মাতৃবৎসলতা
রোম নগরের কোনও সৎকুলপ্রসূতা নারী উৎকট অপরাধ করাতে, বিচারকর্ত্তারা, প্রাণদণ্ডের আদেশ বিধান করিয়া, তাহাকে কারাগারে অবরুদ্ধ করেন, এবং কারাধ্যক্ষকে আদেশ দেন, অমুক দিন, অমুক সময়ে, অমুক স্থানে, এই স্ত্রীলোকের প্রাণদণ্ড করিবে। সহসা তাঁহাদের আদেশ অনুযায়ী কর্ম্ম সমাধা না করিয়া, কারাধ্যক্ষ বিবেচনা করিলেন, সর্ব্বসাধারণ সমক্ষে বধস্থানে লইয়া গিয়া, এরূপ সদ্বংশসম্ভূতা নারীর প্রণদণ্ড করিলে, ইহার আত্মীয়বর্গের মস্তক অবনত হইবে, তদপেক্ষা উত্তম কল্প এই, আহার বন্ধ করিয়া রাখি, তাহা হইলে অল্প দিনের মধ্যে অনাহারে ইহার প্রাণাত্যয় ঘটিবে। মনে মনে এই সিদ্ধান্ত করিয়া, তিনি ঐ স্ত্রীলোককে অনাহারে রাখিয়া দিলেন।
অবরোধের পর দিন, তাহার কন্যা আসিয়া, কারাধ্যক্ষের নিকট, জননীকে দেখিতে যাইবার অনুমতি প্রার্থনা করিল। তিনি সবিশেষ পরীক্ষা দ্বারা, তাহার সঙ্গে কোনও প্রকার আহার সামগ্রী নাই দেখিয়া, তাহাকে কারাগৃহে প্রবেশ করিতে অনুমতি দিলেন। কন্যা, তদবধি প্রতিদিন, মাতৃসমীপে যাতায়াত করিতে লাগিল। এই রূপে কতিপয় দিবস অতীত হইলে, কারাধ্যক্ষ বিবেচনা করিতে লাগিলেন, কই কন্যা অদ্যাপি ইহার জননীকে দেখিতে আইসে, ইহার তাৎপর্য কি, সে অনাহারে কখনই এত দিন বাঁচিতে পারে না, কিন্তু তাহার মৃত্যু হইলেই বা, এ প্রত্যহ তাহাকে দেখিতে আসিবে কেন। যাহা হউক, ইহার তথ্যানুসন্ধান করিতে হইল। এই বলিয়া, তিনি, সে কোনও প্রকার আহার পায় কি না, ইহার পুঙ্খানুপুঙ্খ সন্ধান করিলেন – কিন্তু তাহার আহার প্রাপ্তির কোনও সম্ভাবনা দেখিতে পাইলেন না। তখন, এই কন্যা, বোধ হয়, স্বীয় জননীর নিমিত্ত, কোনও প্রকার আহার লইয়া যায়, এইরূপ সন্দিহান হইয়া, তিনি স্থির করিয়া রাখিলেন, অদ্য যে সময়ে সে আপন জননীর নিকটে যাইবে, প্রচ্ছন্ন ভাবে অবস্থিত হইয়া, সমুদয় প্রত্যক্ষ ও পরীক্ষা করিব।
নির্দ্ধারিত সময় উপস্থিত হইল। কন্যা যথানিয়মে কারাধ্যক্ষের অনুমতি লইয়া, জননী-সন্নিধানে গমন করিল। কিঞ্চিৎ পরে, কারাধ্যক্ষ প্রচ্ছন্ন ভাবে অবস্থিত হইয়া, অবলোকন করিলেন, কন্যা জননীকে স্তন্য পান করাইতেছে। তিনি তদীয় মাতৃস্নেহের এইরূপ ঐকান্তিকতা দর্শনে, অতিশয় চমৎকৃত হইয়া, মনে মনে তাহাকে শত শত সাধুবাদ প্রদান করিলেন এবং কারাবরুদ্ধা কামিনী, কিরূপে, অনাহারে, এত দিন, প্রাণ ধারণ করিয়া আছে, তাহা বিলক্ষণ বুঝিতে পারিলেন। অনন্তর তিনি এই অদৃষ্টচর অশ্রুতপূর্ব্ব ঘটনার সমস্ত বিবরণ বিচারকর্ত্তাদিগের গোচর করিলে, তাঁহারা কন্যার মাতৃভক্তি ও বুদ্ধি কৌশলের যথেষ্ট প্রশংসা করিলেন, এবং নিরতিশয় প্রীত ও যৎপরোনাস্তি চমৎকৃত হইয়া, কারারুদ্ধা কামিনীর অপরাধ মার্জ্জনা করিলেন। ঐ কামিনী কেবল কারামুক্তা হইলেন, এরূপ নহে, যাবজ্জীবন তাহাদের দৈনন্দিন ব্যয় নির্ব্বাহের জন্য, সাধারণ ধনাগার হইতে মাসিক বৃত্তি নির্দ্ধারিত হইল। বিচারকর্ত্তারা এই পর্য্যন্ত করিয়াই ক্ষান্ত রহিলেন না, যে স্থলে এই অলৌকিক ঘটনা হইয়াছিল, তদুপরি, সর্ব্বসাধারণের প্রতি মাতৃভক্তির উপদেশ স্বরূপ, এক অপূর্ব্ব মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়া দিলেন।