মাটির দেওয়াল – ৭

সরু আলপথের শেষে একটা বাঁশের সাঁকো।

ঠিক যেন কেউ ছবি এঁকে রেখে গিয়েছে। শিরীষ থমকে দাঁড়াল। নয় নয় করেও আট মাসের বেশি এখানে থাকা হয়ে গেল, কই এই সেতু তো আগে নজরে পড়েনি! এটাও কি নাওডুবি গ্রামের মধ্যে? নাকি হাঁটতে হাঁটতে অন্য কোথাও চলে এসেছে? অন্য কোনও গ্রামে?

শিরীষের বেশ অবাকই লাগছে। এদিকটায় কি সে কখনও আসেনি? তা কী করে হবে? নিশ্চয়ই এসেছে, এত মন দিয়ে খেয়াল করেনি। অনেক সময় এরকম হয়। একই জায়গা অন্যরকম লাগে। মানুষের বেলাতেও তাই। চেনা মানুষকে মনে হয় বদলে গিয়েছে। আসলে সব কিছুর ভিতরেই খানিকটা অদেখা থেকে যায়। সে প্রকৃতিই হোক আর মানুষই হোক। শিরীষ লম্বা করে শ্বাস টানে। সোমদত্তার এমনটাই হয়েছে। সে এতদিন ঘর করবার পরও, স্বামীর পুরোটা দেখেনি। তাই এই ঘটনায় বড় ধাক্কা খেয়েছে। মেনে নিতে পারছে না। শিরীষও কি নিজেকে এভাবে জানত? এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা সিস্টেম এভাবে ভেঙে দেবে জানত সে? মনে হয় না। চেনা মানুষের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা অচেনা মানুষটা কখন জেগে উঠবে কেউ আগাম জানতে পারে না।

সাঁকোটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পলকা একটা সেতু। বাতাসে একটু একটু দুলছে। পাশাপাশি দু’জনও যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। উলটো দিক থেকে আর একজন চলে এলে চেপে দাঁড়াতে হবে। তাতেও কি পারবে? ফিরে যেতে হতে পারে। জীবনের মতো। কোনও কোনও সেতু একা পার হতে হয়।

ছবির মতো সাঁকোর ওপাশের আকাশ কালো মেঘে ভরা। খানিক আগেও এই মেঘ ছিল না। আকাশ ছিল নীল। আলো ঝলমলে। শরতের আলো। হঠাৎ কোথা থেকে যে এত ঘন কালো মেঘ এসে পড়ল কে জানে! যদিও সময়টা ‘এই রোদ এই মেঘ’-এর সময়। বৃষ্টি কখনও হয়, কখনও হয় না। হলেও বেশি হয় না। এক পশলা, দু’ পশলায় ক্ষান্ত দেয়। এখন মনে হচ্ছে, জোরে নামবে। নামলে কি সমস্যা হবে? শিরীষ ছাতা নিয়ে বেরোয়নি। ক’টা বাজে? শিরীষ কবজি উলটে ঘড়ি দেখতে গেল। ঘড়িও পরা হয়নি। হিসেব মতো দুপুর তিনটে -সাড়ে তিনটে হওয়ার কথা। আর একটু বেশি হতে পারে। মনে হচ্ছে, সন্ধে নেমে এসেছে। গ্রামে এমনিতেই তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে। এখন তো মেঘে সব আলো ঢেকেছে। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। ঝড় উঠবে নাকি? শিরীষ আরও এগিয়ে গেল।

নাওডুবি আসার পর বেশ কয়েকবার ঝড়জল দেখা হয়ে গেল শিরীষের। প্রথমবারের ঝড় ভয়ংকর ছিল। তখন জমির ঘরটায় ছাউনি ছিল খানিকটা টিনের, খানিকটা বাঁশ খড়ের, দেয়াল মাটির। রাতে হাওয়ার দাপটে সেই ছাউনির আধখানা ভেঙে, দুমড়ে মুচড়ে গেল উড়ে। শিরীষ বেরিয়ে যে অন্য কোনও বাড়িতে আশ্রয় নেবে, সে উপায় ছিল না। বড়মামা ঠিকই বলেছিলেন, এই জমির ধারেকাছে ঘরবাড়ি নেই। যে একটা-দুটো কাঁচা ঘর রয়েছে, সেগুলোও সব জমির মধ্যে। সেখানে মানুষজন থাকে না। জলের পাম্প, চাষবাস সরঞ্জাম রাখা হয়। অধিকাংশ সময় তাও থাকে না। খালিই পড়ে থাকে। জায়গাটা নাওডুবির গ্রামের মধ্যে পড়লে কী হবে, ঘরবাড়ির দেখা মেলে অনেকটা যাওয়ার পর। ফলে সেদিনের ঝড়জলে কোথাও যাওয়ার ছিল না। ঘরের একদিকের চাল উড়ে গিয়েছে, যে-কোনও মুহূর্তে বাঁশ, মাটির দেয়ালও ধসে পড়বে। বাইরে বেরোলেও বিপদ। খোলা মাঠে মাথায় বাজ পড়তে পারে। এইসব জায়গায় বাজ সবচেয়ে ভয়ের। বেরিয়ে গাড়ি পর্যন্ত যাওয়া অসম্ভব। গাড়ি কি আস্ত আছে? উপড়ে গাছ ভেঙে পড়েনি তো? নিকষ অন্ধকার। ঘরের হ্যারিকেন নিভে গিয়েছে। টর্চও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভরসা শুধু আকাশ চেরা বিদ্যুতের আলো। সেই আলোতে ভিজে যাওয়া তক্তপোশ খানিকটা টেনে সরিয়েছিল শিরীষ। তারপর চুপ করে বসে জলের ছাঁটে ভিজতে ভিজতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মাথার উপর ঘরের বাকি চালটুকু যদি ভেঙে না পড়ে, কাল সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকে যদি, তবে এখানেই ‘প্রজেক্ট নাওডুবি’র ইতি। ফাইল ক্লোজ়ড। ফিরে যাবে কলকাতায়। মালপত্র ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছু নেই। জামাকাপড়, ব্যাগ জুতো যেটুকু যা আছে সবই ভিজে ঢোল। পড়ে থাকবে এখানে। পরে গ্রামের লোক যদি কেউ ঢোকে ঝড় জলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া এই ঘরে, জানবে, একটা লোক কিছুদিন পাগলামি করে বেসামাল হয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু ঘটল অন্য ঘটনা।

ঝড়-জল থেমে গেল রাতেই। পরদিন ভোরের আলো ফুটতে ঘর থেকে বেরোল রাত জাগা শিরীষ। মেঘমুক্ত, ঝকঝকে নীল আকাশ। কে বলবে কাল সারারাত ভয়ংকর দুর্যোগ হয়েছে? পুব দিক থেকে সূর্য মুখ বাড়িয়েছে। সোনালি আলোতে রুক্ষ মাঠ ভেসে যাচ্ছে দিগন্ত পর্যন্ত। এই সময়ে এক ধরনের হ্যালুসিনেশন হল শিরীষের। মনে হল, পাকা ধানে তার খেত ভরে গিয়েছে। রাতের বৃষ্টিতে স্নান করে তারা ঝলমলে, খুশি। হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে হাসছে। ফিসফিস করে কথা বলছে—”কেমন আছেন শিরীষবাবু? রাতে ঘুম কেমন হল?”

মন ভরে গেল শিরীষের। সে স্বপ্নকে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল। তার আর কলকাতায় ফেরা হল না। হাঁটু পর্যন্ত গামবুট পরে আলপথে ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। কাজ অনেক। ট্রাক্টরের মালিককে খবর দিতে হবে। মাটিতে জল পড়েছে। বাতানোর কাজ সহজ হবে। মাটিতে নাইট্রোজেন বাড়াতে ধনঞ্চা গাছের বীজ ছড়াতে হবে। হারান বলেছে, মাস খানেক, মাসদেড়েকে এই ঘাস হাতখানেক বড় হবে। তখন ওই গাছ সমেত জমিতে ফাল চাষ দিতে হবে। ধনঞ্চা গাছের শিকড়বাকড়, পাতা জমির জন্য উপকারী। রুক্ষ পতিত জমিতে ফসল ফলানো কি সহজ কথা? অনেক ধৈর্য, অনেক পরিশ্রম লাগে। এরপর রোটার দিয়ে মাটিকে দলাই মলাই করা লাগবে। মাটি হবে ঝুরোকুরো। এরপর জৈব সার আর জল। এই জল পেয়ে জমি হবে কাদাকাদা। গ্রামের মানুষ বলে, ‘ভেকসা কাদা’। কাজ কি কম হল? কাদায় মাখামাখি হয়ে গাড়ির কাছে যায় শিরীষ। জমির গায়ে একটা বুড়ো অশ্বথ গাছের নীচে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করেছিল সে। রাতের ঝড়ে গাড়ির উপর ডাল ভেঙে পড়েছে। তবে ক্ষতি কিছু হয়নি। ছোটখাটো ডাল। সেসব সরিয়ে শিরীষ গাড়ি স্টার্ট করেছিল সবেরগঞ্জের দিকে। এখনই ট্রাক্টর ভাড়া করতে হবে।

সাঁকোটা গিয়েছে একটা খালের ওপর দিয়ে। খালটা বাঁদিকে খানিকটা গিয়ে দুম করে মিলিয়ে গিয়েছে। আসলে বাঁক নিয়েছে। গোটা বর্ষাকাল কেটে যাওয়ার পরও খালে জল নেই তেমন। যেটুকু আছে আহামরি কিছু নয়। বাঁশের সাঁকোতেই যখন পারাপার চলে, খালের অবস্থা কতটা শোচনীয় বোঝা যায়। এমনটা হওয়ার কথা নয়। বর্ষার পর খাল বিল ভরে থাকে। এটাও একটা আশ্চর্য ঘটনা। দু’পাড়ে বড় বড় ঘাসের জঙ্গল। একজন বুড়োমানুষ সাঁকোর কাছে বসে রয়েছেন উবু হয়ে। ধুতি ধরনের একটা কাপড় লুঙ্গির মতো করে পরা। গায়ে ফতুয়া গেঞ্জি। মানুষটা জলের দিকে তাকিয়ে আছেন। শিরীষ গুটিগুটি পায়ে তাঁর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।

“কর্তা, এই খালের নাম কী?”

বুড়োমানুষ মুখ ফেরালেন। এক মুখ দাড়ি। বিড়ি খাচ্ছেন। তাঁর ঘাড় ফেরানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল, শিরীষের ডাকে বিরক্ত হয়েছেন। কোনও কিছু মন দিয়ে দেখছিলেন, তাতে ব্যাঘাত পড়ল।

শিরীষ আবার বলল, “খালের নাম কী?”

বুড়োমানুষ গম্ভীর মুখে বললেন, “এইডা খাল নয়, এইডা নদী।”

শিরীষ অবাক হয়ে বলল, “নদী! এইটুকু নদী!”

বুড়োমানুষ আরও বিরক্তি নিয়ে বললেন, “কেন? নদী এইটুকু হলে আপনার অসুবিধা আছে? নদী বড় হইলে, আপনি কী করতেন? জাহাজ চালাতেন?”

রাগের কথা শুনে শিরীষের বেশ মজা লাগল। এই ছ’মাসে সে জেনেছে, গ্রামের মানুষের রাগ, ভালবাসার, দুঃখের মধ্যে কোনও প্যাঁচ-পয়জার নেই। তাতে আবার অনেক সময় স্নেহের ধমকও থাকে। আরও কয়েক পা এগিয়ে গেল শিরীষ। খানিকটা নিচু গলায় বলল, “কর্তা, আমি কি হেঁটে পার হতে পারব?”

বুড়োমানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে তাচ্ছিলোর সুরে বললেন, “আপনার হাঁটা আপনি বোঝেন, আমি বলব কেন?”

‘সাঁকো ভেঙে পড়বে না তো?”

বুড়োমানুষ এই কথার জবাব না দিয়ে একই ভাবে জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শিরীষের খুব ভাল লাগল। মনে হল, ছবি-সাঁকোর পাশে একজন ছবি-মানুষ বসে রয়েছেন। জীবন সম্পর্কে নির্মোহ একজন মানুষ।

কালো আকাশ নেমে এসে মাটিতে ঠোঁট ছুইয়েছে। এতক্ষণে বৃষ্টি শুরু হরে যাওয়ার কথা। কেন অপেক্ষা করছে কে জানে। বয়স্ক মানুষটি এবার শীর্ণ নদীর পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। শিরীষ বুঝতে পারছে, আবার কথা বলতে গেলে আরও রেগে যাবেন। তারপরেও সে বলল। রাগলে রাগুক।

“এই নদীর নাম কী?”

আশ্চর্যের বিষয় হল এবার আর মানুষটি রাগলেন না। মুখ নামিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “নাওডুবি।”

শিরীষ অস্ফুটে বলল, “নাওডুবি! গ্রামের নাম?”

মানুষটা একইরকম আনমনে বললেন, “হ্যাঁ, এই নদীর নামেই গ্রামের নাম, নাওডুবি। একসময়ে নদীর জোর ছিল। এখন মজে গিয়েছে। খালের মতো চেহারা হয়েছে। বৃষ্টির জলও ধরে রাখতে পারে না।”

কথা শেষ করে মানুষটা উঠে দাঁড়ান। শিরীষ এবার দেখতে পেল, সঙ্গে একটা ছাতাও রয়েছে। কাঠের হাতের লম্বা ছাতা।

“কর্তা, আপনি থাকেন কতদূর?”

ছাতা খুলতে খুলতে বুড়োমানুষ আবার বিরক্ত গলায় বললেন, “আপনার দরকার কী? ঘাড়ে করে পৌঁছে দিবেন?”

শিরীষ একটু হেসে বলল, “না, বৃষ্টি নামবে তো…”

ছাতা খুলে মানুষটা মাঠ ধরে এগিয়ে গেল। শিরীষ সাঁকোর দিকে এগিয়ে গেল।

নাওডুবিতে এসে শিরীষ জানতে পেরেছিল, মামা জমি রেজিষ্ট্রি অফিসে, স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসে দেখা করে, কথা বলে সব পাকা করে গিয়েছেন। কী আশ্চর্য! মানুষ হারিয়ে যায়, ভালবাসার চিহ্ন ফেলে ফেলে যেতে থাকে।

শিরীষ সাঁকোর উপরে উঠল। দেখে যতটা মনে হয়েছিল, উঠে বোঝা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি নড়বড়ে। নাকি বাতাসের জোর বেড়েছে বলে কাঁপছে? নদীর উপর সাঁকো! ভাবতেই অবাক লাগছে। কতটা হেঁটে এসেছে? একঘণ্টা? নাকি আরও বেশি? এখনও গজ, ফুট, মিটারের ধারণা খুব স্পষ্ট হয়নি শিরীষের। হওয়া উচিত ছিল। ছ’মাস হয়ে গেল জমিতে কাজ করছে। মাপামাপির ধারণা থাকবে না। যদিও সবটা হারান আর রতনকাকা দেখে। হারান থাকে নাওডুবি গ্রামে। রতনকাকা আসে সবেরগঞ্জ থেকে। হারানের বয়স চল্লিশের কম। রতনকাকারও বয়স বেশি নয়, তারপরেও সবাই ‘কাকা’ ডাকে। দুজনেই চাষবাসে এক্সপার্ট। তবে নিজের জমি নেই, অন্যের জমিতে কাজ করে। হারানের পরামর্শ মতো জমির পাশে পাকা ঘর তোলা হয়েছে। দেড়খানা ঘর। বড়টা শিরীষের, আর ছোটটা গেস্টরুমের মতো। আর কেউ যদি এসে থাকে। হারান, রতনকাকা তো কাজ করতে করতে কোন দিন আটকে যেতে পারে। ছোট ঘরটায় যেতে গেলে বাগান পেরিয়ে যেতে হয়। বাড়ির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পথ নেই। ইচ্ছে করেই রাখেনি শিরীষ, আর কেউ থাকলে, নিজের মতো আড়ালে থাকতে পারবে। এই দুই ঘরের ছাদটুকু যা ঢালাই করা, বাকি সব টিনের চালা। দুটো ঘরের সঙ্গে বাথরুম, ছোট একটা রান্নার জায়গা, একফালি বারান্দা। পিছনের উঠোনে শেডের নীচে চাষের জিনিসপত্র থাকে। কুয়ো খুঁড়তে হয়েছে, একটা টিউবওয়েলও বসাতে হয়েছে। এই দুটোতে সময়,খরচ দুই-ই বেশি হয়েছে। এখানে জল পেতে গেলে মাটির অনেকটা গভীরে যেতে হয়।

বাড়ির চারপাশে বেড়া দিয়ে, সামনে একটুখানি সবজির বাগান করে দিয়েছে রতনকাকা। শাক, লেবু, লঙ্কা। ছোট একটা মাচা করে কুমড়ো। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকা যায়। দিগন্ত পর্যন্ত খেত, মাঠ, আকাশ মিলেমিশে, জড়িয়ে মুড়িয়ে থাকে। হারান আর রতনকাকা বেশিরভাগ সময়েই দিনে দিনে কাজ করে চলে যায়। হারানের সাইকেল আছে, রনকাকা বড় রাস্তা পর্যন্ত চলে যায়, তারপর সবেরগঞ্জ যাওয়ার জন্য ভ্যান বা ট্রাক্টর ধরে। আর যদি রাতে থাকতেই হয়, ভাগাভাগি করে থাকে। শিরীষও কলকাতা থেকে এসে এখানেই ওঠে। প্রথমে থাকত উইকেন্ডে। তারপর সপ্তাহে তিনদিন। চাকরি ছাড়ার পর কখনও কখনও টানা পনেরো- কুড়িদিন পর্যন্ত থেকে যায়।

এবার একমাস হতে চলল, ফেরা হয়নি। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে সামনের খেতের দিকে। এক-একটা করে পর্ব দেখতে পায়। খুব আনন্দ হয়। মনে হয়, স্বপ্ন দেখছে। মাঝেমধ্যে অবাক লাগে। দাদু তাকে কেন বেছে গেলেন? চোখ দেখে মনে হয়েছিল, বালকটি অন্যরকম? নাকি ভরসা করেছিলেন? যদি পারে, এ-ই পারবে। জিন তো রয়ে গিয়েছে। নাকি নিজের মনের মধ্যেই কোথাও এই খ্যাপামি লুকিয়ে ছিল? দাদুর স্বপ্ন তাকে খুঁচিয়ে দিল। এটাই বোধহয় সত্যি। অনেককিছু ভাল লাগছিল না। সেই কবে চাকরি শুরু করেছে! কেরিয়ারের দৌড় ক্লান্ত, অবসন্ন করে তুলছিল। স্কুলে পড়ার সময় ভাবত, শুধুই ছবি আঁকবে, আর্টিস্ট হবে! কলেজে উঠে কবিতা লিখতে শুরু করেছিল, বইমেলায় লিটল ম্যাগাজ়িন করল। ম্যাগাজ়িনের নাম ছিল, আঁখি। নাটকের দল করে অভিনয় করল। মাঝেমধ্যে হুটপাট করে বেরিয়ে পড়ত একা। বাস থেকে নেমে পড়ত হাইওয়ের মাঝখানে। এই চাষবাসের জীবন কি সেই রোমান্টিক মননের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে ছিল?

বাঁশের সাঁকোর মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল শিরীষ। ঝড় উঠেছে। এতক্ষণ থম মেরে থাকা কালো মেঘ ভেঙে টুকরো হয়ে ছুট লাগিয়েছে চারপাশে। সেই কলেজ জীবনে লেখা একটা কবিতার দুটো লাইন মাথায় ভেসে আসছে। আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। শিরীষ বিড়বিড় করে বলে উঠল।

“তোমার সঙ্গে পণ রেখেছি ঝড়/ কে আগে বলবে, কে আগে…”

মনে পড়ছে না। বাকিটা মনে পড়ছে না। কতদিন পরে মাথায় কবিতা ফিরে এল!

বাতাস দিচ্ছে। ঝড় উঠবে নাকি? শিরীষ আরও এগিয়ে গেল।

বাতাস এবং বৃষ্টিতে বাঁশের সাঁকো দুলছে। শিরীষ ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল আর তখনই মনে পড়ে গেল কবিতার ভুলে যাওয়া লাইনগুলো। অস্ফুটে শিরীষ বলে উঠল, “তোমার সঙ্গে পণ রেখেছি ঝড়/ কে আগে বলবে, কে আগে ছিঁড়বে চরাচর।”

শিরীষের আনন্দ হচ্ছে, আবার দুঃখও হচ্ছে। আনন্দ হচ্ছে এই কারণে যে, কতদিন আগে ফেলে আসা কবিতা আবার তার কাছে ফিরে এসেছে। প্রয়াত দাদু, হারিয়ে যাওয়া বড়মামাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাল শিরীষ। তাঁরা না থাকলে এই মুহূর্ত তো আসত না। তারপরেও দুঃখ হচ্ছে। প্রিয় মানুষরা এই কবিতা শোনার জন্য তার পাশে নেই। সোমদত্তা নেই, দোতারা নেই। এই সময়ে নারীকন্ঠের চিৎকারে মুখ তুলল শিরীষ।

“স্যার, আপনি দাঁড়ান, আমি আপনার কাছে যাচ্ছি। আমি ছাতা এনেছি স্যার…আর এগোবেন না…পড়ে যাবেন স্যার…প্লিজ় স্যার…”

একটা ছাতা মাথায় সাঁকোর দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে অতিরিক্ত ছিপছিপে এক তরুণী। পারলে ছুটে আসছে। জিন্‌স এবং শার্টের ওপর কোট মতো কিছু পরেছে। বৃষ্টি ও অন্ধকারে কোনওটার রংই চেনা যাচ্ছে, না। তবে মেয়েটিকে চেনা যাচ্ছে। মেয়েটির নাম এপা। ত্রপা বসু। বাড়ি কলকাতায়, কৃষি নিয়ে লেখাপড়া করেছে কল্যাণীতে। এখন গবেষণার জন্য থাকে বোলপুরে। মাস্টার ডিগ্রি করে এখন গবেষণায় ব্যস্ত। সেই গবেষণার একটা অংশ হিসেবে সে শিরীষ মুখার্জির ‘প্রজেক্ট নাওডুবি’ নিয়েছে। এরকম ঘটনা বিদেশে ঘটলেও, এদেশে নাকি বিরল। শহরের বিলাসী, স্বছন্দ, নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত কেউ গ্রামে চাষবাস করতে চলে এসেছে, এমনটা কখনও শোনা যায়নি। তার গবেষণার গাইড একজন কৃষিবিজ্ঞানী। তিনি সব শুনে উত্তেজিত।

“ত্রপা, তুমি এই পাগল লোকটাকে ছাড়বে না। তার সঙ্গে লেগে থাকবে। কীভাবে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে যাচ্ছে এবং ব্যর্থ হচ্ছে, সেটা স্টাডি করবে। পারলে ওর মনের ভিতর ঢুকতে চেষ্টা করবে। এই প্রজেক্টের পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা জানার চেষ্টা করবে। অনেক সময় পলিটিক্যাল লোকেরা গ্রামে ঢোকার জন্য এই ধরনের আড়াল তৈরি করে। যদিও এই লোকের সাইটে গিয়ে যে প্রোফাইল দেখছি, তাতে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। যাই হোক, ত্রপা মনে রাখবে, তুমি একটা দারুণ সুযোগ পেয়েছ। ঠিকমতো ধরতে পারলে, ভবিষ্যতে খুব কাজে লাগবে। বলা যায় না, এগ্রিকালচারাল ইকনমিক্সে একটা উদাহরণ হয়ে থেকে যেতে পারে। এই লোকে কিন্তু বেশিদিন খেতে-মাঠে থাকতে পারবে না। নানারকম চাপ আসবে। ফ্যামিলির কথা জানবে। নেক্সট ফেজ়ে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলবে। তারা এই ঘটনা কেমন ভাবে নিয়েছে জানতে হবে। এই লোক কিন্তু পালিয়ে যাবে। ফিল্ড ওয়র্ক হিসেবে সবটাই তোমাকে রিসার্চ পেপারে তুলে ধরতে হবে।”

এপার বয়স পঁচিশ। দু’-তিন মাস কম বেশি হতে পারে। সেই অর্থে সে দোতারার চেয়ে সামান্য কয়েক বছরের বড়। রোগা হলেও মেয়েটি বেশ সুন্দরী। গায়ের রং ফরসা। চোখে একধরনের মায়াভাব। কথা শুনলে বোঝা যায়, নরম প্রকৃতির। হাসি ও কান্না দুটিই সরল। ছোট করে কাটা চুলের এই মেয়েটির সঙ্গে শিরীষের আলাপ হয় এক কৃষিমেলায়। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগ থেকে ক্যাম্প করা হয়েছিল। ওরকমই একটা ক্যাম্পে ছিল ত্রপা তখন শিরীষের নাওডুবি প্রজেক্ট একেবারে গোড়ার সময়। সে তখন এই ধরনের বিভিন্ন মেলা, সেমিনারে ঘুরে বেড়াত। জিনিসটা বুঝতে চেষ্টা করত। ত্রপা সেদিন মেলায় ধান চাষের পদ্ধতি নিয়ে কথা বলছিল। কেউই শুনছিল না। দু’-তিনজন ছিল, তারাও একসময়ে সরে যায়। শিরীষ গোটাটা মন দিয়ে শোনে। শেষে কথা বলে।

“আমি নিজে এই ধরনের একটা কাজ করতে চলেছি। আপনার সঙ্গে আরও একটু কথা বলতে পারি?”

শিরীষের পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি দেখে থমকে যায় ত্রপা। আদ্যোপান্ত শহুরে এই মানুষটা কি তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে? তাই হবে। সে কড়া গলায় উত্তর দেয়।

“স্যার, আপনি ভুল করছেন। আমি কৃষি কাজের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।”

শিরীষ বলল, “আমি জানি, সেই কারণেই আমি কথা বলতে চাই। আপনার যদি অসুবিধে হয় আপনি অন্য কাউকেও ডেকে দিতে পারেন। তার সঙ্গে কথা বলব।”

প্রেস্টিজে লাগে ত্রপার। শিরীষের ব্যক্তিত্বের কাছে থমকে যায়। সে বলে, “আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন স্যার।”

শিরীষ বলল, “আমি কি একটু বসতে পারি?”

“অবশ্যই।”

সেই শুরু আলাপের। শিরীষের নাওডুবি প্রজেক্টের কথা শুনে সে মুগ্ধ হয়। সে তার রিসার্চ গাইডকে বিস্তারিত জানায়। পঁচিশ বছরের এই তরুণী গবেষণার কাজ হিসেবে প্রায় পঞ্চাশ বছরের এই মানুষটির সান্নিধ্যে এলেও খুব অল্পদিনের মধ্যেই তার মনে হতে শুরু করছে, এই মানুষটি আলাদা। এঁর কাছে থাকলে তার মন ভাল লাগে। মানুষটি তাকে মাঝেমধ্যে বকুনি দেন। কেন সে বারবার আসে, এই কারণে। সেই বকুনি বেশ জোরেই দেন। চোখে জল চলে আসে। সে চলে যায়। কিন্তু দু’দিন পরে মন কেমন করে। নাওডুবিতে চলে আসে আবার। তখন মানুষটা আবার বকুনি দেন। কারণ সম্পূর্ণ উলটো, কেন এতদিন আসেনি!

সেতুর উপর থেকে ত্রপাকে দেখে শিরীষ খুশি হল আবার রাগও করল। এই দুর্যোগেও মেয়েটি কেন এসেছে? শিরীষ নিজেকে সামলাল। এখন এসব ভাবনার সময় নয়। এখন দুটো লাইন মাথার মধ্যে ঘুরুক—

“তোমার সঙ্গে পণ রেখেছি ঝড়/ কে আগে বলবে, কে আগে ছিঁড়বে চরাচর।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *