মাটির দেওয়াল – ৬

দোতারা একটা বেতের মোড়ায় বসে চুল মুছছে।

এই বাড়িটা দোতারার নয়, কিন্তু এই মোড়াটা তার। মোড়ার গায়ে সুতো দিয়ে বাঁধা একটা বোর্ড। তাতে ইংরেজিতে লেখা ‘রিজার্ভড’। এর অর্থ, মোড়ায় অন্য কেউ বসা চলবে না। কিছু রাখাও যাবে না।

এটা বিহানের স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্ট। মাপে ছোটখাটো। একটা ঘরের মধ্যেই সব। দোতারা এখানে মোড়া কিনে এনে রেখে গিয়েছে। কারণ, এই অ্যাপার্টমেন্টে আর যেসব বসার জায়গা আছে সেগুলো হয় লন্ডভন্ড, নয়তো ধুলো জমেছে অথবা জামাকাপড় পড়ে থাকে। একবার দোতারা এসে দেখেছিল, চেয়ারে একপাটি জুতো। আর সহ্য করতে পারেনি দোতরা, একদিন ঘাড়ে করে মোড়াটা এনেছে। শুধু আনেনি, একটা কাগজের বাক্স ছিঁড়ে বোর্ড বানিয়ে ‘রিজার্ভড’ লিখে গিয়েছে। বিহানকে বলে গিয়েছে, “এই নোটিশ লাগানো রইল। তারপরেও কেউ বসলে, হারামজাদার পাছায় এমন লাথি মারব যে দু’দিন বসতে হবে না।”

বিহান গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “এখনই গালাগালি দিচ্ছিস কেন? কেউ তো এখনও বসেনি।”

দোতারা বলল, “বসে গেলে আর গাল দিয়ে কী হবে? অ্যাডভান্স দিয়ে রাখলাম। যদি বলিস নোটিশে লিখেও দিতে পারি? দেব?”

বিহান বলল, “থাক, ওটা আমি মুখে বলে দেব।”

এত কড়া হুমকির পরেও বিহানের বন্ধুরা এই ‘নোটিশ’ মানে না। তারা এখানে এলে আগে মোড়ায় বসবে। তবে কান সজাগ রাখে। ডোরবেল কি বাজল? যদি বাজে, লাফ দিয়ে নেমে পড়তে হবে। দোতারা এসে গেলে কেলেঙ্কারি। সে ডেনজারাস মেয়ে। যদি কাউকে তার মোড়ায় বসতে দেখে তা হলে তুমুল ঝামেলা বাঁধাবে। এমনকী সত্যি সত্যি পা চালিয়ে দিতে পারে। ও যা খুশি করতে পারে। একবার বিহানের বন্ধু চন্দন বলেছিল, “আজ তোকে খুব সেক্সি দেখাচ্ছে।”

দোতারা মোড়ায় বসে বই পড়ছিল। মুখ না তুলেই সহজভাবে বলেছিল, “তাই নাকি! থ্যাঙ্ক ইউ।”

চন্দন স্মার্ট হয়ে বলল, “অবশ্যই তাই। ইচ্ছে করছে কোলে নিয়ে ঘুরি।”

দোতারা মুখ তুলে বলল, “পারবি? অসুবিধে হবে না?”

চন্দন দুপাশে হাত ছড়িয়ে হেসে বলল, “তুই যদি অ্যালাউ করিস আমার অসুবিধে কী? বিহান রাগ করবে না তো?”

দোতারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তোর কোল, আমি চড়ব, এতে বিহান রাগ করার কে?”

চন্দন মজা পেল। উৎসাহ দেখিয়ে বলল, “দেন ফাইন।”

চন্দন বাবু হয়ে বসেছিল মেঝেতে। দোতারা মোড়া থেকে উঠে গিয়ে ধপাস করে তার কোলে গিয়ে বসল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল চন্দন। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হাতের বইটা খুলে তাতে মন দিল দোতারা। ঘরের বাকিরা হাসতে শুরু করল বটে, চন্দনের মনে হল, হাঁটু দুটো ভেঙে যাবে। দোতারা ডান-বাঁয়ে অল্প দুলতেও লাগল।

“ওরে ওঠ! পা ভেঙে যাচ্ছে।”

দোতারা চন্দনের আর্তনাদে কান না দিয়ে বইতে আরও মন দিল।

“এবার কিন্তু সত্যি মরে যাব দোতারা, প্লিজ় উঠে পড়।”

দোতারা চাপ বাড়াল। চন্দন ককিয়ে উঠল।

“তোর পায়ে পড়ছি দোতারা, কোল থেকে উঠে পড়।”

দোতারা অবাক গলায় বলল, “সে কী রে! এই যে বললি, কোলে নিয়ে ঘুরবি! ঘোর আগে, তারপর তো উঠব।”

চন্দন প্রায়ে কেঁদে ফেলল, “আর ঘুরব না। অনেক হয়েছে।”

সবাই বলতে লাগল, “উঠবি না দোতারা। কিছুতেই উঠবি না। কোলে তোলা কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাক।”

চন্দন বলল, “পায়ে পড়ছি মাইরি, উঠে পড়।”

দোতারা বলল, “তুই পায়ে পড়বি কেন! আমি তো তোর কোলে পড়েছি। এবার চেয়ারের মতো করে তোর গায়ে হেলান দেব। হেলান দিয়ে বই পড়ব। সেক্সি মেয়ে কোলে বসে গায়ে হেলান দিলে কেমন লাগে দেখ।”

সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। চন্দন চিৎকার করে উঠল, “ওরে বাবা রে গেলাম রে! পাঁজরের হাড় সব ভাঙল।”

দোতারা হাতের বই বন্ধ করে বলল, “ঠিক আছে, এবার তবে কান ধরে বল আর কখনও বউ বা গার্লফ্রেন্ড ছাড়া কাউকে কোলে তুলতে চাইবি না। জোরে জোরে বলবি সবাই যেন শুনতে পায়। একবার নয়, পাঁচবার বলবি। নইলে কিন্তু এবার কাঁধে উঠে বসব। দুটো পা ঝুলিয়ে দেব।”

চন্দন সত্যি সত্যি কান ধরে ছাড়া পেল। এই মেয়েকে বিহানের বন্ধুরা চট করে ঘাঁটায় না। তার রেখে যাওয়া মোড়াতেও বসে সাবধানে।

মোড়ায় বসে দোতারা চুল মুছছে। চুল বৃষ্টিতে ভিজেছে। মুছছে কোনও তোয়ালে দিয়ে নয়, টি-শার্ট দিয়ে। তার চুল বড়। আগে সে চুল বড় হতে দিত না। কিছুদিন হল দিচ্ছে। দিচ্ছে না বলে বলা উচিত দিতে খানিকটা বাধ্য হয়েছে। যদিও সে প্রায়ই সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়, অনেক হয়েছে। এবার চুল একেবারে ছোট করে কেটে ফেলা হবে। সবচেয়ে ভাল হয় একদম নেড়া হলে। আজকাল মেয়েরা ফ্যাশন করতে নেড়া হচ্ছে। তাদের কলেজেও আছে। দোতারা অবশ্য ফ্যাশন করতে নয়, ঝামেলামুক্ত হতে নেড়া হতে চায়। বিশেষ করে স্নানের পর প্রতিবারই তার একথা মনে হয়। ভেজা চুল অনেকটা সময় ধরে তোয়ালে বা ড্রায়ার দিয়ে শুকনো করা তার কাছে অতি পরিশ্রম এবং সময়ের অপচয়। অসহ্য লাগে। আগে মেয়েদের হাতে ছিল দেদার সময়। বারান্দা, ছাদে, উঠোনে দাঁড়িয়ে চুল শুকোনো ছিল এক কর্মযজ্ঞ। এই দৃশ্য দেখে আশপাশের বাড়ির হাঁদা ধরনের ছেলেরা প্রেমেও পড়ত। কেশবতীরাও ছাড়ত না, সেই হাঁদা প্রেম নিয়ে খেলা করত। মুচকি হাসি, তেরচা চাহনি এবং গামছা দিয়ে ঝেড়ে ভেজা চুল থেকে জলকণা উড়িয়ে সেই প্রেম দিত উসকে। দোতারার বিশ্বাস, প্রেমের রকমফের নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হলে, এই প্রেম অবশ্যই সেখানে জায়গা পেত। নাম হত ‘চুল শুকোনো প্রেম’। যদিও অবধারিত ভাবে এই ধরনের প্রেম টিকত না। জলকণার মতোই অচিরেই শুকিয়ে যেত। আবার ফিরে আসত বীরদর্পে, বিয়ের সম্বন্ধে। আর হাসিঠাট্টা নয়, এবার ‘সে’ অতি গুরুতর। পাত্রপক্ষ যেসব পয়েন্টে কাগজে লিখে সম্ভাব্য পাত্রীদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে রসগোল্লা, শিঙাড়া খেয়ে বেড়াত, তার মধ্যে একটা পয়েন্ট অবশ্যই থাকত, ‘পাত্রীর মাথার চুল’। খাট-আলমারি, রেডিয়ো, সাইকেলের মতোই জরুরি। মেয়ে যেন একটাল চুল নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঢেকে। সম্বন্ধ পরীক্ষায় পাশ করতে হলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান, ডালে ফোড়ন এবং পিঠ ছাপিয়ে চুল রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। এই তিন সাবজেক্টের যে-কোনও একটায় ফেল মারায় কত বিয়ে যে ভেঙেছে! সেই যুগ আর নেই। কন্যার পিঠে আলুলায়িত চুল এখন বিড়ম্বনা। তাকে যত্নআত্তি করবার সময় কোথায়? যদিও বন্ধুরা দোতারাকে বলেছে, নেড়া হওয়ার পাশাপাশি চুল বড় রাখার ফ্যাশনও নাকি ফিরে আসছে। এতে দোতারার কিছু এসে যায় না। সে এমনিতেই সুন্দরী, স্মার্ট, বুদ্ধিমতী। ছেলেরা তার সঙ্গে প্রেম করার জন্য ছোঁক ছোঁক করে। আলাদা করে সাজগোজের প্রয়োজন নেই। তারপরেও চুলের বিড়ম্বনা নিয়ে তাকে থাকতে হচ্ছে। সে বিরক্ত।

দোতারা চেহারায় তার বাবার ধাত পেয়েছে। শিরীষকে দেখলে বয়স বোঝা যায় না। বরং বেশ খানিকটা কমই মনে হয়। চল্লিশ পেরোলে বাঙালির ভুড়ি হবেই। শিরীষের হয়নি। বয়সের তুলনায় চেহারা হালকা। অথচ মানুষটা কোনওরকম শরীরচর্চায় নেই। কর্পোরেটে চাকরি মানেই এখন নানাধরনের লাইফস্টাইল সমস্যা। শিরীষকে সেই সমস্যা ছুঁতে পারেনি। পরিশ্রম, পরিমিত খাওয়াদাওয়া, মাপা মদ্যপান তাকে সুস্থ রেখেছে। সুস্থ না থাকলে কেউ এই বয়সে নতুন করে কাঁধে লাঙল নিয়ে খেতে চাষ করতে নামে?

দোতারা বাবার ফ্যান। নিজের রূপ নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও, বাবার রূপ নিয়ে তার প্রছন্ন গর্ব রয়েছে। অনেক সময়েই সে বলেছে, “তোমার পাশে হাঁটলে তোমাকে আমার বাবা বলে মনে হয় না, মনে হয় বয়ফ্রেন্ড।”

সোমদত্তা মেয়ের এই কথায় খেপে যায়। ধমক দেয়।

“এ কী অসভ্যের মতো কথা! এই ধরনের কথা আর কখনওই তুমি বলবে না।”

দোতারা লেখাপড়ায় অতিরিক্ত ভাল হলেও শান্তশিষ্ট বা চুপ করে থাকার মেয়ে নয়। আড়ালে অনেকেই তাকে বলে ‘অতি পাকা মেয়ে’। কেউ বলে, এই কারণে মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল নয়।’ কেউ বলে, ‘পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেই মানুষ হয় না। টিয়াপাখি হয়। ট্যাঁক ট্যাঁক করে কথা বলতে শেখে।’ দোতারা এইসব আড়ালের কথা জানে এবং খুশি হয়। সে গালমন্দ পছন্দ করে। মাঝেমধ্যে এমন সব আচরণ করে যাতে লোকে রেগে যায়। এক সময়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিজের পরিচয় দিত, ‘আই অ্যাম আ ব্যাড গার্ল, আই ক্যান পাঞ্চ এনিহোয়্যার অন ইয়োর বডি।’ এতে অন্যদের রাগ হবে না? বলা নেই কওয়া নেই, তুমি আমায় মারবে কেন! শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই মারকুটে কথা দোতারা বাদ দিয়েছে। মোদ্দা কথা, চুপ করে যাওয়ার মেয়ে সে নয়। সেদিন মায়ের ধমকের জবাব দিয়েছিল।

“তুমি আসলে হিংসে করছ মা। তুমি চাও না, বাবা আর কারও বয়ফ্রেন্ড হোক। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট আমলের বাংলা সিনেমার মতো শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে থাকুক। আর তুমি গান করবে, আমি আপন করিয়া চাহিনি, তবু তুমি তো আপন হয়েছ…”

সোমদত্তা বলেছিল, “এবার কিন্তু তুমি মার খাবে দোতারা।”

সেদিন মার খায়নি, কিন্তু বাবার প্রেম প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কিছুদিন আগে সত্যি সে মায়ের চড় খেয়েছে। যে মেয়ে ছোটবেলায় হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র মায়ের কাছে হালকা পলকা মারধর খেয়েছে, তার এই ধেড়ে বয়সে চড় খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দোতারা রাগ করেনি। সে থমকে গিয়েছিল। বুঝেছিল, তার ভুল হয়েছে। বাড়াবাড়ি করেছে সে। এই মহিলা বাবার সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকেছে। এবার একা হয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনার জন্য কার দায় বেশি, সে হিসেব যা-ই হোক না কেন, বিচ্ছেদের ঘটনা সত্যি। এবং সেই ঘটনা সুখের নয়। এই মানুষটাকে কিছু বলার আগে ভেবে বলা উচিত ছিল। সে যা বলেছে, তাতে একটা চড় কোনও ঘটনাই নয়, আরও বেশি হতে পারত।

সোমদত্তা অবশ্য দোতারার চুল ছোট করে ফেলার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে।

“এ আবার তোমার নতুন কায়দা হয়েছে! তাবশ্যই চুল কেটে ফেলবে। কলেজ যাওয়ার সময় তো কোনওদিনই ঠিকমতো মাথা মোছো না। মাথায় জল বসানো কোনও কাজের কথা নয়।”

দোতারা বলেছে, “আজই ফেরার সময় পার্লার হয়ে ফিরব।”

সোমদত্তা বিরক্ত হয়ে বলেছে, “একথা তো তুমি রোজই বলছ। যাচ্ছ কই? মাথায় জল বসিয়ে একদিন জ্বর বাঁধালে ঠিক হবে। সামনে না তোমার পরীক্ষা? তার কী হবে?”

দোতারা বলে, “আজ ফাইনাল বললাম।”

তারপরেও চুল কাটা হয়নি। এর কারণ বিহান। বিহান তার বান্ধবীর যেমন ‘গুণমুগ্ধ’, তেমন ‘চুলমুগ্ধ’-ও বটে। ইদানীং তাকে ফোটো তোলার নেশায় পেয়েছে। দোতারার চুলকে ‘সাবজেক্ট’ করে অনেক কায়দা মার্কা ফোটো সে তুলেছে এবং ক্রমাগত তুলে চলেছে। তার মতে, মাথার চুল মেয়েদের ‘রহস্যময়ী’ করে। একরাশ ঘন চুল হল মেঘের মতো, কুয়াশার মতো। আজ বলে নয়, যুগযুগান্ত ধরে নাকি এই ‘রহস্য’ চলছে। ক্যামেরা দিয়ে বিহান এই ‘রহস্য’ ধরতে চায়। তার মডেল দোতারা। কখনও ঘাড়ের উপর চুল ফেলে, কখনও মুখের উপর ছড়িয়ে, কখনও কাঁধের পাশ থেকে, কখনও পিছন থেকে সে ফোটো তুলছে। দোতারা সহ্য করতে পারছে না। প্রতিবার ফোটোশুটের আগে প্রচুর গাল দিচ্ছে।

“এখনও তুই ঠিকমতো ফোটো নিতে পারলি না!”

বিহান একগাল হেসে বলে, “আগের দিন মনে হল, পেরেছি। যে ছবি খুঁজছিলাম, লেন্সে ধরে ফেলেছি। পরে ফোটো ল্যাপটপে ফেলে বুঝতে পারলাম পারিনি। তোকে দেখাচ্ছে পেতনির মতো। রহস্যময়ীর বদলে পেতনিময়ী।”

দোতারা সহজ ভাবে বলল, “তুই একটা বালের ফোটোগ্রাফার?”

বিহান এই গালি গায়ে না মেখে হেসে বলল, “ঠিকই বলেছিস তারা, আমি একজন কেশ বিশেষজ্ঞ চিত্রগ্রাহক। শ্যাম্পু, তেলের কোম্পানিরা যদি আমাকে চিনত, সোনার সিংহাসনে বসিয়ে নিয়ে যেত। ওদের বিজ্ঞাপনের ফোটো তুলতে তুলতে যদি আমি…”

দোতারা হাত দেখিয়ে বিহানকে থামিয়ে কড়া গলায় বলল, “তোর এই পাগলামি অনেক সহ্য করেছি বিহান। তুমি শালা, গত একবছর ধরে আমার ফোটো তুলে চলেছ। তুলছ আর ডিলিট করছ…তুলছ আর ডিলিট করছ। অনেক হয়েছে, নো মোর। এবার আমি আমার এই চুলের হ্যাপা ডিলিট করব।”

বিহান কাকুতি মিনতি করবার ঢঙে বলল, “প্লিজ় দো, আর ক’টাদিন অপেক্ষা কর। নেক্সট ইয়ার ফ্রান্সের নাইসে একটা ফোটো কম্পিটিশন আছে। বিষয়, মিস্টিরিয়াস উইমেন। ঠিক করেছি এন্ট্রি পাঠাব এবং তোর ছবি দিয়েই পাঠাব। একবছর ধরে সেই চেষ্টাই চালাচ্ছি। তোকে এতদিন বলিনি, যদি রাগ করিস, আজ বলে ফেললাম।”

দোতারা অবাক হয়ে বলল, “তুই আবার কবে থেকে কম্পিটিশনে নাম দিচ্ছিস!”

বিহান গদগদভাবে বলল, “আগে দিইনি, এবার দেব ভেবেছি। তোর ফোটো দিয়ে শুরু। শুভযাত্রা বলতে পারিস।”

দোতারা ফোঁস করে একটা বানানো নিশ্বাস ফেলল। বলল, “তার চেয়ে বরং নিজের পশ্চাৎদেশ দিয়ে শুরু কর। সেদিন ফেসবুকে দেখলাম, ভেনিজ়ুয়েলা না কোথায় যেন ফোটোগ্রাফি কম্পিটিশন হচ্ছে। সাবজেক্ট হল, বিউটি অব ইয়োর ওন বাটক। সেলফি তুলে পাঠিয়ে দে। ভাল রেজ়াল্ট করবি।”

বিহান বলল, “উফ, তারা, আজকাল তুই বড্ড স্ল্যাং ইউজ় করছিস!”

দোতারা নির্বিকারভাবে বলল, “ভাবছি ইলেকট্রনিক্স ছেড়ে স্ল্যাং-ট্রনিক্স নিয়ে পড়াশোনা করব। যাক, মনে রাখবি, আর মাত্র দু’দিন, ওনলি টু ডেজ়। তারপর তোর বেয়াড়া আবদার খতম। পার্লারে ঢুকে চুল ঘ্যাচাং। একেবারে নেড়া হয়ে যাব। মনে থাকে যেন।”

দোতারা আজ বৃষ্টিতে ভিজেছে। ভিজত না। ক’দিন বৃষ্টি হচ্ছে না দেখে ছাতা রেনকোট না নিয়েই বেরিয়েছে। দুম করে আকাশে মেঘ করে এমন ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে কে জানত? ভেজা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। নিউ টাউনের এদিকটা শুনশান। রাস্তায় দোকানবাজার নেই যে ঢুকে পড়বে। দোতারা এসেছে বিহানের অ্যাপার্টমেন্টে। আজ তার ফোটো সেশনের দু’দিনের কোটা শেষ হতে চলেছে। তিন বছর হতে চলল নিউ টাউনের এই স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্টে বিহান রয়েছে। সে ডাক্তারি পড়ে। বাড়ি বর্ধমান। কলকাতার এক মেডিকেল কলেজে পড়ছে। শুরুতে হস্টেলে থাকতে শুরু করেছিল। একদিন বিহানের মা এসে হস্টেলের অবস্থা দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যান আর কী! ছেলে এ কোথায় গিয়ে পড়েছে। তিনতলার ঘর অগোছালো, জানলায় শিক পর্যন্ত নেই।

বিহানের বাবা তাঁকে বোঝালেন, ছেলেমেয়েরা এইভাবেই ডাক্তারি পড়ে। ছাত্রাবস্থায় কঠিন কৃচ্ছ্র্রসাধন ছাড়া বড় ডাক্তার হওয়া যায় না। এসব নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। বিহানের নরম স্বভাবের মা মানতে রাজি হননি। ছেলের চিন্তায় তিনি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেন। এমনকী, রাতের ঘুম পর্যন্ত উধাও হয়। চোখ বুজলেই নাকি চোখে হস্টেলের অগোছালো ঘর আর শিকহীন জানলা ভেসে উঠতে থাকে। বিহানের বাবা বাধ্য হয়ে এই ফ্ল্যাট কেনেন। তবে শর্ত হয়েছে, ডাক্তারি পড়া শেষ হলে এই ফ্ল্যাটের টাকা ছেলেকে দিতে হবে। বিহানের ডাক্তার হতে আর আড়াই বছর বাকি। তবে বিহান খুব দ্রুত এই অ্যাপার্টমেন্টটিকে হস্টেলের চেহারা দিতে পেরেছে। কমবেশি রোজই তার বন্ধুরা কেউ না কেউ এসে থাকছে। অনেক সময় দু’-তিনজনও চলে আসে। একসঙ্গে পড়াশোনা এবং অল্পবিস্তর নেশাটেশা করার পর মাটিতে লম্বা বিছানা হয়। ঘরের অগোছালো অবস্থা হস্টেলকে অনেক পিছনে ফেলতে পেরেছে। কোনটা বিছানা, কোনটা পড়ার টেবিল, আলাদা করা কঠিন। রান্নার হাঁড়ি থাকে খাটের উপর, বালিশের নীচে থাকে খুন্তি। জানলার গ্রিল থেকে প্লাস্টিকের কঙ্কাল ঝোলে। ফুলদানিতে নরমুণ্ড। বিহানের বাবা নিজে এসে দুরবস্থা দেখে গিয়েছেন। স্ত্রীকে কলকাতা-মুখো হতে দেন না। দেবেন কী করে? ছেলের ঘরের অবস্থা দেখলে তো জ্ঞান হারাবেন।

দোতারা যেদিন আসে, সেদিন বিহান সবাইকে বারণ করে। বন্ধুরা কেউ থাকলে বের করে দেয়। তারপরেও দু’-একজন থেকে যায়। বলে, “তোর সমস্যা কী? দোতারা তো আমাদেরও বন্ধু।”

বিহান বলে, “হতে পারে, কিন্তু এখন কেটে পড়।”

“এ কেমন অত্যাচার বিহান? এ তোর কেমন নিষ্ঠুরতা! এই মাঝদুপুরে কোথায় যাব?”

বিহান বলে, “যেখানে খুশি। কলকাতায় ঘুরে বেড়ানোর জায়গার অভাব নেই।”

“একটা কাজ করি না!”

বিহান বলে, “কী কাজ?”

“আমার চোখ একটা ফেট্টি দিয়ে বেঁধে দে। আমি ধৃতরাষ্ট্রের মতো হয়ে যাই। কোনও পাপ, কোনও অন্যায় দেখি না। তারপর তুই আর দোতারা যা খুশি কর। মাইরি বলছি ফেট্টির ফাঁক দিয়ে দেখব না।”

এরপর বিহান বন্ধুকে দরজা খুলে ঘাড় ধাক্কা দেয়। আজ অবশ্য কেউ আসেনি। দোতারা যে আসবে ঠিকই ছিল। ফোটো তোলার শেষদিন বলে কথা। ক’দিন পরে পরীক্ষা বলে বিহান কলেজ যাচ্ছে না। সকাল থেকে পড়াশোনা করে ক্লান্ত। মানব শরীরের হাড় যে কঠিন বস্তু, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। দোতারা এল ভিজে একসা হয়ে। দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল বিহান। দোতারা এসেছে বলে নয়, অবাক হল ভিজে এসেছে বলে।

“তুই ভিজে?”

দোতারা বিহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। বলল, “কলেজে প্র্যাকটিকাল করছিলাম। অ্যান্টেনা অ্যান্ড ওয়েব প্রোপাগেশন। জানলা দিয়ে দেখলাম, আকাশে মেঘ। সব সরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ভাবলাম যেতেই যখন হবে, বৃষ্টি নামার আগেই যাই। অনেকটা করে এনেছিলাম, বাস থেকে নেমে ভিজে গেলাম। তোদের এখানে তো শালা কোনও শেল্টার নেই। তাড়াতাড়ি তোয়ালে দে। কাচা দিবি। পরার জামা প্যান্ট দিবি।”

বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকল দোতারা। বিহান পরিষ্কার তোয়ালে দিতে পারেনি। তার দুটো তোয়ালের অবস্থাই সঙ্গীন। একটায় মাংসের ঝোল লেগেছে, একটায় মাথার তেল। নিজের দুটো কাচা টি-শার্ট বের করে দিয়েছে। দোতারা সেগুলোই ব্যবহার করছে। বাথরুমে গিয়ে সে নিজের জামা খুলেছে। মোজা, রুমাল, ব্রা, প্যান্টি পর্যন্ত। সব শুকোতে দিয়েছে ঘরের ফ্যানের নীচে। সামান্য বৃষ্টি ভেজা কাপড়ও সে গায়ে রাখতে পারে না। হাঁচি শুরু হয়ে যায়। মায়ের ধাত পেয়েছে। বৃষ্টির জলে সমস্যা আছে। অন্য কোনও জলে নেই। এমনকী সুইমিং পুলেও দিব্যি থাকে। যত গোলমাল বৃষ্টিতে। ছোটবেলায় বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, “এই মেয়ের রেন ইনটলারেন্স রয়েছে, বৃষ্টির জলে অ্যালার্জি। সব চলবে, বৃষ্টিতে ভেজা চলবে না।” অথচ দোতারা পাগলের মতো বৃষ্টি ভালবাসে। স্কুল বয়সে বন্ধুরা মজা করে ভিজত, সে পারত না। চোখ ছলছল করে দূর থেকে দেখত। মনে হত, বৃষ্টিতে ভিজতে না পারলে জীবনটাই বৃথা। সে একটা ‘বৃথা জীবন’ বয়ে বেড়াচ্ছে। একবার কলেজ থেকে দলবেঁধে ম্যাসানজোরে যাওয়া হয়েছিল। একেবারে ড্যামের পাশে গেস্টহাউস। ঢোকার পরপরই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। হুটোপাটি করে মেয়েরা ছুটল ছাদে। বৃষ্টিতে ড্যাম দেখতে হবে। ছাদেই শুরু হল তুমুল নাচ। রেন ডান্স। অনেকে জামা খুলে ফেলল। প্রকৃতির কাছে প্রকৃতির বেশে। অসুবিধে কিছু ছিল না, পুরো গেস্টহাউসটাই তো মেয়েরা নিয়েছিল। দোতারার খুব ইচ্ছে করছিল যোগ দিতে পারল না। সবাই খুব ডাকাডাকি করল, তাও পারল না। তবে এখন ঠান্ডা লাগার বদভ্যাসটা কমেছে, তবে জামাটামা একটু ভিজে গেলেই সর্তক থাকতে হয়। সেই কারণেই ভিজে কাপড় খুলে শুকোতে দিয়েছে।

বিহানকে দোতারা চেনে দেড় বছর। না, তার চেয়ে মাসখানেক বেশিই হবে। কিন্তু এরমধ্যেই তাকে খানিকটা বুঝতে পেরেছে। ছেলেটা অন্যরকম। কাউকে ‘অন্যরকম’ বলার জন্য অনেক কারণ লাগে না, একটা-দুটোই যথেষ্ট হয়। বিহানের বেলাতেও তাই। ছেলে যাতে একা আরামে থাকতে পারে, তার জন্য বাবা-মা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে দিল, অথচ বিহান বন্ধুদের সঙ্গে সেই ঘর ভাগ করে নিয়েছে। এমনও হয়েছে, অসুস্থ বন্ধুকে খাটে শুইয়ে সে বিছানা করেছে মেঝেতে। মেল শভিনিজ়মে একদম ভোগে না। ছেলেমেয়ের অধিকার, ক্ষমতায় ভেদাভেদ নেই। দোতারার উপর কোনও জোরজবরদস্তি নেই, আবার আছেও। তবে সেই জোর খাটাতে কখনও তার স্বাধীনতায় হাত দেয় না। মজার কথা হল, দোতারা জেনেছে, এই ছেলের কেবলামি যেমন আছে, দুষ্টুমিও রয়েছে। মাঝেমধ্যে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি বিহানের প্রেমে পড়েছি?’ তারপরেই ভাবে, পড়লে পড়েছে। প্রেম নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তাকে ইনসিডেন্টের মতো ভাবাই ঠিক। যখন যেমনভাবে আসবে, সেইভাবে মুখোমুখি হতে হবে। যদি মন দিয়ে হয় মন দিয়ে, যদি শরীর কাছে যেতে চায়, শরীরকে ছেড়ে দিতে হবে। এসব নিয়ে ইনহিবিশনের প্রশ্ন নেই। শরীর এমন কোনও কাচের পলকা কাপ নয় যে নাড়াচাড়া করলেই ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকবে। ‘চরিত্র’ একটি প্যাঁচালো ধারণা। সমাজ বেশিরভাগ সময়েই ভুল ব্যাখ্যা করে। তাকে মিথ্যে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেছে। চরিত্র সেই বাঁধনে পড়ে আরও ছটফট করে। খালি ভাবে, কখন দড়ি ছিঁড়ব। কেউ ছিঁড়ে ফেলে, কেউ ছিঁড়তে গিয়ে ফাঁসে জড়িয়ে পড়ে। কেউ আবার ছিঁড়তে সাহস না পেয়ে ভাবে, ‘আমার চরিত্রটি অতি পবিত্র।’ দোতারা মনে মনে বলে, ‘কচুর মাথা পবিত্র।’ সে ঠিক করে ফেলছে, আর যাই হোক, ‘বিয়ে’ নামক গোলমেলে সম্পর্কটির মধ্যে সে কোনওদিন যাবে না। যেদিন মন চাইবে না, ‘টা টা’ বলে উলটোদিকে হাঁটবে। মায়ের মতো কোর্টে ঘুরে জুতোর শুকতলা ছিড়তে সে রাজি নয়, আবার বাবার মতো কিছুতেই ডিভোর্স দেব না ভেবে জেদ করে বসেও থাকবে না। এতে সময় নষ্ট।

বিহান উৎসাহ নিয়ে বলল, “তা হলে শুরু করা যাক? এরপরে লাইটের সমস্যা হবে।”

দোতারা অন্যদিকে মুখে ফিরিয়ে বলল, “ফোটো তুলবি না। কম জামাকাপড় পরে আছি।”

সত্যি দোতারার গায়ে জামাকাপড় কম। বিহানের শর্টসের ওপর টিশার্ট। বিহান ক্যামেরা বের করে ফেলেছে।

“জামাকাপড় দিয়ে কী হবে? আমি তো জামাকাপড়ের ছবি তুলছি না। তারা, ভেজা চুলে তোকে যা লাগছে না মাইরি! ফোটো দেখলে নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যাবি।”

দোতারা নাক দিয়ে ফুঃ ধরনের অবজ্ঞার আওয়াজ করে বলল, “আমি আমার প্রেমেই থাকি। চারপাশে তো প্রেমে পড়ার মতো আর কাউকে দেখি না।”

বিহান লেন্স ঠিক করতে করতে বলল, “তুই না পড়িস, অনেক ছেলেই কিন্তু মনের ভিতর দোতারা বাজিয়ে গান করে প্রেমসাগরে ডুব দিয়েছে…”

দোতারা সামনে ফেলে দেওয়া চুল বিহানের টি শার্ট দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, “নামগুলো বলিস তো৷ ওদের দোতারার তার কীভাবে ছিঁড়তে হয় দেখব। কানের গোড়ায় এমন মারব না যে প্রেমসাগর থেকে আর উঠতে হবে না। হাবুডুবু খাবে।”

“সে তুই পারিস তারা, তুই যা গুন্ডা। অ্যাই, এই দিকে ফের। ফোকাসটা করে নিই। মুখের সামনে থেকে চুল সরা। ভূতের মতো লাগছে।”

দোতারা চুল সরাতে সরাতে বলল, “আমাকে যদি ভূতের মতো লাগে তোমার ক্যামেরার কপালে দুঃখ আছে। ওকে এমন পেটাব যে কপালে সাতটা স্টিচ দিতে হবে।”

বিহান চুপ করে ফোটো তুলতে থাকে। নিঃস্তব্ধ ঘরে শাটারের আওয়াজ হতে থাকে চাপা স্বরে। মনে হয় সে কথা বলছে। প্রেমের কথা? প্রেম বিষয়ে দোতারা যতই কঠিন এবং উদাসীন ধ্যানধারণা নিয়ে থাকুক না কেন, বিহানকে পছন্দ। খানিকটা বেশিই পছন্দ। ছেলেটার নানাধরনের শখ এবং জীবনবোধ তার ভাল লাগে। ফোটো ভোলা, গান গাওয়া, পাহাড়ে, জঙ্গলে ট্রেক করা তো আছেই। তার সঙ্গে মানুষদের জন্য কাজ করতেও সে ভালবাসে। ডাক্তারি পড়া খুবই চাপের। যত উপরের দিকে যায়, চাপ বাড়ে। এর মধ্যেই বিহান সপ্তাহে একদিন করে শিয়ালদার কাছে নাইট স্কুলে পড়াতে যায়। বড়দের লেখাপড়া শেখায়। গরিব মানুষরা সব পড়তে আসে। অক্ষর চেনা, অঙ্ক শেখানো। হাজার কাজ থাকলেও এই দিনটা মিস করে না বিহান। সে নিজের পরীক্ষাই থাকুক, আর পার্টিই থাকুক। বাবা বলত, “যে মানুষের শখ আহ্লাদ নেই, আবেগ নেই, পাগালামি নেই সে মানুষই নয়।”

একথা শুনলে সোমদত্তা রেগে যেত খুব। সে একজন প্র্যাকটিকাল মহিলা। একটা সময় মেয়েকে নিয়ে চরম বাড়াবাড়ি করত সে। খাওয়া- পরা-ঘুমোনো-জাগা— সবের উপর নজর রাখত। এমনকী কার সঙ্গে মিশবে, কী কথা বলবে, তাও। পারলে মেয়ের ভাবনার ভিতরে ঢুকে বসে থাকত। দোতারা অতিষ্ঠ হয়ে যেত। মায়ের ছুটি থাকলেই আতঙ্ক। এখনও স্বভাব বদলায়নি। তবে মেয়ে বড় হয়েছে বলে জোর খাটাতে পারে না।

বাড়ির কোনও বিষয়ে দোতারা সহজে নাক গলায় না। ছোটবেলা থেকেই নিজের লেখাপড়ার জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। চারপাশে কী ঘটছে, তাই নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। জ্ঞান হওয়া থেকে দেখছে, বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করছে। ফলে তাদের সবসময় কাছে পায়নি। অসুবিধে হয়নি। একা থাকার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। নিজেকে সেভাবে তৈরি করে নিয়েছে। গোড়া থেকেই লেখাপড়া করতে তার ভাল লাগত। মা পরীক্ষার রেজ়াল্ট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত। ফার্স্ট হলেই হল। বাবা কিন্তু শুধু ফার্স্টে খুশি ছিল না। মার্কশিট নেড়েচেড়ে ফিরিয়ে দিত।

“পরীক্ষার রেজ়াল্ট তো হল, বাইরে কী হল সেটা বল।”

প্রথম প্রথম এই কথার মানে বুঝতে পারত না দোতারা।

“পরীক্ষার বাইরে আবার কী হবে!”

শিরীষ হেসে বলত, “বাঃ! পরীক্ষার বাইরেই তো আসল পরীক্ষা। সেখানে সিলেবাসও নেই, বইও নেই, টিচারও নেই। এমনকী পরীক্ষার খাতা দেখারও কেউ নেই। সব নিজেকে করতে হবে।”

দোতারার কাছে এসব কথা ধাঁধার মতো লাগত। বলত, “কী বলছ বাবা! বুঝতে পারছি না।”

শিরীষ বলত, “লেখাপড়া, নিজের কেরিয়ারের পাশাপাশি জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে দোতারা। শখ আছে, স্বপ্ন আছে, অন্যের দুঃখ কষ্ট নিয়ে ভাবা আছে। জীবনের দুঃখ এবং আনন্দ— এই দুই সেখানেও থাকে।”

পুরোটা না বুঝলেও দোতারার এই কথা ভাল লাগত। সোমদত্তা এসব একেবারে পছন্দ করত না। বলত, “মেয়েকে এসব কী হাবিজাবি শেখাচ্ছ! লেখাপড়া ছাড়া ওর কোনও দিকে মন দেওয়ার নেই। আমি তো নাচ গানও শিখতে দিইনি। লেখাপড়ায় ডিস্টার্বেন্স হবে।”

শিরীষ বলত, “ভুল করছ সোম। আমিও তো লেখাপড়া শিখেছি। খারাপ শিখিনি। স্কুল বয়স থেকেই খেলাধুলো, ছবি আঁকা, নাটক, গান-বাজনা সবই করেছি। কলেজে ঢুকে হুল্লোড় আরও বাড়িয়েছি। কবিতা লিখেছি, লিটল ম্যাগাজ়িন করেছি। পাশাপাশি একটা এনজিওতে যুক্ত হয়েছিলাম। নাম ছিল ‘মেন্টাল স্ট্রেংথ’। দরিদ্র, সহায় সম্বলহীন মানসিক রোগীদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প করা হত। খুব ঝক্কির কাজ। খবর পেয়ে নানা জায়গা থেকে পাগল ধরে আনতাম। জোর করে তাদের চিকিৎসার জন্য ক্লিনিকে রাখা হত। এসব করে ক্ষতি তো হয়নি।”

সোমদত্তা রেগে গিয়ে বলত, “লেকচার দিয়ো না। কী চাও তুমি? দোতারা লেখাপড়া ছেড়ে তোমার মতো হুজুগে মাতুক? আমি অ্যালাউ করব না। আর কে বলেছে ক্ষতি হয়নি তোমার? কবিতা, ছবি, থিয়েটার নিয়ে না থাকলে হয়তো আরও উন্নতি করতে!”

শিরীষ থমকে গিয়ে বলত, “যা ভাল বোঝো করবে।”

সোমদত্তা বলত, “তাই করব। এই দুনিয়াটা শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবনার দুনিয়া। যে নিজেকে নিয়ে ভাবে না, সে আউট। দয়া করে তুমি মেয়েকে কুশিক্ষা দেবে না।”

মা যাই বলুক, দোতারার বাবার কথা ভাল লাগত। সে আসলে মানুষটাকেই ভালবাসে। এখনও বাসে। মায়ের মতো মানুষের সঙ্গে এতদিন কীভাবে চলেছে ভেবে অবাক লাগে। সে যে এই বইপত্র গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে হস্টেলে পালিয়ে গিয়েছে, তার পিছনের একটা কারণ শ্ৰীমতী সোমদত্তা মুখার্জি। কাছে থাকলেই ঘ্যানঘ্যান। এখন থেকেই বিদেশে পাঠানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আরে বাবা, গোড়াটা তো এখানে শিখে যেতে হবে। তারপর তো হায়ার স্টাডি। ওই মহিলাকে কে বোঝাবে? গান শুনলে, সিনেমা দেখলে পর্যন্ত টেনশন করে।

“সিনেমা দেখবি তো, লেখাপড়ার জন্য এরকম এক কঠিন সাবজেক্ট না বেছে, সহজ কিছু একটা বাছলে পারতিস।”

দোতারা রেগে বলে, “মনে হচ্ছে, তাই বাছা উচিত ছিল। তা হলে হয়তো আমাকে নিয়ে তুমি এত কনসার্ন হতে না।”

সোমদত্তা রেগে গিয়ে বলেছে, “এত আন্ডারএস্টিমেট করছিস কেন? লেখাপড়া তো আমরাও করেছি। খুব খারাপ কিছু করিনি।”

দোতারা হাতজোড় করে বলে, “না মা, তোমাকে আন্ডারএস্টিমেট করছি না, ওভারএস্টিমেট করছি। যা নিয়েই লেখাপড়া করো, ইলেকট্রনিক্সেও তুমি সমান পারদর্শী। আমি সাহিত্য বা কর্মাস নিয়ে পড়লেও একই কথা বলতাম। এবার দয়া করে ঘর থেকে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও। কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে না পারলেও নিজের লেখাপড়া সম্পর্কে আমি কতটা সচেতন তুমি ভালই জানো। রেজ়াল্টও দেখছ।”

সোমদত্তা বলে, “সেই জন্যই তো বেশি ভয়। পা ফসকাতে কতক্ষণ…”

দোতারা বলে, “চিন্তা কোরো না। পা ফসকে তোমার ঘাড়ে পড়ব না।”

নাওডুবির ঘটনায় বাবাকে সমর্থনই করে দোতারা। সে মনে করে, বাবা তো না বলে কিছু করেনি। মাকে বলেছিল, তাকেও বলেছে। মা আটকাতে পারেনি। সেও মানুষটার ঘোরের কাছে হেরে গিয়েছিল। এটা বাবারই জয়।

বিহান ঘরের দেয়ালে, পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। ফোটো সেশন চলছে। তবে প্রতিটা শটের জন্য সময় লাগছে। সময় না লেগে উপায় নেই। ফোটোতে টিশার্ট চলে এলে! রহস্যময়ী সুন্দরীর হাতে টিশার্ট! কম্পিটিশনে ঢুকতেই দেবে না। দোতারা টিশার্ট ধরা হাত সরালে তবে শাটার টিপতে হচ্ছে। ধৈর্যের কাজ। এত ধৈর্যের পরেও বিহান খুশি। এই ভঙ্গিতে দোতারার ফোটো তোলার সুযোগ সে আগে পায়নি। মনে হয় না আর কখনও পাবে। আর কবে সে ভিজে আসবে ঠিক নেই। গোটা বর্ষাকালটা রেনকোট আর বড় ছাতা নিয়ে ঘুরেছে। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তে দেয়নি। সেই মেয়ের মাথার চুল ভিজবে কী করে? একটাই পথ ছিল, দোতারাকে যদি কখনও স্নানের পর পাওয়া যেত। কথাটা মাথায় আসেনি। এলেই বা কী হত? এই মেয়ে থোড়াই রাজি হত। উলটে একথা বললে নির্ঘাত হাত চালাত। গুন্ডা প্রকৃতির মেয়ে। আলাপও হয়েছিল গুন্ডামির মধ্যে দিয়ে।

দেড়বছর আগের কথা। যাদবপুর থেকে অটোতে উঠেছিল। খানিকদূর গিয়ে অটোচালক বলল, “আর যাব না, নেমে যান। অন্য অটো ধরুন।”

পিছনে বসা এক তরুণী বলল, “কেন যাবেন না?”

অটোচালক একজন কমবয়সি ছেলে। সে অতি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “ভাল লাগছে না। ভাড়া দিয়ে নেমে যান।”

“এ কী কথা! মাঝপথে নামিয়ে দিচ্ছ কেন ভাই?”

অটোচালক তরুণটি বলল, “বললাম তো, এই পর্যন্ত। এরপর অন্য গাড়িতে উঠতে হবে। যান ওখানে গিয়ে লাইন দিন। খুচরোতে ভাড়া দেবেন।”

সবাই গজগজ করতে করতে ভাড়া বের করতে লাগল। বিহানেরও ঝগড়া করবার সময় ছিল না। পিছনে বসা তরুণীটি শান্ত গলায় বলল, “ভাড়া দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, আপনাকে পুরো রুটটাই যেতে হবে। কারণ, রুট ভাঙার কথাটা আপনার আগে বলা উচিত ছিল।”

অটোচালক চোখ নাচিয়ে বলল, “এ তো বিরাট মাস্তান দেখছি, উচিত শেখায়! মেয়ে মাস্তান?”

তরুণীটি আরও শান্তভাবে বলল, “হ্যাঁ ভাই, মেয়ে মাস্তান। নিন, দেরি করবেন না, গাড়ি স্টার্ট করুন।”

অটোচালক এবার ঘুরে বসল। বলল, “আরিধ্বাস! এমনভাবে বলছে যেন মারবে!”

তরুণী বলল, “হ্যাঁ, প্রয়োজনে মারব। আপনাদের কয়েকজনের গুণ্ডামি বড় বেড়েছে। ভালদেরও নাম খারাপ হচ্ছে। একটু মারধরের প্রয়োজন।”

আটোচালক আঙুল তুলে বলল, “অ্যাই মাগি, মুখ সামলে কথা বল! জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব!”

তরুণী ঝুঁকে পড়ে হাঁ করে বলে, “নিন, জিভ ছিঁড়ে নিন।”

বিহান এতক্ষণ চুপ করে ছিল এবার আর পারে না। এগিয়ে গিয়ে উদ্ধত ছেলেটিকে বলে, “আপনি এসব কী বলছেন!”

অটোচালক বলল, “বেশ করছি। শালি আমাকে চমকায়…”

তরুণী এবার কষিয়ে একটি চড় মারে। চালক ছেলেটি ছিটকে পড়ে। তরুণী শান্তভাবে সিটে হেলান দিয়ে বলে, “আর একটা চড় খেতে না চাইলে গাড়ি চালান।”

ছোকরা চালক অটো ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে অটো থেকে নেমে বিহানের সঙ্গে তরুণীর কথা হয়। আলাপও হয়।

এই মেয়ে যে গুন্ডা প্রকৃতির তা তো বোঝাই যাচ্ছে। বিহান জানে, মুখে যতই তাচ্ছিল্য করুক, ধমক দিক, এই মেয়ে তার নানাবিধ খেপামিকে প্রশ্রয় দেয়। তারই একটা হল এই ফোটো তোলা।

দোতারা মনে মনে অশান্ত। শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে বাবা সংসারের ডালপালা অনেকটাই ছেঁটে ফেলেছে। মা এবার গাছটা পুরো কেটে ফেলতে চাইছে। বাড়ি ছেড়েছে। বাবাকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছে। বাড়ি ছাড়ার পরও মাঝেমধ্যে এসেছে। তবে বাবা বাড়ি না থাকলে। এখন আর আসছে না। দোতারা তিন জায়গায় ভাগ করে থাকে। হস্টেল, কসবার ফ্ল্যাটে এবং সল্টলেকে মা আর দিদার কাছে। বেশি সময়টাই অবশ্য হস্টেলেই কাটায়। দিদিমার বয়স হয়েছে। তিনি মেয়ে-জামাইয়ের ঘটনায় ভেঙে পড়েছেন। নাতনিকে মধ্যস্থতা করতে বলেন। বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়েছে। তবে তার পিছনে শুধু নাওডুবিতে গিয়ে চাষ করা নয়, অন্য ঘটনাও আছে। ত্রপা নামে একটি মেয়ে মঞ্চে উদয় হয়েছে। বাবার ‘নায়িকা’, মায়ের ‘খলনায়িকা’। বাবা ফসল ফলাতে গিয়ে হাঁটুর বয়সি একটা মেয়ের প্রেম পড়ে গেল! নাকি খবরে কোনও গোলমাল আছে? এই কথাটা বলতেই সেদিন সোমদত্তা রেগে আগুন হয়ে গেল।

“তুই কী বলতে চাস?”

দোতারা বলল, “বলতে চাই, ঘটনা সত্যি তো?”

সোমদত্তা মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই কী বলছিস? তোর বাবার নামে বানিয়ে বানিয়ে এত বড় একটা অ্যালিগেশন আনছি?”

দোতারা বলল, “তুমি নিজে থেকে আনছ না, তোমার লইয়ার হয়তো মামলার সুবিধের জন্য আনতে বলেছেন।”

সোমদত্তা বলল, “চুপ কর। বাবার হয়ে আর ওকালতি করতে হবে না। জেনে রাখ, ওই সব চাষবাস, সহজ জীবন, এসব তোর বাবার মিথ্যে কথা ছিল। মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে থাকবে বলে সংসার ছেড়ে পালিয়েছে।”

দোতারা বলল, “কেন? বাবা, তোমাকেও তো যেতে বলেছিল।”

সোমদত্তা ফোঁস করে ওঠে, “মানে! আমি তোর বাবার সঙ্গে থেকে চাষ করব? লেখাপড়া শিখেছি মাঠে গিয়ে এক হাঁটু জলকাদায় দাঁড়িয়ে ধানের চারা পুঁতব বলে? গোরুর দুধ দুইব? তোর বাবা তো একটা গোরু আর দুটো ছাগল পুষেছে শুনলাম।”

দোতারা বলল, “কেন ক্ষতি কী? এখন লেখাপড়া অনেকেই করে মা। শিক্ষিত মানুষও চাষবাস করে।”

সোমদত্তা লম্বা করে শ্বাস টেনে বলে, “আমার সঙ্গে রসিকতা করবি না দোতারা। আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল, তোর বাবা চাকরিবাকরি ছেড়ে চলে যেতে চাইছে কেন! ভেবেছিলাম, আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে মত বদলাবে। বউ-মেয়ের চেয়ে ধানখেতের টান নিশ্চয় বেশি নয়। তাতেও দেখলাম কিছু হল না। তখন বুঝতে পারিনি, এখন পারছি, ওই মেয়েটাই আসল কালপ্রিট। ওই আমার সর্বনাশ করেছে।” একটু থেমে দম নিয়ে থমথমে গলায় আবার বলতে শুরু করল, “ওই মেয়ে তোর বাবার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। বেশি বয়েসে অমন একটা ছুকরি হাতে পেয়ে নিজের স্ত্রী মেয়েকে ভুলে গিয়েছে… এরা আসলে কলগার্ল, প্রস্টিটিউট…শাঁসালো কাউকে পেলে ভদ্রলোক সেজে চেপে ধরে… আমার উকিল বলেছিল, তোর বাবার নামে ফোর নাইনটিএইট-এ কমপ্লেন করতে। আমি রাজি হইনি। তোর বাবা ফেঁসে গিয়েছে, আমি চাই বেশ্যাটাকে জেলে পুরতে। শি ইজ় দ্য কালপ্রিট। সে তোর বাবাকে হানিট্র্যাপে ফেলেছে, এরপর চিট করবে। নইলে হঠাৎ তোর বাবা জঙ্গলে গিয়ে থাকবে কেন? তার তো মাথা খারাপ হয়ে যায়নি!”

কথা শেষ করে সোমদত্তা হাঁপাতে লাগল।

দোতারা ঠান্ডা গলায় বলল, “মা, তুমি রেগে আছ। তার জন্য বাবাকে যা বলছ বলো, সে রাইট তোমার আছে। ভদ্রলোক তোমার স্বামী। কিন্তু একজন অচেনা মেয়ে সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলা তোমার উচিত নয়। যেটুকু শুনছি, তুমিও বলেছ ওই মেয়ে তোমার মেয়ের বয়সের কাছাকাছি বয়সের। হয়তো ইমফর্মেশনে ভুল রয়েছে। ইভেন ইফ শি ইজ় আ কল গার্ল, তা হলেও তুমি এই অপমান তাকে করতে পারো না। কল গার্লকেও কল করতে হয় মা। কেউ তাকে ডেকেছে।”

সোমদত্তা চিৎকার করে বলে, “তুই আমাকে জ্ঞান দিস না। একশোবার বলব, হাজারবার বলব। শি ইজ় আ হোর, আ হোর, আ হোর…”

দোতারা সামান্য হাসল। বলল, “মা, তুমি চিৎকার করতে পারো, কিন্তু এই শিক্ষা তুমি তো আমাকে দাওনি। মেয়েটি সম্পর্কে তো তুমি কিছুই জানো না মা, শুধু জানো, সে বাবার পরিচিত। তার নামে এই নোংরা কথাগুলো বলা কি ঠিক হচ্ছে? হচ্ছে না। মেয়েটাকে যেমন অপমান করা হচ্ছে, তেমন প্রস্টিটিউশন করতে যারা বাধ্য হয় তাদেরও অপমান করা হচ্ছে।”

সোমদত্তা খেপে উঠে বলল, “অপমান কী দেখলি, ওই বেশ্যাটাকে হাতের কাছে পেলে খুন করব।”

দোতারা বলল, “মা, বলতে খারাপ লাগছে, তারপরেও না বলে পারছি না। সামান্য এক বেশ্যা কিন্তু অতি সহজে তোমার কাছ থেকে বাবাকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছে। তুমি আটকাতে পারলে না? এত তো চেহারা, রূপ, কেরিয়ার, স্টেটাস নিয়ে কনসার্ন ছিলে, তাতেও লাভ হল না? মাটির দেওয়ালের মতো এক ধাক্কায় ভেঙে গেল! শুধু বাইরেটাই দেখেছ এতদিন, নিজের ভিতরটা একবার তাকিয়ে দেখলে না? ওই মেয়েটি প্রস্টিটিউট হলেও তার গর্ব করা উচিত। শিরীষ মুখার্জির মতো মানুষকে জয় করেছে।”

এরপরই সোমদত্তা সোফা ছেড়ে উঠে এসে দোতারার গালে একটা চড় কষায়।

চুপ করে যায় দোতারা। এই ধাক্কায় নিজের ভুল বুঝতে পারে। কথাটা বেশি কড়া কথা হয়ে গিয়েছে। অষ্ফুটে বলে, “সরি মা।”

দোতারা নিজের মনে ঝাড়া দিল। এসব মাথায় রাখলে চলবে না। স্বাভাবিক হতে হবে।

“অ্যাই বিহান, তোর কাছে আর কাচা জামাটামা কিছু আছে?”

বিহান ক্যামেরা নামিয়ে বলল, “কেন?”

দোতারা বলল, “গা মুছব। এটা ভিজে গিয়েছে।”

বিহান বলল, “তোকে তো কাচা দুটো জামাই ওয়ার্ডরোব থেকে বের করে দিলাম। একটা তো পরেছিস, আর একটা গামছা বানিয়ে মাথা মুছছিস। ক’টা জামাকাপড় রাখব? মাসখানেক লন্ড্রি যায়নি এমন কিছু দিলে চলবে?”

দোতারা একটু চুপ করে থেকে বলল, “আজই শালা চুল কেটে ফেলব। তোর ফোটোতে ইয়ে। আমার যদি হাঁচি হয় না দেখবে তোমার কী করি। ওই প্লাস্টিকের কঙ্কাল আর লাগবে না। তোকে মেরে কঙ্কাল বানিয়ে ঝুলিয়ে দেব।”

বিহান গদগদ গলায় বলল, “দো, মনে হয় না, আর তোকে চুল বড় রাখতে হবে। আজই ফোটো পেয়ে যাব। কে জানে এতক্ষণে হয়তো পেয়ে গিয়েছি। একটা বেডকভার দেব? মাথা মুছবি?”

দোতারা কড়া চোখে বিহানের দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল, “দাঁড়া, তোর ফোটো তোলা বের করছি।” বলতে বলতে ফট করে গায়ের টিশার্টটা খুলে ফেলল দোতারা। একবারে খালি গা। তারপর হাতের টিশার্ট দিয়ে গা মুছতে শুরু করল এমন একটা ভঙ্গিতে যেন কিছুই ঘটেনি। বিহান থমকে গেল। সত্যি, ক্যামেরা তুলে নেওয়ার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। সে ডাক্তারি পড়ছে। মানুষের নগ্ন শরীর দেখার অভিজ্ঞতা তার অনেকদিনই হয়েছে। কিন্তু নগ্নতা এমন সুন্দর হয় জানা ছিল না। এত অপূর্ব শরীর সে আগে কখনও দেখেনি। কল্পনাও করতে পারে না। নাকি শরীর তার পছন্দের মানুষের বলে এমন মনে হচ্ছে? হতে পারে। যা খুশি হোক। দোতারার গলায়, স্তনে, পেটে, নাভিতে সে বিহ্বল হয়ে গেল।

দোতারা হাতের বই সরিয়ে মুখ তুলে তাকাল। গাঢ় স্বরে বলল, “কাছে আয় বিহান। মনটা খুব অস্থির লাগছে। আমাকে একটু বুকে নে।”

বিহান ক্যামেরা সরিয়ে হামা দিয়ে এগিয়ে এল। দোতারা চোখ নামাল। খুব যত্ন করে দোতারার প্যান্ট খুলতে লাগল বিহান। নিজেরই তো প্যান্ট, কোথায় ইলাস্টিক, কোথায় বোতাম, জানা আছে সবই, তবু হাতড়াতে লাগল।

এক সময়ে নগ্ন বিহানকে নিজের শরীরে নিতে নিতে দোতারা বলল, “আমাকে শান্ত করে দে… প্লিজ় আমাকে শান্ত করে দে…”

ক্লান্তি আর তৃপ্তি নিয়ে দু’জনে শুয়েছিল পাশাপাশি। বিহানের বুকে হাত রেখে দোতারা বলল, “আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবি?”

দোতারাকে আরও কাছে টেনে বিহান তার গালে নাক ঘষতে ঘষতে আদুরে গলায় বলল, “যাব যাব…তুই যেখানে বলবি যাব…মরতে বললে মরব…”

দোতারা চুলের মুঠি ধরে বিহানের মুখ, তার নগ্ন, উদ্ভাসিত স্তনের ওপর নিতে নিতে বলল, “তা হলে চল তোকে আবার মেরে ফেলি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *