মাণিকজোড় – শোভন সোম
পলটু আর মিনটু ছিল যজম ভাই। শুধু চেহারাতেই নয়, স্বভাবেও দুজনের মধ্যে অনেকখানি মিল ছিল। তাদের বাবা ছিলেন মুদিখানার কর্মচারী, তাই পলটু-মিনটুর যত না সাধ ছিল, সেই অনুপাতে একরত্তিও সাধ্য ছিল না। অতঃপর, স্বাভাবিকভাবেই সাধ পূরণের জন্য সহপাঠীদের খাতা-পেন্সিল-ছুরি চুরিতে তাদের হাতেখড়ি শুরু হল।
সহপাঠী নীলু একদিন ক্লাসে সুন্দর একটা ঝরণা কলম নিয়ে এল। তাই দেখে পলটুতে-মিনটুতে চোখ ঠারাঠারি হয়ে গেল। কিন্তু কলমটাকে নীলু সারাক্ষণ এমন ভাবে আঁকড়ে রাখল যে, পলটু-মিনটু ওটা হাতাতে পারল না। স্কুল-ফিরতি ওরা একটা বড় দোকানে গিয়ে ঝরণা কলম দেখতে চাইল। সেলস্ম্যান হরেক রকম কলম ওদের সামনে মেলে ধরল; তার মধ্যে ছিল নীলুর মত একটা কলম। পলটু-মিনটু অনেকক্ষণ ধরে এ-কলম সে-কলম যাচাই করতে লাগল। দোকানে তখন খদ্দেরের ভিড়। সেই ফাঁকে পলটুর পকেটে ঈপ্সিত কলমটা চালান হয়ে গেল। ওরা তাই কোন কলম পছন্দ না করেই বেরিয়ে এল। তারপর দিন পনেরো সেই রাস্তা দিয়েই ওরা গেল না।
মানুষের লোভের সীমা নেই; চুরির সাফল্য চোরকে বড় চুরিতে উৎসাহিত করে। দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তার কোন বৈপরীত্য ঘটল না। আরো বড় চুরিতে তারা অতঃপর হাত পাকাতে লাগল।
দু’ভাইয়ের মধ্যে ছোট ভাই মিনটু তবু একটু ভীতু ধরণের। পলটুকে সে মধ্যে মধ্যে সতর্ক করতে চাইত, কিন্তু বেপরোয়া পলটুকে তখন চুরির নেশায় পেয়েছে। সে মিনটুকে গালাগাল দিত: তুই একটা কমীনা বে, স্লা কোন হারামির গব্ভপাত পলটু মণ্ডলকে ধরে!
এবারের চুরি কিন্তু পলটু হজম করতে পারল না। স্কুলের টাইপরাইটার চুরি করে বেচতে গিয়ে সে ধরা পড়ল। ফলে এক বছরের সাজা হিসেবে ওকে রিফরমেটরিতে পাঠান হল। সে বছর ওদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার কথা। যথা সময়ে মিনটু থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে এক ব্যবসায়ীর গদীতে খাতা লেখার কাজে নিযুক্ত হল। দুই ছেলেকেই মা বাবা খারিজের খাতায় ধরে রেখেছিলেন, তাই মিনটু চাকরি পেয়েই বেলেঘাটার বস্তিতে আলাদা ভাবে থাকতে আরম্ভ করেছিল। পলটু কবে ছাড়া পেলো-না-পেলো সে-খবর রাখা সে প্রয়োজন বোধ করে নি।
দৈবেও যাদের জীবনে কিছু ঘটে না, আজ-কাল-পরশু সব দিন যাদের কাছে একই ধরণের, মিনটু ছিল তাদেরই একজন। সময় মত গদীতে যাওয়া, নির্দিষ্ট একটা সময় গদীতে কাজ করা, তারপর সময় মত ফিরে আসা; তার জীবনের এই ছকের মধ্যে এতটুকু ব্যতিক্রম ছিল না।
একদিন দুপুরবেলা মিনটু কাজে ব্যস্ত, এমন সময় ‘এই মিনটে’ ডাক শুনে সে চমকে উঠে সামনে যাকে দেখল, তাকে হঠাৎ চিনতে পারল না। দামী স্ট্রেচলোনের ফ্লেয়ার্স, ট্যাপার্ড চেক শার্ট, চোখে ওয়াইন কালার গ্লাস, মাইকেল মধুসূদন মার্কা চুল আর জুলফি শাভিত ব্যক্তিটি যে তারই অভিন্ন সহোদর পলটু, সে কি করে কল্পনা করবে!
‘আয়, আয়, বাইরে আয়।’ দামী সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে পলটু বলল।
মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে মিনটু বেরিয়ে এল।
‘চল স্লা, কোন রেস্তোরাঁয় বসি’। পলটু এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘তুই কি জিন্দেগীভর পরের টাকা গুণেই কাটাবি নাকি? ডরপোক্ বুদ্ধু কাঁহাকা!
পলটু আগেই হকচকিয়ে গিয়েছিল। মিনটুর সঙ্গে প্রায় চার বছর বাদে ওর দেখা। এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে ঢের জল গড়িয়ে গেছে।
পলটু ওকে ভাল ভাল খাবার খাওয়াল, দামী সিগারেটের প্যাকেট দিল—যদিও বিড়ি টেনে টেনে মিনটুর মুখে আর সিগারেট রোচে না, সে যত দামীই হোক। কিন্তু পলটু কিছুতেই ওর আবাসের ঠিকানা দিল না। শুধু বলে গেল, ও নিজে এসে এসেই দেখা করবে।
গদীতে ফিরে আসতে মালিক বলল, ‘কি হে মণ্ডল, তোমার দাদা তো দেখছি বেশ মালদার লোক। তুমি এই আশি টাকা মাইনেয় পড়ে আছ কেন? দাদাকে ধরে ভাল একটা কাজ জুটিয়ে নাও না।’
মিনটু কাষ্ঠহাসি হাসল।
ব্যাপারটা চরমে উঠল যখন পলটু ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে ধরা পড়ার পর আদালতে নিয়ে যাবার সময় পুলিশ ভ্যান থেকে পালাল।
পলটুর ছবি কাগজে কাগজে বেরোল, তার নামে হুলিয়া বেরোল, তার মাথার দাম ধরা হল দশ হাজার টাকা।
পলটু মিনটু দুজনেরই উচ্চতা, চুলের রঙ, চোখের রঙ, গায়ের রঙ, নাক, ঠোঁট, কানের ম্যপ এক। বিশেষ করে দুজনেরই নাকের ডগা সুপুরির মত গোলালো। অনায়াসে একজনকে আরেকজন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
মালিক ওর দিকে কটমট করে তাকায়, রাস্তায়-ঘাটে, ট্রামে-বাসে, পাড়ায় সবাই ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। অতঃপর মালিক একদিন সাফ বলে দিলেন, ‘তোমার দাদার রঈসগিরির এই কারণ, বটে! কিন্তু বাপু তোমাদের চেহারাতে তো ফারাক নেই। কার পেটে কি, জানি না। তবে আমার টাকা-পয়সার কারবার, ডাকাতদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই।’
অথাৎ মিনটু পথে দাঁড়াল।
সাতদিন ওর বস্তির ঘরে শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনায় তোলপাড় করে মিনটু কাটাল। তারপর সে স্থির করল, নাগপুরে তার দূর-সম্পর্কের বুড়ি বিধবা পিসির কাছেই একমাত্র যাওয়া যেতে পারে।
পিসির সঙ্গে ওদের দীর্ঘকাল কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মিনটুর পক্ষে কলকাতায় থাকাও সম্ভব ছিল না।
অনেক খুঁজে-পেতে ধন্তোলী পাড়ায় পিসির বাড়ি বার করল সে। পরিচয় দিতে পিসি বলল, ‘কে, বলাইয়ের ছেলে—মিনটু! তা বাবা তোদের সেই কবে দেখেছি, তা কি মনে আছে? এতদিন তো পিসির খোঁজ-খবর নিস নি, বেঁচে আছে না মরে গেছে পিসি! তা হঠাৎ কি মনে করে?
মিনটু আসল কথা চেপে গিয়ে মিথ্যে বানিয়ে জবাব দিল, নাগপুরে একটা চাকরির খবর পেলুম। ভাবলুম, তুমি আমাদের নিজের জন, তোমার কাছেই এসে উঠি। তাই সটান চলে এলুম।’
মিনটু ঢিপ করে প্রণাম করতে গেল।
‘আহা, থাক, থাক, ছুঁস নি। সন্ধ্যেবেলা এই নেয়ে এলুম, এখন পুজোয় বসব। ওই ঘরে, যা, কাপড়-চোপড় ছেড়ে নেয়ে-ধুয়ে আয়, আমি পুজোটা সেরে আসি।’
মিনটুর পিসি নিঃসন্তান। পিসে জমি বাড়ি রেখে গেছে। বাড়ি ভাড়ার আয়েই পিসির দিন চলে। পিসে যথেষ্ট টাকা পয়সাও রেখে গেছে নগদে আর ব্যাঙ্কে। মিনটু ক’দিনেই বুঝতে পারল, পিসি হাড়-কঞ্জুষ! এক নয়া খসাতেই প্রাণ যায়। ঘরে ঘরে জিরো পাওয়ারের বাতি, সন্ধ্যে সাতটা বাজতেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে—পাছে বেশি আলো পোড়ে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও তেমনি।
মিনটু দু’দিনেই হাওয়ার গতি বুঝে নিয়ে পিসির বশংবদ হয়ে উঠল। ক্রমে ক্রমে ওর ওপর পিসির বিশ্বাস জন্মাতেও দেরি হল না। পিসির সব কাজেই এখন মিনটুকে না হলে চলে না।
প্রবাসে বাঙালিতে বাঙালিতে এক ধরণের স্বাভাবিক হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। ফলে এর তার সাহায্যে একটা চাকরি জোটাতেও মিনটুর দেরি হল না। গদিতে খাতা লেখার অভিজ্ঞতা ছিল, হিসেবে টিসেব একটু-আধটু বুঝতো মিনটু, সেই সুবাদে এক বাজারের মালিকের কাছে ভাড়া আদায়ের কাজে সে বহাল হল। কাজ সারাদিন ঘুরে ঘুরে তাগাদা দিয়ে ভাড়া আদায় করা আর খুচরো ব্যাপারীদের কাছ থেকে প্রত্যেক দিনের ভাড়া তোলা।
এই ভাবে বছর ঘুরে গেল আর ইতিমধ্যে মিনটুর ঢের ইয়ার-দোস্তও জুটে গেল। ইয়ার-দোস্তদের পাল্লায় পড়ে সে মালটানায় রপ্ত হল আর সেই সঙ্গে ওকে পেয়ে বসল সট্টা, খেলার নেশা। নাগপুর শহরের আনাচে কানাচে অলিতে গলিতে সট্টার আখড়া। এই দুর্দান্ত নেশায় একবার যাকে পায়, তার আর রেহাই নেই। সেই মাকড়শার জালে মিনটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেল।
ফলে আদায়ী টাকায় সে হাত দিতে শুরু করল। আজকের আদায়ের টাকার খাকতি কালকের আদায়ের টাকা দিয়ে পূরণ করে সে কিছুদিন জোড়াতালি দিয়ে চালাতে লাগল; কিন্তু অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে উঠতে লাগল।
এমন সময় একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মূর্তিমান পলটু এসে নাগপুরে আবির্ভূত হল।
মিনটু ভোর ছ’টায় কাজে বেরোচ্ছিল, এমন সময় দোরগোড়ায় সাক্ষাৎকার। মিনটু চেঁচিয়ে উঠল, ‘পলটে, তুই!’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চুপ কর। ভেতরে চল।’
কথা শুনে পিসি চেঁচিয়ে বলল, ‘কি রে মিনটে, কার সঙ্গে কথা কইছিস?’
পিসির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পলটুই এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘পায়ের ধুলো দাও, পিসি। আমি পলটু। বোম্বে যাচ্ছিলুম, পথে একদিনের জন্যে নামলুম, তোমাদের দেখে যাবার মন করল।’ বলেই ষাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত।
পলটুর গায়ে লাল-কালো চেককাটা জামা, নীল রঙের জীনস্ আর হাতে সর্দারজীদের বালা। হাতে একটা কালো চামড়ার পেটমোটা ব্যাগ।
পিসি বলল, ‘ষাট ষাট। তোদের বাপ-মা তো বোনের খোঁজ নেয় না। তোদেরই যা দেখছি পিসির জন্যে দরদ।’
‘তুমি আমাদের সাতকূলে এক পিসি, তোমাকে আমি আর মিনটে কি ভুলে থাকতে পারি? দাও পিসি, খেতে দাও। খেয়ে ঘুমোব। গতরাতে ট্রেনে একদম ঘুম হয় নি। গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা ধরে গেছে।’ পলটু খুব সহজ অন্তরঙ্গ ভাবে বলল।
‘বোস, বোস। চান করে কাপড় ছেড়ে ঠাণ্ডা হয়ে নে।’ পিসি হেসে বলল, ‘তোরা তো দেখছি মানিকজোড় রে! কে পলটে, কে মিনটে চেনা যায় না।’
‘তুমি নাম ধরে ডাকলেই তো চিনতে পারবে।’ পলটুও হাসল, ‘তোমায় অত শত ভেবে মাথা ঘামাতে হবে না। কই, খেতে দাও না, খিদে পেয়েছে যে! আজ আমি সারাদিন ঘুমোব। কাল ভোরেই ফের ফিরে যেতে হবে। সেদিন বিকেল হতেই কাজ সেরে মিনটু বাড়িতে ফিরে এল।
ধনবটে রঙ্গমন্দিরে রাত ন’টায় কাওয়ালির আসর ছিল। মিনটু আগেই টিকেট কেটে রেখেছিল। ভাবল, আজ আর সে কাওয়ালি শুনতে যাবে না, পলটুর সঙ্গে গল্প করেই কাটাবে।
সন্ধ্যেবেলা পিসি পূজোয় বসার পর দু’ভাইয়ে শুয়ে শুয়ে সুখ-দুঃখের সব গল্প করতে লাগল।
কথায় কথায় মিনটু জানাল, হাজার দুয়েক টাকা ওর জরুরী দরকার, জুয়ার আর নেশার খাঁই মেটাতে যেটা ঘাটতি হয়েছে, সেটা পূরণ না করতে পারলে ওর চাকরি তো যাবেই, জেলেও যেতে হতে পারে তছরূপের দায়ে। পলটু ওকে এই বিপদ থেকে যদি উদ্ধার করতে পারে, তবে বড় উপকার হয়।
পলটু ওর কালো ব্যাগটা খুলে একতাড়া একশ’ টাকার নোট দেখিয়ে বলল, ‘দু হাজার তোকে দিতে পারব না। যদি পারি, বড় জোর পাঁচশ’ আন্দাজ। আমার নিজেরই টাকার দরকার।’
‘তাই না হয় দে আপাতত!’
‘কিন্তু তারপর! বাকিটা কোত্থেকে জোটাবি!’ পলটু কিছুক্ষণ ভাবল, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দাঁত দিয়ে খুঁটল, মাথা চুলকোলো, তারপর মিনটুর কানের কাছে মুখ এনে চুপি চুপি বলল, ‘একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। তুই স্লা, এক নম্বরের ডরালু। শুনেই পিছিয়ে যাবি। দেখ, আমার হাতে বেশি সময় নেই; ভোরেই পিটটান দিতে হবে কাকপক্ষী জাগার আগে।’
মিনটু উৎসুক হল, ‘বল্ই না তোর প্ল্যান। না বলেই আমাকে ভীতু বলে গালাগাল দিচ্ছিস। মা কালীর কিরে, বলেই দ্যাখ না।’
‘পারবি, বুড়িটাকে খুন করতে? ওর তো সিন্দুকেও টাকা, ব্যাঙ্কেও টাকা। ও টেঁসে গেলে, তুই ছাড়া আর কোন দাবীদার ওয়ারিশ নেই। পারবি?
‘কাকে! পিসিকে!’ আঁৎকে উঠল পলটু।
‘এই জন্যেই তোকে ডরপোক বলি। হ্যাঁরে, পিসির তো এক দঙ্গল ভাড়াটে। ওরা কেউ আমায় আসতে দেখেছে?’
‘অত ভোরে এ বাড়িতে আমি আর পিসি ছাড়া কেউ ওঠে না। তার ওপর শীতকাল। পিসি তো সারাদিন গোবরছড়া, চান, পুজো আর শুচিবাই নিয়েই আছে। ভাড়া চাওয়া ছাড়া ওদের সঙ্গে পিসি কথা কয় না। তুই তো সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালি; তুই যে এসেছিস এ বাড়ির আমি আর পিসি ছাড়া কেউ টেরও পায় নি।’
‘তাহলে তো কেল্লা ফতে!’
রাত পৌনে ন’টায় মিনটু পিসিকে বলল, ‘পিসি, আমি থিয়েটারে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে।’
পিসি ভিতরের দিকে নিজের ঘরে শুয়ে ছিল। কঁকিয়ে বলল, ‘পলটে, দোরটা দিয়ে দে। আমার আবার কোমরের ব্যাথাটাচাগিয়ে উঠেছে অমাবস্যায়। বিছানা থেকে উঠতে পারছি না।’
মিনটুর বদলে পলটু ওর সেই লাল কালো চেককাটা জামা, নীল জীনস্ পরে কালো ব্যাগের সব নোটের বাণ্ডিল পকেটে ঠেসে ব্যাগটা দেখে রেখে ধনবটে রঙ্গমন্দিরের কাওয়ালি শো’র টিকিট নিয়ে বেরিয়ে গেল।
প্রোগ্রাম অনুসারে রাত সাড়ে দশটায় পনেরো মিনিটের বিরতি।বাড়িতে মিনটু একা জেগে ঘড়ির কাঁটার গতি লক্ষ্য করতে লাগল। মিনটু আগেই বাড়ির পেছনের দিকের দরজা খুলে রেখেছিল। সেদিকে ঝোপঝাড় জঙ্গল, তার ওপর আবার অমাবস্যার রাত।
রাত ঠিক সোয়া দশটায় হাতে দস্তানা পরে মুখে কালো রুমাল বেঁধে বেড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে মিনটু পিসির ঘরে এল।
কণ্ঠনালীতে চাপ পড়তেই পিসি অমানুষিক আওয়াজ করে উঠল। বেতো রুগী হলে কি হবে, প্রাণ নিয়ে কথা! পিসি কিঞ্চিৎ ধস্তাধস্তির চেষ্টা করেও শেষে নিস্তেজ হয়ে গেল। মিনটু বুঝল সব শেষ। পিসির চিৎকার আর ধস্তাধস্তির শব্দে আশেপাশের ভাড়াটেরা সজাগ হয়ে উঠল। হৈ হৈ শুরু হতে না হতেই মিনটু পিছনের দরজা দিয়ে হাওয়া।
ধনবটে রঙ্গমন্দিরের পেছন দিকের বাথরুমের সারির আড়ালে প্ল্যান মাফিক মিনটু অপেক্ষা করতে লাগল। দশটা বত্রিশে পলটু এল।
‘হাপিস!’ পলটু জিজ্ঞেস করল।
‘মোক্ষম। দে, তোর পোশাকটা দে।’
দু-ভাইয়ে ঝটপুট পোশাক বদলাবদলি করে নিল।
‘প্রোগ্রাম আর টিকিট দে। হ্যাঁ, এতক্ষণ প্রোগ্রাম ঠিকমত চলছিল তো?’
‘হ্যাঁ। শোন। আমি কাওয়ালি আরম্ভ হবার আগে ক্যান্টিনে গিয়ে চা সিঙ্গাড়া খেয়েছি আর এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছি। নে, সিগারেটের প্যাকেটটা রাখ। ক্যান্টিনওলাকে আমি একশ’ টাকার একটা নোট দিয়েছিলুম। ক্যান্টিনওলার কাছে একশ টাকার চেঞ্জ ছিল না। আমার সীট নম্বর জেনে নিয়ে খুচরো পাঠাবে, বলল। আমি সীটে যেতে গিয়ে আমার ঠিক তিনটে সীট আগে বসা এক উঁচু খোঁপাউলীর জুতো ইচ্ছে করে মাড়িয়ে দিয়েছি। ও আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ছিল। আমি বললুম, সরি ম্যাম। আর আমার ডানপাশে বসেছিল দাড়িতে মেহন্দি লাগানো চোখে সুর্মা টানা এক শেখ। ওর সঙ্গে আমি দু একটা কথা বলেছি, এই ‘কেমন লাগছে’, এই সব। আর হ্যাঁ, ক্যান্টিনওলা যখন চেঞ্জ ফেরৎ পাঠাল, তখন ঘড়িতে দেখলুম ঠিক দশটা পঁচিশ। লে, স্লা, সব আঁটঘাট বাঁধা এখন। কারো বাপের এমন ব্যাটা জন্মায় নি যে তোকে ধরে। আচ্ছা ভাই, আমি এখন চলি। আবার দেখা হবে।’
মিনটু বলল, ‘পলটে, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয় নি, আমি যে এখানে আছি সে খবর আর পিসির ঠিকানা জানলি কি করে?’
পলটু হেসে বলল, ‘আমরা হলাম রিসিভিং সেট, সব ট্রান্সমিশন ধরে ফেলি। সব খোঁজ-খবর আগেভাগে না রাখলে কি চলে! আমরা সব খবর জোগাড় করে রাখি। যাকগে, ওসব তুই বুঝবি না। এখন বুড়ির মাল হাতিয়ে এন্তার ফুর্তি কর। তোকে মানুষ করে দিয়ে গেলুম বে।’
পলটু অন্ধকারে অন্ধকার হয়ে মিলিয়ে গেল।
বিরতি তখনও শেষ হয় নি, তার আগেই পলটুর পোশাক পরা মিনটু প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসল। আড়চোখে একবার উঁচু খোঁপা বাঁধা মহিলাকে দেখে নিল, তারপর ডান পাশের মেহন্দি ছোপানো দাড়িওলা ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু রসিকতা করার চেষ্টা করল।
ধনবটে রঙ্গমন্দির থেকে ধনতোলী অতি কাছে। রাত বারোটায় কাওয়ালির আসর ভাঙার পর হল থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে আরেক প্যাকেট সিগারেট কিনল মিনটু আর ক্যান্টিনওলাকে চেঞ্জ পাঠাবার জন্যে ধন্যবাদ জানাল।
বাড়িতে এসে সে যা আশা করেছিল, যথারীতি তাই দেখতে পেল। যেন কিছুই জানে না, এমন ভাবে গলায় স্বাভাবিক উৎকণ্ঠার আভাষ এনে পুলিশ ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপার কি? কি হয়েছে!’
মিনটু যা ভয় করেছিল, তেমন কিছু ঘটল না। ইন্সপেক্টর অতি সহৃদয়তার সঙ্গে ওকে চেয়ারে বসিয়ে ওর ঘাড়ে হাত রেখে ধীরে ধীরে পিসির খুন হবার কথা ভাঙলেন। সে সারাদিন কি করেছে, বিশেষ করে সন্ধ্যে থেকে এই অবধি কোথায় ছিল, সব খুঁটে খুঁটে জানতে চাইলেন। সে পলটুর বিষয় সম্পূর্ণ উহ্য রেখে বাকি সব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে বলে গেল। সে কী কাজ করে, কাজের ধরণ কি, সব জেনে নিয়ে তিনি ভেবে চিন্তে বললেন, ‘আজ শনিবার, আপনার তো শনিবারেই বেশি ভাড়া আদায় হবার কথা, তাই না? আর শনিবারে যা আদায় হয়, সেগুলো নিশ্চয়ই সোমবারে জমা পড়ে। আচ্ছা, এ ব্যাপারটা, মানে সোম পর্যন্ত ক্যাশ আপনার কাছে থাকে, এটা কি অনেকেই জানে?
‘তা তো মনে হয়। বিকেলের দিকে, সন্ধ্যের দিকে পাইকারদের কাছ থেকে যা ওঠে, আর খুচরোদের কাছ থেকে দৈনিক যা তোলা হয়···?’
‘আপনি আজ কাওয়ালি শুনতে যাবেন, এটা কবে ঠিক করেছিলেন?
‘আমি সাতদিন আগে টিকিট কেটেছি। টিকিটে ওরা নামও লিখে দিয়েছিল।’
‘তার মানে, আপনি বলছেন, আপনি পৌনে ন’টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাহলে আপনি বাড়িতে নেই জেনে বোধ হয় টাকা চুরির জন্য খুনী···আচ্ছা, করোনারের রিপোর্ট দেখি আগে। চলি, মিস্টার মণ্ডল। ঘাবড়াবেন না, মুষড়ে পড়বেন না। চিয়ার আপ।’
দু’দিন বাদে দুপুরবেলা পুলিশের গাড়ি এসে মিনটুকে সটান বাজার থেকে তুলে নিয়ে গেল। সেদিনও মিনটুর পরনে ছিল পলটুর সেই লাল কালো চেককাটা জামা, নীল জীনস্, মায় হাতে সর্দারজীদের স্টিলের বালা। থানাতে ওকে নিয়ে গিয়ে কোন ভণিতা না করেই ও-সি বললেন, ‘ময়না তদন্তে জানা গেছে, আপনার পিসি খুন হয়েছেন। রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। আপনি ওই সময় ধনবটে রঙ্গমন্দিরে কাওয়ালি শুনছিলেন,তাই না? অবশ্য আপনি যে ওই সময় অন্যত্র ছিলেন, সে আমরা সন্দেহ করছি না, মিস্টার মণ্ডল। তবে কিনা···’
অনেকখানি সাহস সঞ্চয় করে মিনটু বলল, ‘আমার আপন বলতে গেলে ওই এক পিসিই ছিল। আমি ভাবতেই পারি না, মাত্র তিন ঘণ্টা বাইরে ছিলুম, এর মধ্যে এমন মর্মান্তিক কাণ্ড ঘটে যেতে পারে!’
থানা অফিসার বললেন, ‘আপনি ভাববেন না, আপনাকে সন্দেহ করছি। খুনীকে কেউ দেখবার আগেই সে পালিয়েছিল। এমন কি আঙুলের ছাপ অবধি গলায় পাওয়া যায় নি। যাকগে, আপনার অ্যালিবাই তো ফুল প্রফ। কি বলেন?’
আরো উৎসাহিত হয়ে মিনটু বলল, সেটা আপনারা যাচাই করলেই নিশ্চিত জানতে পারবেন। আমি ন’টায় হলে পৌঁছে প্রথমে ক্যান্টিনে গেলুম, সিগারেট কিনলুম। তারপর সীটে যাবার পথে, হ্যাঁ মনে পড়ছে আমার ঠিক তিন সীট আগে এক মহিলা বসেছিলেন, হ্যাঁ···লাল শাড়ি পরেছিলেন তিনি, অসাবধানে তাঁর পা আমি মাড়িয়ে দিয়েছিলুম। আর আমার ডান পাশে মেহন্দি ছোপানো দাড়িওলা এক ভদ্রলোক···’
মিনটুকে থামিয়ে দিয়ে অফিসার বললেন, ‘ব্যস, ব্যস, অত জানবার দরকার নেই। আপনি যে শনিবার রাত ন’টা থেকে বারোটা অবধি ধনবটে রঙ্গমন্দিরে কাওয়ালি উপভোগ করছিলেন, তার সাক্ষী-সাবুদের অভাব নেই। সেদিন ফাংশনের সব টিকিটে নাম লেখা ছিল, তাই আপনি যাঁদের কথা বলছেন, তাঁদের আমরা অলরেডি জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছি, ওই পোশাক পরে আপনি সত্যি সত্যি ওইদিন ন’টা থেকে বারোটা অবধি হলে ছিলেন। আচ্ছা মিস্টার মণ্ডল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনি তো জুয়ো খেলেন, শুঁড়িখানায় নিয়মিত যান, তাই না?’
মিনটু চোখ নামিয়ে লজ্জিত স্বরে বলল, ‘ওই একটু সামান্য শখ···’
‘আমরা খবর পেলুম, আপনি সম্প্রতি কাজে একটু গাফিলতি করছেন। এই, মানে যা আদায় করেন, ঠিক মত জমা দেন না। ধরুন, শুক্রবার দিন আপনি যা আদায় করেছেন, শনিবার সেটা পুরো জমা দেননি। ইদানীং এরকম প্রায়ই হচ্ছে। আপনার শখগুলো বেশ একটু দামী শখ, কি বলেন?’
মিনটু জবাব না দিয়ে কাষ্ঠহাসি হাসল।
‘আরে, লজ্জা পাচ্ছেন কেন, মশাই? দুনিয়াটা ফুর্তির জায়গা। হেসে নাও দু-দিন বৈ তো নয়; আর তাই টাকার বড় দরকার। ঠিক বলিনি!’
মিনটু পুনরায় জোর করে মুখে হাসির রেখা ফোটাল।
‘আচ্ছা, আপনি শো আরম্ভ হবার আগে ক্যান্টিনে খেয়ে একশো টাকার নোট দিয়েছিলেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ। ওরা আমাকে বিরতির একটু আগে চেঞ্জও ফিরিয়ে দিয়েছিল।
‘হ্যাঁ, জানি। কিন্তু মিস্টার মওল, ক্যান্টিনে সাধারণত কেউ একশো টাকার নোট দেয় না। ক্যান্টিনে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওই দিনে আর কেউ একশো টাকার নোট দেয়নি।’ অফিসার ড্রয়ার খুলে একটা একশো টাকার নোট মিনটুর সামনে মেলে ধরলেন: ‘দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা।’
সব একশো টাকার নোটেরই তো এক চেহারা!’ মিনটু হেসে বলল।
‘তা বটে। কিন্তু, বিশেষ করে এই নোটটার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। দেখুন তো, ওই কোণ-ছেঁড়া নোটটা পেছন দিকে সরু সেলোটোপ দিয়ে নিপুণ ভাবে লাগানো। দেখছেন?’
‘আমি এই ভাবেই এটাকে পেয়েছিলাম। তখন অত খেয়াল করিনি তো!’
‘এটা কি তবে…’
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিনটু বলল, ‘শনিবারে যে টাকা বাজারে আদায় হয়েছিল, তার মধ্যে এটা···’
‘অ, সেই টাকা আপনি ভেঙেছেন?’
‘না। আমি তো আদায়ের টাকা ঠিক-ঠিকই জমা দিই। দু-একদিন যা দেরি হয়, সেটা তো তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়!’ মিনটু নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে চাইল।
‘অস্বাভাবিক বটেই, নইলে আপনাকে একটা একশো টাকার নোট নিয়ে এত কথা বলতুম না।’ কঠিন স্বরে অফিসার জবাব দিলেন।
‘তাহলে—মানে···’ আমতা আমতা করে মিনটু বলল, ‘আপনারা কি আমাকে তহবিল তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত করতে চাইছেন?’
‘ব্যাপারটা অত হালকা নয়। এটা খুনের মামলা। তছরুপের নয়।’
থানা-অফিসার স্টেনোকে ডেকে শনিবার সকাল থেকে রাত বারোটা অবধি মিনটুর গতিবিধির বিবরণ লিখিয়ে নিতে বললেন। বিশেষ জোর দিলেন, একশো টাকার নোটটার প্রসঙ্গে, ‘ওটাই আসল। নোটটার বিষয়ে ঠিক ঠিক বলুন।’ তিনি দু-তিনবার মিনটুকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।
মিনটু ভাবল, একটা সামান্য নোট নিয়ে তো মামলা। ওটা ও টেপ লাগানোই পেয়েছিল, এটা স্বীকার করলেই বোধ হয় ল্যাঠা চুকে যাবে। তাহলেই এরা ওকে ছেড়ে দেবে। মিনটু বশংবদ হয়ে গড়গড় করে বানিয়ে বানিয়ে বলে গেল, নোটটা সে শুক্রবারে পেয়েছিল। কোন পাইকার বা দোকানী দিয়েছিল সঠিক মনে নেই। শনিবার দিন সে সব টাকা মালিকের কাছে জমা দিতে পারেনি, কেননা হিসেব করার সময় পায়নি। ইত্যাদি।
মিনটুর বয়ানের টাইপ করা প্রতিলিপি পড়ে শুনিয়ে থানা-অফিসার নিচে মিনটুকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এবার আসুন।’
মিনটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বাব্বা, এতক্ষণ বুকটা যা ঢিপ ঢিপ করছিল। কথায় বলে পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। আর পুলিশরাও ওস্তাদ, কথার প্যাঁচ কষে ঠিক কথা ঠিক-ঠিক বার করে নেয়। যাক, অল্পের ওপর দিয়ে গেল। আসল ব্যাপার ওরা আঁচও করতে পারেনি। রক্ষে!
মিনটু ডান দিকে দরজা দিয়ে বেরোতে যাচ্ছিল, থানা-অফিসার বলে উঠলেন, ‘ওদিকে নয়, বাঁ-দিকের প্যাসেজ দিয়ে চলুন।
মিনটুকে এগিয়ে দিতে পুলিশ অফিসার নিজেই এলেন। বাঁ-দিকের প্যাসেজ যেখানে বাঁক নিয়েছে, তার কাছাকাছি এক বেঞ্চিতে এক মোটাসোটা বয়স্কা মহিলা সাদা সার্ট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বসেছিলেন। অফিসারের সঙ্গে মিনটু এগিয়ে আসতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত উঠে দাঁড়িয়ে সেই ভদ্রমহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ তো—এই তো সেই খুনী, শুক্রবার রাতে এই লোকটিই আমার স্বামীকে খুন করেছে।
সাদা সার্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ঠিক চিনতে পারছেন তো!’
‘নিশ্চয়ই। ওর গায়ে সেদিনও এই লাল-কালো ঘরকাটা জামা আর নীল প্যান্ট, হাতে লোহার বালা ছিল।’
‘চেহারায় কোন ভুল নেই তো?’
‘ভুল! আমি আপনাদের চেহারার যা বিবরণ দিয়েছি মিলিয়ে দেখুন। ওই যে অদ্ভুত ধরণের নাক, কটা চোখ দেখছেন, এক রত্তি ভুল নেই।’ মহিলা হাঁপাতে লাগলেন।
‘শান্ত হোন, মিসেস রাঠোর।’ থানা-অফিসার সহানুভূতির সঙ্গে বললেন।
‘আমি!’ এতক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে মিনটু শুনছিল; এবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি এই মহিলাটিকে কস্মিনকালেও দেখিনি। ইনি কি বলছেন, আমি বুঝতে পারছি না।’
‘না বোঝারই কথা।’ ঠাট্টার সুরে অফিসার বললেন। তারপর মহিলাটির দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি যে টাকার বাণ্ডিলের ওপর প্রথমেই টেপ দিয়ে জোড়া লাগানো নোটটা রেখেছিলেন, সেটা আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, আপনার দেওয়া সেলোটেপের রোলের সঙ্গে নোটে লাগানো টেপের অংশ হুবহু এক।’
‘সত্যি বলছি, আমি কিছু জানি না।’ মিনটু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘আপনারা ভুল করছেন।’
‘ভুলই বটে। জুয়েলার রণছোড়দাস রাঠোর শুক্রবার রাতে পরদিন ব্যাঙ্কে জমা দেবেন বলে নিত্যকার মত বাড়িতে ক্যাশ নিয়ে এসেছিলেন। স্বামী-স্ত্রীতে গুণতে বসে একটা একশো টাকার আধছেঁড়া নোট দেখতে পেয়েছিলেন। মিসেস রাঠোর সেটাকে, পেছন দিকে সেলোটেপ দিয়ে জুড়ে নোটের বাণ্ডিলের সব ওপরে রেখেছিলেন। শুক্রবার মাঝরাতে আপনি ওদের বেডরুমে ঢুকে পিস্তল দেখিয়ে সিন্দুক খুলিয়ে সব টাকা একটা ব্যাগে ভরে নিয়েছিলেন। কি মশাই, মনে পড়ছে? তারপর মিস্টার রাঠোর আপনাকে বাধা দিতে গেলে, আপনি তাঁকে গুলি করে খুন করেন। ঠিক বলিনি? কী, বাক্স্ফুর্তি হচ্ছে না যে! আর সেই জোড়া লাগানো নোটটাই আপনি ক্যান্টিনওলাকে দিয়েছিলেন।’
‘আপনারা মারাত্মক ভুল করছেন। আমি খুন করিনি। বিশ্বাস করুন, মা কালীর দিব্যি। খুন আমি করিনি, যে খুন করেছে, সে আমি নই।’
‘তাহলে আপনার ডাবল এসে খুন করেছে! তীব্র ব্যঙ্গের স্বরে থানা-অফিসার বলে উঠলেন, ‘এই বলতে চান তো? আর মিথ্যে বলে কি লাভ?’
হ্যাঁ, তাই—সত্যিই তাই। ওর যমজ ভাই পলটু হুবহু ওর মত দেখতে, ছোটবেলা যখন একসঙ্গে থাকত ওরা, এমন কি আত্মীয়-স্বজনরা পর্যন্ত পলটু মিনটু কোন্টা কে চিনতে পারত না। পলটুই জুয়েলার রাঠোরকে হত্যা করে একদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য পিসির বাড়িতে এসে সারাদিন লুকিয়ে ছিল। ধনবটে রঙ্গমন্দিরের পেছন থেকে কাওয়ালির বিরতির সময় ফের অন্ধকারে অন্ধকার হয়ে পলটু মিলিয়ে গেছে।
মিনটুর গায়ে দিব্যি নিজের পোশাক চাপিয়ে সে গা ঢাকা দিয়ে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যেবেলাই মিনটু বাড়িতে ফিরে এসেছিল। ভোর অবধি বাড়িতেই ছিল, শুক্রবার রাতে মিনটু একবারও বাইরে যায়নি। পিসি তার সাক্ষী। একমাত্র পিসিই ওকে বাঁচাতে পারত। সেই পিসিকেই শনিবার মিনটুই নিজের হাতে খুন করেছে।
‘স্বীকার করেই ফেলুন না। মিথ্যে ঢেকে রেখে আর লাভ কি?’ থানা-অফিসার মিনটুর কাঁধে হাত রাখলেন।
মিনটু কিছু বলবার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। বলবার আর কিছুই ছিল না।