মাতৃলিপি

মাতৃলিপি

পাঁচ মিনিট পরেই বোর্ড মিটিং। কেবিনে বসে কম্পিউটার থেকে কিছু নোটস তড়িঘড়ি পেনড্রাইভে লোড করে নিচ্ছে সোমনাথ। দু’জনের পরেই তার প্রেজেন্টেশন। কোম্পানির খুব ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং এটা। সোমনাথের কেরিয়ারের জন্যেও। এমন সময় ফোন এল মোবাইলে৷ সেটটা টেবিলে একটু দূরে রাখা আছে। বাঁ হাতে তুলে নিয়ে স্ক্রিন না দেখেই সোমনাথ কানে তুলল, হ্যালো!

কিছু ঠিক করলে? শ্রেয়ার গলা।

সোমনাথ অবাক হয়ে জানতে চায়, কীসের কথা বলছ?

হায় কপাল! ছেলের নাম…

মনে পড়ল সোমনাথের। সাতদিন হল ছেলের বাবা হয়েছে সে। প্রথম সন্তান। অফিসে আজ যা চাপ, নিজের নামটাই মনে রাখা কঠিন! শ্রেয়াকে বলল, প্লিজ, ঘণ্টা দুয়েক পর ফোন করো। নাউ আই অ্যাম অফুলি বিজি।

‘বিজি’ বললেই হল! তুমি বলেছিলে বারোটার আগেই ফোন করে জানাবে নাম। আমি এক ঘণ্টা ওয়েট করলাম। ভাবছি, হয়তো ঠিক করে উঠতে পারোনি বলে দেরি করছ। এখন তো দেখছি ব্যাপারটা মাথাতেই ছিল না। এদিকে ওঁর কিন্তু আসার সময় হয়ে গেছে।

‘ওঁর’ অর্থে সোমনাথের বাবা, শ্রেয়ার শ্বশুরমশাই। শ্রেয়ার ভীষণ চিন্তা, শ্বশুরমশাই এসে নাতির নামকরণ না করে দেন। ছেলের জন্মের সময় শাশুড়ি ছিলেন, ওরকমই একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। চিন্তা সোমনাথেরও, তাদের পরিবারে সকলের নামের সঙ্গে ‘নাথ’ যোগ হয়ে চলেছে। সোমনাথের ছোট ভাইয়ের নাম মল্লিনাথ, বাবার নাম দিবানাথ, জ্যাঠা মথুরানাথ, ঠাকুরদা যোগনাথ। মানে নাথের ছড়াছড়ি। তুলনায় মেয়েদের নামে অনেক বৈচিত্র্য। কিন্তু হল ছেলে। সোমনাথের বাবা আজ হালিশহরের বাড়ি থেকে আসছেন নাতির মুখ দেখতে। ‘নাথ’ যুক্ত নামও নিশ্চয়ই ঠিক করে রেখেছেন।

কী হল, বলো? শ্রেয়া তাড়া দেয়।

সোমনাথের চোখে ভেসে উঠেছিল বাবার চেহারাটা, ওদের হাউজিং-এ এসে সিকিউরিটি গার্ডের টেবিলে নিজের নাম লিখছেন। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি, কাঁধে আদ্যিকালের ব্যাগ। মুখে কিন্তু কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই। বংশধরের মুখ দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। সোমনাথ ফোনে শ্রেয়াকে বলে, নাম রাখো রজার, রজার চৌধুরী। দারুণ না? ধ্যাত, বাঙালি ছেলের নাম ইংরেজি হবে কেন! আপত্তি জানায় শ্রেয়া।

সোমনাথ অবশ্য প্রায় না ভেবেই নামটা বলেছে। স্ক্রিনে রজার সফটওয়্যারের ডিটেল

ফুটে উঠেছিল, সেটা দেখেই বলে দেয় নামটা। তার সমর্থনে এখন বলে, বাংলা নাম দিয়ে কী হবে, পড়বে তো ইংলিশ মিডিয়ামে। বড় হয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গলে পড়ে থাকার চান্স খুব কম। এই নামটাই ফিট।

না না, বাঙালির ছেলে, তার একটা নিজস্ব পরিচয় থাকবে না!

কেন ‘চৌধুরী’ টাইটেলে সেই পরিচয় তো আছে।

‘চৌধুরী’ পদবি অন্য ভাষার লোকেদেরও হয়। ধর্মও বোঝা যায় না। সেইজন্যই নামটা বাঙালি হিন্দু টাইপ করতেই হবে।

ও কে, গিভ মি অ্যানাদার হাফ অ্যান আওয়ার। তার মধ্যেই নাম ঠিক করে দিচ্ছি। তুমিও ভাবতে থাকো।

আমি আর ভাবতে পারছি না। আজ সকালে প্রিয়া আরও চারটে নাম পাঠিয়েছে। সব মিলিয়ে পঁচিশটার ওপর হয়ে গেল। একটাও পদের নয়। আধ ঘণ্টা পর ফোন করছি। রাখলাম।

ওপ্রান্ত নীরব হয়ে যেতে স্বস্তির শ্বাস ফেলল সোমনাথ। ফোন পুরোপুরি অফ করে পকেটে পুরল। আবার অন করবে মিটিং থেকে বেরোনোর পর। ততক্ষণে বাবা এসে যাবেন ফ্ল্যাটে। নামও দিয়ে দেবেন। সেটা কী করে বাতিল করা যায়, তখন ভাবা যাবে। আপাতত মিটিংটা তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকঠাক পারফর্ম করতে পারলে, একটা লিফটমেন্ট বাঁধা।

পেনড্রাইভটা কম্পিউটার থেকে খুলে নিতে গিয়ে সোমনাথের চোখে পড়ে টেবিলের ওপ্রান্তে ইউনিফর্মড বেয়ারার হাঁটু। চোখ তুলে দেখে, মানিক দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে ইন্টারকমে ক্যান্টিনকে চা দিতে বলেছিল সোমনাথ। মানিক বোধহয় শ্রেয়ার ফোনের সময় চা নিয়ে ঢুকেছে। এখনও দাঁড়িয়ে আছে কেন? কাপ তুলে নিয়ে সোমনাথ কপালে ভাঁজ ফেলে মানিককে জিজ্ঞেস করে, কী, কিছু বলবে?

ছেলের নাম ঠিক করছেন বুঝি? তোষামুদি হাসি সহ জানতে চায় মানিক।

বস-এর ব্যক্তিগত ফোনালাপ শুনে, এই ধরনের প্রশ্ন যে গর্হিত আচরণ, মানিক তা নিশ্চয়ই বোঝে। সাহসটা পেয়েছে সম্ভবত সোমনাথের নরম স্বভাবের জন্য। সুনাম বজায় রাখতে সচেষ্ট সোমনাথ চায়ে চুমুক মেরে মজা করার ঢঙে বলে, কেন, তোমার স্টকে কোনও ভাল নাম আছে নাকি?

আমার স্টকে আর কী নাম থাকবে! তবে আমাদের পরের গ্রামে এক সন্ন্যাসী ‘নাম’ দেন। মানে কিছুদিন হল দিচ্ছেন। অদ্ভুত সব কাণ্ড হচ্ছে সেই নাম নিয়ে।

কীরকম? উদাসীন আগ্রহে জানতে চায় সোমনাথ।

মানিক বলে, এ পর্যন্ত তিনি যে ক’টা বাচ্চার নামকরণ করেছেন, তাদের ফ্যামেলির কিছু না কিছু ভাল হয়েছে।

যেমন?

কারও বাঁজা নারকোল গাছে ফল আসতে শুরু করেছে। যেসব ডিপ পুকুরে খাপলা জালে মাছ ওঠে না, সেখানে মাছ পড়ছে দেদার। কালো মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ আসছে বড়লোক বাড়ি থেকে।

এসব তোমার লোকমুখে শোনা কথা?

সোমনাথের প্রশ্নে ঘাড় কাত করে মানিক। বলে, এগুলো শোনা হলেও, আমার শ্বশুরবাড়ির ঘটনাটা তো সত্যি। বড় শালার মেয়ের নাম রাখলেন সন্ন্যাসী, ছোট শালার পুলিশের চাকরিটা হয়ে গেল।

বাঃ, খুব ভাল খবর। বলে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সোমনাথ। এবার কনফারেন্স রুমের দিকে যেতে হবে। মিটিং শুরু হতে ঠিক দেড় মিনিট বাকি।

করিডর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সোমনাথ ভাবে, মানিক কি জানে সোমনাথের চাকরিতে একটা উন্নতি অপেক্ষা করছে? তাই কি সন্ন্যাসীর কথাটা তুলল? জানার কথা নয়। অতটা ওপর মহলের আবহাওয়ার পূর্বাভাস ওর মতো বেয়ারা কী করে পাবে!

অফিসের পর ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে সন্ধে উতরে গেল। সোমনাথের মাথায় এখন ছেলের নাম, বাবার আসার কথা, কিছুই নেই। মন জুড়ে রিপ্লে হয়ে চলেছে বোর্ড মিটিং-এর ছবি। বড়সাহেবদের এক্সপ্রেশন দেখে আন্দাজ করা গেল না, কতটা ইমপ্রেসড হয়েছেন সোমনাথের প্রেজেন্টেশনে। সকলেই যেন মুখোশ পরে ছিলেন। অভিব্যক্তি একটাই, শুনছি, বলে যাও। সোমনাথের যে লিফটমেন্টটা হওয়ার কথা, তা হচ্ছে, ছ’মাসের জন্য জার্মানির মিউনিখে কোম্পানির সদর অফিসে ট্রেনিং নিতে হবে। তারপর এসে বসবে মুম্বইয়ের জোনাল অফিসের সি.ও. হয়ে। স্যালারি, পার্কস হবে দ্বিগুণ। আদৌ কি হবে এসব?

অফিসের পোশাক বদলে, বাথরুম ঘুরে সোমনাথ একবার ছেলেকে দেখে এসেছে। এটা তার নতুন রুটিন। এ. সি. লাগানো বেডরুমে শুয়ে দেদার ঘুমোচ্ছে ব্যাটা। আজ মনে হল, ছেলে বুঝি তার মতো দেখতে হয়েছে। কাল মনে হচ্ছিল শ্রেয়ার মতো।

, সোমনাথ এখন ড্রয়িং-এ বসে চা খাচ্ছে। তাকিয়ে আছে চলন্ত টিভির দিকে, প্রোগ্রামটার কোনও ছাপ মাথায় পড়ছে না। শ্রেয়া নিজের চা নিয়ে এসে সোফায় বসল। বলল, বাবা তো এলেন না।

মুহূর্তের মধ্যে ‘নাম’ প্রসঙ্গটা মনে পড়ল সোমনাথের। প্রথমেই উদ্বিগ্ন হল বাবার জন্য। জিজ্ঞেস করল, এলেন না কেন, কী হয়েছে?

সেরকম সিরিয়াস কিছু নয় নিশ্চয়ই। তা হলে ওবাড়ি থেকে ফোন আসত। বলল শ্রেয়া।

সোমনাথদের হালিশহরের বাড়িটা পাঁচ পুরুষের। এখন বাবারা চার ভাই ওখানে থাকেন। তাঁদের ছেলেমেয়েদের কয়েকজন ওখানে থাকলেও, বেশির ভাগই ছড়িয়ে পড়েছে। মেয়েদের তো বিয়ের পর বাড়ি বদলেই যায়। অফিস যাওয়ার সুবিধের জন্য সোমনাথও চলে এসেছে কসবার এই আবাসনের আট তলায়।

ফোন করে একবার দেখতে পারতে, কেন এলেন না বাবা। তোমাকেই তো ফোনে আসবেন বলেছিলেন। শ্রেয়ার উদ্দেশে বলল সোমনাথ।

শ্রেয়া বলে, তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম। আগে ফোন করলে যদি ‘নাম’ দিয়ে দেন। ভেবেছ কিছু তুমি?

চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে নামিয়ে সোমনাথ আড়মোড়া ভাঙে। বলে, কখন ভাবব বলো তো? কাজের চাপে মাথা তোলা যায় না। আজ আবার বোর্ড মিটিং ছিল।

মিটিংটা সোমনাথের কেরিয়ারের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেয়াকে সেটা জানাতে চায় না। সারপ্রাইজ দেওয়ার ইচ্ছে আছে।

শ্রেয়া বলে, বার্থ সার্টিফিকেট নিতে গেলে কর্পোরেশনকে একটা নাম জানাতেই হবে। আর তিনদিন বাদে গেলেই পাওয়া যাবে সার্টিফিকেটটা। ফোন করে জেনে নিয়েছি আমি।

আচমকাই মানিকের কথা মনে পড়ে সোমনাথের। বলে, আমাদের অফিসের বেয়ারা এক সন্ন্যাসীর কথা বলল। ওদের দেশের দিকে থাকেন। নামকরণ করেন শিশুর। পয়া নাম দেন। যাবে নাকি তাঁর কাছে?

প্রশ্নের আড়ালে থাকা ঠাট্টাটাকে পাত্তাই দিল না শ্রেয়া। বলল, প্লিজ, খবর যখন পেয়েছ, একবার ওঁর কাছে যাও না। নাম যদি রাখতেই হয়, এইভাবেই রাখা উচিত। এতটাই গুরুত্ব দিয়ে।

সোমনাথ তো অবাক। বলে, সন্ন্যাসী তো ওল্ড টাইপ নাম রাখবে। পছন্দ হবে তোমার? বাবার দেওয়া নামই যখন রাখতে চাইছ না।

বাবার নামটা এড়াতে চাইছি ‘নাথ’ শব্দটার জন্য। পুরনো সংস্কৃত টাইপ নাম হলে তো ভালই হয়।

সেরকম না হয়ে ধরো, সাধু নাম দিলেন ‘করালীচরণ’, তখন কী করবে? রাখব না নামটা। তবু একবার সন্ন্যাসীর দেওয়া ‘নাম’ জানতে অসুবিধে কোথায়? হাতে যখন তিনদিন সময় আছে।

একটু আগেই এই সময়টাই শ্রেয়ার কাছে বড্ড কম মনে হচ্ছিল। এখন অগাধ। তাও তো সাধুর পুরো মাহাত্ম্য শোনেনি, বন্ধ্যা গাছে ফল আসে, জাল ফেললেই পুকুর থেকে মাছ ওঠে অঢেল। কালো মেয়ের ভাল বিয়ে হয়। আচমকাই চাকরি পায় মানিকের ছোট সম্বন্ধী…

তিন দিনের শেষ দিনটা আজ। রবিবার বলে এই দিনটাই সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে সোমনাথ। খানিক আগে লোকাল ট্রেনে চেপে কাটোয়া লাইনের অগ্রদ্বীপ স্টেশনে এসে নেমেছে। কথামতো মানিক দাঁড়িয়ে ছিল। ভ্যানরিকশার ব্যবস্থাও রেখেছে। তাতে চেপে দু’জনে এখন চলেছে সিমুরিয়া গ্রামে। ওখানেই থাকেন সন্ন্যাসী। শ্রাবণের দুপুর। রোদ থাকলেও, তেমন তেজ নেই। খানিকটা বাধ্য হয়েই সন্ন্যাসীর কাছে ছেলের নাম নিতে এসেছে সোমনাথ। শ্রেয়া বলেছে, তুমি যদি না যেতে পারো, বলো। আমি বোন অথবা মাকে নিয়ে চলে যাব।

রিস্ক নেয়নি সোমনাথ। এই ধরনের মিরাকল দেখানোর সাধু-সন্ন্যাসীরা জেনারেলি ভণ্ডই হয়। মহিলারা এদের কাছে সবচেয়ে ভাল শিকার। শ্রেয়াকে এমন পট্টি পরাবে যে একগাদা টাকা জলে যাবে সোমনাথের। তার চেয়ে এই ভাল, ছুটির দিনে ছোট্ট একটা আউটিং হচ্ছে। অনেকদিন কোথাও ঘোরাও হয়নি। একা লোকাল ট্রেনে চেপে তো নয়ই।

আজকাল হালিশহরের বাড়িতে গেলে, নিজের গাড়িতেই যায় সোমনাথ। ইট ছ্যাতরানো রাস্তায় যতবার ঝাঁকুনি খাচ্ছে রিকশা, মানিকের মুখে পড়ছে অপরাধের ছায়া। কেননা এটা ওর দেশ গাঁ। সোমনাথ কিন্তু জার্নিটা বেশ উপভোগ করছে। এই মুহূর্তে তার চারপাশে শুধু মাঠ আর খেতজমি। আজ সকালের দিকে অথবা কাল বৃষ্টি হয়েছে। খেতগুলো হয়ে আছে আকাশের আয়না। দূরে মাঠ থেকেই যেন উঠেছে পাহাড়ের মতো সাদা মেঘ। বাকি আকাশ স্বচ্ছ নীল। সেখানে চিল পাক খাচ্ছে। আকাশ, মেঘ, ভেজা জমির সঙ্গে কোথায় যেন একটা অদ্ভুত মিলমিশ। অথচ এই আকাশ তো শহর থেকেও দেখা যায়, তখন তাকে ততটা আপন লাগে না। এতটা গন্ডগ্রামে এর আগে আসা হয়নি সোমনাথের। আর হয়তো হবেও না। পদোন্নতি যদি হয়ে যায় চাকরিতে, তখন একের পর এক আধুনিক শহরে কাটাতে হবে জীবন।

ট্রেনে ওঠার আগে পর্যন্ত সোমনাথের মনে একটা অপরাধ বোধের কাঁটা ফুটছিল। যত এগিয়েছে ট্রেন, মাঠঘাটের হাওয়া উঠে এসে দ্রবীভূত করেছে সেই অনুতাপ৷ বাবা যে সেদিন এলেন না, তারপর আর কোনও খোঁজ নেওয়া হয়নি। কারণ সেই একটাই, যদি ‘নাথ’ যুক্ত কোনও প্রাচীন নাম দিয়ে ফেলেন নাতির। এক্ষেত্রে শ্রেয়ার যুক্তিটাই সম্বল করেছে সোমনাথ, বিশেষ কিছু হলে, ওবাড়ি থেকে ফোন আসত। তার মানে কি অল্প কিছু হলে বাবা-মায়ের খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই? এমনও তো হতে পারে, বাবা অভিমান করে বসে আছেন, সেদিন যেতে পারলাম না, কই, ছেলে তো খোঁজ নিল না কোনও!

এরকম একটা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সোমনাথ ছেলের একটা ভাল নামের জন্য সময় নিচ্ছে। নিজের নামটা বইতে কোনওদিন তার ভাল লাগত না। হাজার হাজার ‘সোমনাথ’ আছে বাংলায়। শ্রেণি অবস্থান বুঝতে বেশ অসুবিধে হয়। সন্ন্যাসীর কাছে গেলে এ ব্যাপারে যে কোনও সুবিধে হবে না, গ্রামের গভীরে ঢুকে যেতে যেতে আরও ভালভাবে টের পাচ্ছে। এই অঞ্চলে ‘সোমনাথ’ নামটাই হয়তো খুব পোশাকি। এরকমটা হতে পারে জেনেও কেন এল? ঘণ্টা ছ’-সাত অন্য কোথাও কাটিয়ে, শ্রেয়াকে গিয়ে বললেই হত, সাধু নাম দিলেন ‘কালীপদ’। শ্রেয়া কিছুতেই সে নাম রাখত না। তা হলে কি ‘পয়া’ নাম পাওয়ার গ্রাম্য বিশ্বাসটাই সোমনাথকে নিয়ে এল এখানে? প্রশ্নটা নিয়ে মনের প্রত্যন্তে একবার ঘুরে আসে সোমনাথ, সঠিক কোনও উত্তর পায় না।

একটা সরু নদীর ব্রিজের ওপর উঠে পড়েছে ভ্যানরিকশা। ওপারে এখনও পর্যন্ত গ্রামরেখা দেখা যাচ্ছে না। মানিকের উদ্দেশে সোমনাথ বলে, আর কত দূর? তোমাদের গ্রামই তো এখনও এল না। বলছ, তার পরের গ্রামে যেতে হবে।

মানিক বলে, আর দশ মিনিট। আমাদের গ্রামের দিকে তো যাইনি। শর্টকাটে নিয়ে যেতে বলেছি।

রিকশাওলার উদোম পিঠে ঘাম গড়াচ্ছে। সোমনাথদের তেমন কষ্ট হচ্ছে না। নদীর জলছোঁয়া হাওয়ায় বেশ আরাম।

সোমনাথ মানিককে বলে, তুমি এত দূর থেকে অফিস যাও কী করে? যাতায়াতেই তো অনেক টাইম চলে যায়!

তা যাক। গ্রামে ফিরে এলে বড় শান্তি, বলে বড় করে শ্বাস নেয় মানিক।

ভঙ্গিটা অহংকারের মতো লাগে। সোমনাথের বেলায় ঘটেছিল ঠিক উলটো, হালিশহর থেকে কলকাতা দেড় ঘণ্টার মতো জার্নি, তার পোষাত না। আদি বাড়ি ছেড়ে চলে এল কলকাতায়। আবাসনের আটতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এখন নিজেকে বেশ সার্থক মনে হয়। আপাতত কথা ঘোরায় সোমনাথ, তুমি সন্ন্যাসীর আস্তানাটা চেনো তো, নাকি খুঁজতে হবে?

আমি আশ্রমে আসিনি। সিমুরিয়ায় আমার শ্বশুরবাড়ি। ডিরেকশন একটা দিয়েছে ওরা। তেমন বুঝলে কারও কাছে জেনে নেব।

বেলা পড়তে শুরু করেছে। রং পালটাচ্ছে রোদের। সাধুর ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি সেরে ট্রেন ধরতে হবে। কাল আবার অফিস আছে। এসব চিন্তার মধ্যেও সোমনাথের মাথায় এক সুখ-কল্পনা ভর করে। দূরে গাছপালা ঘেরা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে ভাবে, কোনওভাবে যদি সন্ন্যাসীর দেওয়া নামটা ফিট করে যায়, ছেলে বড় হলে সোমনাথ বলবে, তোর নাম নিয়ে আসতে আমি প্রত্যন্ত এক গ্রামে গিয়েছিলাম। কী অপূর্ব সেই পথের প্রাকৃতিক রূপ।

বাবার প্রয়াসকে ছেলে নিশ্চয়ই সাধুবাদ জানাবে, একবার আসতে চাইবে এই গ্রামে, যেখানে ওর নামের জন্ম হয়েছিল। ততদিনে হয়তো এ গ্রামকে গিলে নেবে শহর।

একটা বাস্তব ব্যাপার হঠাৎ খেয়াল পড়ে সোমনাথের। মানিককে জিজ্ঞেস করে, সাধুর চার্জ কত, কিছু জেনেছ?

মানিক হেসে ফেলে বলে, কত আর হবে, গ্রামের দিকের ব্যাপার, ওই ক’টা টাকা আপনার কাছে আছে।

সোমনাথের সমস্যাটা মানিক বুঝবে না। কার্ডের হ্যাবিট হওয়ার পর থেকে সোমনাথের পার্সে খুচরো টাকা কমই থাকে, বেরোনোর সময় আজ বেশি করে নিতে ভুলেও গেছে। মনে একটা খিচ নিয়ে প্রকৃতির দিকে চেয়ে বসে থাকে সোমনাথ।

দূর থেকে গাছপালা ঘেরা যে জায়গাটা দেখা যাচ্ছিল, সেটাই সিমুরিয়া। গ্রামে ঢোকার মুখে মুদিখানা গোছের একটা দোকানের সামনে রিকশাওলাকে থামতে বলল মানিক। ভ্যানে বসেই দোকানিকে জিজ্ঞেস করল, গোপালমাস্টারের বাড়িটা কোথায়?

টাটে বসা দোকানি আঙুল নির্দেশ করে বলল, মিনিট পাঁচ এগিয়ে যান আরও। প্রথম যে মোড়টা পড়বে, বাঁদিক ধরে এগোলে, পাকা বাড়ি একটাই। ওইটাই গোপাল ভট্টাচার্যের বাড়ি।

রিকশাওলা ফের প্যাডেল মারতে শুরু করেছে। পরপর দুটো খটকায় সোমনাথের কপালে এখন ভাঁজ। মানিককে জিজ্ঞেস করে, গোপাল ভট্টাচার্যটা আবার কে?

উনিই তো সন্ন্যাসী। শ্রীপুর হাইস্কুলের বাংলার টিচার ছিলেন। রিটায়ারমেন্টের পর সন্ন্যাস নিয়েছেন।

সোমনাথ ভাবে, হয়ে গেল! এ তো শখের সন্ন্যাসী। টাইম পাস করার জন্য পেশাটা বেছেছেন অথবা টু-পাইসের ধান্দা। এই ইনফর্মেশনগুলো দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি মানিক। একেই বলে গেঁয়োলোক। এদের কাছে সাধু, মাস্টার সব সমান। পরের খটকাটায়

যায় সোমনাথ, তুমি তো বলেছিলে আশ্রম। বাড়িতে আবার আশ্রম হয় নাকি? পাকাবাড়ি মানে তো বিষয়ী বড়লোক। তিনি আবার…

এবার মানিকও কিছুটা ধন্দে। বলে, আমি সেটাই ভাবছি। আসলে আগে তো আসিনি। চলুন না, গিয়ে দেখাই যাক।

একতলা ছিমছাম বাড়ির সামনে এসে পৌঁছোল সোমনাথরা। পাশে আটচালার আশ্রমও আছে। দরজার ওপরে টিনের বোর্ডে লেখা ‘অমৃতধাম’। বসত সংলগ্ন বেশ ক’টা বড় ঝাঁকড়া গাছ। রিকশাওলা তার গাড়ি নিয়ে চলে গেল গাছতলায়। টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল পাটাতনে। সোমনাথরা ওর ভ্যানরিকশাতেই ফিরবে স্টেশনে।

মানিক ঠিক করে উঠতে পারছে না, কোন দরজায় যাবে, বাড়ির না আশ্রমের? আশপাশে কোনও লোকজন দেখা যাচ্ছে না। গোরুর ডাক ভেসে এল বাড়ির পিছন থেকে। ইতস্তততার মধ্যেই দেখা গেল পাকাবাড়ির সদর দিয়ে বেরিয়ে আসছে এক যুবতী। সম্ভবত এ-বাড়ির বউ। দুই আগন্তুককে দেখে, থমকে গিয়ে ঘোমটা তুলল। হাতে কাঁসার গ্লাস।

মানিক জিজ্ঞেস করে, গোপালবাবু, মানে স্বামীজি আছেন?

সম্বোধনের দ্বিধা দেখে বউটির কোনও ভাবান্তর হল না। বলল, আছেন। আসুন আমার সঙ্গে।

আশ্রমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল যুবতী। অনুসরণ করল সোমনাথরা।

ঘরটাকে অনায়াসে ‘হলঘর’ বলা যায়। চাটাইয়ের দেওয়াল। মেঝে মাটির৷ কোনও আসবাব নেই। বড় বড় চারটে জানলা দিয়ে বিকেলের আলোয় ঘর আলোকিত। দূরে বেদি মতো জায়গায় বসে আছেন গোপাল ভট্টাচার্য। পরনে লাল শালু। দাড়িগোঁফ নিয়ে পুরোপুরি সন্ন্যাসী। শরীরে জল-তেল পড়ে সেটা বোঝা যাচ্ছে। ছোট টুলের ওপর রাখা

খাতায় নিমগ্ন হয়ে কী যেন লিখছেন। বউটি সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বাবা, আপনার চা। মুখ তুললেন সাধু। বললেন, ওঃ, দাও মা, দাও। গ্লাসটা হাতে নিতে গিয়ে চোখ গেল সোমনাথদের দিকে। সাধু অবাক হয়ে বলেন, আপনারা!

মানিক কথা শুরু করে, স্বামীজি, আমি পাশের গ্রামেই থাকি। ইনি আমার অফিসের স্যার। আপনার কথা বলেছিলাম। দেখা করতে এলেন।

সন্ন্যাসী অতি বিনয়ে হাত জোড় করে বললেন, আমার কী সৌভাগ্য। আসুন, আসুন। বউটির উদ্দেশে বললেন, বউমা, এঁদের দুটো বসার জায়গা দাও।

দুটো আসন পেতে দিয়ে বউটি ঘর ছেড়ে চলে গেল। মেয়েটি আশ্চর্য রকমের ভাবলেশহীন। শ্বশুরের কাছে ক্লায়েন্ট এসেছে, খুশি হওয়ার কথা তো!

সোমনাথ, মানিক আসনে বসল। সাধুর মুখে বিগলিত হাসি, বলুন, আপনাদের জন্য কী করতে পারি?

এবারেও মানিকই বলল, ক’দিন আগে স্যারের ছেলে হয়েছে। আপনার কাছে ‘নাম’ নিতে এলাম।

সাধু চায়ের গ্লাস তুলে চুমুক দিতে দিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সোমনাথ বুঝল, ঠগবাজির অভিনয় শুরু হয়ে গেল। চোখ সরিয়ে নিল সোমনাথ।

গলা ভিজিয়ে সাধু বললেন, আমার কথা তার মানে কলকাতা অবধি ছড়িয়ে গেল! সোমনাথ, মানিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মানিকের মুখে আগাম কৃতজ্ঞতার হাসি।

মেঝের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে একটু যেন অপরাধী গলায় সাধু বললেন, গল্প যখন রটতে থাকে, জরুরি অংশগুলোই আগে বাদ পড়ে যায়। এত দূর থেকে এলেন, কোনও লাভই হবে না। কেন? আশঙ্কার গলায় জানতে চাইল মানিক।

সাধু ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো পাশের গ্রামে থাকেন, যাদের কাছে আমার কথা শুনেছেন, তারা বলেনি, জাতকের চেহারা দেখে আমি নাম দিই?

এই রে, নাঃ। এ কথা তো কেউ বলেনি আমায়। মানিকের গলায় আপশোস। সোমনাথ কিন্তু অন্য কিছুর গন্ধ পায়, বাচ্চা না দেখে নাম দিতে গিয়ে সাধু বোধহয় একটু বেশিই চার্জ হাঁকবেন। এসব তারই ভূমিকা।

চা খাওয়ার ফাঁকে সাধু বলতে থাকলেন, গ্রামের লোকেরই বা কী দোষ দিই, বলুন? তারা কাছাকাছি থাকে, বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে ‘নাম’ নিতে এসেছিল। এটাই যে প্রাইমারি কন্ডিশন, তা কী করে বুঝবে?

সাধু মানে প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক বড্ড ছড়িয়ে খেলছেন। বিষয়টা গুটিয়ে আনতে সোমনাথ বলে, এখন আর ছেলেকে আনা যাবে না। কাল থেকে আমার অফিস। বার্থ সার্টিফিকেটের জন্য করপোরেশনে নাম জমা দিতে হবে। আপনি সেফ ধরনের চার-ছ’টা ‘নাম’ বলুন। আমরা তার মধ্যে একটা চুজ করে নেব।

ভদ্রলোক হাসছেন। দাড়িগোঁফওলা মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, শুভ বা সেফ নাম বলে কিছু হয় না। প্রফুল্ল নামের বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়, আবার যাবজ্জীবন জেল খাটা আসামিও আছে। অর্থাৎ নামটি আসামিটির ক্ষেত্রে স্যুট করেনি।

সোমনাথ এবার স্পষ্টতই হতাশ। সাধুর দেওয়া নাম হয়তো রাখত না, কিন্তু এত দূর উজিয়ে এসে ফাঁকা হাতে ফিরতে হবে, ভাবতে পারেনি। সামনে ‘মুরগি’ পেয়েও সাধু কেন এত উদারতা দেখাচ্ছেন, বোঝা যাচ্ছে না। মানিক কী যেন বলতে যাচ্ছিল, আগের সেই বউটি চা নিয়ে এল অতিথিদের জন্য। গ্লাসে নয়, কাপ ডিশে। দমে যাওয়া মন নিয়ে চায়ে দেয় সোমনাথ। চা-টা খারাপ নয়। হালিশহরের বাড়িতে এরকম চায়ের চল। চা-পাতা ফোটানো। দুধ চিনি বেশি।

বাচ্চার ছবি হলে চলবে? কাল আমি আপনাকে এনে দিতে পারি, বলল মানিক। খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে বেচারি। রাস্তা খোঁজার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। আগামীকাল সোমনাথের থেকে ছবি নিয়ে রাত হলেও এখানে আসত।

সাধু বললেন, হরিদ্বারের ছবিতে কি গঙ্গার শব্দ পাওয়া যায়? তেমনই জাতকের শরীর অজস্র লক্ষণ কখনওই ছবিতে ধরা সম্ভব নয়।

ঘরের পাশে আশ্রম বানিয়ে সাধুর এরকম চটকদার পাণ্ডিত্য দেখানোয় যথেষ্ট রাগ হয়ে যায় সোমনাথের। কতটা সময় ব্যয় করে, কত দূর থেকে এসেছে সে! বিনয়ের মোড়কে সাধুকে খানিকটা চার্জ করে বসে সোমনাথ, জাতকের দিকে তাকিয়ে আপনি প্রধানত কী কী ব্যাপার পর্যবেক্ষণ করেন?

সেসব বললে কি আপনি বুঝবেন? এ আমার গবেষণার বিষয়। এখনও করে চলেছি। বলে, টুলের ওপর রাখা খাতাটা দেখালেন ভদ্রলোক। খানিক আগে ওটাতেই তিনি কী সব যেন লিখছিলেন।

সোমনাথ হাল ছাড়ে না। বলে, আপনি মোটামুটি একটা ধারণা দিন। দেখি না কতটা বুঝতে পারি।

জোরাজুরিতে বিরক্ত হলেন না গোপাল ভট্টাচার্য। সোজা হয়ে বসলেন। জানতে চাইলেন, আপনি ব্রহ্ম বিশ্বাস করেন?

আমার বিশ্বাসে কিছু আসে যায় না। আপনি বলে যান। ব্রহ্ম সম্বন্ধে প্রচারিত ধারণাটুকু আমার আছে।

তা হলে শুনুন, এই মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্রহ্ম। জলে, বায়ুতে, প্রাণে সর্বক্ষেত্রে ব্রহ্মের প্রকাশ। তেমনই লিপিতেও। ধরুন গিয়ে ‘অ’ বর্ণটি, একটি বিন্দু দিয়ে শুরু। মানে বিন্দু আকারে ব্রহ্ম বর্ণমালায় প্রথমে প্রকাশিত হলেন। তারপর রেখা আকারে শুরু হল তাঁর পরিক্রমা। ‘অ’-এর অর্ধচন্দ্রাকারটি বিন্দুর ওপরে উঠল না। কেন? এর কোনও একটা মানে আছে নিশ্চয়ই। এইসব অনুসন্ধান করতে করতে আমি বাংলার প্রতিটি লিপির অর্থ আবিষ্কার করেছি। ‘ক’ অক্ষরটি ‘ব’-এর মতন হয়েও কেন একটি নাসিকার প্রয়োজন হয়ে পড়ল, আমি বুঝি৷ ‘ব’ এবং ‘ক’-এর আকৃতিগত তফাতের সঙ্গে আচরণগত ভেদাভেদ আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারি। বর্ণমালার প্রতিটি লিপির চরিত্র ভিন্ন। জাতকের শরীরের লক্ষণ, পারিবারিক পরিবেশ, নামের পাশে পদবির অক্ষরগুলি রাখার বাধ্যতা, সমস্ত কিছু বিচার করে, সুপ্রযুক্ত লিপি বেছে নিয়ে আমি নামকরণ করি।

শুনতে বেশ লজিকাল লাগছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে আছে একটা ভ্রান্ত ধারণার ওপর। সেটা ভাঙতে সোমনাথ বলে, লিপির সৃষ্টি কিন্তু হয়েছিল চিত্ররূপ থেকে। ক্রমশ তা সাংকেতিক রূপ পেতে পেতে আজ এই অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।

আমি তা জানি। স্কুলে বাংলা পড়াতাম, জানতে আমাকে হয়েছে। লিপির এই বিবর্তনও জানবেন ব্রহ্মের সুনির্দিষ্ট প্রকাশভঙ্গি। গূঢ় এক অর্থ আছে এর। দেখুন, ব্রহ্ম নিয়ন্ত্রণ করছেন পৃথিবীর প্রকৃতিকে। প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে রূপ পাচ্ছে সভ্যতা। তার বিকাশের মাধ্যম ভাবের আদানপ্রদান। এল ভাষা, ধীরে ধীরে তার সাংকেতিক রূপ, লিপি। এই লিপিই যখন পর পর আপনি বসিয়ে দেবেন, তখনও একটা চিত্রসংকেত অনুভব করবেন। মানে ব্রহ্ম সেখানেও বিরাজ করছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে।

একটা উদাহরণ পেলে সুবিধে হয়। আন্তরিকভাবে জানতে চায় সোমনাথ। কেননা, ইতিমধ্যে সে ব্রহ্ম ইজুক্যালটু ‘এক্স’ ধরে নিয়ে গোপাল ভট্টাচার্যকে অনুসরণ করে যাচ্ছে। মানিক কিন্তু আক্ষরিক অর্থে ‘হাঁ’ হয়ে শুনে যাচ্ছে সন্ন্যাসীর কথা।

গোপালবাবু বলেন, যেমন ‘বাংলা’ শব্দটিকে লক্ষ করুন, ‘ব’ হচ্ছে ব্রহ্মের ধ্বনিরূপ আ-কার দিয়ে ব্রহ্মের প্রকৃত তেজকে আড়াল করা হল। তারপর কী দেখছেন? একটা আধশোয়া রেখা, বুকের ওপর বিন্দু। যেন একটি মানুষ আয়েশে ব্রহ্মবিদ্যা অনুশীলন করছে। এই হচ্ছে সরল জীবনযাপন। এবার এল ‘ল’, লিপিটির মধ্যে জলের ঢেউয়ের

আভাস পাবেন। শেষে আ-কার সম্পূর্ণ করল দেশ বা জাতির সীমানা।— একটু থেমে গোপালবাবু সমর্থন চাইলেন, কী, আমাদের গোটা জাতির ছবিটাই ফুটে উঠল কিনা ওই – অক্ষর সমাবেশে?

এই মায়া-বিভ্রমের কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না সোমনাথ। জানলা দিয়ে আসা আলো প্রায় নিভু নিভু। বাইরের গাছে পাখির কিচিরমিচির শুনে বোঝা যাচ্ছে, সন্ধে আসন্ন। গোপালবাবু বলে ওঠেন, নামকরণের কোনও ইচ্ছা থেকে আমি ‘লিপিচর্চা’ করিনি। আমার দেওয়া নামে লোকের সংসারে কী করে শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে, সে ব্যাপারেও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই আমার। তাই এর কৃতিত্ব নিতে চাই না। আবার কেউ নামকরণ করাতে এলে ‘না’ বলতে পারি না আমি। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, জাতকের ‘নাম’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারা জীবন ধরে লোকে তাকে ওই নাম ধরে ডাকবে, সেই ধ্বনির প্রভাব তার ব্যক্তিত্বে পড়তে বাধ্য। সব ধ্বনি সবার জন্য মঙ্গলময় হয় না।

কার ক্ষেত্রে কোনটা শুভ বিচার করার প্রাথমিক পর্যায়টা কী, যদি একটু বলেন। ছাত্রসুলভ বিনয়ে জানতে চায় সোমনাথ।

প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক বলতে থাকেন, প্রথমত, শিশুটির শয়নভঙ্গি আমি লক্ষ করি। কখনও আবছা, কখনও বা স্পষ্ট কোনও লিপির আভাস পাই। শিশুটির হাত-পা নাড়া, মুখভঙ্গি থেকেও লিপির প্রতিরূপ বেরিয়ে আসে। সেই লিপি দিয়েই নামের আদ্যক্ষর হওয়া উচিত। পরের অক্ষরগুলির জন্য আরও অনেক বিচার আছে।

একটানা আসনপিঁড়ি হয় বসার অভ্যাস সোমনাথের নেই, পা ধরে যাচ্ছে। বসার ভঙ্গি পালটে নেয়। ঘরটা বড়ই অন্ধকার হয়ে আসছে। গোপালবাবুর কথাগুলো খামোকাই ভারী ঠেকছে ওজনে। বিষয়টাকে সাধারণ মানের করে নিয়ে আসার জন্য সোমনাথ জিজ্ঞেস করে, ‘লিপি’ নিয়ে এই বিশেষ ভাবনাচিন্তাগুলো আপনি কবে থেকে শুরু করেন?

আমার মেজছেলে মারা যাওয়ার পর। উত্তরটায় ঝাঁকুনি খেল সোমনাথ। পরের ধাক্কাটা

এল আরও বড় হয়ে। গোপালবাবু বললেন, আত্মহত্যা করেছিল। বিয়ের আগের দিন। ভিটে লাগোয়া গাছের পাখিরাও এখন চুপ। গোপালবাবু বলতে থাকেন, ওর নাম ছিল বিজয়। আমরা বিজু বলে ডাকতাম। নামটা ওকে দেওয়া ঠিক হয়নি। ওর ক্ষেত্রে অকল্যাণকর ওই ডাক শুনেছে সর্বক্ষণ।

অত্যন্ত বিষাদময় অবস্থার মধ্যে দিয়ে হলেও সোমনাথ এতক্ষণে গোপাল ভট্টাচার্যকে যেন বুঝতে পারছে। লিপির প্রতি ওঁর এই যে অলীক আধ্যাত্মিকতা চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস, তা আসলে এক সন্তপ্ত পিতার সান্ত্বনা। সমবেদনাপূর্ণ গলায় সোমনাথ জানতে চায়, আপনার ছেলের এরকম চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও প্র্যাক্টিকাল কজ কিছু আছে কি?

বাস্তব কারণটা বলা ভারী মুশকিল। যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল বিজয়, তাতে সুইসাইড করার কোনও মানেই হয় না। এখানেই সবচেয়ে বেশি ধন্দ লেগেছিল আমার। সুস্থ, স্বাভাবিক ছেলে। সহজেই মানুষের মন কেড়ে নিতে পারত। দাদা, বোনের নয়নের মণি ছিল সে। বউদির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ভাল। ছোটমেয়ে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে, বিজুর পাত্তা নেই। পাওয়া গেল দু’মাইল দূরে, গাছতলায় একা বসে বসে কাঁদছে। এসএসসি

দিয়ে চাকরি পেল নবদ্বীপের স্কুলে। ওর বিয়ের জন্য বেশ ক’টা পাত্রী দেখা হল। বিজুর পছন্দেই আমরা বর্ধমানের এক মেয়ের সঙ্গে কথা পাকা করলাম। তাদের বাড়ির অবস্থা ভাল। মেয়ে দেখতেও খুব সুন্দর। আমাদের কোনও দাবিদাওয়া নেই। বিয়ের দিন স্থির হল তিন মাস বাদে। আমি ধীরেসুস্থে বিয়ের জোগাড়যন্ত্র করছি। ছেলেকে দেখছি মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলে। চাকরি পাওয়ার পর বিজুই এ-বাড়ির ফোনের লাইন নেয়। একদিন বিজুকে বললাম, হ্যাঁরে, মেয়েটার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলিস, ওর বাড়ির লোক তো কিছু মনে করতে পারে। উত্তরে বলল, ওকে আমি একটা মোবাইল সেট কিনে দিয়েছি। ভাবলাম, ভাল কথা, মেয়েটা বাড়ির লোকের চোখের আড়ালে গিয়ে কথা বলতে পারছে। কিন্তু দিন দিন ছেলেকে আমার কেমন উন্মনা, অস্থির ঠেকছিল। হঠাৎ একদিন আমাকে বলে বসল, এই বিয়েটা করা আমার বোধহয় ঠিক হচ্ছে না বাবা। জানতে চাইলাম, কেন, কী হয়েছে? বলল, মেয়েটা নাকি ওকে বারবার খোঁটা দেয়, তোমার চেয়ে ঢের ভাল পাত্র আমি পেতে পারতাম। নেহাত বাড়ির লোক ঠিক করেছে বলে, তোমার মতো আনস্মার্ট, গন্ডগ্রামে থাকা ছেলেকে বিয়ে করতে হচ্ছে।

একটানা কথা বলে হাঁফিয়ে গেছেন গোপালবাবু। দম নিতে থামলেন। মানিক, সোমনাথ দু’জনেই এখন নিবিষ্ট শ্রোতা। মূল বাড়ির ইলেকট্রিকের আলো এদিক-ওদিক ধাক্কা খেয়ে আশ্রমঘরেও এসেছে সামান্য। ফের শুরু করলেন গোপাল ভট্টাচার্য, ছেলেবউ থাকবে বলে বাড়ি লাগোয়া নতুন ঘর তুলে ফেলেছিলাম। তবু বিজুকে বললাম, দেখ বাবা, তুই যদি ভাল বুঝিস, শহরে গিয়ে ফ্ল্যাট কিনে থাক, আমার কোনও আপত্তি নেই। সে বলল, আমি তোমাদের ছাড়া থাকতেই পারব না। তখন বললাম, এখনও বিয়ের এক মাস বাকি। তুই যদি বলিস, বিয়ে ক্যানসেল করে দিতে পারি আমি। মতামত দিতে ছেলে সময় চাইল। এক সপ্তাহ বাদে এসে জানাল, তুমি না করে দাও। আমি ফোনে পাত্রীর বাড়িতে সব বললাম, তাদের মেয়ে আমার ছেলেকে দয়া করে বিয়ে করুক, আমি চাই না। শুনে পাত্রীর বাবা ‘হায় হায়’ করে উঠল। কথা বলতে চাইল ছেলের সঙ্গে। ফোন দিলাম বিজুকে। ঘণ্টাখানেক ওদের সঙ্গে কথা বলার পর আমাকে জানাল, আর কোনও সমস্যা নেই। ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে। মনে আমার একটু খোঁচ রয়েই গেল। বিয়ের তখন ঠিক একদিন বাকি। বাড়ির সামনে বাঁশ বাঁধা হয়ে গেছে। মাছওলা অ্যাডভান্স নিয়ে গেল। প্যান্ডেলওলাদের কী সব ডিরেকশন দিল বিজু। তারপর বারান্দায় আমার পাশে এসে বসল। আমি তখন জলখাবার খাচ্ছিলাম। বড়বউমা ওকেও রুটি-তরকারি দিতে গেল, নিল না। বলল, পেট ভার। মুড়ি আর চা দাও। পুরোটা খেল না। চা খেয়ে বলল, আর একটু গড়িয়ে নিই, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। সেই যে ঘরে ঢুকল, ওখানেই হ্যাং।

ফাঁসটা যেন সোমনাথের গলাতেই চেপে বসল। অস্বস্তি এড়াতে ঢোঁক গেলে। একই সঙ্গে মনে করে সেই অভাগিনীকে, বিয়ের আগের রাতে যার হবু স্বামী গলায় দড়ি দিয়েছিল। তার কী অবস্থা হয়েছিল জানতে সোমনাথ জিজ্ঞেস করে, পাত্রীর বাড়িতে জানালেন, দুঃসংবাদ?

জানিয়েছিলাম। মেয়ের বাবা, দুই দাদা এসে দেখে গেল। বর্ধমানে গিয়ে রটাল, আমার

ছেলের সঙ্গে নাকি এক বাগদি মেয়ের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটা ব্ল্যাকমেল করছিল বলেই বিজু আত্মহত্যা করেছে। সেসব কুৎসার বিরুদ্ধে আমি কিছু বলিনি। আমার মনে তখন একটাই প্রশ্ন, কী এমন হল যে, আত্মহত্যা করল বিজয়? এই সামান্য সমস্যা থেকে বেরোতে পারল না! অন্য যে-কেউ হলে পারত। বাবা-মা, বাড়ির লোককে ছেড়ে চলে যেত শহরে। অথবা বউকেই টেনে নিয়ে আসত গ্রামে। তা হলে গলদটা কোথায়? বিজুর আঠাশ বছরের অতীত ঘাঁটতে বসলাম আমি। পৌঁছে গেলাম ওর নামকরণ অবধি। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলাম, ওর দেহগঠনের এবং চরিত্রের সঙ্গে নামটা একেবারেই খাপ খায়নি। ‘ব’-এ হ্রস্বই মানে ব্রহ্মতেজকে ছাতার মতো ঢেকে রাখা। ‘জ’-এর ভঙ্গিতে প্রচুর জটিলতা। ‘জটিল’ শব্দটাই ‘জ’ দিয়ে শুরু। এসব সহ্য হয়নি আমার মেজছেলের। আমরা তাকে আয়েশে আদরে বড় করেছিলাম। বড় সহজ সরল মানুষ ছিল সে।

ঘরটা হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠতে ঘাড় ফেরায় সোমনাথ। সেই বউটি কুপি হাতে ঢুকেছে। ওই আলোতে দেখা গেল, গোপালবাবুর চোখের কোল বেয়ে জলের রেখা। শ্বশুরমশাইয়ের উদ্দেশে বড়বউ বলে, বাবা, আপনার উপাসনার সময় হয়েছে। এবার এঁদের নিয়ে যাই?

হ্যাঁ মা, যাও। একটু জল-মিষ্টি খাওয়াও ওঁদের। সেই কলকাতা থেকে এসেছেন। সোমনাথ উঠে দাঁড়িয়ে সসংকোচে বলে, না না, ওসব আবার কেন? এবার আমাদের ফেরা উচিত। রাত হয়ে যাবে বাড়ি পৌঁছোতে।

গোপালবাবু বলেন, সামান্য মিষ্টিমুখ করে যান। অতিথি খালি পেটে গেলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়।

আয়োজন যথেষ্টরও বেশি। থালা ভরতি লুচি তরকারি মিষ্টি খেতে দিয়েছেন গোপালবাবুর স্ত্রী। ওরকম একটা শোকের আবহে থাকার পর খাবার গলা দিয়ে নামছে না সোমনাথের। মানিকেরও একই অবস্থা। গৃহকর্ত্রী এবং বড়বউ সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কষ্ট করে হলেও, খেতে হল পুরোটা। হাতমুখ ধুয়ে সোমনাথ পার্স থেকে কয়েকটা একশো টাকার নোট বার করে। অনেকক্ষণ ধরে অস্বস্তি হচ্ছিল তার, গোপালবাবুর আশ্রমের জন্য কিছু দেওয়া উচিত৷ সেই কথা বলে, গৃহকর্ত্রীকে টাকা দিতে যায় সোমনাথ। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে গোপালবাবুর স্ত্রী বলেন, মাথা খারাপ! আশ্রমের জন্য উনি কারও কাছে এক পয়সাও নেননি। টাকাপয়সার প্রতি মোহমুক্ত হয়েছেন। আমাদের সবাইকে টাকা, জমি ভাগ করে দিয়েছেন। এই তো সেদিন মেয়ে-জামাইয়ের হাতে দিয়ে এলেন পোস্ট অফিসে ম্যাচিয়োর করা দু’লাখ টাকা। ওঁর নিজের সম্পত্তি বলতে এখন আর কিছুই নেই। গ্রাম ছেড়ে হয়তো চলেই যেতেন, কাতর অনুরোধ করে আমরা আটকে রেখেছি।

সোমনাথ বলে, ওঁকে এবার আস্তে আস্তে সংসারে ফেরানোর চেষ্টা করুন। নয়তো শোক ভুলতেই পারবেন না।

বড়বউ বলে, বহু চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। ভীষণ ভালবাসতেন মেজদেওরকে। বিয়ের আগে বিজু একটা কলিংবেল কিনে এনেছিল কলকাতা থেকে। সেটা টিপলেই কথা বের

হত, দয়া করে দরজা খুলুন। বিজু মারা যাওয়ার পর কানেকশন খুলে দেওয়া হয়। তবু বাবা দিনে রাতে মাঝে মাঝে শুনতে পেতেন ওই আওয়াজ। একসময় বললেন, বিজু আমাকে মনের অন্য দরজা খুলতে বলছে। তারপর সেই যে বাড়ি থেকে বেরোলেন, আর ঢুকলেন না। তবু ভাল আশ্রম নিয়ে মেতে আছেন। সকাল-সন্ধে গ্রামের কিছু লোক আসে, গীতা, পুরাণ পড়ে শোনান। নিজের লেখাপড়া নিয়ে থাকেন।

মানিক তাড়া দেয়, স্যার, আর বেশি দেরি করলে কলকাতা ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।

রাত এগারোটা বেজে গেল কসবায় নিজের ফ্ল্যাটে ফিরতে। ক্লান্ত সোমনাথ জুতো ছেড়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। বাথরুম ঘুরে আসার পরিশ্রমটুকু নিতে ইচ্ছে করছে না।

শ্রেয়া গ্লাসে জল এনে রেখেছে সেন্টার টেবিলে। সোমনাথ জলটা খেলেই প্রশ্ন শুরু করবে।

গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়ে সোমনাথ বলে, আসার পথে বাবাকে ফোন করলাম। কী বললেন?

লম্বা চুমুকে জলটা খেয়ে সোমনাথ বলে, ঝিমলির পরীক্ষা চলছে, পুলকার আসছে না। ওকে স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করছেন বাবা। বললেন, সামনের রোববার এখানে আসবেন।

নামের ব্যাপারে কিছু কথা হল?

জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, তোমরাই দিয়ে দাও, একটু মডার্ন দেখে। নবুর ছেলেটা প্রায়ই রাগারাগি করে, ওর ক্লাসমেটদের কত সুন্দর সুন্দর নাম। আমরা ওর নাম রেখেছি, প্রিয়নাথ। সত্যিই এখন এসব নাম চলে না।

ঝিমলি, নবুর ছেলে, এরা সব সোমনাথের জ্যাঠার নাতি-নাতনি। বাবা এদের নিয়ে এমনভাবে মজে আছেন, নাতির মুখ দেখার ব্যাপারটা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে অসুবিধে হচ্ছে না। বাবার ফোনের পর একটু অভিমান হয়েছিল সোমনাথের। এই অনুভূতিটা শ্রেয়াকে চট করে স্পর্শ করবে না। নিজের বাবা যেহেতু নয়। শ্রেয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, যাক, বাবার ব্যাপারটা না হয় মিটল। তোমার সাধু কী নাম দিলেন?

খানিকটা অন্যমনস্ক স্বরে সোমনাথ বলে, সাধু বলতে যা ভেবেছিলাম, সেরকম উনি নন। সন্তান হারিয়েছেন অকালে। শোক ভুলতে ব্রহ্মচর্য পালন করছেন।

নাম কিছু দিলেন কি? আসল কথায় আসতে চায় শ্রেয়া।

শ্বাস ছেড়ে সোমনাথ বলে, দিলেন। ওঁর সেই মৃত সন্তানের নাম। বিজয়। আঁতকে উঠল শ্রেয়া। বলল, দরকার নেই বাবা।

এরপর দু’জনেই চুপ। খানিক বাদে শ্রেয়া বলে, তা হলে কী হবে! কালকের মধ্যে ঠিক করতে হবে কিছু একটা।

হঠাৎ মনে পড়েছে, এইভাবে সোমনাথ বলে ওঠে, দাঁড়াও সন্ন্যাসী একটা সূত্র বলেছেন, সন্তানের শোওয়ার ধরন দেখে নামের প্রথম বর্ণ নির্দিষ্ট করা উচিত।

সোফা ছেড়ে উঠে পড়েছে সোমনাথ। বেডরুমের দিকে এগোচ্ছে, শ্রেয়া বলে, সে আবার কী।

সোমনাথ বলে, এসোই না দেখি।

দু’জনে এসে দাঁড়িয়েছে বিছানার কাছে। ছেলে এখন অঘোর ঘুমে। সোমনাথ চাপা গলায় বলে, দেখো, অনেকটা হ্রস্বই-এর মতো লাগছে না?

শ্রেয়া ফিসফিস করে বলে, হ্রস্বই-এর মাথায় শিখা কই? ওটা তো মাত্রা। আমার কিন্তু ‘হ’-এর মতো লাগছে। হাতটা মাঝে মাঝে এদিকে করে, তখন ‘থ’ হয়ে যায়।

রাত বাড়ছে। গাড়িঘোড়ার আওয়াজ আর উঠে আসছে না। শহরের একটু উঁচুতে, নির্জন, আরামদায়ক ফ্ল্যাটে, স্বামী-স্ত্রী আকুল হয়ে সন্তানের শয়নভঙ্গির মধ্যে খুঁজে চলেছে নিজেদের মাতৃলিপি।

শারদীয় দেশ ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *