মাটির দেওয়াল – ৫

শিরীষ মেয়েকে ফোন করল।

“তারা, বাড়িতে কবে আসছিস?”

দোতারা বলল, “দিন দশেকের আগে নয় বাবা। খুব চাপে আছি। মনে হচ্ছে, সামনের সেমেস্টারে ফেল করব। মনে হচ্ছে বলা ভুল, করবই। ফেল করলে খুবই সমস্যা হবে। প্রথমেই স্কলারশিপ ঘ্যাচাং হবে। তোমার কাছে হাত পাততে হবে।”

শিরীষ হাসল। দোতারা এই কথা ছোটবেলা থেকে বলে আসছে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগের দিন গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিল। সোমদত্তা অধীর হয়ে বলল, “কী রে, তোর না কাল ফিজ়িক্স পরীক্ষা? এখনও ঘুমোচ্ছিস!”

ঘুম জড়ানো গলায় দোতারা বলেছিল, “ফেল নিশ্চিত, তাই পড়ে সময় নষ্ট করব না মা। আমাকে ঘুমোতে দাও। খুব টেনশন হলে তুমি আমার বইগুলো নিয়ে রিভাইজ় করো।”

মেয়ের কথা শুনে সোমদত্তার তো মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা। মেয়ে এসব কী বলছে! তখনই শিরীষকে ফোন করে বসে। শিরীষ ছিল অফিসে।

“সোম, আমি একটা মিটিং-এ ঢুকব। কঠিন কোনও সমস্যা না হলে পরে কথা বলি?”

সোমদত্তা চাপা গলায় ধমক দিয়ে ওঠে, “রাখো তোমার মিটিং। মেয়ে বলছে সে নাকি ফিজ়িক্সে ফেল করবে। ফিজ়িক্সে গোলমাল করার অর্থ বুঝতে পারছ? গোটা কেরিয়ারটা নষ্ট।”

শিরীষ অবাক হয়ে বলেছিল, “ফিজ়িক্সে কম নম্বর হলে জীবন নষ্ট এমন কথা তোমায় কে বলেছে সোম! পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ আছে যারা ফিজ়িক্স পড়েনি। তারা এক-একজন মনীষী।”

সোমদত্তা দাঁত কিড়মিড় করে বলে, “তোমার মেয়ে কোনও মনীষী নয়, সে একজন অতি সাধারণ ছাত্রী। স্কুলের হাবিজাবি পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া কোনও ঘটনা নয়। এমন বহু ছেলেমেয়ের খবর আমি জানি, যারা পরে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়। ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া মার্কশিট চিবিয়ে খায়। আসল হল হায়ার সেকেন্ডারি। সেখানে না পারলে অতীতের সব রেজ়াল্টে চোনা পড়ে যাবে। তুমি জানো না?”

শিরীষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “মনে হয় জানি না। অত বড় বাপ পরীক্ষা তো আমি দিইনি।”

সোমদত্তা হিসহিসিয়ে বলে, “রসিকতা বন্ধ করো। এটা তোমার কবিতা লেখা বা ছবি আঁকা নয়। তারা বলছে, সে নাকি ফেল করবে।”

শিরীষ সহজভাবে বলে, “একথা তো দোতারা ছোটবেলা থেকে বলে। এত টেনশন করছ কেন!”

সোমদত্তা অবাক গলায় বলে, “সেই বলা আর এখন বলা এক হল! তোমার কি মাথা পুরো গিয়েছে? মেয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ। বলছে, পড়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, তার চেয়ে ঘুমোই!”

শিরীষ নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “ভেরি গুড। পরীক্ষার আগে যদি কেউ না ঘুমিয়ে টেনশন করে তা হলে সেটা চিন্তার। আমি তো পরীক্ষার আগের দিন নাইট শো-তে সিনেমা দেখতে যেতাম।”

সোমদত্তা আবার চাপা ধমকে বলল, “বাজে কথা থামাও। আমি ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে আছি, টেনশনে পাগল পাগল অবস্থা, আর যার পরীক্ষা সে ঘুমোবে?”

শিরীষ বলল, “সোম, মেয়েকে নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই। সে পরীক্ষায় ভাল করবেই, তুমি আজই অফিসে জয়েন করো। নইলে তোমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়তে হবে দেখছি।”

সেই পরীক্ষায় দোতারা ফিজ়িক্সে ফুল মাকর্সের চেয়ে মাত্র তিন নম্বর কম পেয়েছিল। তাই সেদিন যখন ‘সেমেস্টারে ফেল করব’ বলল, শিরীষ হেসে ফেলল। এত বড় হয়েও অভ্যেস যায়নি।

দোতারা বলল, “হাসছ কেন?”

শিরীষ বলল, “ফেল করলে ভালই হবে, ফেল কাকে বলে বুঝতে পারবি। জীবনে ফেল বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। জরুরি এবং ইন্টারেস্টিং।”

দোতারা বলল, “জরুরি হলে নেই, ইন্টারেস্টিং হলে আছি। তোমার কাছ থেকে বহুদিন ইন্টারেস্টিং কিছু শোনা হয় না। তুমি কি আমাকে বাড়ি যেতে বলছ? ডিনারে কথা হবে? ইন্টারেস্টিং টক উইথ ওয়াইন?”

শিরীষ একটু চুপ করে থেকে বলল, “না, বাড়িতে আসতে বারণ করছি।”

দোতারা অবাক গলায় বলল, “বাড়িতে যেতে বারণ করছ! তা হলে মনে হচ্ছে কথা খুবই ইন্টারেস্টিং।”

শিরীষ বলল, “তোর মায়ের সামনে বলা যাবে না। বাইরে কোথাও বসব। কোনও রেস্টুরেন্টে বা কফিশপে। ক্লাবেও যেতে পারি… না, ক্লাব বাদ। হাজারটা চেনা লোককে হ্যালো হাই করতে করতে সময় কেটে যাবে।”

দোতারা উচ্ছ্বসিত গলায় বলেছিল, “ফ্যান্টাস্টিক। পিতা-পুত্রীর গোপন বৈঠক। তবে বাবা, লাঞ্চেই যাই। অনেকদিন ভালমন্দ খাইনি।”

ফাইভ স্টার হোটেলের এক রেস্টুরেন্টে বসেছিল দু’জনে। খাবার নেওয়ার পর শিরীষ মেয়েকে ঘটনা সব বলল। হঠাৎ করে বড়মামার টেলিফোন থেকে নাওডুবিতে গিয়ে জমি দেখে আসা পর্যন্ত সবটাই। ভাল ছাত্রের মতোই দোতারার গুণ হল, কথার মধ্যে সে কিছু বলে না। মন দিয়ে শোনে। এখনও তাই হল। শিরীষ থামলে বলল, “আমি মায়ের মুখে হালকা শুনেছি, কী একটা জমিটমি …কানে গিয়েছে, মনে নিইনি। জমি, বাড়ি, গাড়ি, চাকরি, বিদেশ নিয়ে মা আজকাল বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এসবের বাইরে বেরোতে পারে না। চায়ও না। অফিসের প্রোমোশন নিয়েও আমার কাছে পর্যন্ত গজগজ করে, যেন মায়ের অফিসের বস আমার মেজকাকা, আমি বলে দিলেই টক করে মাকে একটা লিফ্‌ট দিয়ে দেবে। সেই কারণেই মায়ের মুখে জমি-কাহিনি শুনতে আগ্রহ বোধ করিনি। পরে দেখলাম, তুমি যাতায়াত করছ। গিয়ে থাকতেও শুরু করেছ। মায়ের ফোঁসফোঁসানি শুনছি, গালাগালি শুনছি। সল্টলেকে দিদিমার কাছে চলে যাওয়াও দেখছি। মাথা ঘামাইনি। এখন দেখছি ঘটনা গল্পের মতো। ছপ্পড় ফুঁড়ে এতটা প্রপার্টি পেয়ে গেলে?”

শিরীষ বলল, “ঘটনা গল্পের মতো হলেও, আমি আর সেটাকে গল্প রাখতে চাই না দোতারা। বাস্তবে এনে ফেলতে চাই। ইতিমধ্যে অনেকটা এনে ফেলেছি। যাকে বলে, হার্ড রিয়েলিটি।”

দোতারা খেতে ভালবাসে। তার বন্ধুরা খাওয়ার বিষয়ে এই বয়স থেকেই হিসেবনিকেশে চলে গিয়েছে। কোনটা খাব, কতটা খাব, খেলে কতটা চর্বি জমবে, সেই সব হিসেব। রেস্টুরেন্টে গেলে মেনু কার্ড নিয়ে যোগবিয়োগ করে। ফ্যাট, কোলেস্টরলের যোগবিয়োগ। দোতারা বলে, “তোরা খাওয়া নিয়ে মাথা ঘামা, আমার কোনও চাপ নেই। আমি একজন অ্যাস্ট্রলজারকে হাত দেখিয়েছি। তিনি বলেছেন, চিন্তা নেই, তোমার মিস ইন্ডিয়া হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। মিস ইউনিভার্সও হয়ে যেতে পারবে। আমি বললাম তার জন্য কি আমাকে কম খেতে হবে? ভোরে উঠে জিমে ছুটতে হবে? তা হলে ছেড়ে দিন। সুন্দরী স্কিম থেকে সরে অন্য কোনও স্কিমে কেরিয়ার করা যায় কিনা দেখুন। খাওয়াদাওয়া, ঘুমে আমি কোনওরকম স্যাক্রিফাইস করতে পারব না। জ্যোতিষী বললেন, বলছি তো চিন্তা নেই। কোনও কষ্ট করতে হবে না। তুমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবে। একটা মাদুলি দিয়ে দিচ্ছি। সেটা পরতেও হবেনা, বাড়িতে আলমারিতে রেখে দিলেই হবে। মাদুলির নাম সুন্দরীধ্রষ্টা মাদুলি। এতেই যা হওয়ার হবে। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, সুন্দরীধ্রষ্টা মাদুলি! সে আবার কী? উনি বললেন, সুন্দর থাকাকে ধরে রাখতে জানে বলে মাদুলির নাম সুন্দরীধ্রষ্টা। সুন্দরীধ্রষ্টা কাছে থাকলে ছিপছিপে ফিগার, টিকোলো নাক, ফরসা চোখ কোনও ব্যাপার নয়। আমি মাদুলি কালেক্ট করেছি। সো মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস্, তোরা খাস না খাস, আমি পেট এবং মন ভরে খাব।”

বাবার সঙ্গে বসেও দোতারার প্লেট ভরিয়ে খাবার নিতে অসুবিধে হল না।

“গল্পকে হার্ড রিয়েলিটি করবে। সেটা কীরকম?”

শিরীষ খাবার মুখে নিয়ে বলল, “আমি ওই জমি বেচব না ঠিক করেছি। চাষবাস করব। দাদু যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকে সত্যি করব। কাজ শুরু হয়েছে।”

দোতারা খাওয়া থামিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “ওয়ান্ডারফুল! এই না হলে দোতারা মুখার্জীর বাবা? সাধে কি আমি তোমার প্রেমে পাগল ডার্লিং! গালটা বাড়াও, একটা চুমু খাই।

শিরীষ খুশি হল। মেয়ে তার প্রজেক্ট সমর্থন করবে সেটা জানত। কিন্ত কতটা করবে সেটা বুঝতে পারছিল না। নিস্পৃহভাবে? নাকি উচ্ছাস নিয়ে? যদিও এখনও কিছু কঠিন সিদ্ধান্তের কথা বলা বাকি রয়েছে।

দোতারা ছেলেমানুষের মতো আবদার করে বলল, “বাবা, আমি ওই জমি দেখতে যাব…আজই যাব…”

শিরীষ হেসে বলল, “এখন খাও। তোমার মা যদি জানে তোমাকে নাওডুবি নিয়ে গিয়েছি তা হলে আর দেখতে হবে না।”

দোতারা হাত নেড়ে বলল, “মা জানবে না। প্লিজ় বাবা, প্লিজ়। আমার বেশ থ্রিলিং লাগছে।”

শিরীষ শান্ত গলা বলল, “আচ্ছা নিয়ে যাব। কিন্তু এটা থ্রিলড হওয়ার কোনও বিষয় নয় দোতারা। আমি বিষয়টাকে কোনও অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে দেখছি না, দেখছি সিরিয়াস কাজ হিসেবে। তুই বড় হয়েছিস, তোকে বলতে কোনও অসুবিধে নেই। অনেকদিন কেরিয়ারের র‍্যাট রেসে দৌড়োলাম। অনেক দূর উঠেছিও। বিদেশে চলে গেলে আরও টাকা পয়সা, প্রতিপত্তি হবে। কোম্পানি আমাকে ফিলাডেলফিয়ায় পাঠাবে বলে ভেবেছে। সেখানকার অফিসে বসাবে। দু’-একমাস পরে আমাকে মুম্বই ডেকে ফাইনাল করবার কথা। কিন্তু আমার এ জীবন আর ভাল লাগছে না। দমবন্ধ লাগছে, হাঁপিয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে, এবার এমন কিছু করব যা নিজের ভাল লাগে। এরপর আর পারব না। বয়স বেড়ে যাবে। কী জানি অসুখ বিসুখ চেপে ধরবে কিনা। সংসারের জন্য, নিজের বাড়ি-গাড়ির জন্য অনেক তো হল। তুই আমার একমাত্র সন্তান, সেই সন্তান এখনই নিজের পায়ে অনেকটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিস। তারপরেও ব্যাকআপ থাকবে। তোর নামে ফিক্সড রেখে দিচ্ছি। তোর মা-ও চাকরি করছে। আমার উপর তোরা আর পুরো ডিপেন্ডেন্ট নোস। কিছু সেভিংসও তো রয়েছে। তিরিশটা বছর তো এভাবে কাটালাম। এই জমি আমাকে একটা অদ্ভুত সিচুয়েশনের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। একদিকে চ্যালেঞ্জ, নতুন ভাবে জীবনের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ, আর একদিকে সরু মই বেয়ে কেরিয়ারের মাথায় উঠতে থাকা। যে মইয়ের শেষ নেই, যে মই টলমলে, ক্লান্তিকর।”

বাবার জন্য মন খারাপ হল দোতারার। সে অস্ফুটে বলল, “তোমার যা খুশি, তাই করো বাবা।”

শিরীষ নিজেকে সামলে হেসে বলল, “যা খুশি করা কি অত সহজ? তোমার মা আমাকে কতটা বোঝে জানি না, তবে এটা আর পারছে না। সে বিদ্রোহ করেছে। সে আমার ভিতরের এই অংশটাকে চেনে না। কখনও একটু আধটু চিনলেও পাত্তা দেয়নি। আমিও কি জানতাম, এরকম একটা অনিশ্চিত জীবন আমাকে এভাবে টানবে? চাষবাস করব এমন কথা কখনও ভাবিনি। কেনই বা ভাবব? কোনও কারণ ছিল না। আমি তো আমার দাদুর মতো রিটার্ন টু রুটস্-এর স্বপ্ন দেখিনি। হয়তো প্রাচীনকালে আমার পূর্বপুরুষরা চাষবাস করতেন। সেই শিকড় জিনের কোথাও রয়ে গিয়েছে। এতদিন সে ছিল চুপ করে, ডরম্যান্ট হয়ে, এখন মাথা চাড়া দিয়েছে। তোমার মা কী করে এসব মেনে নেবে? সে একজন চাষির বউ হতে রাজি নয়। খুব অশান্তি শুরু করেছে।”

দোতারা অবাক হয়ে বলল, “কেন! মায়ের কী সমস্যা? কত বড় বড় মানুষের তো ফার্মহাউস থাকে। সারা পৃথিবীতেই তো আছে। এটা তো নতুন কিছু নয়। উইকেন্ডে গিয়ে ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। এটাই তো ফ্যাশন। মা-ও সবাইকে বলতে পারবে। তুমি বছরে একবার দু’বার আমেরিকা থেকে এসে নিজের ফার্মহাউসে দু’দিন থেকে আসবে। আমি পিকনিকে যাব। এতে মায়ের রাগ করার কী হল?”

শিরীষ কাঁটা-চামচ রেখে প্লেট সরিয়ে দিল। তার লাঞ্চের পরিমাণ সবসময়ই কম। অনেকদিনই শুধু ফল খেয়ে থাকে। সেদিন মেয়ের জন্যই নিয়েছিল।

“দোতারা, সমস্যা এখানেই। এটা কোনও ফার্মহাউস হচ্ছে না। উইকেন্ডে গিয়ে পিকনিক করার জায়গা নয়। আমি সিরিয়াসলি চাষের কথা ভেবে প্রজেক্ট করেছি। নাওডুবি প্রজেক্ট। ফসল, সবজি, বাজারে পাঠিয়ে বিক্রি করা হবে। খরচাপাতি বাদ দিয়ে বাকি টাকা হবে আমার উপার্জন। যেভাবে আর পাঁচজন চাষি চাষবাস করে বেঁচে থাকে, আমি সেভাবে থাকতে চাই। ছেলেখেলা নয়। প্রকৃতি নিয়ে রোমান্টিসিজ়ম নয়। কলকাতার পলিউশন ভাল লাগছে না বলে, গ্রামে গিয়ে থাকার ন্যাকামি নয় এটা। আমি নিয়মিত গিয়ে থাকছি। হইহই করে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। তুই কি ভাবতে পারিস তোর বাবা এখন, ধানগাছের বীজতলা কীভাবে করতে হয় তাও জেনে গিয়েছে?”

দোতারা অস্ফুটে বলল, “বীজতলা কী!”

শিরীষ হেসে বলল, “দেখ দেখি, রোজ ভাত খাস কিন্তু বীজতলা কী জানিস না। আমিও জানতাম না। সবাইকে সব জানতে হবে এমনও নয়, তবে কারও তো জানতে ইচ্ছে করতেও পারে। পারে না? যেমন আমার করেছে। শুধু বই পড়ে নয়, একেবারে হাতেকলমে কাজ করে জানতে চাই।”

দোতারা চোখ সরু করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী জানলে?”

শিরীষ উৎসাহ নিয়ে বলল, “আমাদের জমিতে এখনও বীজতলার সময় আসেনি, তবে আসবে। প্রথমে সার ছড়াতে হবে। অর্গ্যানিক সার। এই ধর, বর্গমিটার পিছু দু’কেজির মতো। তারপর ভাল করে জল দাও। দুই থেকে তিনবার মই চাষ চাই। মই চাষ কী জানিস? জানিস না তো? লাঙলে ফলার জায়গায়, সত্যিকারের মই লাগিয়ে দেওয়া হয়। ল্যাডার। অসমান জমি সমান হয়। সেই মইয়ের উপর লোক দাঁড়িয়েও পড়ে। আমি ভেবেছি, আমাদের জমিতে যখন মই চাষ হবে, আমি মইয়ের উপর দাঁড়াব। মজা হবে না?”

দোতারা মুখে খাবার নিয়ে বলল, “বুঝতে পারছি না এখনও। আরও একটু বলো।”

শিরীষ দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করল।

“মই চাষের পর জমিতে দশ-বারো দিনের মতো জল দাও আটকে। একসময়ে তোর ওই খড়, আগাছা সব যাবে পচে। আবার মই চাষ। জমি হয়ে যাবে থকথকে কাদা। ব্যস, তোর বীজতলা তৈরি। শুধু ইলেকট্রনিক্স জানলে হবে? বীজতলাও জানতে হবে।”

কথা শেষ করে জোরে হেসে উঠল শিরীষ। দোতারার চোখ আরও সরু হয়ে গেল। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে, জমিতে কাদা তৈরি করতে পেরে ভীষণ খুশি হয়েছে। এর মানে কী?

দোতারা অবাক হয়ে বলল, “তোমার ওই নাওডুবি গ্রামে গিয়ে পড়ে থাকার বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করা যাবে?”

শিরীষ একটু চুপ করে থেকে বলল, “করা যাবে। আমি ভেবেছি, উইকেন্ডে যাব না, বরং উইকেন্ডে কলকাতায় আসব। ক্লিয়ার?”

“মানে! তুমি গ্রামে গিয়ে থাকবে?”

শিরীষ হেসে বলল, “গ্রামে নয়, জমিতে মাটির ঘর বেঁধে থাকব। খড়ের চাল, মাটির দেয়াল। আমাদের জমি থেকে প্রপার গ্রামটা বেশ দূরে। যেমন ফাঁকা, তেমন নির্জন, তেমন সুন্দর। দিগন্ত পর্যন্ত দেখা যায়। ট্রেনে যেতে যেতে মাঝেমধ্যে এরকম দৃশ্য দেখা যায়। যতদূর চোখ যায় খেত আর খেত। জায়গাটা ঠিক তেমন। দিনে পাখা নেই, রাতে হ্যারিকেন। জল পড়লে এক হাঁটু কাদা। সাপখোপ খুব। শিয়ালও আছে। মাঠে গর্ত করে থাকে। হেলথসেন্টার সেই সবেরগঞ্জে। ঘণ্টাখানেকের মামলা। ডাক্তার বদ্যির ব্যাপার নেই। ঠিক করেছি, তোর সঙ্গে কোনও ডাক্তারের বিয়ে দেব। দরকার হলে সে-ই ছুটে গিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের চিকিৎসা করে আসবে।”

একটু থামল শিরীষ। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “কী ম্যাডাম, এবার তো আর মুখ দিয়ে ‘ওয়ান্ডারফুল’ বেরোচ্ছে না। ঘাবড়ে গেলি?”

দোতারা সত্যি থমকে গিয়েছিল। খাবার মুখে দিয়ে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল। বলল, “সবই ওয়ান্ডারফুল বাবা। তুমি তোমার দাদুর রিটার্ন টু রুটস-এর স্বপ্ন নিজেও দেখতে শুরু করেছ। ভেরি গুড। কিন্তু হেল্‌থ নিয়ে একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে না কি? যারা গ্রামে জন্মেছে, বড় হয়েছে, তারা অনেক ধরনের অডস্ মানিয়ে নিতে পারে। তাঁদের শরীর এবং মন অনেক অসুবিধের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ় করে নেয়, বাধ্য হয়। তাঁরা নিজেদের সেভাবে প্রতিনিয়ত অ্যাডাপ্ট করেন। সাপের কামড় খেয়েও লড়তে হয়। গ্রামের কত ইনটেলিজেন্ট, স্টুডিয়াস মেয়েরা মাইলের পর মাইল দূরের স্কুল কলেজে পড়তে যায়। কেউ সাইক্লিং করে, কেউ হাঁটে। আমাকে বললে পারব? পারব না। আমার অভ্যেস, শরীর রিফিউজ় করবে। তুমি এই আরবান লাইফস্টাইল ছেড়ে ওখানে মানাতে চেষ্টা করলেও কি তোমার শরীর তা মানবে?”

শিরীষ বলল, “না, মানবে না। তারপরেও আমি চেষ্টা চালাচ্ছি। স্বপ্নের মধ্যে অনেক দুঃস্বপ্নও থাকে। সেসবও ফেস করতে হয়। দাদু তাঁর উইলে তো লিখেই গেছেন, শরীরের কারণে তিনি প্রজেক্ট থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। তেমন অসুবিধে হলে আমিও ফিরে আসব। শুরু তো করে ফেলেছি। সমস্যা নিয়েই করেছি। একটা একটা করে সল্‌ভও করছি। তুইও তো বাড়ির সুখস্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে হস্টেলে গিয়ে থাকছিস, থাকছিস না?”

দোতারার খাওয়া শেষ হয়েছে। কথায় কথায় বেশি খাওয়া হয়ে গেল। মুখ মুছতে মুছতে শান্তভাবে বলল, “আমার থাকা আর এই বয়সে তোমার জনমানবশূন্য কোথাও গিয়ে থাকাটা কি এক হল? দশ-বারো বছর আগে হলে একটা কথা ছিল।”

শিরীষ হাতের ইশারায় বিল চায়। তারপর বলল, “দেখ তারা, আরও দশ-বারো বছর আগে এই জমি যদি পেতাম, কিছুতেই যেতাম না। আমি শিয়োর। তখন এই কর্মজীবন সম্পর্কে আমার মোহভঙ্গ হয়নি। ক্লান্তি আসেনি। স্বাধীনভাবে, মনের মতো কিছু করব এই ভাবনাটা যেমন খুব কম বয়সে আসে, তেমন বেশি বয়সেও আসে। কম বয়সে বড় চাকরিবাকরি ছেড়েছুড়ে অনেকে নানা ধরনের কাজ করছেন। বিজ়নেসই বল আর ক্রিয়েটিভ কাজই বল। লিস্টে সব বড় বড়, খ্যতিমান মানুষরা আছেন। কিন্তু বেশি বয়সে ‘নতুন কিছু করব’ ভেবে কোনও লাভ হয় না। শুধু ভাবনাটুকুই হয়। বাকি জীবন আফশোস করে কাটাতে হয়। আমি এটা বদলাতে চাই। দেখি না, পারি কি না দেখি। আমি তো বড় বিজ়নেস বা ক্রিয়েটিভ কিছু করতে চাই না। শান্ত, স্নিগ্ধ, ভেজালহীন একটা জীবন চাইছি। অন্যের চাষ করা ফসলে খেতে পারলে নিজে চাষ করে খেতে সমস্যা কোথায়?”

দোতারা বলল, “না সমস্যা কিছু নেই। তবে তুমি কি ওখানে পাকাপাকি থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ?”

শিরীষ বিল মিটিয়ে কার্ড ওয়ালেটে রেখে বলল, “কাজ শুরু হওয়ার পর কিছুদিন তো থাকতে হচ্ছেই। খুব ইন্টারেস্টিং! চাষবাস, জমিজমা, ফসল নিয়ে কত কী জানতে পারছি! তোকে একদিন চিঠি লিখে ফেলেছিলাম পর্যন্ত। দেখা যাক, এরপর কী হয়।”

দোতারা একটু চুপ করে থেকে বলল, “বাবা, শহর ছেড়ে, শহরের ভাল চাকরি ছেড়ে, অপরচুনিটি ছেড়ে, গ্রামে চলে যাওয়ার গল্প কম নেই। সারা পৃথিবীর গল্প উপন্যাস ঘাঁটলে এরকম অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে। সিনেমা, থিয়েটারও রয়েছে। শহরের ব্রাইট ছেলেমেয়ে গ্রামে চাষ করতে চলে যাচ্ছে, ফার্মহাউস করতে চলে যাচ্ছে, ডাক্তারি করতে যাচ্ছে, পড়াতে যাচ্ছে, রাজনীতি করতে যাচ্ছে। তবে এগুলো গল্প, উপন্যাস, সিনেমাতেই কি ভাল নয়? নিজের জীবনের সঙ্গে কি খাপ খাবে?”

শিরীষ একটু চুপ করে থেকে বলল, “তোকে তো আগেই বলেছি, গল্প উপন্যাস বা সিনেমার রোমান্টিসিজ়মের সঙ্গে আমার ভাবনার পার্থক্য রয়েছে। আমি একটা বিরাট নতুন কিছু করতে চাই, এমনও ক্লেম করিনি। আমি যেমন চাষ করার আনন্দ পেতে চাইছি, স্ট্রাগলটাও দেখতে চাইছি।”

দোতারা চুপ করে রইল। সে বাবার যুক্তির মধ্যে অনেকগুলো ফাঁক দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সেই ফাঁক এখন মানুষটাকে দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। মানুষটা একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ঘোরে যুক্তি কাজ করে না, সময় দিতে হবে। ঘোর কাটতে শুরু করুক। বাবা যে জীবনযাপনের কথা ভাবছে, সেটা পারবে না। সিস্টেম পারতে দেবে না। মোহভঙ্গ হবে। তবে বড় কোম্পানির চাকরিবাকরি ছেড়ে গাঁয়ে গিয়ে চাষ করার ভাবনাটিকে স্যালুট জানাতে হয়। শুধু শিকড়ে ফেরার রোমান্টিসিজ়ম নয়, বুকের পাটা থাকলে এই কাজ করা সম্ভব। সে বাকি গোটা জীবনটার জন্যই তোক আর একদিনের জন্য হোক। দোতারা বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “উইশ ইউ বেস্ট অফ লাক, বাবা। চলো, আমাকে হস্টেলে নামিয়ে দেবে।”

এই কথার কিছুদিন পরে সোমদত্তা দেখতে পেল, তার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, এমবিএ করা, নামী কোম্পানির উঁচুপদে চাকরি করা স্বামী শুধু আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করল তাই নয়, একদিন দুম করে চাকরিটাই ছেড়ে দিয়ে বসল। পরদিন সোমদত্তা ব্যাগ গুছিয়ে সল্টলেকে তার মায়ের কাছে চলে যায়। যাওয়ার সময় মেয়েকে বলে গেল, “দোতারা, তুমি বড় হয়েছ, তুমি ঠিক করো কোথায় থাকবে। আমার সঙ্গে না তোমার বাবার সঙ্গে। তোমার সিদ্ধান্তু যাই হোক, আমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকতে পারব না। চাষবাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বইতে লেখা হয়, কৃষক সমাজের বন্ধু। আমিও তাই মনে করি। কিন্তু সরি, আমি একজন চাষির বউ হয়ে বেঁচে থাকতে পারব না। হয় তোমার বাবার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, নয়তো ঘটনা অন্য কিছু।”

দোতারা বলল, “কী অন্য কিছু?”

সোমদত্তা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “দোতারা, তোমার বাবার ব্যাপারে কিছু কিছু কথা আমার কানে আসতে শুরু করছে। কথাগুলো যদি সত্যি হয়, ওই সব চাষবাস, দাদুর স্বপ্ন, গ্রামের স্নিগ্ধ, সরল জীবনের কথা গল্প মাত্র। তোমার বাবার নাওডুবিতে ঘর বানিয়ে থাকার কারণ সম্পূর্ণ অন্য। সে কারণ খুবই লজ্জার। আমি আর কিছুদিন অপেক্ষা করব, তারপর কোর্টে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *