মাতৃকা
সমরেশ মজুমদার
সকালবেলায় আমার বাবা আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। তাড়াতাড়ি মানে সাড়ে ছটা সাতটা। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোন জরুরী কাজ ছাড়া বাবাকে কোনদিন সাড়ে নটার আগে ফিরতে দেখিনি। অফিস থেকে বেরিয়ে এই সময়টুকু বাবা কি করে স্পষ্ট করে বলতে পারব না। তবে কখনও অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেনি। আমরা যে পাড়ায় থাকি সেখানে রাত করে যারা বাড়ি ফেরে তাদের। অনেকেই টালমাটাল হয়ে হাঁটো বাবা এইসময় নেশা করে একথা কোন বড় শত্রুও বলতে পারবে না, মাও না।
বাবা যে তাড়াতাড়ি ফিরছে তার কারণ আমার মা খুব অসুস্থ। অসুখটা কাল অবধি এমন ছিল যে দিনরাত তার কাছে বসে থাকতে হবে তা নয়। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে এলে বাবাকে কেমন অসহায় দেখাতা কি করে সময়টা কাটাবে যেন বুঝতে পারত না। আজ ঘুম থেকে ওঠার পর মায়ের এমন বাড়াবাড়ি হল যে বাবা খুব ছোটাছুটি করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাকে নিষেধ করা হল। এখন আমার তিন বছরের ভাইটাকে নিয়ে আমি বাড়িতে আছি। স্কুলে তো যাওয়া হল না আমাকে যে কোলে পিঠে করেছে সেই কমলামাসী ভাইকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
আজ আমার বয়স ষোল হল। ষোল মানে সুইট সিক্সটিন। আচ্ছা, ইংরেজিতে ষোলর আগে সুইট কথাটা বলে কেন? একমাস আগের আমার সঙ্গে এখনকার আমার তো কোন তফাৎ নেই। আমার শরীরের বাড় নাকি খুব বেশী সবাই বলে আমি বাবার ধাত পেয়েছি। মা আমার কাঁধের কাছে পড়ে মারামারি করলে মা নিশ্চয়ই হেরে যাবে কিন্তু পৃথিবীতে আমি মাকেই সব চেয়ে বেশী ভয় পাই। একটু আগে দুপুরের খাওয়ার সময় কমলামাসী আমাকে পায়েস খেতে দিয়েছিল আজ সকাল থেকে বাড়িতে যেসব ব্যাপার চলছে তাতে আমার জন্মদিনটার কথা কারো খেয়াল থাকতে পারে না। কিন্তু কমলামাসী বলল মা নাকি গতকালই তাকে পায়েস করার কথা বলে দিয়েছিল। অন্যান্যবার এই দিনটা এলে আমার খুব কষ্ট হত আমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ি। আমাদের ক্লাসের মেয়েরা জন্মদিনে পার্টি দেয়া ক্লাসে কেক গিফট নিয়ে যায়। মা সেটা একদম পছন্দ করে না। শুধু বাড়িতে লুচি আর পায়েস খেয়ে জন্মদিন করতে হয় বিচ্ছিরি! কিন্তু আজ খেতে বসে ওগুলো দেখে আমার খুব কান্না পেয়ে গেল। সকাল থেকে যে কষ্টটা বুকের মধ্যে হচ্ছিল এখন যেন সেটা আরো বেড়ে গেল।
মায়ের জন্য বুকটা কেমন করতে লাগল। আজ বিকেলে আমি বাবার সঙ্গে মাকে দেখতে যাব।
আমার বাবাকে দেখতে বেশ সুন্দর। লম্বা, খুব ফরসা নয় কিন্তু হাসলে চমৎকার দেখায়। মা খুব ফরসা কিন্তু বেঁটো বাবা রাগ করলে সেটা কয়েক মিনিট থাকে। মা কিন্তু সহজে নরম হয় না। কিন্তু মা খুব ভদ্র, মানে রুচি আভিজাত্য এইসব মায়ের খুব আছে। আজ অবধি কখনো মায়ের আচরণে কোন বেনিয়ম দেখিনি বেনিয়ম মানে, যেখানকার জিনিস সেখানেই রাখতে হবে, ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে, চেঁচিয়ে কথা বলা চলবে না। এইসব নিয়ম কিন্তু শুধু আমার আর মায়ের জন্য বাবার ওপর এর প্রয়োগ নেই, মা তাকে কিছু বলে না। আমি জিজ্ঞাসা করি না কিছু কারণ আমি জানি আমার বাবা ও মায়ের অনেক কথা আমি জানি আর সেটা ওরা জানে না আমার যে একটা গোপন ব্যাপার আছে তা অবশ্যই বাবা জানে না, মাকে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় আমার মানে ঠিক বুঝতে পারি না
আমার মা আর বাবার মধ্যে সম্পর্কটা ভাল নয়। দিনের বেলায় এটা ঠিক বোঝা যায় না। বাবা ঘুম থেকে উঠে সোফায় বসে চায়ের কাপ নিয়ে কাগজ পড়ে। সে সময় আমি স্কুলে যাওয়ার জন্যে তৈরী হই। এতদিন হয়ে গেল তবু ভোর ভোর কিছুতেই ঘুম ভাঙতে চায় না। আমাদের স্কুল বসে ঠিক আটটায়। শ্যামবাজার থেকে ওয়েলিংটনে সরাসরি ট্রামে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু সেই কবে ক্লাস টু থেকে আমি মিসেস মুখার্জীর গাড়িতে যাওয়া আসা করছি তার আর ব্যতিক্রম নেই। মা মিসেস মুখার্জীকে সত্তর টাকা মাসে দেবে কিন্তু আমাকে বাসে ট্রামে যেতে অ্যালাউ করবে না। এখন আমি কচি খুকী নই যে রাস্তা হারিয়ে ফেলব বাবা একবার বলেছিল, ‘এবার মুখার্জীর কোল থেকে ওকে নামিয়ে দাও। নিজে যাওয়া আসা করে পথঘাট চিনুক। নইলে। চিরকাল বোকা হয়ে থাকবে।’ মা উত্তর দেয়নি কিছু কিন্তু মিসেস মুখার্জীর আসা বন্ধ হয়নি। ঠিক সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতেই দুবার হর্ন বাজাবো তখনও যদি আমার জুতোর ফিতে বাঁধা না। হয় ব্যাগ কাঁধে দৌড়ে নামতে হবে দোতলা থেকে সাতটা থেকেই মা টিকটিক করে আমার পেছনে এতক্ষণ বাথরুমে কি করছ, জামা পরতে এত দেরী কেন? কাল রাত্রে বইপত্র গুছিয়ে রাখতে পারোনি?ইস, জুতোটার কি অবস্থা করেছ, ব্রাশ করতে পারনি এত বড় ধেড়ে মেয়ে! সেই সময়টায় হর্ন বেজে উঠতেই আমি ছুটতে থাকি। কয়েক পা নেমেই মনে পড়ে যায়, মায়ের হাতে ব্যাগটা দিয়ে আমি দৌড়ে আবার ঘরে ফিরে যাই। খবরের কাগজের আড়াল থেকে বাবার চোখ। তখন দরজার দিকে আমার পায়ের শব্দ পাওয়ামাত্রই বাবা অন্যমনস্ক হবার ভান করে। আমি এক হাতে কাগজটাকে সরিয়ে দিয়ে চট করে গালে হাম খেয়ে ফের ছুটে যাই। মা তখন নীচে বিরক্তিতে মাথা নাড়ছে। মুখে কিছু না বলে মিসেস মুখার্জীর সঙ্গে দেখনহাসি হেসে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়িটা চলে যাওয়া পর্যন্ত।
আজকাল বাবাকে হাম খেতে আমার কেমন যেন লাগে। যেদিন থেকে স্কুলে যাচ্ছি সেদিন থেকে বাবাকে হাম খেয়ে যাওয়া একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছে। ছোট যখন ছিলাম তখন এক রকম ছিল কিন্তু বড় হয়ে গেছি আমি এ কথাটা বাবা একদম খেয়াল করে না। যেদিন একটু সময় থাকে হাতে অথবা বাবার মেজাজ ভাল থাকে সেদিন আমার কোমর জড়িয়ে ধরে বাবা বলে, ‘এই যে আমার পিসি মা, আমাকে আজকাল আদরই করতে চায় না।’ আগে বাবা আমার ঠোঁটে হাম খেত। সেটা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার, থুতু লেগে যায়। এখন শুধু গালে ঠোঁট ছাঁয়াই একদিন আড়াল থেকে মাকে এ ব্যাপারে কথা বলতে শুনেছি। মা বলছিল, ‘মেয়েটা বড় হচ্ছে খেয়াল রেখো’ বাবা অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, ‘সেটা তো তোমার ডিপার্টমেন্টা’ তারপর যেন মনে পড়ে গিয়েছে এমনভাবে বলল, ‘তুমি কি হাম খাওয়ার কথা বলছ? সেটা ছাড়া আমি থাকতে পারব। না। এটা একটা আমার এক্সপেরিমেন্টা মেয়েরা বড় হলে বাপমায়ের কাছ থেকে তফাতে চলে যায় মানি, কিন্তু আজন্ম যদি তুমি একটা জিনিস প্রতিদিন করে যাও তাহলে তফাতে যাওয়ার সময়টা পাবে কি করে? ও রোজ আমাকে হাম খায় যেমন ভাত টিফিন খায়।’ মা কোন জবাব দেয়নি। কিন্তু বাবা জানে না আমি হাম আর চুমু খাওয়ার তফাৎটা বুঝে গেছি। হাম, হামি, হামু— বাবা যাই বলুক না কেন আসলে সবই চুমু খাওয়া। ভদ্রতা করে লোকে নিজের মত এবং সুবিধে অনুযায়ী একটা নাম দিয়ে নেয়। একটা সিনেমা দেখে ব্যাপারটা আমি স্পষ্ট বুঝে গিয়েছি। এই সিনেমা দেখা ব্যাপারটা নিয়েও মায়ের নিয়ম-অনিয়ম আছে। সিনেমা দুই প্রকার, বড়দের। সিনেমা, ছোটদের সিনেমা। বড়দের সিনেমা আমার দেখা চলবে না যেসব সিনেমায় নায়ক নায়িকার ছবি থাকে সেগুলো বড়দের সিনেমা। মায়ের ধারণা ওগুলো দেখলে আমি বুঝতে পারব না। আসলে আমি যদি বখে যাই এই হল ভয়। আমার ক্লাসের মেয়েরা কিন্তু হরদম এসব ছবি দ্যাখো টারজান, লরেল হার্ডি—এইসব ছবি আর কটা হয়! এক বছর আগে মায়ের সঙ্গে একটা মর্নিং শো দেখতে গিয়েছিলাম লরেল হার্ডির ছবি। সেখানে একটা বাসের মধ্যে একটা লোক তার সঙ্গের মেয়েকে খুব কায়দা করে চুমু খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমি অন্ধকারেও মায়ের থমথমে মুখ বুঝতে পারছিলাম লোকটা এমন করে চুমু খাচ্ছিল যে আমার শরীর কেমন হয়ে গিয়েছিলা মনে হচ্ছিল কেউ যদি ওরকম করে আমায় চুমু খেত! বাবার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই হয় না। তারপরই তো আমি সমীরদার লভে পড়ে গেলাম।
বাবা-মায়ের মধ্যে যে ব্যাপার আছে তা যে দিনের বেলায় বোঝা যায় না, এটা কিন্তু আমার কাছে খুব আশ্চর্যের মনে হয়। আসলে মা অত্যন্ত ভদ্র এবং মার্জিত বলেই এটা সম্ভবা আমার মনে আছে অনেকদিন আগে কমলা মাসী একবার দেশে গিয়েছিল তখন ওর বদলে একটা বাচ্চা মেয়ে আমাদের বাড়িতে কাজ করত। সে একদিন কথায় কথায় খবরের কাগজ দেয় যে ছেলেটা তাকে খচ্চর বলেছিল। শুনে আমার কি অবস্থা। দৌড়ে মাকে গিয়ে বললাম, ওকে এক্ষুনি ছাড়িয়ে দাও’। মা কি হয়েছে জানতে চাইলে আমি কিছুতেই শব্দটা বলতে পারলাম না। তখন বিরক্ত হয়ে মা ধমকাতে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম এখন যে কি হাসি পায় ব্যাপারটা ভাবলে! আসলে মায়ের রুচিতে আমি মানুষ বলে অমনটা হয়েছিল বাবা একবার নিজের মনে বলেছিল, শালা দিন দিন সিগারেটের দাম বাড়ছে! কথাটা শুনে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি ও কথাটা বললে কেন? অবাক হয়ে বাবা বলেছিল, কোন কথাটা?’ আমি উচ্চারণ করতে না পেরে খাতা নিয়ে ইংরেজিতে এস এ এল এ লিখে বাবাকে দেখিয়েছিলাম। তা দেখে বাবার কি হাসি!
দিনের বেলায় তো বাবা-মায়ের মধ্যে কথাই হয় না শনিবার আমার ছুটি থাকে, সেদিন তো সব দেখি কাগজ পড়ে বাবা বাজারে যায়। সংসারের তিনটি কাজ বাবা করে থাকে। বাজারে যাওয়া, ইলেকট্রিক বিল আর টেলিফোনের টাকা দেওয়া। ব্যাস! বাজার থেকে ফিরে চা খেয়ে দাড়ি কামাতে বসে বাবা। সে যে কি ব্যাপার না দেখলে বোঝা যাবে না। প্রথমে জুলপির পাকা চুল সন্না দিয়ে তুলবে, তারপর আদর করার মত নিজের দাড়ি কামাবো ততক্ষণে ভাইকে স্নান করিয়ে নিজে তৈরী হয়ে নেয় মা। সাড়ে নটা বাজতে না বাজতেই নীচে খেতে চলে যায় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার আগে একবার যন্ত্রের মত জিজ্ঞাসা করে চাবির দরকার আছে কি না। খাওয়া হয়ে গেলে মা আর ওপরে ওঠে না। বাগবাজারের স্কুলে চলে যায়। বাবা বের হয় সাড়ে দশটা নাগাদ। হেলে দুলে ঘুমন্ত ভাইকে আদর করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি আমার ঢিপসি মা?’ আমি একটু মোটাসোটা বলে আদর করে ঢিপসি বলে ডাকা—দু চক্ষে দেখতে পারি না। আগে চাইতাম আজকাল ঘাড় নেড়ে না বলি। তখন গালে চুমু খেতে হয় বাবা বেরিয়ে যায়। মা ফেরে বিকেল হতে না হতেই। বাবার ফিরতে রাত সাড়ে নটা দশটা তখন মা আমার পড়া নিয়ে ব্যস্ত। অতএব কথা বলার সময় নেই বা ইচ্ছে নেই বলে সময় নেই।
দিনের বেলা তো হল এই রকম। রাতের বেলায় সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এই পনের দিন তো না হয় মা অসুস্থ। পনের দিন আগে স্কুল থেকে ফিরে বলল পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কদিন বাবা ডাক্তার এক্সরে নানা রকম এগজামিন করালা কিন্তু তার আগে তো মা বেশ সুস্থ ছিলা রাত্রে একটা ঘরে আমি মা আর ভাই শুই। অন্য ঘরে বাবা আমার শোওয়া নাকি খুব খারাপ, ঘুমোলে হুঁশ থাকে না। তাই দুটো পাশ-বালিশ দিয়ে পাঁচিল তুলে দেওয়া হয় আমার আর ভাই-এর মধ্যে, মা ধারো ভাই হবার আগেও বাবা পাশের ঘরে শুতো।
মাসখানেক আগের কথা। মাঝরাত্রে, ঘুম ভাঙলেই তো মাঝরাত মনে হয়, কেমন আবছায়া হতে হতে ঘুমটা ভেঙে গেলা। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চাপা গলার কথা শুনতে পেলাম, ‘লজ্জা করে না তুমি এই ঘরে এসেছ?
বাবা বললো, ‘অতসী, আমার কথাটা শোন।
‘কিছু শোনার নেই আমার সারা জীবন অনেক শুনেছি। দয়া করে একটু ঘুমুতে দাও।’ মায়ের গলায় এ রকম বিরক্তি আমি আগে কখনও শুনিনি।
‘তুমি আমার ওপর মিছিমিছি রাগ করছ।‘ বাবার গলাটা কেমন দুর্বল লাগল।
‘আমার বয়ে গেছে রাগ করতে কিন্তু তোমাকে জবাব দিতে হবে কেন তুমি এ রকম ব্যবহার করছ? সব কিছুর একটা সীমা আছে। আমি পুরুষ মানুষ ভুলে যাচ্ছ কেন?
‘বেশ তো।’ মায়ের গলাটা বিদ্রুপে ক্যানকেনে, কে তোমাকে নিষেধ করছে? যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়ে পুরুষত্ব দেখাও। শুধু আমার ছেলেমেয়েদের ওপর তার ছায়া না পড়লেই হল।’
‘তুমি আমাকে বেশ্যাবাড়ি যেতে বলছ।’
‘আমি কিছুই বলছি না তুমি এই বাড়িটাকে ওই রকম করে তুলেছ।’
‘মানে?’
‘তুমি কি ভেবেছ আমি সংসার সামলাবো, মেয়েকে পড়াবো, বাচ্চাকে দেখব, চাকরি করব আর রাত্রে তোমার শরীরের চাহিদা মেটাবো?
‘এ সব কথা ও-ঘরে গিয়ে বললে হতো না? মেয়ে জেগে যাবে!’
‘জাগুক। আর একটু বড় হলে আমি নিজেই ওকে বলব এ সব কথা।’
‘কিন্তু ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়। আর তুমি বুঝতে পারছ না কেন কোন মহিলার সঙ্গে আলাপ বা যোগাযোগ মানেই প্রেম নয়!
‘তোমার এই সব যুক্তি আমি অনেক শুনেছি, ঘেন্না ধরে গেছে আমার। এই দুটোর জন্য আমি পড়ে আছি এখানে ঠিক আছে, যাও না ওই সব মহিলার কাছে আমি কি বারণ করেছি?
‘প্লিজ অতসী! তুমি একটু নরম হও। তোমার খুব খাটুনি যাচ্ছে, আমি তো অনেকবার বলেছি তোমাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে ও-টাকা না হলেও আমাদের চলে যাবে।
‘আর তারপর সারা জীবন তোমার খেয়ালখুশী মতন চলতে হবে, না?’
‘অতসী!’
‘আঃ, আমার গায়ে হাত দেবে না। ফের যদি এমন কর তাহলে আমি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাব।’ মায়ের এবারের গলাটা বেশ চড়া।
কিছুক্ষণ কোন কথা শুনতে পেলাম না। আমি যে জেগে আছি এবং সব কথা শুনতে পাচ্ছি তা যাতে কেউ টের না পায় তাই মড়ার মত পড়েছিলাম সত্যি কথা বলতে কি, দু-একটা ব্যাপারে কেমন লাগলেও এই সব কথাবার্তায় মায়ের ওপর আমার খুব রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শুধু শুধু মা বাবাকে ধমকাচ্ছে, এ রকম খারাপ ব্যবহার করছে। কি হতো ও-ঘরে গিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বললে। দিনের বেলায় মায়ের সঙ্গে এই মুহূর্তের মায়ের কোন মিল নেই। তার কিছুক্ষণ পরে আমি চমকে উঠলাম। ভাগ্যিস ঘরটা অন্ধকার ছিল। পাশপালিশের আড়ালে নিজেকে শক্ত করে। রেখে আমি মায়ের ফোঁপানি শুনছিলাম। মা একা একা কাঁদছে। এই প্রথম মাকে কাঁদতে দেখলাম তখনই সব গোলমাল হয়ে গেল আমার প্রেম কথাটা আমি এতদিনে জেনে গেছি। বাবা কি অন্য কোন মহিলার সঙ্গে প্রেম করছে? মায়ের ওপর যে রাগটা হচ্ছিল সেটা চট করে চলে গেল। আমার মা দেখতে খারাপ নয়, তাহলে বাবা কেন অন্য মহিলার সঙ্গে প্রেম করবে? আগেকার দিনে রাজারা দু-তিনটে বিয়ে করত, বাবাও কি সে রকম করবে? ছি, তাহলে আমি সেই মহিলাকে মা বলতে পারব না! মায়ের কান্না শুনতে শুনতে আমারও কান্না পেয়ে গেল। আমি চুপচাপ কাঁদতে লাগলাম আমার মনে পড়ল, একদিন শনিবার হবে সেটা, মা স্কুলে চলে গেলে বাবার একটা ফোন এসেছিল। আমি ধরেছিলাম সেটা, বাবা তখন বাথরুমে, মহিলার গলা ছিল, নাম জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল চিনবে না। সেই মহিলা কি?
আমাদের বাড়িতে একটা টেলিফোন আছে। ছেলেবেলায় সেটা বাজলেই আমি দৌড়ে গিয়ে ধরতাম। কিন্তু একদিন একটা লোক বদমায়েসী করে খুব অসভ্য কথা বলেছিল। সেটা মাকে বলতেই আমার টেলিফোন ধরা বন্ধ হল। সবাই যে খারাপ কথা বলে তা নয়। একজন খুব মিষ্টি গলায় আমার নাম কি, বয়স কত এই সব গল্প করেছিল। এখন আমি অবশ্য টেলিফোন ধরি। সেই বিকেল চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে কমলামাসী নীচে তখন উনুন-টুনুন নিয়ে ব্যস্ত। জামাকাপড় পরিয়ে ভাইকে নিয়ে আমি খেলা করছি এমন সময় টেলিফোনটা বাজে। কমলামাসীর পায়ের শব্দ পেলেই আমাকে রঙ নাম্বার বলে ছেড়ে দিতে হয়। এই নিয়ে সমীরদা খুব রাগ করে। কিন্তু আমি কি করব বুঝতে পারি না। মা যদি জানতে পারে তাহলে মেরে আমার হাড় গুঁড়ো করে দেবে এই কদিন তো ফোনই ধরিনি মায়ের শরীর খারাপ, বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি কষ্টটাই না পাচ্ছিল। পাড়ার ডাক্তারবাবুর ওষুধে কাজ হল না। যেদিন প্রথম ব্যথাটা বাড়ল সেদিন বাবা জানতো না, যেমন দেরী করে বাড়ি ফেরে তেমনি এসেছিল। এসে ওই অবস্থা দেখে কেমন চোরের মত দাঁড়িয়েছিল। কমলামাসী ডাক্তারবাবুকে ডেকে এনেছে, ওষুধ কেনা হয়েছে শুনে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে মায়ের বিছানার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এখন কেমন আছ?
মা কথা বলেনি একটাও। দাঁতে দাঁত চেপে শুয়েছিল, চোখের কোল টলটলো সেটা ব্যথার জন্য না অন্য কিছু জানি না। পরদিন বাবা অফিসে গেল না, ডাক্তারবাবুকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপর এই কয়দিনে তিনজন ডাক্তার দেখার পর মা হাসপাতালে গেল। এর মধ্যে আমি কি করে সমীরদার ফোন ধরি বুঝতে পাচ্ছি খুব অসন্তুষ্ট হচ্ছে সমীরদা, ছেলেরা না একদম কিছু বুঝতে চায় না।
দুপুরবেলায়
একটু আগে বাবা হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। মুখ গম্ভীর, অন্যমনস্ক হয়ে স্নান-খাওয়া করলা আজ বাইরেটা বেশ মেঘলা করেছে। কমলামাসী অনেক কষ্টে ভাইটাকে ঘুম পাড়িয়ে আমার জিম্মায় রেখে গিয়েছে। বাবার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমি খেয়েছি। মা এখন কেমন আছে। কাল রাতের কথা মনে পড়ছে। মায়ের বিছানার পাশে আমরা বসেছিলাম। অত দুষ্টু যে বাপ্পাটা, সেও যেন বুঝতে পেরেছিল মায়ের শরীর ভাল নয়। চুপটি করে আমার কোলের কাছে বসেছিল। বাবা সারাদিন বের হয়নি। মায়ের জ্বর-জ্বর লাগছিল বলে টেম্পারেচারটা নিচ্ছিল। হঠাৎ মা বলে উঠল, ‘আমি যদি মরে যাই তাহলে ভেবো না আমি চলে যাব ঠিক ভূত হয়ে তোমাদের কাছে ঘুরঘুর করব।’
বাবা নিজে কেমন একটা শব্দ করে বলল, ‘কি যে ছাইপাঁশ কথা বল! মরার নাম করছ কেন?
মা বলল, ‘বাঁচতে আমার আর ইচ্ছে করে না গো।’ ইদানীং দেখছি, অসুখটা বেড়ে যাবার পর মা বাবার সঙ্গে কেমন অদ্ভুত গলায় কথা বলে। সেই ঝাঁঝটা নেই, ভীষণ নির্লিপ্ত মনে হয়। ‘আমার এ সব কথা শুনতে ভাল লাগছে না। ‘ বাবা যেন রাগ করল। মা হাসল তারপর আমাদের দিকে মুখ ফেরালা মায়ের চোখে চোখ রাখতে পারলাম না আমি কেমন অদ্ভুত চোখা মা হেসে বলল, ‘তোর খুব কষ্ট হচ্ছে খুকী?’ আমি ঘাড় নাড়লাম। মন দিয়ে পড়াশুনা করবি, ভাইটাকে দেখবি। ও যখন বড় হবে তখন আমার কথা ওকে বলবি।’।
সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে জড়িয়ে ধরে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, মা, তুমি এমন করে বলছ কেন?
‘দূর বোকা মেয়ে! বলছি তো কাঁদছিস কেন? এখন তো তুই একা নেই, তোর ভাই আছে। সব সময় মনে রাখবি।’
ঠিক তক্ষুনি আমার সেই রাতটার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। অনেক অনেকদিনের আগের সেই রাত ভাই তখন হয়নি। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বাজ পড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি উঠে পাশবালিশ সরিয়ে মায়ের কাছে যাব ভাবছি সেই সময় বাবার গলা পেলাম। বাবা এত রাত্রে আমাদের ঘরে আসে না। কি কথা হচ্ছে শুনবার জন্য কাঠ হয়ে শুয়ে থাকলামা বাবা বলছিল, ‘কিন্তু তুমিই তো এক সময় আগ্রহ দেখিয়েছিলে, এখন না বলছ কেন?’
‘আমি যখন চেয়েছিলাম তখন খুকীর তিন বছর বয়েস। তুমি না বলেছিলো’
‘তখন অসুবিধে ছিল সেকথা তো অনেকবার বলেছি।’
‘তুমি তখন আমাকে ডিভোর্সের কথা ভাবছিলো’
না, সে রকম নয়—’
‘এখন আর হয় না। আমার আর ইচ্ছে নেই তুমি যদি জোর কর তাহলে যে আসবে সে আনওয়ান্টেড চাইল্ড হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছ না কেন? এই বিরাট পৃথিবীতে তুমি আর আমি ছাড়া খুকীর কেউ নেই। আমাদের নিজেদের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তো নেই বললেই চলে। তাই একটা সময় তো নিশ্চয়ই আসবে যখন আমাকে এবং তোমাকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। ভাবতে পার তখন খুকী কি রকম একা হয়ে যাবে নিজের বলে ওর কেউ থাকবে না।’
মা যেন কিছুক্ষণ ভাবল, ‘ওর বিয়ে হয়ে যাবে, স্বামী পাবে ঘর পাবে।’
‘যদি না মিল হয় দুজনের?’
‘আমার মত অ্যাডজাস্ট করে নেবো আমি পেরেছি ও পারবে না কেন?’
‘এখন তুমি এই কথা বলছ, কিন্তু একদিন এই সব কথা তুমিই বলেছিলো আমরা তো আবার আগের মত হতে পারি, পারি না?
পারো?’
‘কেন পারি না? তুমি একবার আমাকে সুযোগ দাও।’
এর আগে অন্তত পাঁচবার তুমি এই কথা বলেছ। ঠিক আছে, খুকীর জন্য আমি আর একবার নিজেকে ঠকাই। তবে আজ নয়। ‘বাবা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পাশের ঘরে চলে গেল।
মায়ের কথাটা শুনে আমার সেই রাতটাকে মনে পড়ে গেল। আমি একা থাকব বলে মা ভাইটাকে এনেছে? এর মধ্যে, এই কিছুদিন হল, আমার স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে জেনে গেছি মানুষ কি করে জন্মগ্রহণ করে।
কিছুক্ষণ ওঘরে বসে থেকে বাবা আমার কাছে এল। আমি চুপচাপ জানলা দিয়ে আকাশ দেখছিলাম, বাবা এসে আমার মাথায় হাত দিলা আমার জিজ্ঞাসা করতে খুব ভয় করছিল, তবু বললাম, মা কেমন আছে?
‘ভাল নয়। অপারেশন হয়েছে, জ্ঞান ফেরেনি। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরবে ডাক্তার বলল।’
‘আমি যাব বিকেলে তোমার সঙ্গে।’
‘যাবি? না থাক। বাপ্পা একা থাকবে, কান্নাকাটি করতে পারে। হ্যাঁরে, তোর মা কি খুব ঝাল খেত?
শনি রবিবার ছাড়া দুপুরে মায়ের খাওয়া আমি দেখি না। তবু মনে করতে পারলাম না তেমন কিছু, ঘাড় নাড়লাম বাবা আমার চুলে হাত বোলাচ্ছিলা সামনে খাটের ওপর ভাই হাত পা ছড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। ‘খুকী, তুই তো এখন বড় হয়েছিস, বুঝতে শিখেছিস, আমি তোর মাকে বলেছি তুই থাকতে ভাই-এর কোন কষ্ট হবে না’
‘কেন, মা তো ফিরে আসবে?’ আমি কেমন শিউরে উঠলাম।
‘আসবে, কিন্তু যদ্দিন না আসে।’
আমি ঘাড় নাড়লাম। ভাই আমাকে খুব ভালবাসে। হঠাৎ বাবা কেমন গলায় বলে উঠল, খুকী, তোর মা কি তোর কাছে আমার সম্বন্ধে কিছু বলেছে?
‘না তো, কেন?’
‘না এমনি।’
ঠিক এই সময় টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। বাবাকে কেমন যেন হতভম্ব দেখাচ্ছিল। আমাকে ইঙ্গিত করে ফোনটা ধরতে বলল আমি রিসিভার তুলতে লোকটা নাম্বার যাচাই করে নিয়ে বলল, ‘পেশেন্টের অবস্থা ভাল নয়, ইমিডিয়েট রক্ত চাই। তাড়াতাড়ি চলে আসুন’ খবরটা শুনে বাবা আলমারি থেকে তড়িঘড়ি করে একগাদা টাকা বের করে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। যাবার সময় আমি বাবাকে বললাম, তাড়াতাড়ি এসো, না হয় ফোন করো’ বাবা ঘাড় নেড়ে দৌড়ে নেমে গেল।
বাবা চলে গেলে আমি অনেকক্ষণ কাঁদলাম। মায়ের যদি কিছু হয় তাহলে আমি কি করব? সারা জীবন মাকে ছাড়া থাকব কি করে? অ্যাদ্দিন মাকে অন্যরকম ভেবেছি বলে কেমন খারাপ লাগতে শুরু করল। আমার যখন সেই জিনিসটা প্রথম হয় তখন মা কি যত্ন করে সব বুঝিয়ে দিয়েছিল রাত্তির বেলায় মা না থাকলে আমার ঘুমই হয় না। হঠাৎ মনে হল আমি তবু মাকে এতদিন ধরে পেয়েছি, ভাইটা তো মা কি জানতেই পারল না। শোওয়ার ঘরে এলাম, ঘুমুতে ঘুমুতে ভাই হাসছে। বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগল আমার।
আলমারির দরজা হাট করে খুলে বাবা চলে গিয়েছে। মা থাকলে এমনটা হতে দিত না। আমার জামাকাপড়ের একটা আলাদা স্যুটকেস আছে। মা আলমারিতে হাত দেওয়া পছন্দ করত না। সব অগোছালো করে দেব নাকি। ওপরের তাকে লকার, মাঝখানেরটায় বাবার জামাকাপড়, নীচেরটায় মায়ের শাড়ি। উঃ প্রচুর শাড়ি মায়েরা চড়া রঙগুলো তো মা পরেই না। প্রায়ই বলে, ‘আর একটু বড় হলে তুই পরবি।’ আজ যদি মায়ের কিছু হয় তাহলে এই শাড়িগুলোর কি হবে? আমি একটাও পরতে পারব না। শাড়িগুলোর কাছে মুখ নিয়ে গেলেই মায়ের গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। একদম তলায় বেনারসীটা। মায়ের বিয়ের বেনারসী হাত দিলাম, কি মোলায়েম! অন্যমনস্ক হয়ে শাড়িগুলো ঘাঁটছিলাম আর মনে হচ্ছিল মায়ের পাশে বসে আছি। হঠাৎ হাতে শক্ত মতন কি ঠেকল। টানাটানি করে কাপড়ের চাপ থেকে সেটাকে বের করে দেখলাম একটা। ছোট অ্যালবাম। আমাদের অনেকগুলো অ্যালবাম আছে কিন্তু এটাকে আগে দেখিনি কৌতূহলী হয়ে পাতা ওল্টালাম, প্রথমে মা-বাবার বিয়ের ছবি তলায় তারিখটা লেখা। তার পাশে লেখা, ভীষণ লাজুক। পরের পাতায় বাবার একলা ছবি, কেমন বাচ্চা-বাচ্চা। নীচে লেখা, ফুলশয্যা খুব হ্যাংলা এবং রাক্ষসও। চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল আমার। মানেগুলো অস্পষ্ট বুঝতে পারছি যে তারপর অনেক ছবি, বেশীরভাগ মা-বাবার বাইরে যাবার। মা গগলস পরেছে, এক জায়গায় প্যান্ট পরে কোন পাহাড়ে ঘোড়ায় চেপেছে। হঠাৎ দেখি একটা পুঁচকে বাচ্চা—তার নীচে লেখা, খুকী এল। আমার জন্মতারিখা ব্যস, আর কোন ছবি নেই অ্যালবামে সব কটা পাতা খালি। এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি, মা কেন নিজের অ্যালবামটা বড় তাড়াতাড়ি শেষ করে দিল?
ঘুম থেকে উঠে ভাই বলল, ‘মা আতেনি? আমি ঘাড় নাড়লাম, না।
এই সময়টা ও ঘ্যানঘ্যান করে। কোন কিছুতেই ভোলানো যায় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খাটের ওপর দিয়ে জানলার ধারে চলে যায়। আমাদের দোতলার জানলা দিয়ে নীচের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। স্কুল থেকে মা যখন রিকশায় বাড়ি ফেরে তখন ও জানলায় দাঁড়িয়ে নাচতে থাকে। আজ কমলামাসীকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। এই যেমন এখন, ভাইকে সামলাতে সামলাতে কমলামাসী বার বার আড়চোখে আমায় দেখছে। কেন?
আমার মা কি মরে যাবে? কিছুদিন আগে অবধি আমি জানতাম মরে গেলে ভাল লোকেরা ভগবানের কাছে চলে যায়, খারাপ লোকেরা ভূত-পেত্নী হয়ে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। মা কেন বলল যে ভূত হয়ে ঘুর ঘুর করবো মা কি খারাপ লোক? মা না ফিরলে—চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা ভাবছিলাম। মা যেমন করে হাসে, কথা বলে, রাগ করে, চুল বাঁধে সব মনে করে নিয়ে নিজের চোখের পাতায় দেখছিলাম। ক্রমশ এমন মশগুল হয়ে গেলাম যে খেয়াল করিনি কখন ভাইকে কোলে নিয়ে কমলামাসী আমার সামনে এসে ডাকছে।
‘ও খুকু, ছি ছি, কাঁদে না মা।’ কমলামাসী বলতে আমি আবিষ্কার করলাম যে আমার গাল দুটো ভিজে গেছে। ‘আমরা তো কিছু জানি না, দিদির বাড়াবাড়ি হয়েছে মানেই কি আর চোখের জল মানুষের খুব খারাপ করে ভাই’ কমলামাসী আমার সামনে ভাইকে নিয়ে বসল। বোধ হয় আমাকে কাঁদতে দেখেই ভাই অবাক হয়ে ওর কোলে জড়সড় হয়ে বসে আছে। বড় বড় চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছে।
‘মাসী, মায়ের কেন এমন হল? আমি তো কোনদিন মাকে দুঃখ দিইনি!’
কমলামাসী এখন বুড়ী হয়ে গিয়েছে। যখনই কথা বলে তখন বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ে, ‘কে কিসে দুঃখ পায় তা যদি জানতে পারা যেত ভাই। এই আমি তো তেনাকে দুঃখ দিইনি একদিনও, খোকাকে মারিনি পর্যন্ত, তা তারা চলে গেল কি দুঃখ পেয়ে? আমরা জানতে পারি না ভাই।’
এই সময় টেলিফোনটা বাজল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গেলাম ওটা ধরতো লোকটা যে নাম্বার বলল সেটা আমাদের নয়। রং নাম্বার বলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বুকটা যেন হালকা হল সামান্য আমি কি হাসপাতালের কোন খবর আশা করেছিলাম? চলে আসছি দেওয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়ল। এই সময় সমীরদার ফোন করার কথা এখন রুটিন হয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। এতদিন আমার সন্দেহ হতে মা বোধ হয় সমীরদার ব্যাপারটা অনুমান করতে পারছে। টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে মনে হল মা আমার অনেক কিছু বুঝতে পারত। আমি যখন ছোট ছিলাম মা আমাকে মিথ্যে কথা বলতে নিষেধ করত বলত, ‘তুই যখন মিথ্যে বলবি তখনই আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে আর আমি টের পেয়ে যাব।’ খুব বিশ্বাস করতাম তখন কথাগুলো। সমীরদার সঙ্গে একদিন অনেকক্ষণ রাস্তা দিয়ে হেঁটেছিলাম। সেই প্রথমবার। ভয়ে ভাল করে কথা বলতে পারছিলাম না, সব সময় মনে হচ্ছিল কেউ দেখে ফেলবো আমার বন্ধু শোহিনীদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়, ও জোর করে আমায় নিয়ে গিয়েছিল বাবা-মাকে রাজী করিয়ে সমীরদা শোহিনীর দাদা। এর আগে দু-একবার স্কুলে দেখেছি সমীরদাকে, শোহিনীকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল লম্বা, খুব স্মার্ট, কলেজে পড়ে সেই সিনেমাটার চুমু-খাওয়া লোকটার মত, আমার মনে হয়েছিল আলাপ করতে না পারলে মরে যাব শোহিনী আলাপ করিয়ে দিলে দেখলাম কথা বলতে পারছি না। তারপর ওই পুজোর দিন সব গোলমাল হয়ে গেল আমাকে বাড়িতে দিতে এসে সমীরদা গল্প করতে করতে অনেক রাস্তা ঘোরাল। যখন সমীরদা বলল, ‘তুমি এত সুন্দর যে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমার আপত্তি আছে?’ আমার মনে হল যে আমি পাগল হয়ে যাব। এই প্রথম এ সব কথা কেউ আমাকে বলল। আমরা ঠিক করে নিলাম কখন ফোনে কথা বলবা সমীরদা বাড়িতে আসতে চেয়েছিল, আমি দিইনি।
সেদিন বাড়িতে ফেরা মাত্র মাজ কুঁচকে ছিল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’
ধক করে উঠেছিল বুকটা, ‘শোহিনীদের বাড়িতে।’
‘তোর হাঁটু অবধি এত ধুলো কেন?’
‘কি জানি!’ বলে তাড়াতাড়ি বাথরুমে চলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল মা আমার বুকের ভেতরটা দেখে ফেলেছে। সেই রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না, সারাক্ষণ এপাশ ওপাশ করছিলাম। তাছাড়া আমার অন্য ভয় হচ্ছিলা মা বলে আমি নাকি ঘুমের ঘোরে কথা বলি। যদি আজ রাত্রে সে রকম ভাবে সমীরদার কথা বলে ফেলি! হঠাৎ মা জিজ্ঞাসা করল, তোর কি হয়েছে?
চমকে উঠে বললাম, ‘কিছু না তো!’ মাত্র কয়েক হাত দূরে মা শুয়ে আছে, বুকে হাত দিলে হৃৎপিণ্ডটাকে টের পেয়ে যেত।
‘ঘুমিয়ে পড়।’
সেদিন থেকে আমার মনে হত মা যেন কেমন চোখে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকায়। হয়তো আমার ভুল তবু অস্বস্তি হতো। না, তারপর থেকে আমি শোহিনীদের বাড়িতে যাইনি, সমীরদার সঙ্গে রাস্তায় হাঁটিনি সেদিন সমীরদা আমাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমার খুব ভয় করছিল বলে যাইনি তার চেয়ে টেলিফোনে কথা বলাই ভাল। ইদানীং সমীরদা প্রায়ই বলে বাইরে বেরুতো ওদের কলেজের কাছে খুব ভাল রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানে কেবিনে বসে অনেকক্ষণ কথা বলা যায়। কেউ দেখতে পাবে না। সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠো আমি সেই সিনেমাটাকে চোখের সামনে দেখতে পাই।
রাত্তিরবেলায়
একটু আগে আকাশ থেকে একটা তারাকে ঝরে পড়তে দেখলাম। কমলামাসী বলল, ওটা দেখা নাকি খুব খারাপ, অমঙ্গল হয়। বাবা যে সেই গেছে আর কোন খবর দেয়নি। মা কি রক্ত নিয়ে সুস্থ হয়নি? তাহলে বাবা আসছে না কেন? একটা টেলিফোনও তো করতে পারত! আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। যে আশঙ্কাটাকে সারাদিন ঢেকেঢুকে রেখেছি তাকে যেন আর সামলানো যাচ্ছে না। সন্ধ্যেবেলায় ভাই খুব কান্নাকাটি করেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের কথা বলেছে। সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা, ও আজ মাসীর হাতে খেতে চায়নি মোটেই। আমি কোলে বসিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। তাই দেখে মাসী বলেছে, আজ থেকে তুমি সত্যিকারের দিদি হলে, তোমার দায়িত্ব বেড়ে গেল।’ নিজেকে কেমন অন্য রকম লাগছে। মা যেভাবে ভাইকে খাওয়াতো ঘুম পাড়াতো আমি অবিকল সেই রকম করতে ও আরামে ঘুমিয়ে পড়ল হঠাৎ মনে হচ্ছে আমি যেন ওর কাছে দিদি নই, কেমন করে মা হয়ে গেছি। মা যা যা করত তাই যদি আমি করে যাই তাহলে ওর কোন অসুবিধে হবে না, ক্রমশ এটাই মনের মধ্যে জুড়ে বসছে।
আর তারপর থেকেই মনে হচ্ছে মাকে আমি ঠকিয়েছি। সমীরদার ব্যাপারটা আমি একদম চেপে গিয়েছি। মাকে কি বাবাও ঠকিয়েছে? সেই মহিলার সঙ্গে প্রেমট্রেম করা নিয়ে মা খুব কেঁদেছিল। আমি জানি মা বাবাকে খুব ভালবাসতা অ্যালবামের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়। কি অভিজ্ঞতায় মাকে এখন কাঁদতে হয়? আমি সেটা জানি না, যদি জানতে পারতাম তাহলে আমি হয়তো ভবিষ্যতে মায়ের মত কাঁদতাম না। হঠাৎ মনে হল, আমার এবং বাবার জন্য আজ মায়ের শরীরে রক্ত দেওয়া হচ্ছে।
ভাইটা এমন ভঙ্গিতে ঘুমুচ্ছে ওর বুকে লাগবো ঠিক করে শুইয়ে দিতে গিয়ে আমার হাত জড়িয়ে ধরল ও। ঠিক এই সময় অনেক দূরে আওয়াজটা শুনতে পেলামা আমাদের বাড়ির সামনের ওই রাস্তা দিয়ে শব্দগুলো রোজ গঙ্গার দিকে চলে যায়। শব্দটা কানে যেতেই সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল আমার মনে হল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। কমলামাসীকে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখালাম আমি হঠাৎ মনে হল পৃথিবীটা কেমন ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। খুব চাপা, গম্ভীর এবং কান্না মেশানো হরিধ্বনিটা এগিয়ে আসছে। এক-একটা শব্দ যায় চিৎকার করে শাসাতে শাসাতো এটা। মোটেই সে রকম নয়। কমলামাসী পাশের জানলার ধারে ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে ভাই কেঁপে উঠতেই আমার কি হল জানি না আমি দু-হাত দিয়ে ভাই-এর কান চেপে ধরলাম না, ওকে এই শব্দ শুনতে দেব না। দাঁতে দাঁত চেপে আমি নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছিলাম আচ্ছা, এই সময় এখানে থাকলে কি করত?
ওরা কি মাকে নিয়ে আসছে? মাগো! ওরা কারা! বাবা হাসপাতাল থেকে ওদের কি করে যোগাড় করল? আমাদের কোন আত্মীয় তো কোলকাতায় নেই। এখানে আমরা একা নাকি বাবার অফিসের লোকজন সব শব্দটা এবার কাছে এসে গেছে। নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ির সামনে এসে থামবো আমি ভাইকে কক্ষনো জাগতে দেব না।
এমন সময় পাশের ঘরে টেলিফোনটা চিৎকার করে উঠল। নিশ্চয়ই কেউ খবর দিচ্ছে। কমলামাসী আমাকে একবার দেখে ছুটে গেল ফোন ধরতে। শব্দটা আসছে। খুব আবছায়া দেখলাম কমলামাসীকে, তোমার ফোন ভাই, শোহিনী করছে।’ শোহিনী! সমস্ত শরীর নিরক্ত আমার ভাই-এর কান থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আমি কি টেলিফোন ধরতে যাব? আমি বলতে গেলাম আমি কথা বলব না। সেই সময় যেন ঢেউ-এর মত দুলতে দুলতে শব্দটা আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেল। জানলায় দাঁড়িয়ে কমলামাসীকে দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করতে দেখলাম কোথাও যখন কোন শব্দ নেই কমলামাসী বলল, ‘উঃ, বুকটা কেমন করে উঠেছিল! কি হল, টেলিফোন ধরে রয়েছে!’
কিভাবে আমি টেলিফোন পর্যন্ত হেঁটে এলাম জানি না। শোহিনী হাসল, ‘কিরে, ঘুমুচ্ছিস?’ না।’ ‘তোর মা-বাবা বাড়িতে আছে?’ না।’ ‘গুড, কথা বল।’ পরমুহূর্তেই সমীরদার গলা পেলাম, কার সঙ্গে সারা বিকেল কথা বলছিলে, কতবার ডায়েল করলাম লাইন পেলাম না। আর কেউ ফোন করে নাকি?’
‘মানে?’ আমার মনটা হঠাৎ থমকে গেল। আমার কোন উত্তেজনা হচ্ছে না কেন?
যা সুন্দরী মেয়ে, বলা যায় না। এই শোন, আমি আর পারছি না, কাল বাইরে দেখা করতেই
হবে। ‘ সমীরদার গলায় দাবীর সুর।
‘পারব না। আমার মা হাসপাতালে গেছে।’
‘কেন? সমীরদাকে চিন্তিত শোনালা ভাল লাগল আমার, শরীর খারাপা।’
‘গুড। তাহলে ওই ঝিটাকে কোন রকমে ম্যানেজ করে বাড়ি থেকে বার করে দাও কয়েক ঘণ্টার জন্য আমরা তোমার বাড়িতেই—’,বলে অদ্ভুত হাসল, কী, রাজী?
‘কেন?’
‘তোমাকে হাম না খেতে পেলে আমি মরে যাব।’
সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরটা কেমন করে উঠল। চোখের সামনে আমার মা দাঁড়িয়ে। হ্যাংলা। এবং রাক্ষস কথাটা ভয়ঙ্কর হয়ে গেল আচমকা। আমার পালাবার যেন কোন পথ নেই। রাক্ষসটা তেড়ে আসছে সমানে। কি করে জানি না মায়ের সেই কথাগুলো মনে করতে পারলাম, খুব গম্ভীর গলায় বললাম, আমি আপনার শরীরের চাহিদা মেটাতে পারব না। দয়া করে আমাকে ফোন করবেন না। এটা বে—’কথাটা আমি উচ্চারণ করতে পারলাম না।
‘আরে যাঃ শালা, কি হল!’ সমীরদার গলাটাকে টিপে ধরলাম টেলিফোন নামিয়ে।
আমার গায়ে এখন ভীষণ জোর। মায়ের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখে গিয়েছি। মা যা যা করতো আমি সেইগুলো করতে পারব না কেন? বরং মায়ের ভুলগুলো আমি যাতে না করি এই সময় টেলিফোনটা আবার বাজলা সমীরদা? একবার ভাবলাম ধরব না, তারপর শক্ত হাতে রিসিভার তুললাম।
‘খুকী তোরা কেমন আছিস?’
বাবার গলা। ‘ভাল আছি বাবা। মা কেমন আছে?’
‘এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলছে কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। আমি ভাবছি থেকে যাই কাল পর্যন্ত। তোরা একা থাকতে পারবি তো মা?’ ‘তুমি কিছু চিন্তা কোরো না। আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি বাবা।’ কথাগুলো বলতে যে কি তৃপ্তি লাগল!