মাতাল রহস্য
মদের মতোই মদের গল্পও অতি উত্তেজক। কাণ্ডজ্ঞান-বিদ্যাবুদ্ধির পৃষ্ঠায় কত উলটোপালটা বিষয়ে বলা হল। কুকুর-বেড়াল, চোর-ডাকাত, ছাতা-মাথা কত না খুচরো গল্প শুনে, বানিয়ে বা অন্য বই থেকে টুকে লিখলাম, কিন্তু আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে ইতিমধ্যে টের পেয়েছি মাতাল কথামালা যত জমজমাট হয়, কিছুই আর তেমন জমে না। মদ ও মাতালের আকর্ষণের কোনও তুলনা হয় না।
সম্প্রতি বেড়াল নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করা হয়ে গেছে বোধহয়। ফলে বিদ্যাবুদ্ধির শোচনীয় ঝুল অবস্থা দেখে আমার পরম বন্ধু রসরঞ্জন শ্ৰীযুক্ত হিমানীশ গোস্বামী আমাকে অনুগ্রহপূর্বক তিনটি সুরাসিক্ত রসিকতা প্রেরণ করেছেন, সেগুলি নিবেদন করছি। সুরা রসপিপাসু পাঠকপাঠিকাবৃন্দ সেসব মন দিয়ে পাঠ করুন যদি কিঞ্চিৎ গোলাপি আবেশ তাঁদের স্পর্শ করে, সমস্ত কৃতিত্ব হিমানীশবাবুর, আমার নয়।
স্কচ হুইস্কি দিয়ে আরম্ভ করা যাক। এটাই নাকি জগৎ-সংসারের সেরা মদ। এক বিখ্যাত ফৌজদারি উকিলের বাড়িতে এক মক্কেলের আবির্ভাব। উকিলবাবুর টেবিলের ঠিক সামনের চেয়ারে বসে মক্কেল মহোদয় বললেন, ‘স্যার, এক কেস স্কচ হুইস্কি চুরি করার দায়ে ধরা পড়েছি। এই কেস কি আপনি নেবেন ?’ উকিলবাবু তাড়াতাড়ি গলা নামিয়ে মক্কেলের কানের খুব কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘নেব। নিশ্চয়ই নেব। কেসটা কোথায় ?’
দ্বিতীয় গল্পটি প্রথম গল্পটির মতো তত সরল নয়। রেললাইনের পাশে এক উচ্চতল বাড়ি। সে বাড়ির উপরের এক ফ্ল্যাটে পার্টি হচ্ছে, পার্টি ভাঙল গভীর রাতে, তখন লোডশেডিং, ঘুটঘুটে অন্ধকার, লিফটও বন্ধ। কয়েকজন মাতাল সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে অবশেষে রেললাইনের উপর এসে পৌঁছল। সকলের অবস্থাই এমন যে চলতে পারছে না আর, রেললাইনের ওপরে হামাগুড়ি দিতে লাগল। এইভাবে মিনিট কুড়ি যাওয়ার পরে একজন বলল, ‘আজব বাড়িতে পার্টিতে এসেছিলাম বটে। অর্ধেক সিঁড়ি সিমেন্টের আর বাকি সিঁড়ি কাঠের।’ এই শুনে দ্বিতীয় এক মাতাল বলল, ‘কী উঁচু সিঁড়িরে বাবা, নামছি তো নামছিই, এ যে আর শেষ হয় না।’ এইবার তৃতীয় হামাগুড়িদাতা মাতাল বলল, ‘তা, সিঁড়ি বেয়ে নামতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না। তবে রেলিং দুটো এত নিচু করেছে, হামাগুড়ি দিয়ে না গেলে ধরতেই পারতুম না।’
তৃতীয় গল্পটিও হিমানীশ প্রেরিত। কিন্তু স্বীকার করা ভাল, গল্পটি হিমানীশের নয়, এর প্রবক্তা সাংবাদিক সন্তোষ বাগচী। শ্রীযুক্ত বাগচী কিছুকাল আগে অবসর নিয়েছেন, তাঁর রসবোধ অতি সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত।
সন্তোষবাবুর গল্পটিও অবশ্য মাতাল-সংক্রান্ত। এ কিন্তু ভাল জাতের মাতাল। বছরের শেষ দিনে নিউ ইয়ারস ইভে ভদ্রলোক প্রচুর মদ্যপানের পর প্রতিজ্ঞা করলেন নিজের মনে, ‘না আর নয়, আজ থেকে মদ খাওয়া শেষ। এই বাজে নেশা ছেড়ে দিলাম।’ সোজা বাড়ি গিয়ে যথারীতি বিছানায় শয়ান হলেন তিনি। পরের দিন দুপুরবেলা ঘুম ভাঙল, তখন তাঁর আগের রাতের প্রতিজ্ঞা মনে পড়ল। খুশি হলেন নিজের ওপরে, নববর্ষে চমৎকার প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে; না, সত্যি সত্যি আর কখনও মদ্যপান নয়।
বিকেলের দিকে রাস্তায় বেরলেন তিনি। তখন তিনি নিজের মনের জোর পরীক্ষা করার জন্য পানশালার সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলেন। নববর্ষের অপরাহ্ন, পানশালার ভিতরে তখন মদিরার মোহজাল; উচ্ছল, আনন্দিত জনতা। রাস্তা থেকে মৃদু সংগীতের ইশারা পাওয়া যাচ্ছে। সব কিছু অবহেলা করে, সুরার হাতছানি উপেক্ষা করে ভদ্রলোক নিতান্ত মনের জোরে এগিয়ে গেলেন পানশালা অতিক্রান্ত হয়ে।
কিছু দূরেই আরও একটা পানশালা। সেখানেও অনুরূপ প্রলোভন, প্রচুর নরনারী মদ্যপান করছে। কিন্তু তিনি বেপরোয়া, একে একে বহু পানশালা পার হয়ে গেলেন। তারপর আবার ফিরতি পথে, ওই একই পানশালাগুলির সামনে দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে, দীপ্ত চিত্তে চলে গেলেন।
এইভাবে বার দশেক পারাপার করার পরে ভদ্রলোক নিজের মনকে বললেন, ‘ওরে মন, তোর তো খুব জোর। এই দোকান, এই মদ, এই সব মানুষজনেরা পান করছে, এততেও তোর কোনও বৈকল্য নেই, দুর্বলতা নেই, লোভ নেই। সাবাস! ওরে মন, সাবাস, সাবাস।’
ততক্ষণে নববর্ষের মধুর সন্ধ্যা নীল কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে সরাবসরণীতে উচ্ছলতায় অংশ নিতে এসেছে। রাজপথে খুশি জনতার ভিড়, সুমধুর সুরলহরী ভেসে আসে পাশের পানশালাগুলি থেকে। সেই সঙ্গে হাসি, গান।
এবার ভদ্রলোক নিজের মনকে বললেন, ‘ওরে মন, ওরে আমার মন, তুই যখন এতই সাহসের পরিচয় দিলি, আজ এই নতুন বছরের শুভ দিনে আয় তোকে একটু খুশি করি’, এই স্বগতোক্তি করে ভদ্রলোক তাঁর মনকে খুশি করার জন্য সামনের পানশালার ভেতরে ঢুকে গেলেন।
শ্রীযুক্ত গোস্বামী এবং শ্রীযুক্ত বাগচী, দুই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণকে নিয়ে একটু বেশি মাতামাতি করা হয়ে গেল, আমি নিজেও মানবজাতির ওই বিপজ্জনক প্রশাখার (সৈয়দ মুজতবা আলি দ্রষ্টব্য)। ব্যাপারটা নাকি সুবিধার নয়, এ্যহস্পর্শের দোষ কাটানোর জন্য এইখানে এক কুলীন কায়স্থকে ছুঁয়ে যাচ্ছি।
প্রবীণ, রাশভারী, বিদগ্ধ পরশুরাম বা রাজশেখর বসুকে মদের গল্পে কখনওই স্মরণ করতে সাহস হয়নি। এবার শুধু ফাঁড়া কাটাবার জন্য করছি।
পঞ্চপ্রিয়া পাঞ্চালী গল্পে পরশুরাম মদের ব্যাপারে শ্রীকৃষ্ণকে জড়িয়েছেন। দ্রৌপদীকে শ্রীকৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘দশ-বিশ কলসে উত্তম আসব পাঠিয়ে দেব ? পৈষ্ঠী মাধ্বী আর গৌড়ী মদিরা, মৈরেয় আর দ্রাক্ষেয় মদ্য, সবই দ্বারকায় প্রচুর পাওয়া যায়।…’
শুধু ঈশ্বর বা অবতার নন, যন্ত্র সম্পর্কেও মদের কথা বলেছেন পরশুরাম। একগুঁয়ে বার্থা গল্পে আছে, মোটর গাড়ির মালিক নিজের জন্য এক বোতল ব্র্যান্ডি কিনলেন আর তিন বোতল সাজাহানপুর রম (Rum) কিনলেন তাঁর গাড়ির জন্য, কারণ গাড়ি কেনার পরই তিনি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে, গাড়িকে রম খাওয়ালে (অর্থাৎ পেট্রল ট্যাঙ্কে ঢাললে) তার বেশ ফুর্তি হয়। হর্সপাওয়ার বেড়ে যায়।
মাতাল প্রসঙ্গে আরেকজন সিদ্ধপুরুষকে স্মরণ করি, তিনি অতুলনীয় ত্রৈলোক্যনাথ। ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে এক গুলিখোর মাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, ‘আর বিশ্বাস করিও না, এই পেশাদার মাতালদের। সাত ঘাটের জল এক করিয়া তুমি চারিটি পয়সা জোগাড় করিলে, আড্ডায় আসিয়া সেই চারি পয়সার ছিটে টানিলে, নেশাটি করিয়া তুমি আডডা হইতে বাহির হইলে, আর হয়তো কোথা হইতে একটা মাতাল আসিয়া তোমার গায়ের উপর ঢলিয়া পড়িল, তোমার নেশাটি চটিয়া গেল। শীতকাল, মেঘ করিয়াছে, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছে, ফুরফুর করিয়া বাতাস হইতেছে। সহজেই নেশাটি বজায় রাখা ভার, তার উপর কোথা হইতে একটা মাতাল আসিয়া তোমার গায়ে হড়হড় বমি করিয়া দিল। তোমার নেশাটির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল।’
মহাজ্ঞানী, মহাজন যে পথে গমন করেছেন, সে পথে আরেকটু যাই, আর একটা ল্যাম্পপোস্ট ছুঁই।
কাহিনীটি পুরনো। জনৈক সুরাপায়ী বারে এসে মদের অর্ডার দিয়ে পকেট থেকে একটা পোষা গিনিপিগ বার করে টেবিলের ওপর রাখতেন। তারপর কয়েক পাত্র পান করার পরে গিনিপিগকে তুলে ভাল করে দেখে আবার পকেটে পুরে চলে যেতেন। একদিন বেয়ারা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘দাদা, গিনিপিগটাকে নিয়ে আসেন কেন ?’ দাদা বললেন, ‘দ্যাখো, আমি তো একটা গিনিপিগ আনি। যখন খেতে খেতে দেখি দুটো গিনিপিগ হয়েছে, তখন দুটোকে দু’ পকেটে পুরে বাড়ি ফিরে যাই।’
কিছুদিন পরে গিনিপিগটা মারা গেছে। গিনিপিগ ছাড়া ভদ্রলোক এসেছেন। বেয়ারা বলল, ‘দাদা, এবার কী করবেন ?’ দাদা বললেন, ‘সামনের টেবিলের লোকটা যেই ডবল হয়ে যাবে, আমি উঠে পড়ব।’ এইভাবে ভালই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন দাদা এক পেগ খেয়েই উঠে পড়লেন। বেয়ারাটি ছুটে এল, ‘দাদা, আজ এত তাড়াতাড়ি ?’ দাদা বললেন, ‘তাই তো, আজ বড় তাড়াতাড়ি নেশা হয়ে গেল। সামনের টেবিলের লোকটা এক পেগ খেতেই দেখি ডবল হয়ে গেছে।’ বেয়ারা হেসে বলল, ‘দাদা, ও দেখে ভয় পাবেন না। ও টেবিলে একজন নয়, দু’জনই আছে। ওরা যমজ ভাই। তাই ডবল মনে হচ্ছে।’
দাদা এবার শান্ত হয়ে টেবিলে বসলেন এবং ডবল রিডবল না হওয়া পর্যন্ত, দু’জন চারজন না হওয়া পর্যন্ত মনের সুখে সুরাপান করতে লাগলেন।