মাটির দেওয়াল – ৮

মৈত্রেয়র ফোন রেখে চুপ করে রইল সোমদত্তা।

মৈত্রেয় এ বাড়িতে আসতে চাইছে। সোমদত্তা বলেছে, “না না। মা আছেন। দোতারা আসতে পারে। যে মেয়েটা মাকে দেখাশোনা করে, সেও থাকে।”

মৈত্রেয় বলেছিল, “তাতে কী? এখনও আসতে পারি না!”

সোমদত্তা চুপ করে ছিল। বলল, “পরে বলব।”

মৈত্রেয় সহজভাবে বলেছিল, “বলার কী আছে? নেমন্তন্ন খেতে তো যাব না। তা ছাড়া একটা জরুরি কথা ছিল।”

“টেলিফোনে বলো।”

“এভাবে বলা যায় না। সামনে বসে বলতে হবে। তোমার দেওয়া দায়িত্ব খানিকটা পালন করতে পেরেছি মনে হচ্ছে।”

সোমদত্তা উৎসাহ নিয়ে বলল, “বলো।”

মৈত্রেয় বলল, “বললাম তো এভাবে হবে না।”

সোমদত্তা বলল, “বাইরে দেখা করছি। আজই।”

মৈত্রেয় বলল, “সে তোমার ইচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি কথা হয় তত মঙ্গল। অ্যাকশন নিতে সুবিধে হবে। নাওডুবির দু’জন লোকের সঙ্গে কথা বলেছি।”

সোমদত্তা বলল, “ভেরি গুড। কী বলল তারা?”

মৈত্রেয় বিরক্ত গলায় বলল, “বলছি তো টেলিফোনে বলব না। তোমার বাড়িতে যেতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এত বছর পর নিষেধাজ্ঞা উঠেছে। এখন দেখছি, ওঠেনি। শুধু কাজটুকুর জন্য আমাকে তোমার দরকার।”

সোমদত্তা নিচু গলায় বলল, “রাগ করছ কেন? বললাম তো, মাকে যে দেখাশোনা করে সে চলে আসতে পারে, দোতারা আসতে পারে…”

মৈত্রেয় বলল, “তাতে কী হত? তোমার মেয়ে এলেই বা কী এসে যায়? তুমি বা আমি কেউ চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে পড়ে নেই। একসময়ে এ বাড়িতে আমি অনেকবার এসেছি। তোমার বিয়ের আগে পর্যন্ত।”

সোমদত্তা একটু চুপ করে বলল, “বলছি তো রাগ কোরো না।”

মৈত্রেয় একটু হেসে বলল, “এত বছর বাদে আর নতুন করে কী রাগ করব সোমদত্তা? রাগ, অপমান কি এতদিন ধরে অবশিষ্ট থাকে? মানুষ চিনতে ভুল করেছিলে। আজ তো বুঝতে পারছ, কত বড় ভুল তোমরা করেছিলে। সেদিন তোমার বাবা, আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি নাকি তোমার স্বামী হিসেবে মানানসই নই। তোমাকে বিয়ে করার যোগ্যতা আমার নাকি ছিল না। বলেছিলেন, ওঁরা কোনও ছোটখাটো ব্যবসায়ীর হাতে মেয়েকে তুলে দেবেন না। আমার কাজ খুবই নিচু মানের। জেনেছিলাম, শিক্ষিত মানুষরা কাজের উঁচু-নিচু বিচার করে না। ভুল জানতাম।”

সোমদত্তা বলল, “আহ! এসব কথা এখন আবার টেনে আনছ কেন?”

মৈত্রেয় নিজেকে সামলাল। বলল, “আমি তো টানিনি, তুমি টানলে। তোমার বিপদে কোনও বন্ধু পাশে এসে দাঁড়াতে পারে না? আমি তো সব অপমান ভুলেই ছুটে এসেছি। কিছু পাওয়ার জন্য তো আসিনি।”

সোমদত্তা নরম গলায় বলল, “ঠিক আছে বাদ দাও ওসব।”

সত্যি এক সময়ে বেশিই বন্ধু ছিল দু’জনে। কলেজ জীবনের শেষদিকে। তবে তাকে ‘প্রেম’ বলে ভাবেনি সোমদত্তা, ঘনিষ্ঠ পরিচিতজন হিসেবেই দেখেছিল। এই পর্যায়টি চলে দীর্ঘ দিন। তখন বাড়িতেও এসেছে মৈত্রেয়। সোমদত্তা ইউনিভার্সিটি পাশ করে। আরও ডিগ্রি নিয়ে ভাল চাকরি পায়। মৈত্রেয়র লেখাপড়ায় মন ছিল না। যেটুকু না করলে নয়, সেটুকু। কলেজ পাশ করে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দেয়। তবে সোমদত্তাকে সাহায্য করত খুব। সে অর্ডার করলেই বই, নোটস, সাজেশন নিয়ে হাজির হত। তার একটা সেকেন্ডহ্যান্ড স্কুটার ছিল। ডাকলে বিরক্তি দেখাত, তবে দেরি করত না। সোমদত্তার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার ফর্মও জমা দিয়েছে। পরীক্ষার হলে নিয়ে গেছে স্কুটারের পিছনে বসিয়ে। চাকরি খোঁজার সময়েও সোমদত্তা তাকে খুব খাটিয়েছে। এসবের পিছনে অতিরিক্ত কোনও সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল বলে কখনও মনে হয়নি তার। ভাবার সময়ও ছিল না। সে তখন নিজের কেরিয়ার তৈরিতে পুরো মন দিয়ে বসে রয়েছে। আর পাঁচজনের মতো সাধারণ মন নয়, বাড়াবাড়ি ধরনের মন। বড় চাকরি করব, বাড়ি-গাড়ি হবে। মৈত্রেয় মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করত। একটা পর্যায়ের পর সোমদত্তা রেগে যেত।

“তোমার পিছনে এত সময় ইনভেস্ট করছি কেন জানো সোমদত্তা?”

সোমদত্তা সহজভাবে বলত, “তোমার কোনও কাজ নেই। বেকারদের কারও পিছনে সময় নষ্ট করতে হয়। তাও ভাল, তুমি একজন সুন্দরীর পিছনে সময় নষ্ট করছ।”

মৈত্রেয় হেসে বলত, “একবারেই নয়। ফিউচারে রির্টান পাব বলে।”

সোমদত্তা বলত, “কেমন রির্টান? টাকাপয়সা চাইবে নাকি? তা হলে বাপু মানে মানে কেটে পড়ে। দেখেছই তো আমার হাত দিয়ে সহজে টাকাপয়সা বেরোতে চায় না।”

মৈত্রেয় বলত, “না টাকাপয়সা রির্টান নয়, সার্ভিসের বিনিময়ে সার্ভিস দিয়ে।”

সোমদত্তা ভুরু কুঁচকে বলত, “সেটা কেমন?”

মৈত্রেয় একটু ভেবে বলত, “এই ধরো বলব, চা করে দাও, ভাত করে দাও, স্নানের জল গরম করো…”

সোমদত্তা বলত, “মানে! হোয়াট ডু ইউ মিন মৈত্রেয়?”

মৈত্রেয় মুচকি হেসে বলত, “বাঃ! পতিসেবা বলে একটা কথা আছে না?”

সোমদত্তা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলত, “আমি কি পতির স্নানের জল গরম করবার জন্য লেখাপড়া শিখেছি! ভাল জবের চেষ্টা করছি!”

মৈত্রেয় সামলাতে গিয়ে বলত, “আহা, রাগছ কেন? ঠাট্টা করলাম।”

সোমদত্তা গম্ভীর হয়ে বলত, “এই ধরনের ঠাট্টা আমি পছন্দ করি না মৈত্রেয়। দুটো বইপত্র ক্যারি করবার বদলে তুমি যদি মনে করো এই ধরনের চিপ ঠাট্টা করবে, আমি অ্যালাউ করব না। তা হলে তো ক্যুরিয়র সার্ভিসকে ঠাট্টা রসিকতার পারমিশন দিতে হয়।”

মৈত্রেয় বলত, “আচ্ছা আর করব না।”

পরে আবার করত। দুম করে হয়তো একদিন বলত, “সোমদত্তা, এই যে তোমার জন্য এত দৌড়াদৌড়ি করি, মনে রাখবে তো?”

সোমদত্তা ভুরু কুঁচকে বলত, “কেমন মনে রাখা চাও?”

মৈত্রেয় বলত, “ভেরি সিম্পল। তুমিও একদিন আমার জন্য দৌড়োবে।”

“দৌড়োতে পারব না। নিজের গাড়ি তো হবেই, তাতে লিফ্‌ট দিতে পারব।”

একসময় মৈত্রেয় ব্যাবসা শুরু করল। নানারকম ব্যাবসা। সবই ছোটখাটো। তেমন জমল না। একসময় নামীদামি মেশিনের পার্টস বিক্রি করত। তাই নিয়ে ঝামেলাও হল। নকল জিনিসের কারবার করছে, এই অভিযোগে পুলিশের ঝামেলা। টাকাপয়সা দিয়ে কোনওক্রমে অ্যারেস্ট আটকাল। সোমদত্তার বাবা সেই সময় কিছুটা সাহায্য করেছিলেন। লালবাজারের ফ্রড সেকশনে তাঁর এক বন্ধু কাজ করতেন। তাঁকে বলেছিলেন। তারপর থেকে সোমদত্তার সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। ততদিনে সোমদত্তা চাকরিতে মন দিয়েছে। এমনকী, মুম্বইতে একটি কোম্পানিতে কিছুদিন কাজ করে এসেছে। কলকাতায় আসার পর আবার ফোন এল। মৈত্রেয়ই করল।

“কলকাতায় ফিরে এলে কেন?”

সোমদত্তা অবাক হল, “ফিরে এসেছি, সে খবর কোথা থেকে পেলে!”

মৈত্রেয় গলায় অভিমান নিয়ে বলল, “তুমি আমার খবর না রাখলেও আমি তোমার খবর রাখি।”

সোমদত্তা প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল, “ভালই হল তুমি ফোন করেছ। বেটার অফার পেয়ে চলে এসেছি। তবে এখানে এসে আবার ঠিকানা বদলের ঝামেলায় পড়েছি। ভেবেছিলাম বাইরেই পাকাপাকি থাকব। সেই মতো কতগুলো ডকুমেন্ট বদলে নিয়েছিলাম। আবার পড়েছি ঝামেলায়। মৈত্রেয়, তুমি অবশ্যই একটু এসো। ছোটাছুটি করতে হবে। দেরি কোরো না, শনিবারই এসো।”

মৈত্রেয় শান্তভাবে বলল, “শনিবার তো আমি থাকব না।”

“তা হলে নেক্সট উইক করো। তার বেশি দেরি কোরো না। কাজটা আটতে যাবে।”

মৈত্রেয় ফোনেই ব্যঙ্গের হেসে বলল, “আমার জন্য তোমার কোন কাজটা আটকে আছে সোমদত্তা? সব হয়ে যাবে। এই যদি আমি ফোন না করতাম, তোমার ঝামেলা কি মিটত না?”

এবার সোমদত্তা হেসে বলল, “আচ্ছা বাপু, অনেক রাগ দেখানো হয়েছে। এবার বলো দেখি কবে আসছ? এই সব ঝামেলা না মিটলে মুশকিল। ক’দিন পর লন্ডন যাব। কোম্পানি তিনমাসের জন্য ট্রেনিং-এ পাঠাচ্ছে। প্রপার ডকুমেন্টস ছাড়া ভিসা পেতে অসুবিধে হবে বলেছে।”

মৈত্রেয় আবার হেসে বলল, “হাসিয়ো না সোমদত্তা। এমন ভান করছ, আমি না থাকলে তোমার লন্ডন যাওয়া হবে না। এসব কাজ করার জন্য অনেক এজেন্ট আছে। তাদের বলো, সব স্মুদলি হয়ে যাবে।”

সোমদত্তা বলল, “তুমিই আমার এজেন্ট। বাবা! এতদিন বাদে ফোন করে, এত রাগ দেখাচ্ছ কেন?”

একটু চুপ থেকে মৈত্রেয় বলেছিল, “কোনও কারণ নেই। এমনি দেখাচ্ছি।”

সেদিন টেলিফোন ছাড়ার পর সোমদত্তা বুঝতে পারল, সে একটা অন্যায় করে ফেলেছে। নিজের কথা বলল, মৈত্রেয়র কথা কিছু জিজ্ঞেস করা হল না। সে কেমন আছে? কী করছে? ব্যাবসার সমস্যা কি মিটেছে? ওর মা খুব অসুস্থ ছিলেন। তিনি ঠিকঠাক আছেন তো? সোমদত্তার নিজের উপর রাগ হয়েছিল। ছিঃ! এটা কী করল! নিজেকে নিয়ে, নিজের কেরিয়ার নিয়ে এত মেতে উঠেছে যে, সামান্য ভদ্রতাটুকুও ভুলতে বসেছে! একবার ভাবল, এখনই আবার ফোন করে। পরক্ষণেই মনে হল, সেটা আরও খারাপ হবে। যা ভুল করবার করে ফেলেছে। পরে ‘সরি’ বলে নিতে হবে। খানিকটা সময় গেলে, নিজের সপক্ষে মনে মনে যুক্তি সাজিয়ে নিল সোমদত্তা। মৈত্রেয়র বোঝা উচিত, এরকম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এখন তার কেরিয়ার গড়ার সময়। সবসময়েই চাপা টেনশন। একটা অফিস ছেড়ে অনা অফিসে এসেছে। সেখানে নিজেকে মানানসই এবং গুরুত্বপূর্ণ করতে হবে। এই সময় সাধারণ ফর্মালিটিজ় মাথায় নাও থাকতে পারে। গোটা জীবন ধরেই, ‘তুমি কেমন আছ? বাড়ির সবাই কেমন আছে?’ ধরনের কথা বলা যায়, কিন্তু সারা জীবন ধরে কেরিয়ার তৈরি করা যায় না। মৈত্রেয় নিশ্চয়ই বুঝবে। এতে রাগ বা অপমানের কিছু নেই।

আসব না বলেও শনিবার মৈত্রেয় চলে এসেছিল। সঙ্গে সেই আগের স্কুটার। এতদিনে স্কুটারের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ফাইল হাতে বেরিয়ে সোমদত্তা থমকে গেল। এরকম একটা লড়ঝড়ে গাড়িতে বসে যাওয়া ঠিক হবে না। তার চেয়ে বড় কথা, স্কুটারের পিছনে বসে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কলকাতার পথে ঘোরার মতো অবস্থা তার আর নেই। ছেলে যতই তার পরিচিত হোক। সে এখন কলেজে পড়ে না। অফিসের কেউ যদি দেখে ফেলে, সেটা তার পক্ষে ভাল হবে না।

“মৈত্রেয়, ট্যাক্সিতে যাব। তোমার গাড়ি এখানে রেখে দাও। ফিরে নিয়ে যাবে।”

মৈত্রেয় হেসে বলল, “ভয় নেই, পথে ভেঙে পড়বে না।”

সোমদত্তা বলল, “তা নয়, কোমরে একটা ব্যথা হয়েছে। স্কুটারের ঝাঁকুনিতে সমস্যা হতে পারে।”

মৈত্রেয় বলল, “সাবধানে চালাব।”

সোমদত্তা হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল, “তুমি সাবধানে থাকলে কী হবে, কলকাতার রাস্তা তো আর সাবধানে থাকবে না। একবার লেগে গেলে আমাকে বিছানা নিতে হবে।”

মৈত্রেয় কথা বাড়ায়নি। স্কুটার সোমদত্তাদের বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর ট্যাক্সি ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তখনও কলকাতায় মোবাইলে ক্যাব ডেকে নেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়নি। দোতলার বারান্দা থেকে গোটা ঘটনাটা সেদিন দেখেছিলেন সোমদত্তার বাবা সৌমেন্দু সেন। মৈত্রেয়কে দেখার পর থেকেই তাঁর ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। স্কুটার রেখে, ট্যাক্সিতে মেয়ের সঙ্গে মৈত্রেয় উঠে যাওয়ায় সেই কোঁচকানো ভুরু আরও গভীর হল।

কাজ শেষ হতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। মৈত্রেয় বলেছিল, “চলো কফিহাউসে বসে কফি খাই।”

সোমদত্তা বলেছিল, “না কফিহাউস নয়, বড্ড চেঁচামেচি হয়। আজকাল এত হট্টগোল স্ট্যান্ড করতে পারি না। অন্য কোথাও চলো।”

গলির মধ্যে একটা রেস্তোরাঁয় বসেছিল দু’জনে। কোণের টেবিলে। সোমদত্তা বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি না। চিরকাল আমার কাগজপত্র ঠিকঠাক করে দিয়ে ব্যাড হ্যাবিট তৈরি করে দিয়েছ। মুম্বইতে খুব সমস্যায় পড়তাম।”

গলির মধ্যে একটা রেস্তোরাঁয় বসেছিল দু’জনে। কোণের টেবিলে। সোমদত্তা বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি না। চিরকাল আমার কাগজপত্র ঠিকঠাক করে দিয়ে ব্যাড হ্যাবিট তৈরি করে দিয়েছ। মুম্বইতে খুব সমস্যায় পড়তাম।”

মৈত্রেয় একটু চুপ করে থেকে বলল, “তুমি বদলে গেছ সোমদত্তা।”

সোমদত্তা অস্বস্তি নিয়ে হেসে বলল, “সে আবার কী!”

মৈত্রেয় গম্ভীর হয়েই বলল, “তুমি নিজেও তা জানো।”

সোমদত্তা চায়ের কাপ টেনে নিয়ে সহজভাবে বলল, “মানুষ তো বদলায়। সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? তুমিও কি বদলাওনি মৈত্রেয়? কলেজে তোমাকে যেমন দেখেছি, যেভাবে দেখেছি, তুমি কি তেমনই আছ?”

মৈত্রেয় চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “তা হয়তো হবে। তবে সে বদলানোর বেশিটাই বাইরের হয়। তোমার ভিতরটাও বদলেছে।”

সোমদত্তার পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলল, “ভিতরের বদলের নিকুচি করো, সে তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না! বাইরেটা বদলালে বিপদ। আমি আর আগের মতো সুন্দরী নই বলছ?”

মৈত্রেয় এবার একটা কাজ করে বসল। হাত বাড়িয়ে সোমদত্তার ডানহাতটা ধরল। সোমদত্তা এর জন্য তৈরি ছিল না। মৈত্রেয় এর আগেও তার হাত ধরেছে। সেও ধরেছে। হাত কেন কাঁধ, কোমরও ধরেছে। একসময়ে তার স্কুটারে যাতায়াত তো কম করেনি। গাড়ি টাল খেলেই জড়িয়ে ধরতে হয়েছে মৈত্রেয়কে। মৈত্রেয়ও হাত ধরে স্কুটার থেকে নামিয়েছে। কিন্তু এই স্পর্শ সেসবের থেকে আলাদা। বুকটা ধক করে উঠেছিল সোমদত্তার। মৈত্রেয় কি কিছু বলতে চায়? এর আগে তো এরকম আচরণ করেনি! সে কি প্রোপোজ় করছে চাইছে? এই জন্যই কি সে খবর রেখেছে এতদিন?

মৈত্রেয় খানিকটা গাঢ় স্বরে বলল, “আমার কাছে তুমি সবসময়েই সুন্দর সোমদত্তা।”

সোমদত্তা খুব ধীরে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “তোমার ব্যাবসা কেমন চলছে?”

মৈত্রেয় সোমদত্তার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। সেও হাত সরিয়ে নিল। বলল, “ওই চলছে। নতুন অফিস তোমার কেমন চলছে?”

সোমদত্তা হেসে বলল, “ওই চলছে।”

বাকি সময়টুকু চুপচাপই চা খেল দু’জনে। বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরার সময় মৈত্রেয় বলল, “তুমি চলে যাও সোমদত্তা। আমি একটা কাজ সেরে যাচ্ছি। রাত হলেও সমস্যা নেই, আমি তোমার বাড়ি গিয়ে স্কুটার নিয়ে আসব।”

সোমদত্তা চাপা গলায় বলল, “ছেলেমানুষি কোরো না। ট্যাক্সিতে ওঠো।”

পথে যেতে যেতে পাশে বসা মৈত্রেয়র হাত ধরেছিল সোমদত্তা। মৈত্রেয় হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে সোমদত্তা আরও শক্ত করে ধরে। তারপর হেসে বলে, “তুমি দেখছি, এই ক’বছরে অনেক বদলে গেছ মৈত্রেয়। খুব রাগ হয়েছে তোমার, কথায় কথায় রাগ দেখাচ্ছ। কেন?”

মৈত্রেয় মলিন হেসে বলল, “আমি তোমাকে রাগ দেখানোর কে?”

“ওসব বাজে কথা ছাড়ো। কী হয়েছে তোমার? এত অভিমান কীসের?”

মৈত্রেয় হেসে পরিস্থিতি সহজ করতে চায়। বলে, “ধুর! কীসের আবার অভিমান?”

সোমদত্তা বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, “আরে বাবা, এখন আমাদের নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে ভাবনার সময়। এত দিন ধরে যে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখলাম সেটা তো কাজে লাগাতে হবে। হবে কিনা?”

মৈত্রেয় জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। অস্ফুটে বলল, “তোমার লেখাপড়া আছে, আমার তো নেই।”

সোমদত্তা হাতে চাপ দিয়ে বলল, “ছেলেটা বোকার মতো কথা বলে। তোমার যা আছে সেটাই তোমার লেখাপড়া। তুমি তো নিজের ইচ্ছেতেই ব্যাবসা করছ।”

মৈত্রেয় হতাশভাবে বলল, “সেটাই বা দাঁড়াচ্ছে কই?”

সোমদত্তা বলল, “বিজ়নেসে আপস অ্যান্ড ডাউনস থাকবেই।”

মৈত্রেয় বলল, “আমার সবই ডাউন সোমদত্তা। লেখাপড়া, ব্যাবসা, জীবন সবই।”

তখন শহরে সন্ধে নামছিল। চারপাশে রং বদলাচ্ছে, বাতাস বদলাচ্ছে। সেই বাতাসে গন্ধ বদলাচ্ছে। প্রকৃতি এই সময়ে মানুষকে নিয়ে খেলা করতে ভালবাসে। নিজের সঙ্গে মানুষকেও বদলাতে থাকে। কারও মুখে আলো ফেলে, কেউ চলে যায় অন্ধকারে। কাউকে জীবনের ছায়া করে কোমরে দড়ি বেঁধে দেয়। যেন আসামি। পালানোর পথ নেই। কাউকে প্রকৃতি মুক্তও করে। আগল ভেঙে দেয় তার। সেদিন সোমদত্তার তাই হল। আগল ভেঙে গেল যেন। যা সে কখনও করেনি, করার কথা ভাবেনি, সেদিন চলন্ত ট্যাক্সিতে তাই করল। মৈত্রেয়কে নিজের দিকে ফিরিয়ে জোর করে টেনে নিল, কিছু বোঝার আগেই তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল কয়েক মুহূর্তের জন্য। এটুকুতেই মৈত্রেয়র ঠোঁট ভিজিয়ে দিল।

ট্যাক্সি থেকে নেমে স্বাভাবিকভাবে সোমদত্তা বলল, “স্কুটারটা বদলিয়ো৷ ওই গাড়িতে চড়লে এবার পথে বিপদে পড়বে। টাকা লাগলে বলবে।”

মৈত্রেয় উজ্জ্বল গলায় বলল, “টাকা লাগবে না। দুটো বড় পেমেন্ট পেলেই হয়ে যাবে। এবার আর স্কুটার টুটার নয়। চার চাকা নেব।”

সোমদত্তা গেট খুলে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ব্যবসায় মন দাও। ওটাকে ভাল করে দাঁড় করাও। বাবাকে তো জানো, কড়া ধাঁচের মানুষ। আমি একমাত্র মেয়ে। অনেক দেখেশুনে বিয়ে দেবেন। যতই লেখাপড়া শিখি আর আধুনিক হই না কেন, বিয়েতে কিন্তু বাবাকে ইয়েস বলতে হবে। সে মেক ইয়োরসেলফ্‌ রেডি। আমি লন্ডন থেকে ফিরে আসি।”

সেসব কেটে গিয়েছে অনেকদিন। জীবনের উপর দিয়ে জল গড়িয়েছে বহু। দীর্ঘ ছাড়াছাড়ির পর আবার মৈত্রেয়র সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে সোমদত্তার। এতদিনে তার যেমন বদল হয়েছে, বদল হয়েছে মৈত্রেয়রও। সোমদত্তার থেকে সে সরে গিয়েছিল অস্থির, ব্যর্থ মনে। এমনকী সুইসাইড পর্যন্ত করবে ভেবেছিল। ধীরে ধীরে মনকে শক্ত করে। কাজে মন দেয়। ধাপে ধাপে উন্নতি করেছে অনেকটা। বড় কোম্পানির গাড়ির ডিলারশিপ পেয়েছে। মোটরবাইকও রাখছে। ইচ্ছে আছে, ছোট ভ্যান আর ট্রাক্টরের কাজও করবে। গ্রামে এখন এই দুটোর চাহিদা বেড়েছে। অনেকেই ট্রাক্টর কিনে ভাড়া দিচ্ছে। রাজারহাটে গাড়ির জন্য বড় শোরুম করছে। মধ্যমগ্রামে একটা ছোট বাড়ি কিনে ফেলেছে। বিয়ে ‘করব করব’ করেও করা হয়ে ওঠেনি। আসলে ঠেলা দেওয়ার কেউ ছিল না। আবার এমনটাও হতে পারে, সোমদত্তাকে ভুলতে পারছিল না। ব্যাবসার সূত্রে এক বিবাহিত মহিলার সঙ্গে আলাপ হল। প্রেম নয়, প্রেম প্রেম ভাব। সেই ভাব শরীর পর্যন্ত গড়ায়। তবে মহিলা শরীরে তেমন সাড়া দিতে পারত না। ভাল লাগত না মৈত্রেয়র। মহিলা স্বামীর বদলিতে পাটনা চলে গেল। মৈত্রেয় ভাবল, ভালই হল। ঝামেলা বিদায় হয়েছে। সোমদত্তার সঙ্গে এত বছর পর আবার যোগাযোগ হয়েছে। হয়েছে একেবারে আকস্মিকভাবে।

কোর্টে দেখা হয়ে গেল দু’জনের। মৈত্রেয় ব্যাবসার কাজে কোর্টে গিয়েছিল। কোনও এক পার্টির সঙ্গে গাড়ি কেনাবেচা নিয়ে মামলা চলছে। সোমদত্তাই দেখতে পেয়ে ডেকে নিল। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চা খেল দু’জনে। যতটা পারা যায় সহজভাবে কথা বলেছে। কে কেমন আছে খবর নিয়েছে। যেমন অনেক বছর পর দেখা হলে নিতে হয়। মৈত্রেয়র ব্যাবসা বড় হয়েছে, ভাঙা স্কুটার ছেড়ে বড় গাড়ি চড়ছে, বাড়ি কিনেছে শুনে সোমদত্তার চোখ বড় হয়ে গেল।

“কনগ্র্যাচুলেশনস! কাজে মন দিয়েছ তবে।”

মৈত্রেয় ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে হেসে বলল, “তুমিই তো বলেছিলে কাজে মন দিতে।”

সোমদত্তা বলল, “বিয়ে করোনি কেন?”

মৈত্রেয় হেসে বলল, “তুমি তো তেমন কিছু বলে যাওনি।”

বেশি বয়সেও লজ্জা পেল সোমদত্তা। বলল, “ধ্যাত, আমি কি তোমাকে বিয়ে করতে বারণ করেছিলাম? যতসব বাজে কথা। এখনও সময় আছে, বিয়ে করে ফেলো।”

মৈত্রেয় বলল, “পাত্রী খুঁজে দাও, করে ফেলছি। মনে রাখবে, এখন মৈত্রেয় আর সেই আগের ভিখিরি মৈত্রেয় নেই, বয়স বেশি হলে কী হবে, বিয়ে করলে রাজপুত্র না পাক, মেয়ে টাকা, বাড়ি, গাড়ি সব পাবে। মেয়ের বাবা ঘাড় ধাক্কা দিতে পারবে না।”

সোমদত্তা বলল, “খোঁচা দিচ্ছ?”

মৈত্রেয় খালি ভাঁড় ফুটপাথে রাখা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলল, “সরি। চলো, তোমাকে নামিয়ে দিই।”

সোমদত্তা বলল, “আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।”

গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল মৈত্রেয়। গাড়িতে উঠতে উঠতে ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে এগিয়ে দিল সোমদত্তা। ভিজ়িটিং কার্ডটা নেড়েচেড়ে দেখে মৈত্রেয় বলল, “বাপ রে! এ তো বিরাট চাকরি! তোমাদের অফিসে আমার একজন ক্লায়েন্ট আছে। আমার ওখান থেকে গাড়ি নিয়েছিলেন।”

সোমদত্তা বলল, “তাই নাকি! কী নাম?”

মৈত্রেয় ভুরু কুঁচকে নাম মনে করার চেষ্টা করল। বলল, “সাম মজুমদার… পুরোটা মনে পড়ছে না।”

সোমদত্তা গাড়ির দরজা খুলে নিচু গলায় বলল, “রাতে ফোন কোরো।”

একটু অবাক হয়ে মৈত্রেয় সোমদত্তার দিকে তাকায়। সোমদত্তা বলে, “আমি এখন সল্টলেকে থাকি। রাতে একাই থাকি। মাঝেমধ্যে মেয়ে আসে। এলেও আলাদা ঘরে শোয়।”

মৈত্রেয়কে হতবাক করে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছিল সোমদত্তা।

সোমদত্তা কেন কোর্টে এসেছিল সেদিনই জেনে গেল মৈত্রেয়। মামলা অদ্ভুত হলে কোর্টে আলোচনা হয়। সেই আলোচনা থেকেই কানে এল। সোমদত্তা মুখার্জি নামে এক মহিলা তার স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলা দায়ের করেছে। স্বামী শিরীষ মুখার্জি বড় কোম্পানির বড় পদে চাকরি করত। হঠাৎই তার ইচ্ছে হয়েছে, সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে গিয়ে চাষবাস করবে। চাকরি ছেড়েও দিয়েছে। অনেক বুঝিয়েও তাকে নাকি আটকানো যায়নি। স্ত্রী মনে করে তার স্বামী বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছে। তার সঙ্গে সে সংসার করতে পারবে না। কিন্তু কোর্টে এখনও যথেষ্ট প্রমাণ সাবুদ করতে পারেনি। তবে উকিল পেয়েছে ওস্তাদ।

মৈত্রেয় অবাক হল। এ আবার কেমন ঘটনা! সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে গিয়ে ধান চাষ! লোকটার কি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?

শোরুমের সঙ্গে একটা ছোট অফিস করেছে মৈত্রেয়। সাজানো গোছানো অফিস। বাইরে যে-মেয়েটি বসে, সে-ই রিসেপশনিস্ট এবং পার্সোনাল সেক্রেটারি। এই সব ব্যবসায় বাইরের চাকচিক্য লাগে। নিজের ঘরের একদিকে একটা সোফা রেখেছে মৈত্রেয়। হাতল ধরে টানলে চমৎকার ডিভান বেরিয়ে আসে। কাজের চাপ থাকলে কোনও কোনও দিন রাতে এখানে থেকে যায়। ব্যাবসা বাড়ছে। ঝামেলাও বাড়ছে। শুধু কলকাতা শহরে বসে গাড়ির ব্যাবসা করলে চলবে না। গ্রামেও গাড়ির চাহিদা বাড়ছে। মোটরবাইক তো এখন ঘরে ঘরে। এ ছাড়া ছোট ঢাকা ভ্যানের বেশ চাহিদা। তার ডিলারশিপও পেয়েছে। বারাসত, বর্ধমান, সিউড়িতে লোক রেখেছে। অর্ডার ধরে। কলকাতায় বসে এ কাজ হয় না, মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হয়। কাজ যেন এখন মৈত্রেয়র কাছে নেশার মতো। বিয়ে-থা করেনি। একা মানুষ। তার উপার্জনের টাকায় পরে কে খাবে, এই নিয়ে ভাবে না। কাজ করতে অনেক সময় রাত হয়ে যায়। সেদিন আর মধ্যমগ্রামে ফেরা হয় না মৈত্রেয়র।

অফিসে এসে কাজে মন দিতে পারছিল না মৈত্রেয়। সোমদত্তার অফিসের যে-মহিলা তার কাছ থেকে গাড়ি নিয়েছিলেন, তার পুরো নামটা কী? শুধু ‘মজুমদার’-টুকু মনে পড়ছে। সোমদত্তার দেওয়া কার্ডটা বের করে কম্পিউটারে কোম্পানির ঠিকানা টাইপ করল মৈত্রেয়। নাম ফুটে উঠল। অনসূয়া মজুমদার। একে ফোন করবে? সোমদত্তার খবর কিছু বলতে পারবে? কেন পারবে না? একই অফিসে তো কাজ করে। তার ওপর এখন মনে পড়ছে, মহিলা বেশি কথা বলে। স্ক্যান্ডাল, গসিপ পছন্দ করে। ওর চেনাজানারা গাড়ি নিয়ে কী করে, কোন রিসর্টে যায়, মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে কীভাবে অ্যাক্সিডেন্ট করছে, সেসব বলছিল। সুযোগটা নেওয়া যেতে পারে। সমস্যা একটাই, সোমদত্তাকে বলে বসবে না তো?

সেদিন মোবাইলের দিকে হাত বাড়িয়েও থমকে গিয়েছিল মৈত্রেয়। রাত দশটায় ফোন করেছিল সোমদত্তাকে। দু’-চারটে এদিক ওদিক কথার পর সোমদত্তা সবটাই বলতে থাকে। নাওডুবির জমি থেকে ত্রপা নামের মেয়েটি পর্যন্ত।

“মৈত্রেয়, তোমাকে আমি খুঁজছিলাম। তোমার আগের টেলিফোন নম্বর খুঁজে বের করে আমি ফোন করেছি। বেজে গিয়েছে। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে তোমার বাড়িতেও গিয়েছিলাম। দেখলাম নতুন ভাড়াটে।”

মৈত্রেয় শান্ত গলায় বলল, “আমি তো বহুবছর হল বাড়ি বদলেছি। তোমার বিয়ের আগেই কলকাতা থেকে একটু দূরে সরে গিয়েছি।”

সোমদত্তা বলল, “বহু দরকারে তুমি আমার পাশে থেকেছ, এবারও তোমাকে আমার দরকার। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?”

মৈত্রেয় আবেগ আপ্লুত গলায় বলল, “এসব কী বলছ সোমদত্তা! সাহায্য কী? তুমি বলো কী করতে হবে? তোমার লইয়ারের নাম কী?”

সোমদত্তা বলল, “তুমি কাল দেখা করতে পারবে মৈত্রেয়? সব বলব।”

সেদিন রাতে ঘুম আসতে অনেক দেরি হয়েছিল মৈত্রেয়র। এপাশ ওপাশ করতে থাকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সোমদত্তা আবার ফিরে এসেছে! এটা কি সত্যি? নাকি স্বপ্ন দেখছে? ঘুম ভেঙে গেলে দেখবে কিছু হয়নি? যদিও ফোনে মৈত্রেয়র সঙ্গে কথা বলার পর সোমদত্তা ছিল শান্ত। অন্ধকার ঘরে শুয়ে ঠান্ডা মাথায় সে ভাবতে থাকে। শুধু কোর্ট দিয়ে হবে না। ডিভোর্স চাওয়ার পর ভেবেছিল শিরীষ সব ছেড়েছুড়ে ফিরে আসবে। এখনও হয়নি। বাইরে থেকে ধাক্কা লাগবে। কঠিন ধাক্কা। আর তার জন্য এমন একজনকে লাগবে যে হবে সাহসী, আবার গোপনীয়তা বজায় রাখবে। এই মুহূর্তে মৈত্রেয়র চেয়ে ভাল আর কে আছে? সে গুলি খাওয়া বাঘ। পাশ ফিরে শুল সোমদত্তা।

পরদিন কফিশপে বসে কথা হল।

“তোমার হাজ়ব্যান্ড তোমাকে ডিভোর্স দিতে রাজি হয়েছে?”

“রাজি হয়নি বলেই তো কোর্টে ছোটাছুটি করছি। আমি চেয়েছিলাম মিউচ্যুয়ালি বিষয়টা মিটে যাক। ও শুনতে চাইছে না। এবার নোটিশ পাঠানো হয়েছে।”

“তুমি আমার কাছ থেকে কী চাইছ সোমদত্তা?”

“ত্রপা নামের যে-মেয়েটির কথা বললাম, তার সম্পর্কে খবর চাই। সে যে শিরীষের সঙ্গে থাকে, তার প্রমাণ চাই। কোর্টকে জানাব।”

মৈত্রেয় একটু চুপ করে থেকে বলে, “আমি চেষ্টা করব। বিজ়নেসের কারণে আমার গ্রামের দিকে আজকাল একটু যোগাযোগ হচ্ছে। মোটরবাইক, ভ্যান কিনতে ব্যাঙ্ক লোন লাগে। ব্লক, পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেট চাই। এজেন্ট এসব কাজ করে দেয়। সেই সূত্রে চেনাজানা হয়েছে। তুমি জায়গাটার ডিটেলস দাও সোমদত্তা। গ্রামটার কী একটা উদ্ভট নাম বললে যেন?”

এর মধ্যে আরও দু’দিন মৈত্রেয়র সঙ্গে দেখা করেছে সোমদত্তা। ফোনে তো মাঝেমধ্যেই কথা হয়। সেই কথায় যেমন ‘কাজ’ থাকে, পুরনো প্রেমও থাকে। সোমদত্তা জানে ‘প্রেম’ না থাকলে মৈত্রেয় কাজে উৎসাহ পাবে না। মৈত্রেয়কে তার লাগবে। পুরুষমানুষ নারীর বিষয়ে আসলে মূলত বিভ্রান্ত। বোকাও বটে। একসময়ে যতই প্রত্যাখাত হোক, সে পুরনো প্রেমিকার কাছে সবসময়েই মহৎ হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। তার জন্য নতুন করে ‘জীবন উৎসর্গ’ যেন কোনও ব্যাপার নয়। মৈত্রেয়র বেলায় আর একটু বেশি কি? সোমদত্তা চায় ‘বেশি’ হোক। এরকম একটা বিষয়, যেখানে তার মেয়ে, মা, পরিচিতরা কেউ নেই, সবাই শুধু পরামর্শ দিচ্ছে, “মিটিয়ে নাও। শিরীষ পাগলামি করলেও কোনও অন্যায় করে না।” সেখান এমন একজন চাই যে চোখ বুজে তার পাশে থাকবে। মৈত্রেয় ছাড়া আর কে হতে পারে?

সেই মৈত্রেয় আজ ‘খবর’ নিয়ে একেবারে বাড়ি চলে আসতে চাইছিল।

মৈত্রেয় বলল, “যাক, তোমার সময় হলে বোলো। তোমার জন্য তখনও অপেক্ষা করেছি, এখনও করব।”

মৈত্রেয় ফোন কেটে দেয়। সোমদত্তা ফোনের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে অস্ফুটে বলে, “তুমি রাগ করলে চলবে না। তোমাকে এখন আমার লাগবে। শিরীষকে ফিরিয়ে আনতে হবে।”

দোতলায় মাধুরীদেবী নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছেন, তাঁর বয়স আশি ছাড়িয়ে গিয়েছে। দুপুরের এই সময়টা তিনি ঘুমোন। তাঁর শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। ভাল যাওয়ার কথাও নয়। এই বয়সে মেয়ে-জামাইয়ের জটিল ঝামেলা মেনে নেওয়া কঠিন। প্রথম দিকে ভেবেছিলেন, মেয়ে ঝগড়া করে সুটকেস গুছিয়ে চলে এসেছে বটে, তবে দু’দিন পরে ফিরে যাবে। আগেও সোমদত্তা কয়েকবার এরকম করেছে। বাপের বাড়ি থাকলে সব মেয়েরাই এরকম করে। পরে মিটেও যায়। বর এসে নিয়ে যায়। এবার সপ্তাহখানেক কেটে গেলেও মেয়ে ফেরার নাম করল না। শিরীষও আসেনি। নাতনি এলে তাকে চেপে ধরলেন বৃদ্ধা।

“তারা, তোর মায়ের কী হয়েছে?”

দোতারা সহজভাবে বলল, “দি, কেস নাওডুবি হয়েছে।”

দোতারা দিদিমাকে ‘দি’ ডাকে। শিশুকালের অভ্যেস।

মাধুরী বললেন, “এসব কী বলছিস! কেস নাওডুবি হয়েছে মানে কী?”

দোতারা চোখ বড় করে নাটকীয় ঢঙে বলল, “নাওডুবি নিয়ে গোলমাল হয়েছে, তাই তোমার মেয়ের সংসারে ভরাডুবি হয়েছে।”

“হেঁয়ালি করবি না তারা, ঠিক করে বল, তোর মা কসবায় যাচ্ছে না কেন? আজ শুনলাম, এখানে একজন গাড়ি ধোওয়ার লোক ঠিক করছে। রোজ সকালে এসে তোর মায়ের গাড়ি ধুয়ে দেবে। গাড়ি এখানে থাকবে?”

দোতারা হেসে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আর গাড়ি? দেখছ নৌকো ডুবেছে, তুমি সামান্য গাড়ি নিয়ে ভাবছ দি?”

দিদিমা নাতনিকে গলা থেকে ছাড়িয়ে হাত চেপে ধরলেন। দোতারা ঘটনা সংক্ষেপে বলল। যতটা বলা যায়। বিষয়টা মিটমাট হওয়া যে খুব সহজ নয়, সেটা চেপে গেল। এই বয়সে ওঁর পক্ষে এটা না শোনাই ভাল। বেশি বললে মা রেগে যেতে পারে।

“শোনো দি, আমি যে ঘটনা বলেছি, সেটা আর তোমার মেয়েকে বলতে যেয়ো না। খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে আমার মাথা খেয়ে ফেলবে।”

পরদিন সোমদত্তাকে ধরতে সেও তার মাকে ঘটনা জানায়। জানায়, তার পক্ষে এখাই শিরীষের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। একটা না একটা সময়ে তো জানাতে হতই। সে এই বাড়িতে দিনের পর দিন রয়েছে। প্রতিবেশী, কাজের লোক, আত্মীয়স্বজন, সবার চোখে পড়ছে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে এই দোতলা বাড়ি শেষপর্যন্ত যতই তার হোক না কেন, মা যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন পর্যন্ত তো এটা মায়ের বাড়ি। দিনের পর দিন চুপ করে থাকা তো যাবে না। ভালই হল, মা নিজের থেকে জানতে চাইলেন।

মাধুরী বললেন, “মিটিয়ে নে। ধেড়ে বয়েসে এইসব পাগলামির মানে হয় না।”

সোমদত্তা বলল, “মিটিয়ে আমি কী করে নেব মা? পাগলামি তো আমি করছি না, করছে তোমার জামাই। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চাষা সাজার শখ হয়েছে তার!”

মাধুরী বললেন, “আহা, মানুষের তো গাছগাছালির শখ আহ্লাদ থাকে। তোর বাবাও এই বাড়ির বাগানে কতরকম গাছ করেছে। বেল, জুঁই-এর কথা বাদ দে, আম, জামরুল, পেয়ারাগাছও তো করছিল একসময়ে। পরে বাগান রাখতে পারল না, সেটা অন্য কথা। কিছু গাছ তো আজও রয়ে গিয়েছে। বাগানে দেখতে পাস না?”

সোমদত্তা থমথমে গলায় বলেছিল, “শিরীষ যা করছে সেটা বাগান নয় মা। সে ধান ফলিয়ে খাবে, মাটির ঘরে থাকছে। তোমাকে এতদিন বলিনি, এবার বলছি, আমেরিকা যাওয়ার অফার শুধু ছাড়েনি, সে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য অফিসে অ্যাপ্লিকেশন জমা করেছে। মাথা খারাপ না হলে কেউ এ কাজ করে! আমি সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করেছিলাম। তিনি সব শুনে বললেন, আপনার হাজ়ব্যান্ডের আর যাই হোক, মানসিক অসুখ হয়নি। প্রফেশন চেঞ্জ করতে চাওয়াটা নাকি পাগলামির মধ্যে পড়ে না। আমি বোঝাতে পারিনি। শিরীষকে বলেছিলাম, তুমি ডক্টরের কাছে চলো। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।”

মাধুরী একটু চুপ করে থেকে বললেন, “সোম, তুই শিরীষকে ফোনে ধরিয়ে দে, আমি কথা বলব।”

শিরীষ দু’দিন পরেই চলে এসেছিল। শাশুড়ির জন্য প্রতিবারের মতো চা-পাতাও নিয়ে এসেছিল। বয়স যতই হোক, মাধুরী সকাল-বিকেল এক কাপ করে ভাল চা খেতে পছন্দ করেন। দোতলার বারান্দায় একা বসে খান। সল্টলেকের এই দিকটা এখনও নির্জন। পাখি ডাকে। শিরীষ বিকেল যখন এল মাধুরী বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসেছিলেন। গায়ে হালকা চাদর।

শিরীষ পাশে চেয়ার টেনে বসে বলেছিল, “কেমন আছেন? কোমরের ব্যথাটা কমেছে?”

মাধুরী শান্ত গলায় বললেন, “কমেছে, তবে সকাল-বিকেল জানান দেয়। বাকি ক’টাদিন ওই ব্যথা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। তাও তো এই বয়সে অনেকের চেয়ে ভাল আছি। সর্বক্ষণ বিছনায় শুয়ে থাকতে হয় না, তাই যথেষ্ট।”

শিরীষ বলল, “ওভাবে বলছেন কেন? কোমরের জন্য আরও ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে।”

মাধুরী একথায় গা না করে বললেন, “শিরীষ, তুমি নাকি চাষবাস করবে ঠিক করছ?”

শিরীষ সুন্দর হেসে বলল, “নিজের হাতে এখনই পারব না, এখন যারা কাজটা জানে তারা করছে। পরে আমারও নামার ইচ্ছে আছে।”

মাধুরী বললেন, “এসব আমার জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল না। তোমরা বড় হয়েছ, নিজের ভাল নিজেই বুঝবে। এর মধ্যে নাক গলানোর আমি কে? তোমার শ্বশুরমশাই বেঁচে থাকতেও তা করেননি। বলতেন, ভাল ছেলের সঙ্গে মেয়েকে জুড়ে দিয়েছি, বাকিটা ওরা বুঝবে! তার পরেও মনে হচ্ছে, কোথাও সমস্যা হচ্ছে। সংসারে এতদিন পর সমস্যা হবে কেন? সত্যি কি তুমি কলকাতা ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করেছ?”

শিরীষ বলল, “না, এমন কিছু ঠিক করিনি। করবই বা কেন? সোম আছে, আপনার নাতনি আছে, কলকাতায় তাদের লেখাপড়া, কাজ। কসবার ফ্ল্যাটে তারা থাকবে। তা ছাড়া আপনি একা থাকেন। আমার দায়িত্ব নেই? এত বছর ধরে আমায় দেখছেন, কখনও কি মনে হয়েছে, দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করি না?”

মাধুরী একটু ভেবে বললেন, “তা হলে তুমি কলকাতায় থাকবে?”

শিরীষ আবার হেসে বলল, “অবশ্যই থাকব। তবে সবসময় থাকব না, মাঝেমধ্যে এসে থাকব। জমিতে বেশি সময় দিতে হচ্ছে। অফিস যদি আমাকে কোথাও বদলি করত, নতুন একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব দিত, কী করতাম? সেখানেও বেশি সময় দিতে হত, নয় কি?”

“তা হত। তবে আপিসের চাকরি আর ধান চাষ কি এক হল?”

শিরীষ বলল, “না এক হল না। স্বাধীনভাবে যে-কোনও কাজ করাতেই ঝুঁকি বেশি, তাই আনন্দও বেশি। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে ধান চাষ আমাকে বেশি আনন্দ দেবে। জীবনে আনন্দেরও একটা দাম আছে।”

মাধুরী জামাইয়ের কথা শুনে একটু চুপ করে রইলেন। বললেন, “তোমার বউ তো খুব রেগে গিয়েছে। বাড়ি ফিরবে না বলছে।”

শিরীষ বলল, “সেটা আমার দোষ। আমি ওকে প্রজেক্টটা ঠিকমতো বোঝাতে পারিনি। আশাকরি ভবিষ্যতে ও বুঝবে। সোম বাড়ি ফিরবে, আপনি চিন্তা করবেন না।”

মাধুরী বললেন, “তুমি নাকি বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলে?”

শিরীষ বলল, “হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। তবে এও তো একরকম যাওয়াই হচ্ছে। দেশের মধ্যে যাওয়া। নাওডুবি খুব সুন্দর জায়গা। একটু গুছিয়ে নিই, আপনাকেও নিয়ে যাব। ক’দিন মেয়ে, নাতনিকে নিয়ে থাকবেন। খুব ভাল লাগবে। খেত থেকে ভোলা ধানের চাল, সবজি খাবেন।”

মাধুরী চাদরের খুঁট থেকে সুতো ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, “চাকরিটা না ছাড়লেই পারতে শিরীষ। আজকালকার দিনে… ভয় করে। শুনি, দেশে কাজকর্মের অবস্থা ভাল নয়।”

শিরীষ নরম গলায় বলল, “আপনি ভয় পাবেন না। চাষে ফেল করলে আবার অফিসে চাকরি নেব। আপনার জামাইয়ের যা বিদ্যেবুদ্ধি, তাতে চাকরি পেতে অসুবিধে হবে না।”

মাধুরী আবার খানিকটা চুপ করে থেকে বলেছিলেন, “বেশি করে জামাকাপড় সঙ্গে রাখবে। পাড়াগাঁয়ে গরমের সময়েও ঠান্ডা পড়ে। একবার তোমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম…”

রাতে সোমদত্তা তার মায়ের কাছে বসে মন দিয়ে এই আলোচনার রিপোর্ট শোনে।

“তুই কালই কসবা ফিরে যা সোম। শিরীষ ছেলেটা ভাল। তুই ভুল বুঝছিস। পুরুষমানুষের শখ আহ্লাদ তো থাকবেই। এ তো খারাপ কিছু নয়।”

সোমদত্তা হিসহিসিয়ে বলে, “কীসের শখ আহ্লাদ মা? বউ মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার শখ আহ্লাদ? বুঝেছি, তোমার মাথা খেয়ে গিয়েছে। তুমি ওর হয়ে একটা কথাও বলবে না। আর দু’দিন দেখব, তারপরই তোমার জামাই বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল। আমাকে পথে বসানো বের করে ছাড়ব। কত প্ল্যান করে রেখেছিলাম জানো?”

মাধুরী মেয়ের গায়ে হাত রেখে বললেন, “মাথা ঠান্ডা কর সোম। শিরীষের সঙ্গে কথা বল।”

এসব আগের ঘটনা। এখন সবই জানাজানি হয়ে গিয়েছে। গোড়াতে শুধু চাষবাসের বিষয়টা ছিল, পরে একটা মেয়ে ঘটনায় ঢুকে পড়েছে। তবে সেটা আর মাকে বলেনি সোমদত্তা। কে জানে একসময়ে হয়তো সেটাও বলতে হবে।

সোমদত্তা ঠিক করল সে মৈত্রেয়কে বাড়িতে ডাকবে। খুব তাড়াতাড়ি ডাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *