ্যাঁ, সবকিছুই ঠিকঠাক।”

“কীরকম?”

“ব্রেকফাস্টের দাওয়াত পেয়েছি ওখানে।”

“ব্রেকফাস্ট! ইমবার্টদের ওখানে!”

“নিশ্চয়ই। কেন নয়? তোমার হামলায় নিশ্চিত মরণের হাত থেকে বাঁচিয়েছি আমি মঁসিয়ে লুদোভিক ইমবার্টকে। অকৃতজ্ঞ নন তিনি। প্রাতরাশের দাওয়াত দিয়েছেন আমাকে।”

সংক্ষিপ্ত নীরবতার পর মুখ খুলল অপরজন: “কীভাবে কী করবে, ছক কেটেছ নিশ্চয়ই?”

“বাছা,” বলে উঠল লুপাঁ। “ছোটোখাটো ওই হামলাটার আয়োজক আমি নিজে। ভোর তিনটার সময় আমার একমাত্র বন্ধুকে আহত করার ঝুঁকি নিয়ে লাঠির বাড়ি আর বুটের লাথি হাঁকিয়েছি তার ওপরে। সফল ওই আয়োজন থেকে পাওয়া সুযোগটুকু পায়ে ঠেলব আমি? কী যে বলো না তুমি!”

“কিন্তু ওদের হালহকিকত নিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ানো গুঞ্জনগুলোও নিশ্চয়ই কান এড়ায়নি তোমার?”

“বাদ দাও তো ওসব! ছয় মাস ধরে ওদের পেছনে লেগে আছি আমি। ভালো মতন তদন্ত আর পর্যবেক্ষণ করেছি এই সময়টায়। জিজ্ঞাসাবাদ করেছি চাকরবাকর, পাওনাদার আর অন্যান্য লোকেদের। পুরো ছয়টি মাস ছায়ার মতো অনুসরণ করেছি আমি স্বামী-স্ত্রীকে। অতএব, আমি জানি, কী করছি। বুড়ো ব্রফোর্ড বা অন্য কারও কাছ থেকে সৌভাগ্য এসে উদয় হয়েছে কি না ওদের কাছে—যেমনটা বোঝাতে চাইছে ওরা—ওতে কিছুই যায়-আসে না আমার। আমি শুধু জানি, সম্পত্তিটার অস্তিত্ব রয়েছে, এবং এক সময় সেটা আমারই হবে।”

“বাপ রে, বাপ, এক শত মিলিয়ন!”

“দশ হোক, পাঁচ হোক-মন্দ নয়। বন্ডে ভর্তি ওদের সিন্দুকটা। আমি যদি না নিই ওগুলো, অন্য কারও কাছে খোয়াতে হবে।”

প্লেস দে লিতোয়াইলে এসে থেমে দাঁড়াল ট্রাম।

চারতলার ভাড়াটে ফিসফিস করল লুপাঁর কানে: “আমাকে কী করতে বলো এখন?”

“এ মুহূর্তে কিছুই নয়। পরে জানাব তোমাকে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই এখানে।”

.

পাঁচ মিনিট পর লুপাঁকে ইমবার্ট ম্যানশনের দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ির ধাপ বাইতে দেখা গেল।

স্ত্রীর সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিলো মঁসিয়ে ইমবার্ট। বাচাল স্বভাবের ছোটোখাটো, পৃথুল শরীরের মাদাম জেরভেজ ইমবার্ট আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাল লুপাঁকে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয়, নিজ হাতেই আপ্যায়ন করা উচিত আমাদের এই বিপদের-বন্ধুটিকে।”

পুরোনো, উপকারী বন্ধুর মতোই আপ্যায়ন করল ওরা লুপাঁকে। ডেজার্ট পরিবেশন করতে করতে মজবুত হয়ে উঠল এই বন্ধুত্ব, বিনিময় হলো পরস্পরের গোপন অনেক কাহিনি। নিজের জীবনের গল্প বলল লুপাঁ; জানাল, ম্যাজিস্ট্রেট পিতার পরিবারের সদস্য হিসেবে কেমন ছিল ওদের জীবনযাপনের ধরন; শোনাল বিপর্যস্ত শৈশবের ইতিহাস এবং বর্তমান হালচাল। অন্য দিকে, জেরভেজ দিলো ওর যৌবন, বিয়ে-শাদি, বুড়ো ব্রফোর্ডের মহানুভবতা, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এক শ’ মিলিয়ন এবং সেই সম্পত্তি অর্জনের পথে যে সমস্ত বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়েছে, সে-সবের ফিরিস্তি। চড়া সুদে যে কর্জ করতে বাধ্য হয়েছিল, সেটা তো বললই, ব্রফোর্ডের ভাতিজাদের সঙ্গে লাগাতার হয়ে চলা বিবাদ, মামলা, আদালতের স্থগিতাদেশ-কিছুই জানাতে বাকি রাখল না।

“স্রেফ ভাবুন তো একবার, মঁসিয়ে লুপাঁ,” বলল মহিলা। “বন্ডগুলো সবই রয়েছে আমার পতিদেবতার অফিসে, অথচ একটা কুপনও সরানোর জো নেই আমাদের। সরালে সবই হারাতে হবে। সিন্দুকেই রয়েছে ওগুলো, কিন্তু উপায় নেই ছুঁয়ে দেখার।

এতসব ধনসম্পত্তি নিজের করে পাওয়ার সম্ভাবনায় ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল লুপাঁ। পুরোপুরি নিশ্চিত ও, টাকাগুলো নিয়ে যে-ধরনের হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে মেজবানদের, ওরকম বিপত্তিতে পড়তে হবে না ওকে।

‘আহ, শুধু হাতে পাওয়ার অপেক্ষা!’ মনে মনে উচ্চারণ করল লুপাঁ। ‘স্রেফ হাতে পাওয়ার অপেক্ষা!’

.

অচিরেই ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিল এই বন্ধুত্ব। ওদের প্রশ্নের জবাবে নিজের দুঃখ- দারিদ্র্যের কথা লুকাল না লুপাঁ। সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভাগা যুবককে নিয়োগ দেওয়া হলো ইমবার্ট দম্পতির ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। বেতন মাসে এক শ’ ফ্রাঁ।

এই চাকরির সুবাদে প্রতিদিনই ইমবার্ট হাউসে উপস্থিত হতে হবে লুপাঁকে। দোতলায় একটা কামরা দেওয়া হলো তাকে অফিস হিসেবে। এর ঠিক নিচেই মঁসিয়ে ইমবার্টের অফিস-কক্ষ।

শিগগিরই উপলব্ধি করল লুপাঁ, সহকারীর পদটা কতখানি স্বস্তিদায়ক ওর জন্য। প্রথম দুই মাসে মাত্র চারখানা গুরুত্বপূর্ণ চিঠির নকল করতে হলো ওকে, একবার মাত্র ডাক পড়ল মঁসিয়ে ইমবার্টের অফিসে। সে-কারণে একবারই সুযোগ পেল ও সিন্দুকটা চর্মচক্ষে দেখার। তার ওপর খেয়াল করেছে লুপাঁ, নিয়োগকর্তাদের আয়োজিত সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিমন্ত্রিত নয় ও। তবে এতে অসন্তুষ্ট হওয়ার বদলে খুশিই হলো ছদ্মপরিচয় ধারণকারী যুবক। কেননা, সেটা ওর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে সুবিধাজনক।

যাহোক… সময় কিন্তু মোটেই নষ্ট করছিল না লুপাঁ। শুরু থেকেই ইমবার্টের অফিসে চুপিসারে হানা দিয়ে পরীক্ষা করছিল সিন্দুকটা। ওটা ছিল, যাকে বলে, অভেদ্য একটা জিনিস। বিস্তর লোহা আর ইস্পাতে মোড়ানো ঠান্ডা আর অটল চেহারার আসবাবটি। সাধারণ যন্ত্রপাতির সাহায্যে খোলার উপায় নেই। অবশ্য তাতেও দমল না আর্সেন লুপাঁ।

‘শক্তি যেখানে ব্যর্থ, মগজের সেখানে জয়-জয়কার,’ বলে প্রবোধ দিত ও নিজেকে। ‘আসল কথা হলো, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় হাজির থাকা। তদ্দিন পর্যন্ত চুপচাপ অপেক্ষা করাই শ্রেয়।‘

তাৎক্ষণিক কিছু প্রাথমিক প্রস্তুতি নিল লুপাঁ। অত্যন্ত সাবধানে নিজ কামরার মেঝেতে সিসার একটা পাইপ বসাল ও, কার্নিশের দুই লেয়ারের মাঝ দিয়ে প্রবেশ করেছে যেটা ইমবার্টের অফিস-কক্ষে। এই পাইপের সাহায্যে নিচতলায় কী-হচ্ছে-না-হচ্ছে, দর্শন ও শ্রবণের ইচ্ছা আরকি।

অতঃপর মেঝের ওপর লম্বা হয়ে কাটতে লাগল ওর দিনগুলো। প্রায়ই সিন্দুকের সামনে আলোচনায় বসতে দেখল ও ইমবার্ট দম্পতিকে—উলটেপালটে দেখছে নানান ধরনের বই আর কাগজপত্র। যখনই কম্বিনেশন লক ঘোরাল ওরা, সংখ্যাগুলো পড়ার চেষ্টা করল লুপাঁ। বোঝার চেষ্টা করল, কয় বার ডানে- বামে ঘোরানো হচ্ছে তালাটা। ওদেরকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করে চলল তস্কর, ধরার চেষ্টা করল আলাপগুলো। চাবিরও প্রয়োজন রয়েছে সিন্দুকটা খোলার জন্য। কিন্তু কোথায় যে রাখা হয়েছে ওটা, বুঝতে পারল না ও। লুকিয়ে রেখেছে না কি?

একদিন দেখা গেল, সিন্দুক বন্ধ না করেই কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে ইমবার্ট দম্পতি। তৎক্ষণাৎ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো লুপাঁ, দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে ঢুকে পড়ল কামরাটায়।

কপাল মন্দ ওর। তক্ষুনি আবার ফিরে এলো ওরা!

“আহ, মাফ করবেন!” তড়িঘড়ি করে বলে উঠল লুপাঁ। “দরজা ভুল করে ফেলেছি আমি।”

“আরে, আসুন, আসুন, মঁসিয়ে লুপাঁ!” জবাবে বলল মাদাম ইমবার্ট। “এ তো আপনার নিজেরই বাড়ি! আপনার পরামর্শ প্রয়োজন আমাদের। কোন বন্ডগুলো বিক্রি করা উচিত, সেই ব্যাপারে। ফরেন সিকিউরিটিরগুলো, না কি সরকারি সুদের?”

“কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে, বললেন না?” বিস্মিত প্রশ্ন লুপাঁর।

 “ওহ, ওটা?” হাসল মহিলা। “সব বন্ডের ওপরে আসলে স্থগিতাদেশ দেয়নি আদালত।

সিন্দুক খুলে বন্ডের একটা প্যাকেজ বের করল মঁসিয়ে ইমবার্টের স্ত্রী।

“না, না, জেরভেজ,” আপত্তি জানাল স্বামীপ্রবর। “বিদেশি বন্ডগুলো বিক্রি করে দেওয়াটা বোকামি হবে। সুদ যখন বেড়ে সর্বোচ্চতে উঠবে, দামও বাড়বে ওগুলোর। আপনি কী বলেন, বন্ধু?”

‘বন্ধু’-র কোনো মত নেই এই ব্যাপারে। তারপরও সরকারিগুলো বিক্রির পরামর্শ দিলো ও।

মাদাম ইমবার্ট তখন আরেকটা প্যাকেট বের করে, দৈবচয়ন পদ্ধতিতে একখানা কাগজ টেনে নিল সেখান থেকে। তিন শতাংশ সুদে দু’হাজার ফ্রাঁর বন্ড ওটা।

প্যাকেটটা নিজের পকেটে রেখে দিলো লুদোভিক।

সেদিন বিকেলেই, সেক্রেটারিকে সঙ্গে নিয়ে জনৈক স্টক-ব্রোকারের কাছে ছেচল্লিশ হাজার ফ্রাঁ-তে ওগুলো বিক্রি করে দিলো ভদ্রলোক।

.

মাদাম ইমবার্ট যতই বলুক না কেন, নিজ বাড়ির অনুভূতি হচ্ছে না এখানে লুপাঁর। এদিকে, সেক্রেটারির পদটাও আজব কিসিমের। এক সময় জানতে পারল, ওর নামটা পর্যন্ত জানা নেই চাকরবাকরদের। স্রেফ ‘মঁসিয়ে’ বলে ডাকে ওরা তাকে। লুদোভিকও তা-ই। “মঁসিয়েকে বলো… মঁসিয়ে কি এসেছেন…” ইত্যাদি ইত্যাদি।

কী এর রহস্য?

তার ওপর প্রথম পরিচয়ের স্ফূর্তি নেই আর ওদের মাঝে। ক্বচিৎ ওর সঙ্গে কথা বলে এখন ইমবার্ট দম্পতি। হিতকারী হিসেবে ওদের কাছ থেকে সে- রকম ব্যবহার পেলেও খুব একটা মনোযোগ ছিল না ওদের লুপাঁর প্রতি। মানব সঙ্গ পছন্দ করে না, এমনই এক চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে যেন ওকে। একাকী থাকাটাই যেন কাঠিন্যে মোড়া আজব লোকটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

একদিনের কথা। ভেস্টিবিউলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় মাদাম ইমবার্টের কণ্ঠস্বর কানে এলো লুপাঁর। দু’জন লোকের সঙ্গে কথা বলছিল মহিলা।

“এমনই অসভ্য লোকটা, বুঝলেন!”

‘অসভ্য, না?’ মনে মনে খেদ ঝাড়ল লুপাঁ। বুঝতে পেরেছে, ওর কথাই বলা হচ্ছে।

চাকরিদাতাদের এহেন অদ্ভুত আচরণের অর্থ খোঁজা বাদ দিয়ে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলল ও। সিদ্ধান্ত নিল, সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় হাত-পা গুটিয়ে রেখে সময় নষ্ট করবে না আর, রইবে না মাদাম ইমবার্টের অমনোযোগের অপেক্ষায় যার কাছেই রয়েছে সম্ভবত সিন্দুকের চাবি। কম্বিনেশন এলোমেলো করে দেওয়ার কাজটা মহিলাই করে। এখন উপলব্ধি করতে পারছে লুপাঁ, নিজের মগজ খাটিয়েই আগে বাড়তে হবে ওকে।

ওদিকে, তীব্র প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে ইমবার্টদের বিরুদ্ধে। বেশ কিছু খবরের কাগজে প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো পরিবারটিকে।

ওই সময় ইমবার্টদের এক পারিবারিক সম্মিলনে উপস্থিত ছিল লুপাঁ। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আসর গরম করে তুলছিল অভ্যাগতরা। লুপাঁর মনে হচ্ছিল, আরও বেশি কালক্ষেপণ করলে সবই হারাতে হবে ওকে।

পরের পাঁচ দিন, ছয়টার সময় বাড়ি ফেরার বদলে—যেমনটা করে থাকে সচরাচর-অফিস-ঘরে আবদ্ধ রাখল ও নিজেকে। সবাইকে অবশ্য বোঝাল, বেরিয়ে গেছে ও। আদতে, মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে নজর রাখছিল ইমবার্টের অফিস-কামরায়।

কিন্তু ওই পাঁচ সন্ধ্যায় আরাধ্য সুযোগ ধরা দিলো না লুপাঁর হাতে। মাঝরাতের দিকে এক পার্শ্বদরজা দিয়ে বাড়ি ছাড়ল ও, দরজাটার চাবি ছিল ওর কাছে।

ষষ্ঠ দিনে বুঝতে পারল লুপাঁ, শত্রুপক্ষের পরোক্ষ বক্রোক্তিতে ত্যক্ত দম্পতি সিন্দুকে কী কী রয়েছে, উপস্থাপন করতে চলেছে সেগুলোর তালিকা।

‘আজই বোধ হয় কাজে হাত দেবে ওরা,’ ভাবল ও।

হলোও তা-ই। ডিনারের পরই অফিসে বসে সিন্দুকে রাখা হিসাবের খাতা আর সিকিউরিটিগুলো পরীক্ষা করা শুরু করল ইমবার্ট দম্পতি।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল এভাবে। ওপরতলায় ভৃত্যদের ঘরে যাওয়ার আওয়াজ কানে এলো লুপাঁর। কেউই নেই আর নিচতলায়। মাঝরাত্রিতেও নিজেদের কাজে ব্যস্ত স্বামী-স্ত্রী!

“এখনই কাজে নামতে হবে আমাকে,” বিড়বিড় করল লুপাঁ।

নিজের ঘরের জানালা খুলল ও। এক প্রাঙ্গণ বরাবর উন্মুক্ত হলো ওটা অন্ধকার আর নীরবতায় ডুবে আছে বাইরের সবকিছু।

টেবিল থেকে গিঁট দেওয়া একখানা রশি তুলে নিল লুপাঁ। জানালার সামনের ব্যালকনিতে রশিটা বেঁধে ছেড়ে দিলো নিচের দিকে। ইমবার্টদের অফিসের জানালা অবধি নেমে গেল রশি।

একটা মুহূর্ত চুপচাপ ব্যালকনিতে বসে রইল উৎকর্ণ লুপাঁ। চেয়ে রয়েছে নিচের দিকে। ভারী পর্দার কারণে ইমবার্টদের অফিসের ভেতরটা পুরোপুরি চোখের আড়ালে।

রশি বেয়ে নিচে নেমে এসে সন্তর্পণে জোড়া জানালায় ঠেলা দিলো ও। বিকেলবেলা কারিগরি ফলিয়ে রেখেছে বল্টুর ওপরে; এমনভাবে এক টুকরো তার আটকে দিয়েছে ওটার সঙ্গে যে বন্ধ হবে না জানালাটা। বুঝতেও পারবে না কেউ খেয়াল না করলে।

অনায়াসেই খুলে গেল জানালা। সীমাহীন সতর্কতায় মাথা ঢোকানোর মতো পাল্লা ফাঁক করল লুপাঁ। পর্দাটা কয়েক ইঞ্চি সরিয়ে সিন্দুকের সামনে বসে থাকতে দেখল ইমবার্ট ও তাঁর অর্ধাঙ্গিনীকে। কাজে এতটাই মগ্ন ওরা, কথাই বলছে না বলতে গেলে; বললেও, মৃদু স্বরে।

ওদের সঙ্গে নিজের দূরত্বটা যাচাই করে নিল লুপাঁ; কীভাবে কী করলে সাহায্য চাইতে পারার আগেই এক এক করে কবজা করতে পারবে স্বামী-স্ত্রীকে, খতিয়ে দেখল মনে মনে।

কিন্তু যেই না তৎপর হতে যাবে, এমন সময় মাদাম ইমবার্ট বলে উঠল: “আহ! ঠান্ডা হয়ে উঠেছে ঘরটা! শুতে যাচ্ছি আমি। তুমি আসবে না, প্রিয়?”

“না, থাকছি আমি। শেষ করতে হবে কাজটা।”

“শেষ করবে! সারা রাতই তো লেগে যাবে তা হলে!”

“না, তা লাগবে না। বেশি হলে, এক ঘণ্টা।”

চলে গেল মহিলা।

বিশ মিনিট গেল। তিরিশ মিনিট।

পাল্লাটা আরেকটু ঠেলল লুপাঁ। আরেকটু। কেঁপে উঠল পর্দা।

ফিরে তাকাল ইমবার্ট। ভাবল, বাতাসে নড়ছে বুঝি পর্দা। জানালাটা বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াল ভদ্রলোক।

কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি হলো না, হলো না ধস্তাধস্তিও। মূল্যবান মুহূর্তগুলোর মধ্যেই, সামান্যতম আহত না করে, লোকটিকে অজ্ঞান করে ফেলল লুপাঁ। মাথায় পর্দা পেঁচিয়ে, বেঁধে ফেলল হাত-পা। এমনই কায়দায়, হামলাকারীর চেহারা দেখার সুযোগই হলো না লুদোভিক ইমবার্টের।

দেরি না করে সিন্দুকের কাছে চলে গেল লুপাঁ। দু’খানা প্যাকেট বগলদাবা করে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। সার্ভেন্টস’ গেটটা খুলতেই রাস্তায় দাঁড়ানো ক্যারিজটা দেখতে পেল ও।

“ধরো এগুলো,” বলল সে কোচোয়ানকে। “ফলো করো আমাকে!”

আবার অফিসে ফিরল লুপাঁ। দুই বারেই খালি করে ফেলল ওরা সিন্দুকটা। এরপর নিজের ঘরে চলে এলো লুপাঁ। দড়িটা খুলে ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দিলো গোপন এই অপকর্মের সমস্ত প্রমাণ।

কয়েক ঘণ্টা পরের কথা। লুণ্ঠিত জিনিসগুলো পরীক্ষা করে দেখছিল লুপাঁ ও তার সহকারী। যা পেয়েছে, তাতে অখুশি নয় লুপাঁ, যেহেতু আগেই টের পেয়েছিল, অতিরঞ্জন করা হয়েছে ওদের সম্পত্তির ব্যাপারে। শত মিলিয়ন তো নয়ই, সব মিলিয়ে দশ মিলিয়নও হবে না এই সম্পদের মূল্য। তারপরও অঙ্কটা কম নয় বড়, সে-জন্য এতেই সন্তুষ্ট আর্সেন লুপাঁ।

“বন্ডগুলো বিক্রির সময় কিছুটা ক্ষতি তো মেনে নিতেই হবে,” বলল ও সহকারীকে। “যেহেতু বেচতে হচ্ছে কম দামে, আর গোপনে। সেই শুভক্ষণ না আসা পর্যন্ত আমার টেবিলের ড্রয়ারেই বিশ্রাম নিক ওগুলো।”

পরদিন ইমবার্ট হাউসে হাজির না হওয়ার কোনো কারণই খুঁজে পেল না লুপাঁ। কিন্তু সকালের কাগজ পড়ে চমকে গেল ও: হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ইমবার্ট দম্পতি!

আইনের লোকেরা যখন সিন্দুকটা বাজেয়াপ্ত করল, কিছুই পেল না ওরা ওটার মধ্যে। পাবে কীভাবে? কিছুই তো ফেলে যায়নি লুপাঁ।

***

এই হচ্ছে ঘটনা। এরপর কী হয়েছিল, সেটা জানলাম, একদিন যখন আমার বাড়িতে এলো লুপাঁ। অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল, যেটি ওর স্বভাবের বিপরীত। লাল হয়ে ছিল চোখ জোড়া।

“যা-ই বলো না কেন,” বললাম ওকে। “এটাই কিন্তু তোমার সবচেয়ে সফল অভিযান।’

সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলল ও: “জটিল একটা রহস্য রয়েছে এর মধ্যে, কিছুতেই যেটা ধরতে পারছি না। কেন পালাল স্বামী-স্ত্রী? অজান্তেই ওদেরকে সাহায্য করেছি আমি, অথচ সেটার সুবিধা নিল না কেন ওরা? এভাবে বললেই তো হতো: ‘কোটি কোটি টাকা ছিল সিন্দুকে! সবই চুরি হয়ে গেছে!”

“হিম্মত হয়নি আরকি বলার,” বলি আমি।

“হুম, তা-ই হবে…” মন্তব্য করল লুপাঁ। “আর নয় তো…”

“নয় তো কী?”

লুপার এই ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড়ের কারণটা কী, বুঝলাম না। এটা নিশ্চিত যে সব কথা বলেনি ও আমাকে, কিছু একটা চেপে গেছে। তল পাচ্ছিলাম না ওর এই অস্বাভাবিক আচরণের। লুপাঁর মতো চরিত্রকে ক্ষণিকের দ্বিধায় ফেলতে হলেও অত্যন্ত জটিল বিষয় হতে হবে ওটাকে।

ঝটপট কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।

“ওই দিনের পর থেকে আর দেখোইনি ওদেরকে?”

“নাহ।”

“দুর্ভাগা ওই দম্পতির জন্য একটুও করুণা বোধ করোনি আগে?”

“করুণা! আমি!” চেঁচিয়ে উঠল ও।

ওর এই আচমকা উত্তেজনা চমকে দিলো আমাকে। বন্ধুর গোপন কোনো ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে ফেলিনি তো? বললাম, “নিশ্চয়ই। ওদেরকে যদি ফেলে না যেতে ওভাবে, পরবর্তী বিপদের মোকাবেলা হয়তো করতে পারত ওরা, অন্তত পালাতে পারত পকেটগুলো ভর্তি করে।

“কী বলতে চাও?” জিজ্ঞেস করল ও বিরক্ত হয়ে। “তোমার কি মনে হয়, এর জন্য অনুশোচনায় ভোগা উচিত আমার?”

“অনুশোচনাই বলো, কিংবা করুণা-”

“উহুঁ! ওসব ওদের প্রাপ্য নয়।”

“ওদের সৌভাগ্য ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য বিন্দু মাত্র অনুশোচনা হচ্ছে না তোমার?”

“কীসের সৌভাগ্য?”

“বন্ডগুলোর কথা বলছি।”

“ওহ! ছিনতাই করেছি ওগুলো, তা-ই না? সম্পত্তির একটা অংশ থেকে বঞ্চিত করেছি ওদেরকে-অপরাধ হয়েছে এটা? আহ! আসল ঘটনা কিছুই জানো না তুমি, খোকাবাবু! ভাবতে পারো-কাগজে যা লেখা রয়েছে, মোটেই ওরকম দাম নয় ওগুলোর! জাল বন্ড সবগুলো-নকল! কি, বুঝতে পেরেছ এবার?”

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।

“কী বলছ তুমি! জাল ওগুলো! ওই চার-পাঁচ মিলিয়নের পুরোটাই?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, নকল!” রাগে, ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠল লুপাঁ। “ঝুটো মাল সব! কানাকড়িও মিলবে না ওগুলো থেকে! আর তুমি বলছ, অনুশোচনা জাগবে ওদের প্রতি! ওদেরই তো বরং করুণা হওয়া উচিত আমার জন্য। আহাম্মকের মতো ইমবার্টদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছি আমি। হয়েছি ওদের সর্বশেষ শিকার!”

রাগটা খাঁটি ছিল ওর। চোট খেয়েছে ওর আত্মগর্ব।

“শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই অদৃষ্টটা বেইমানি করেছে আমার সাথে,” বলে চলল লুপাঁ। “হামলাকারীর কবল থেকে যখন নিজের জীবন বিপন্ন করে ইমবার্টের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হলাম, চাকরি পেলাম ওদের বাড়িতে, অন্যদের কাছে আন্দ্রে ব্রফোর্ড হিসেবে উপস্থাপন করল ওরা আমাকে। হ্যাঁ, বাছা, এই হচ্ছে ঘটনা! কিন্তু কিছু সন্দেহ করিনি আমি। খবরের কাগজ পড়ার পরই মোটামাথাটা আমার ধরতে পেরেছে সবকিছু। কীরকম বুদ্ধি, দেখেছ? সবাই জানল, ব্রফোর্ড নামের পাগলাটে লোকটাকে কামরা দেওয়া হয়েছে তৃতীয় তলায়। অমিশুক লোকটা সান্নিধ্য পছন্দ করে না মানুষের। এভাবে আমাকে ব্রফোর্ড সাজিয়ে ব্যাঙ্কার এবং অন্যান্য ঋণদাতার কাছ থেকে টাকা ধার নিতে সক্ষম হয়েছিল ওরা। হাহ! কী এক অভিজ্ঞতা আমার মতো এক নবিশের জন্য! কসম খেয়ে বলছি, এই শিক্ষা থেকেই লাভ তুলে আনব আমি!” থামল লুপাঁ। আমার বাহু আঁকড়ে ধরে উত্তেজিত স্বরে বলতে আরম্ভ করল আবার: “প্রিয় বন্ধু, মাদাম ইমবার্টের কাছে পনেরো শ’ ফ্রাঁ পাই আমি এ মুহূর্তে!”

ওর রাগ দেখে না হেসে পারলাম না। ছুঁচোর ঢিবির ওপর পাহাড় গড়তে চাইছে লুপাঁ।

আপন মনে হেসে উঠল ও। “হ্যাঁ, বন্ধু, পনেরো শত ফ্রাঁ। জানো না হয়তো, প্রতিশ্রুত বেতন থেকে এক পয়সাও পাইনি আমি, উলটো ওই মহিলাই পনেরো শ’ ফ্রাঁ নিয়েছে আমার কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে! কীভাবে, জানো? টাকাগুলো চ্যারিটিতে দিয়ে দেবো বলেছিলাম তাকে। গরিব মানুষদের সাহায্য করার জন্য না-কি টাকাটা প্রয়োজন ছিল মহিলার। মঁসিয়ে ইমবার্ট আবার জানত না এটা। মহিলার অভিনয়ে পটে গিয়েছিলাম বলে টাকাগুলো বেরিয়ে গেছে এই গর্দভের কাছ থেকে। জনৈক প্রিয়দর্শিনীর ফাঁদে পড়ে পনেরো শ’ ফ্রাঁ খোয়ানো আর্সেন লুপাঁ আবার তার কাছ থেকেই চার মিলিয়ন মূল্যমানের জাল বন্ড চুরি করেছে, চমকপ্রদ নয় এটা? আর এ কাজের পেছনে কত সময়, ধৈর্য আর বুদ্ধিই না খরচ করতে হয়েছে আমাকে! এই প্রথম বোকা বনলাম আমি জীবনে। আমার এই নিন্দিত জীবনের একটা শিক্ষা হয়ে থাকল এটা।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *