মাণিক চোর

মাণিক চোর

প্রথম পরিচ্ছেদ 

বেলা দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হইয়াছে। মেঘমুক্ত সুনীল অম্বরে থাকিয়া সহস্রাংশু প্রচণ্ড কিরণে চারিদিক যেন দগ্ধ করিতেছে। উত্তপ্ত পবন শন্ শন্ শব্দে প্রবাহিত হইয়া অগ্নিকণাসম ধূলিরাশি বিক্ষিপ্ত করিতেছে। বিহগকুল প্রাণভয়ে ভীত হইয়া স্ব স্ব কুলায়ে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। বসন্তের নবোদ্গত শাখা-প্রশাখাদিসহ বিটপীশ্রেণী যেন ম্রিয়মাণ হইয়া রহিয়াছে, পথিমধ্যস্থ ধূলিকণা চারিদিকে উত্থিত হইতেছে। 

এমন সময়ে বিষমপুর গ্রামের পথ দিয়া এক অশ্বারোহী মন্থরগমনে অগ্রসর হইতেছিলেন। হাজারিবাগ জেলার অন্তর্গত বিষমপুর একখানি গণ্ডগ্রাম। গ্রামখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র না হইলেও এখানে অল্প লোকেরই নিবাস। তারাপদ বোস গ্রামের জমীদার। 

অশ্বারোহী যুবক–বয়স ত্রিশ বৎসরের অধিক নহে। দেখিতে সুপুরুষ ও সুসজ্জিত। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মাক্ত। দেখিলেই বোধ হয়, তিনি অনেক দূর হইতে অশ্বারোহণে আগমন করিতেছেন। 

যুবকের ন্যায় তাঁহার অশ্বটিও সর্ব্বাঙ্গসুন্দর, তাহার ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ও ঘর্মাক্ত কলেবর দেখিলে যুবক অপেক্ষা তাহাকে অধিকতর ক্লান্ত বলিয়া বোধ হয়। 

কিছুদূর মন্থরগমনে অগ্রসর হইলে পর যুবক দূরে এক প্রাসাদসম অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন। তাঁহার বিমর্য ম্লান বদন প্রফুল্ল হইল। তিনি বামপদ দ্বারা অশ্বকে সঙ্কেত করিলেন। পরিশ্রান্ত হইলেও সে প্রভুর আজ্ঞা পালনে বিরত হইল না। ইঙ্গিতমাত্রে সে যুবককে লইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে সেই অট্টালিকাভিমুখে অগ্রসর হইল। 

নিকটবর্ত্তী হইলে যুবক দেখিলেন, অট্টালিকার তিন দিকে উদ্যান, সম্মুখে বিস্তীর্ণ মাঠ। উত্তরে নানাবিধ প্রকাণ্ড আয়কর বৃক্ষ, পূর্ব্বে আম জাম নারিকেলাদি বিবিধ ফলের গাছ, পশ্চিমে বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি, দক্ষিণে বিস্তীর্ণ মাঠে গোলাপ বেল মল্লিকাদি মনোরম সৌগন্ধপূর্ণ পুষ্পকুঞ্জ। যুবক অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া অশ্বরজ্জু ধারণ করতঃ অট্টালিকার দ্বার সমীপে গমন করিলেন। দেখিলেন, দ্বার রুদ্ধ। 

অশ্বারোহী বিস্মিত হইলেন। নিকটে কোন লোক দেখিতে না পাইয়া তিনি চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। দেখিলেন, অদূরে এক বৃদ্ধ এক প্রকাণ্ড বৃক্ষতলে বসিয়া উদ্যান-পরিচর্য্যায় নিযুক্ত। নিকটস্থ একটি বৃক্ষে অশ্বরজ্জু বন্ধন করিয়া যুবক সেই বৃদ্ধের নিকটে গমন করিলেন এবং মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “হরিসাধনবাবু কি বাড়ীতে আছেন?” 

বৃদ্ধ চমকিত হইয়া তাঁহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। পরে অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে হাঁ-তিনি বাড়ীতেই আছেন। কর্তাবাবুর মৃত্যুর পর হইতে তিনি সর্ব্বদাই এখানে থাকেন।” 

যুবক পূৰ্ব্বেই সে কথা শুনিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন “একবার তাঁহাকে সংবাদ দিতে পার? বলিও, ত্রৈলোক্যবাবু দেখা করিতে আসিয়াছেন।” 

দ্বিরুক্তি না করিয়া বৃদ্ধ তখনই সেই প্রাসাদসম অট্টালিকার দ্বার সমীপে আগমন করিল এবং দ্বার উন্মোচন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। 

যুবক দেখিলেন, সংস্কারাভাবে সেই প্রকাণ্ড অট্টালিকা ও তৎসংলগ্ন উদ্যানের অবস্থা অতি শোচনীয়। তিনি শুনিয়াছিলেন, হরিসাধনের পিতা অতি ধনবান। পিতার মৃত্যুর পর তিনিই এখন সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। কেন যে তিনি বাটা সংস্কার করেন নাই, কি জন্য যে তিনি উদ্যানকে শ্রীহীন অবস্থায় রাখিয়া নিশ্চিন্ত আছেন তাহা বুঝিতে পারিলেন না। 

কিছুক্ষণ পরেই বৃদ্ধ ফিরিয়া আসিল এবং অতি নম্র ভাবে বলিল “আপনি ভিতরে আসুন।” 

যুবক দ্বার অতিক্রম করিয়া বাটীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। বৃদ্ধ দ্বার রুদ্ধ করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। অট্টালিকার বহির্দ্দেশ অপেক্ষা ভিতরের অবস্থা অধিকতর শোচনীয়। নীচের অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ থাকিলেও প্রায় সকলগুলিই অব্যবহার্য্য। যে সিঁড়ি দিয়া তিনি দ্বিতলে উঠিলেন, তাহার স্থানে স্থানে ভগ্ন। দেওয়ালের অধিকাংশই শ্রীহীন। 

বৃদ্ধ যুবককে দ্বিতলের একটি প্রকোষ্ঠের দ্বার সমীপে লইযা গেল। পরে বিনীত কণ্ঠে বলিল “আপনি ভিতরে যান, বাবু এই ঘরে আছেন।” 

যুবক ভিতরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, হরিসাধন একখানি সুকোমল কৌচের উপর বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছেন। যুবক গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলে তিনি তাঁহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। সহসা তাঁহার মুখ প্রফুল্ল হইল। তিনি পুস্তকখানি কৌচের উপর রাখিয়া, সহাস্যবদনে তখনই তাঁহার দিকে অগ্রসর হইলেন। পরে হাসিতে হাসিতে বলিলেন “তিলক এসেছিস? আমাকে তবে তোর মনে পড়েছে? কেমন করে আমার সন্ধান পেলি?” 

অশ্বারোহীকে দেখিয়া হরিসাধন অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। তাঁহার হস্ত ধারণ করিয়া সাদরে সেই কৌচের নিকট আনয়ন করিলেন এবং তাহার উপর বসাইয়া স্বয়ং পার্শ্বে উপবেশন করিলেন। 

ত্রৈলোক্যনাথ বন্ধুর আনন্দ দেখিয়া পরম আপ্যায়িত হইলেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন “আমি শিকারে আসিয়াছিলাম। ফিরিবার সময় এইদিক দিয়া যাইবার ইচ্ছা হইল। পশ্চিমে যখন তোর সঙ্গে দেখা হয়, তখন বলেছিলি শীঘ্রই ফিরিবি। তাই আমি একেবারে তোদের কাছারি বাড়ীতে গিয়াছিলাম। সেখান থেকেই তোর সন্ধান পেয়েছি।” 

আগ্রহ সহকারে হরিসাধন জিজ্ঞাসা করিলেন “তবে আমার সকল দুর্দ্দশার কথাই শুনেছিস?” 

ত্রৈ। হাঁ ভাই! তোর পিতার গঙ্গালাভের কথায় আন্তরিক দুঃখিত হয়েছি। 

হ। কেবল এই সংবাদটি পেয়েছিস? 

অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন ভাই? মানবের পিতৃহীন হওয়া অপেক্ষা আর দুর্দ্দশা কি অধিক হ’তে পারে?” 

হতাশের হাসি হাসিয়া হরিসাধন বলিলেন “হতে পারে কি না, শুনিলেই বুঝতে পারিবি।” 

ব্যস্তসমস্ত হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “কি শুনি?” 

হরিসাধন বলিলেন, “সে সব পরে হবে। এখন আজ এখানে থাকা হবে ত?” 

হাসিয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “সেই জন্যই ত এখানে এসেছি। তোর চাকর কই? আমার ঘোড়াটা বাহিরে আছে।” 

হরিসাধন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরে বিষণ্ণবদনে বলিলেন “চাকরের মধ্যে দুটি লোক আছে। বুড়ো মাসী—আর সেই পুরাতন মাধা। আর সকলকে জবাব দিয়েছি। সকল কথাই শুনতে পাবি।” 

ত্রৈলক্যনাথ বলিলেন “মাধা আছে ত? এমন কাজ নই যে, সে পারে না। বামুনের ছেলে বটে কিন্তু গায়ে অসুরের বল। কোথা সে?” 

হরিসাধন হাসিতে হাসিতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং গৃহ হইতে বাহির হইয়া মাধাকে ডাকিলেন। মাধা নিকটেই ছিল, প্রভুর কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে তখনই তাঁহার নিকটে গমন করিল। হরিসাধন তাহার উপর বন্ধুর অশ্বরক্ষার ভার দিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন; এবং তাহাকে ত্রৈলোক্যের আহারাদির বন্দোবস্ত করিতে আদেশ করিলেন। 

মাধা ত্রৈলোক্যনাথকে চিনিত। যখন হরিসাধন পশ্চিমে গিয়াছিলেন, তখন মাধা তাঁহার সহিত ছিল। ত্রৈলোক্যনাথও সেখানে হরিসাধনের নিকটেই অপর এক বাটীতে বাস করিতেন। মাধা তাঁহাকে বিলক্ষণ ভক্তি করিত। মাধার মত তিনিও ভয়ানক বলিষ্ঠ বলিয়াই মাধা তাঁহাকে বিলক্ষণ চিনিত। 

তিলক আসিয়াছেন শুনিয়া মাধা সহসা ভ্রুকুটী করিল। পরে তখনই আত্মসংবরণ করিয়া হাসিতে হাসিতে ত্রৈলোক্যনাথের নিকট গমন করিল এবং সাদর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

ত্রৈলোক্যনাথ ব্রাহ্মণ সন্তান হইলেও শূদ্র বন্ধুর গৃহে আহার করিতে অসম্মত নহেন। পশ্চিমে হরিসাধনের বাটীতে তিনি অনেকবার আহার করিয়াছেন। বাল্যাবধি উভয়ে উভয়ের পরিচিত, উভয়েই সমবয়স্ক ও সমান অবস্থাপন্ন। উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় সৌহার্দ্য ছিল। 

আহারাদি সমাপন করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ যখন হরিসাধনের সহিত পুনরায় সেই প্রকোষ্ঠে সেই কৌচের উপর উপবেশন করিলেন, তখন হরিসাধন অগ্রে অন্যান্য কথার অবতারণা করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করতঃ বলিলেন “তিলক! আর এক মাস পরে এখানে আসিলে আমার সহিত দেখা হইত না। আমার সমস্ত সম্পত্তিই বন্ধক। একমাসের মধ্যে দেনা পরিশোধ করিতে না পারিলে সকলই বিক্রীত হইবে। আমায় ভিক্ষুকের মত দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে।” বাধা দিয়া ত্রৈলোক্যনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন এমন হইল ভাই! তোদের অগাধ সম্পত্তি কিসে নষ্ট হইল? 

তোর পিতা ত তেমন লোক ছিলেন না। তবে তিনি নগদ অর্থ ব্যয় করিয়া নানাবিধ রত্ন সংগ্রহ করিতেন, এই তাঁর রোগ ছিল। এক একখানি রত্নের দামে অনেক ভূসম্পত্তি কেনা যায়। সে রত্নগুলি কোথায়? সেগুলি ত পেয়েছিস?” হরিসাধন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন “সেগুলিই ত কাল! তাদের জন্যই বাবা আমার প্রাণে মরিলেন। রত্নগুলি চুরি গিয়াছে ভাই! একখানিও পাই নাই।” 

ব্যস্ত হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “পুলিসেও কি কোন কিনারা করিতে পারিল না?” হ। কই? 

ত্রৈ। একেবারে হাল ছেড়েছে? 

হ। এক রকম বটে। 

ত্রৈ। তোর পিতার মৃত্যু হয় কিসে? 

হ। সেই রত্নগুলির শোক তিনি সংবরণ করিতে পারেন নাই। উহার শোকেই তাঁহার মৃত্যু হয়। 

ঠিক এই সময়ে মাধা গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিল এবং উভয়ের সম্মুখে কতকগুলি তাম্বুল ও সুবাসিত তামাকুপূর্ণ একটি সোণাবাঁধান হুকা রক্ষা করিল। হরিসাধন জিজ্ঞাসা করিলেন “মাধা। তিলক শোবে কোথা? তেমন ঘরই বা কোথায়?” 

মাধা প্রভুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কোন উত্তর করিতে পারিল না। তখন হরিসাধন বলিলেন “তবে থাক্—এই ঘরেই দুজনে শোব। আর একটা ভাল বিছানার বন্দোবস্ত কর।” 

বাধা দিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ মাধাকে বলিলেন “না না, এ ঘরে না। এত বড় বাড়ীতে একটি ভিন্ন শোবার ঘর নাই, এ বড় আশ্চর্য্য!” 

লজ্জার হাসি হাসিয়া হরিসাধন বলিলেন “নিজেই ত বাড়ীর অবস্থা দেখছিস। আর একখানি ভাল ঘর আছে। কিন্তু সে ঘরে তুই থাকিস্ আমার ইচ্ছা নয়।” 

সাগ্রহে ত্রৈলোক্যনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন? সে ঘরে কি?” 

হ। সেই ঘরেই বাবা আমার মারা পড়েন। 

ত্রৈ। তবে সেটিই তাঁর শোবার ঘর? 

হ। হাঁ! 

ত্রৈলোক্যনাথ দৃঢ়তা ব্যঞ্জক স্বরে বলিলেন “তবে আমি সেই ঘরেই থাকিব।” 

হরিসাধন যেন ব্যথিত হইলেন। তিনি বলিলেন “এখানকার সকলেই বলে, ও ঘরে ভূত আছে।” 

ত্রৈলোক্যনাথ হাসিয়া উঠিলেন। পরে বলিলেন “ভাল, এতদিনের পর ভূতই দেখা যাবে।” 

হ। সে ঘর অনেকদিন বন্ধ আছে। 

ত্রৈ। শোবারও এখন অনেক বিলম্ব আছে। 

হরিসাধন অনেক বুঝাইলেন, বারম্বার নিষেধ করিলেন, কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথ কিছুতেই ছাড়িলেন না। তখন হরিসাধন মাধার দিকে চাহিয়া বলিলেন “ঘরটি শীঘ্র পরিষ্কার করিয়া রাখ। বাবার বিছানা যেমন ছিল তেমনই আছে। তিলক স্বচ্ছন্দে সেই বিছানায় শুইতে পারিবে।” 

মাধা কোন উত্তর করিল না। হরিসাধনের মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। তাহার ভঙ্গি দেখিয়া ত্রৈলোক্য হাস্য সংবরণ করিতে পারিলেন না! মাধা যে অত্যন্ত ভীত হইয়াছে, তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন। উপহাস করিয়া বলিলেন “মাধাও আমার কাছে থাকবে। কেমন মাধা?”

সচকিত নেত্রে সভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে যোড়হস্তে মাধা বলিল “আমায় মাপ করুন, লাখ টাকা দিলেও আমি রাত্রে ও ঘরে থাকিব না।” 

আন্তরিক বিরক্ত হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “তবে এখনই ঘরটাকে পরিষ্কার করে রাখ। কি জানি রাত্রি হয়ে গেলে আর পরিষ্কারও হবে না।” 

বন্ধুর কথায় হরিসাধন ঈষৎ হাসিয়া মাধাকে সত্বর সে আদেশ প্রতিপালন করিতে বলিলেন। মাধাও আর দ্বিরুক্তি করিতে সাহস না করিয়া বিরক্তির সহিত তথা হইতে প্রস্থান করিল; এবং কিছুক্ষণ পরে পুনরায় তথায় আসিয়া বলিল, ঘরটি পরিষ্কার হইয়াছে। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

সূৰ্য্য অস্ত গিয়াছে। কিন্তু এখনও অন্ধকার সমগ্র পৃথিবী গ্রাস করিতে পারে নাই। অত্যুচ্চ বৃক্ষোপরি তখনও অস্তগত দিনমণির আভা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছিল। কৃষকগণ ধেনু লইয়া হল স্কন্ধে আপনাপন কুটীরাভিমুখে গমন করিতেছিল। বিহগকুল নিজ নিজ কুলায়ে প্রত্যাগত হইয়া জগৎ পিতার স্তুতি গান আরম্ভ করিয়াছিল। হরিসাধন ত্রৈলোক্যনাথকে লইয়া পিতার কক্ষে প্রবেশ করিলেন। 

গৃহে প্রবিষ্ট হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ দেখিলেন, ঘরটি বেশ বড় ও সুসজ্জিত। এক পার্শ্বে দুইখানি মখমলাচ্ছাদিত সুকোমল কৌচ, চারিখানি চেয়ার, একটি প্রকাণ্ড দেরাজ, দুইটি আলমারি, অপর পার্শ্বে এক অতি সুন্দর খাটের উপর দুগ্ধফেননিভ শয্যা। শয়্যার উপর সাটিনের মসারি। 

গৃহ মধ্যে ছয়টি প্রকাণ্ড জানালা ও একটি দরজা। হরিসাধন বন্ধুর হাত ধরিয়া একটি জানালার নিকট গমন করিলেন। পরে বলিলেন “এই যে লোহার শিক দেখিতেছিস্, উহাই সকল অনিষ্টের মূল।” 

ত্রৈলোক্যনাথ তাঁহার কথার মর্ম্ম বুঝিতে পারিলেন না। তিনি হরিসাধনের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কিসে?” 

হ। শিকের সাহায্যেই চোর এ ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল। 

ত্রৈ। কে বলিল? কেমন করিয়া তুই তাহা জানিতে পারিলি? 

হ। যে রাত্রে বাবার মৃত্যু হয়, তাহার পরদিন প্রাতঃকালে মাধা আমায় শিকের উপর যে দাগ দেখাইয়াছিল তাহাতেই আমি জানিতে পারিয়াছি। 

ত্রৈ। শিকটা লোহার, উহাতে কিসের দাগ দেখিয়াছিলি? 

হ। কেন- ধূলার। দাগগুলি দেখিয়া স্পষ্টই বোঝা গেল যে, চোর সেই শিক ধরিয়াই উপরে উঠিয়াছিল। 

ত্রৈ। ভাল, উপরেই না হয় উঠিল, কিন্তু কেমন করিয়া এ ঘরে আসিল? ঘরে আসিবার কি আর কোন পথ আছে? হরিসাধন বলিলেন “কই, না।” 

ত্রৈ। এ জানালার কি গরাদ ভাঙ্গা ছিল? 

হ। না–আমি ভালরূপ পরীক্ষা করেছিলাম। 

ত্রৈ। চোর তবে কি করিয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল? পুলিসের লোকে কি বলিলেন? 

হ। তাঁরা বলেন, ছাদে যে আলোক আসিবার পথ আছে, সেই পথ দিয়াই চোর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।

ত্রৈ। সেখানে কোন চিহ্ন ছিল? 

হ। ছিল — ধূলার দাগ। 

ত্রৈলোক্যনাথ আর কোন প্রশ্ন করিলেন না। তিনি হরিসাধনের সহিত ছাদে গমন করিয়া কাচাবৃত আলোকপথ দুইটি পরীক্ষা করিলেন। দেখিলেন, সেখান দিয়া সহজে কোন লোক গৃহের ভিতর আসিতে পারে না। কিন্তু বন্ধুকে মনের কথা বলিতে ইচ্ছা করিলেন না। কিছুক্ষণ সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমসৌরভে স্নাত মৃদুমন্দ মলয়পবন সেবন করিয়া পুনরায় হরিসাধনের শয়ন প্রকোষ্ঠে প্রত্যাগমন করিলেন। 

কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর ত্রৈলোক্যনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “হরি! এখনও কি তোর ভাঙ খাওয়া অভ্যাসটা আছে?” 

ঈষৎ হাসিয়া হরিসাধন বলিলেন “এ দেহের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যাসটা যাবে। প্রায় সতের বৎসরের অভ্যাস সহজে কি ছাড়া যায়?” 

এই সময় মাধা উভয়ের জলখাবার লইয়া আসিল। হরিসাধন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তিলকের ভাঙ কোথায়?” 

পরে ত্রৈলোক্যনাথের দিকে চাহিয়া বলিলেন “আজ তুইও একটু খাবি ত?” 

অল্প হাসিয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “খেতে পারি কিন্তু জানিস্ ত খেলে আমায় কেমন জড় সড় করে ফেলে।” হরিসাধন মাধাকে ইঙ্গিত করিলেন। প্রভুর অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া সে তখনই তথা হইতে চলিয়া গেলে এবং ত্রৈলোক্যনাথের জন্য অপর একটি পাত্রে খানিক ভাঙ আনিয়া দিল। তিনিও স্বহস্তে গ্রহণ করিয়া পান করিলেন। 

জলযোগ সমাপ্ত হইলে হস্ত প্রক্ষালন করিবার পূৰ্ব্বে ত্রৈলোক্যনাথ নিজ অঙ্গুলি হইতে একটি অঙ্গুরীয়ক উন্মোচন করিলেন, হরিসাধন এতক্ষণ সেদিকে লক্ষ্য করেন নাই। অতি সুন্দর ও উজ্জ্বল পান্নাবসান আংটা দেখিয়া পরীক্ষার জন্য তিনি উহা বন্ধুর হস্ত হইতে গ্রহণ করিলেন এবং স্বয়ং কিছুক্ষণ অতি মনোযোগের সহিত নিরীক্ষণ করিয়া মাধার হস্তে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “পান্নাখানি বড় সুন্দর -না মাধা?” 

মাধা এতক্ষণ নির্নিমেষ নয়নে সেই অঙ্গুরীয়কের দিকে চাহিয়াছিল। ব্যস্তসমস্ত হইয়া প্রভুর নিকট হইতে আংটীটি গ্রহণ করিয়া সতৃষ্ণনয়নে অবলোকন করিতে লাগিল। 

কিছুক্ষণ অতি মনোযোগের সহিত পরীক্ষা করিয়া মাধা বলিল “আসল পান্না, অনেক দাম।” 

ত্রৈলোক্যনাথ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। পান্নাখানির দাম বাস্তবিকই অনেক। মাধা দামী পাথর পরীক্ষা করিতে পারে দেখিয়া তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন কেমন করিয়া এ বিদ্যা লাভ করিলে মাধা?”

মাধা ঈষৎ হাসিল। পরে বলিল “আমি যাঁর চাকর ছিলাম, তিনি একজন জহুরী। তিনিই আমায় এ বিদ্যা দিয়েছিলেন।” 

ত্রৈ। তুমি কি কখনও তাঁহার রত্নগুলি দেখিয়াছিলে? 

মা। কতবার, আমি তাহার প্রত্যেকখানি চিনি। 

ত্রৈ। দেখিলে বলিতে পার? 

মা। নিশ্চয়ই পারি কিন্তু আর যে সেগুলিকে দেখিব এমন আশা নাই। 

ত্রৈ। কেন? 

মাধা ঈষৎ হাসিল, সস্মিতমুখে বলিল “আপনি কি মনে করেন, সামান্য চোরে সেই রত্ন চুরি করিয়াছে? কখনও না।” 

ত্রৈ। না-কেন? 

মা। কেন না, তাহাদিগকে কেহই বিক্রয় করিতে সাহস করিবে না। সাধারণ লোকে সে সকল পাথর কিনিতে পারিবে না। 

ত্রৈলোক্যনাথ মাধার কথায় সায় দিলেন, ভাবিলেন, তাহার অনুমান সত্য। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কে চুরি করিল?” 

মা। আমার বোধ হয় যাহারা কার্য্য করে, তাহাদের দ্বারাই সেগুলি চুরি হইয়াছে। আমার প্রভুর নিকট যে সকল মূল্যবান রত্ন ছিল, অনেক রাজার নিকটও তেমন জিনিষ নাই। কে কাহার মনের কথা বলিতে পারে? বিক্রয় করিয়া অর্থ লাভের জন্য তাহারা চুরি করে নাই। কেবল সঞ্চয়ের জন্যই করিয়াছে। 

ত্রৈ। এমন লোক আছে, যাহারা চোরাই দ্রব্য বিনা বাক্যব্যয়ে ক্রয় করিতে পারে। যেরূপ লোকের কথা তুমি বলিলে, আমি তাহাদের কয়েকজনকে চিনি। তাহাদের ভিতর অন্ততঃ একজন এরূপ প্রকৃতির লোক আছে। 

মাধা কোন উত্তর করিল না। সে ধীরে ধীরে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

রাত্রি এক প্রহর উত্তীর্ণ হইয়াছে। হরিসাধনের প্রকাণ্ড অট্টালিকা রজত শুভ্র চন্দ্রকিরণে উদ্ভাসিত হইয়াছে। তারকাবিহীন সুনীল অম্বর-পথে শ্বেতবর্ণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেঘমালা পবন-হিল্লোলে সঞ্চালিত হইতেছে। পথশ্রমে ক্লান্ত হওয়ায় ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্রামার্থ নির্দ্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে গমন করিলেন। 

গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ ভিতর দিক হইতে দ্বাররুদ্ধ করিয়া দিলেন। সিদ্ধির ঝোঁকে তাঁহার মস্তিষ্ক বিঘূর্ণিত হইতেছিল। তখনই শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। 

গৃহের এক পার্শ্বে একটি সুন্দর আলোকাধারে অতি ক্ষীণ আলোক জ্বলিতেছিল। ঘরের সকল জানালা রুদ্ধ ছিল। ত্রৈলোক্যনাথ শয়ন করিলেন বটে কিন্তু সহসা নিদ্রা যাইতে পারিলেন না। বায়ু সঞ্চালনের পথ না থাকায় গৃহটি শীঘ্রই গরম হইয়া উঠিল। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মাক্ত হইল, তিনি একলম্ফে শয্যা হইতে অবতরণ করিয়া একটি জানালার নিকট গমন করিলেন। 

জানালা খুলিয়া ত্রৈলোক্যনাথ দেখিলেন, আকাশে প্রায় পূর্ণচন্দ্ৰ উদিত হইয়াছে। সেই প্রাসাদ সদৃশ অট্টালিকা ও তাহার চতুষ্পার্শ্বদেশ কোমল স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত হইয়াছে। মধ্যে মধ্যে এক এক খণ্ড মেঘ আসিয়া চন্দ্ৰকে আবৃত করিতেছে। আলো ও ছায়ায় যেন লুকোচুরি খেলা করিতেছে। 

উন্মুক্ত বাতায়ন পথ দিয়া গৃহ মধ্যে জোছনা প্রবেশ করিল। প্রকোষ্ঠাভ্যন্তর অপেক্ষাকৃত শীতল হইল। ত্রৈলোক্যনাথ পুনরায় গিয়া শয়ন করিলেন। 

দুগ্ধফেননিভ মখমলাচ্ছাদিত অতি সুকেমাল শয্যায় শয়ন করিয়াও ত্রৈলোক্যনাথ নিদ্রিত হইতে পারিলেন না। তাঁহার মনে নানা প্রকার চিন্তার উদয় হইল। তখন ভাবিলেন, হরিসাধন কেমন করিয়া ভাড়াটে বাটীতে বাস করিবেন। চিরকাল সুখে প্রতিপালিত হইয়া কেমন করিয়া তিনি কষ্টের মুখ দেখিবেন। তাঁহার ভূসম্পত্তি সামান্য নহে। অনেক ধনকুবের তাহার জন্য লালায়িত। এমন সম্পত্তি তাঁহার হস্তচ্যুত হইবে! আবার ভাবিলেন, কে তাঁহার পিতার সেই বহুমূল্য রত্নগুলি চুরি করিল? পুলিস এত মূল্যবান দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে জানিয়াও নিশ্চিন্ত কেন? কে এ রহস্য ভেদ করিবে? তখন ভাবিলেন, বাহির হইতে কেমন করিয়া চোর আসিতে পারে? যাহা শুনিয়াছিলেন, চোর তাহাতে তাঁহার বিশ্বাস হইল না। আবার যদি বাহিরের চোর না আসিল, তবে কে সেই রত্নরাজি চুরি করিল? বাড়ীর মধ্যে একমাত্র চাকর মাধা। কিন্তু তাহার মত বিশ্বাসী লোক অতি অল্পই দেখা যায়। হরিসাধনের পিতা মাধাকে সৰ্ব্বস্ব দিয়া রাখিয়াছিলেন হরিসাধনও এখন মাধাকে বাড়ীর কর্তার মত করিয়া রাখিয়াছিল। সে যে এমন কার্য্য করিবে তাহা বোধ হয় না। বিশেষতঃ মৃত প্রভুর জন্য সে এখনও সামান্য কথায় রোদন করে। মাধা কখনও প্রভুকে হত্যা করে নাই। 

এইরূপ চিন্তার পর ত্রৈলোক্যনাথ পুনরায় শয্যা ত্যাগ করিলেন এবং গৃহের আলোক নির্বাপিত করিয়া পুনরায় শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁহার তন্দ্রা আসিল। 

কতক্ষণ যে তাঁহার তন্দ্রাভাব ছিল তাহা ত্রৈলোক্যনাথ স্থির করিতে পারিলেন না। কিন্তু সহসা চমকিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বোধ হইল, ঘরের ভিতর কি যেন নড়িতেছে। তিনি কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হইয়া রহিলেন। কিন্তু আর কোন শব্দ শুনিতে পাইলেন না। ভাবিলেন, গৃহে হয় ত ইঁদুরের বাসা আছে। তাহারাই ওইরূপ শব্দ করিতেছে। এই ভাবিয়া পুনরায় নিদ্রিত হইবার চেষ্টা করিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে ত্রৈলোক্যনাথ পুনরায় চমকিত হইলেন। এবার তাঁহার স্পষ্টই বোধ হইল, যেন গৃহে তিনি একা নহেন। তিনি জানালার দিকে চাহিলেন, দেখিলেন রুদ্ধ। অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। কিছু পূর্ব্বে তিনি জানালা খুলিয়া দিয়াছিলেন, এখন কিরূপে বদ্ধ হইল? 

তিনি আবার শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং জানালা খুলিয়া দিলেন, জ্যোৎস্নালোকে তাহার সাহস হইল, তিনি ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলেন না। 

পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে ঘরটি প্রকাণ্ড, জানালার নিকট হইতে প্রায় বার হস্ত দূরে শয্যা। বাতায়ন পথ দিয়া যে জ্যোৎস্না গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল তাহাতে ঘরের অতি অল্প অংশই আলোকিত হইয়াছিল। 

বাতায়ন উন্মুক্ত করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ যেমন পুনরায় শয্যায় প্রবেশ করিতে উদ্যত হইবেন, সেই সময় একখণ্ড মেঘ আসিয়া চন্দ্ৰকে আবৃত করিল। গৃহ মধ্যস্থ চন্দ্রালোকও সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হইল। সেই অবসরে ত্রৈলোক্যনাথ গৃহ মধ্যে কোন মনুষ্যের সমাগম অনুভব করিলেন। তাঁহার বেশ বোধ হইল, গৃহের ভিতর কোন লোক প্রবেশ করিয়াছে। তিনি বিস্মিত হইলেন, স্বয়ং তিনি গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়াছেন। সেই দ্বার ভিন্ন গৃহ প্রবেশের দ্বিতীয় পথ নাই, তাহাও শুনিয়াছিলেন। কেমন করিয়া তবে সেই মানবমূৰ্ত্তি গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিল? 

এইরূপ চিন্তা করিয়া পুনর্ব্বার শয্যায় শয়ন করিলেন। কিন্তু নিদ্রা আসিল না। কিছুক্ষণ পরে উন্মুক্ত বাতায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ গৃহাভ্যন্তরস্থ জ্যোৎস্নালোকে মানবের ছায়া দেখিতে পাইলেন, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইল। তিনি একদৃষ্টে সেই ছায়ার দিকে চাহিয়া রহিলেন। দেখিতে দেখিতে ছায়া যেন মিলাইয়া গেল। ত্রৈলোক্যনাথের নির্ভীক হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হইল। 

জানালার নিকটস্থ একখানি কৌচের উপর ত্রৈলোক্যনাথ নিজ বস্ত্র রাখিয়া বন্ধুর একখানি কাপড় পরিয়া শয়ন করিয়াছিলেন। বস্ত্রাদির নিকট তাঁহার অঙ্গুরীয়কটিও রাখিয়া দিয়াছিলেন। 

সভয়নেত্রে ত্রৈলোক্যনাথ সেই জানালার দিকে চাহিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই ছায়া তাঁহার নয়নপথে পতিত হইল। তিনি ভয়চকিতনেত্রে সেই ছায়া লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে তিনি দেখিলেন, ছায়া সরিয়া গেল। এক অস্পষ্ট মানবাকৃতি তাঁহার নয়ন গোচর হইল। তিনি দেখিলেন, সে ধীরে ধীরে সেই কৌচের নিকট গমন করিল। তাঁহার বোধ হইল, সে যেন তাঁহার অঙ্গুরীয়কের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। ত্রৈলোক্যনাথ তাহার মুখ দেখিতে পাইলেন না। সে তাহার মস্তক অবনত করিয়া অতি মনোযোগের সহিত আংটীটি লক্ষ্য করিতেছিল। তিনি দেখিলেন, তাহার মাথায় একটা জরীর টুপী। হরিসাধনের মুখে শুনিয়াছিলেন তাহার পিতা সেইরূপ জরির টুপী মাথায় দিতে বড় ভালবাসিতেন এবং প্রায় সদাই পশ্চিম দেশবাসিগণের মত পোষাক পরিতেন। 

ত্রৈলোক্যনাথ ভীত হইলেন। এতকাল ভূত দেখেন নাই, মনে বড়ই সাহস ছিল কিন্তু এখন সম্মুখে সেই মূৰ্ত্তি দেখিয়া তাঁহার সকল সাহস দূর হইল। পূর্ব্বে ভূত দেখিবার আগ্রহ প্রকাশ করিলেও এখন তাঁহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। তাঁহার স্পষ্টই অনুমান হইল যে, হরিসাধনের পিতার প্রেতমূর্ত্তি সে ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। তিনি মূল্যবান প্রস্তর বড় ভালবাসিতেন। তাই তিনি তাঁহার পান্নাবসান আংটার দিকে নির্নিমেষ নয়নে চাহিয়া আছেন। 

সহসা ত্রৈলোক্যনাথের সাহস হইল। তিনি শয্যা হইতে ধীরে ধীরে অবতরণ করিলেন এবং অতি সন্তর্পণে সেই মূর্তির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহাকে অধিক দূর যাইতে হইল না। নিমেষ মধ্যে কে যেন তাঁহার গলা ধরিয়া সবলে পশ্চাতে ধাক্কা দিল। 

বলিষ্ঠ হইলেও ত্রৈলোক্যনাথ হঠাৎ আক্রান্ত হইয়া পড়িয়া গেলেন এবং তখনই হতচেতন হইলেন। 

যখন তাঁহার জ্ঞান সঞ্চার হইল, যখন তিনি চক্ষু উন্মীলন করিলেন, তখন বেলা হইয়া গিয়াছে। উন্মুক্ত বাতায়ন পথে নবোদিত সূর্য্য-কিরণ প্রবেশ করিয়া গৃহ আলোকিত করিয়াছে। 

ত্রৈলোক্যনাথ লম্ফ দিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। তাঁহার বোধ হইল কে যেন তাঁহার গৃহদ্বারে করাঘাত করিতেছে। তিনি বুঝিতে পারিলেন। বেলা হইয়াছে দেখিয়া হরিসাধনই তাঁহার সংবাদ লইতে আসিয়াছেন বুঝিয়া তিনি তখনই দ্বার উন্মোচন করিলেন। দেখিলেন, তাঁহার অনুমান সত্য। তিনি লজ্জিত হইলেন; সহসা কোন কথা বলিতে পারিলেন না। 

হরিসাধন তাঁহার মনোগত ভাব বুঝিয়া ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাই! কাল বেশ ঘুম হইয়াছিল ত? কোনরূপ ব্যাঘাত হয় নাই?” 

ত্রৈলোক্যনাথের মস্তক তখন ঘুরিতেছিল, গত রাত্রে তিনি একে একে সেই সকল কথা বন্ধুর নিকট সবিশেষ ব্যক্ত করিলেন। তিনি যে সত্য সত্যই প্রেতাত্মার দর্শন পাইয়াছিলেন এবং সেই প্রেতমূর্ত্তি তাহার যে গলা টিপিয়া ধরিয়াছিল, তাহা তাঁহার বিশ্বাস হইল না। তিনি ভাবিলেন, সিদ্ধির ঝোঁকে এ ওই সকল খেয়াল তাঁহার মনোমধ্যে উদয় হইয়াছিল। লজ্জায় তিনি তখন সে সকল কথা চাপিয়া গেলেন। 

হরিসাধন তাঁহার মলিন মুখ ও রক্তবর্ণ চক্ষু দেখিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহার নিদ্রার কোনরূপ ব্যাঘাত হইয়াছিল কি না? 

বন্ধুর নির্ব্বন্ধাতিশয় দর্শনে ত্রৈলোক্যনাথ গৃহ মধ্যে মানব-সমাগমের কথা বলিলেন। হরিসাধন হাসিয়া উঠিলেন। তিনি বলিলেন “উহাও যে তোমার মিথ্যা কল্পনা মাত্র তাহাতে সন্দেহ নাই। নতুবা কেমন করিয়া আবদ্ধ গৃহে অপর লোকে প্রবেশ করিবে?” 

ত্রৈলোক্যনাথও হাসিয়া বলিলেন “যে রাত্রে তোমার পিতার সেই রত্নরাজি অপহৃত হইয়াছিল, সে রাত্রেই বা অপরে কেমন করিয়া গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল?” 

হ। ভাল, যদি গত রাত্রে চোরই আসিয়া থাকে, তাহা হইলে সে জরির টুপী মাথায় দিয়া আসিবে কেন?

ত্রৈ। তোরই মুখে শুনিয়াছিলাম যে, তোর পিতা জরির টুপী পরিতে ভালবাসিতেন। যদি চোর না হয় তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই তোর পিতার প্রেতাত্মা। 

হ। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে সে তোকে আক্রমণ করিবে কেন? তোর সহিত তাঁহার শত্রুতা ছিল না। বরং তিনি তোকে আমার মত ভালবাসিতেন। কেন তাঁর প্রেতাত্মা তোর গলা টিপিয়া ধরিবে? 

ত্রৈলোক্যনাথ তাহার কোন কারণ নির্দ্দেশ করিতে পারিলেন না। তাঁহাকে লজ্জিত দেখিয়া হরিসাধন সে কথা চাপা দিয়া বলিলেন “অনেক দিন পরে সিদ্ধি খাইয়া তোর মাথা গরম হইয়াছে। বেশ করিয়া তৈল মাখিয়া আগে স্নান করিয়া আয়। মাথাটা শীতল হইলেই তোর দুশ্চিন্তা দূর হইবে।” 

ত্রৈলোকন্যাথ দ্বিরুক্তি করিলেন না। ইত্যবসরে মাধা তৈলাদি আনয়ন করিল। হরিসাধন ঈষৎ হাসিয়া মাধার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “গত রাত্রে ইনি বাবার প্রেতমূর্তি দেখিয়াছেন।” 

মাধা চমকিত হইল। ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে সে বলিল “আশ্চৰ্য্য নহে, আমি ত সেই জন্যই উহাকে ঘরে শয়ন করিতে বার বার নিষেধ করিয়াছিলাম।” 

এই বলিয়া মাধা চলিয়া গেল। তখন হরিসাধন বলিলেন “দুজনে একসঙ্গে স্নান করিব, তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি তৈল রাখিয়া আসি।” 

হরিসাধন প্রস্থান করিলেন। ত্রৈলোক্যনাথ তৈলের বাটী লইয়া পুনরায় সেই প্রকোষ্ঠে গমন করিলেন এবং দেখিলেন, তাঁহার আংটীটা যথাস্থানেই রহিয়াছে। তিনি ভাবিলেন, যদি চোর আসিত, তাহা হইলে সে আংটীটা রাখিয়া যাইত না। তিনি নিজের গলায় হাত দিলেন। দেখিলেন সেখানে বেশ বেদনা হইয়াছে। গৃহ মধ্যে একখানা প্রকাণ্ড আয়না ছিল। তিনি তাহার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। দেখিলেন, তাঁহার গলায় লাল চিহ্ন রহিয়াছে। যদি প্রেতাত্মা আসিয়া থাকে, তাহা হইলে সে তাঁহাকে আক্রমণ করিবে কেন? আর তাঁহার গলায় সেরূপ চিহ্নই বা হইবে কেন? তিনি ভাবিলেন তাঁহার বন্ধুকে সেই দাগ দেখাইবেন কিন্তু পরক্ষণেই মনে করিলেন, তিনি হয় ত বলিবেন, সিদ্ধির নেশায় তিনি নিজেই ওইরূপ দাগ করিয়া থাকিবেন। তিনি জানালার নিকট গমন করিলেন এবং সকল স্থান উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলেন। কিন্তু সন্দেহজনক কোন চিহ্নই দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি কি ভাবিয়া মেঝের উপর শুইয়া পড়িলেন এবং সেই অবস্থায় চারিদিক লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। 

কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর তিনি যেমন গাত্রোত্থান করিতে উদ্যত হইবেন অমনই সেই শয্যার পার্শ্বে মসারি চাপা কি একটা পদার্থ নয়ন গোচর হইল। ত্রৈলোক্যনাথ লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং নিমেষ মধ্যে শয্যা পার্শ্বে গিয়া উহা তুলিয়া লইলেন। দেখিলেন, একটা জরির টুপী। 

ত্রৈলোক্যনাথ অতি মনোযোগের সহিত টুপীটা পরীক্ষা করিতেছেন এমন সময়ে গৃহ দ্বার হইতে তাঁহার বন্ধু ডাক দিলেন। তখন তাঁহাকে সে কথা না বলিয়া তিনি টুপীটা যেখানে ছিল তথায় রক্ষা করিলেন এবং সত্বর গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া হরিসাধনের নিকটে আগমন করিলেন। তিনি ভাবিলেন, তাঁহার বন্ধু সে গৃহে আসিলে স্বয়ং উহা দেখিতে পাইবেন। 

উভয় বন্ধুতে মিলিয়া স্নান করিলেন। বাগানের মধ্যে এক প্রকাণ্ড পুষ্করিণী ছিল। উহার জল এত পরিষ্কার যে, নিকটস্থ লোকেরা তাহা পান করিয়া থাকে। স্নানের পর পুনরায় উভয়ে অট্টালিকায় প্রবেশ করিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

স্নান করিয়া ত্রৈলোক্যনাথের মস্তিষ্ক শীতল হইল। হরিসাধন নিজ গৃহে প্রবেশ করিলেন, ত্রৈলোক্যনাথও বস্ত্র পরিবর্তনের জন্য পূর্ব্বগৃহে আগমন করিলেন। সিক্ত বসন ত্যাগ করিয়া নিজ বস্ত্র পরিধান করিবামাত্র তিনি শয্যার নিকট গমন করিলেন। দেখিলেন, টুপীটা সেখানে নাই। 

ত্রৈলোক্যনাথ বিরক্ত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, সত্য সত্যই তাঁহার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছিল। যদি তিনি যথার্থই টুপীটা দেখিতেন, তাহা হইলে সেটা গেল কোথায়? কে উহা গ্রহণ করিল? তিনি আর একবার ভাল করিয়া গৃহের চারিদিকে নিরীক্ষণ করিলেন। দেখিলেন, স্নান করিতে যাইবার পূর্ব্বে তিনি আংটীটা যেখানে দেখিয়াছিলেন এখন আর সেখানে নাই, আর একটা টেবিলের উপর রাখিয়াছে। তবে কি তাঁহার সমস্তই ভ্রম? না সত্যই কোন লোক ইত্যবসরে সেই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল? 

অনেক চিন্তা করিয়াও ত্রৈলোক্যনাথ সেই অদ্ভুত রহস্য ভেদ করিতে পারিলেন না। তাঁহার মনে হইল তিনি সত্যই সেই জরির টুপীটা দেখিয়াছেন। ভাবিলেন, বন্ধুকে সে কথা বলিবেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁহার অন্যরূপ সন্দেহ হইল। 

বাড়ীতে এক মাধা ভিন্ন দ্বিতীয় লোক নাই। হয় ত সেই তাঁহার অনুপস্থিতি কালে সেই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। আরও কিছুক্ষণ চিন্তার পর তাঁহার সন্দেহ সত্যে পরিণত হইল। তাঁহার বিশ্বাস হইল, যখন তিনি স্নান করিতে গিয়াছিলেন, সেই সময়ে মাধাই সে গৃহে প্রবেশ করিয়া টুপীটা লইয়া গিয়াছে এবং আংটীটা স্থানান্তরিত করিয়াছে। তিনি ভাবিলেন, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে গত রাত্রে মাধাই তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল। তাহার প্রভু যেমন মূল্যবান প্রস্তর ভালবাসিতেন এবং যথেষ্ট অর্থব্যয় করিয়া সেই সকল সঞ্চয় করিতেন, সেও তেমনিই বহুমূল্য হীরকাদি মণি মুক্তা ভালবাসে। ত্রৈলোক্যনাথের পান্নাবসান আংটীটা সে যেরূপ আগ্রহের সহিত পরীক্ষা করিয়াছিল তাহাতে তিনি তাহার উপরে সে সন্দেহ করিলেন। কিন্তু সে কথা তাঁহার বন্ধুর সমক্ষে বলিতে সাহস করিলেন না। তিনি জানিতেন, হরিসাধন মাধার হস্তে সমস্ত দিয়া রাখিয়াছেন, তিনি যে তাঁহার পুরাতন চাকরের প্রতি অবিশ্বাস করিবেন, তাহা কখনও সম্ভব নহে। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ পুনরায় ভাবিলেন, যদি মাধাকেই গত রাত্রে তাঁহার শয়ন-গৃহে দেখিয়া থাকেন, তাহা হইলে সে কেমন করিয়া গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিল? শয়ন করিবার পূর্ব্বে তিনি গৃহের দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়াও ত্রৈলোক্যনাথ সেই প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিলেন না, কেমন করিয়া যে সে সেই গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা তিনি তখন অনুমান করিতে পারিলেন না। তবে তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে, মাধাই হরিসাধনের পিতার সেই বহুমূল্য রত্ন সমূহ অপহরণ করিয়াছে। কিন্তু কেমন করিয়া যে তিনি তাহা প্রমাণ করিবেন, তাহার উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলেন না। 

ত্রৈলোক্যনাথ যখন এইরূপ চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন, তখন হরিসাধন তথায় উপস্থিত হইলেন এবং বন্ধুর হাত ধরিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। ত্রৈলোক্যনাথ একবার ভাবিলেন, তাঁহার সন্দেহের কথা বন্ধুর নিকট খুলিয়া বলেন কিন্তু পরক্ষণেই তাঁহার মতের পরিবর্তন হইল। তিনি ভাবিলেন, যখন তাঁহার বন্ধু মাধাকে সৰ্ব্বস্ব দিয়া বিশ্বাস করিয়াছেন, তখন তিনি যে তাহাকে অবিশ্বাস করিবেন, তাহা সম্পূর্ণ অসম্ভব। হয় ত মাধাকে তাঁহার কথা বলিয়া দিবেন। মাধা চতুর লোক যে তাঁহার ইঙ্গিত পাইলেই সাবধান হইবে। সুতরাং রত্নগুলি পুনঃপ্রাপ্ত হইবার আশা থাকিবে না। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি হরিসাধনকে জিজ্ঞাসা করিলেন “মাধা তোদের এখানে কত দিন আছে বলিতে পারিস? আমি ত বহুদিন হইতে উহাকে তোদের বাড়ীতে দেখিতেছি।” 

বন্ধুর কথায় কিছুমাত্র সন্দেহ না করিয়া হরিসাধন ঈষৎ হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ঠিক কতদিন আছে আমি জানি না, তবে যখন মাধা এখানে চাকরী করিতে আইসে, তখন তাহার বয়স আট বৎসর মাত্র। সেই অবধিই সে আমাদের বাড়ীতে চাকরী করিতেছে। 

ত্রৈ। এখন উহার কত বয়স? 

হ। আন্দাজ পঞ্চাশ বৎসর। 

ত্ৰৈ। এত! উহাকে দেখিলে ত তত বলিয়া বোধ হয় না। এখনও দেহে যথেষ্ট বল আছে। 

হ। নিশ্চয়ই, একা এই বাড়ীর সকল কাজ করা বড় সহজ কথা নয়। 

ত্রৈ। তোর পিতাও কি শেষ অবস্থায় অপর সকল চাকরকে কাজ হইতে জবাব দিয়াছিলেন? 

হ। না দিয়া করেন কি? পাওনাদারগণ এত উৎপীড়ন আরম্ভ করিয়াছিল যে, তিনি বাধ্য হইয়া সকল খরচই কমাইয়া দিয়াছিলেন। 

ত্রৈ। তবু ত বিষয়টা রাখিতে পারিলেন না? 

হ। কেমন করিয়া পারিবেন? যদি একখানি পাথর বিক্রয় করিতেন, তাহা হইলেই সকল দেনা শোধ হইত। আমি অনেক বুঝাইয়াছিলাম। 

ত্রৈ। তিনি কিছু বলিয়াছিলেন? 

হ। তিনি বলিয়াছিলেন, যতদিন জীবিত থাকিবেন, পাথরগুলি বিক্রয় করিবেন না। তাঁহার অবর্তমানে আমি বিক্রয় করিয়া দেনা শোধ করিব। 

এই বলিয়া হরিসাধন বিমর্ষ হইলেন। ত্রৈলোক্যনাথ তাহা দেখিতে পাইলেন। তিনি আর কোন কথা তুলিলেন না। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

বেলা দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। প্রচণ্ড মার্তণ্ড তাপে উত্তপ্ত হইয়াই যেন পবন চারিদিকে ছুটাছুটি আরম্ভ করিয়াছে। বিহগকুল তৃষ্ণাৰ্ত্ত হইয়া জলান্বেষণে প্রবৃত্ত হইয়াছে। রাখালগণ স্ব স্ব ধেনুপাল ছাড়িয়া বৃক্ষের ছায়ায় শ্যামল দূর্ব্বাশয্যায় শয়ন করিয়াছে। কেহ বা বংশী লইয়া আনন্দিত মনে বাজাইতে আরম্ভ করিয়াছে। 

হরিসাধন বন্ধুর আহারের জন্য বিবিধ সামগ্রীর আয়োজন করিয়াছিলেন, মাধাকে অতি যত্ন সহকারে সেগুলি পাক করিতে হইয়াছিল, উভয়ের আহার করিতে অনেক বিলম্ব হইল। 

আহারাদি শেষ হইলে হরিসাধন জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ এখানে থাকা হবে ত তিলক? 

আন্তরিক দুঃখিত হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন, আমার বড় ইচ্ছা, কিছুদিন তোর এই জমীদারীতে বাস করি। কাজের জন্য আমাকে অনেক দূরদেশে যাইতে হইয়াছে। আমি অনেক গ্রাম ও নগর দেখিয়াছি, কিন্তু তোর জমীদারী আমার বড় ভাল লাগে। এমন সুদৃশ্য গ্রাম আমি আর কোথাও দেখি নাই। এমন সম্পত্তি জন্মের মত তোর হাত হইতে যাইতেছে শুনিয়া আমার বড় কষ্ট হইল। 

বাধা দিয়া হরিসাধন বলিলেন “ও বিষয়ে অনেক ভাবিয়াছি কিন্তু কোন উপায় দেখি না। অত টাকা আমি কোথায় পাইব? টাকা সংগ্রহ না হইলে কি করিয়া বিষয় রক্ষা করিব? ও কথা আর তুলিস না। এখন তোর কথা বল্?” 

দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “ইচ্ছা ত থাকি কিন্তু পারি কই?” 

হ। পারিবি নাই বা কেন? 

ত্রৈ। আমার কাজ কি জানিস ত? 

হরি। খুব জানি, তিলক গোয়েন্দার নামে অনেক চোর ডাকাত সশঙ্কিত 

ঈষৎ হাসিয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “আমিও ওই রকম একটা কাজে এসেছি। আজ রাত্রে আমায় বিদায় দিতেই হবে।” 

দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া হরিসাধন বলিলেন “এখনও পাঁচ ছয় ঘণ্টা আছিস্ ত? এরই মধ্যে বিদায়ের কথা কেন?” মাধা নিকটেই ছিল। সে এতক্ষণ নীরবে সকল কথাই শুনিতেছিল। ত্রৈলোক্যনাথের বিদায়ের কথায় সে আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিল “বাবু কি আজই রওনা হইবেন?” 

ত্রৈলোক্যনাথ হাসিয়া তাহার দিকে চাহিলেন। পরে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন “তুমি আমার ঘোড়াটাকে সাজ দিও। বড় জরুরি কাজ, আমায় যেতেই হবে। কিন্তু সবার আগে এই বাড়ী ও বাগানের সকল স্থান ভালরূপ দেখে যাবার ইচ্ছা আছে।” 

হরিসাধন হাসিতে হাসিতে বলিলেন “বাড়ীর বাহিরে যেমন, ভিতরেও ঠিক তেমন। দেখে দুঃখ হবে। আর বাগান? চক্ষেই ত দেখছিস্!” 

ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “ভাল হউক আর মন্দ হউক, দেখিতে দোষ কি? মন্দ জিনিষ কি লোকে দেখে না? তুই আমার সঙ্গে না যাস্ মাধা যাবে। আমার বিশ্বাস, তোর চেয়ে ও বেশী জানে।” 

বন্ধুর প্রস্তাবে অতিশয় আনন্দিত হইয়া হরিসাধন মাধার দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, সে যেন বিরক্ত, তিনি ত্রৈলোক্যনাথকে বাড়ী ও বাগানের সমস্ত স্থান দেখাইবার জন্য মাধাকে বলিয়া দিলেন। আন্তরিক বিরক্ত হইলেও সে সম্মত হইল। 

মাধা নিজের কার্য্যে গমন করিলে ত্রৈলোক্যনাথ বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিলেন “হরি! তুই স্বচক্ষে কখনও সেই রত্নগুলি দেখেছিলি?” 

বিস্মিত হইয়া হরিসাধন বলিলেন “কতবার দেখেছি, কেন তিলক?” 

ত্ৰৈ। সৰ্ব্বশুদ্ধ কতগুলি ছিল? 

হ। একশত আটখানি। অতি উৎকৃষ্টগুলিই তিনি সঞ্চয় করিয়াছিলেন। -এ। তিনি কত টাকা ব্যয় করিয়া রত্নগুলি সংগ্রহ করিয়াছিলেন? 

হ। প্রায় কোটী মুদ্রা। তবুও সকলগুলি কেনা নয়। 

ত্রৈ। কেন? 

হ। কতকগুলি পৈতৃক। 

ঈষৎ হাসিয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “রোগটাও তাহলে পৈতৃক! বোধ হয় রত্নগুলি পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত হইয়া আসিতেছে।” 

হরিসাধন বলিলেন “তোর অনুমান সত্য। আমিও পিতা ঠাকুরের নিকট সেই রূপ শুনিয়াছি। আমার কিন্তু ওরূপ সঞ্চয়ে আদৌ ইচ্ছা ছিল না। জগদীশ্বর তাই বুঝি আমার নিকট হইতে কাড়িয়া লইলেন।” 

ত্রৈলোক্যনাথ দুঃখিত হইলেন। বন্ধুকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। মাধার সহিত যাইবার জন্য তাঁহার নিকট বিদায় লইলেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

মাধা যখন সেই প্রাসাদ সদৃশ অট্টালিকার প্রত্যেক কক্ষ, দালান, পথ, সিঁড়ি ইত্যাদি সকল স্থান প্রদর্শন করিয়া ত্রৈলোক্যনাথের সহিত বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন বেলা প্রায় শেষ হইয়াছে। অস্তোন্মুখ রবিকিরণ ব্যোমচারিণী নীরদা জালে প্রতিফলিত হইয়া অতি অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। প্রখর তেজা সহস্র রশ্মিকে হীনবল দেখিয়াই বুঝি উত্তপ্ত সমীরণ ভয়ে শীতল হইয়াছে। গোধন লইয়া রাখালগণ মেঘাকারে ধূলি উড়াইয়া মাঠ হইতে গৃহে ফিরিতেছে। 

ত্রৈলোক্যনাথ একে একে সকল স্থানই নিরীক্ষণ করিলেন। তাহাদের শ্রীহীনতা দেখিয়া অত্যন্ত ব্যথিত হইলেন। উদ্যানে আসিয়া মাধাকে বলিলেন, কতকাল এ সকলের সংস্কার হয় নাই তাহা কি তুমি বলিতে পার? 

মা। বড়বাবুর আমলে হয় নাই। 

ত্রৈ। তিনি কেবল মণিমাণিক্য লইয়াই থাকিতেন, সকলের দিকে লক্ষ্য করিতেন না। কেমন, না? 

মাধা মুখে কোন উত্তর করিল না, ঘাড় নাড়িয়া, সম্মতিসূচক উত্তর জ্ঞাপন করিল। তখন ত্রৈলোক্যনাথ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন “ভাল মাধা, বাড়ীর সকল ঘরই ত তুমি দেখালে, কই, তোমার ঘরখানি ত দেখি নাই?” 

মাধা তখন লজ্জিত হইল। সে বলিল “ঘরখানি অতি ছোট, ভিতরে দেখিবার মত কোন জিনিষই নাই।” 

এই বলিয়া অগ্রসর হইল। ত্রৈলোক্যনাথ তাঁহার অনুসরণ করিলেন। 

মাধার ঘরে গিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ দেখিলেন ঘরখানি বাস্তবিকই অতি ক্ষুদ্র, দৈর্ঘ্যে ছয় হাতের অধিক নহে। ঘরের ভিতর একখানি খাটিয়ার উপর একটি শয্যা। পার্শ্বে একটা ক্ষুদ্র জানালা, ভূমি হইতে এক হস্ত উপরে স্থিত। মেজের উপর কতকগুলি তৈজসপত্র। একটা সিন্দুক একটি বাক্স, একটি ক্ষুদ্র আলমারির উপর নিতান্ত আবশ্যকীয় কতকগুলি দ্রব্য। 

ত্রৈলোক্যনাথ শয্যার উপর বসিয়া পড়িলেন। পরে জানালার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন “পুরাতন জিনিষগুলির কেমন গঠন দেখিয়াছ? এখন পয়সা দিলেও এমন জিনিষ পাওয়া যায় না?” 

বাধা দিয়া মাধা বলিল “আপনি যথার্থই বলিয়াছেন। এমন জিনিষ মিলে না।” 

ত্রৈলোক্যনাথ শয্যা হইতে উঠিলেন। ধীরে ধীরে জানালার নিকট গমন করিলেন, দেখিলেন, যে লৌহদণ্ডের সাহায্যে হত্যাকারী গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা সেই জানালার পার্শ্বে। তিনি চমকিত হইলেন। পরে মাধার দিকে চাহিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন “এই লোহার দণ্ডটার সাহায্যেই চোর উপরে উঠিয়াছিল, কেমন মাধা?” 

মাধা বলিল “আজ্ঞে হাঁ। এটাই সকল অনিষ্টের মূল।” 

ত্রৈলোক্যনাথ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন “এত নিকটে ছিলে অথচ কোন শব্দ তোমার কানে গেল না?”

মাধা যেন কিছু বুঝিতে পারিল না। সে ত্রৈলোক্যনাথের মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “যেদিন তোমাদের বাড়ীতে চুরি হইয়াছিল, আমি সেইদিনের কথা বলিতেছি। চোর ত এই লোহার শিক ধরিয়াই উপরে উঠিয়াছিল?” 

মাধা তখনই সে কথায় সায় দিল। সে বলিল “আজ্ঞে হাঁ-ওই শিক ধরিয়াই সে উপরে গিয়াছিল। তাহার হাত ও পায়ের দাগ শিকের গায়ে স্পষ্টই দেখা গিয়াছিল।” 

ত্রৈ। সেইজন্যই ত তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। এত কাছে তুমি ছিলে অথচ কোন শব্দ পাইলে না?

মা। কই না। 

ত্রৈ। এই যে বলিতেছিলে, তোমার ঘুম বড় সজাগ। সামান্য শব্দেই তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়। 

মাধা কোন উত্তর করিল না। ত্রৈলোক্যনাথ যখন প্রথম তাঁহার গৃহে প্রবেশ করেন; তখনই তাহার ভাবান্তর উপস্থিত হইয়াছিল, যতক্ষণ তিনি ঘরে ছিলেন, ততক্ষণই সে যেন অন্যমনস্ক। এক কথায় প্রায়ই অপর উত্তর দিতেছিল। ত্রৈলোক্যনাথ প্রথমতঃ তাহার এই চিত্ত-চাঞ্চল্যের কারণ বুঝিতে পারিলেন না। কিন্তু যখন সে তাঁহার শেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না, তখনই যেন সমস্ত সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হইল। তিনি শেষ চেষ্টা করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। 

মাধাকে নিরুত্তর দেখিয়া ত্রৈলোক্যনাথ ঈষৎ হাসিলেন। পরে অতি গম্ভীর ভাবে মৃদুস্বরে বলিলেন “এখন রত্নগুলি কোথা রাখিয়াছ বল দেখি? তোমার সকল বিদ্যাই ধরা পড়িয়াছে। ভাল চাও ত দামী পাথরগুলি বাহির করিয়া দাও।” মাধা তবুও কোন কথা বলিল না। কিন্তু সে তীব্র দৃষ্টিতে ত্রৈলোক্যনাথের দিকে কটাক্ষপাত করিতে লাগিল। তাহার সুগোল চক্ষুদ্বয় হইতে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে লাগিল। ত্রৈলোক্যনাথ কিছুমাত্র ভীত বা শঙ্কিত হইলেন না। তিনি দৃঢ়তাব্যঞ্জক স্বরে বলিলেন “তুমিই গত রাত্রে আমার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিলে, তুমিই সবলে আমার গলা টিপিয়া ধরিয়াছিলে, তোমারই একটা জরির টুপী সেই বিছানার পার্শ্বে পড়িয়া ছিল। আজ প্রাতে তুমিই আবার টুপীটা লইয়া আসিয়াছ। তোমার অঙ্গুলির দাগ এখনও আমার গলায় রহিয়াছে।” 

মাধা কোন উত্তর করিল না। ক্রোধে তাহার সর্ব্ব শরীর থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল, সে সেই জানালার দিকে সরিয়া গেল। 

ত্রৈলোক্যনাথ তখন ঘরের অপর পার্শ্বে ছিলেন। মাধাকে জানালার দিকে যাইতে দেখিয়া তিনি ভাবিলেন, সে বুঝি ভয় পাইয়াছে। তিনি তাহার দিকে ভ্রুক্ষেপও করিলেন না। জানালার নিকট গিয়া তাহার ভিতর হইতে মাধা নিমেষ মধ্যে একটা লৌহদণ্ড গ্রহণ করিল এবং তখনই উত্তোলন করিয়া ত্রৈলোক্যনাথকে আক্রমণ করিল। 

ত্রৈলোক্যনাথ স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে, মাধা তাঁহাকে সহসা এরূপে আক্রমণ করিবে। তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু বহুদিন গোয়েন্দাগিরি করিয়া তাঁহার আশ্চর্য্য প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব-শক্তি জন্মিয়াছিল। তিনি তাহারই বলে মাধার হস্ত হইতে প্রথমবার নিষ্কৃতিলাভ করিলেন। 

একবার বিফল হইয়া মাধা ক্ষান্ত হইল না। সে নিমেষ মধ্যে পুনরায় সেই দণ্ড উত্তোলন করিল এবং অতি ধীরে ধীরে সতর্ক ভাবে ত্রৈলোক্যনাথের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। ত্রৈলোক্যনাথ সে আঘাত সহ্য করিতে মনস্থ করিলেন। তিনি দক্ষিণ হস্তে আপনার মস্তক রক্ষা ও বাম হস্তে দৃঢ়মুষ্টি ধরিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। 

মুহূৰ্ত্ত মধ্যে মাধা ত্রৈলোক্যনাথের মস্তক লক্ষ্য করিয়া আঘাত করিল। নির্ভীক হৃদয় ত্রৈলোক্যনাথ দক্ষিণ হস্তে মস্তক রক্ষা করিলেন বটে কিন্তু সে আঘাতে তাঁহার হস্ত ভগ্ন হইল। নিমেষে তাঁহার বজ্রমুষ্টি মাধার দ্রুদ্বয়ের ঠিক মধ্যস্থলে পতিত হইল। অস্পষ্ট শব্দ করিয়া মাধা তখনই অচেতন হইয়া পতিত হইল। 

ঠিক এই সময়ে হরিসাধন তথায় উপস্থিত হইলেন। ত্রৈলোক্যনাথ তাঁহাকে বলিলেন “মাধা! আমার হাতটা ভাঙ্গিয়া দিয়াছে।” 

কারণ জানিবার পূর্বেই হরিসাধন একজন ডাক্তার আনিবার জন্য লোক প্রেরণ করিলেন। ত্রৈলোক্যনাথ একে একে সকল কথা ব্যক্ত করিলেন। বলিলেন “মাধাই তোদের রত্নগুলি চুরি করিয়াছে, কিন্তু বিক্রয় করে নাই। তোর স্বর্গীয় পিতা ঠাকুরের মত মাধারও রত্ন সঞ্চয়ের অভিলাষ ছিল। তিনি অগাধ সম্পত্তির অধিকারী। তাঁহার সকলই সম্ভবে। মাধা সামান্য আট টাকার চাকর, সে কেমন করিয়া কোটীপতির সখ মিটাইতে পারিবে?” 

সে প্রায়ই তোর পিতার নিকট থাকিত, রত্নগুলি প্রায়ই দেখিতে পাইত এবং অতি কষ্টে লোভ সংবরণ করিত। অনেক দিন এইরূপ করিয়া অবশেষে চুরি করিল, রত্নগুলির শোকেই যে তিনি মারা পড়িয়াছেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। মাধা যে তাঁহাকে হত্যা করিবে এ কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না।” 

এত বিশ্বাসী মাধা যে রত্নগুলি চুরি করিয়াছে এ কথা হরিসাধনের বিশ্বাস হইল না। কিন্তু তাঁহার বন্ধু একজন পাকা গোয়েন্দা, তিনি যখন এতটা কাণ্ড করিয়াছেন, তখন তাঁহার কথাতেও তিনি অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তিনি কহিলেন “যদি মাধা লইয়া থাকে, তাহা হইলে সেগুলি এখনও এ বাড়ীত আছে। কেন না, একদিনের জন্য মাধা অনুপস্থিত নহে।” 

ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “তাহা হইলে এই বাড়ীরই কোন স্থানে সেগুলি লুকান আছে।” 

হতাশের হাসি হাসিয়া হরিসাধন বলিলেন “কেন ভাই লোভ দেখাস্?” 

ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “আমি মিথ্যা বলি নাই। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, গত রাত্রে মাধাই আমার শয়ন প্রকোষ্ঠে গমন করিয়াছিল, – মাধাই আমার গলা টিপিয়া ধাক্কা দিয়াছিল।” 

হরিসাধন বলিলেন “মাধা এখন অজ্ঞান। জ্ঞান হইলে যদি কখনও রত্নগুলির সন্ধান বলে, তবেই সেগুলি পাওয়া যাইতে পারে।” 

ত্রৈলোক্যনাথ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “রীতিমত অন্বেষণ করিলে নিশ্চয়ই বাহির করিতে পারা যায়।” 

এমন সময়ে ডাক্তার আসিয়া ত্রৈলোক্যনাথের হস্ত পরীক্ষা করিলেন এবং উপযুক্তরূপে বন্ধন করিয়া মাধাকে পরীক্ষা করিলেন। দেখিলেন, তাঁহার অবস্থা বড় ভাল নয়। তিনি তাঁহাকে তখনই সরকারী হাসপাতালে পাঠাইয়া দিতে পরামর্শ দিলেন। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

ত্রৈলোক্যনাথ যেরূপ আহত হইয়াছিলেন, তাহাতে হরিসাধন তাঁহাকে সেই রাত্রে ছাড়িতে পারিলেন না। অন্ততঃ এক সপ্তাহকাল সেখানে থাকিয়া কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলে বিদায় দিবেন মনস্থ করিলেন। ত্রৈলোক্যনাথ বন্ধুর অনুরোধ এড়াইতে পারিলেন না। বিশেষতঃ রত্নগুলিকে বাহির করিবার জন্য তাঁহার আন্তরিক অভিলাষ ছিল। তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মাধা সেই বাড়ীরই কোন নিভৃতস্থানে সেগুলি রাখিয়াছিল। কিন্তু যতক্ষণ তাহার জ্ঞান সঞ্চার না হইতেছে, ততক্ষণ তিনি সে সংবাদ পাইতেছেন না। 

রাত্রি এক প্রহর উত্তীর্ণ হইলে ত্রৈলোক্যনাথ তাঁহার নির্দ্দিষ্ট শয়নকক্ষে গমন করিলেন। হরিসাধন সে রাত্রি তাঁহার নিকটে থাকিয়া শুশ্রূযা করিবেন মনস্থ করিয়াছিলেন, কিন্তু ত্রৈলোক্য হাসিয়া সে কথা চাপা দিলেন। 

শয্যায় শয়ন করিয়া তাঁহার নিদ্রা হইল না। ভগ্ন হস্তের দরুণ যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ নীরবে সেই ভয়ানক যাতনা সহ্য করিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিলেন। সেদিন তিনি গৃহের আলোক নির্ব্বাপিত করেন নাই। কিন্তু তাহার ক্ষীণালোকে ঘরটার চতুর্থাংশও আলোকিত হয় নাই। যন্ত্রণার হস্ত হইতে অব্যাহতি লাভ করিবার জন্য তিনি অন্যমনস্ক হইবার চেষ্টা করিলেন। ভাবিলেন, মাধা রত্নগুলি লইয়া কি করিল? নিশ্চয়ই সে উহার একখানিও বিক্রয় করিতে সাহস করে নাই। বিক্রয় করিয়া অর্থলাভ করাও তাহার উদ্দেশ্য ছিল না। দুদণ্ড নিভৃতে সেই উজ্জ্বল মূল্যবান প্রস্তরগুলিকে দেখিয়া চক্ষুর সার্থকতা সম্পাদন করিবার জন্যই সে সেগুলি অপহরণ করিয়াছিল। মাধা যদি এই বাড়ীতে সে সকল না রাখিল, তবে আর কেথায় রক্ষা করিল? 

এইরূপ চিন্তা করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ ভাবিলেন, মাধা যদি এ বাড়ীতে রাখিয়া থাকে, তাহা হইলে এই ঘর ভিন্ন আর কোথাও রাখে নাই। এই ঘরটি তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিলে নিশ্চয়ই বাহির করা যাইতে পারে। 

এই চিন্তা করিয়া ত্রৈলোক্যনাথ শয্যা ত্যাগ করিলেন, পরে গৃহের এক পার্শ্ব হইতে আরম্ভ করিয়া গৃহ মধ্যস্থ সমুদায় আসবাব একে একে পরীক্ষা করিলেন। আলমারি দেরাজ বাক্‌স প্রভৃতিতে চাবি দেওয়া ছিল, কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথ তাঁহাদের পরীক্ষায় বিফলমনোরথ হইলেন না। তিনি একজন বিচক্ষণ গোয়েন্দা, গোয়েন্দার নিত্য ব্যবহার্য্য কতকগুলি দ্রব্য তাঁহার নিকট সর্ব্বদাই থাকিত। তিনি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে পকেট হইতে একখণ্ড লৌহ বাহির করিলেন এবং তাহার সাহায্যে সকলগুলিই খুলিয়া ফেলিলেন 

পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে চারিদিক পরীক্ষা করিলেও ত্রৈলোক্যনাথ রত্নগুলির কোন নিদর্শনই পাইলেন না। ভাবিলেন, এ ঘরে না পাইলেও এ বাড়ীতে নিশ্চয়ই আছে। 

এই প্রকারে রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল। সহসা গত রাত্রের কথা তাঁহার মনে উদয় হইল। তিনি ভাবিলেন, গত রাত্রে কি জন্য মাধা ঘরে আসিয়াছিল? যদি পান্নাবসান আংটীর জন্য যাইত তাহা হইলে সেটি রাখিয়া আসিত না-নিশ্চয়ই লইতে পারিত। যদি তাঁহাকে হত্যা করিবার উদ্দেশ্যে আসিত, তাহা হইলে তাহা শেষ না করিয়া ফিরিল কেন? 

কিছুক্ষণ ভাবিয়া ত্রৈলোক্যনাথ স্থির করিলেন, মাধা ওরূপ কোন কার্য্যের জন্য আইসে নাই। সে সেখান হইতে রত্নগুলি সরাইবার জন্যই রাত্রে হরিসাধনের পিতার প্রেতমূর্ত্তির ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছিল। সে যে তাঁহার যাইবার পূর্ব্বে গৃহ মধ্যে কোথাও লুক্কায়িত ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। 

কারণ সে মনে জানিত, যদি হরিসাধন কিছুদিবস ওই স্থানে বাস করেন, তাহা হইলে নানা কারণে তিনি সকল রত্ন-অপহরণকারী বলিয়া মাধাকেই স্থির করিবেন ও পরিশেষে মাধাকেই বিপদে ফেলিবেন। ভূতের ভয় পাইলে আর তিনি এখানে অধিকক্ষণ থাকিবেন না, এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিবেন। এই ভাবিয়াই মাধা ভূত সাজিয়া তাঁহাকে ভয় প্রদর্শন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। রত্নগুলি মাধা হরিসাধনের পিতৃ-গৃহে কোন না কোন স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। যে সময় হরিসাধন তাহাকে ঘরটি পরিষ্কার করিয়া, ত্রৈলোক্যনাথের শয়ন করিবার নিমিত্ত বিছানাদি ঠিক করিতে বলিয়াছিল, সেই সময় সে রত্নগুলি স্থান হইতে স্থানান্তরিত করে। পরে সে যখন বুঝিতে পারে যে, ত্রৈলোক্যনাথ অদ্যই স্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিবে, তখন তাহাদিগের অনুপস্থিতিতে অর্থাৎ স্নান করিবার সময় সে পুনরায় রত্নগুলি ওই স্থানে রাখিয়া আসিতে পারে, কারণ সে যে সেই সময় ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহার আংটীটি স্থানান্তরিত করা ও জরির টুপীটি ঘর হইতে লইয়া যাওয়াই তাহার প্রমাণ। ওই ঘর ভিন্ন রত্নগুলি রাখিবার উপযুক্ত স্থান এই বাড়ীর ভিতর আর নাই। কারণ পুঁতিয়া রাখিলে সেই রত্নগুলি সর্ব্বদা দেখিবার সুযোগ তাহার ঘটিবে না। বিশেষ ভূতের ভয়ে ওই ঘরের ভিতর কি রাত্রিকালে, কি দিবাভাগে কেহই প্রবেশ করে না। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি আর বিফল পরিশ্রম করিলেন না। মাধা যে সেগুলি সেই গৃহ হইতে স্থানান্তরিত করিয়াছিল ও পুনরায় ওই ঘরেই রাখিবার সম্ভাবনা তাহা তিনি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু আবার মনে করিলেন, যদি সে উহা অপর স্থানে রাখিয়া থাকে, তবে মাধা সেগুলি কোথায় রখিল? তিনি স্বচক্ষে তাহার গৃহের প্রত্যেক সামগ্রী দেখিয়াছেন। সেখানে সেই মূল্যবান পাথরগুলির চিহ্নও দেখিতে পান নাই। 

ত্রৈলোক্যনাথ কিছুক্ষণ এ প্রশ্নের উত্তর ঠিক করিতে পারিলেন না। পরে স্থির করিলেন, যখন মাধা জানিতে পারিয়াছিল, যে তিনি রাত্রেই সেস্থান ত্যাগ করিবেন, তখনই সে সেই রত্নগুলিকে পুনরায় এই গৃহ মধ্যে রাখিয়া দিয়াছে। রত্নগুলি নিশ্চয়ই এই ঘরে আছে। 

আবার ভাবিলেন, এই ঘরে বলা যায় না। পূর্বতন জমীদার রত্নগুলি রক্ষার জন্য নিশ্চয়ই কোন গোপনীয় স্থান নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন। মাধা নিশ্চয়ই সেস্থান জানে, গোলযোগ মিটিলে পর সে সেই স্থানেই উহাদিগকে রাখিয়াছিল এবং এখনও রাখিয়াছে। 

এইরূপ চিন্তায় রাত্রি শেষ হইল। ঊষার আলোকের সঙ্গে সঙ্গে হরিসাধন তাঁহার গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। বন্ধুর মুখ দেখিয়াই তিনি বুঝিতে পারিলেন, তিনি রাত্রি জাগরণ করিয়াছেন। মনে করিলেন হস্তের যন্ত্রনায় তাঁহার ঘুম হয় নাই। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, তিলক। হাতের যন্ত্রনায় রাত্রে কি তোর ঘুম হয় নাই? 

ঈষৎ হাসিয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “না ভাই, সেজন্য নয়, তোর সেই রত্নগুলিই আমার জাগরণের কারণ।” হরিসাধন বলিলেন “যদি তোর দৃঢ়বিশ্বাস থাকে, তবে কোন লোক দ্বারা বাড়ীটা খোঁজ করা হউক।” ত্রৈলোক্যনাথ ব্যথিত হইলেন। ভাবিলেন, অপর লোক যদি বাহির করিতে পারে, তিনিই বা না পারিবেন কেন? কিন্তু মনোভাব কোনরূপ প্রকাশ না করিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন “তার পিতার এত যত্নের সেই পাথরগুলি তিনি কোথায় রাখিতেন জানিস্?” 

ঈষৎ হাসিয়া হরিসাধন বলিলেন “কেন, সেই হাতির দাঁতের ছোট বাক্সটার ভিতর।” 

ত্রৈলোক্যনাথ কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “সে কি! আবার ফেরত পাইলে কেমন করিয়া?” “বাগানের একটা আম গাছের তলায়। এ রকম দুটি বাক্‌স ছিল, একটি কিছুদিন পূর্ব্বে হারাইয়া যায় তাহারই দিন কয়েক পরে রত্নগুলি চুরি যায়। পুলিসের লোকে চারিদিক অন্বেষণ করিয়াছিল। তাহারাই বাক্‌সটা পাইয়াছিল।” 

ত্রৈ। রত্ন সমেত বাক্সটি তিনি কোথায় রাখিতেন? নিশ্চয়ই কোন গোপনীয় স্থান ছিল। 

হ। ছিল বে কি! বিছানার ভিতরই বাসটি রাখিতেন। 

অতীব বিস্মিত হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “এ বিছানার ভিতর! তুই ঠিক জানিস্? আমি যে রাত্রে তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াছি। কই, কিছুই ত দেখিতে পাইলাম না? স্থানটা কি তোর জানা আছে?” 

হরিসাধন হাসিয়া উত্তর করিলেন “আছে বৈ কি! 

ত্রৈলোক্যনাথ উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং তখনই তাঁহার নিকট গিয়া তাঁহার দুই হস্ত ধরিয়া শশব্যস্তে বলিলেন “শীঘ্র দেখাইয়া দে।” 

হরিসাধন বন্ধুর এইরূপ চাঞ্চল্যের কোন কারণ বুঝিতে পারিলেন না। তিনি তখনই শয্যার উপর উঠিলেন এবং উপরের চাদর ও লেপ তুলিয়া গদি বাহির করিলেন। পরে একটি চাবি টিপিবামাত্র উহার কিয়দংশ বাসের ডালার মত খুলিয়া গেল। উহার ভিতরে যাহা দেখিতে পাইলেন, তাহাতে হরিসাধন স্তম্ভিত হইলেন। ত্রৈলোক্যনাথ নিকটেই ছিলেন, তিনি সেই গোপনীয় স্থান হইতে নিমেষ মধ্যে একটি হাতির দাঁতের ক্ষুদ্র বাক্‌স তুলিয়া লইলেন। সৌভাগ্যক্রমে বাক্সটির চাবি বন্ধ ছিল না, শশব্যস্ত হইয়া ত্রৈলোক্যনাথ উহা খুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলেন, সেই অপহৃত রত্নরাজি। ত্রৈলোক্যনাথ একে একে প্রত্যেকখানি পরীক্ষা করিয়া, গণনা করিলেন। দেখিলেন, একখানিও নষ্ট হয় নাই। সকলগুলিই অতি যত্নে রক্ষিত হইয়াছে। 

হরিসাধন হতবুদ্ধি হইলেন। কি উপায়ে কোন্ কৌশলে যে ত্রৈলোক্যনাথ রত্নগুলি বাহির করিলেন, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না। তিনি আপনার দুই হস্তে বন্ধুর দুটি হাত ধরিয়া অতি বিনীত স্বরে বলিলেন “ভাই তিলক! তুই প্রথম হইতেই মাধার উপর সন্দেহ করিয়াছিলি। কিন্তু বলিতে কি, আমি তাহাতে তোর উপর বিরক্ত হইতাম। এখন আমার বেশ জ্ঞান হইয়াছে। এতদিন আমি যে দুধ কলা দিয়া কালসর্প গৃহে রাখিয়াছি তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি।” 

বাধা দিয়া ত্রৈলোক্যনাথ হাসিতে হাসিতে বলিলেন “তোকে যে ছাড়িয়া যাইতে হইল না, এমন সুন্দর জমিদারী তোর যে হস্তচ্যুত হইল না, ইহাই আমার সৌভাগ্য। আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, তোর অদৃষ্টে এমন দুদশা হইবে। যাহা হউক, এখন ঈশ্বরের কৃপায় তুই যেমন ছিলি তেমনই হইলি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, তিন চারিখানি পাথর বিক্রয় করিলেই সকল দেনা পরিশোধ হইবে- তোর জমীদারী খালাস হইবে।” 

হরিসাধন আন্তরিক আনন্দিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “মাধা সম্বন্ধে কি করা যায়? 

ত্রৈ। সে যে আর হাসপাতাল হইতে ফিরিয়া আসিবে, এমন বোধ হয় না। আমার আঘাতেই যে এই প্রকার হইয়াছে তাহা নহে। সে বেশ বুঝিয়াছিল যে, আমি তাহার উপর সন্দেহ করিয়াছি এবং রত্নগুলি ভিতরে ভিতরে অন্বেষণ করিতেছি। সেইজন্যই সে পূর্ব্বরাত্রে এই ঘরে আসিয়া বাক্‌সটি লইয়া গিয়াছিল। পরে যখন শুনিল, আমি পরদিনই প্রস্থান করিব, তখন সে আবার উহাকে যথাস্থানে রাখিয়া গিয়াছিল। 

হ। তোর জন্যই আমি আবার পূর্ব্বসম্পত্তি ফেরত পাইলাম। তোর ঋণ আমি এ জন্মে শোধ করিতে পারিব না। ঈষৎ হাসিয়া ত্রৈলোক্যনাথ বলিলেন “এ জন্মে না পারিস, পরজন্মে শোধ করিস। এখন এক কাজ কর্।” সাগ্রহে হরিসাধন জিজ্ঞাসা করিলেন “কি কাজ?” 

ত্রৈ। বিবাহ করিয়া সংসার কর্। 

হ। আমার অমত নাই। এতদিন কেবল দারিদ্র্যের জন্য বিবাহ করি নাই। তুই আরোগ্য হইলে পাত্রী স্থির করা যাইবে। যতদিন সম্পূর্ণ ভাল না হইবি, ততদিন ত তোকে কোথাও যেতে দিব না। 

ত্রৈলোক্যনাথ হাসিলেন। তিনি বলিলেন “আমিও সেই মৰ্ম্মে বাড়ীতে ও আমার উপরিতন কর্ম্মচারীকে পত্ৰ লিখিব মনে করিয়াছি। তোকে সংসারী না করিয়া আমারও কোথাও যাইতে ইচ্ছা নাই।” 

সম্পূর্ণ 

[ ফাল্গুন, ১৩১৭ (?) ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *