মাদকের রাজ্যে
মেঘের অনেক রং।
কখনো রক্তের মতো টকটকে লাল।
কখনো নীল।
কখনো সবুজ।
কখনো সজনে ফুলের মতো সাদা।
এখন অবশ্য মেঘের রং ধূসর।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
মন খারাপ করে দেয়া বৃষ্টি।
সেদিন সকালে বৃষ্টি ছিল কি না মনে নেই, তবে কেন জানি আমার মন খারাপ ছিল ভীষণ। বিক্ষিপ্তভাবে নেটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎই একটা লেখা চোখে পড়ল। কে জানত এই লেখাটিই বদলে দেবে আমার জীবনের গতিপথ! লেখকের মুন্সিয়ানা আছে বটে, বাস্তব ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত আর কিছু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আশ্চর্য এক কাহিনি ফেঁদে বসে আছেন পর্ন-আসক্তি নাকি কোকেইন বা হেরোইনের নেশার মতোই ক্ষতিকর! একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। যদিও হজম করতে সময় লাগল কিছুটা। পর্ন দেখলে আপনার মস্তিষ্কের যে ক্ষতিটা হবে কোকেইন, হেরোইন ইত্যাদি কড়া মাদক সেবনেও আপনার একই ক্ষতি হবে! শুধু তা-ই না, পর্ন-আসক্তি আপনার মস্তিষ্কের গঠনই বদলে ফেলবে!
কিন্তু কেন?
আপনি কিছু খেলেন না, পান করলেন না, ঘরের এককোণে বসে বসে পর্ন দেখলেন, তারপরেও কেন কোকেইন বা হেরোইন সেবনের মতো ক্ষতির শিকার হবেন আপনি? কেন আপনার মস্তিষ্ক পরিবর্তিত হয়ে যাবে? এই “কেন”-র উত্তর পাবার জন্য বিজ্ঞানের কিছু কচকচানি শুনতে হবে। চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব সহজভাবে বোঝানোর। আমাদের মস্তিষ্কের একটা অংশকে বলা হয় রিওয়ার্ড সেন্টার (Reward Center)। এটার কাজ হলো আপনাকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে
আনন্দের অনুভূতি দেয়া, বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়া। সহজ বাংলায় বলি। ছোটবেলায় ফেলুদা পড়ার নেশা ছিল। বাসা থেকে বলত পরীক্ষায় ভালো রেসাল্ট করলে ফেলুদার বই কিনে দেয়া হবে। পরীক্ষায় ভালো রেসাল্ট করার পর আমাকে ফেলুদার বই কিনে দিয়ে ভালো ফলাফলের জন্য পুরস্কৃত করা হলো, রিওয়ার্ড সেন্টার ঠিক এই কাজটাই করে। যে কাজগুলো আপনার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভালো কিছু খাওয়া, কিছু পাবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা, রিওয়ার্ড সেন্টার সেই কাজগুলো করার জন্য আপনাকে প্রেরণা দেবে এবং কাজ শেষে পুরস্কৃত করবে।
কিন্তু রিওয়ার্ড সেন্টার কীভাবে আমাদের পুরস্কৃত করে? মেকানিমটা কী? রিওয়ার্ড সেন্টার এই পুরস্কার দেবার জন্য ডোপামিন (Dopamine) এবং অক্সিটোসিন (Oxytocin) নামের দুটো কেমিক্যাল রিলিয করে। যখন রিওয়ার্ড সেন্টার অনুভব করে পুরস্কার দেয়ার মতো কিছু ঘটেছে, এ কেমিক্যাল দুটো পাইকারি হারে উৎপন্ন হওয়া শুরু করে। আর এ দুটো কেমিক্যাল উৎপন্ন হলেই খেল খতম… আকাশে বাতাসে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। আনন্দম, আনন্দম, আনন্দম। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, এই “রিওয়ার্ড সেন্টার” খুব সহজেই বেহাত হয়ে যায়। আফিম বা কোকেইন জাতীয় মাদকদ্রব্য কোনো ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই “আরামসে” রিওয়ার্ড সেন্টারকে উত্তেজিত করে তোলে। মস্তিষ্কে ডোপামিন আর অক্সিটোসিনের জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়। পরিণতিতে কবির ভাষায়, “সুখের মতো ব্যথা” অনুভূত হতে থাকে।
মাদকদ্রব্যের মতো পর্নও খুব সহজেই মস্তিষ্কে ডোপামিনের বন্যা বইয়ে দিয়ে। দর্শককে ক্ষণিকের জন্য সুতীব্র আনন্দ দিতে পারে। পর্ন-আসক্ত এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা গিয়েছে, তাদের মস্তিষ্কের গঠন হুবহু এক।
লেকিন পিকচার আভি বাকি হ্যায়…
ডোপামিন ব্রেইন পালসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুরস্কার পাবার নতুন রাস্তা তৈরি করে। যার ফলে যে কাজটার কারণে প্রথমবার ডোপামিন নির্গত হয়েছিল, মস্তিষ্ক ডোপামিনের লোভে বার বার সেটাতে ফিরে যেতে চায়। এ কারণেই একবার পর্ন দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। দুধের দাঁত পড়তে শুরু করেছে তখন কেবল। বহু কষ্টে ব্যাট তুলে ধরতে পারি। আশেপাশে আমার মতে কয়েকজন। পিচ্চিকে নিয়ে একটা দল গঠন করা হলো, বল থাকলেও ব্যাট ছিল না। কারোরই সাহস ছিল না বাবার কাছে ব্যাটের আবদার করার। অগত্যা একজন তার বড় ভাইয়ের হাতেপায়ে ধরে তাল গাছের ডাল চেঁছে ব্যাট বানানোর ব্যবস্থা করল। সেই ব্যাট নিয়ে আমাদের কী যে আনন্দ!
কিছুদিন এটা দিয়ে জম্পেশ খেলা হলো, কিন্তু তারপর তালের এই ব্যাট দিয়ে খেলা আর মন টানে না। ইতিমধ্যে আমরা কিছুটা বড় হয়েছি। কাঠমিস্ত্রীদের দিয়ে নিম কাঠের সুন্দর একটা ব্যাট বানানো হলো। নীল রঙা এই ব্যাট এখনো আমার চোখে ভাসে! কত ছক্কা যে মেরেছি এই ব্যাট দিয়ে! কিছুদিন পরে এই ব্যাট দিয়েও খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। চাঁদা তুলে বৈশ দামি কাঠের বল খেলার ব্যাট কেনা হলো। এত প্যাঁচাল পাড়ার একটাই উদ্দেশ্য, আপনাদের বোঝানো যে মানুষ কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশিদিন সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। আল্লাহ্ মানুষকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। পর্ন-আসক্তির ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে। ধরুন, আপনি কোনো সফটকোর (Softcore) পর্ন দেখলেন। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ডোপামিন রিলিয হলো, আপনি আনন্দ পেলেন। পর পর কয়েকবার পর্ন দেখার পর ঠিক একই পরিমাণ ডোপামিন রিলিয হলেও, আপনি আগের মতো আর আনন্দ পাবেন না। আপনি আর এই পর্ন ভিডিওতে সন্তুষ্ট থাকতে পারবেন না। আপনার প্রয়োজন হবে নতুন কিছুর। কেন এমন হয়?
মাত্রাতিরিক্ত ডোপামিন রিলি হলে মস্তিষ্ক ডোপামিনের ব্যাপারে কম সংবেদনশীল হয়ে যায়। অর্থাৎ আগের ডোজে আর কাজ হয় না। কারণ অতিরিক্ত ডোপামিনের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মস্তিষ্ক এমন কিছু স্নায়ু বিসর্জন দেয় যেগুলোর কাজ ছিল ডোপামিনজাত উদ্দীপনা গ্রহণ করে সাড়া দেয়া। Receptor Nerve নামের এ স্নায়ুগুলোর কাজ হলো ডোপামিন অণু গ্রহণ করে মস্তিষ্ককে এই সিগন্যাল দেয়া যে, আমি এত এত পরিমাণ ডোপামিন গ্রহণ করেছি। যখন Receptor Nerve এর সংখ্যা কমে যাবে তখন আগের মতো সেই একই পরিমাণ ডোপামিন রিলিয হলেও সেটা গ্রহণ করার জন্য পর্যাপ্ত Receptor Nerve থাকছে না, আর তাই মস্তিষ্ক ধরে নিচ্ছে উপস্থিত ডোপামিনের পরিমাণ খুব কম। এ কারণেই সে একই পর্ন ভিডিও দেখেও আপনি আগের চেয়ে কম আনন্দ পাচ্ছেন।
আগের মতো আনন্দ পাবার জন্য আপনার তখন আরও “কড়া” কিছু লাগবে। আপনি ঝুঁকে পড়বেন হার্ডকোর (Hardcore) পনের দিকে। এতে ডোপামিন রিলিযের মাত্রা বাড়বে এবং আপনি পাবেন আগের সেই সুতীব্র আনন্দ। সফটকোর পর্ন দিয়ে শুরু করে ডোপামিন লেভেলের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য আপনি ধীরে ধীরে সমকামী পর্ন আর শিশু পর্নের মতো জঘন্য জিনিসও দেখা শুরু করবেন। মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক এমনটাই ঘটে। সিগারেট থেকে যে নেশীর শুরু হয় তার শেষ হয় কোকেইন আর হেরোইনো। আমাদের মস্তিষ্কের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হচ্ছে ফ্রন্টাল লৌব (Frontal Lobe)। এই বাবাজির কাজ কী? ল্যাবের করিডোর দিয়ে কোনো রূপবতী হেঁটে গেলে আপনার দুচোখে যে স্বপ্নের আবির নামে, তার জন্য দায়ী এই ফ্রন্টাল লৌব। আমাদের ভাব প্রকাশের মধ্যম মানে ভাষা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের পারদর্শিতা, সর্বোপরি আমাদের ব্যক্তিত্ব নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই ফ্রন্টাল লৌব।
মাদকাসক্তি, অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়া, ইন্টারনেট আসক্তি, পর্ন–এই ফ্রন্টাল লৌবের মারাত্মক ক্ষতি করে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, একজন মানুষ যত বেশি পর্ন দেখে, তার মস্তিষ্কের তত ক্ষতি হতে থাকে এবং ক্ষতি পূরণ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ নার্ভ সেল হল দেহের সেই কোষগুচ্ছ যেগুলো কখনোই রিজেনারেট করে না। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও পর্ন ভিডিও আপনার মস্তিষ্কের কী ব্যাপক ক্ষতি করে, আশা করি বোঝা গেছে।