মাটির দেওয়াল – ৯

“স্যার, আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে?”

শিরীষ বলল, “না, খারাপ লাগছে না। বরং ভাল লাগছে।”

“স্যার, ভোরে দেখেছি, গায়ে হালকা টেম্পারেচার ছিল। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন তাই বিরক্ত করিনি। আমি কি এখন একবার থার্মোমিটার দিয়ে দেখতে পারি?”

শিরীষ বলল, “তার কোনও প্রয়োজন নেই। জ্বর দুম করে আসে, কিন্তু নামে ধাপে ধাপে। সেটাই ভাল। ওষুধ খেয়েছি, তুমিই তো দিয়েছ। তা ছাড়া এখন আর জ্বর নেই, ঝরঝরে লাগছে।”

“সত্যি!”

শিরীষ বলল, “তোমার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“একটা কথা বললে রাগ করবেন না তো স্যার?”

শিরীষ সহজভাবে বলল, “করব। তারপরেও তুমি বলতে পারো।”

“আপনার নিজের ব্যাপারে আপনাকে আমি পুরোটা বিশ্বাস করি না। এই কয়েকমাসে আপনাকে খানিকটা চিনেছি মনে হয়।”

শিরীষ চোখ তুলে বলল, “একজন মানুষকে চেনার জন্য পাঁচ মাস কি খুবই কম সময় নয়?”

“সবসময় নয় স্যার। ভালমানুষকে চেনা যায় তাড়াতাড়ি। আর বেশি ভালমানুষকে বেশি তাড়াতাড়ি চেনা যায়। যেমন স্যার আপনি। আপনি একজন বেশি ভালমানুষ।”

শিরীষ একটু হেসে বলল, “এই মজার থিয়োরি তোমাকে কে শেখাল?”

“আমার মা স্যার। আমার মা লেখাপড়া তেমন কিছু করেননি। চাকরিবাকরিও করেন না, ঘর সামলান। আমাকে আর আমার দিদিকে মানুষ করেছেন। বিভিন্ন গুণের মধ্যে মায়ের একটা গুণ হল, চট করে মানুষ চিনতে পারেন। সামনাসামনি দেখে পারেন, আবার গল্প শুনেও পারেন। আমি মাকে আপনার গল্প বলেছি, উনি বলেছেন, তুই ঠিকই বলেছিস, তোর স্যার মানুষ বেশি ভাল।”

শিরীষ আরও মজা পেয়ে বলল, “তুমি কী এমন বললে যাতে আমাকে ভাল মানুষ বলে মনে হল!”

“বেশি কিছু বলিনি, একটা ঘটনা বলেছি। খুব সামান্য একটা ঘটনা। তাতেই মা বুঝতে পেরেছে।”

শিরীষ এবার চোখ বড় করে বসল। বলল, “বলো কী! মাত্র একটা ঘটনায় আমাকে চিনে গেলেন? ঘটনাটা কী, জানতে পারি?”

ত্রপা মাথা নামিয়ে লাজুক গলায় বলল, “না স্যার, বলা যাবে না।”

শিরীষ বলল, “ঠিক আছে। বোলো না।”

বৃষ্টিতে ভিজে ধুম জ্বর হয়েছিল শিরীষের। দু’দিন বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। ত্রপা সেই যে এসেছে, আর বোলপুরে ফিরে যায়নি। এখানেই গেস্টরুমে রয়ে গিয়েছে। সেদিনই তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। শিরীষের কাছে সে নিয়ম করে আসছে। ক্যামেরায় চাষের প্রতিটা পর্ব ধরে রাখছে। নোটস নিচ্ছে। শিরীষের ইন্টারভিউ নিচ্ছে। তার পেপার তৈরিতে যেমন যেমন লাগবে। তবে রাতে কখনও থাকেনি। বিকেলের আগেই শিরীষ তাকে চলে যেতে বলে। প্রথমে ঠান্ডা গলায় বলে। তারপরে মাঝারি ধরনের ধমক দেয়।

“বেলা পড়ে গেল, এখনও আমার পিছনে ঘুরঘুর করছ কেন?”

ত্রপা বলল, “মাঠের কাজ শেষ করে আপনি কী করেন সেটা দেখছি। এখানে তো সময় কাটানোর জন্য শহুরে আয়োজন নেই।”

শিরীষ বিরক্ত হয়ে বলে, “এটাও তোমার গবেষণার মধ্যে পড়ে?”

ত্রপা মাথা চুলকে বলে, “বুঝতে পারছি না স্যার। আমার গাইড বলেছেন, আপনাকে যতটা পারা যায় ফলো করতে এগ্রিকালচার ফিল্ডে আপনি একজন অভিনব মানুষ।”

শিরীষ দাঁত চেপে বলে, “আমি এখন ঘুমোব। তুমি এবার যাও।”

ত্রপা বলল, “স্যার, আর-একটু থাকি?”

শিরীষ বলল, “রাত হয়ে গেলে ফিরবে কী করে?”

ত্রপা বলে, “চিন্তা করবেন না। হারানদা বা রতনকাকার সঙ্গে এগিয়ে যাব।”

শিরীষ এবার খুব রেগে যায়। ধমক দিয়ে বলে, “এটা তোমার গবেষণাগার নয় যে, তোমার ইচ্ছেমতো চলবে। তুমি এখনই চলে যাবে এবং আর কোনওদিনই আসবে না। তুমি ধান গাছ নিয়ে গবেষণা করো, আমি ধান গাছ নই। আর কখনওই আসবে না। এখনই বিদায় নাও!”

সেদিন বৃষ্টি সব গোলমাল করে দেয়। এপার ছাতা কাজে লাগেনি। লাগার কথাও নয়। যদিও আকাশ যতটা সাজগোজ করেছিল, সেই তুলনায় বৃষ্টি তেমন হয়নি। তারপরেও ভিজে একসা হয়ে, কাদা মেখে দু’জনে ঘরে ফিরেছিল। আসলে নাওডুবি নদীর সাঁকো থেকে শিরীষের ঘর পর্যন্ত পথটা বেশি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে অতটা পথ চলে গিয়েছিল, খেয়াল ছিল না। আজকাল মাঝেমধ্যে এরকম হয় শিরীষের। অন্যমনস্ক লাগে। এমনটা আগে ছিল না। এখানে এসে বদলটা হয়েছে। সবসময় সেই টানটান, সতর্ক, টেনশনের মধ্যে থাকার ব্যাপারটা চলে গিয়েছে। শহর ছাড়তে শহুরে টেনশনটাও চলে গিয়েছে।

ত্রপার ছাতার নীচে দু’জনকে লম্বা পথ আসতে হয়েছিল সেদিন। তাও আস্ত ছাতা নয়, একদিক শিক ভেঙে কেতরে পড়া ছাতা। ছাতা কেতরে পড়ার আগেই ত্রপা বারবার ছাতার নীচ থেকে ছিটকে যাচ্ছিল। তাকে ধমক দিতে হয়।

‘আরে তুমি কোথায় যাচ্ছ? ছাতার নীচে এসো।’

ত্রপা বলেছিল, “আপনি চলুন স্যার, আমার বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস আছে।”

শিরীষ কড়া গলায় বলে, “অভ্যেস থাকলে থাকুক, তুমি আগে এসো।”

ত্রপা একটু এগিয়ে এল বটে, তবে ছাতার নীচে পুরোটা ঢুকল না। ভিজতে ভিজতেই চলল। সেই সঙ্গে চলছিল বকবকানি। শিরীষ গোড়া থেকেই দেখছে, এই মেয়ে কথা বলতে ভালবাসে। কথা বলার মধ্যে ভণিতা কিছু নেই। সবটাই মনে হয় খাঁটি, ভিতর থেকে বলছে। এই সময়ের অনেক ছেলেমেয়েদের মতো উপরচালাকি ভাব একেবারেই নেই। অথচ এমন নয় যে, ত্রপা গ্রামের মেয়ে, শহুরে জটিলতা, প্যাঁচপয়জার দেখেনি। সবই দেখেছে। শহরে জন্মেছে, শহরেই বড় হয়েছে। লেখাপড়া করেছে কল্যাণীতে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পালা শেষ করে এখন বিশ্বভারতীতে গবেষণার কাজ করছে। থাকে বোলপুরে, পেইং গেস্ট হিসেবে। তবে বেশিরভাগ সময়ই বাড়িতে থাকা হয় না। ফিল্ড ওয়র্ক করতে ব্লকে ব্লকে ঘুরে বেড়াতে হয়। গ্রামে রাতও কাটায়। নাওডুবিতে বারবার শিরীষের কাছে যাতায়াত করা এবং ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকার কারণও সেই গবেষণা। এটা তার গবেষণারই একটা অংশ। ত্রপা সেদিন ভিজতে ভিজতেই বকবক করতে লাগল।

“স্যার, কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি। কাদা-মাটি, জল-বৃষ্টিতে অভ্যস্ত না হলে চলে? আমার একটা পেপার ছিল রেন হার্ভেস্টিং-এর ওপর। বৃষ্টিতে চাষ। থিয়োরির পর যেতে হবে প্র্যাকটিকালে। একবারে হাতে- কলমে চাষ দেখতে হবে। আমি গেলাম আমোদপুরে। ইউনিভার্সিটি থেকে পাঠাল। সেখানে যাওয়ার সময়ে একটা বিরাট বোকামি করে ফেললাম। গামবুট নিয়ে যেতে ভুলে গেলাম। এদিকে আমাকে তো বৃষ্টির মধ্যে খেতে নেমে কাজ দেখতে হবে। তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আল ধরে তো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম। খানিকটা যাওয়ার পরই হল বিপদ। পা হড়কে পড়লাম খেতে খেতে তখন টইটম্বুর জল। আমার প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গেল ডুবে, পা গেল কাদায় গেঁথে… কিছুতেই আর টেনে তুলতে পারি না। পারব কী করে? জুতো তো আটকে গেছে!”

এই পর্যন্ত গল্প বলার পর ত্রপার ছাতার একটা দিকের শিক বৃষ্টির ঝাপটায় গেল উলটে। ত্রপা জিব কেটে বলল, “এই রে! আজও একটা ভুল করে ফেলছি। ভাঙা ছাতাটা নিয়ে চলে এসেছি। কেন যে বারবার এত ভুল হয়ে যায়!”

শিরীষ হেসে ফেলল। মনে হল, খানিক আগে এপাকে দেখে যে রাগ হয়েছিল সেটা আর নেই। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া এই সুন্দর মেয়েটাকে খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, মেয়েটা আলাদা কেউ নয়, বৃষ্টির একটা অংশ।

বাড়ি ফিরতে ত্রপা তাড়াতাড়ি জল গরম করে দিল। স্নান করে জামা কাপড় বদলাল শিরীষ। এপার তো সে উপায় নেই। সে সঙ্গে জামাকাপড় কিছু রাখে না।

“স্যার, আমার সমস্যা হবে না। খানিক বাদেই তো ফিরে যাব। জামা গায়েই শুকিয়ে যাবে।”

শিরীষ অবাক হয়ে বলল, “এক্ষুনি ফিরে যাবে কী করে? বাইরের অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না? বৃষ্টি কমলেও এখনই থামবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া এখন বোলপুর ফিরবে কী করে?”

কথাটা ঠিক। কোনও কোনও দিন গবেষণার কাজ বাবদ গাড়ি ভাড়া করে নেয়। ফিল্ডওয়ার্ক থাকলে গাড়ি ভাড়ার বিল জমা দিলে টাকা পাওয়া যায়। কোনও কোনও দিন গাড়ি না থাকলে ট্রেন-বাস ধরে চলে আসে। আজ গাড়ি পায়নি ত্রপা। আসার সময় ঝামেলা হয়নি। কিন্তু ফিরে যাওয়া কঠিন। সবেরগঞ্জ গিয়ে বাস ধরে রেল স্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে বোলপুর পৌঁছনো একরকম অসম্ভব। তার ওপর বৃষ্টি চলছে। ত্রপা তারপরেও বলল, “স্যার, চিন্তা করবেন না, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

এবার কড়া গলায় শিরীষ বলল, “বোকার মতো কথা বোলো না। দুম করে চলে আসার আগে ভাবা উচিত ছিল। মেঘ দেখার পরও যখন বেরিয়েছ, সঙ্গে আস্ত ছাতা, এক সেট জামাকাপড় নিয়ে বেরোনো উচিত নয় কি? মাঠেঘাটে ঘুরে কাজ করো, এটা খেয়াল থাকে না কেন?”

ত্রপা অপরাধীর মতো কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “বেরোনোর সময় আমি যে-মেঘ দেখেছিলাম স্যার, ওতে বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। আর হলেও এতটা হয় না।”

শিরীষ খানিকটা অন্যমনস্ক হয়েই বলল, “সব কিছু কি কথা মতো হয়? এই যে আজ আমি পথ হারিয়ে নাওডুবি নদীটা খুঁজে পেলাম, তা কি কারও কথা মতো হয়েছে? এই যে দু’জনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজলাম, সেও কি কারও কথা শুনে? এই যে তুমি আজ অন্ধকার মাঠঘাটের মধ্যে আটকে পড়লে সেটাও কি কথা ছিল? ছিল না। এমনই অনেক কিছুরই কথা থাকে না, হয়ে যায়। রোদ ওঠে, বৃষ্টি পড়ে।”

ভিজে কাপড়ে ত্রপার শীত করছে। হালকা কাঁপুনিও হচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে যেন। তারপরেও সে অস্ফুটে বলল, “স্যার, কী অপূর্ব বললেন!”

শিরীষ নিজের কাচা ইস্তিরি করা চুড়িদার পাজামা, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি বের করে এনে বলল, “নাও, ধরো। এখনই গরম জলে স্নান করে এসো। গেস্টরুমটা খুলে দিচ্ছি। চাদর বালিশ সব আছে। রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বে।”

ত্রপা কী করবে বুঝতে পারছিল না। শিরীষের দেওয়া পোশাক হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। তার লজ্জা করছে। খুবই লজ্জা করছে। স্যারের পোশাক সে গায়ে দেবে কীভাবে?

“কী হল, কথা কানে গেল না? যাও বলছি। কাঁপছ তো। এখনই চেঞ্জ না করলে জ্বর আসবে।”

ত্রপা বিড়িবিড় করে বলল, “আমার অভ্যেস আছে। একবার হয়েছিল কী…”

শিরীষ ধমক দিয়ে বলল, “চুপ! আবার গল্প শুরু করে… এ তো আচ্ছা মেয়ে?”

ত্রপার শরীরে আবার কাঁপুনি এল। তবে এবার আর শীতে নয়, এল আনন্দে। সে বাথরুমের দিকে ছুট দিল।

ধান পাকতে শুরু করছে। খেতে খুব কাজ নেই। তাই হারান একাই এসেছিল সেদিন। যেটুকু যা কাজ ছিল করে দিয়েছে। বৃষ্টি শুরু হতে চিন্তায় পড়েছিল সে, বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস বেশি হলে ধানের ক্ষতি হবে। আমন ধানে অসময়ের ঝড়-বৃষ্টি ভাল নয়। এখানে আবার চাষ একটু দেরিতেই শুরু হয়েছে। জমি তৈরি করতে সময় লেগেছিল। তারপরে বিছন তৈরিতে সময় গিয়েছে। প্রায় মাসখানেক লেগে গিয়েছে। তারপর সময় গিয়েছে বীজতলা বানাতে। সবমিলিয়ে চারা পুঁততে সেই আষাঢ় মাসের মাঝখান পর্যন্ত গড়িয়েছে। পরের বার থেকে আর এতটা সমস্যা হবে না। তখন তো মাটি তৈরিই থাকবে। ঝড়-জলের ঝামেলা না হলে এবার অগ্রহায়ণের মাঝেই ধান পুরোপুরি পেকে উঠবে। আগেও হতে পারে। শিরীষ আসতে হারান মাথায় ছাতা খুলে সাইকেলে বসল। তার বাড়ি যেতে অসুবিধে নেই। সে তো থাকে নাওডুবি গ্রামে।

ত্রপা বাথরুম থেকে বেরোল খানিকটা জড়সড় হয়ে। পাজামা এবং পাঞ্জাবি, দুটোই মাপে বড় হয়েছে। হওয়ারই কথা। তবে একটা অস্বস্তি থেকে বেঁচেছে। তার ব্রা, প্যান্টি সবই ভিজে গিয়েছে। সেসব খুলে শুকোতে দিতে হয়েছে। পোশাক বড় হওয়ায় অন্তর্বাস না থাকার অস্বস্তি কম হচ্ছে। স্যারের সঙ্গে কাল সকাল পর্যন্ত থাকতে পারবে, ভেবেই খুব আনন্দ হচ্ছে ত্রপার। অনেকটা কাজ করতে পারবে। এই আনন্দের জন্য সে সব জড়তা এবং অস্বস্তিকে তুচ্ছ করতে পারে। একটু ক্ষণের মধ্যে ত্রপাকে চমকে দিয়ে শিরীষ দুটো কাজ করল। এক নম্বর হল, চা বানিয়ে ত্রপাকে তার ঘর থেকে ডেকে পাঠাল। আর দু’নম্বর হল, একটা পাতলা গায়ের চাদর বের করে দিল।

“চাদরটা ভাল করে গায়ে দাও। ঠান্ডা লেগে যাবে। চলো, আমরা বারান্দায় বসে চা খাই।”

ত্রপা এতটাই মুগ্ধ হল যে কী বলবে, কী করবে বুঝতে পারল না। হাতের চায়ের মাগটা নিয়ে খানিকটা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। অস্ফুটে বলল, “স্যার, আপনি চা বানিয়েছেন!”

শিরীষ বলল, “কেন, আমি পারি না ভেবেছ? একসময়ে হস্টেলে থেকেছি, সব আমার শেখা। খেয়ে দেখো, আগে চুমুক দাও।”

ত্রপা কাঁপা হাতে মাগ মুখে তুলে চুমুক দিল, “অপূর্ব!”

শিরীষ হেসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ! তা হলে তুমি আজ রাতে আমাকে খিচুড়ি বানিয়ে খাওয়াবে।”

ত্রপা কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, “স্যার, আমি তো খিচুড়ি বানাতে পারি না।”

শিরীষ হেসে বলল, “নো প্রবলেম। খিচুড়ি বানানো ভেরি ইজ়ি। আমি তোমাকে বলে দেব, তুমি শিখে নেবে। চলো, চা খাই।”

গ্রিল ঘেরা বারান্দা ছোট কিন্তু দু’জনে চমৎকার বসা যায়। বেতের চেয়ার রাখা হয়েছে। বাইরে যতদূর দেখা যায় শুধু অন্ধকার। ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়েই চলছে।

ত্রপা বলল, “স্যার, আমি কি আপনার ইন্টারভিউটা শেষ করতে পারি?”

শিরীষ বলল, “অনেক তো হয়েছে, আবার কী?”

ত্রপা বলল, “একটু বাকি আছে স্যার।”

শিরীষ বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু তিনটে প্রশ্নের বেশি নয়।”

ত্রপা মোবাইলের রেকর্ডার মোড চালু করে এগিয়ে আসে। ফোনটা শিরীষের মুখের সামনে ধরল।

“এইভাবে বড় চাকরি ছেড়ে চাষ করতে চলে আসায় আপনার মিসেস কী বললেন?”

শিরীষ একটু হেসে বলল, “এটা তুমি আমার গিন্নিকেই জিজ্ঞেস করো বরং। তবে এখন নয়, এখন খুব চটে আছে। আমি যদিও নিশ্চিত, একদিন তার রাগ কমবে। মাঠ যখন সোনালি ধান বাতাসে মাথা দোলায়, তখন এক অনির্বচনীয় দৃশ্য গন্ধ তৈরি হয়। তার উপর রাগ করে থাকতে পারে?”

ত্রপা গদগদ গলায় বলল, “অপূর্ব বললেন স্যার।”

শিরীষ বলল, “তুমি এত ‘অপূর্ব’ বলো যে, মনে হয় ‘অপূর্ব’ যদি শব্দ না হয়ে মানুষ হত, বেচারি লজ্জায় মরে যেত!”

ত্রপা বলল, “স্যার, শুধু তো খেত ভরা সোনালি ধান নয়, সেই ধান বিক্রি করা নিয়েও অনেক সমস্যা হয়। ঠিকমতো বাজার পাওয়া যায় না, দাম পাওয়া যায় না। কৃষককে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে হয়…”

শিরীষ সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেই কষ্টটাও জানব, অনুভব করব। এটাও আমার এখানে আসার পিছনে একটা কারণ। স্বপ্ন দেখব, স্বপ্নভঙ্গ কেন হয় সেটাও দেখব।”

ত্রপা একটু আমতা আমতা করে বলল, “স্যার, যদি রাগ না করেন, একটা প্রশ্ন করি?”

শিরীষ বলল, “বলো, কিন্তু এটাই আজকে শেষ।”

“আপনি কি কোনও রাজনৈতিক কারণে…”

প্রশ্ন পুরো শেষ করতে হয়নি এপার, শিরীষ বলল, “হ্যাঁ, রাজনৈতিক কারণ আছে। একটাই রাজনীতি। নিজেকে এক অন্য জীবন চেনাব। সবাই চাইলেও এই সুযোগ পাবে না। আমার টাকাপয়সার একটা মোটামুটি চলে যাওয়ার মতো সঞ্চয় আছে। তাই আমি এই ঝুঁকি নিতে পারলাম। আমি সুযোগটা নিলাম। ব্যস, আর একটাও প্রশ্ন নয়। চলো, খিচুড়ি রান্না শেখাই।”

সত্যি খিচুড়ি রান্না হল। প্রেশারে চাল-ডালের মধ্যে বাগানের সবজি ফেলে দেওয়া হল। শিরীষের নির্দেশ শুনে শুনে সবটাই করল ত্রপা। তার উত্তেজনা, ভাল লাগা দেখে শিরীষ দারুণ মজা পেল।

“আজ রাতে তোমাকে একটা প্রাইজ দেব।”

“খিচুড়ি খারাপ হলেও দেবেন?”

“অবশ্যই দেব। তোমার এত আনন্দের জন্যই দেব।”

“দারুণ হবে স্যার। আনন্দ হচ্ছে বলে পুরস্কার! মা কি সাধে আপনাকে খুব ভালমানুষ বলেছেন? প্রাইজ়টা কী জানতে পারি?”

শিরীষ গলা নামিয়ে বলল, “রাতে জানতে পারবে।”

রাতে ডিমভাজা, আচার দিয়ে গরম খিচুড়ি খাওয়ার পর শিরীষ নিজে গেল গেস্টরুম তদারকি করতে। ত্রপা অনেক বারণ করলেও শুনল না।

“যাকে রোজ তাড়িয়ে দিই, তাকে যখন কাছে থাকতে বলি, যত্ন করবার দায় আমার।”

রাতে শুতে যাওয়ার আগে ত্রপা বলল, “স্যার, আমার প্রাইজ়?”

তখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। শিরীষ ফিসফিস করে বলল, “এখানে নয়, চলো, জলকাদা বাঁচিয়ে খেতের ধারে দাঁড়াই। যাবে?”

ত্রপা বলল, “অবশ্যই যাব।”

তখন মেঘ ছিল না আর। তারায় তারায় আকাশ ভরেছে। খেত থেকে ভেসে আসছে জলে ভেজা পাকা ধানের গন্ধ। নিকষ অন্ধকারে ‘স্যার’ যাতে পড়ে না যান ত্রপা তার কনুই ধরল। শিরীষ গলা খুলে বলতে শুরু করল—

“যদি মনে করো, এই ভাবে কেটে যাবে দিন/ তবে তুমি ভুল করো/ যদি মনে করো, এইভাবে কেটে যাবে রাত/ তবে তুমি ভুল করো/ দিনরাত সব কেটে যায় যে যার নিয়মে/ তুমি নিয়ম ভাঙা মানুষ/ বেঁচে থাকো শুধু ভাল থাকার ভ্রমে।”

শিরীষ চুপ করলে, ত্রপা আকুল স্বরে বলেছিল, “কী অপূর্ব! এই কবিতা কার লেখা?”

শিরীষ বলল, “চলো, ভিতরে যাই। শীত করছে। প্রাইজ় কেমন হল? নিজের লেখা কবিতা, নিজের মুখে শুনিয়ে দিলাম। তাও আবার ধানখেতের পাশে দাঁড়িয়ে।”

ত্রপা চুপ করে ঘরে ঢুকল। বলল, “স্যার, আমি আপনাকে একটা প্রণাম করব।”

শিরীষ ত্রপাকে কাছে টেনে কপালে একটু চুমু খেল।

“ভাল থেকো। অনেক বড় হও।”

শিরীষের রাতে জ্বর এল। প্রবল জ্বর। সকালে চলে যাওয়ার সময় ডাকতে এসে জানতে পারল। তারপর থেকে রয়ে গিয়েছে ত্রপা। দু’দিন ধরে সেবা করছে। ডাক্তারকে ফোন করছে। সাঁইথিয়া থেকে ওষুধ আনিয়েছে। তবে শিরীষের ভাল হয়ে যাওয়ার কথাটা পুরোটা বিশ্বাস করছে না।

শিরীষ অবাক হয়ে বলল, “আমি মিথ্যে বলি!”

“হ্যাঁ স্যার, বলেন। খিদে পেলেও বলেন, খিদে পায়নি। শরীর ভাল না হলেও বলেন, ভাল আছি। মন খারাপ হলেও বলেন, আজ মনটা খুব ভাল। আপনাকে বিশ্বাস করি না।”

শিরীষ ‘হো হো’ আওয়াজ করে হেসে ফেলল। হাত বাড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে তুমি এসে আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখো জ্বর আছে কিনা।”

ত্রপা চিন্তিত মুখে এগিয়ে এসে শিরীষ বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরল। তার ভুরু কুঁচকে গেল। আরও একটু এগিয়ে শিরীষের কপালে হাত দিল, গলায় হাত দিল। তারপর হাসিহাসি মুখে বলল, “না জ্বর নেই। এবার আপনি সত্যি বলেছেন।”

শিরীষ বলল, “বাপ রে! তুমি এমন ভাব করছ যেন আমি মস্ত কোনও রোগ থেকে সেরে উঠলাম। ঠান্ডা লেগে সামান্য জ্বর হয়েছিল মাত্র।”

ত্রপা একটু চুপ করে থেকে বলল, “ক’টাদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। ভাল করে ডাক্তার দেখিয়ে, রেস্ট নিয়ে আসুন।”

শিরীষ বলল, “খেপেছ? আমার খেতে প্রথম ধান পাকছে। এই সময়ে আমি কলকাতায় গিয়ে বসে থাকব! একেবারে নয়। এই আনন্দের স্বাদ আমি একটু একটু চুমুক দিয়ে নিতে চাই মাই ডটার। কোনও মুহূর্ত বাদ দেব না।”

এখন দেওয়াল ঘড়িতে সকাল সাতটা বেজে এগারো মিনিট। মিনিট কুড়ি আগে ঘুম ভাঙলেও শিরীষ ওঠেনি। এবার উঠে, থম মেরে বসে আছে। কোমর পর্যন্ত চাদর টানা। ঘরের জানলাগুলো খুলে দিয়েছে ত্রপা। ঝলমলে রোদে ঘর ভেসে যাচ্ছে। ঘরটা তৈরি করার সময় বেশি জানলা করতে বলেছিল শিরীষ।

ত্রপা বলল, “দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। দু’দিন তো কিছু মুখে দেননি। চা দিই একটু?”

“খেতে ইচ্ছে করেনি। এখন একটু করছে। সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণ। দাও, চা দাও।”

শিরীষ বিছানা থেকে নামতে গেলে মাথাটা হালকা টলমল করে উঠল। করাটাই স্বাভাবিক। দু’দিন শরীরের উপর দিয়ে যা গেল! মাথা ব্যথা, গা-হাত-পা ব্যথা, ধুম জ্বর। বৃষ্টিতে ভেজার ভোগান্তি। আহা রে, দোতারা বৃষ্টিতে ভিজতে পারে না। জীবনের একটা বড় আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত। বাথরুম থেকে বেরিয়ে শিরীষ ঠিক করল যে, দু’দিনের জন্য কলকাতায় যাবে। শরীরের জন্য নয়, মেয়ের জন্য মন কেমন করছে। সোমদত্তার সঙ্গেও কতদিন দেখা হয়নি। সে কি দেখা করবে? মনে হয় না। তা হলেও একবার ফোন করতে হবে।

ত্রপা গেস্টরুমে তৈরি হচ্ছে। তাকে এবার যেতে হবে। সে স্যারের জামাকাপড় কেচে শুকিয়ে দিয়েছে। সেগুলো ভাঁজ করতে লাগল। তার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে স্যারের কাছে গিয়ে কাঁদি। স্যার জিজ্ঞেস করুক, “এ কী! তুমি কাঁদছ কেন ত্রপা? আমি তো তোমাকে বকিনি?”

ত্রপা বলবে, “আমি বলব না স্যার, কিছুতেই বলব না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *